বাদালোনা-র সেই লাশটি
ভুল যত সামান্যই হোক না কেন, তা যে সব সময়েই বুঝতে পারা যায় না–তা নয়। কিন্তু কঠিন হল এই ছোট্ট ভুল শুধরোনো। বিশেষ করে আপনি যদি সত্যান্বেষী অপরাধবিশেষজ্ঞ হন, আর রহস্য সমাধানের গুরুভার যদি চাপানো হয় আপনার কাঁধে–তাহলে এই ছোট্ট ভুলই যে শেষকালে কি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে, তা শুধু আপনিই হাড়ে হাড়ে টের পান। তদন্তের শুরুতেই যদি কোনওরকমে ভুলপথে চালিয়ে দেওয়া যায় আপনাকে, তাহলেই তুমুল বিপর্যয়ের মাঝে পড়ে সম্পূর্ণ বিপন্ন হয়ে পড়তে আপনি বাধ্য।
প্রথম থেকেই আমার কেন জানি মনে হয়েছিল বাদালোনার খুনের কেসটাতে রহস্য রয়েছে প্রচুর। আপাতদৃষ্টিতে যত সরল মনে হয়েছিল, তত সরল নয় কেসটি। সমস্ত হত্যাপর্বটা এমনই গোলমেলে যে মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিল আমার। খবরের কাগজে বর্ণিত লোমহর্ষক নাটক হিসাবেই প্রথম শুরু হয়, কাহিনি। স্বভাবমতো সাংবাদিকরা দিব্বি চাঞ্চল্যকরভাবেই পরিবেশন করেছিল খবরটা। কিছু কিছু আবছা ইঙ্গিত আর সম্ভাবনাও উল্লেখ করতে ভোলেনি। ১৯৩২ সালের মার্চ মাসের শেষাশেষি শুরু হয় এই সংবাদ-পত্ৰ নাটকের। বাদালোনার একটা ভিলায় মাটির নীচে একটি যুবতী মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছে। বাদালোনা অবশ্য বার্সিলোনার কাছেই। সম্ভবত মাসখানেক আগে খুন করা হয়েছিল মেয়েটিকে। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তার বিকৃত দেহ। মুখ দেখে জানার উপায় ছিল না তার প্রকৃত পরিচয়। কিন্তু এইটুকু বোঝা গিয়েছিল যে বছর তিরিশ হবে তার বয়স।
বাড়িটা একতলা। মালিকের নাম অ্যান্তোনিও ক্যারিরা জানকোসা। মাস তিনেক আগে আর্জেন্টিনার এক ভদ্রলোককে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। ভদ্রলোকের নাম অরিলিও মার্তিনেজ। নিজেকে আর্জেন্টিনার বাসিন্দা বলে দাবি করলেও আসলে তিনি ছিলেন স্পেনের অধিবাসী।
লাশ পাওয়ার একমাস আগে এই ভদ্রলোকই বাড়ির চাবি মালিকের হাতে তুলে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। দিনকয়েক পরে ঘরদোর তদারক করতে এলেন জাকোসা। তখনই কীরকম একটা গন্ধ পেলেন উনি। শুধু তাই নয়। লক্ষ্য করলেন মেঝের কয়েকটা টালিও আলগা হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের শরণ নিলেন জাকোসা। ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন মেঝের টালি সরিয়ে পরীক্ষা করা হোক। মাটি খুঁড়তেই পাওয়া গেল মেয়েটার দেহ। একটা থলির মধ্যে হাত-পা বাঁধা লাশটা ঠেসে সযত্নে সেলাই করে দেওয়া হয়েছিল মুখটা।
ড্রেসিং গাউন ছাড়া আর কিছুই ছিল না মেয়েটির পরনে। খবরের কাগজের সবজান্তারা লিখেছিল, গলা টিপে অথবা মাথায় চোট মেরে জীবনদীপ নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল হতভাগিনীর। লাশ পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন প্রায় তিরিশ বছর তার বয়স।
এখনও মনে পড়ে সেটা হাতে নেওয়ার পর বাদালোনায় গিয়ে কি পরিমাণে দমে গিয়েছিলাম আমি। অল্প কয়েকটি শহরতলী ভিলা দিয়ে গড়ে-ওঠা অঞ্চলটিতে জীবনের চঞ্চল স্রোতস্বিনী যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এরকম নিঝুম নিশ্চুপ জায়গা মোটেই ভালো লাগে না আমার। বিশেষ করে কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না খুন যেখানে হয়েছে, সেই ভিলাটিকে। পূতিগন্ধে ভরপুর বাতাসে যেন দম আটকে আসতে চায়। ঘরের মেঝেতে বিশাল একটা গর্ত দেখলাম। লাশটা থলিতে পাওয়া গিয়েছিল এই ঘর থেকেই।
তন্নতন্ন করে বাড়ি তল্লাস করে একগাদা পরিধেয়, একটা চশমা এবং একটা হাতব্যাগ জড়ো করলাম আমি, কতকগুলো পোশাকে রক্তের দাগ লেগেছিল। বলাবাহুল্য জিনিসগুলো নিহত মেয়েটিরই। সারা তল্লাটে দারুণ গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল খুন যেই করুক না কেন, এই তার প্রথম খুন নয়। পাড়াপড়শীদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে একটু বুদ্ধি খরচ করলেই পুলিশের কর্তারা এই মৃত্যু-ভবন থেকে আরও অনেক লাশ আবিষ্কার করতে পারবে। গুজবগুলো যে নেহাতই গুজব এবং ভিত্তিহীন, তা না বললেও চলবে। সেই কারণেই প্রথমেই বলে নিয়েছি আমি কেসটার প্রকৃত রহস্য ধরতে না পারার ফলেই এতখানি জটিল হয়ে উঠেছিল এই তদন্ত পর্ব।
জটিলতা আরও বৃদ্ধি পেল শবব্যবচ্ছেদ করার পর। তাড়াহুড়ো করে কোনওরকমে ওপরে-ওপরে কর্তব্য শেষ করলেন ডাক্তার। মেয়েটির বয়স পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যে, তথ্য পেলাম তাঁর কাছ থেকেই। ফলে, ওই বয়সের অনেকগুলি মেয়ের নাম পাওয়া গেল। খামোকা খানিকটা সময় নষ্ট করলাম তাদের প্রত্যেকের হদিশ বার করতে। শেষকালে দেখা গেল প্রত্যেকেই জলজ্যান্ত জীবিত।
হত্যা-রহস্য সমাধানে একটা মস্ত বড় বিষয় হচ্ছে মোটিভ অর্থাৎ হত্যার উদ্দেশ্য। প্রত্যেক গোয়েন্দাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মোটিভ নির্ণয় করার জন্যে আদাজল খেয়ে উঠে-পড়ে লাগে। কিন্তু এদিক দিয়েও আমি অসহায়। কেননা, খুনের আগে অরিলিও মার্তিনেজের জীবন সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গ জানতাম না আমি। মাস দুয়েকের জন্যে ভিলায় আস্তানা পেতেছিলেন ভদ্রলোক। তারপর আরও মাসদুয়েক কেটে গেছে, নতুন কোনও ভাড়াটে বসাননি তিনি বাড়িতে। পাড়াপড়শীদের কাছে শুনলাম সন্ধের অন্ধকার না নামলে ভদ্রলোককে বাইরে বেরোতে দেখা যেত না। দেখতে শুনতে যুবাপুরুষের মতোই। মৃদুস্বরে বড় সুন্দর কথাবার্তা বলে চিত্তজয়ের গুণ ছিল তাঁর। কৃশকায়। উচ্চতাও তেমন কিছু নয়। কিন্তু পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে ফুলবাবুটির মতো সেজেগুজে থাকতেন। চেহারার ওপর যে বিলক্ষণ যত্ন ছিল মার্তিনেজের, তা তাঁকে দেখলেই বোঝা যেত।
বাড়ির লিজে সই দেওয়ার সময় আত্ম-পরিচয় দেওয়া আইডেনটিফিকেশন কার্ডটি সংলগ্ন করে রেখেছিলেন মার্তিনেজ। এই কার্ড পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম অনেক যত্ন নিয়ে সই করেছেন ভদ্রলোক। তাইতেই আমার আর তিলমাত্র সন্দেহ রইল না যে এ নাম তার পিতৃদত্ত নয়–ছদ্মনাম। আমি জানি অনেকে মনে করেন Graphology অর্থাৎ হাতের লেখা পরীক্ষা করে চরিত্র নিরূপণের শাস্ত্রে নাকি কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তাঁদের সঙ্গে এ সম্পর্কে একমত নই আমি। ঠিকানা ছাড়া কার্ডে যা কিছু তথ্য পাওয়া গেল, তা ডাহা মিথ্যা। ঠিকানা দেওয়া ছিল ১০ নং ক্যাল্লি দ্য টলার্স, বার্সিলোনা। গেলাম সেখানে। বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের ভার ছিল যে স্ত্রীলোকটির ওপর, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম অরিলিও মার্তিনেজ বলে কেউ এ-বাড়িতে থাকতেন কিনা? বাড়ির মালিকের কাছে। আমাকে নিয়ে গেল সে এবং তার কাছেই জানলাম অরিলিও মার্তিনেজের নাম এ-বাড়ির কেউ এর আগে শোনেনি। কিন্তু সহজেই হাল ছাড়বার পাত্র নই আমি। নামটা যে আসল নয়, তা তো আমি জানতামই। কাজেই, মার্তিনেজের চেহারার বর্ণনা দিলাম এবার। কাজ হল তাতে। বাড়িওলা বললেন–হ্যাঁ, হা, চিনি বইকি। বেঞ্জামিন বালসোনাকেই তো এই রকম দেখতে। আমার এই বাড়িতেই কিছুদিন ছিলেন ভদ্রলোক। বড় অল্প কথাবার্তা বলতেন। তাছাড়া বাঁধাধরা জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন না তিনি–বড় বিশৃঙ্খল ছিল তাঁর প্রকৃতি। মাঝে-মাঝে দারুণ টানাটানি চলত। তবে একবার শুনেছিলাম, বার্সিলোনাতে নাকি তার একটা ভিলা আছে।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেল পয়লা নম্বরের জোচ্চোর এই বালাসানো। অনেকগুলো শহরের পুলিশ মহলে বিলক্ষণ নামডাক আছে তার। দূরন্ত জুয়ারি সে, হাতের মারপ্যাঁচেও মহা ওস্তাদ। এ ধরনের লোকদের জীবনে অভাব অনটন আর স্বাচ্ছল্যের যেমন দ্রুত পরম্পরা দেখা যায়, বালসানোও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বালসানো আর অরিলিও মার্তিনেজ যে এক এবং অভিন্ন পুরুষ, তা প্রমাণ করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। ক্যাল্লি দ্য টলার্সের বাড়িওলা আর বাদালোনার প্রতিবেশীদের পুলিশ ফোটোগ্রাফ দেখাতে তারাও একবাক্যে সমর্থন জানাল আমার সিদ্ধান্তকে।
তদন্ত-পর্বের এই পর্যায়ে পৌঁছে অনায়াসেই বালসানোর নামে গ্রেপ্তার পরোয়ানা বার করে দিতে পারতাম। কিন্তু নিহত মেয়েটিকে তখনও শনাক্ত করে উঠতে পারিনি আমি। কাজেই চট করে কিছু করা সঙ্গত মনে করলাম না। এই সময়ে খবর পেলাম, ইউলেলিয়া মাইনো নামে একজন বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে বার্সিলোনাতে প্রায় দেখতে পাওয়া যেত বালসানোকে। গোলগাল নধরকান্তি চেহারা মেয়েটার। চুলের রং কুচকুচে কালো। ক্যাল্লি দ্য লা ক্যাডেনাতে একসঙ্গে একটি ঘরে কিছুদিন ছিল ওরা দুজনে। তারপর উধাও হয়ে যায় বালসানো এবং মেয়েটি। এবং কেউ জানে না বর্তমানে পৃথিবীর কোনও মুলুকে আস্তানা নিয়েছে দুই মূর্তিমান।
আরও খবর পেলাম, ইউলেলিয়া তার সম্মায়ের সঙ্গে গ্রানোলর্স-এ থাকত। সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলাম সেখানে। বিমাতা বাড়িতেই ছিলেন। আমাকে দেখেই না জানি কি হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়েছে। মনে করে রীতিমতো সঙ্কিত আর উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এই বাড়িতেই একটা চিঠির কয়েকটা ছিন্ন অংশ পেলাম। জোড়া লাগাতেই পেলাম পুরো চিঠিটা। ইউলেলিয়ার চিঠি। একজন বন্ধুর সঙ্গে বার্সিলোনা ত্যাগ করে যাচ্ছে সে। বিমাতার কাছে তার অনুরোধ তিনি যেন পড়া শেষ হয়ে গেলেই চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলেন। চিঠির তারিখ ছিল ২৩ মার্চ, ১৯৩২। বাদালোনায় মৃতদেহ আবিষ্কারের ঠিক দুদিন আগেকার তারিখ।
এ-কেসের একটা অত্যন্ত দরকারি সূত্র হচ্ছে বালসানো-ইউলেলিয়া ঘটিত প্রণয় উপাখ্যানটি। কিন্তু তার চাইতেও দরকারি যা, তা হল খুনে পাষণ্ডটার নাম ধাম জানা। শবব্যবচ্ছেদ হওয়ার পর যে রির্পোট পেয়েছিলাম তা আমার কাছে অন্তত সন্তোষজনক মনে হয়নি। কিন্তু একগুঁয়ে ডাক্তার কিছুতেই তাঁর রিপোর্ট শুধরোতে রাজি হলেন না। মেয়েটির বয়স নাকি কোনওমতেই তিরিশের বেশি নয়–ছিনেজোঁকের মতো এই তথ্যকেই আঁকড়ে রইলেন ভদ্রলোক। ভেবে দেখলাম ক্যাল্লিন দ্য টলার্সের বোর্ডিং হাউসে গেলে অনেক জটিল প্রশ্নের উত্তর আমি পেলেও পেতে পারি। তাই আবার গেলাম বাড়িওলার সঙ্গে এ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্যে।
এমি ল্যাঙ্গার নামে একজন জার্মান স্ত্রীলোকের সঙ্গে কিছুদিনের জন্যে এ-বাড়িতে সংসার পেতেছিল বালসানো। প্রায় ষাট বছর বয়স এমি ল্যাঙ্গারের। বিধবা। স্বামী ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। অবস্থা ভালোই ছিল তার। আসক্তি মদ আর অন্যান্য মাদক দ্রব্যে। বিস্তর অর্থ ছাড়াও অনেক হিরে-জহরৎ ছিল নাকি তার গহনার পেঁটরায়। চলে যাওয়ার সময়ে সব কিছুই নিয়ে গিয়েছিল সে ফেলে গিয়েছিল শুধু একটা কাকাতুয়া। দিব্যি জার্মান বলতে পারে পাখিটা। দেখলাম, মনিবানীর আকস্মিক অন্তর্ধানে মুষড়ে পড়েছে বেচারি। খুঁজে পেতে এমন একজনকে বার করলাম যে জার্মান কথা কইতে পারে। তাকে নিয়ে এলাম কাকাতুয়ার সামনে। ওদের কথার্বাতা থেকে নতুন কোনও তথ্য জানতে পারব, এই আশা ছিল আমার। কিন্তু এবারও আশাহত হতে হল আমাকে।
কিন্তু এমি লাঙ্গারই যে বালসানোর হাতে খুন হয়েছে এবং বাদালোনার সেই লাশটি যে তারই সে বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল আমার। বাদালোনার ভিলাতে পাওয়া কিছু আসবাবপত্র আর বই যে এমি ল্যাঙ্গারেরই, তাও প্রমাণ করতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি আমাকে। খুঁজতে খুঁজতে বার্সিলোনায় একটি দোকানের সন্ধান পেলাম। পুরোনো জিনিস খরিদ করত দোকানদার। এমি ল্যাঙ্গারের কিছু পোশাক উদ্ধার করলাম দোকান থেকে। বালসানোই বিক্রি করে ছিল। কিন্তু আসল কাজটাই যে তখনও বাকি। যেমন করেই হোক আমাকে প্রমাণ করতেই হবে যে লাশটা এমি ল্যাঙ্গারেরই এবং কোনও তরুণী মেয়ের নয়। এ ব্যাপারে আমার ওপর কিঞ্চিৎ কৃপাবর্ষণ করলেন ভাগ্যদেবী। হঠাৎ খবর পেলাম, এমির পায়ে একবার একটা দগদগে ঘা হয়েছিল। অস্ত্রোপচার করে তবে সুস্থ হয়েছিল সে। ভেবে দেখলাম এ খবর যদি নির্ভেজাল হয়, তাহলে লাশটা আর একবার পরীক্ষা করলেই মুশকিল আসান হয়ে যাবে। তৎক্ষণাৎ সে ব্যবস্থা হল। অপারেশনের চিহ্নও পাওয়া গেল পায়ে। ডাক্তারও শেষ পর্যন্ত সুর পালটে স্বীকার করলেন, মেয়েটার বয়স তিরিশ নয়, ষাট এবং সে এমি ল্যাঙ্গারই বটে।
এবার বালসানো আর তার নতুন প্রণয়িনীকে জালে ফেলতে হবে। কাগজে কাগজে ছেপে দিলাম ওদের ছবি আর দৈহিক বর্ণনা। পরিশেষে মাদ্রিদের লাভেপিসু কোয়ার্টারে একটা বোর্ডিং হাউসে গ্রেপ্তার করা হল দুজনকে যে ঘরে এমি ল্যাঙ্গারকে পুঁতে রেখে ছিল, তার নক্শা আর খবরের কাগজে প্রকাশিত খুনের বিবরণটা নিজের কাছেই রেখে ছিল বালসানো।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর এতটুকু চঞ্চলতা দেখা গেল না বালসানোর ধীর স্থির মুখে। ওর বিরুদ্ধে কেন্সটা যে ভাবে দাঁড় করিয়েছিলাম তাতে ফাঁক ছিল না কোথাও। কিন্তু অম্লানবদনে ও সব অভিযোগ অস্বীকার করে বসল। এমি ল্যাঙ্গারকে নাকি সে কস্মিনকালেও দেখেনি। এবং এ জঘন্য হত্যা তার নয়, তারই জানাশুনা আর একজন অপরাধীর। এমি ল্যাঙ্গার নিহত হওয়ার সময়ে শ্রীঘরে ছিল তার এই খুনে বন্ধুটি–এ খবর শুনেও তিলমাত্র বিচলিত হল না ও। ওর মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্যে বেশ কয়েকবার অকুস্থলে নিয়ে গেলাম ওকে। প্রতিবারই বিন্দু বিন্দু ঘামে ওর বিবর্ণ মুখ ভরে উঠলেও কিছুতেই স্বীকার করানো গেল না যে সেই হত্যাকারী।
ভিলার মধ্যে কিন্তু এমি ল্যাঙ্গারকে খুন করা হয়নি। ক্যাল্লি দ্য টলার্সের বোর্ডিং হাউস ছেড়ে বার্সিলোনার ক্যাল্লি দ্য রোজেনল-এ একটা বাড়িতে আস্তানা নিয়েছিল ও। খুনের দিন-তিনেক বাদে বালসানোকে একটা বিশাল সুটক্সে বয়ে নিয়ে যেতে দেখেছিল একজন মেয়ে কুলি। বিশ্রি দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল ভেতর থেকে। জার্মান স্ত্রীলোকটি অসুস্থ হয়ে পড়ার ফলে সে নাকি একাই ফিরে যাচ্ছে। এই সাফাই গেয়েছিল বালসানো।
নাক সিঁটকে শুধিয়েছিল মেয়ে-কুলিটা–কিন্তু ওই সুটকেসটা থেকে ও রকম যাচ্ছেতাই গন্ধ বেরুচ্ছে কেন বলুন তো? কী আছে ওতে?
সসেজ–একদম খারাপ হয়ে গেছে কিনা তাই, চটপট জবাব দিয়েছিল বালসানো।
এই সুটকেসটাই ভিলাতে নিয়ে গিয়েছিল সে। ভেতরে ছিল হতভাগিনী এমি ল্যাঙ্গারের লাশ। সুটকেসটা পরীক্ষা করার পর রক্তের দাগ পাওয়া গেল ভেতরে। পেরেকে লেগে থাকা মেয়েদের পোশাকের সুতোও পেলাম। খুনের সূত্রপাত হয় একটা ঝগড়া থেকে। বালসানোর ধারণা ছিল কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আছে এমি ল্যাঙ্গারের। কিন্তু যখন সে দেখলে সব ভুয়ো–অত টাকাই নেই তার, তখন সংহার মূর্তি ধারণ করল সে। মদে চুর চুর হয়েছিল এমি। কথা কাটাকাটি হতে হতে ফস করে সে খামচে ধরে বালসানোর মুখ। তৎক্ষণাৎ ছুরি বাগিয়ে ধরে বালসানো এবং পরমুহূর্তে একটি মাত্র মোক্ষম টানে দু-টুকরো করে দেয় এমির কণ্ঠনালী। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে রুধির স্রোত। আঘাতটা যে মারাত্মক, তখন বুঝতে পারেনি বালসানো। তাই গোটা দুই মোজা এমির গলায় পেঁচিয়ে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে ও। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিষ্প্রাণ হয়ে যায় এমির দেহ। নির্বিকারভাবে এবার লাশ সরানোর আয়োজনে তৎপর হয়ে ওঠে বালসানো। স্বল্প পরিসরে দেহটাকে যাতে ঠেসে নিয়ে যাওয়া যায়, তাই আরও ক্ষতবিক্ষত করে নেয় লাশটা। এই কারণেই বিকৃত দেহটাকে পুলিশের হাতে পড়ার পর চুল চেরা পরীক্ষা না করার ফলে ঠিক কীভাবে খুন হয়েছিল এমি, তা জানা যায়নি অনেকদিন পর্যন্ত।
এমিকে কবর দেওয়ার জন্যে ভিলার বাগানটাই প্রথমে মনোনীত করেছিল বালসানো। কিন্তু যে রাতে কাজ সারবে বলে স্থির করলে সে, সেই রাতেই একজন চৌকিদার তাকে দেখতে পায়। কাজেই পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফেলল বালসানো। ঘরের মেঝেতেই সমাহিত করা হল এমি ল্যাঙ্গারকে। বার্সিলোনার ক্রিমিন্যাল কোর্টে খুনের অপরাধে বিচার শুরু করা হল তার আর ইউলেলিয়া মেইনের। কিন্তু তখনও অবিচল বালসানো। দৃঢ়কণ্ঠে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করার পর বারবার এই বলে সে হুঁশিয়ার করে দিলে আদালতকে যে নির্দোষীকে অবিচারের যাঁতায় ফেললে প্রত্যেকেরই সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। মুক্তি দেওয়া হল ইউলেলিয়াকে। কিন্তু খুন আর ডাকাতি করার জন্যে বাইশ বছর এবং দলিল দস্তাবেজ জাল করার জন্যে আরও দু-বছর সশ্রম কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হল খুনে বদমাশ বেঞ্জামিন বালসানোকে।
১৯৩৬ সালে শুরু হয় স্পেনের গৃহযুদ্ধ। বালসানো তখনও জেলে। যুদ্ধের দুর্যোগ বার্সিলোনার ওপর ঘনিয়ে আসতেই অন্যান্য কয়েদিদের সঙ্গে তাকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৫ সালের আবার নতুন অপরাধের জন্যে তাকে পাঠানো হয় কারাকপাটের অন্তরাল।
* ডন ভিসেনতি রেগুয়েনগো (মাদ্রিদ, স্পেন) রচিত কাহিনি অবলম্বনে।