1 of 2

বাদাম পাহাড়ের যাত্রী

বাদাম পাহাড়ের যাত্রী

বাংরিপোসির বাংলোর অন্ধকার বারান্দাতে পাশাপাশি ওরা দুজনে বসেছিল। লোডশেডিং হয়ে গেছে। কলকাতা থেকে বিকেল বিকেল এসে পৌঁছেছে এখানে। সরোজ বলল, দুস শালা। লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতেও চাঁদ হাপিস।

আকাশ বোধহয় ওর কথা শুনেই রেগে গেল। এতক্ষণ মেঘ ছিল, এবার বৃষ্টিও নামল। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। মাটি থেকে গন্ধ উঠল সোঁদা। সোঁদা হঠাৎই।

এবং প্রায় সেই সঙ্গেই একেবারে ওদের গায়ের পাশেই এক লম্বা ছায়ামূর্তি দেখে ওরা দু-জনে একই সঙ্গে চমকে উঠল।

ভদ্রলোক কখন এলেন, কীসে করে এলেন, কিছুই বোঝা গেল না। তাঁর পায়ের আওয়াজ পর্যন্ত পায়নি ওরা। যেন ভূঁই-ফোঁড়।

কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগ। হাতে টর্চ। বোধহয় হেঁটে এসেছেন, দুরে কোথাও বাস বা ট্রাক থেকে নেমে। লম্বা সৌম্য চেহারা, মাথাভরতি কাঁচা-পাকা চুল। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। ওদের দু জনের প্রায় কানের কাছে দাঁড়িয়েই চড়া-গলায় ভদ্রলোক বললেন, চৌকিদার কোথায়?

সরোজ, মূর্তিটি ভূত-টুত নয়, সে সম্বন্ধে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়ে আশ্বস্ত হল।

বলল, চৌকিদারের ঘর ডানদিকে।

ঘর বুঝি খালি নেই?

তা জানি না। আমরা দুজন তো এক ঘরেই আছি। অন্য ঘরের কথা চৌকিদারই বলতে পারবে। ওর ঘর ওইদিকে। বলে, ঘরটা আঙুল দিয়ে দেখাল সরোজ।

ও।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে চৌকিদারের ঘরের দিকে চললেন ভদ্রলোক।

বিমল স্বগতোক্তি করল, কানে বেশ কম শোনে রে। একটু হলপ কর, সরোজ, পার্টিকে।

সরোজ উঠে, চৌকিদারের ঘরের দিকে গেল।

ইতিমধ্যে অঝোরে বৃষ্টি নামল। যে বিশাল ঝুরি ছড়ানো গাছটা বাংলোর ডানপাশে একেবারে পঞ্চবটীর মতো ছেয়ে আছে তার উড়াল পাতা উথাল-পাতাল করে একটু পরেই যেন প্রলয় এল সশরীরে। যেমন বৃষ্টি, তেমনই ঝোড়ো হাওয়া।

বিমল বিরক্ত হয়ে ঘরে গিয়ে বসল গা বাঁচানোর জন্যে। বছরের এই সময়ে এরকম থার্ডক্লাস ব্যাপার হবে জানলে, কলকাতা থেকে ওরা দু-জন বেরুতই না। তাস খেলত ছুটিতে।

সরোজ ফিরল অনেকক্ষণ পরে। বলল, পুরো ব্যাপারটাই কেমন হেঁয়ালি ঠেকছে।

কেন?

পার্টি নাকি আসছে বারিপদা থেকে বাসে। বলল, কাল যাবে সিমলিপালে। সেখান থেকে বড়াইপানি।

বিমল বলল, বড়াইপানি? সেটা আবার কী ব্যাপার?

কী ঘোড়ার ডিম ফলস-মলস আছে নাকি। যত্ত সব!

বিমল আবার বলল, কিন্তু জিপ ছাড়া এ পার্টি যাবে কী করে? সিমলিপাল ন্যাশনাল পার্কে বাস বা গাড়ি নিয়ে যাওয়া মুশকিল। আমি তো ন্যাশনাল পার্ক-ফার্কের খোঁজখবর একটু আধটু রাখি।

সরোজ বলল, সেকথাই তো বলছিলাম পার্টিকে। এখানে একজন অথরিটি বসে আছে। ইচ্ছে করলে কনসালট করতে পারেন।

বিমল একটু ফুলে উঠে বলল, তা শুনে কী বলল?

কিছুই বলল না। শুনতে পেল কি না তাই-ই বা কে জানে? মরুকগে যাক।

দুজনেই চুপ করে বাইরের ঝড়-বৃষ্টির আওয়াজ শুনল কিছুক্ষণ।

সরোজ বলল, কেচাইন করল মাইরি! কী দুযযোগ।

বিমল কথা ঘুরিয়ে বলল, পার্টি, রাতে খাওয়া-দাওয়ার কী করবে? এ বাংলোতে তো খাওয়া-দাওয়ার কোনো বন্দোবস্তই নেই। বলেছিস সেকথা। খিচুড়ি খেতে বল না। আমাদের জন্যে তো হচ্ছেই। ভাগাভাগি করে খেয়ে নেওয়া যাবে। ওর কাছ থেকে গোটা পাঁচেক না হলেও গোটা নিতেক টাকা মিল বাবদ নিয়েও নেওয়া যাবে।

সরোজ বলল, গুরু! তোমার আগেই ভেবেছি সেকথা। বলা হয়ে গেছে অলরেডি। বলল, খাব। কিন্তু দাম নিতে হবে। ক্যালানে। বিনি-পয়সায় খাওয়াচ্ছে কে?

বলল, সাড়ে সাত টাকা দেবে।

সাড়ে সাত টাকা? এক থালা খিচুড়ি আলু ভাজা আর ডিমভাজার জন্যে? বড়োলোকি দেখাচ্ছে?

তোর-আমার কী। দেবে, দেবে। সরোজ বলল, লোকটা ছিটেল আছে। ভালোই হয়েছে। খাদ্য খিচুড়ি, শালা খাদকও খিচুড়ি।

সরোজ বারান্দা থেকে নেমে ভালো করে উঁকিঝুঁকি মেরে বলল, একটু একটু করে মেঘ কাটছে। এমন চললে, এক ঘন্টার মধ্যে আকাশ কিলিয়ার হয়ে যাবে মনে হয়। চল, চান টান করে আমরা তৈরি হয়ে নিই। লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে এমন জায়গায় এসে একটু জংগল-লাইফ এনজয় না করলে এলাম কী করতে?

বিমল বলল, চল, বরাত ভালো থাকলে আজ হাতিও দেখা যেতে পারে। বুঝলি। কাল তো হল না।

সরোজ বলল, সত্যিই কী দেখতে চাও তুমি গুরু? কিছু কিছু জিনিস আছে, যেমন ধর, পরীক্ষার রেজাল্ট, বুনো-হাতি, এইসব আমি কিন্তু নিজের চোখে দেখার কোনোদিনই পক্ষপাতী নই।

ওরা চান-টান করে গাড়িতে উঠে রাম-এর বোতল, জলের বোতল আর দুটো গ্লাস নিয়ে যখন। বেরোলো, তখন রাত প্রায় আটটা। আবহাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেছে। চৌকিদারকে বলে গেল যে সাড়ে-নটা নাগাদ ফিরবে। খিচুড়ি যেন রেডি রাখে। সঙ্গে ডিমভাজা।

বিমল বলল, চল, বাংরিপোসির ঘাট পেরিয়ে বিসেই অবধিই ঘুরে আসি। ঠান্ডায় রামটা জমবে ভালো।

হাতি-ফাতি সত্যিই বেরোবে না তো রে?

চল না তুই। আমি তো আছি। তোর ভয় কী?

তাই-ই তো! ওয়াইলড লাইফের মাস্তানের কথা ভুলেই গেছিলাম। তুই তো দ্বন্দ্ব,ণ্ঠ.এর মেম্বারও। পালামৌর জঙ্গলের অথরিটি। ____ হওয়ার জন্যে চেষ্টা চালাচ্ছিস বিস্তরই। সেটা হলে কী হবে র‍্যা! ন্যাজ গজাবে?

মেলা ভচর-ভচর করিসনি। যা বুঝিসনি তা নিয়ে কপচাসনি। এখন বাণিজ্য আছে মাত্র দুটি।

কী কী?

রাজনীতি আর ওয়ার্লড লাইফ-এর এক্সপার্ট বয়েছিস!

তাই?

ইয়েস।

বাংলোর গেট থেকে একটু যেতে-না-যেতেই দেখা গেল ঝকঝকে চাঁদের আলোতে একটি প্রকাণ্ড দাঁতাল হাতি এসে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দু-পাশের খেত জাগানিয়া লোকেরা হুঃ হাঃ করে চেঁচিয়ে, পটকা ফাটিয়ে কানে তালা লাগাবার উপক্রম করল। তাতে হাতিটা ভীষণ চটে গিয়ে ওদের গাড়ির দিকেই দৌড়ে এল শুড় তুলে।

সরোজ তাড়াতাড়ি হেডলাইট ডিপারে দিয়ে বিমলকে জিজ্ঞেস করল, কী করব গুরু? শিগগির বল।

তারপর গুরুকে একেবারেই নির্বাক দেখে, ব্যাক গিয়ারে ফেলে বাংলোর গেটের মধ্যে নিয়ে এল গাড়িকে গাঁ-গাঁ করে।

হাতিটা গেটের মুখ অবধি এসে বাঁ-দিকের জঙ্গলে ঝোপ-ঝাড় ভেঙে চলে গেল।

সরোজ ফিসফিস করে তুতলে শুধোলো, একলা মা, মা-মানেই তো রো-রোগইলিফ্যান্ট? কীরে বিমলে?

বিমল গাড়িটা বাংলোর হাতার মধ্যে ঢুকেছে কি না ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, না-ন-নট নে নেসেসারিলি!

তারপরই বলল, অত্ত ভয় পাওয়ার কী ছেল?

বাইরে আর না গিয়ে, ওরা ফিরে এল বাংলোতেই। বাংলোর বারান্দায় বসে রাম খেতে খেতে বিমল সরোজকে হাতির বিষয়ে জ্ঞান দিচ্ছিল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে তাদের হঠাৎ সেই ভদ্রলোকের কথা মনে হল।

বিমল বলল, সেই ছিটেল পার্টি কোথায় গেল র‍্যা? কী যে মিস করল তা নিজেই জানে না!

সরোজ বলল, ছেড়ে দে। কানে খুবই কম শোনে। বড্ড চেঁচিয়ে কথা বলতে হয়। নইলে, সঙ্গেই নিয়ে যেতুম।

সরোজ বলল, ভর সন্ধ্যেতে ঘুমোচ্ছে নাকি? দ্যাখ, মেয়ে-ফেয়ে যোগাড় করে ফেলেছে হয়তো! হেভি চালু বলতে হবে। ঘর ছেড়ে যে বেরুচ্ছেই না র‍্যা!

তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, অ্যাই যে স্যার! যাবেন নাকি? ওয়াইল্ড ইলিফ্যান্ট দেখতে?

বিমল বলল, মুখ। ইলিফ্যান্ট নয়, এলিফ্যান্ট।

সরোজ বলল, বুঝবে তো! তাহলেই হল!

ভিতর তেকে কোনো সাড়াই দিল না কেউ।

সরোজ স্বগতোক্তি করল, কোথায় ভ্যানিস হয়ে গেল? যাঃ বাব্বা!

আধঘন্টা পর ওরা আবার বেরুল। ওরা আবারও বাংরিপোসির ঘাটের কাছে এসেছে, এমন সময় ফুটফুটে চাঁদের আলোয় হাতির একটি ছোট্ট দলকে নামতে দেখল ঘাট থেকে। বিমল বলল, এই সেরেছে।

কিন্তু হাতিগুলো ঘাট থেকে নেমেই বাঁ-দিকের জঙ্গলে ঢুকে এগিয়ে গেল কানচিনা বাংলো যেদিকে, সেদিকে। এদিকের ধানের স্বাদ বোধ হয় তাদের পছন্দ নয়।

চারদিক থেকে আবার হুঃ হা! হু হাঃ! শব্দ উঠল।

হাতিরা মিলিয়ে যেতে-না-যেতেই ঘাটের পথ বেয়ে একজন ভুতুড়ে মানুষ পায়ে হেঁটে নেমে আসছে বলে মনে হল। যেন হাতিদের পায়ে-পায়েই। গাড়িটা একটু এগোতেই ওরা হেডলাইটে সেই ভদ্রলোককে দেখতে পেল।

আতঙ্কিত গলায় সরোজ বলল, হয় ভূত, নয় নির্ঘাৎ পাগল।

বিমল বলল, পাগল নয়, উন্মাদ। ইডিয়ট।

সরোজ বলল, পায়ে হেঁটে রাতের বেলা এইরকম জায়গায় ওস্তাদি করে? লোকটার কি হাতির নাতি খেয়ে নাড়ু হবার ইচ্ছে নাকি, বল তো বিমলে? তুই তো এসব বিষয়ে অথরিটি! লোকটা কি আত্মহত্যা করতে চায়? তা, নাড়ু হয়ে মরার দরকার কি? কত সোজা রাস্তাই তো ছিল।

বিমল, ওয়াইল্ডলাইফ নিয়ে পড়াশুনো করে। মাসে মাসে ওর বাড়িতে ম্যাগাজিন আসে। তার গাড়িতে পাণ্ডা ভালুকের সবুজ ছবি সাঁটা। ওয়ার্লর্ড-লাইফ ফান্ডের লাইফ মেম্বার হয়েছে ও থোক টাকা দিয়ে। ও বিজ্ঞের মতো স্বগতোক্তি করল, গাড়ল।

সরোজ গাড়ি থামিয়ে, হেডলাইট নিবিয়ে দিল।

ভদ্রলোক কাছে এলে, হেডলাইট জ্বালিয়ে দিল। ওরা এই প্রথম ভালো করে, আলোয় দেখল। ভদ্রলোককে। ট্রাউজারের মধ্যে শার্ট গোঁজা। হাতা-গোটানো শার্টের। টানটান শালগাছের মতো ঋজু চেহারা। সারা গা-মাথা-জামা-কাপড় বৃষ্টিতে একেবারে চুপচুপে ভেজা।

সরোজ মুখ বাড়িয়ে বলল, চলুন দাদা, আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি বাংলোতে। করেছেন কী? জ্বর হবে য্যা! এই কার্তিক মাসের বৃষ্টি!

ভদ্রলোক উত্তরে বললেন, কালকেই চলে যাব।

সরোজ গলা চড়িয়ে বলল, পায়ে হেঁটে এমনভাবে হাতির পেছনে পেছনে রাতের বেলা কেউ পাহাড় থেকে নামে? আপনি কি সাহস দেখাচ্ছেন? তুলে আছাড় মারলে কী হত একবার ভাবলেন না দাদা? ঘরে কি কেউই নেই? বে-থা করেননি?

ভদ্রলোকের কানে বোধহয় কথাগুলো পৌঁছোল না।

উনি একবার আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর দূর পাহাড়ের রাতচরা পাখি-ডাকা রহস্যময়তার দিকে এবং জ্যোৎস্না-পিছলে যাওয়া ধানখেতের দিকে একটুক্ষণ চুপ করে থেকেই, ডান হাতটি তুলে যেন অন্য কোনো সুন্দর রহস্যময় গ্রহ থেকে বললেন, আঃ এই পৃথিবী কী। সুন্দর! সব কিছুই কী সুন্দর এখানে। না?

তারপর বললেন, গাড়ি থেকে নামুন না। এইভাবে কি কিছু দেখা যায়? গাছপালা, পাখি, প্রজাপতি, এমনকী মানুষও? নিজের পায়ে চলে চিনুন এই জঙ্গল পাহাড়কে, দিনে রাতে। দেখবেন কত তফাত। কী আশ্চর্য সুন্দর! সব কিছু!

সরোজ গলা নামিয়ে বলল, এ দেখি উলটো জ্ঞান দিচ্ছে র‍্যা!

বিমল গাড়ি থেকে নেমে, চেঁচিয়ে বলল, রাত সাড়ে-নটায় ফিরব আমরা। খিচুড়ি খাব। আপনার তাড়া থাকলে আপনি খেয়ে নেবেন আগে।

ভদ্রলোক বোধহয় শুনতে পেলেন না।

সরোজ চেঁচিয়ে বলল, বুঝলেন তো!

ভদ্রলোক বললেন, আমি কাল ভোরেই চলে যাব। থাকব না। যাত্রী আমি।

বলেই, বাংলোর দিকে পা বাড়ালেন।

গাড়িটা ছপছপে চাঁদের আলোয় নীচের রাস্তার উপর রেখে ওরা রাম খেতে লাগল। একটা সাপ ডানদিকের ধানখেত থেকে উঠে রাস্তা পেরিয়ে বাঁ-দিকের ধানখেতের দিকে যেতে লাগল আস্তে আস্তে।

বিমল আতঙ্কিত গলায় বলল, রাসেলস ভাইপার।

সরোজ বলল, তোর মুণ্ডু! জল-ঢোঁড়া। গাড়ি চাপা দিয়ে দেখাব তোকে?

সরোজ বলল, ছিঃ ওয়াইলড লাইফ। তোরা নাঃ।…

দূরের গাছ থেকে হঠাৎ পেঁচা ডেকে উঠল, দুরগুম দুরগুম দুরগুম করে।

সরোজ বলল, আর দেকতে হবে না রে বিমলে। অ্যাইবারে এক্কেবারে রমরমা যাবে হাওড়ায়। তোর ঢালাইয়ের কারবারে। নীপুজোর রাতে নীপেঁচা ডাকছে। আর দ্যাকে কে?

২.

ভদ্রলোক যে কোন ভোরে উঠে চলে গেলেন!

ঘুম থেকে যখন উঠল ওরা, তখন প্রায় আটটা বাজে। অশ্বথের ফল পেকেছে, লাল লাল। বাঁ পাশে ক্ষীরকুঁড়ি গাছ। পাখির মেলা বসেছে যেন।

চৌকিদার গুরবা সিং বলল, ভদ্রলোক ঠিক সাড়ে চারটেতে রাত থাকতে উঠে, চান করে তৈরি হয়ে, প্রথম বাসেই চলে গেছেন যোশীপুরের দিকে।

বিমলরাও আজ যোশীপুরে যাবে। ঠিক করেছে, কোনো ভালো বাংলো-ফাংলো না পেলে আবার ফিরে এসে থাকবে এখানেই। এ জায়গাটায় ভালো ডানলোপিলো আছে, ইলেকট্রিসিটি আছে। কিন্তু খরচও ভালো। ঘর ভাড়াই দিনে পঁচিশটাকা।

সকালটা শুয়ে-বসে আলসি করে, অনেক কাপ চা খেয়ে ওরা কাটিয়ে দিল। দুপুরে ডিমের কারি দিয়ে ভাত খেল। এ হতভাগা জায়গায় মাছ পাওয়া যায় না মোটে।

বিকেল বিকেল পথে বেরিয়ে বিমল বলল, কত গচ্চা গেল র‍্যা? ম্যানেজার?

সরোজ বলল, যাই-ই যাক, পাঁচশো ক্রেডিটে আছি এখনও। বুঝলে? গুরু।

মানে?

বিমল সরোজের দিকে ফিরে শুধোলো।

ফ্রিজের সঙ্গে যে স্ট্যাবিলাইজারটা লাগানো ছিল ঘরে, সে যন্তরকে কেঁপে দিয়ে বেডিং-এ পুরে নিয়েছি। কলকাতায় দাম সাড়ে-সাতশো টাকা।

বিমল বলল, এই নইলে ম্যানেজার! গাড়িতে ঘুরতে অনেক খরচা, অথচ গাড়ি ছাড়া ঘোরাও যায় না। অন্তত ভদ্রলোকেরা পারে না।

ওরা অনেকক্ষণ হল বিসেই পেরিয়ে এসেছে। মনাদার বাংলোয় জায়গা পেল না। মনাদা থেকে অনেকখানি এসেছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে উঁচু মালভূমি মতো জায়গাটা। বিসোই-এর পর থেকেই বিমল বার বার বলছিল, আটু গেলেই যোশীপুর, আটু গেলেই যোশীপুর।

সরোজ বলল, গুরু! আর কত আটু যেতে হবে?

বিমল জবাব না দিয়ে অথরিটির মতো বলল, এসব জায়গায় যেকোনো জানোয়ার যখন-তখন বেরিয়ে পড়তে পারে, বুঝলি। এখন কথা বলিসনি! ভালো করে গাড়ি চালা। দু-পাশের জঙ্গল দ্যাখ।

সরোজ বলল, জঙ্গল আমি দেখতে গেলে, তোমাকে কে গর্ত দেখাবে গুরু! আমি যে গাড়ি চালাচ্ছি।

অনেক হয়েছে। সামনে তো অন্তত দেখতে পারিস।

তা তো দেখছিই!

সরোজ এদিকে-ওদিকে তবু একবার তাকাল। বোঝবার চেষ্টা করল, ওকে অনভিজ্ঞ জেনে বিমল গুল মারছে কি না! কিন্তু কোনোও জানোয়ারই বেরুল না। এদিকে দেখতে দেখতে অন্ধকারও হয়ে গেল।

ঘন অন্ধকার। দু-পাশেই জঙ্গল ও পাহাড়। সরোজের গা ছমছম করতে লাগল। বিমলের কথা আলাদা। ও জঙ্গলের অথরিটি।

এবারে মনে হল, বোধহয় যোশীপুরের কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। গা ছমছম ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের মধ্যে মধ্যে একেবারে নির্জন রাস্তা। চাঁদ উঠেছে। জনমানব তো দূরের কথা, গাড়ি ঘোড়ারও চিহ্নমাত্র নেই।

হঠাৎই ওদের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ওরা দেখল রাস্তার বাঁধার ঘেঁষে একজন লোক চলেছে। একটু ঝুঁকে। যোশীপুরের দিকেই। লোকটা যেন বাঁ-দিকের জঙ্গলের সঁড়িপথ দিয়ে বেরুল মনে হল।

ডেঞ্জারাস। ডাকাত-ফাঁকাত নয় তো?

বিমল বলল।

কাছাকাছি আসতেই সরোজ চেঁচিয়ে উঠল, এ-যে সেই-ই র‍্যা! সেই-ই মাল!

বিমল বলল, কী বলবি বল এদের? বন-জঙ্গল ওয়াইলড লাইফ সম্বন্ধে কোনোই জ্ঞান নেই। লোকটার। পৈত্রিক প্রাণই চলে যাবে নির্ঘাত কোনোদিন। ইডিয়ট!

সরোজ গাড়ি দাঁড় করাল।

বিমল মুখ বের করে বলল, অ্যাই যে, আমরা সেই বাংরিপোসির খিচুড়ির পার্টনার! দাদা। এখান কেউ রাতের বেলা এমন একা একা হাঁটে! বনজঙ্গল সম্বন্ধে কিছুমাত্র না জেনে মশাই, আপনি না…

তারপরই ভদ্রলোককে কিছুমাত্র বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বলল, জানেন? আমি কত সেমিনার অ্যাটেন্ড করি। কত পড়াশুনো করি এসব বিষয়ে। তবু আমিও…আর আপনি…মানে, ভাবা যায় না, ভাববাই যায় না।

তারপর গলা আরও চড়িয়ে বলল, বুঝলেন! ভাবা যায় না।

সরোজ গাড়ির পিছনের দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে দিয়েই বলল, অনেক তো হয়েছে। এবার মানে মানে উঠে পড়ুন। আমরা যোশীপুরেই যাব।

ভদ্রলোক কথা না-বলে বাঁ-হাতের এক ঠেলায় দরজাটা ধপ করে বন্ধ করে দিলেন।

সরোজ বলল, সঙ্গে টর্চ পর্যন্ত নেই একটা। এখন চাঁদও তো দেখছি তেমন জোর হয়নি। নাঃ, রিয়্যালি!

ভদ্রলোক হাসলেন। কাঁচা-পাকা চুলে আর পুরু চশমার কাচে ভদ্রলোককে এই বিখ্যাত সিমলিপারের জঙ্গলের চেয়েও রহস্যময় বলে মনে হল ওদের দুজনেরই।

বিমল কী যেন বলতে গেল।

ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বললেন, পাওয়ার বেশি হলেও, চোখে আমি ভালোই দেখি।

তারপর বললেন, জানেন, এই রাতের জঙ্গল কথা বলে, হাঁটে, অপূর্ব! গায়ে কাঁটা দেয়, ভালোলাগায়। কখনো কান পেতে শোনেননি বুঝি?

তারপরই বললেন, আচ্ছা! হেমন্তর রাতের বনের গায়ের গন্ধ নিয়েছেন নাকে কখনো? নেননি? কোথায় লাগে আতরের গন্ধ! আসুন! নেমে পড়ুন। আমার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে চলুন। অপূর্ব! আঃ!

বলে, নিজেই নাক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন।

ভদ্রলোক নিজে কানে কম শোনেন বলে কথাগুলো খুব জোরে জোরে বললেন।

কথাগুলো দু-পাশের জঙ্গলে আর কালো পাথর-ভরা পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে চারদিকে গমগম করে উঠল। ওদের কাছে ফিরে এল।

সরোজ গলা চড়িয়ে বলল, আপনি যাচ্ছেন না তাহলে আমাদের সঙ্গে?

ততক্ষণে উনি একটু এগিয়ে গেছিলেন। রাস্তার একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু-হাত তুলে ভদ্রলোক হাসলেন। জোড়া-হেডলাইটে ওঁর ছায়াটা পড়ল সামনে লম্বা হয়ে। ওদের যাবার পথকে প্রায় অন্ধকার করে দিয়ে।

বললেন, নিশ্চয়ই যাব। আবার কাল ভোরেই বেরোব।

কোথায়?

সরোজ চেঁচিয়ে জিগগেস করল।

বাদামপাহাড়।

বিমল বলল, চল চল, আর দেরি করিসনি। রাতে কোথায় থাকব, বাংলো খালি পাব কি না? তাতে ডানলোপিলো আছে কি নেই? ইলেকট্রিসিটি আছে কি নেই? সবই অজানা। যেতে হবে, চান। করতে হবে, খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। যত্ত সব পাগলের কারবার।

সরোজ গাড়ির অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিল।

ভদ্রলোককে প্রথম চাঁদের নরম দুধলি অন্ধকারের জঙ্গলে ফেলে ওদের গাড়ি গোঁ-গোঁ করে এগিয়ে চলল।

বিমল বলল, হ্যাঁ রে ওষুধপত্র সব আছে তো? না শেষ?

সরোজ বলল, সব আছে গুরু। এখন শুধু তুমি আর চাঁদ ঠিক থেকো। পুরো দু-বোতল রাম আছে এখনও। না হলে আর ম্যানেজারি করলাম কী?

চড়াই উঠতে উঠতে গিয়ার বদলাতে বদলাতে অন্যমনস্ক গলায় সরোজ বলল, লোকটা এই অন্ধকারে, এই পথ দিয়ে, পায়ে হেঁটে আসবে কী করে র‍্যা? আমার তো শালা এপথে গাড়িতে যেতেই ভয়-ভয় করছে।

বিমল বলল, তুই আমার সঙ্গে একটু-আধটু সেমিনারে-টেমিনারে ঘোরাঘুরি কর। তোরও ভয় ভেঙে যাবে। আসলে ভয়ের কিছুই নেই জঙ্গলে! ভয়টা আমাদের মনে।

এমন সময় একজোড়া জুলজুলে চোখ জ্বলে উঠল পথের ডানদিকের জঙ্গলে, হেডলাইটের আলোতে।

বিমল কাঁপা-কাঁপা গলায় ভীষণ ভয় পেয়ে বলল, টাইগার! প্যানথেরা টাইগ্রিস! টাইগ্রিস! সরোজ! সাবধান! দাঁড়া!

সরোজ ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড় করাল। বেশ ঝাঁকুনি লাগল দু-জনেরই।

ফিসফিস করে বলল, কী গুরু? খৈরির কাজিন নাকি?

বিমল অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে স্টিয়ারিং-ধরা সরোজের হাতে চিমটি-কেটে বলল, সব সময় ইয়ার্কি ভালো লাগে না।

ইতিমধ্যে খেঁকশিয়ালটা পথের ডানদিক থেকে বাঁ-দিকে এক দৌড়ে রাস্তা পেরোল।

বিমল বলল, টাইগার নয়, হায়না। না, না, উলফ! উঃ!

সরোজ বলল, থাম তো! মেলা ভ্যাচোর ভ্যাচোর করিস না! আমাদের মামাদের হরিপালের বাঁশঝাড়ে এ মাল কত্ত আছে। এ তো শেয়াল! খেঁকশিয়াল।

বলেই, গাড়ি আগে বাড়াল।

বিমল তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে বলল, আমি কেবল ওই পাগলটার কথা ভাবছি। সেই ভোরে বেরিয়ে এসে কোনদিকে মাল গেল? বড়াইপানি না মাঝাইপানি, না ছোটাইপানি রাতে কোথায়ই বা থাকবে যোশীপুরে তা ভগবান-ই জানেন। কতরকমের পাগলই যে আছে এই দুনিয়ায়!

সরোজ বলল, কোথায় যাবে বললে যেন কাল? কাঠাম পাহাড় না গাদাম-পাহাড়?

বিমল বলল, দুস! বড়ো উলটোপালটা বলিস তুই! বাদামপাহাড়!

সেখানে কী আছে র‍্যা? কাজু বাদামের ঝাড়?

সরোজ শুধোলো।

বিমল বলল, কে জানে? কিছু নিশ্চয়ই আছে। পাগলই জানবে।

তারপর হঠাৎই বলল, পাগলটা কী বলছিল র‍্যা? হেমন্তর বনের গায়ের গন্ধ না কী যেন?

সরোজ ফিচিক করে হাসল। ব লল, শালা গন্ধ গোকুল! আমাদের পাড়ার হেমন্তর বোনের গায়ের গন্ধ হলেও না হয় বুঝতুম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *