বাদশাহ নামদার হুমায়ূন

হুমায়ূন আহমেদ কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস বাদশাহ নামদার। মোগল সাম্রাজ্যের রংদার চরিত্র সম্রাট হুমায়ুনকে নিয়ে লিখেছেন লেখক হুমায়ূন। একেবারে ভিন্ন ধরনের এই বই নিয়ে লেখকের কৌতূহলোদ্দীপক সাক্ষাৎ কার নিয়েছেন আলীম আজিজ ও তৈমুর রেজা।

প্রশ্ন: সরাসরি বইয়ের প্রসঙ্গে চলে আসি। বাদশাহ নামদার উপন্যাসের কাহিনির সঙ্গে অনেক বেশি মিল আছে গুলবদন বেগম প্রণীত হুমায়ুন-নামা গ্রন্থের।
হুমায়ূন আহমেদ: হ্যাঁ, সেই বইটা আমার কাজে এসেছে। তবে আমি অনেক কিছু নিয়েছি জওহর আফতাবচির কাছ থেকে, বাদশাহ হুমায়ুনকে যিনি পানি পান করাতেন।
এই লোকটি সব সময় বাদশাহ হুমায়ুনের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। তিনি যখন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তখনো তিনি তাঁকে ছেড়ে যাননি। এমন কি আকবরের যখন জন্ম হয়েছে তখনো জওহর আফতাবচি সঙ্গে ছিলেন।
প্রশ্ন: আপনি সাধারণত সমকাল নিয়েই লেখালেখি করেন। হঠাৎ বাদশাহ হুমায়ুনকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে গেলেন কেন?
হুমায়ূন: বাদশাহ নামদার বইটি লেখার কারণ আমি বইয়ের ভূমিকাতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। ছোটবেলায় আমি যখন ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ি, তখন আমাকে বেশ ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়েছে। ছাত্ররা আমাকে ডাকত ‘হারু হুমায়ূন’। কারণ শেরশাহর সঙ্গে প্রতিটি যুদ্ধে আমি হেরেছি। পালিয়ে বেড়িয়েছি। আমি বলতাম, আমি হারছি নাকি? সবাই বলত, ‘হারু হুমায়ূন, হারু হুমায়ূন’। এটা একটা কারণ। আরেকটা হতে পারে, চিতোরের রানি যখন সাহায্য চেয়ে তাঁর কাছে রাখিবন্ধন পাঠালেন, তিনি যে সঙ্গে সঙ্গে সব ফেলে রেখে ছুটলেন—এই পাগলামিগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
প্রশ্ন: হারু হুমায়ূন আপনার লেখায় আগে বোধহয় কখনো আসেনি। হঠাৎ করে আপনার সঙ্গে এর যোগসূত্র হলো কীভাবে? হঠাৎ করে কেন মনে এল হুমায়ূনকে নিয়ে লিখতে হবে?
হুমায়ূন: আসলে আমার আকর্ষণ তাঁর খ্যাপা ধরনের জন্য। এই রকম একটা পাগল লোক। ভিস্তিওয়ালা তাঁর জীবন রক্ষা করেছে বলে আধাবেলার জন্য তাকে দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। এটা পাগলামি ছাড়া আর কী! তুমি তাকে টাকা-পয়সা দাও। একেবারে দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া—এটা কোনো কাজ হলো? তার মানে তুমি এত হেলাফেলা করে ভাবো? এইটা আমাকে খুবই সারপ্রাইজ করল। চিতোরের রানিকে সাহায্য করতে তিনি সব ফেলেফুলে ছুটলেন। এটাও সারপ্রাইজিং। তারপরে রক্তবর্ণ কাপড় পরে তিনি যে মানুষ হত্যা শুরু করলেন—এটা কিন্তু ইতিহাস থেকে নেওয়া। সেখানে একটা ছেলে এসে গান গাইল। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে হুমায়ুন সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন। মোগল চিত্রকলার শুরুটা কিন্তু হুমায়ুনের হাতে। তাঁর আগে মোগল চিত্রকলা ছিল না। তিনি পারস্য থেকে চিত্রকর নিয়ে এলেন। ভারতে তিনিই প্রথম মানমন্দির তৈরি করেছেন। কেন? কারণ তিনি পারস্যে মানমন্দির দেখে আসছেন। তাঁর মৃত্যুও হয়েছে কিন্তু ওই মানমন্দিরের কারণে। সকালে ফজরের আজান হয়েছে। তিনি জানেন সকালে ফজরের আজানের সময় শুক্রগ্রহ মানে সন্ধ্যাতারাটা ওঠে। ওটা দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। পরনের কাপড়ে আটকে তিনি পড়ে যান। এ সব ঘটনা, একটা ক্যারেক্টার এত বিচিত্র হতে পারে? এত খেয়ালি হতে পারে। বৈরাম খাঁর কথা পড়েছ না?
প্রশ্ন: অনেকে মনে করেন, দুই ধরনের সাহিত্যিক থাকে। পপুলার লেখক আর সিরিয়াস লেখক। সিরিয়াস সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা যায়, তাঁরা ইতিহাস নিয়ে কাজ করেন। এই বই দিয়ে আপনি ইতিহাসের দিকে ঝুঁকছেন। জনপ্রিয় সাহিত্যিকের খাতা থেকে নিজের নাম কি কাটাতে চাচ্ছেন?
হুমায়ূন: না, না। আমি আমার আগের যে খাতা সেটাতেই বহাল আছি। আমার খাতা একটাই। আমি এমনিতে ইতিহাসের খুব মনোযোগী পাঠক। ইতিহাসে আমার আগ্রহ আছে। এখানে বাসায় যে বইগুলো দেখছেন, সেটা কিন্তু আমার মূল লাইব্রেরি না। আমার অনেক বই স্কুলে আছে। তারপর নুহাশ পল্লিতে আছে। লেখার থেকে আমি পড়ার পেছনে বেশি সময় দিই। এত জানার জিনিস আছে পৃথিবীতে। কিন্তু বাংলা বইয়ে ইতিহাস খুবই কাঠখোট্টাভাবে লেখা। এই লেখাগুলো তো কেউ পড়ে না। আমার ইচ্ছে করে এসব গল্প পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে। গল্পগুলোই আসলে আমাকে ইনস্পায়ার করে। আমার বাসায় গুলবদনের বই সাত বছর ধরে আছে। শাওন কখনো পড়ার আগ্রহ পায়নি। কিন্তু বাদশাহ নামদার যখন ও পড়ে শেষ করল, তখন গুলবদনের বই তাকে টানতে শুরু করল। এখন সে গুলবদন পড়ছে, বাবরনামা পড়ছে।
প্রশ্ন: বাদশাহ নামদার লিখতে গিয়ে আপনি নিজেই হুমায়ুন চরিত্রটির মধ্যে ঢুকে পড়েছেন এমন কি কখনো মনে হয়েছে?
হুমায়ূন: না, আমি নিজেকে কখনো তাঁর জায়গায় কল্পনা করিনি। কারণ যে নির্দয়তা তিনি দেখিয়েছেন, সেগুলো ভয়াবহ। আমি কখনো এসব ভাবতে পারি না। একটা মানুষের মধ্যে তো ভালো-মন্দ দুইটাই থাকবে, ওনার মধ্যেও পুরোপুরি ছিল।
প্রশ্ন: আপনার টিপিক্যাল চরিত্রগুলো এই বইয়ে প্রায় অনুপস্থিত। দুজন মাত্র চরিত্রকে আপনার চেনা ধরনের সঙ্গে মেলানো যায়। হরিশঙ্কর আচার্য আর হামিদা বানু। যেমন হামিদা বানু জোৎ স্না দেখতে ভালোবাসে।
হুমায়ূন: হামিদা বানু চরিত্রটা ঐতিহাসিকভাবেই এমন। জোৎ স্না দেখতে ভালোবাসে। একটু চঞ্চল, একটু ছটফটে। হুমায়ুনের সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হবে তখন হামিদা বানুর বয়স মাত্র পনেরো। হুমায়ুনের চারটা বউ আছে। হুমায়ুন মায়ের সঙ্গে রদখা করতে গিয়ে দেখলেন পনেরো বছরের একটি মেয়ে তাঁকে কুর্নিশ করছে। তিনি হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করছেন, মেয়েটা কে? জানা গেল, একজন শিক্ষকের মেয়ে। হুমায়ুন বললেন, আমি একে বিবাহ করতে চাই। হামিদা বানু বিয়ের কথা শুনে বললেন, এটা অসম্ভব ব্যাপার। আমি এমন কাউকে বিয়ে করব, যাঁর হাত আমি যখন ইচ্ছে ধরতে পারি, যাঁকে দেখলে আমার কুর্নিশ করতে হবে না। আর ইনি তো রাজ্যহারা লোক। একে আমি বিয়ে করতে যাব কেন? এসব আমার বইয়ের মধ্যে আছে।
প্রশ্ন: তো স্যার, এই বইয়ের মধ্যে আপনি যেমন আলাদা হয়ে উঠেছেন, এটা কি আপনি সচেতনভাবেই চেষ্টা করেছিলেন?
হুমায়ূন: না, না। দেখো পৃথিবীতে দুই ধরনের লেখক আছে। একটা হলো স্পনটিনিয়াস রাইটার। আরেকটা ধরন হলো, চিন্তাভাবনা করে বইপত্র পড়ে ধীরেসুস্থে লিখবে। অল থ্রু মাই লাইফ আই ওয়াজ এ স্পনটিনিয়াস রাইটার। এর মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। তবে এই স্পনটিনিয়াস রাইটিংয়ের জন্য আমাকে ইতিহাস পড়তে হয়েছে। তথ্যগুলো ব্রেইনের একটা অংশে ছিল। কিন্তু আমি লিখেছি স্পনটিনিয়াসলি। চিন্তাভাবনা করে, এটা করব ওটা করব—এসবের মধ্যেই আমি নেই।
প্রশ্ন: এই বইয়ে আপনার লেখার স্টাইলে পরিবর্তন স্পষ্ট, যেমন আপনার লেখায় হিউমার খুব পরিচিত ব্যাপার, কিন্তু এই বইতে কোথাও কোথাও ঝিলিক থাকলেও হিউমার প্রায় নেই।
হুমায়ূন: হ্যাঁ। এই বইয়ে আমার স্টাইলগত পরিবর্তন অবশ্যই আমার ইচ্ছাকৃত। এখানে আমি প্রচুর তৎ সম শব্দ ব্যবহার করেছি। পুরোনো বানানগুলো অনেক ক্ষেত্রে রক্ষা করেছি। পুরোনো আবহটা আনার জন্য। যেসব দীর্ঘ-ঈ কার আজকাল হ্রস্ব-ইতে লেখা হচ্ছে সেগুলোতে আমি দীর্ঘ-ঈকার ব্যবহার করেছি। পাণ্ডুলিপি হায়াৎ মামুদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তাঁকে আমি বলেছি, আমি দীর্ঘ-ঈকারগুলো রাখছি, যাতে ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাটার্নে একটা পুরোনো দিনের ফ্লেভার তৈরি হয়। এটা সচেতনভাবে করা।
একটা গল্প তোমাদের বলি, এটা আমাকে বোঝার জন্য কাজে লাগতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো একটা উপলক্ষে আমাকে চট্টগ্রামে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আমি আগ্রহ করে গেলাম। গিয়ে দেখি হলভর্তি লোকজন বসে আছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিক কায়সার বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠলেন। হুমায়ূন আহমেদ মধ্যবিত্ত নিয়ে লেখালেখি করেন। এর বাইরে তিনি যেতে পারেন না। মধ্যবিত্ত হলো আমাদের সমাজের টু পার্সেন্ট মাত্র। বাকি আটানব্বই লোক অন্য শ্রেণীর। কৃষিজীবী আছে, মৎ স্যজীবী আছে। অল থ্রু অব হিজ লাইফ তিনি এদের নিয়ে কিছু লেখেননি। মাত্র টু পার্সেন্ট লোক নিয়েই লিখেছেন। তাঁকে লেখক বলে স্বীকৃতি দেওয়ার তো কিছু নেই। যাঁরা দুর্বল মনের মানুষ, তাঁরা এসব শুনলে চিন্তায় পড়ে যান। আরে এভাবে তো কখনো ভাবিনি। মাত্র টু পার্সেন্ট লোককে নিয়ে লিখছেন। দেখলাম কিছু কিছু ছেলেপেলের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। তারা এটা নিতে পারছে না। তাঁর কথা শেষ হওয়ার পর আমি বললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লেখক যাঁকে বলা হয়, তিনি সারা জীবন শুধু রাজা-বাদশাহ আর রাজকন্যাদের নিয়ে লিখেছেন। তাঁর নাম শেকসপিয়ার। আমার শেকসপিয়ারের মতো ক্ষমতা নেই বলে আমি এগুলো লিখছি। কিন্তু মধ্যবিত্ত নিয়ে লিখলেই যে সব স্পর্শ করা যাবে না, এটা কে বলেছে আপনাকে? এরপর তিনি খুবই লজ্জিত হয়ে আমাকে সরি বলেছেন।
আরেকটা ঘটনা বলি। বিচিত্রার শাহাদাত চৌধুরী আমাকে বললেন, আপনি তো লেখালেখি করছেন, এক কাজ করি। আপনাকে ট্যাগ করে দিই সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। দুজনের মুখোমুখি একটা আলোচনা আমরা ছাপব। আমি রাজি হয়ে গেলাম। সৈয়দ হকের সঙ্গে বসলাম মুখোমুখি। তিনি প্রশ্ন শুরু করলেন এইভাবে, হুমায়ূন আহমেদ সাহেব। আপনার সব উপন্যাসই দেখি, হয় চার ফর্মায় শেষ হয়, নয় পাঁচ ফর্মায় কিংবা ছয় ফর্মায়। এভাবে ফর্মা হিসেবে কি উপন্যাস আসে আপনার মাথায়? আমি সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম, তাঁর ইনটেনশন খুব খারাপ। আমি তো পুরোপুরি ধরা খেয়ে গেছি। তখন বললাম, ‘হক ভাই, আপনি যে সনেটগুলো লেখেন, এগুলো তো ১৪ লাইনে লেখেন। আপনার ভাব যদি ১৪ লাইন মেনে আসতে পারে, আমার উপন্যাস ফর্মা হিসেবে এলে অসুবিধা কী?’
প্রশ্ন: আপনি এর আগে ঐতিহাসিক যেসব উপন্যাস লিখেছেন, সেখানে ন্যারেটর হিসেবে আপনার সাধারণ মানুষকে পাই। এখনকার সাব-অল্টার্ন স্টাডিস বা তলা থেকে দেখা ইতিহাসের সঙ্গে এই ব্যাপারটা খুব খাপ খায়। কিন্তু বাদশাহ নামদার উপন্যাসের প্রায় পুরো গল্পটাই অভিজাতদের পাটাতন থেকে বলা। ন্যারেটর হিসেবে নিম্নবর্গ বা তলার মানুষ নেই। এটা কেন হলো? আপনার কি কোনো লিমিটেশন ছিল?
হুমায়ূন: লিমিটেশন তো ছিলই। আমি যাঁদের কাছ থেকে তথ্য নিচ্ছি, এঁদের
একজন হচ্ছেন আবুল ফজল। একজন হচ্ছেন হুমায়ুনের বোন। একজন তাঁর পানি সরবরাহকারী আফতাবচি। আমাকে তো এঁদের কাছ থেকে তথ্যগুলো নিতে হয়েছে। আর সেই সময় হুমায়ুনের রাজসভায় যাঁরা গেছেন, তাঁদের কারও কারও ভাষ্যের সাহায্য আমি নিয়েছি। কাজেই নিচু তলার কারও ভাষ্য পাওয়ার সুযোগ ছিল না। এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখার কেউ নেই। এটা করতে গেলে আমাকে করতে হতো পুরোপুরি কল্পনার সাহায্য নিয়ে। সে ক্ষেত্রে আমি ইতিহাস থেকে আরও দূরে সরে যেতে পারতাম। এই উপন্যাসের একটা চরিত্র হচ্ছে ভিস্তিওয়ালা। সে যদি একটা বই বা উপন্যাস লিখে যেতে পারত, তাহলে তার দৃষ্টিভঙ্গিটা আমরা জানতে পারতাম।
প্রশ্ন: এই উপন্যাসে আমরা দেখি, হুমায়ুন যখনই যুদ্ধ জয় করতেন, তখনই তিনি বিরাট উৎ সবে মেতে উঠতেন। হেরেমের ব্যাপারেও তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তিনি আফিম খেতেন, এটা আপনার উপন্যাসেই আছে। কিন্তু বাদশাহ নামদার-এ হেরেমটাকে আপনি কিছুটা এড়িয়ে গেছেন।
হুমায়ূন: হ্যাঁ, এটা আমি কিছুটা বাদ দিয়েছি। এই জিনিসটাকে আমার কাছে একটু অরুচিকর মনে হয়। পতিতালয় থাকবে একজন সম্রাটের, এটা কেমন কথা।
প্রশ্ন: সেক্স বা সেক্সুয়ালিটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী—সাহিত্য বা ফিকশনের ক্ষেত্রে?
হুমায়ূন: এটা নিয়ে আসাটাকে খুব মডার্নিস্ট মনে করা হয়। যিনি যত ভালোভাবে নিয়ে আসতে পারেন, তিনি তত মডার্ন লেখক, এটা ভাবা হয়। আমাদের বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় লেখক যিনি, তাঁর নাম হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উনার গল্প-উপন্যাসে কোথাও সেক্সুয়ালিটি পেয়েছ? এক জায়গায় শুধু আছে, ‘তখন তাহার শরীর জাগিয়া উঠিল।’ এর বেশি তিনি আর আনেননি। শুধু ‘জাগিয়া ওঠা’ পর্যন্ত। পাঠকের কল্পনার ওপর তিনি ছেড়ে দিয়েছেন।
প্রশ্ন: বাদশাহ নামদার-এ ওই সময়ের জিওগ্রাফি, এনভায়রনমেন্ট, ওই সময়ের সোসাইটি, সাধারণ মানুষ—এর প্রায় কিছুই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এটা আপনার উপন্যাসে একটা ব্যত্যয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা একটা খামতিও। এ ব্যাপারে আপনার নিজের কী মনে হয়?
হুমায়ূন: তোমরা তো আমাকে কনফিউজ করে দিলে। ওই যে কালটা ধরা যাচ্ছে না বলছ, সেটা আমার মনে হয় না। আমাদের সেলিনা হোসেন গালিবকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছেন। সেই উপন্যাসে গালিব বলছেন, একজন স্ত্রী ভাত রাঁধতে পারলেই হলো। গালিবের স্ত্রী তো ভাত রাঁধতে পারেন না। বড়জোর রুটি বানাতে পারেন। এই ত্রুটিগুলো কিন্তু আমি করিনি। আর সাহিত্যিক তো ঐতিহাসিক না। ভারবাটিম তার সবকিছু ধরার দরকার নেই। তোমাদের কল্পনার জন্য জায়গা রাখতে হবে না, বলো? সময় ধরার জন্য আর কী করতে পারতাম, বলো।
প্রশ্ন: যেমন ধরেন, ওই সময়ের পথঘাট। আমরা অনেক যাত্রার বিবরণ পেয়েছি যে সৈন্য দল যাচ্ছে।
হুমায়ূন: পথঘাট ছিল না, ফর ইয়োর ইনফরমেশন। পথঘাট শুরু করলেন শেরশাহ। গ্র্যান্ডটাংক রোড বানালেন উনি। পথঘাট ছিল না তো, যে পথের বর্ণনা দেব। পালকি-টালকি ছিল…আরেকটা কারণ হলো, আগে আমি ঐতিহাসিক যেসব উপন্যাস লিখেছি, যেমন—জোছনা ও জননীর গল্প, সেই সময়টা আমি নিজ চোখে দেখেছি বা মধ্যাহ্ন কিছুটা হলেও দেখেছি, বাবা-চাচাদের কাছ থেকে শুনেছি। কিন্তু এই উপন্যাসের সময়টা চাক্ষুস দেখেছে, এমন কারও সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ নেই। বই যেগুলো হাতে আছে, এর বাইরে আমরা কিন্তু কিছু জানতে পারছি না। যে বইগুলো আমি পড়েছি, সেখানে প্রায় কোনো ডিটেইলই নেই। গুলবদন বেগমের বইয়ে যেমন—শুধু এভাবে লেখা যে আম্মা এটা বললেন বা আব্বা এটা করলেন। অমুক এটা করলেন, তমুক এটা করলেন। শুধু সারমর্মটা আছে। বর্ণনা সেভাবে নেই।
আর একটা সমস্যা হলো, হুমায়ুনের সময়ের কোনো স্থাপত্যকলাও নেই। সবই ধ্বংস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ধ্বংস হয়েছে এইটিন ফিফটি সেভেনে। সিপাহি বিদ্রোহের কারণে ইংরেজরা খুবই খেপে গেল, মোগলের কিছুই থাকবে না এখানে, ইনক্লুডিং তাজমহল। সব ডেমোলিশ করতে হবে। তখন এটা রক্ষা করলেন একজন ইংরেজ সাহেব। তাঁর নামটা এই মুহূর্তে আমি ভুলে গেছি। তিনি এগিয়ে এসে বহু কষ্টে এটা রক্ষা করলেন। লালকেল্লা আর তাজমহল। ওরা ঠিক করেছিল, মোগলের কোনো চিহ্নই রাখবে না।
আর শোনো। আমার লেখার ধরন নিয়ে একটা ছোট্ট কথা তোমাদের বলি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঔপন্যাসিক বলতে হবে তলস্তয়কে। আরেকজন দস্তইয়েভস্কি। এঁরা করেন কী, একটা চরিত্রকে বর্ণনা করা শুরু করেন। ধরো, তোমাকে তারা বর্ণনা করছেন। অনেক লাইন কিন্তু খরচ করছেন তোমার পেছনে। তার চোখ এমন ছিল, তার অল্প কিছু গোঁফ ছিল, নাকটা খাড়া ছিল—টোটাল বর্ণনা দিয়ে তোমার চেহারাটা ফুটিয়ে তুলবেন। আমি কিন্তু ওই লাইনে যাই না। সাধারণত আমি চেহারার বর্ণনা দিই না। আমি এই ব্যবস্থাটা করি। ডায়ালগের ভেতর দিয়েই যেন পাঠক চরিত্রগুলোকে কল্পনা করতে পারে। এটার সুবিধাটা দেখো। আমরা পথের পাঁচালী উপন্যাসটা যখন পড়ি, তখন প্রত্যেকেই একজন করে দুর্গাকে কল্পনা করি। একটা অপু কল্পনা করি। সত্যজিৎ রায় যখন ছবি বানালেন, তখন সবার কল্পনাটা সীমিত হয়ে গেল। যে কারণে আমি এত কিছু লিখি, আমি কিন্তু হিমু নিয়ে কোনো সিনেমা বা নাটক করিনি। কারণ, সবার কল্পনায় নিজের মতো একটা হিমু আছে। আমি ওইটায় হাত দিতে চাইনি। মিসির আলিও আমি বানাইনি। অন্যরা দুয়েকজন বানিয়েছে। আমি এর থেকে দূরে থাকছি। শুভ্রও আমি বানাইনি। বানাতে চাচ্ছিও না। যার মনে যা আছে, সেটাই থাকুক।
প্রশ্ন: এখানে দেখা যায়, বাদশাহ হুমায়ুনের জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল।
হুমায়ূন: অত্যন্ত ঝোঁক ছিল। উনি তাঁর ছেলে আকবরের জন্মের পর নিজের হাতে ৪০ না ৪৫ পৃষ্ঠার একটা কোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। আকবরের জন্মতারিখটা ভুল লেখা আছে। কারণ, সত্যিকারের জন্মতারিখ সবাই জেনে ফেললে জাদুটোনা করে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে। আকবরের জন্মের সময় আফতাবচি সেখানে উপস্থিত। আবুল ফজল এটা জানলেন অনেক পরে। আমরা তো নেব জওহর আফতাবচির মতো।
প্রশ্ন: আপনার উপন্যাসে হুমায়ুন প্রবলভাবে ভাগ্যবিশ্বাসী একজন মানুষ, গ্রহ-নক্ষত্রের বিচার ছাড়া তিনি কিছু করেন না, কিন্তু তাঁর আশপাশে এমন কোনো চরিত্র নেই। জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী কারও দেখা কিন্তু আমরা পাই না।
হুমায়ূন: ঠিকই বলেছ। আমার উপন্যাসে এ রকম কোনো চরিত্র নেই। কিন্তু বাদশাহ হুমায়ুনের লোক ছিল, যে এই গ্রহ-নক্ষত্রের ব্যাপারগুলো দেখত বা তিনি নিজেই দেখতেন বেশির ভাগ সময়। বাবর কিন্তু এসবের ব্যাপারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি তলোয়ারের ওপর নির্ভর করতেন, রণক্ষেত্রের ওপর বিশ্বাস রাখতেন। হুমায়ুন দূর্বল মনের মানুষ। এ জন্য গ্রহ-নক্ষত্রের ওপর নির্ভর করতেন।
প্রশ্ন: আপনি যখন ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন, তখন এমন অনেক চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হয় যাদের আপনি দেখেননি, বইপত্র ছাড়া যাদের কথা জানার উপায় নেই। এ রকম চরিত্রগুলো আপনি কীভাবে ভিজুয়ালাইজ করেন? কোনো পদ্ধতি কি থাকে আপনার?
হুমায়ূন: পদ্ধতি থাকলে তো আমি লেখক বানানোর একটা স্কুল দিয়ে ফেলতে পারতাম। আর বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পর সবচেয়ে বড় লেখক হতেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের ছেলে। কারণ, তাঁরই সবচেয়ে বেশি সুযোগ ছিল বাপের কাছ থেকে লেখালেখির কলাকৌশল শিখে নেওয়ার। সে তো মোটামুটি গাধা ছাড়া কিছু হয়নি।
এটা আসলে বলা যাচ্ছে না। ব্রেইনের কোন অংশে কীভাবে আসলে প্রসেস হয়, আমি জানি না। তুমি কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালো ছুতার হতে পারবে। কিন্তু লেখকের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে ভালো লেখক হতে পারবে—এটা আমি মনে করি না। এর প্রেরণাটা অন্যখান থেকে আসে। এটা রহস্যময়।
প্রশ্ন: স্যার, বাদশাহ নামদার-এর সূত্র ধরে এ রকম আরও ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার ইচ্ছা কি আছে আপনার?
হুমায়ূন: না, এই মুহূর্তে আমি আর ভাবছি না। অনেক সময় নষ্ট হয় আমার। দুনিয়ার বই পড়তে হয়। আর ব্যাপারটা খুব কনফিউজিং। একেকজন ঐতিহাসিক একেক রকম কথা বলে যাচ্ছেন। ভেরি ভেরি কনফিউজিং। এক ধরনের ইতিহাস পড়লে তোমার মনে হবে, আওরঙ্গজেবের মতো নিষ্ঠুর মানুষ পৃথিবীতে নেই। আরেক ধরনের ইতিহাস পড়লে মনে হবে, ও মাই গড, আওরঙ্গজেবের মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে নেই। একটা উদাহরণ দিই। রাজপুতানার এক রাজার দুজন রানি ছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে গর্ভবতী হলেন। তখন রাজা মারা গেলেন। এই দুজনের এক রানি খবর পাঠালেন আওরঙ্গজেবের কাছে, ‘আপনি যদি আমার সন্তানকে স্বীকৃতি দেন রাজা হিসেবে, তাহলে আমি আমার লোকজন নিয়ে মুসলমান হয়ে যাব।’ আওরঙ্গজেব দুই রানির কোনো ছেলেকেই রাজত্ব দিলেন না। যে রাজা মারা গেছেন, তাঁর ছোট ভাইকে রাজত্ব দিলেন। সভাসদরা বললেন, ‘কী আশ্চর্য! আমরা এত বড় একটা সুযোগ পেলাম। আপনি সেটা নিলেন না কেন?’ আওরঙ্গজেব বললেন, ‘আমি রাজ্য শাসন করতে এসেছি। ধর্মপ্রচার করতে আসিনি। নাবালক পুত্রকে বসিয়ে আমার চলবে না।’ আওরঙ্গজেব নিজে খুবই ধার্মিক লোক। তিনি বলছেন এই কথা।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০১০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *