1 of 2

বাদশা-বেগম ঝমঝমাঝম – সৌমিত্ৰশংকর দাশগুপ্ত

বাদশা-বেগম ঝমঝমাঝম – সৌমিত্ৰশংকর দাশগুপ্ত

শিশমহলে পা দিয়েই বাদশা প্রমাদ গুণলেন। বেলা দ্বিপ্রহর, খিদেয় পেট চুঁইছুঁই করছে। এ-সময়ে নাকে কোপ্তা কাবাবের গন্ধ এলেই তিনি খুশি হতেন, তার বদলে আতর আর গোলাপজলের খুশবুতে তার খালি পেট কেমন গুলিয়ে উঠল। এছাড়াও তাঁর কানে এল গগনভেদি সপ্তসুর যার সাতটি সুর সপ্তদিগন্তে ভেসে চলেছে, ‘সা’-এর সঙ্গে ‘রে’-এর কোন যোগাযোগ নেই, ‘গা’-এর সঙ্গে ‘মা’-এরও মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন দিগ্বিজয়ী বাদশা। হায়! সারা দুনিয়া জয় করে এসে শেষে কিনা নিজেরই মহলে খেয়ালি এক বেগমের পাল্লায় পড়ে তাকে অনাহারে মরতে হবে! স্ত্রী এমনই বিষম বস্তু!

মণিবেগম বাদশাকে দেখেই একমুখ হাসলেন। টকটকে ফর্সা রং, গালদুটি আপেলের মত, গোলগাল, নাদুসনুদুস চেহারা। দেখেই বোঝা যায়, ইনি খেতে এবং ঘুমোতে ভালবাসেন। বাদশা অবশ্য তার আরও একটি গুণের খবর রাখেন। বেগমের রান্নার হাত চমৎকার। শুধু খেতে নয়, খাওয়াতেও ভালবাসেন। সেজন্য খিদে পেলেই বাদশা মোতিমহল পার হয়ে শিশমহলে চলে আসেন। মোতিমহলে থাকেন তার আরেক বেগম। চুনিবেগম। তার কথা একটু পরে।

মণিবেগম বাদশাকে দেখে একমুখ হাসলেও বাদশার ভ্রূ কিন্তু কুঞ্চিত হয়েই রইল। সেভাবেই বললেন—’কি গাইছ?’

—ইমন, জনাব।

–ইমন! সে তত সন্ধের রাগ। এই বেলা দ্বিপ্রহরে…

মণিবেগম আবারও ছড়িয়ে হাসলেন। বললেন—জানি, মালিক। তবে ওস্তাদজি বলেন, দুপুরে সন্ধের অন্ধকার নামিয়ে আনতে পারলে তবেই না রেওয়াজের জোর।

বাদশা ভেতরে-ভেতরে ধৈর্য হারাচ্ছিলেন। তবে সময়টা দুপুর, পেটে খিদে এবং সামনে রন্ধনপটীয়সী বউ, তাই কোনক্রমে বাদশাহী মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বললেন—’গান গানই, ভোজবাজি তো নয়।‘

–‘ওস্তাদজি আমাকে সবসময় বিপরীতের চর্চা করতে বলেন। মণিবেগমের হাতে তানপুরা ঝংকার দিয়ে উঠল। বসন্তে গাইতে বলেন মল্লার, ভোরে দরবারি, রাতে মিঞা কে টোড়ি’…

-‘থামো, থামো।‘–খিদে এবং বেগমের বাক্যবাণে চোখে অন্ধকার দেখে দিগ্বিজয়ী বাদশা পারস্যের গালচের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন।

মণিবেগম আবারও মিষ্টি হেসে বলেন—’আপনাকে একটু ইমনের বন্দিশ শোনাই, খোদাবন্দ?’

ওফ্‌! বউ বোকা হলে সেই পুরুষের কি যে ঝঞ্জাট! নাকি বোকা নয়, হিংসুটি! বাদশা কোমরবন্ধে হাত রাখলেন। তলোয়ারে হাত ছোঁয়ালে মেজাজ মুহূর্তে গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু হায়! বেগমমহলে কবে আর কোন পুরুষ তলোয়ার নিয়ে ঢুকেছে!

ওদিকে মণিবেগম গলা ঝেড়ে, কানে হাত চেপে, চোখ বুজে বিশাল হাঁ করে সুর ধরে ফেলেছেন। দিগভ্রষ্ট সেই সুর শুনে বাদশারও হাঁ ক্রমশ বড় হতে-হতে তিনি প্রায় খাবি খাওয়ার অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছেন। তবে বাদশাহী রক্ত বলে কথা! থেকে থেকেই ছলকে উঠতে চায়। বাদশা তাই প্রথমে তার গুরুগম্ভীর গলায় গলা-খাঁকারি দিলেন। তাতেও কোন কাজ হলনা দেখে তার মনে হল বেগমের গলাটা টিপে ধরেন। সেখানে পরতে-পরতে চর্বি জমে আছে দেখে মনে-মনেই হাত গুটিয়ে নিয়ে এবার কূটবুদ্ধির প্রয়োগ করেন। বলেন, কেয়াবাৎ, কেয়াবাৎ।

মন্ত্রের মত কাজ হয়। বেগম কুর্নিশ করে তানপুরা নামিয়ে রাখেন। এবং বাদশা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে কাজের কথা পাড়েন।—আজ কি কি খানা পাকালে, বেগম?

প্রশ্ন শুনে বেগম বিস্ময়ে দুই চোখ বড় বড় করে বলেন—’অহ্ খোদা! আপনি মোতিমহল থেকে খানা সেরে আসেননি?’

বাদশার মাথায় বাদশাহী খুন চড়ে যায়। মনে-মনেই তিনি মণিবেগমের মুণ্ডচ্ছেদ করেন। এর বেশি আর কি-ই বা করতে পারেন? অথচ আজই দুপুরে দরবারে তিনি তিন-তিনটে দাগি চোরকে কোতল করার হুকুম দিয়ে এসেছেন। কিছু দূরে বেগমের পোষা বেড়ালটা লেজ গুটিয়ে পাপোষের ওপর বসে ছিল। খিদের চোটে বাদশা তার অভ্যস্ত কায়দায় দরবারি হুঙ্কার দিতে গিয়ে শোনেন, বেড়ালটা ভিজে ভিজে গলায় ডেকে ওঠে—ম্যাঁও!

প্রবল পরাক্রমশালী বাদশাও তাঁর দরবারি তর্জন-গর্জন ভুলে গিয়ে গোঁজ হয়ে অভিমানের সুরে বলেন—মোতিমহলে কবে আবার আমি খানা-পিনা করতে যাই?

সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল করে হেসে ওঠেন মণিবেগম। বাদশাও কোমরবন্ধে হাত রাখেন। আবারও তার খেয়াল হয় যে তলোয়ার নেই, বেগম তো দূরের কথা, বেগমের বেড়ালটাকেও কেটে ফেলবার সাধ্য তার নেই।

এবার থেকে অভ্যাসটা বদলে ফেলুন, জনাব! মণিবেগম হাসি-হাসি মুখে বলেন-শিশমহলে আসুন গানবাজনা শুনতে, আর খানা-পিনা সেরে আসুন মোতিমহলে।

উফ! অসহ্য! এই আওরত তো মোটেও বুরবাক নয়! বরং বাদশা যা সন্দেহ। করেছিলেন তাই। হিংসুটি!

কি কুক্ষণেই যে খোরাসান প্রদেশ জয় করতে গিয়ে চুনিবেগমকে নিকাহ্ করে এনেছিলেন বাদশা! নিকাহ যে গুনাহ্ হয়ে দাঁড়াবে একবারও যদি বুঝতেন!

ভাবতে-ভাবতেই আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি। কিসের গুনাহ্? তারা পুরুষ-পরম্পরায় বাদশাহ। বিজিত প্রদেশের নারী-লুণ্ঠন বীরধর্মেরই অঙ্গ। তিনি চুনিবেগমের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। অমন গান মণিবেগম সাত-জন্ম সাধনা করেও গাইতে পারবে না। তবুও তানপুরা নিয়ে ম্যা ম্যা করে চলেছে। অমন গানের তারিফ করবে ওর ওই পোষা বেড়াল। নাঃ, এই আওরত বুরবাকও বটে।

—’ওসব কথা ছাড়ো।’–বাদশা গলায় জোর আনার চেষ্টা করেন। চুনিবেগম রান্নাবান্নার কিছু জানে না।

—’তাই বুঝি?’—মণিবেগম বিলোল কটাক্ষ হানেন। তারপর বলেন—’তা শিখে নিতে বলুননা সুলতান? আমি যদি গানবাজনা শিখি, তবে চুনিবেগমও রান্নাবান্না…’

‘আঃ! কি যে বলোনা! সবাইকে দিয়ে সব কিছু হয় না।‘

—কেন হবে না? আমি যদি গাইতে পারি, তবে চুনিবেগমও রাঁধতে পারবে।

বাদশা মণিবেগমের শুধু মুণ্ডচ্ছেদ নয়, একেবারে কচুকাটা করেন। তবে সবটাই মনে-মনে। গরম হয়ে বলেন–দ্যাখো বেগম, দুপুরে খানাপিনার সময় এসব কথা কাটাকাটি আমার ভাল লাগেনা কিন্তু! বলি, নিজের জন্যও তো কিছু বেঁধেছ, না কি? তার থেকেই আমার খানার বন্দোবস্ত করো। দিবানিদ্রার সময় পার হতে গেল।

—অয় খোদা! কি যে বলেন! আমি আর এখন রাঁধি কোথায়? আমি তো শুধু গাই!

–তোবা, তোবা।–বাদশাহের পেটের আগুন তার চোখের তারায় ঝলসে ওঠে। নাঃ, এর চেয়ে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়াও ভাল। ইস্পাহান প্রদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই একটা খিটিমিটি চলছে। এই ভরদুপুরেই বেরিয়ে পড়া যাক। পথের মাঝে দু-পাঁচটা সরাইখানা লুণ্ঠন করলেই খানার ব্যবস্থাটা হয়ে যাবে। ভাবতে-ভাবতেই বীররক্ত ছলকে ওঠায় এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়েন সম্রাট।

মণিবেগম কোন ব্যস্ততা দেখান না। গালে হাত দিয়ে চোখ বড়বড় করে বলেন—আরে, চললেন কোথায়?

এই ভর দুপুরে ‘দিগ্বিজয়ে’ বললে হাস্যকর শোনাবে, তাই বাদশাহের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় কোথায় আবার? মোতিমহলে!

—সে তো যাবেনই।’—মণিবেগমের গলায় বাদশাহের তলোয়ারের চেয়েও ধারালো ছুরি ব্যঙ্গের সুরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে।’–খাবেন এই বাঁদির মহলে, আর শোকেন চুনিবেগমের মোতিমহলে! তারপরেই গলার সুর পাল্টে তর্জনি তুলে কুমের সুরে বলে ওঠেন-বসুন! বসুন বলছি!’

সেই ধমক শুনে দিগ্বিজয়ী সুলতান অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখেন, পর্দার আড়ালে মণিবেগম অদৃশ্য, শুধু বেড়ালটা ধৈর্যের প্রতীক হয়ে পালোসের ওপর লেজ গুটিয়ে বসে তাকে যেন কিসের একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে।

অল্পক্ষণ পরেই দেখা যায় বাদশা-বেগম তারিয়ে-তারিয়ে বাদশাহী খানা খেয়ে চলেছে, হাড়গোড় ছুঁড়ে দিচ্ছেন বেড়ালটার দিকে। আহারের প্রায় শেষভাগে হঠাৎ-ই স্বর্গীয় সুর ভেসে আসে। মোতিমহলে চুনিবেগম গান ধরেছেন। মণিবেগম বাদশাহের উসখুস ভাব লক্ষ করেন এবং সঙ্গে-সঙ্গেই তার পাতে হিন্দুস্থানের রাবড়ি ঢেলে দেন। ফলে, আহারের পর বাদশাহের আর নড়বার ক্ষমতা থাকে না। চুনিবেগমের গান শুনতে-শুনতে মণিবেগমের পাশে শুয়ে দিবানিদ্রার সুখ অনুভব করেন তিনি। ঘুম যখন ভাঙে, তখন চুনিবেগম থেমে গিয়েছেন, মণিবেগম সুর ধরেছেন। ‘ওহ্, অসহ্য’ বলে গটগট করে শিশমহল থেকে বেরিয়ে আসেন বাদশা, পেছনে মণিবেগম কটমট করে চেয়ে থাকেন।

সন্ধের পর দরবারের ঝামেলা মিটিয়ে মোতিমহলে এসে ঢোকেন সুলতান। সেখানে চুনিবেগম মুখ ভার করে বলেন-দুপুরে আজ এলেননা যে? কত করে গলা সাধলাম!

শুনে বাদশাহ মরমে মরে যান। চুনিবেগমের রঙও টকটকে ফর্সা, তবে মণিবেগমের মত গোলগাল চেহারা নয়। দোহারা গড়ন, মাথায় বেশ খানিকটা লম্বা, টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট, চঞ্চল দুই চোখ, রাজহংসী গ্রিবা। সেই গ্রিবা সামান্য বাঁকিয়ে রবাব বাজিয়ে যখন গান ধরেন চুনিবেগম, সে গান শুনেও সুখ, সে ভঙ্গি দেখেও যেন আর আশ মেটে না। হায়! দুপুরে আজ এই স্বর্গীয় সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বাদশা। তিনি তো চলেই আসতেন, কিন্তু বাদ সাধল ওই হিন্দুস্থানের রাবড়ি। সুস্বাদু, যেন অমৃত! তবে খেলেই বড় ঘুম পায়।

–‘জানি, মণিবেগম আজ আপনাকে পেট পুরে খাইয়েছে।’—চুনিবেগমের পাতলা ঠোঁট অভিমানে কিঞ্চিৎ স্ফুরিত হল।

—না, না, তেমন কিছু … তবে শেষপাতে ওই রাবড়িটা…’ মুখ ফসকে বলেই ফেলেন বাদশা।

—ওসব খাবেন না। মণিবেগম ওতে সিদ্ধি মিশিয়ে রাখে।

–বলো কি?

—ঠিকই বলি। আপনি সরল মানুষ। গান-পাগল। ওসব মেয়েলি প্যাঁচ-পয়জার বুঝবেন না। মণিবেগমের বেড়ালটাকে দেখেননি? শুধু খায় আর ঘুমোয়। ওটাকে ওষুধ করেছে। আপনাকেও করার মতলবে আছে।

দিগ্বিজয়ী বাদশা এসব শুনে চমকে ওঠেন। উষ্ণীষ খুলে কেশবিরল মস্তকে দ্রুত আঙুল চালান। চুনিবেগম তো ঠিকই বলেছে! আজকাল প্রায়ই শিশমহলে খানাপিনার পর তার আর ওঠার অবস্থা থাকে না।

–‘তাহলে উপায়?’–বাদশা খুবই বিব্রত এবং অসহায় বোধ করেন।

—আমি আপনার জন্য সুর ও সুরা দুইই মজুত রেখেছি। এসব কি যথেষ্ট নয়?

বাদশা ধন্ধে পড়ে যান। সন্ধের পর থেকে রাত্রির প্রথম প্রহর পর্যন্ত এধ্ব খুবই ভাল, তবে মধ্যযামের পর খিদেয় ঘুম ভেঙে যায়। তখন চুনিবেগম কণ্ঠলগ্না হয়ে থাকলেও তার মণিবেগমের কথাই বেশি মনে পড়ে। ইচ্ছে হয়, বেগমের বেড়ালটি হয়ে রসুইখানায় সেঁধিয়ে যান।

গলা-খাঁকারি দেন সুলতান। তারপর বলেন—তুমি … ইয়ে … একটু রান্নাবান্না শেখোনা কেন?

আপনি কুম করলেই পারি। সেদিন রাত্রে আপনাকে মুগ্মসল্লম বেঁধে খাওয়ালুম না?

শুনে বাদশা কিঞ্চিৎ মুখবিকৃতি করলেন। সেই বিস্বাদ এখনও তার জিভে লেগে আছে। পরের দিনই মণিবেগমের মহলে গিয়ে জিভের স্বাদ ফেরাতে হয়েছিল তাকে। বাগে পেয়ে মণিবেগমও তাকে দু-ঘণ্টা ধরে কালোয়াতি শুনিয়ে দুরমুশ করে দিয়েছিলেন।

—আজও আপনার জন্য আফগানি কাবাব বানিয়ে রেখেছি।—চুনিবেগম মধুর হেসে বললেন।

সর্বনাশ! সে আবার কেমন চিজ? বাদশা প্রমাদ গুণলেন। মুখে অবশ্য বললেন–বেশ তো, বেশ তো! তবে তার আগে তোমার গান শুনি।

চুনিবেগম রবাবে ঝংকার তুলে গান ধরলেন। অপূর্ব সেই সঙ্গীতসুধা উপভোগ করতে করতে বাদশা ঠোঁটে তুলে নিলেন সুরার পাত্র। এইভাবে রাত্রির প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হল, দেউড়িতে বাজল ঘণ্টা, আর শিশমহল থেকে মণিবেগমের বাঁদি এসে পর্দার আড়াল থেকে বলল—জাহাপনা, খানা তৈয়ার।

বাদশা কলে-পড়া ইঁদুরের মত চুনিবেগমের দিকে তাকালেন। বেগম যন্ত্রে ঝংকার দিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন—বলো গিয়ে আজ সুলতান আমার এখানেই থাকেন।

এ-কথা শুনে বাদশাহের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার অবস্থা হল। সুরার প্রভাব একটু একটু করে কেটে এখন ক্ষুধার বেশ উদ্রেক ঘটছে। মাঝ রাতে এই ক্ষুধা দাবানলের আকার নেবে। বাদশা ভাবলেন, যা থাকে নসিবে, চুনিবেগম আফগানি কাবাব আনতে পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হলেই তিনিও এই মোতিমহল থেকে অন্তর্হিত হবেন।

চুনিবেগম অবশ্য ওঠার কোন লক্ষণই দেখালেন না। সুরেলা গলায় বাঁদিকে কুম করলেন। তার মানে, বাঁদিই খাবার সাজাবে। এটিও বাদশার একেবারেই না পস। মণিবেগমের এসব কাজে বড় পরিপাটি। ইনি কিন্তু গতর নাড়াবেন না। রবাব কোলে তুলে নিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন—একটু সময় লাগবে। ততক্ষণ আপনাকে একটা ইরানি গজল শোনাই?

বাদশা আবারও উষ্ণীষ খুলে ফেললেন। বিননি করে ঘাম হচ্ছে। আধপেটা খেয়ে রাত কাটাতে হবে। তার ওপর চুনিবেগমের আর একটি বদভ্যাস আছে। আহারের পর সে পোষাক পাল্টায়, বাঁদিকে দিয়ে প্রসাধন সারে। ততক্ষণ পর্যন্ত বাদশাকে জেগে বসে থাকতে হয়।

চুনিবেগম চোখ বুজে পারস্যের গজল ধরেছেন, আর বাদশাও সেই ফাঁকে, পালানর পথ খুঁজছেন, এমন সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। পর্দা সরিয়ে মোতিমহলে এসে দাঁড়ালেন শিশমহলের মণিবেগম। আর সুরের রাজ্যে অসুরের প্রবেশের জন্যই কিনা কে জানে, রবাবের তার গেল হঠাৎ-ই ছিঁড়ে এবং বাধা পেয়ে চোখ খুলে চুনিবেগম দেখলেন, তারই মহলের দরজায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং মণিবেগম!

ঘোর বিপদ বুঝে বাদশা গলা-খাকারি দিয়ে বললেন—তোমার ওখানেই যাচ্ছিলাম … তবে … ইয়ে … মানে, পারস্যের গজল … তা তুমিও একটু শুনে যাও না?

মণিবেগম বাদশার কথায় ভ্রূক্ষেপও করলেন না। সোজাসুজি চুনিবেগমের দিকে তর্জনী তুলে কুমের সুরে বললেন—চুনি, ওঁকে ছেড়ে দাও।

রবারে তার ছিঁড়ে যাওয়ায় এমনিতেই চুনিবেগমের মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তার ওপর মণিবেগমের খবর্দারিতে সুরেলা গলা তারসপ্তকে চড়িয়ে ভীষণ ব্বিক্তির সঙ্গে বললেন—ওরে আমার কে রে! বললেই হল, ছেড়ে দাও!

মণিবেগমের মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল। তিনিও রণরঙ্গিনী মূর্তি ধরে সুরার পাত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ভয়ংকর স্বরে বললেন—এসব ছাইপাঁশ গিলিয়ে বাদশার খিদের বারোটা বাজাচ্ছিস—তোর লজ্জা করেনা রাক্ষুসী?

চুনিবেগমও এক লাফে উঠে কোমরে ওড়না জড়িয়ে তেড়ে গিয়ে বললেন—আর তুমি যে রাবড়িতে সিদ্ধি মিশিয়ে সুলতানকে ঘুম পাড়িয়ে রাখছ বলি, ভেবেছটা কি?

—বেশ করি। আমার মহলে সুলতান নিশ্চিন্তে ঘুমান।

—আহা! মরে যাই! আর আমিই বুঝি ওকে রাতে জাগিয়ে রাখি?

—সে তো ওঁর চোখের কোণে কালি দেখলেই বোঝা যায়। আমি সিদ্ধি মেশাই? তুই বিষ মেশাস। তোর ওই মদে বিষ মেশান থাকে।

—সেই বিষ পান করতেও সুলতান সকাল-সন্ধে আমার মহলে আসাই পছন্দ করেন। আর উপায়ই বা কি? ভেবেছ আমাকে টক্কর মারতে ওই হেঁড়ে গলায় গান গেয়ে সুলতানের মন ভোলাবে? শয়তানি, হিংসুটি!

—শুনছেন, জাঁহাপনা শুনছে? মুখপুড়ি, ডাইনি!

–শুনছেন, জাঁহাপনা শুনছেন? আপনি কিন্তু আজ আমার এখানেই খেয়ে যাবেন।

–কক্ষনো না। সুলতান, একবার সাহস করে উঠে আসু তো? আমি আপনার জন্য কাশ্মীরী কোর্মা বানিয়ে রেখেছি।

—ওসব সুলতান মুখেও তোলেন না। আমি বানিয়েছি আফগানি কাবাব।

—সুলতান, খবর্দার ওর কথায় বিশ্বাস করবেন না। ও রান্নার কি জানে? বাবুর্চিকে দিয়ে রাঁধিয়ে নিজের বলে চালাচ্ছে। পাজি, মিথ্যেবাদি।

—তুমিই বা গানের কি জান? তালকানি, পেঁচানি!

—আমি না থাকলে সুলতান না খেয়ে মরতেন।

—তোমার ওই গান শুনে একদিন এমনিই মরবেন।

—তুই থাম।

—আমি কেন থামব? এটা আমার মহল।

—চো-ও-প!

—চোপরাও!

বলা বাহুল্য, সেদিন রাত্রে বাদশাহের আর আহার হলই না। চুনিবেগমের আফগানি কাবাব ছুঁচো আর ইঁদুরে খেল, মণিবেগমের কাশ্মীরী কোর্মাও গেল বেড়ালের পেটে। বিরক্ত হয়ে রাতটা বারমহলে কাটিয়ে পরের দিন সকালে আবার দরবারে এসে বসলেন তিনি। ক্লান্ত, চিন্তিত। আজও যে কি থেকে কি হবে!

এই সময় দ্বাররক্ষী এসে খবর দিল, একজন দরবেশ বাদশাহের সঙ্গে দেখা করতে চান। বাদশা তাকে হাতের মুদ্রায় হাঁকিয়ে দেবার ইঙ্গিত করতে রক্ষী বলল যে, দরবেশ নাকি তন্ত্রমন্ত্র জানেন, তিনি স্বপ্নে আদেশ পেয়েছেন বাদশা বড় মনোকষ্টে আছে, সেই কষ্টের যেন নিবৃত্তি হয়।

একথা শুনে বাদশার মনে কিঞ্চিৎ বিশ্বাস জন্মাল। তিনি দরবেশকে হাজির করার হুকুম দিলেন। দরবেশ একজন বৃদ্ধ। আলখাল্লা-পরা বৈশিষ্ট্যহীন চেহারা, হাতে একটি বাঁকানো লাঠি। তিনি এসেই বাদশাকে দরবার ফাঁকা করার অনুরোধ জানালেন। বাদশা সেই অনুরোধ রাখতেই দরবেশ বললেন—গোড়া থেকে সব খুলে বলুন। দেখি, আল্লার ইচ্ছেয় যদি বিহিত করতে পারি।

বাদশা সবই খুলে বললেন। তাঁর পিতৃ-পিতামহ পাঁচ-সাতজন বেগম নিয়ে দাপটে ঘরকন্না করেছেন, আর মাত্র দুটিকে নিয়েই তার হিমসিম অবস্থা। কালে কালে হল কি?

দরবেশ বললেন—বিষয়টা আপনার পূর্বপুরুষদের আমলেও খুব সহজ ছিল না। বেগম হল দিল্লিকা লাচ্ছু, যো খায়া ও হি পস্তায়া।

বাদশা চিন্তিতভাবে বললেন—তাহলে উপায়?

দরবেশ বললেন—আমাকে দিন তিনেক সময় দিন।

—বেশ। আপনি তবে আমার অতিথিশালায় থাকুন। খানাপিনা করুন, গোলাপজলের ফোয়ারায় আমার বাছা বাছা নর্তকীদের নৃত্য-গীত উপভোগ করুন।

—আমি দরবেশ। বিলাসব্যসনের ধার ধারি না। আপনার দারোয়ানের ঘরটিই আমার বিশেষ পছন্দ। আপনি ওখানেই আমার থাকার বন্দোবস্ত করুন।

অতঃপর দরবেশ রয়ে গেলেন দারোয়ানের ঘরে, আর বাদশাও দোনামোনা করে আবারও যাতায়াত শুরু করলেন শিশমহলে আর মোতিমহলে।

কিন্তু দুই মহলই নীরব। সেই রাত্রের তুমুল ঝগড়ার পর দুই শিবিরেই যেন গোরস্থানের শান্তি। চুনিবেগমের তার-ছেঁড়া রবাবে আর সুর ওঠেনা, মণিবেগমও বেসুরে সঙ্গীতচর্চা করেন না। রান্নাবান্না বাবুর্চিকে দিয়েই করান হয়, বলা বাহুল্য বাদশাহের সেসব মুখে রোচে না।

তারপর, রাত্রে শুয়ে দুই বেগমেরই ফিচির-ফিচির কান্না শুনতে হয়। বাদশা ‘কি হল কি হল’ করলে মণিবেগম ফোপাতে-ফোপাতে বলেন—কি আবার হবে? আমি নাকি তালকানি, পেঁচানি—ডাইনিটা কি বলল শুনলেন তো? অনুরূপভাবে চুনিবেগমও বলেন—আমি নাকি শয়তানী, হিংসুটি-মিথ্যেবাদি, পাজিটা কি বলল শুনলেন তো?

জেরবার হয়ে তিদিন পর্যন্ত কোনক্রমে ধৈর্য বজায় রেখে অবশেষে বাদশা দরবেশকে ডেকে পাঠান। দরবেশ সব শুনে বলেন—আরও তিনদিন দেখুন।

সেই তিনদিনেও অবস্থার কোন ইতরবিশেষ হয় না। শুধু দুই বেগমেরই চোখের জল শুকিয়ে গিয়ে শরীর-মুখ-চোখ কেমন কাঠ কাঠ হয়ে যায়। রাত্রে শিশমহলে শুতে গেলে মণিবেগম গুম হয়ে বলেন–আজ আমার কাছে যে? পথ ভুলে? আবার মোতিমহলে গেলে চুনিবেগম ভুরু টান করে বলেন—কাল যদি ওখানে, তবে আজ রাতে কেন এখানে?

ছ-দিনের মাথায় দরবেশ বলেন—এবার আমি দুই বেগমের সঙ্গে আলাদা আলাদা কথা বলতে চাই।

বাদশা সেইমতই ব্যবস্থা করেন। আধঘণ্টা পর ফিরে এসে দরবেশ বলেন—হল না।

-কি হল না?

—আমার এই বাঁকানো লাঠিটি মন্ত্রপূত। এটি ছোঁয়ালেই আপনার চুনি হয়ে যেতেন মণিবেগম, আর মণি হয়ে যেতে চুনি।

-বলেন কি?

—কিন্তু চুনিবেগম বললেন, ওই ধুমসী হতে আমার বয়ে গেছে। দিন-রাত শুধু রাঁধবাড় আর খাও। ও কি মানুষের জীবন?

—আর মণি?

–বললেন, গান-টান আমার ভালই লাগে না। নেহাত বাদশার মন রাখতে একটু-আধটু গাই। বেঁধে-বেড়ে পুরুষকে খাওয়াতে কত সুখ!

—তাহলে উপায়?

–কাল বলব।

পরের দিন আবার দরবেশকে বেগমদের মহলে পাঠিয়ে বাদশা অধীর প্রতীক্ষা করতে থাকেন।

ফিরে এসে দরবেশ বলেন–ব্যবস্থা হয়ে গেল।

—কিরকম, কিরকম?–বাদশার আগ্রহ আর ধরে না।

–সপ্তাহে তিনদিন, শনি, রবি, সোম মোতিমহলে চুনিবেগম গানও গাইবেন আবার বেঁধেও খাওয়াবেন।

—চুনি করবে রান্না! আর সেই রান্না খেতে হবে আমাকে! এক-দু-দিন নয়, তিন-তিনটে দিন! মারা পড়ব দরবেশ।

-বিচলিত হবেন না। আমার এই যাদুদণ্ডটি ওঁর হাতে দুইয়ে দিয়ে এসেছি। ওই তিনদিন চুনিবেগমের হাতে আপনি অমৃতের স্বাদ পাবেন।

—আর মণি?

—মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ওঁর গলায় সুর বিরাজ করবে। গানও শোনাবেন, বেঁধেও খাওয়াবেন।

–বলেন কি!

–জুম্মাবারে সংযম পালন করবেন। তবে সাবধান, দিন ভুল করবেননা, যেন। তাহলেই যাদুর খেল খতম।

—দাঁড়ান, দাঁড়ান, ঝালিয়ে নিই। সোম, মঙ্গল, বুধ চুনি … না না, কি যেন বললেন, শনি, রবি সোম মণি … না না … মণি তো নয়, চুনি …।

বাদশা চোখ বুজে কর গুণে দিনের হিসাব করতে থাকেন। ধাতস্থ হয়ে চোখ খুলেই দেখেন, আরেঃ! কোথায় সেই দরবেশ।

এরপর সেই বাদশা দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে আরও নানা দেশ জয় করেন। তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে বিজিত দেশের বহু রাজকন্যা তাকে দেহ-মন দুইই সমর্পণ করতে চান। বাদশা তাঁদের প্রত্যেককেই মিষ্ট হাস্যে আপ্যায়িত করে বলেন-তা হয়না সুন্দরী! ঘরে আমার দুই বেগম। শনি-রবি-সোম, আর মঙ্গল বুধ-বেস্পতি। সুন্দরীরা মনঃক্ষুণ্ণ হলেও বাদশার কথাকে রসিকতা ভেবে করতালি দিয়ে হেসে উঠে বলেন-বাঃ বাঃ, আপনার দুই বেগমেরই ভারি অদ্ভুত নাম তো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *