বাদাবনের বেকহ্যাম

বাদাবনের বেকহ্যাম

গোলপোস্ট থেকে মিটার পনেরো দূরে বল বসেছে৷ নিয়োগী দুটো হাত দু-দিকে ছড়িয়ে গোলপোস্টের সামনে এমন করে দাঁড়িয়েছে যেন এক্ষুনি কোনও অদৃশ্য হাতিকে জড়িয়ে ধরবে৷ বল থেকে ফুট চারেক দূরে দাঁড়িয়ে ফণী হাতিটাকেই কেনার জন্য জরিপ করছে৷ তার পিছনে আর দু-পাশে জনা দশেক ছেলেপিলে দাঁড়িয়ে গার্ড-অফ-অনার দিচ্ছে যেন৷

অবশেষে দু-পা এগিয়ে ধাঁই করে বলে লাথাল ফণী, নিয়োগী বাঁদিকে লাফিয়ে ধাঁ করে ধরে ফেলল উড়ন্ত বলটাকে৷ হতাশ ফণীর গলা দিয়ে বেরিয়ে এল দুটো শব্দ ‘যাঃ, পেনাল্টি মিস৷’

বাদাবন অগ্রগামী ক্লাবের ফুটবল প্যাকটিস চলছে৷ সামনেই চেঁদোবাবু স্মৃতি ফুটবল প্রতিযোগিতা৷ প্রতিবছর পাঁচ-সাতখানা গ্রাম ঝেঁটিয়ে ক্লাব অংশ নেয় তাতে৷ বাদাবন প্রতিবছরই তাতে সেকেন্ড হয়৷ এমনকি ‘দু-নম্বরি ক্লাব’ নামটা পর্যন্ত চালু হয়ে গেছে৷ ফাইনালে উঠে শেষ মুহূর্তে হেরে যাওয়াটাই যেন বাদাবনের ট্র্যাডিশন৷ তার মধ্যে গত তিনবারই আবার টাইব্রেকারে হার৷

এমনিতে নিয়োগী যে খারাপ গোলকিপিং করে তা নয়, কিন্তু বাদাবনের সব বাঘা বাঘা প্লেয়ারই সেট-পিসে তালকানা৷ হয় গোলকিপারের গালে লুলুভুলু বল মারে না হয় বারপোস্টের উপর দিয়ে পাঁজা পার হয়ে যায়৷ ফণীর মাথায় একটা রাশভারী গাঁট্টা বসিয়ে দিল দিলু, ‘এতক্ষণ ধরে এই শেখালাম? কোমর ঝুলে যাচ্ছে, ন্যালাখ্যাপার মতো হাত ছুঁড়ছিস, ব্যালান্স পাবি কী করে রে হতভাগা?’

অনুপম আর বাবাই আবার পেনাল্টি মারে৷ একটাতেও গোল হয় না, দিলু হাওয়ায় হাত ছুঁড়ে বলে, ‘এটা বাদাবন না শালা, এটা উলুবন৷ আর আমি মুক্তো ছড়াচ্ছি৷ তোদের কপালে ফাইনালিস্টই নাচছে৷ চাম্পিয়ন আর হতে হল না৷ নে, অনেক হয়েছে, বাড়ি যা এবার৷’

সত্যিই সন্ধে হয়ে আসছে৷ মাঠের আলো একেবারে কমে এসেছে৷ সন্ধের দিকে ধুলো পড়ে এলে এই মাঠে লোকজন হাঁটতে আসে৷ কেউ কেউ একেবারে মাঝখানে শতরঞ্চি পেতে বসে আড্ডা দেয়৷ সেদিকে একবার দেখে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় দিলু৷

গোলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, ‘তোদের বলে কোনও লাভ হবে না, তা-ও বলছি, সেট পিস আসলে মনস্তত্ত্বের খেলা৷ কোন ডিফেন্ডার কোন দিকে সরবে, গোলকিপার কোন দিকে ঝাঁপাবে, সেটা বুঝে গেলেই সেট-পিসে গোল আসবে৷ কাল আবার এখান থেকেই…’

‘আমি মারব একটা?’

কথার মাঝেই থেমে যায় দিলু৷ একটা বছর কুড়ির বেঁটেখাটো ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের থেকে একটু পিছনে৷ ছেলেটার গড়ন দেখে বোঝা যায় একেবারেই ফুটবল খেলার উপযুক্ত নয়৷ থলথলে চেহারা, গায়ে বা পায়ে তেমন জোর আছে বলেও মনে হয় না৷ ইতস্তত করেই কথাটা বলেছে সে৷ ছেলেটার পাশে একটা ওরই বয়সি মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে৷

বলটা দূরে পড়ে ছিল, ফাঁকা গোলপোস্ট দেখিয়ে দেয় দিলু, ‘মারো৷’

ছেলেটা কিন্তু আপত্তি করে, ‘না৷ গোলকিপার লাগবে৷’

নিয়োগী এতক্ষণ এপাশ-ওপাশ ঝাঁপিয়ে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল৷ তা-ও দিলু তাকে ইশারা করতে গোলপোস্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে৷ খুব একটা গুরুত্ব দেয় না নিয়োগী৷ এই ছেলেটার পক্ষে যেটুকু মারা সম্ভব তা সে অবলীলায় ধরে ফেলবে৷

পিছিয়ে গিয়ে শুরু করে ছেলেটা৷ মনে মনে বিড়বিড় করে কিছু বলে নেয়৷ এগিয়ে এসে পা-টা প্রায় ফুটখানেক পিছনে ঠেলে লাথি হাঁকিয়ে দেয় বলে৷ উড়ন্ত কামানের গোলার মতো বল ভেসে আসে নিয়োগীর শরীর লক্ষ্য করে৷ ও দু-হাতে ধরার চেষ্টা করে বলটা৷ ধরেও ফ্যালে, কিন্তু বলের তেজে ও নিজে আর মাটিতে থাকে না৷ বল সমেত উড়ে গিয়ে জড়িয়ে যায় জালে৷ ‘উরিসশ্লা! কী পেনাল্টি!’ ফণী থতমত খেয়ে বলে৷

