বাদশাহ ও কুমারগণ

বাদশাহ ও কুমারগণ

শাহজাহানের রাজ্য-নাশ

৭ই মার্চ, ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে, বাদশাহ শাজাহানের রাজ্যাভিষেকের ৩১ বৎসর আরম্ভ হইল; মহা সমারোহে শুভ দিন কাটিয়া গেল, এই সুদীর্ঘ রাজত্বকালে প্রজাগণ শান্তি ও সম্বৃদ্ধি ভোগ করিতেছিল। কেবল শেষের দিকে একটি বিপদের ছায়া আসিয়া পড়িয়াছিল– কুমারগণের বড়ই অমিল ও ঈর্ষা, বাদশাহ তাহাদিগকে খুব দূরে দূরে রাখিয়া কোনরকমে শান্তিরক্ষা করিতে পারিয়াছিলেন।

জ্যেষ্ঠ কুমার দারাশিকো পিতার বড়ই প্রিয় ছিলেন। তিনি বাদশাহের সঙ্গে থাকিতেন; তাঁহার উঁচু উপাধি (শাহ-ই-বুলন্দ্-ইকবাল), ৬০ হাজার অশ্বারোহীর সেনাপতি এই সর্ব্বোচ্চ পদ এবং প্রতিপত্তি দেখিয়া প্রজা ও সৈন্যগণ তাঁহাকে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী বলিয়া মনে করিত। বাদশাহও যেন তাহাই ইচ্ছা করিতেন। একখান মণি খচিত স্বর্ণ আসন বাদশাহের সিংহাসনের সম্মুখে রাখা ছিল; যখন দারা দরবারে আসিতেন উহার উপর বসিতেন। রাজ্যের কোন কাজই দারাকে না জানাইয়া করা হইত না। কুমার আদর্শ পতি ও পিতা ছিলেন; তাঁহার জ্ঞানও গভীর কিন্তু সুদীর্ঘ কাল রাজসভায় থাকায় যুদ্ধবিদ্যা ভুলিয়া গিয়াছিলেন; ফকীর ও যোগীদিগের সঙ্গ এবং সুফী ও উপনিষদের গভীর দর্শনের আন্তরিক চর্চ্চা তাঁহার বিষয়বুদ্ধি লোপ করিয়া দিয়াছিল।

দ্বিতীয় কুমার শাহ শূজা, বাঙ্গলার সুবাদার বড়ই বিলাসী এবং অকৰ্ম্মণ্য ছিলেন; ১৭ বৎসর বাঙ্গলার জলবায়ু তাঁহার শরীর ও মন নিস্তেজ করিয়া দিয়াছিল, রাজকার্য্যে ও সৈন্য বিভাগে চারিদিকে বিশৃঙ্খলতা ও শ্লথতা রাজত্ব করিত।

তৃতীয় কুমার আওরংজীব অক্লান্ত পরিশ্রমী, দ্রুত অশ্বারোহী, অসীম কৌশলী, স্থির, গম্ভীর, সংযমী, বিলাস ত্যাগী, দাক্ষিণাত্যের সুবাদার ছিলেন। তাঁহার সংযত সাহস ও অনিদ্র সতর্কতা কেবল তাঁহার প্রগাঢ় রাজনৈতিক চতুরতা ও কপটতার সঙ্গেই তুলনা করা যাইতে পারে। সত্য বটে তাঁহার মনে ঔদার্য্য বা বিস্তৃতি ছিল না; কিন্তু মন সংকীর্ণ হওয়ায় এই সুবিধা হয় যে উদ্দেশ্যটি সতত সৰ্ব্ব শক্তি দ্বারা অনুসরণ করা যায়। ইহা তাঁহার বিজয়ের একটি কারণ। দয়া দাক্ষিণ্য কৃতজ্ঞতা বাৎসল্য প্রভৃতি ‘হৃদয়ের দুর্বলতা’ তাঁহার চাণক্যনীতির সফলতার বিঘ্ন করিত না। সুদূর দাক্ষিণাত্যেও তাঁহার সৈন্য সর্ব্বদা প্রস্তুত ও দক্ষ অবস্থায় রাখা হইত। ভবিষ্যৎ ভাবিয়া আওরংজীব সেখানেই অনেকগুলি কর্ম্মপটু এবং বিশ্বাসী ভৃত্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন- যথা খলিলুল্লা খাঁ জমান্, মির আস্করী (আকিল খাঁ রাজী), মুর্শিদকুলী খাঁ, এবং রণ ও মন্ত্রণায় অদ্বিতীয় কুশলী মির জুম্‌লা।

কনিষ্ঠ কুমার মুরাদ্ বখ্শ্ অন্ধ সাহসে যুদ্ধ করা ও বিলাসে গা ঢালিয়া দেওয়া ভিন্ন আর কিছুই জানিতেন না। বুদ্ধি বিদ্যার কোনই ধার ধারিতেন না। এ সময় গুজরাত প্রদেশ তাঁহার শাসনে ছিল।

বাদশাহের স্বাস্থ্যভঙ্গ

হঠাৎ দৃশ্যপট পরিবর্তন হইল। ৬ই সেপ্টেম্বর দিল্লীতে শাহজাহান কঠিন মূত্রকৃচ্ছ্র ও তাঁহার উপসর্গে আক্রান্ত হইয়া পড়িলেন, রাজ-বৈদ্যগণ কোনই উপকার করিতে পারিলেন না। বাদশাহের এতটুকু শক্তি রহিল না যে দরবারে আসেন অথবা দর্শনের জানলায়’ (ঝারোখা-ই-দর্শন) বসিয়া ভক্ত প্রজাবৰ্গকে একবার মুখ দেখান। দারা অক্লান্ত যত্নে দিবা নিশি পিতার সেবা করিতে লাগিলেন। রোগ গৃহের বাহিরের ঘরটি তাঁর বাসস্থান হইল। ভ্রাতাগণ সংবাদ না পান এই জন্য সভাসদগণের বাদশাহ দর্শন বন্ধ করিয়া দিলেন, আওরংজীবের প্রতিনিধিকে (উকীল) কয়েদ করিলেন, এবং রাজধানীর বাহিরের পথ ও খেয়াঘাটে পাহারা বসাইয়া রাখিলেন যেন কোন দূত না যাইতে পারে। কিন্তু ইহার ফল ঠিক বিপরীত হইল। সংবাদ না পাইয়া কুমারগণ ব্যস্ত ও চঞ্চল হইয়া পড়িলেন। রাজ্যময় অদ্ভুত গুজব প্রচার হইতে লাগিল; চারিদিকে দুষ্ট লোক গোলমাল বাধাইয়া স্বার্থলাভের সুযোগ পাইল। কিছুদিন পরে বাদশাহ একটু সুস্থ হইয়া জানলায় দেখা দিলেন; কিন্তু তাহাতে কি হইবে? লোকে বলিতে লাগিল যে আসল বাদশাহ মরিয়া গিয়াছেন, ওটা একজন দাস বাদশাহের পোশাক পরিয়া তাঁর আকৃতির অনুকরণ করিয়া জানলায় বসিয়া দূর হইতে লোকের সালাম লইতেছে ও প্রতিদান করিতেছে।

সিংহাসনের জন্য যুদ্ধ আর থামাইয়া রাখা অসম্ভব হইল। ছোট তিন কুমার সসৈন্যে আগ্রার দিকে ধাবমান হইলেন। বাদশাহ নিজ হস্তে লিখিত ও নিজ মোহরযুক্ত চিঠি পাঠাইয়া তাঁহাদিগকে স্ব-স্ব প্রদেশে ফিরিয়া যাইতে আদেশ করিলেন। তাঁহারা এইরূপ উত্তর পাঠাইলেন, ‘আমরা সিংহাসনাকাঙ্ক্ষী বিদ্ৰোহী নহি; ভক্ত প্রজা ও বিনীত পুত্র, ভীষণ জনরব শুনিয়া বড়ই চিন্তিত হইয়াছি। একবার শুধু বাদশাহের নিকট গিয়া তাঁহাকে দেখিয়া চক্ষু সার্থক এবং মন নিশ্চিন্ত করিব। তারপর বাদশাহের যাহা আজ্ঞা হয়, তাহাই, পালন করিব’। দারা ইহার প্রকৃত মৰ্ম্ম বুঝিলেন। আত্মরক্ষার জন্য দুই দল সৈন্য শূজা ও আওরংজীবের বিরুদ্ধে পাঠাইলেন এবং পিতাকে ধীরে ধীরে দিল্লী হইতে আগ্রায় আনিলেন।

দারার পরাজয়

পথে আওরংজীব ও মুরাদ একত্র হইলেন এবং উজ্জয়িনীয় যুদ্ধে দারার প্রেরিত সৈন্যকে পরাস্ত করিয়া আগ্রার দিকে অগ্রসর হইলেন। দারা সর্ব্বস্ব এক যুদ্ধের ফলে সঁপিয়া আগ্রা হইতে সৈন্য লইয়া স্বয়ং যুদ্ধে আসিলেন। ২৯ শে মে ১৬৫৮ খ্রি: অসহ্য রৌদ্র ও গরম বাতাসের মধ্যে আগ্রার ১৩ মাইল দক্ষিণে সামুগড় গ্রামে, এই সৈন্যের সংঘর্ষ হইল। বিপক্ষের সুচালিত তোপের সম্মুখে দারার সৈন্যগণ শস্যের মতো কাটা পড়িতে লাগিল। তাঁহার প্রবল আক্রমণগুলি ব্যর্থ হইল; তাঁহার নায়কগণ (রুস্তম খাঁ, রাও ছাত্রশাল প্রভৃতি) যুদ্ধ করিতে করিতে মারা গেলেন। অবশেষে দারা দ্বিতীয় পুত্র সিপিহর শিকো এবং জনকতক অনুচর সঙ্গে দ্রুত অশ্বে চড়িয়া পলায়ন করিয়া সন্ধ্যার পর আগ্রায় নিজ বাড়ীতে পৌঁছিয়া একেবারে শোকে অবসর হইয়া পড়িলেন, অন্তঃপুরে ক্রন্দন ও আর্তনাদের রোল পড়িয়া গেল এবং এই দুঃসংবাদ চারিদিকে প্রচার হইল। শাহজাহান জানিতে পারিয়া সেই রাত্রে দারাকে বলিয়া পাঠাইলেন, “দৈবক্রমে তোমার এ দুর্দ্দশা; তুমি কি করিবে? এখন একবার দুর্গে আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করা এবং কয়েকটি আবশ্যক কথা শুনা তোমার পক্ষে ভাল; তারপর যেখানে ইচ্ছা যাইও এবং যাহা তোমার কপালে থাকে ঘটিবে।” কিন্তু দারা মম্মাহত হইয়াছিলেন, মান সম্পত্তি ক্ষমতা সব হারাইয়া তাঁহার আর মুখ দেখাইবার ইচ্ছা ছিল না। তিনি পিতাকে উত্তর পাঠাইলেন, “আর কোন মুখে, কি দশায়, আপনার সম্মুখে উপস্থিত হইতে পারি? এ শহরে দেরী করিলে শত্রুগণ আমার চারিদিক ঘিরিয়া ফেলিবে, এ অপমানিত হতভাগ্য পুত্রকে দেখার ইচ্ছা ছাড়িয়া দিন। শুধু আমার সম্মুখে যে সুদীর্ঘ বিপদপূর্ণ ভ্রমণ রহিয়াছে তাহার আরম্ভে আপনার আশীর্ব্বাদ চাই।” এ সংবাদে বাদশাহ ও অন্তঃপুরের মহিলাগণ শোকে উন্মত্তপ্রায় হইলেন। প্রভাতে ৩টার সময় দারা স্বীয় পত্নী নাদিরাসুর বেগম (যুবরাজ পর্বেজের কন্যা) এবং অপর কয়েকটি স্ত্রীলোক এবং কয়েকটি হস্তী বোঝাই ধনরত্ন লইয়া আগ্রা হইতে দিল্লীর দিকে পলাইলেন।

আগ্রার দুর্গ অবরোধ

যুদ্ধ জিতিয়া সে রাত্রি আওরংজীব রণক্ষেত্রের পশ্চাতে দারার পরিত্যক্ত শিবিরে কাটাইলেন। তিনদিন পরে (১লা জুন) আগ্রার শহরতলীতে নূর মঞ্জিল বা বীরা নামক বাগানে আসিয়া তাম্বু ফেলিলেন। পুরবাসিগণ মহা ভয় ও চিন্তায় রহিল, মুরাদের সৈন্যগণ বড়ই উচ্ছৃঙ্খল; শহরে ঢুকিয়া লুঠ ও অত্যাচার আরম্ভ করিল। তৃতীয় দিবস আওরংজীব তাঁহার জ্যৈষ্ঠ পুত্র মহম্মদ সুলতানকে খা খানান ও একদল সৈন্য সহ শহরের মধ্যে শান্তি রক্ষা করিতে ও প্রজাবৰ্গকে আশ্বস্ত করিতে পাঠাইলেন। প্রতিদিন দলে দলে বাদশাহী কৰ্ম্মচারী ও ওমরাহগণ নূর মঞ্জিলের বাগানে আসিয়া ‘উদীয়মান সূর্য্য” কে উপাসনা করিতে লাগিলেন এবং আওরংজীবের অধীনে কৰ্ম্ম লইলেন।

শাহজাহান দুইজন প্রবীণ কর্ম্মচারীকে চিঠি দিয়া আওরংজীবের নিকট পাঠাইলেন, কিন্তু কোনই সন্তোষজনক উত্তর আসিল না। অবশেষে হতাশার বলে বলীয়ান হইয়া বৃদ্ধ নরপতি দুর্গদ্বার বন্ধ করিয়া দিয়া অবরোধের জন্য প্রস্তুত হইলেন।

আওরংজীব জুলফিকার খাঁ ও বাহাদুর খাঁকে দুর্গ জয় করিতে পাঠাইলেন। তাহারা রাত্রে পৌঁছিয়া আক্রমণ করিল, কিন্তু সেই অজেয় দুর্গের উপর দন্তস্ফুট করিতে পারিল না। সে কালে অবরোধে বড় দেরী হইত, তার উপর আওরংজীব দাক্ষিণাত্য হইতে কোনই অবরোধের সরঞ্জাম আনেন নাই। সেনাপতিদ্বয় যমুনার তীরে দারার বাড়ীতে রহিল, তাহাদের সৈন্যগণ অনেকেই দুর্গ দেওয়ালের ও বাহিরের গাছের নীচে বেশ আশ্রয়ে রহিল; দুর্গের তীর ও গোলা তাহাদের মাথার উপর দিয়া উঁচায় চলিয়া গেল। আওরংজীবের একটি তোপ জাহানারার মসজিদের উপর দাঁড় করান হইল; ইহার প্রথম গোলাতে দুর্গদ্বারের উপরের তোপটির মুখ খণ্ড খণ্ড হইল। আর একটি তোপ দারার বাড়ীর ছাদ হইতে গোলা চালাইয়া দুর্গপ্রাসাদের দোতালা ভাঙ্গিয়া ফেলিল দুর্গরক্ষীদের কামান ভাল চালান হয় নাই। ঐতিহাসিক ঈশ্বরদাস নাগর বলেন যে ইহার দারোগা ইতিকাদ খাঁ ঘুষ খাইয়া ফাঁকা বারুদের আওয়াজ করিয়াছিল এবং রাত্রে দ্বার খুলিয়া আওরংজীবের লোকদিগকে মধ্যে আসিতে দিয়াছিল। কিন্তু দুর্গের ২৫০০ পদাতিক-কালমক্; হাবশী, ও তুর্ক বিশ্বাসী ও বীর বোদ্ধা ছিল; তাহাদের বন্দুকের চোটে কেহ দুর্গের বাহিরে মাথা দেখাইতে পারিল না। দুর্গমধ্যের অনেক ওমরাহ ও মসবদার অবরোধ ক্লেশ সহ্য করিতে না পারিয়া প্রথম দিন সন্ধ্যার সময় যে ভিস্তিরা যমুনা হইতে একটি ছোট দ্বার দিয়া দুৰ্গমধ্যে জল আনিত, তাহাদের তদারক করিবার ভান করিয়া, বাহিরে গিয়া পলায়ন করিল।

তবুও দুর্গ জয়ের কোনই আশা দেখা দিল না। তখন আওরংজীব মন্ত্রণা করিয়া এই ফন্দি বাহির করিলেন যে যমুনার জল লওয়া বন্ধ করিয়া দুর্গবাসীদিগকে পিপাসায় মারিয়া দুর্গ জয় করিবেন। পরদিন তাঁহার সৈন্যগণ হাজরি দরজা অবধি আগাইয়া জল লইবার পথ বন্ধ করিল এবং নদীর ধারে দিনরাত পাহারা দিতে লাগিল। দুর্গের মধ্যে যে কি কষ্ট হইতে লাগিল তাহা সহজে কল্পনা করা যাইতে পারে। বাদশাহ ও ওমরাহগণ চিরদিন ‘গলিততুষার ‘ যমুনার বিশুদ্ধ জল পান করিয়া আসিয়াছেন, এখন কি আর দুর্গের পুরাতন অব্যবহৃত কূপ কয়টির কষায় জল খাইতে পারেন?

পিতা পুত্র

তখন শাহজাহান এ মৰ্ম্মস্পর্শী চিঠিখানি আওরংজীবকে পাঠাইলেন:-

“বাবা আমার। বীর আমার। এইমাত্র কাল আমি নয় লক্ষ অশ্বারোহীর অধীশ্বর ছিলাম। আর আজ আমার একটি জল দেবার চাকরের অভাব!

হিন্দুদের যাহা হউক, ধন্য বলি,
তাহারা মৃত (আত্মীয়) কে জল দান করে।
কিন্তু, হে পুত্র। তুমি এমন অদ্ভুত মুসলমান
যে আমি জীবিত থাকিতে জল হইতে বঞ্চিত করিয়াছ!”

আওরংজীব চিঠির পৃষ্ঠে উত্তর লিখিলেন, “যেমন কর্ম্ম তেমনি ফল! আর বেশী লেখা বেআদবী।” (১)

বাদশাহ নিরুপায় হইয়া এই গম্ভীর চিঠি তাঁহার বিজয়ী নির্ম্মম পুত্রকে পাঠাইলেন, “পিতৃভক্তি একেবারে ভুলিয়া গিয়াছ। আমাকে শত্রু বলিয়া বিবেচনা কর এবং আমাকে যেসব কষ্ট দিতেছ তাহাতে তোমার ইহ জগতে লজ্জা ও পরকালে সৰ্ব্বনাশ হইবে, শেষ বিচারের দিন কি বলিয়া আত্মরক্ষা করিবে? যুদ্ধ জয় করিয়াছ বলিয়া উন্মত্ত হইও না। আশা করিও না ভাগ্য চিরকাল তোমার পক্ষে থাকিবে, কারণ ভাগ্য বড় পরিবর্তনশীল। যাহাতে নিজের ক্ষতি হইবে এরূপ কাজ করিও না। জগৎজন আমার রাজত্বের গৌরব ও সমৃদ্ধি দেখিয়া মুগ্ধ ছিল, ইহার শেষ অংশ তুমি বিষময় করিও না। সাধু পুত্রের মতো কার্য্য কর, যেন তোমার নাম ও যশ চিরস্থায়ী হয়।”

আওরংজীব উত্তরে লিখিয়া পাঠাইলেন, “আমি বাধ্য পুত্র, অধুনা যাহা করিয়াছি তাঁহার কারণ এই যে ভয় ও নিরাশায় আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র ধরিতে বাধ্য হইয়াছি, নচেৎ আপনার উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিয়া চরণে উপস্থিত হইতাম। এখন দুর্গটা আমার লোকদের হাতে ছাড়িয়া দিন, তারপর আমি বিনীত ভাবে উপস্থিত হইয়া আপনার ক্ষমা ভিক্ষা করিব।”

শাহজাহান সম্মত হইলেন। অবরোধের তৃতীয় দিন তাঁহার লোকগুলি দুর্গ ছাড়িয়া দিল, এবং আওরংজীবের পুত্র মহম্মদ সুলতান সসৈন্যে প্রবেশ

করিয়া দখল লইলেন (৮ই জুন) এইরূপে আগ্রাদুর্গ ও তাহার অসীম ধনরাশি যাহা বাদশাহেরা তিন পুরুষ ধরিয়া জমা করিয়াছিলেন-অতি সহজে হস্তান্তর হইল।

শাহজাহান বন্দী

বিজিত ‘শাহানশাহ’ এই ভ্রাতৃদ্রোহী যুদ্ধ থামাইবার এক শেষ চেষ্টা করিলেন, তিনি এখনও আশা ধরিয়া রহিলেন যে তাঁহার সাম্রাজ্য চারি পুত্রের মধ্যে ভাগ করিয়া দিয়া শান্তি স্থাপন করিবেন। বয়োবৃদ্ধ মান্যবর উজীর জাফর খাঁ জ্যেষ্ঠা রাজকুমারী জাহানারা, দু’জনে ক্রমান্বয়ে আওরংজীবের নিকট গিয়া বাদশাহের প্রার্থনা নিবেদন করিলেন। কিন্তু তাঁহারা আওরাংজীবকে জানিতেন না; তাঁহারা জানিতেন না যে,

“রাজধর্ম্মে ভ্রাতৃ ধর্ম্ম বন্ধুধৰ্ম্ম নাই,
শুধু জয় ধৰ্ম্ম আছে।“

আওরংজীব উত্তর করিলেন যে তিনি পিতার অত্যন্ত বাধ্য বটে, কিন্তু তাঁহার মত ধার্মিক মুসলমানের পক্ষে ‘কাফির’ দারাকে দূর করিয়া দেওয়া ‘লোকহিতের জন্য’ অবশ্য কর্তব্য।

১১ই জুন আওরংজীব নূর মঞ্জিল বাগান হইতে মহা সমারোহে রওনা হইলেন, ইচ্ছা বাদশাহের সঙ্গে দেখা করা। এমন সময় শায়েস্তা খাঁ ও শেখ মির আসিয়া অনেক রকম যুক্তি দিয়া তাঁহাকে নিরস্ত্র করিল। একখান বাদশাহী চিঠিও ধরা পড়িল, যাহা হইতে বুঝা গেল যে বৃদ্ধের হৃদয় এখনও জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্য কাঁদিতেছিল। সুতরাং সাক্ষাৎ করার সংকল্প ত্যাগ করিয়া আওরংজীব গিয়া আগ্রা শহরে দারার প্রাসাদ অধিকার করিলেন।

জীবনে আর পিতা পুত্রের দেখা ঘটিল না। ১২ই জুন হুকুম হইল যে শাহজাহানের কয়েদ আরও কঠিন করিতে হইবে; তাঁহার সমস্ত ক্ষমতা লোপ করা হইল এবং আগ্রা দুর্গের অন্দরের বাহিরে আসা বন্ধ হইল। এই প্রাসাদ কারাগারে বৃদ্ধ জীবনের শেষ আট বৎসর কাটাইলেন, একমাত্র সান্ত্বনার আধার সেই অবিশ্রান্ত সেবিকা দেবকল্পা জাহানারা ‘মুঘলরাজ্যের এন্টিগনি’। কিন্তু তিনি বিজয়ী পুত্রের ব্যবহার ভুলিতে পারিলেন না। এই শেষ কয় বৎসরে তিনবার জাহানারা অত্যাচারী ভ্রাতার জন্য পিতার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করেন, দুইবার বাদশাহ অস্বীকার করিলেন। কিন্তু দয়া জগতে অজেয়, তৃতীয়বার তাঁহার চেষ্টা সফল হইল। শাহজাহান আওরংজীবকে ক্ষমা করিলেন।

[দলিল–(১) আকিল খাঁ রাজীব লিখিত জফরনামা-ই-আলম-গিরি। কলিকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির পারসী হস্তলিপি নং ডি. ২৩৯। (২) মির মহম্মদ মাসুমের তারিখ ই-শাহশূজাহ ইণ্ডিয়া আফিস লাইব্রেরীর পারসী হস্তলিপি নং ৫৩৩। (৩) ঈশ্বর দাস নাগরের ফতুহাৎ-ই-আলমগিরি ব্রিটিশ মিউজিয়মের পারসী হস্তলিপি নং এডিশানাল ২৩৮৮৪। (৪) ঐ স্থানের পারসী হস্তলিপি নং এডিশানাল ১৮৮৮১ এর ৭৭ক পৃষ্ঠায় ‘মৰ্ম্মস্পর্শী চিঠি’ খানা আছে। (৫) মুদ্রিত আলমগিরনামা হইতে কেবল তারিখ লওয়া হইয়াছে এবং (৬) খাফি খাঁর ইতিহাস হইতে কেবল শেষ ঘটনাটি উদ্ধৃত হইল। এই সব গ্রন্থ সমসাময়িক, উর্দু ইতিহাসের মতো ঘটনার অনেক পশ্চাদ্বর্ত্তী এবং গুলিসুরী গুজবপূর্ণ নহে। বলা বাহুল্য আওরংজীবের চাটুকার সভাসদগণের লিখিত ইতিহাসে এই প্রবন্ধের অনেক ঘটনাই নীরবে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে।

চারি নম্বরে বর্ণিত চিঠিখানির আমল এইরূপ:-

“বাবা-এ-মন, বাহাদুর-ই-মন, দিরোজ, সাহিব্‌-ই-নঃ লাখ সোয়ার বুদেম্, ও ইমরোজ বা এবং আবদার মুহতাজ।

(মস্‌নবী )

আফ্রিন্ বর, হনুদ দর্ হর বাব্
মুদারা মি দেহন্দ দায়েম্ আব্
আয়ং পেসর তু আজব্ মুসলমানি
জিন্দা জানস্ বা আব্ নারসানি।’
জবাব আজ্‌-তফ্‌-ই আলমগির বর্ পুশ্ৎ-ই রোকা-
‘কর্দা-এ-খেশ্ আয়েদ্ পেশ্। জিয়াদা হদ্দ-ই-আদব্।’

পারসী হইতে অনুবাদ করিতে সর্ব্বত্রই সংক্ষেপে এবং কয়েকস্থানে সরল করিয়াছি, অবিকল রাখি নাই।]

[প্রবাসী, ভাগ ৬, সংখ্যা ৮, অগ্রহায়ণ, ১৩১৩।]

১। এই উত্তরের নৃশংসতা নিম্নলিখিত ঘটনা হইতে ভাল বুঝা যাইবে; মির মহম্মদ মাসুম তাঁহার ইতিহাসে লিখিয়াছেন:-

একদিন কোন কার্য্যোপলক্ষে আগ্রা প্রাসাদে বাদশাহের ঘুসালখানাতে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম একজন সুন্দর সুসজ্জিত যুবক শাহজাহানকে ময়ূর পাখা দিয়া বাতাস করিতেছে। অনেক বৎসর পরে রাজসভায় আসিয়াছি বলিয়া তাহাকে চিনিতে পারিলাম না। একজন বন্ধু বলিয়া দিলেন। “উনি কুমার আওরংজীব।” পরদিন আমার প্রভু শাহশূজার সঙ্গে বাদশাহী শিকারস্থানে গেলাম, ফিরিবার সময় দেখি যে সেই যুবক একটা পানদান কোমরে বাঁধিয়া ঘোড়া ছুটাইয়া চলিতেছে, বন্ধু বলিলেন, “ওটা বাদশাহের পানদান, তাঁহাকে পান পরিবেশন করার ভার উহার হাতে”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *