বাদশার সমাধি
অনেক অনেক কাল আগেকার কথা।
আমরা তিন বন্ধু গেছিলাম দিল্লিতে বেড়াতে। প্রতি বছর পূজার ছুটিতে আমরা তিন বন্ধু বাইরে কোথাও-না-কোথাও বেড়াতে যেতাম।
তখন এদেশে ব্রিটিশ রাজত্ব। বাংলাদেশ তখনও দু-ভাগ হয়নি।
সারা ভারতের লোক তখন পরম সুখে দিন কাটাচ্ছে। দেশে এত দাঙ্গাহাঙ্গামা ছিল না। এত খুনজখম ছিল না। এত গুণ্ডামি, রাহাজানিও ছিল না।
সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে পথে বের হতে পারত।
তিনজনে আমরা টিকিট কেটে সেদিন সকালে তুফান মেলে উঠে বসলাম।
ওল্ড দিল্লিটা ছিল অনেকটা আমাদের চিৎপুর রোডের মতো। সরু সরু রাস্তা, সরু সরু গলি, পুরোনো আমলের সব ঘরবাড়ি। আর আমরা যেখানে উঠেছিলাম, সেই ‘ফতেপুরী’ ছিল ওল্ড দিল্লি স্টেশনের খুব কাছে। ওল্ড দিল্লিতে দর্শনীয় ছিল লাল কেল্লা, জুম্মা মসজিদ, লৌহোরি গেট, আজমীরী গেট, কাশ্মিরী গেট প্রভৃতি।
ওল্ড দিল্লি থেকে বাসে উঠে আমরা নিউ দিল্লিতে গিয়ে সেন্ট্রল সেক্রেটারিয়েট, ভাইসরয়ের বাড়ি এবং আরও নানা দ্রষ্টব্য স্থান দেখলাম। একদিন বাসে উঠে তিনজন গেলাম কুতুবমিনার দেখতে। এই ঐতিহাসিক কীর্তি দেখে খুব ভালো লাগল।
আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। এবার হাওড়ার দিকে ফিরব বলে কথাবার্তা বলছি। ওই হোটেলের ম্যানেজার আমাদের প্রশ্ন করলেন— আমরা কী কী দর্শনীয় স্থান দেখলাম।
আমরা আগ্রা মথুরা থেকে দিল্লি পর্যন্ত যা যা দেখেছি সব তাঁকে বললাম। এমনকী সেকেন্দ্রার আকবরে সমাধি পর্যন্ত দেখেছি, বললাম।
তিনি তখন বললেন, ‘আপনারা কুতুবপুর যাননি?’
আমরা বললাম, ‘না।’
তিনি বললেন, ‘পূর্ণিমার রাতে কুতুবপুরের বাদশার সমাধি একটি বিশেষ দ্রষ্টব্য বস্তু।’
আমরা প্রশ্ন করলাম, ‘সেটা এখান থেকে কতদূর?’
‘বেশি দূর নয়— মাইল পনেরো-ষোলো। বাসে যেতে হয় কুতুবপুরে। স্টেশন থেকে বাস ছাড়ে। তারপর হেঁটে মাইল খানেক গেলেই বাদশার সমাধি।’
আমরা প্রশ্ন করলাম, ‘এ কোন বাদশা?
ম্যানেজার বললেন, ‘মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অনেক বাদশা দিল্লির সিংহাসনে আসীন হন— কিছুদিন পরেই তাঁরা আবার একে-একে চক্রান্তের শিকার হয়ে নিহত হন। ইনি তাঁদের মধ্যে একজন। এই বাদশা ও তাঁর বেগমকে চক্রান্তকারীরা ওই কুতুবপুরেই হঠাৎ আক্রমণ করে হত্যা করে। তাঁদের সমাধিই ওখানে আছে।
একটু ভেবে ম্যানেজার বললেন, ‘আগামী পরশু তো পূর্ণিমা আছে। ওইদিন সকালে খেয়ে-দেয়ে রওনা হবেন। সব দেখে পরদিন ফিরবেন।’
আমরা রাজি হলাম।
গাইড ধরলাম আমরা কুতুবপুরে গিয়ে। সে আমাদের সঙ্গে চলল বাদশার সমাধিতে।
তখন সন্ধ্যা সাতটা। আমরা সমাধি থেকে কিছু দূরে একটা গাছের কুঞ্জের আড়ালে বসে রইলাম। মাঝে-মাঝেই এখানে এমন সব ঝোপ আছে। এদের বলে কুঞ্জ।
আমরা গাইডকে প্রশ্ন করলাম, ‘এইসব কুঞ্জে সাপ-খোপ নেই তো?’
‘না, সব নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়।’
আমরা প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে এই সমাধি দেখতে কি প্রায়ই লোক আসে?’
‘হ্যাঁ আসে বটে, তবে শুধু পূর্ণিমায়। সবাই তো এ-সমাধির কথা জানে না। তাই ভিড়ও হয় না।’
আমরা চুপ করে বসে রইলাম।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল।
সঙ্গে-সঙ্গে দেখি আজব কাণ্ড।
একটি সমাধি থেকে বাদশা এবং অন্য সমাধি থেকে বেগম বের হলেন।
বাদশা হাততালি দিলেন দু-বার।
সঙ্গে-সঙ্গে কোত্থেকে একটা সুন্দর সিংহাসন বার করে আনল দু-জন লোক ধরাধরি করে। তারপর তারা একটা আলবোলা আনল। তাতে সুগন্ধি তামাক সেজে দিল।
বাদশা ও বেগম সিংহাসনে বসলেন।
বাদশা বুড়ুক-বুড়ুক করে আলবোলা টানতে শুরু করলেন।
অপূর্ব সুমধুর গন্ধে চারদিক যেন আমোদিত হয়ে উঠল। তামাকের যে এত সুমধুর গন্ধ হয়, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।
তামাক খাওয়া শেষ হল।
তারপর বাদশা আবার দু-বার হাততালি দিলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে এসে হাজির হল বিশাল একটা সাদা ঘোড়া।
বাদশার পরনে ছিল দামি কুর্তা, পাজামা, মাথায় দামি উষ্ণীষ। তাতে অনেক হিরা, মণি, মুক্তা বসানো। কুর্তাতেও মাঝে মাঝে হিরা, চুনী, পান্না প্রভৃতি বসানো।
চাঁদের আলো সেগুলির ওপরে পড়ে ঝকঝক করছিল যেন। বাদশার কোমরে খাপে মোড়া তলোয়ার।
বাদশা তারপর ঘোড়ার পিঠে উঠলেন।
বেগমকে ইশারায় সিংহাসনে বসে থাকতে বললেন।
বাদশা ঘোড়ায় চেপে ভ্রমণে বের হলেন।
খটাখট-খটাখট করে শব্দ তুলে ঘোড়া ছুটে চলল বাদশাহকে পিঠে নিয়ে।
একটু পরে তারা অদৃশ্য হল।
দু-জন বাঁদী এসে বেগমের হাত-পা টিপতে লাগল।
আমাদের চোখের সামনে একের-পর-এক এইসব দৃশ্য দেখতে লাগলাম। এ যেন কোনো যাত্রা নাটকের অভিনয় দেখছি।
মিনিট কুড়ি-পঁচিশ কেটে গেল।
তারপর আবার দূর থেকে শোনা গেল খটাখট শব্দ।
দেখা গেল বাদশা ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে আসছেন।
এইসময় আমার কেমন যেন মনে হল, এইসব কিছু সাজানো নয় তো? কতকগুলি লোক হয়তো এসব অভিনয় করছে।
আমি লাফ দিয়ে উঠে গিয়ে বাদশার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে কুর্নিশ করলাম।
বাদশা তাকালেন আমার দিকে।
কেমন যেন নিষ্প্রভ দৃষ্টি। মরা কোনো জন্তু-জানোয়ারের চোখের মতো। সেই চোখের দৃষ্টি স্থির, চোখের পাতা নড়ছে না।
বাদশা বললেন, ‘কোন হো তুম?’
আমি বললাম, ‘ম্যয় হুঁ এক গরিব ভিখারি বান্দা। বাদশাকো পাশ কুছ ভিখ মাঙতা হুঁ।’
সঙ্গে-সঙ্গে বাদশা পকেটে হাত দিয়ে কতকগুলি সোনার আমলকী বের করে আমার দিকে ছুড়ে দিলেন।
সেগুলি ছিটকে পড়ল।
আমি আমলকীগুলি কুড়িয়ে পকেটে রেখে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম, এতগুলি সোনার আমলকীর দাম কয়েক হাজার টাকা হবে।
কিন্তু এদিকে কবরের কাছের সেই বাদশা ও বেগমের মূর্তি এবং তাঁদের সব সঙ্গীসাথীদের মূর্তি যেন হঠাৎ কোথায় মিলিয়ে গেল।
গাইড ছোকরা আমার কাছে এসে বললে, ‘এ আপনি কী করলেন?’
‘কেন? কী হল?’
আপনার জন্যে ওরা অদৃশ্য হল। তা না হলে আপনারা কত কী দৃশ্য দেখতে পেতেন।
আমি বললাম, ‘মৃত আত্মাদের এইসব দৃশ্য দেখে লাভ কী?’
গাইড বললে, ‘এইসব দেখতেই তো লোকে আসে এখানে।’
আমি বললাম, ‘তার চেয়ে আমি যে আমলকী পেয়েছি, তা অনেক মূল্যবান।’
গাইড ছোকরা কিছু বললে না, শুধু মৃদু হেসে উঠল।
আমরা ফিরে চললাম।
পরদিন ভোর পর্যন্ত একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে বসে গল্প করে কাটালাম।
শুনলাম, প্রতি পূর্ণিমার রাতে চায়ের দোকানটা সারারাত খোলা থাকে।
অবশেষে ভোরের বাসে ফিরে এলাম দিল্লি।
হোটেলের ম্যানেজার আমাদের বললেন, ‘কেমন দেখলেন সব কিছু?’
আমরা তখন সব ঘটনা বর্ণনা করলাম।
তিনি তখন বললেন, ‘কই দেখি আমলকীগুলো।’
আমি পকেট থেকে সেগুলো বের করতে গেলাম।
কিন্তু একী!
পকেটে আমলকী একটাও নেই— তার বদলে সব মাটির খোলার টুকরো। যেন কোনো ভাঙা মাটির হাঁড়ি বা কলসির টুকরো টুকরো চাকতি।
বিস্ময়ে আমরা সকলেই হতবাক হয়ে গেলাম।