দিলু অন্যদিকে ফিরে বাবাইকে কিছু বোঝাচ্ছিল৷ সে পিছনে ফিরে দ্যাখে নিয়োগী বল হাতে গোলপোস্টের জালে খাবি খাচ্ছে৷ বলটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে সে আবার নিয়োগীকে দাঁড় করায় গোলের সামনে৷

বলটা ছেলেটার দিকে এগিয়ে দেয়, ‘আবার মারো তো দেখি৷’

পাশের মেয়েটাকে কিছু একটা বলে ছেলেটা৷ তারপর আবার আগের মতো ফিরে লাথি মারে বলে৷ কোণে মেরে গোল করার ইচ্ছা নেই৷ ছেলেটা যেন একবগ্গা, সোজা মারবেই৷ নিয়োগী আবার হাত বাড়ায়, আবার ছিটকে পড়ে গোলের ভিতরে৷

দিলু প্রায় দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় ছেলেটাকে, ‘পেয়ে গিয়েছি শালা, এই ছেলেই আমাদের সেট-পিস মারবে৷ বাদাবনের বেকহ্যাম৷’

ছেলেটা একটু অস্বস্তিতে পড়ে, ‘এহঃ, আমার নাম নাড়ু৷’ তারপর সঙ্গের মেয়েটির দিকে দেখিয়ে বলে, ‘আর এ আমার গালফেরেন্ড৷’

কাছ থেকে, দূর থেকে, মাঝখানে প্লেয়ার দাঁড় করিয়ে সব কিছুই চেষ্টা করে দেখে দিলু, ফল হয় একই৷

বার দশেক একই কাণ্ড ঘটতে নিয়োগী পেট ধরে বসে পড়ল৷ কাতরাতে কাতরাতে বলল, ‘এ ছেলের বল আর ধরতে গেলে আমার নাড়িভুঁড়ি আজ মাঠেই পড়ে থাকবে৷’

দিলু উৎফুল্ল গলায় বলল, ‘তাহলেই ভাব, নাড়ু আমাদের ক্লাবে খেললে অপোনেন্টের গোলকিপারের কী দশা হবে৷ খালি ক-টা ফ্রি-কিক জোগাড় করতে পারলেই…’

নিলু এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল, সে এবার এগিয়ে এসে বলে, ‘তুমি যে বলছিলে, প্লেয়ারের মনস্তত্ত্ব বুঝে খেলতে হবে… এ ছেলে তো ওসবের ধারও ধারে না…’

‘তাই তো ভাবছি রে নিলু৷ একেবারে গোলকিপারের গায়ে মেরে গোল৷ নাঃ, এ একেবারে গায়ের জোরের ব্যাপার৷ যাক গে, কাপ আমাদের ক্লাবেই আসছে এবার৷’

দিলু তক্ষুনি ছোকরাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ক্লাবের খাতায় নাম লেখাতে চাইছিল৷ কিন্তু নাড়ু আপত্তি করল৷ খেলাধুলায় ওর বিশেষ আগ্রহ নেই, ও সন্ধেবেলা গালফেরেন্ডের সঙ্গে মাঠে ঘুরতে বেরিয়েছিল৷ সবাইকে পেনাল্টি মারতে দেখে ওর নিজেরও ইচ্ছে হয়েছিল তাই ক-টা মেরেছে৷ ফুটবল খেলতে গেলে বিস্তর দৌড়োদৌড়ি করতে হয়৷ ওসবে ওর আগ্রহ নেই তেমন৷

হাজার বলা-কওয়া করেও ওকে রাজি করানো গেল না৷ সাধাসাধি করে ওর বাড়ির ঠিকানাটুকু কেবল জোগাড় করতে পারল দিলু৷ পরে না হয় গিয়ে আর-একপ্রস্থ যোগাযোগ করা যেতে পারে৷

গালফেরেন্ডের সঙ্গে আবার মাঠের ভিতরে হারিয়ে গেল নাজু৷ দিলু মনে মনে ঠিক করে নিল, যে করেই হোক এ ছেলেকে বাদাবন অগ্রগামীতে খেলাতেই হবে৷ বাদাবনের বেকহ্যামের হাত ধরেই ট্রফি আসবে ক্লাবে৷ কিন্তু কীসের লোভ দেখানো যায় নাড়ুকে? টাকাপয়সা তো ক্লাবের পকেটেও তেমন নেই৷ তাহলে?

দিলীপ পাল ওরফে দিলুর বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি৷ বছর পাঁচেক আগে অবধিও খেলাধুলোর মতো বল ছিল গায়ে৷ বাদাবনের এক নম্বর সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিল৷ কিন্তু দিলু বসে যাওয়ার পর থেকেই বাদাবনের অ্যাগ্রেসিভ ফুটবলে যেন হাহাকার নেমে আসে৷ নবেন্দু তালকানা, নিলুর ছোকরা বয়স, অভিজ্ঞতার অভাব৷ একমাত্র ঘন ডিফেন্সের জোরে কোনওরকমে ফাইনাল অবধি পৌঁছে গিয়েছে এতদিন৷ দিলু খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর ক্লাবের কোচ-কাম-ম্যানেজার হয়েছে৷

পরদিন প্যাকটিসে এসে কিন্তু আর দেখা গেল না নাড়ুকে৷ সন্ধে পর্যন্ত অপেক্ষা করল দিলু৷ নাড়ুর দেখা নেই৷ দিলু মনে মনে ভাবল, ছেলেটাকে দলে টানতে গেলে আগে ওর মন বুঝতে হবে৷ ও যেটা চাইছে, ঠিক সেইটার লোভ দেখালেই সুড়সুড় করে আসবে ও৷

তিনদিনের দিন একটু আগেভাগেই প্যাকটিস শেষ করে দিল দিলু৷ নিলু আর নিয়োগীকে একটু ধারে টেনে এনে বলল, ‘তোরা দু-জন আমার সঙ্গে আয় একটু৷’

‘কোথায় যাবে?’ নিলু জিজ্ঞেস করল৷

‘একজনের ব্যাপারে একটু খোঁজ নিতে হবে৷’

মাঠ থেকে বেরিয়ে ঠিকানাটা খুঁজতে বেশি দেরি হল না দিলুর৷ নাড়ুগোপাল পোদ্দার, ঘাটাপাড়া, গোবরবস্তি৷ বস্তি ঠিক বলা যায় না, বোঝা যায়, বছর পাঁচেক আগে অবধি জায়গাটায় একটা বস্তিজাতীয় কিছু ছিল, সেসব উঠে গিয়ে ছোটোছোটো কয়েকটা বাড়ি তৈরি হয়েছে৷ এইগুলোর মধ্যেই কোনও একটায় থাকে নাড়ুগোপাল পোদ্দার৷ কিন্তু আগেভাগে সেখানে হানা দেয় না দিলু৷ একটু দূরেই একটা পান-বিড়ির গুমটি আছে, নিয়োগী আর নিলুকে নিয়ে সেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়৷

‘কাকা, একটা গোল্ড ফ্লেক দেখি৷’

বছর চল্লিশের দোকানদার ঢুলুঢুলু চোখে একটা সিগারেট এগিয়ে দেয়, দিলু সেটা ধরাতে ধরাতে বাকি দু-জনকে দেখিয়ে বলে, ‘এদের একটা করে ক্রিম রোল৷’

কাচের বয়াম খুলে ক্রিম রোল এগিয়ে দেয় দোকানদার৷ দিলু ধোঁয়া ছেড়ে বলে, ‘নাড়ুগোপালের বাড়ি কোনটা জানেন?’

দোকানদারের ঢুলুঢুলু চোখ হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে যায়, ‘আবার কী করে এসেছে চুল্লুর ব্যাটা?’

দিলু একটু থতমত খায়, ‘চুল্লুর ব্যাটা কে?’

‘কে আবার, ওই যে যার নাম বললেন৷ ওর বাপটা তো চুল্লু খেয়ে খেয়ে পেটে আলসার না পালসার কী যেন বাঁধিয়ে বসেছে৷’

‘পালসার তো মোটরবাইক, আলসার বলুন৷’

‘ওই হল৷’

‘কী করেছে নাড়ুগোপাল?’ মুখ থেকে ক্রিম রোল সরিয়ে নিলু জিজ্ঞেস করে৷

‘কী করেনি বলো৷ বেপাড়ায় মারপিট করেছে, কাদের যেন ঘুসিয়ে দাঁত ফেলে দিয়ে এসেছে, মুকুন্দদার ছেলের পাছায় এমন লাথি মেরেছিল যে, সে আর চলতে পারত না, পেচন ঘষটে ঘষটে যেত-আসত এই দোকানের সামনে দিয়ে৷ অচেনা ছেলেপিলে এসে চুল্লুর ব্যাটার খোঁজ করলেই বুঝি, কোথাও ঘোঁটলা পাকিয়েছে নির্ঘাত!’

নিয়োগীর হাত থেকে ক্রিম রোল খসে পড়ছিল প্রায়, সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু কেন?’

‘কেন, সে আমি কী জানি, ওকেই জিজ্ঞেস করুন৷’ তারপর তিনজনকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে দোকানদার বলে, ‘তো আপনাদের কারও তো হাত-পা ভাঙা দেখছি না৷ পেছন ঘষটেও চলছেন না৷ কী ব্যাপার বলুন তো?’

দিলু হাসে, ‘আজ্ঞে না না৷ ওসব কিছু না৷ আমাদের ক্লাবে আসলে খেলাতে চাই ওকে৷’

‘কী খেলা? কুস্তি?’

‘ফুটবল৷’

খ্যাঁ খ্যাঁ করে হেসে ওঠে দোকানদার, ‘তাহলেই হয়েছে৷ কারও উপর মাথা গরম করে পেচনে একখানা লাথি কষালেই…’

দোকান ছেড়ে বাড়িগুলোর দিকে আসতে আসতে চিন্তিত দেখায় দিলুকে, নিয়োগী সেদিকে তাকিয়ে বলে, ‘এ যা রগচটা ছেলে দেখছি, মিনিট দশেকের মধ্যেই তো লাল কার্ড খেয়ে বাইরে চলে যাবে৷’

‘শুধু তা-ই নয় রে৷ রেগে গিয়ে অপোনেন্টের কাউকে বেকায়দায় মেরে ইনজিওর করে দিলে আমাদের নমিনেশন ক্যানসেল করেই বের করে দেবে মাঠ থেকে…’

‘তাহলে?’

‘ভাবছি, সেকেন্ড হাফে নামাব৷ গোলকিপারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে বলব না হয়৷’

নিলুর দিকে চেয়ে বলে, ‘তোরা একটু গায়ে টোকা লাগলেই মাঠে গড়িয়ে যাবি৷ গোটা পাঁচেক ফ্রি-কিক জোগাড় করতেই হবে, বুঝলি?’

নিলু ঘাড় নেড়ে দেয়৷ বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ায় তিনজনে৷ বাইরে কলপাড়ে এক মাঝবয়সি মহিলা কাপড় ধুচ্ছিলেন, দিলুই এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘নাড়ুগোপাল পোদ্দারের বাড়ি এটা?’

একটা লুঙ্গি হাওয়ায় তুলে বার দুয়েক আছাড় মেরে মহিলা বলে, ‘বেশ করেছে৷ মুকুন্দর মাতাল ছেলেটা মদ খেয়ে মেয়েছেলেদের সঙ্গে ধাষ্টামি করেছিল, মেরে ধুনুচি নাচিয়ে দিয়েছে, বেশ করেছে৷ তোদের ক-টা বাপ আছে, আমিও দেখব৷’

‘একটা করে বাপ আর একটা ক্লাব আছে বউদি৷’ মিনমিন করে বলে দিলু, ‘ইয়ে… বাদাবন অগ্রগামী৷ চেঁদোবাবু কাপে আমরা ওকে খেলাতে চাই একটু৷’

একটু নরম হন মহিলা৷ আছাড়ের বদলে মৃদু হাতে যেন আদর করতে থাকেন হাতের কাপড়টাকে, ‘অ… মুকুন্দ পাঠায়নি তোমাদের?’

‘আজ্ঞে, তাকে তো আমরা চিনিই না৷’

‘তা না-চেনাই ভালো৷ কচি কচি ফুলের মতো ছেলে সব তোমরা…’

নিলু আর নিয়োগী একটু চোখ চাওয়াচাওয়ি করে৷

দিলু ফিসফিস করে বলে, ‘হ্যাঁ, এই মাত্র ছিঁড়ে আনলাম গাছ থেকে৷’

‘তা যাও বাছা, নাড়ু ভেতরে আছে৷’

ভিতরে পা দেওয়ার আগেই কিন্তু একটা ঢ্যাঙা চেহারার লোক দরজা আগলে দাঁড়ায়, ভুরু তুলে তাকিয়ে তরল গলায় বলে, ‘এই ছোকরা, তুমি সেই নাটুবাবুর শুঁড়িখানায় কাজ করো না? কই, মালের বোতল কই? বের কর শালা৷’

নিয়োগী বিড়বিড় করে, ‘এই মনে হয় চুল্লু, কিন্তু তোমার থেকে মদ চাইছে কেন বলো তো?’

‘ইয়ে, আপনি ভুল করছেন মেসোমশাই৷ আমরা মদ বেচি না৷’

‘তাহলে বেরিয়ে যা হারামজাদারা বাড়ি থেকে৷ মাল ছাড়া এ বাড়িতে কোনও শালাকে ঢুকতে দেব না৷’

‘ওরে ছোটোলোকের জাত…’ এবার রণচণ্ডী মূর্তি ধরেন মহিলা, ‘ধরে ধরে না নিয়ে গেলে হাগা-মোতার সাধ্যি নেই, আবার ঢুকতে দেবে না৷ দাঁড়া, আমার ছেলেকে বলে তোর পেছনে এমন লাথি মারাব…’ পেছনে হাত দিয়ে ধীরে ধীরে সরে পড়ে লোকটা, বিড়বিড় করে বলে, ‘মাল খেইচি বলেই না এমন ছেলে জন্ম দিতে পেরিচি…’

ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকে আসে তিনজনে৷ বাইরে হাঁকডাক শুনে বেরিয়ে এসেছিল নাড়ু৷ সে ওদের তিনজনকে দেখে ভুরু তুলে একবার চেনার চেষ্টা করে, তারপর বলে, ‘ও আপনারা৷ আমি তো বলে এসেছিলুম, ফুটবল আমি খেলব না৷’

‘আহা! বেশিক্ষণ তো খেলতে হবে না তোমাকে৷ এই ধরো মিনিট তিরিশেক…’ নিয়োগীকে দেখায় দিলু, ‘এর পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে সারাক্ষণ, আর ফ্রি-কিক পেলে শুধু মেরে দিয়ে আসবে৷’

নাড়ু আবার ভুরু তোলে, ‘লোকে টিটকিরি দেবে না তো?’

‘যে দেবে, তার মাথা ভেঙে দেব না আমরা?’ নিলু গর্জে ওঠে৷ নিয়োগী নরম গলায় বলে, ‘ইয়ে… আমরাই দায়িত্ব নিয়ে ভেঙে দেব৷ তোমাকে আবার ভাঙতে যেতে হবে না৷’

‘আর আমার গালফেরেন্ড?’

দিলু থমকায়, ‘মানে তাকেও কি খেলতে দিতে হবে?’

‘না৷ সামনের সারিতে বসতে দিতে হবে৷’

‘এ আর এমন কী কথা৷’

‘গোলপোস্টের পেছনে বসতে দিতে হবে৷ না হলে গালফেরেন্ডের মুখে বল লাগলে কিন্তু আমি…’

‘পেছনে লাথি মেরে…’ বাকি কথাটা শেষ করে নিলু৷

‘তুমি যা চাইছ তা-ই হবে ভাই৷ শুধু একটি ম্যাচ, খালি ওই ফাইনালটা একটু উতরে দাও আমাদের৷’

নিয়োগী চাপাস্বরে আপত্তি জানায়, ‘ওকে বাকি ম্যাচেও চাই দিলুদা৷’

দিলু ধমকায়, ‘তুই চুপ কর৷ মার পেটে পড়ে কোনও গোলকিপারের ভালোমন্দ কিছু হলে ফাইনালের আগেই টুর্নামেন্ট ক্যানসেল হয়ে যাবে৷’

‘ঠিক আছে, খেলব৷’

ভেবে-চিন্তে জানায় নাড়ু, ‘কিন্তু আর-একটা জিনিস চাই আমার৷’

‘কী?’

‘সবার সামনে বলব না৷ আপনার আর আমার প্রাইভেট ডিল৷’ এগিয়ে যায় দিলু৷ নাড়ু বেঁটেখাটো মানুষ৷ বেশ খানিকটা নীচু হয়ে ওর মুখের কাছে কান আনতে হয় দিলুকে৷ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে নাড়ু৷ সেটা শুনে ছায়া নামে দিলুর মুখে৷ উত্তর দিতে প্রায় তিন মিনিট সময় নেয়৷ তারপর বলে, ‘ঠিক আছে৷ তা-ই হবে৷’

ফেরার পথে আর একটাও কথা বলে না দিলু৷ নিলু আর নিয়োগী বারকয়েক ওকে জিজ্ঞেস করে, ঠিক কী চেয়েছে নাড়ুগোপাল পোদ্দার৷ জবাবে সে শুধু জানায়, ‘উঁহুঁ, প্রাইভেট ডিল, শুনলি না? এক্ষুনি যদি পাঁচকান করি তাহলে ও আমার…’

টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার দিন পাঁচেক আগে বলা-কওয়া করে একবার ক্লাবে প্যাকটিসে আনা হয় নাড়ুকে৷ দিলু একটা খাতায় হিসেব রাখে ওর খেলাধুলার৷ দৌড়োদৌড়ি- শূন্য, ডিফেন্স শূন্য, থ্রু বল বাড়ানো- শূন্য, ট্যাকল করতে দেওয়া যাবে না ইত্যাদি৷ বিশেষ লাভ হল না এতে৷ ফাঁকা গোলে দূর থেকে বারকয়েক শট মারানো হল তাকে দিয়ে৷ টুর্নামেন্টের আগে নিয়োগী ইনজিওরড হয়ে গেলে আবার আতান্তরে পড়তে হবে৷

ঘটা করে টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে গেল৷ প্রথমে গ্রুপের খেলা৷ সেটা হাসতে হাসতে টপকে গেল বাদাবন৷ নিলু একাই তিন ম্যাচে সাতটা গোল করল৷ বোঝা গেল, এতদিনে ওর অভিজ্ঞতা আর পায়ের জোর দুটোই খানিক বেড়েছে৷ দিলু ম্যাচ শেষে ওর পিঠ চাপড়ে দিল৷

নকআউটে খানিক নড়বড় করলেও সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল বাদাবন৷ ম্যাচ গড়াল পেনাল্টি শুটআউটে৷ নিয়োগী তেড়েফুঁড়ে উঠল সেদিন৷ পাঁচটার মধ্যে তিনটে শট হাতি আগলে বাঁচিয়ে দিল৷ ম্যাচ জেতার পর ওকে কাঁধে নিয়ে নাচানাচি করল বাদাবনের সাপোর্টাররা৷ তবে এত কিছুর মাঝে কেউ কেউ বলল, প্রতিবছরের ন্যায় এবারেও ফাইনালে ডুবতে চলেছে বাদাবন৷ অদ্যই শেষ রজনী৷ সেসব কানে যেতে বাঁকা হাসি হাসল দিলু৷ তুরুপের আসল তাসটি তো এখনও বাকি৷

বাদাবনের বেকহ্যামের কথা কারও কানে যায়নি এখনও৷ ফাইনালেই নামবে সেই চমক৷ বিপক্ষে হারানিধি স্পোর্টিং-এর কিপার কামাখ্যাপ্রসাদের কথা ভেবে মনে মনে খানিক মায়াই লাগল ওর৷ সেমিফাইনালের তিনদিন পরেই ফাইনাল৷ পরদিন সকাল হতেই ঘাটাপাড়া গোবরবস্তিতে ছুটল দিলু৷ আজেবাজে খেয়ে নাড়ুর পেট খারাপ হলেই মুশকিল৷ বাদাবনের ফাইনালিস্ট টিমের সে-ই যে নীলমণি, সেটা নাড়ুর মনেও নেই হয়তো৷

ওর বাড়ি গিয়ে শুনল, নাড়ু নাকি ভোরবেলা কোথায় একটা বেরিয়েছে৷ কখন ফিরবে, ওর মা বলতে পারল না৷ দিলু অনেকক্ষণ বসে-টসে থেকে অবশেষে মায়ের কাছেই কিছু চিরকুট লিখে দিয়ে চলে এল৷ মনের ভিতরে চিন্তাটা রয়েই গেল ওর৷ ফাইনালের দিন যদি নাড়ুর মুড বিগড়ে যায়? যদি খেলতে না আসে? দিলু জানে, ওকে ছাড়া বাদাবনের ফাইনাল জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ৷ দুরুদুরু বুকেই ক-টা দিন নার্ভের সঙ্গে যুদ্ধ করল ও৷

অবশেষে এসে গেল সেই কালান্তক ফাইনাল৷ তবে সকালে মাঠে যেতেই দিলুর মনটা খুশি হয়ে গেল৷ নাড়ু নিজে থেকেই এসে বসে আছে মাঠের একপ্রান্তে৷ দৌড়ে গিয়ে ওর পিঠ চাপড়ে দিল দিলু৷ নাড়ু একটুও না হেসে বলল, ‘যেটা বলেছিলেন, সেটা মনে আছে তো?’

‘মনে তো আছেই… চিন্তার কিছু নেই তোমার৷’

‘ক-টা থেকে খেলা?’

‘দুপুর দুটো থেকে শুরু৷’

‘রোদ থাকবে তো৷’ নাড়ু বিরক্ত হয়৷

‘আহা, তুমি তো ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকবে৷’

‘আমার কথা বলছি না৷ আমার গালফেরেন্ড…’

দিলু একটু ভাবনায় পড়ল৷ দর্শকাসনের উপরে রোদ পড়বে দুপুরবেলা৷ বিশেষ করে গোলপোস্টের পিছনের জায়গাটা৷ খানিক ভেবে-চিন্তে সে বলল, ‘আচ্ছা, আমি একটা গোল টুপি আর সানগ্লাসের ব্যবস্থা করছি না হয়, চলবে?’

‘করুন৷ আমি দুটোয় খেয়েদেয়ে আসব৷’

কথাটা বলেই হনহন করে মাঠ ছেড়ে হাঁটা দিল নাড়ুগোপাল পোদ্দার৷ দিলু ওকে আটকাল না৷ কী দরকার রাগিয়ে? ওকে তো প্রথম থেকে নামানো হবে না৷ দুটোয় এলেও মিনিট চল্লিশেক সময় থাকবে৷

দুটোর সময় যখন খেলা শুরুর বাঁশি বাজল তখন দর্শকাসনের দিকে একবার চাইল দিলু৷ গালফেরেন্ডটি এসে গিয়েছে৷ সানগ্লাস আর টুপি পরে বসে আছে নিজের জায়গায়৷ নাড়ুগোপালও জুতো-মোজা পরছে মনে হয়৷ দিলু একবার ওর কাছে গিয়ে বলল, ‘সব ঠিকঠাক তো?’

‘খাসির মাংস-ভাত খেয়ে পেটটা একটু আইঢাই করছে৷ তা ছাড়া কোনও অসুবিধা নেই৷’ নাড়ু খুশি-খুশি গলায় বলে৷

ফার্স্ট হাফে একটাও গোল হয় না৷ কামাখ্যাপ্রসাদ যেন দৈত্য রাজার বংশধর৷ লম্বায় সাড়ে ছ-ফুট৷ তেমন তাগড়াই বলিষ্ঠ চেহারা৷ বল যেন গোলে ঢোকার আগে ওর কাছে বারকয়েক অনুমতি চায়৷ নিলু ফাঁকা পেয়ে সজোরে মেরেছিল কয়েকবার৷ কিন্তু চিনের পাঁচিলের মতো অবলীলায় সেসব ফিরিয়ে দিয়েছে কামাখ্যাপ্রসাদ৷ দিলুর মনেও সন্দেহ জাগে, নাড়ুগোপাল একেও কি জালে জড়াতে পারবে? কে জানে…

সেকেন্ড হাফে প্রথম দশ মিনিটেও গোল নেই৷ হারানিধি স্পোর্টিং-এর অ্যাটাক এমন কিছু আহামরি নয়৷ কিন্তু গোলের সামনে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা কামাখ্যাকে টপকে বল যেতে পারছে না৷

ষাট মিনিটের মাথায় বুক ঠুকে মিডফিল্ডার ঘোতনাকে তুলে নিয়ে নাড়ুগোপালকে নামিয়ে দিল দিলু৷ দর্শকরা থমকে থাকল কিছুক্ষণ৷ এ আবার কে? সারা টুর্নামেন্ট পরে ফাইনালে নতুন প্লেয়ার নামছে৷ তা-ও আবার এমন বেঁটেখাটো গোলগাল চেহারার?

কথামতো গোলপোস্টের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নাড়ু৷ দিলুর পাশে বসা ক্লাবের সভাপতি মলয়বাবু চাপাস্বরে বললেন, ‘এ ছোকরা আবার কে হে, কোন পজিশনে খেলছে?’

‘আজ্ঞে, পজিশনটা বড়ো কথা নয়, মলয়দা৷ এ ছেলে শুধু ফ্রি-কিক আর পেনাল্টি মারতে পারে৷’

মলয়বাবু ঠোঁট ওলটালেন, ‘কী জানি বাবা! গোলকিপারের পাশে এমন গ্যাঁট হয়ে আছে যে মনে হচ্ছে দুটো গোলকিপার খেলছে আমাদের৷’ আজকের রেফারিটি কিন্তু ধুরন্ধর৷ নির্দেশমতো সামান্য ছোঁয়াটুকু লাগলেই গড়িয়ে পড়ছে নিলু আর নবেন্দু৷ কিন্তু ছলচাতুরি একেবারে সহ্য করছেন না রেফারি৷ শেষে ঊনসত্তর মিনিটের মাথায় একটা ফ্রি কিক পাওয়া গেল৷ গোলপোস্টের থেকে মিটার তিরিশেক দূরে৷

আর-একটু হলেই লাফিয়ে উঠেছিল দিলু৷ নিজেকে সংবরণ করল ও৷ গোলটা হলেই লাফানো যাবে না হয়৷

বীরবিক্রমে এগিয়ে গেল নাড়ুগোপাল পোদ্দার৷ বাদাবনের প্লেয়ারদের কয়েকজন ওর পিঠ চাপড়ে দিল৷

কামাখ্যা ক্রুশবিদ্ধ জিশুর মতো হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়েছে গোলের কাছে৷ বল মাটিতে রেখে ফুট তিনেক দূরে সরে দাঁড়াল নাড়ু৷ রেফারির বাঁশি বাজতেই দৌড়ে গিয়ে লাথিয়ে দিল বলে৷ দিলুর দু-হাত নিজে থেকেই উপরে উঠে এসেছিল, সেটা মাথায় নেমে এল৷

কোথায় কী? উড়ন্ত পালকের মতো কচ্ছপ গতিতে গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে গেল বল৷ কামাখ্যা একহাতে ধরে নিল সেটা৷ তারপর ছুঁড়ে দিল ডিফেন্ডারের পায়ের কাছে৷

দিলুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল৷ নাড়ুগোপালের ম্যাজিক কাজ করছে না তাহলে… নিলুও হতবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ছিল দিলুর দিকে৷ দু-জনের চোখেই হতাশা৷

নাঃ, একবার তো বেকহ্যামেরও ভুল হয়, নতুন আশায় বুক বাঁধল দিলু৷ আশি মিনিটের মাথায় পেনাল্টি বক্সের ভিতরেই নবেন্দুকে ঠেলে ফেলে দিল কেউ— পেনাল্টি৷

এবার নিশ্চিত গোল হবে৷ ফ্রি-কিক দূর থেকে মারতে হয়৷ মাঝে অনেক প্লেয়ার থাকে, কিন্তু পেনাল্টিতে সেসব বালাই নেই৷ এবার কামাখ্যাকে উড়িয়ে দেবে নাড়ুগোপাল৷

কিন্তু না, গোলপোস্টের উপর দিয়ে বল উড়িয়ে দিল নাড়ুগোপাল৷ মিস! নাড়ুগোপাল আজ সত্যি ডাহা ফেল৷ সভাপতি কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন দিলুর দিকে৷ দিলুর মনে হল, মাঠ ছেড়ে এখন পালাতে পারলে বাঁচে৷ এ খেলা নির্ঘাত পেনাল্টি শুটআউটে যাবে৷ আর কামাখ্যা যেভাবে রসগোল্লার মতো বল ধরছে, তাতে বাদাবনের খেলা কিংবা না-খেলা একই ব্যাপার৷

খেলা এক্সট্রা টাইমে যেতে আরও একটা ফ্রি-কিক পেল বাদাবন৷ আবার লাভ হল না তাতে৷ একই রকম নরম গতিতে বল ভেসে এল গোলের দিকে৷

খেলা পেনাল্টি শুটআউট চলে গেল৷

অনেকক্ষণ থেকে একটা ব্যাপার মাথায় ঘোরাফেরা করছে দিলুর৷ নাড়ুর ম্যাজিক কাজ করছে না কেন? একবার তাকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেসও করল৷

সে ঠোঁট উলটে বলল, ‘জানি না৷ মারছি তো জোর৷ কাজ হচ্ছে না একদম৷’

দিলু প্রাণপণে ভাবতে লাগল৷ মনস্তত্ত্ব, খেলোয়াড়ের মনস্তত্ত্বটাই আসল, নিশ্চয়ই কিছু একটা কারণ আছে, সেটা উদ্ধার করতে না পারলে নাড়ুকে দিয়ে গোল করানো যাবে না৷ কী হতে পারে?

ভাবতে ভাবতে বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মাথায় খেলে গেল ওর৷

হ্যাঁ… সমাধান পেয়ে গিয়েছে ও… নাড়ুর পা-দুটোকে জাগিয়ে তোলার মন্ত্র পেয়ে গিয়েছে ও…

পেনাল্টি মারার জন্য রেডি হচ্ছিল নাড়ু৷ দিলু গিয়ে বাধা দিল, ‘নিলু আগে মারবে৷ তুই শেষে মারবি৷ আর সানগ্লাস পরে মারবি৷’

নাড়ু খুব একটা আপত্তি করল না৷ নিলু পাশ থেকে ঝাঁজিয়ে উঠল, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? সানগ্লাস পরে পেনাল্টি মারবে?’

‘হ্যাঁ মারবে৷ আমি বলছি, মারবে৷’

‘কিন্তু কেন?’ পাশ থেকে অন্য কেউ বলে ওঠে৷

‘তাহলে ও কোনদিকে তাকাচ্ছে, বুঝতে পারবে না কামাখ্যা৷’

নিয়োগী আপত্তি করে এবার, ‘তুমি কি সব ভুলে গেলে দিলুদা? ও ডাঁয়ে-বাঁয়ে কোনওদিকে মারে না৷ সোজা গোলকিপারের গায়ে মারে৷’

‘তুই কোচ না আমি কোচ? যা বলছি তা-ই করো নাড়ু৷ তুমি সানগ্লাস পরো৷ নিয়োগী, তোকে সব ক-টা শট বাঁচাতে হবে৷ নাড়ুর গোলেই জিতব আমরা৷ ও গোল করবেই৷’

গালফেরেন্ডের থেকে সানগ্লাস ধার করে চোখে গলাল নাড়ু৷ ভালোমতো রোদ আছে এখনও৷ চোখে খানিক আরামই লাগল ওর৷

পেনাল্টি সেভ করার যেন হিড়িক পড়ে গেল৷ নিয়োগী হারানিধির পাঁচটা শটের সব ক-টাই বাঁচিয়ে দিল৷ ওদিকে কামাখ্যাও চারটে আটকেছে৷ পাঁচ নম্বর শটে গোল হলে বাদাবন জিতবে, না হলে আবার শুরু হবে শুটআউট৷ পাঁচ নম্বর শট মারতে সানগ্লাস পরে এগিয়ে গেল নাড়ু৷ মাঠে হাসাহাসির ঝড় উঠেছে৷ মলয়বাবু দেঁতো হাসি হেসে বললেন, ‘এমনিতেই তো তালকানা, সানগ্লাস পরে একেবারেই হয়ে গিয়েছে মনে হয়৷’

কামাখ্যা আবার হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল গোলের কাছে৷ নাড়ু চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে কিছুটা পিছিয়ে এল৷ বাঁশি বাজল, দৌড় শুরু করল নাড়ুগোপাল৷

কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে দিলু দেখল, গোলপোস্টের ভিতরের জালে বেবাক মশার মতো আটকে গিয়েছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ কামাখ্যাপ্রসাদ, দু-হাতে পেট চেপে ধরে ছটফট করছে ও৷ কেবল হাতে ধরা আছে কামানের গোলাস্বরূপ একটা ফুটবল৷ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বল ও গোলকিপারকে একসঙ্গে গোলে ঢুকিয়ে দিয়েছে নাড়ুগোপাল৷

পাঁচ বছর পর বাদাবনের দর্শকের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে৷ বাধা-টাধা টপকে তারা পিলপিলিয়ে ঢুকে আসছে মাঠের ভিতরে৷ তাদের মধ্যে কেউ কেউ কাঁধে তুলে নিয়েছে নাড়ুগোপালকে৷ মলয়বাবু বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন, মিনমিনিয়ে বললেন, ‘ছোকরার ওটা পা না রকেট লঞ্চার? কে বলো তো ছেলেটি?’

‘আমাদের বাদাবনের বেকহ্যাম৷’ মুচকি হাসি হেসে বলে দিলু৷ আধ ঘণ্টা পরে ড্রেসিং রুমে প্লেয়ারদের সঙ্গে খানিক জড়াজড়ির পর উত্তেজনাটা কমে আসে দিলুর৷ বাইরে এতক্ষণে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন শুরু হয়েছে৷ নাড়ু তার গালফেরেন্ডের সঙ্গে মাঠের এককোণে বসেই গল্পসল্প করছে৷

নিলু আর নিয়োগী ড্রেসিং রুমেই চেপে ধরে দিলুকে, ‘তুমি শালা কী ম্যাজিক করলে বলো তো? সানগ্লাস পরে মানুষের পায়ে এত জোর চলে আসে নাকি?’

দিলু মাথা নাড়ে, ‘পায়ের জোরটা বড়ো কথা নয় রে, আসল হল মনের জোর৷ মনের ভিতরে সেই তাগিদটা আনলে খোঁড়াও পাহাড় জয় করতে পারে৷’

‘সেটার সঙ্গেই বা সানগ্লাসের কী সম্পর্ক?’

দিলু ঘুরে বসে, ‘আচ্ছা, তোদের বলেই দিই৷ এক্সট্রা টাইমেও যখন নাড়ুর পা চলল না তখন বুঝলাম, আজ কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে৷ ওর মনের ভিতরে অন্যদিন কিছু একটা কাজ করে, যেটা আজ করছে না, সেটা কী হতে পারে, ভাবতে বসলাম৷ এবার ভেবে দেখ, নাড়ুর ব্যাপারে আমরা কী কী জানি৷ ‘গালফেরেন্ডকে নিয়ে একটা স্ট্রং জায়গা আছে ওর৷ তার সঙ্গে কিছু ইতরামি করেছিল বলেই মুকুন্দর ছেলেকে ঠেঙিয়েছিল৷ সেদিন ওর মা আমাকে বলছিল, ওর থেকে লম্বা ছেলেদের সঙ্গে নাকি মাঝেমধ্যেই হাতাহাতি করে নাড়ু, কিন্তু কেন?’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে নিজেই উত্তরটা দেয় দিলু, ‘কারণ নাড়ু বেঁটেখাটো৷ ওর গালফেরেন্ডের হয়তো লম্বা ছেলেদের উপর খানিক দুর্বলতা আছে৷ এদিকে ফুটবল মাঠে যারা একটু লম্বা, তারাই সাধারণত গোলকিপার হয়৷ নাড়ু দ্যাখে, ওর গালফেরেন্ড গোলকিপারের দিকে তাকিয়ে আছে৷ ব্যস, ওর মাথা গরম হয়ে যায়৷ অকারণে তো আর মারধর করা যায় না, তাই বল মারার বাহানায়…’

‘মানে এই কারণেই সেদিন পেনাল্টি মারতে এসেছিল নিজে থেকে?’

নিয়োগী আতঙ্কিত গলায় বলে৷

‘হ্যাঁ৷ আজ কামাখ্যাকে অনেক আগেই ঘায়েল করত৷ কিন্তু একটা মুশকিল হয়েছিল আজ৷ ওঁর গালফেরেন্ডটি আজ সানগ্লাস পরেছিল৷ ফলে সে কোনদিকে চেয়ে আছে নাড়ু বুঝতে পারেনি৷ স্বভাবতই রাগও হয়নি৷

‘কিন্তু ওকে সানগ্লাস পরিয়ে…’ কথার মাঝেই থেমে যায় নিলু৷

‘ওকে সানগ্লাস পরিয়ে আমার কোনও লাভ হয়নি৷ লাভ হয়েছে মেয়েটার চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে৷ এই মাঠের মাঝে আর কোথায় সানগ্লাস পাবে নাড়ু, অগত্যা গালফেরেন্ডের থেকেই ধার করতে হবে৷ তোরা যতক্ষণ পেনাল্টি মারছিলি, ততক্ষণ ও দেখে নিয়েছে, মেয়েটার চোখ কোথায় ঘুরছে৷ ব্যস৷ বলের ঘায়ে কামাখ্যাপ্রসাদের পিণ্ডি দিয়েছে চটকে!’ নিলু আর নিয়োগী দু-জনের মুখই হাঁ হয়ে গিয়েছিল৷ অবাক হয়ে ওরা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল দিলুর দিকে৷

বাইরে এতক্ষণে মাইক বাজতে শুরু করেছে৷ নিলু ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট হয়েছে৷ আর চেঁদোবাবু ট্রফি যাচ্ছে বাদাবনের হাতে৷

মলয়বাবু এগিয়ে যাচ্ছিলেন ট্রফি নিতে৷ দিলু থামিয়ে দেয় ওঁকে৷ নিজেই দ্রুত মঞ্চে উঠে ট্রফি হাতে নিয়ে নেমে আসে সুড়সুড় করে৷ নাড়ুগোপাল এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে, ওর হাতেই ট্রফিটা ধরিয়ে দেয় দিলু৷

‘এটা কী হল?’ মলয়বাবু প্রতিবাদ করে ওঠেন৷

‘এই বছর ট্রফিটা ক্লাবে সাজানো যাবে না, মলয়দা৷ নাড়ুগোপালের গালফেরেন্ডের নাকি ভারী পছন্দ ওটা৷ তার উপরে আজ আবার ওর জন্মদিন৷ শর্ত অনুযায়ী ওটা ওর পড়ার টেবিলেই থাকবে৷’

মলয়বাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন৷ চুপ করে গেলেন৷ নাড়ুগোপাল এগোতে যাচ্ছিল, দিলু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ইয়ে… মাঝে মাঝে ইচ্ছা হলে আমাদের ক্লাবে এসো না হয়…’

‘বেশ আসব৷’

‘আর তোমার নামটা তো জেনেছি৷ ট্রফিটা যে পেল, মানে তোমার গালফেরেন্ডের নামটা তো জানাই হয়নি৷’

‘ভিট্টোরিয়া…’ কথাটা বলে মেয়েটার হাত ধরে হনহন করে হাঁটা দেয় নাড়ুগোপাল পোদ্দার৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *