বাদশার নেকনজর – ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
পঞ্জাবের হসন-আবদাল শহরে বাদশা আওরঙ্গজেবের একখানা মস্ত বড়ো বাগানবাড়ি ছিল৷ এই বাড়ির বাগানের ভিতর দিয়া জল বাহির হইয়া তোড়ে নীচের একটা নালায় পড়িত৷ সেই নালার মুখে এক বুড়ো জাঁতাকল বসাইয়াছিল৷ বাগানের জল সজোরে জাঁতার উপর পড়িলেই উহা ঘুরিত, সঙ্গেসঙ্গে গম পেষাই হইয়া ময়দা বাহির হইত৷ সেই ময়দা বেচিয়া অতি কষ্টে কাচ্চাবাচ্চা লইয়া বুড়োর দিন গুজরান হইত৷
হসন-আবদাল জায়গাটা পাহাড়ে, কাজেই গ্রীষ্মকালেও খুব ঠান্ডা৷ রাজধানী দিল্লি খুব গরম জায়গা, আওরঙ্গজেব বাদশা তাই এ সময়ে মাঝে মাঝে সদলবলে এখানে হাওয়া বদলাইতে আসিতেন৷ সেবার বাদশা আসার পর তাঁর চাকরবাকরেরা কী জানি কেন, যেখান দিয়া বাগানবাড়ির জল বাহির হইয়া নালায় পড়িত তাহার মুখ বন্ধ করিয়া দিল৷ জলও আর নালায় পড়ে না, বুড়োর ময়দার জাঁতাও আর ঘোরে না৷ শেষে বুড়োর পেট-চলা দায়, ছেলে-মেয়ে লইয়া সে বড়ো মুশকিলে পড়িল৷
বখতাওর খাঁ আওরঙ্গজেব বাদশার একজন বড়ো কর্মচারী৷ বুড়োর কষ্টের কথা একদিন তাঁর কানে গেল৷ তিনি সেইদিনই সন্ধ্যার সময় কথায় কথায় বুড়োর অবস্থা বাদশাকে জানাইলেন৷ আওরঙ্গজেব বাদশা নিজে গোঁড়া মুসলমান, মুসলমান প্রজাদের উপর দরদ তাঁর সব চাইতে বেশি৷ যখন তিনি শুনিলেন, বুড়ো ময়দাওয়ালা একজন মুসলমান-তাঁহারই চাকরবাকরের দোষে অনাহারে মর-মর, তাঁহার যা কষ্ট হইল সে আর কী বলিব? বাদশার মনটা এমন খারাপ হইয়া গেল যে, রাত্রে বিছানায় শুইয়াও তিনি ঘুমাইতে পারিলেন না৷ ভাবিতে লাগিলেন, তিনি তো রাজভোগ খাইয়া তোফা আরামে বিছানায় গড়াইতেছেন, সে বুড়ো বেচারির হয়তো আজ একবেলা এক মুঠা আহারও জোটে নাই৷ পেটের জ্বালায় ছটফট করিয়া মরিতেছে৷ বাদশা আর শুইয়া থাকিতে পারিলেন না, তখনই বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া বখতাওর খাঁকে ডাকাইয়া বলিলেন,-‘এখনই দু-থালা ভালো ভালো খাবার, আর পাঁচটা সোনার মোহর বুড়োর বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে৷’
বখতাওর খাঁ আবার বুড়োর ঠিকানা জানিতেন না৷ অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক পেয়াদার কাছে সন্ধান পাইলেন যে, পাহাড়ের উপরে ছোট্ট এক কুঁড়েঘরে বুড়ো বাস করে৷ একটা লোকের হাতে খাবারের থালা দিয়া বখতাওর তাহার সঙ্গে চলিলেন-বুড়োর উদ্দেশে৷ রাত্রে বুড়োর চোখেও ঘুম ছিল না৷ তাহার ময়দার কল বন্ধ হওয়ায় একটি পয়সাও আয় নেই৷ কাচ্চাবাচ্চা লইয়া ওখানে পড়িয়া থাকিলে যে অনাহারে মরিতে হইবে তাহাও ঠিক৷ এ বয়সে বুড়োর আর নূতন কিছু করিবারও উপায় নাই৷ কী করিবে কোথায় যাইবে, ভাবিয়া সে আর কূল কিনারা পাইতেছে না৷ এমন সময় বখতাওর খাঁ ও তাঁর সঙ্গী বুড়োর বাড়িতে গিয়া হাজির৷ তাঁহারা যখন সেই খাবারের থালা ও মোহরগুলি বাদশার খয়রাত বলিয়া তাহার সামনে ধরিলেন, তখন বুড়ো আনন্দের বেগ সামলাইতে না পারিয়া একেবারে ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিয়ে ফেলিল৷
পরের দিন বুড়োর দুয়ারে বাদশার পালকি আসিয়া হাজির! তাহাকে এখনই রাজবাড়িতে যাইতে হইবে-বাদশার তলব৷ পালকির গায় কত রংবেরঙের ছবি, মকরমুখো রুপোর দাণ্ডিতে সোনার চোখ জ্বলজ্বল করিতেছে৷ বুড়ো তো জীবনে এমন পালকি কখনো চোখে দেখে নাই-পালকিকে সে কুর্নিশ করিবে, না, আর কিছু করিবে, কিছুই ভাবিয়া পায় না৷ শেষে লোকজনদের কথায় সে পালকিতে চড়িয়া বসিল৷ বুড়োকে দেখিয়া বাদশা খুব খুশি হইলেন-আদর করিয়া তাহার ঘর-সংসারের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন-কে আছে, না আছে তাহার খোঁজ লইলেন৷
খোদ শাহানশা বাদশার সামনে আসিয়া দাঁড়াইবে-বুড়ো কখনো মনেও করিতে পারে নাই! তাহার হাত কাঁপে, পা কাঁপে, গলা শুকাইয়া কাঠ হয়, মুখ দিয়া কিছুতেই কথা বাহির হয় না৷
বাদশা তাহাকে ভরসা দিয়া ঠান্ডা করিলে হাতজোড় করিয়া সে অতিকষ্টে ঘর-সংসারের হাল জানাইয়া বলিল যে সংসারে তাহার এক স্ত্রী, দু-টি ছেলে ও দু-টি আইবুড়ো মেয়ে৷ বাদশা দেখিলেন, সংসারে বুড়ো একলা নয়৷ অনেকগুলি পুষ্যি লইয়া সে বেকারে পড়িয়াছে৷ লজ্জিত হইয়া বলিলেন, ‘চাকরবাকরদের দোষেই তোমাকে এত কষ্টে পড়তে হয়েছে৷ তুমি আমার প্রতিবেশী, তোমার দুঃখ দূর করাই আমার কর্তব্য, তা না হলে আমি যে তোমার দুঃখের কারণ হয়েছি সে জন্যে আমি দুঃখিত৷’ বাদশা বুড়োকে নগদ দু-শো টাকা দিলেন, অন্দরের বেগমরাও অনেক টাকাপয়সা, গয়নাগাটি, কাপড়চোপড় দান করিলেন৷ দু-দিন রাজার হালে রাজবাড়িতে কাটাইয়া, বুড়ো ঘরে ফিরিবার জন্য পালকিতে উঠিল৷ বুড়ো তখন আর সে বুড়ো নাই-একেবারে নূতন মানুষ৷ গায়ে তার শাল, কিংখাবের পায়জামা, জামায় আবার জরির কত কাজ, মাথায় বাহারে টুপি, গায়ে আতর গোলাপের খোশবাই! ওই বেশে সে যখন বাড়িতে পৌঁছিল, তখন তাহার স্ত্রী, তাহার ছেলে-মেয়েরা তাহাকে চিনিতেই পারে না৷ তারপর একটু ঠাহর করিয়া দেখিয়া তাহাকে যখন চিনিল, তখন আর তাহাদের আনন্দ দেখে কে!
দিন দুই-তিন পরে আবার বাদশার পালকি বুড়ো ও তাহার মেয়েদের লইতে আসিল৷ পয়সার অভাবে এতদিন আইবুড়ো মেয়ে দু-টির সাদি হইতেছিল না৷ বাদশা তাহাদের সাদির জন্য বুড়োকে হাজার টাকা দিলেন৷ বেগমরা গহনাগাটি, পোশাক-আশাক, আরও কত কী দিলেন! বয়সের দরুণ বুড়োর মুখের মাংস ঝুলিয়া পড়িয়াছিল৷ চোখ দুটিও যাইবার দাখিল৷ বাদশা নিজের হাকিম পাঠাইয়া বুড়োর চোখের চিকিৎসা করাইলেন৷ আর তাহার ছেলে দুটিও বাদশার দেওয়া অনেকরকম দামি জুতো-জামায় জরির তাজে খুদে নবাব সাজিয়া মনের সুখে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল৷ বুড়োর ময়দার জাঁতা আবার আগের মতোই চলিতে লাগিল৷ বাদশা বুড়োর আরও একটা জাঁতা বসাইয়া দিলেন৷ জাঁতা ঘুরিবার জন্যও সরকারি বাগান হইতে আরও বেশি করিয়া জল জোগান হইতে লাগিল৷ বাদশা আওরঙ্গজেব তাঁহার চারকবাকরদের উপর কড়া হুকুম জারি করিলেন-এবার যদি বাগানের জলের অভাবে বুড়োর ময়দার কল চলা বন্ধ হয়, তবে তিনি কারও ঘাড়ে মাথা রাখিবেন না৷