বাদল

বাদল

চাণক্য যখন লেখেন, ‘লালয়েৎ পঞ্চবর্ষাণি দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ’, সে সময় নিশ্চয় আমাদের বাদলের মতো ছেলে জন্মগ্রহণ করিত না। ওই একফোঁটা ছেলে, সবে বোধ হয় দুইটা বৎসর পুরা হইয়াছে, অথচ বাড়িসুদ্ধ এতগুলো লোক ওর পিছনে হিমসিম খাইয়া যাইতেছি। ওর ঠাকুরমার কাছে ওর সাতখুন মাপ, এমন কি, প্রতিদিন সত্য সত্য সাতটি করিয়া খুন করিলেও। কিন্তু তাঁহার মুখেও কখনো কখনো শোনা যায়, “না, আমাদের কম্ম নয়; আমরা হার মানলাম বাপু, ও ছেলেকে শাসনে রাখবার জন্যে একটা লেঠেড়া রাখতে হবে।”

অর্থাৎ লালনের ব্যবস্থাটা বাদলের সম্বন্ধে ক্রমেই অচল হইয়া উঠিতেছে। তবে লেঠেড়াতেও যে তাহাকে বেশ আঁটিয়া উঠিতে পারিবে, সে সম্বন্ধে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে; কারণ, তাহার দৌরাত্ম্যে ছেলেমেয়েদের মধ্যে এবং তাহার মা প্রভৃতি দুই-একজন বড়দের মধ্যেও গোটাকতক অ্যামেচার লেঠেড়া গড়িয়াই উঠিয়াছে; কিন্তু বাদল তো এখন ঠিক যে বাদল সেই বাদল।

আমি তো “তোর যা ইচ্ছে কর বাপু” বলিয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছি, এক রকম নিরাশ হইয়াই; কারণ ছোট ছেলেদের, দেশের ভবিষ্যৎ আশাদের, শরীর এবং মনের তত্ত্ব—এবং এই দুইটিকে উৎকর্ষিত করিবার উপায় সম্বন্ধে মোটা মোটা দামী ফরাসী, জার্মান, ইংরেজি প্রভৃতি বই হইতে এত পরিশ্রমে যে জ্ঞান এবং ধারণা আহরণ করিয়াছিলাম, তাহা বিলকুল ওলটপালট হইয়া গিয়াছে। আমার আঠাশ টাকার পাঁচখানা অতিকায় বইয়ের কোনো পাতাতেই বাদলের কোনো অংশ ধরা পড়ে না। কেতাব-লেখকের পাকা ঝুনো মাথায় যে সবের ধারণাও কস্মিনকালে আসিতে পারে না, এমন সব নিত্যনূতন অনাসৃষ্টির মতলব এই একরত্তি ছেলেটির মাথায় ঠাসা। এই চরিতাখ্যানের আদ্যোপান্ত পড়িলে বুঝা যাইবে যে, চেষ্টার আমি কসুর করি নাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুঝিয়াছি, এছেলেকে বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা খালি পয়সার শ্রাদ্ধ, সময় আর উৎসাহের অপব্যয়। ওর যাহা অভিরুচি করুক গিয়া।

তবে ইহার মধ্যে বাড়ির লোকদের বেশ একটু দোষ আছে। প্রথমত—মা। তাঁহার একটা গুমর, ছেলেপিলেদের সম্বন্ধে কোনো বেটাছেলে কিছু বোঝে না; জোর করিয়া বলেন, “একেবারে কিচ্ছু নয়, আমার কাছে লিখিয়ে নাও এ কথা।”

আমাদের সম্বন্ধে এ রকম হীন ধারণায় রাগ হয়, বলি, “তুমি কি বলতে চাও মা, এই সাত টাকা, দশ টাকা দামের বইগুলো সবাই খাতিরে পড়ে কিনছে? এতে ছেলেদের

“দুধ জ্বাল হতে পারে পুড়িয়ে। থাম, আর বকিস না বাপু।”

এর পর আর বকিতে ইচ্ছাও হয় না।

কিন্তু ইহাতেও তেমন কিছু ক্ষতি নাই। ক্ষতি হইতেছে এইখানে যে, বিশেষ করিয়া বাদলের সম্বন্ধে আবার দুনিয়ার মেয়ে পুরুষ কেহই কিছু বুঝে না, এক তিনি ছাড়া। কি করিয়া এই ধারণা মাথায় বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছে যে, ও এক মহাপুরুষ হইবে, ব্যস, ওর সাজা নাই, বকুনি নাই, এমন কি ওর দুষ্টামিতে বাধা দেওয়ারও হুকুম নাই বলিলে চলে। অত্যাচারের আতিশয্যে এক-একবার যে রাগ দেখান, সেটা একেবারে মৌখিক, আদরেরই রূপান্তর।

সেদিন শিশুদের অনুকরণপ্রিয়তা ও স্বাধীন চিন্তার উন্মেষ সম্বন্ধে একটা নিবন্ধ পড়িতেছি, হঠাৎ ছেলেমেয়েদের পড়িবার ঘরে হাসিকান্নার একটা মস্ত হট্টগোল উঠিল। একটু পরে বাম হাতে দক্ষিণ হাতটা ধরিয়া রাণু কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটিয়া আসিল। দেখি, কব্জির উপর স্পষ্ট চারিটি দাঁতের দাগ, লাল হইয়া উঠিয়াছে।

জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে করেছে?”

“বাদল, রাক্ষস ছেলে।”

“হুঁ, তা বুঝেছি। কোথায় সে, চল দেখি।”

ঘরে গিয়া তদন্তে জানা গেল, গৃহশিক্ষক জগন্নাথবাবু যাওয়ামাত্র বাদল আসিয়া তাঁহার আসনটি অধিকার করিয়া বসে এবং শিক্ষকতার বাজে অংশগুলিতে সময় অপব্যয় না করিয়া একেবারে সার অংশ লগুড়-চালনায় লাগিয়া যায়। ছাত্রছাত্রীরা জাঙিয়া-পরা এই কচি মাস্টারের অভিনব মাস্টারি খানিকটা আমোদচ্ছলে উপভোগ করিল; কিন্তু তাহার অব্যর্থ সন্ধানের চোটে আমোদের ভাগটা ক্রমেই সাংঘাতিক রকম কমিয়া আসিতে লাগিল। তখন রাণু লগুড়টি কাড়িয়া লয়, তাহার পর এই কাণ্ড।

বাদল একপাশে দাঁড়াইয়া মুখে চারিটি আঙুল পুরিয়া দিয়া অপ্রতিভভাবে সব শুনিতেছিল। হঠাৎ সজাগ হইয়া উঠিয়া গটগট করিয়া আমার সামনে আসিয়া দাঁড়াইল এবং মুখটা তুলিয়া বলিল, “কাকা, হাম হাম।”

রাণু বলিল, “অমনই ছেলে ঘুষ দিতে এলেন, ভারি চালাক!”

ঘুষ লইবার মতো আমার মনের অবস্থা ছিল না। বাদলের হাতটা ধরিয়া বাড়ির ভিতর গিয়া একটু রাগতভাবেই জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে একে ওদের পড়বার ঘরে যেতে দিয়েছিল, আমি না পইপই করে বারণ করে আসছি?”

মা বলিলেন, “যেতে আর দেবে কে? ও কি কারুর হুকুমের তোয়াক্কা রাখে নাকি? তোমাদের এক অদ্ভুত ছেলে হয়েছে, রাজার রেয়ৎ নয়, মহাজনের খাতক নয়, মনে হল ভেতরে রইল, মনে হল বাইরে টহল দিতে গেল; কে ওকে রুকছে বল!”

বলিলাম, “না, দিনকতক একটু সজাগ থাকতেই হবে মা; দরকার হয়, ওর মার সংসারের পাট করা একেবারে বন্ধ করে দাও দিনকতকের জন্যে। তোমরা বোঝ না, এটা ওদের নকল করবার বয়স কিনা, যত সৎ জিনিসের নকল করতে শিখবে ততই মঙ্গল। এখন যদি বাইরে গিয়ে জগন্নাথবাবুর হুঙ্কার, বেত আছড়ানি, কিংবা ঠাকুর আর চাকরের নিত্য ঘুষোঘুষির নকল করতে যায় তো ও একটি আস্ত খুনে হয়ে উঠবে, এই বলে দিলাম। এখন ওদের মনটা—”

মা কি বলিতে যাইতেছিলেন, আমি বাধা দিয়া বলিলাম, “হ্যাঁ, জানি আমার কোনো কথাই তোমাদের পছন্দ হয় না। কিন্তু এ তো আমার নিজের মনগড়া কথা নয়। এ যে ফরাসী লেখকের বই থেকে তুলে বলছি, সে যে-সে লোক নয়; বইটার এর মধ্যে সাত- সাতটা সংস্করণ—”

মা যেন উদ্ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “আঃ, তুই থাম দিকিন বাপু; কচি ছেলে নকল করতে শেখে—এ কথা জানবার জন্যে নাকি আমায় ফারসী আরবী বই ওটকাতে হবে, গেলাম আর কি! এই নকলের চোটেই তো গেরস্তকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেয়েছে, কিন্তু করা যায় কি? এই তো এক্ষুনি মায়ের ঘরে কীর্তি করে এল। ঘরের মেঝেয় এক বাটি দুধ আর একটা ঝিনুক রেখে বেচারী কি কাজে একটু এদিকে এসেছে। আর আছে কোথায়! লুসীর কোল থেকে তার ছানাটা টেনে নিয়ে গিয়ে, থেবড়ে বসে, সেটাকে চিত করে কোলে ফেলে, মুখের মধ্যে ঝিনুক পুরে দুধ খাওয়ানোর সে ধুম দেখে কে! ঘরের মধ্যে কেঁউ-কেঁউ শব্দ কিসের? গিয়ে দেখি, ওম্মা! ছেলে দুধের সমুদ্রের মধ্যে বসে, আর ওই কাণ্ড! থমকে দাঁড়াতে, মুখের দিকে চেয়ে ‘বাদো ডুডু’।—তার মানে উনি হয়েছেন মা, লুসীর ছানা হয়েছে বাদল, মার বাদলকে দুদু খাওয়ানো হচ্ছে। বাঁচাতে বাঁচাতেও বউমা এসে দিলে ঘা-কতক বসিয়ে। এখন বল, চাও এমন সৎকাজের নকল? ওকে বাইরে রাখবে, কি ওর জন্যে একটা খোঁয়াড় গড়বে, তোমরাই ঠিক কর। বাড়ির সবাই তো হেরে বসে আছি।”

আমি বললাম, “আমার উদ্দেশ্য তুমি ঠিক ধরতে পার নি মা, ওর কাছে তো ভালোমন্দ বলে প্রভেদ নেই। কাকে নকল করতে হবে, কোনটা নকল করতে হবে কি ভাবে নকল করতে হবে, আমাদেরই বেছে দেখিয়ে দিতে হবে। নিজের স্বাধীন ইচ্ছে খাটাতে গেলেই গলদ। চোখে পড়লে আমাদের ধমকে-ধমকে শুধরে দিতে হবে। বেশ তো, আজকের এই দুটো ব্যাপারই এখন টাটকা রয়েছে, এই দুটো নিয়েই আরম্ভ করা যাক।”

বাদল মার কাছ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া মুখে চারিটি আঙুল পুরিয়া দিয়া অপরাধীর মতো নিজের কীর্তিকাহিনী শুনিতেছিল, আমি হাতটা ধরিয়া সামনে দাঁড় করাইয়া চোখমুখ কুঞ্চিত করিয়া বলিলাম, “বাদল!”

আজ ঝোঁকটা বড় বেশি পড়িয়াছে, বাদলের ঠোট দুইটি ঈষৎ কাঁপিয়া উঠিল। কিন্তু সামলাইয়া লইয়া মার ভাবগতিকটা লক্ষ্য করিবার জন্য তাঁহার মুখের দিকে চাহিল। বিষণ্ণ মুখ, সামলাইয়া-লওয়া কান্নার দুইটি বিন্দু অশ্রু চোখে ঠেলিয়া আসিয়াছে। আস্তে আস্তে ধরা গলায় ডাকিল, “নিন্নী!”

বাস, মা গলিয়া গেলেন। তাড়াতাড়ি কোলে তুলিয়া লইয়া আদরে চুম্বনে যতক্ষণ না মুখটাতে হাসি ফুটাইতে পারিলেন, ততক্ষণ নিরস্ত হইলেন না।

আমি নিরাশ হইয়া বলিলাম, “ওই, সব মাটি করলে! কি, না একটু গিন্নি বলে ডেকেছে। মনের ওপর নিজের দোষের জ্ঞানটি দিব্যি জমে আসছিল, তুমি সব ভেস্তে দিলে। ওই জিনিসটি হচ্ছে অনুতাপের অঙ্কুর। তোমরা নষ্ট করেছ ওকে—তুমি আর দাদা মিলে।” মা ধমক দিয়া উঠিলেন, “ক্ষ্যামা দে বাপু, ওইটুকু ছেলের নাকি আবার অনুতাপ, প্রাশ্চিত্তির—অমুঙ্গুলে কথা শোন একবার! করে নিক যত দুষ্টুমি করবে ও; ও শেষ পর্যন্ত একটা মহাপুরুষ হবেই বলে দিচ্ছি। তোরা সব লক্ষণ চিনিস না।’

এই অবস্থা। চুপ করিয়া ভাবিতে থাকি; দুঃখ হয়, এঁরা বিজ্ঞানের দিক দিয়া যান না, মেথড বুঝেন না—ইনি আর দাদা। এ বিষয়ে দাদার গাফিলতি আরও মারাত্মক; কেন না তিনি আবার বিচার এবং শাসনের অভিনয়ের মধ্য দিয়া প্রকাশ করেন সেটা।

কোর্ট হইতে আসার সঙ্গে সঙ্গে দাদার ঘরে তাঁহার দৈনন্দিন ঘরোয়া কোর্ট বসিয়া গিয়াছে। একপাল বাদী—রাণু, আভা, ভোম্বল, রেখা, আরও সব। ফরিয়াদী মাত্র একটি— বাদল। সে বিচার-পদ্ধতির সনাতন ধারা লঙ্ঘন করিয়া জজের কোলে বসিয়া লেবেঞ্চুস খাইতেছে এবং অবসরমতো মাথা-সঞ্চালন করিয়া কি একটা সুর ভাঁজিতেছে।

নানা রকম ছোটবড় নালিশের চোটে ঘরের মধ্যে হট্টগোল পড়িয়া গিয়াছে। রাণুর হাতে দাঁতের ছাপ, আভার মাথা-ভাঙা কাচের পুতুল, রেখার ছেঁড়া বই, ভোম্বলের ছেঁড়া চুল—এক প্রলয় কাণ্ড! চৌকাঠের বাহিরে লুসীও তাহার পাঁচটি নিরীহ, বিপন্ন, অত্যাচারগ্রস্ত শাবক পাশে লইয়া দীন নয়নে বিচারাসনের দিকে চাহিয়া আছে। দেখিলে এক একবার মনে হয় বটে, তাহার সপরিবারে ওই লেবেঞ্চুসটির দিকে লোভ। কিন্তু সে বেচারী ছাপোষা, বাদলের অত্যাচারে উদ্বাস্তু হইয়া ন্যায়ের দ্বারস্থ হইয়াছে, এ অনুমানেও কোনো বাধা দেখি না।

এমন জবরদস্ত মকদ্দমা দাদা দুইকথায় শেষ করিয়া দিলেন। পকেট হইতে কাগজমোড়া খান-চার-পাঁচ বিস্কুট বাহির করিয়া ফরিয়াদীকে প্রশ্ন করিলেন, “এগুলো সমস্ত পেলে আর দুষ্টুমি করবে না তো বাদল?”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “মন্দ বিচার নয়, আমারও একটু দুষ্টুমি করবার লোভ হচ্ছে। কাল আবার দুষ্টুমি করলে জরিমানার পরিমাণ ডবল হয়ে যাবে তো?”

দাদা বলিলেন, “ও ওইসব করেছে বলে বিশ্বাস হয়? ওর চোখ দুটো দেখ দিকিন।” বেঁটে, চওড়া গড়ন, একটু ঘাড়ে-গর্দানে, আর এই রকম ঘাড়ের উপর প্রকাণ্ড একটা মাথা, এগুলো সবই বাদলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু বড় বড় ভাসা ভাসা চোখ দুইটি সত্যই একটু গোল বাধায় বটে, যদি বাদলের সঙ্গে অষ্টপ্রহর পরিচয় না থাকে। আর সে রকম পরিচয় দাদার বড় একটা নাইও।

সকাল সকাল দুইটি খাইয়া আফিস যান, প্রায় সন্ধ্যার সময় আসেন। ডাক পড়ে, “বাদল!”

শান্ত-শিষ্ট শিশুটি আসিয়া উপস্থিত হয়। দাদার জন্য বিশেষ করিয়া পরানো পরিষ্কার জামা গায়ে, হাতমুখ যত্ন করিয়া মোছানো। আসিয়াই গোটাকতক চুমা উপঢৌকন, প্রায় কাঁদ- কাঁদ হইয়া একবার ‘একা’ একবার ‘আনু’র নাম উচ্চারণ—মানে, রেখা ও রাণুর হাতে আজ সমস্ত দিনটা নির্যাতন গিয়াছে। সান্ত্বনাস্বরূপ লেবেঞ্চুসপ্রাপ্তি। তারপর জ্যাঠার সেবা। জুতা রাখিয়া দেওয়া, চটি আনিয়া তাঁহার পা দুইখানি পাতিয়া

বসাইয়া দেওয়া, হাত-পা ধুইবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়া বেড়ানো; কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই, যেন কোন বাড়ি না কোন বাড়ির ছেলে।

দাদা তৈয়ার হইলে ভাঁড়ার-ঘরে গিয়া দাদার জলযোগের বন্দোবস্তের জন্য মোতায়েন হওয়া, পানের ডিবা হাতে করিয়া আবার প্রবেশ।

তাহার পর বসিয়া বেশ পরিপাটিভাবে দাদার জলখাবারের রেকাবির ভার লাঘব করা।

এই অংশের চতুর্থ অধ্যায়ে দেখা যায়, বাদল দাদার সঙ্গে খানিকক্ষণ হুড়াহুড়ি করিয়া ক্লান্ত হইয়া পাশে শুইয়া পড়িয়াছে। দাদা আস্তে আস্তে তাহার রগের উপর করাঘাত করিতেছেন এবং বাদলের শান্ত অধরে ‘ভাত আসছেন, আমি খাচ্ছেন’-শীর্ষক তাহার স্বরচিত প্রিয় গানটি মৃদুতর হইয়া মিলাইয়া আসিতেছে।

আমি বলিলাম, “ওর চোখ দুটো তো মারামারির জন্যে হয় নি, ওকে বাঁচাবার জন্যে হয়েছে, বাঁচাচ্ছেও বেশ। কিন্তু ওর হাত-পা আর দাঁত—যা ওর অস্ত্র, সেগুলো দেখে তোমার কোনো সন্দেহের কারণ আছে? যদি থাকে তো না হয় বাখারিগুলোও আনিয়ে দিই।”

দাদা হাসিয়া বলিলেন, “শুনছ বাদল, বাদীরা নিজের মুখেও নালিশ করলে, আবার ভালো উকিলও রেখেছে। এখন তোমার কি বলবার আছে, বিশেষ করে বাখারি সম্বন্ধে?” বাদল দাদার হাঁটু-ঘোড়ার উপর ঘোড়সওয়ার হইয়া বসিয়া ঘোড়াকে চালাইবার নানা উপায় লইয়া ব্যস্ত ছিল; বাখারির কথা শুনিয়া সড়াৎ করিয়া নামিয়া পড়িয়া গটগট করিয়া বাহির হইয়া গেল। আমরা তাহার এই হঠাৎ তিরোভাবের কারণ না ধরিতে পারিয়া তাহার পুনরাগমনের প্রতীক্ষা করিতেছি, এমন সময় বাদল একখানা চওড়া, প্রায় হাতখানেকের বাখারি লইয়া প্রবেশ করিল।

চৌকাঠ পার না হইতেই ছেলেমেয়েগুলা কলরব করিয়া উঠিল। কেহ বলিল, “ওটা ওর তরোয়াল, ওই দিয়ে আমার কপালে মেরেছিল, এই দেখ।” কেহ বলিল, “ওটা আমার রাঁধার হাতা, আমায় দিয়ে দিতে বল।” সবচেয়ে ছোট সন্তানবৎসলা আভা কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, “না গো না, ওটা হাতা নয়, তরোয়াল নয়, আমার ছেলে, ওর কাপড় কেড়ে নিয়েছে বাদলা!”

বাদল এসবের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করিয়া সটান দাদার কোলে গিয়া বসিল এবং অচল ঘোড়াটিকে গতিবান করিবার জন্য তাহার এই নূতন আমদানি করা সূক্ষ্ম চাবুকটি উঁচাইয়া ধরিল।

দাদা হাসিয়া উদ্যত চাবুকটি ধরিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, “আহা বাদল, ঘোড়া দুটো সমস্ত দিন তোমার জ্যাঠাটিকে বয়ে বয়ে এলিয়ে পড়েছে, আর এর ওপর ঠেঙিয়ে কাজ নেই।”

বাদল দাদার মুখের দিকে চাহিয়া নালিশের সুরে বলিল, “ডুট্টু।”

দাদা বলিলেন, “আহা, কিছু খায় নি কিনা অনেকক্ষণ, তাই দুষ্টু হয়েছে। তোমায় একটা ভালো ঘোড়া কিনে দোবখন, কি বল?”

তারপর আমায় বলিলেন, “কালকে ছুতোরকে ডেকে একটা কাঠের ঘোড়ার কথা বলে দিস তো।”

বলিলাম, “দোহাই, আর উপসর্গ বাড়িয়ে কাজ নেই। যা সরঞ্জাম সব মজুত—”

দাদা কথাটা শেষ না করিতে দিয়া বলিলেন, “না, কাজ কি? আমার ঠ্যাং দুটো ওই আখাম্বা বাঁশ-পেটা খাক আর কি! এখন ওই ঝোঁক চেপেছে, সেদিন রমনায় ঘোড়দৌড় দেখে।”

বলিলাম, “ছুতোরকে বলে দিতে বিশেষ আমার আপত্তি নেই, শুধু ভয় এই যে, আর একটা ঝগড়ার ঘর বাড়বে। আর, তা ছাড়া কচি ছেলের ঝোঁকমতো সব বিষয়েই যোগান দিয়ে যাওয়াটা ঠিক নয়, তাতে ওদের মন একটা নির্দিষ্ট গতি পায় না। এ কথাটা বেশ সুন্দর একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন বিখ্যাত জার্মান লেখক ফন—”

দাদা বিরক্তভাবে বলিলেন, “তোর ওই কেতাবী বুলি রাখ দিকিন। ছেলেপিলের মন এখন হাজার পথে হুহু করে দৌড়বে, ও মাঝ থেকে পাহাড়-প্রমাণ কেতাবের লাইন ঘেঁটে ঘেঁটে হয়রান হল! বাংলা কথা হচ্ছে, ছোট ছেলের ঘোড়ার শখ হয়েছে, তাকে একটা কিনে দিতেই হবে। না দাও, আমার হাঁটু, তোমার কাঁধ, চেয়ারের হাতল, ছাতের আলসে, যা সুবিধে পাবে ঘোড়া করে বসে থাকবে। শেষকালে একটা কাণ্ড ঘটাক আর কি—”

আভা বলিল, “বারে, ও আমাদের মারলে, আর ওকেই বিস্কুট দেওয়া হল; আবার একটা ঘোড়া পাবে—”

রেখার কথায় ইহার মধ্যেই বেশ ঝাঁজ হইয়াছে। একটু পিছনে ছিল, সে-ই আড়াল হইতেই বলিল, “ও ছেলে কিনা; আমরা সব বানের জলে ভেসে—”

দাদা রাগ দেখাইয়া বলিলেন, “কে রে? রাখী বুঝি? তা মেয়ে হতে গিছলে কেন?”

রেখা আর একটু আড়ালে সরিয়া গিয়া বলিল, “বাদলের মার খাবার জন্যে।”

দুইজনেই হাসিয়া উঠিলাম। দাদা বলিলেন, “একেবারে পেকে গেছে হতভাগা মেয়ে। নাঃ, এরা বেজায় মরীয়া হয়ে উঠেছে। আচ্ছা, তোদের বিচার করে দিচ্ছি, দাঁড়া।”

ডাকিলেন, “বাদলবাবু, এদিকে এসো তো, লক্ষ্মীছেলে।”

বিচারের আশায় বাদীমহলে একটু চঞ্চলতা, ফিসফিসানি পড়িয়া গেল। বাদল দাদার ইজিচেয়ারের পিছনে গিয়া দুলিয়া দুলিয়া বিস্কুট খাইতেছিল এবং রেখার সহিত লুকাচুরি খেলা করিতেছিল; ডাক শুনিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াইল।

দাদা রাণুর হাতটা তুলিয়া ধরিয়া বলিলেন, “এ কি করেছ বল তো? এ তোমার কে হয়?”

গড়পড়তা রোজ এরকম চার-পাঁচটি বিচার-অভিনয় হওয়ায় বাঁধা গতটি বাদলের খুব রপ্ত। দাদার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে দুই হাতে খাসা নির্বিকারভাবে নিজের কান দুইটি ধরিয়া বলিল, “ডিডি অয়।”

“প্রণাম কর।”

হুকুমের পূর্বেই সে অর্ধেক ঝুঁকিয়াছিল, প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। সন্ধির স্বাক্ষর- স্বরূপ রাণু একটা চুমা খাইল। এটিও বাঁধা রীতির আর একটা অঙ্গ।

এইরকম ভাবে দোষের গুরুত্বলঘুত্বনির্বিশেষে পাঁচটি মকদ্দামার এই একই পদ্ধতিতে বিচারকার্য শেষ হইলে দাদা বলিলেন, “কেমন, তোমাদের আর কোনো দুঃখ নেই তো? বাদলের সাজা মনে ধরেছে? আর কোন নালিশ নেই তো আজ?”

ও বয়সে ভাব করিবার ইচ্ছাটাই প্রবল, সেইজন্যই হউক, কি ইহার বেশি বিচারের আশা নাই বলিয়াই হউক, এক রেখা ছাড়া সবাই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “না।”

রেখার ঐতিহাসিক দৃষ্টিটা বেশ তীক্ষ্ণ। সে বলিল, “আবার কাল—”

দাদা হাসিয়া বলিলেন, “বেশ, কালকের কথা কাল দেখা যাবে। এই চারখানা করে বিস্কুট নাও সব; বাদল যদি দুষ্টুমি করে, একটু করে ভেঙে দিও, ঠাণ্ডা থাকবে। যাও, বিচার শেষ।

না বলিয়া পারিলাম না, “এই একঘেয়ে নকল-বিচার ওর মনে কোনও দাগ বসাতে পারে না, এইজন্যেই—”

দাদা তাঁহার সেই হাসির হিল্লোল তুলিয়া বলিলেন, “দাগ বসাতে হলে তো ওরই বিদ্যে শিখতে হয় আমাকেও, রাণুর কব্জিটা দেখেছিস তো? আমার দাঁতে অত জোর-টোর নেই বাপু।”

সবাই চেঁচামেচি করিতে করিতে চলিয়া গেল। বাদল দাদার মুখের পানে চাহিয়া বলিল, “দাত্তা, দুচী?”

দাদা আমায় কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন; অন্যমনস্কভাবে উত্তর করিলেন, “হ্যাঁ জ্যাঠা, লুসী।…আমি যতদূর দেখছি, শৈলেন—”

বাদল আধ-খাওয়া বিস্কুটটা লুসীর দিকে বাড়াইয়া ডাকিল, “আঃ, আঃ।”

লুসী আপনার বাচ্চাগুলিকে ঘাড়পিঠ হইতে ঝাড়িয়া দিয়া লেজ নাড়িতে নাড়িতে উপস্থিত হইল।

দাদা বলিয়া যাইতেছিলেন, “এই তো গ্রামে নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব, দল পাকাতে পেলে সব ছেড়ে তাইতে মেতে ওঠে, কতটা দুঃখের বিষয়ে বল তো?…তুই হাসছিস যে?” আমার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া তিনিও সজোরে হাসিয়া উঠিলেন। বাদল তাঁহার বিচারের ত্রুটিটুকু পূরণ করিয়া দুই হাতে কান ধরিয়া লুসীর সামনের থাবা দুইটির উপর মাথা দিয়া পড়িয়া আছে এবং লুসী তাহার দীর্ঘ জিহ্বা দিয়া পরম ক্ষমাভরে তাহার মাথা-পিঠ চাটিয়া চাটিয়া একশা করিয়া দিতেছে।

দাদার বিচারের সদ্য সদ্য আলোচনা করিবার এমন চমৎকার সুযোগটা আমি নষ্ট হইতে দিলাম না। হাসিতে হাসিতেই বলিলাম, “তোমার বিচারের ফার্সটা যেটুকু অসম্পূর্ণ ছিল, বাদল নিখুঁতভাবে সেটা পুরিয়ে দিলে দাদা।”

.

পরের দিন সকালে দাদার ঘরে বাদলের কথা হইতেছিল। মা বলিতেছিলেন, “ওর তো সর্বজীবে সমান ব্যবহার হবেই, ওসব লক্ষণই আলাদা। স্থির হয়ে এক-একসময় যখন বসে থাকে, ঠিক পরমহংসদেবের মতো মুখের ভাবটি হয়, দেখিস নি! তিনিও নিশ্চয় ছেলেবেলায় ঠিক অমনটি ছিলেন। আর তা ছাড়া অমন একটা বড় তীর্থে জন্মেছে, ও একটা মহাপুরুষ না হয়ে যায় না, তোরা সব—”

এমন সময় বারান্দায় চটাস করিয়া একটা প্রচণ্ড চড়ের আওয়াজ হইল, আর সঙ্গে সঙ্গে বাদলের ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিবার আওয়াজ।

মা তাড়াতাড়ি বাহিরে গিয়া ধমকাইয়া উঠিলেন, “কি বউমা, ছেলের গায়ে হাত? আর ওই রকম হাত? দিন দিন যে কসাই হয়ে উঠছ!”

বউমার চাপা গলায় ক্রুদ্ধ স্বর শোনা যাইতে লাগিল, “আমি তো আর এই ডানপিটে চোরকে নিয়ে পারি না মা; দেখবেন আসুন, রান্নাঘরে কি কাণ্ডটা করেছে হতচ্ছাড়া ছেলে।” দৃশ্যটি নিশ্চয় খুবই মনোজ্ঞ, সবাই উৎসুকভাবে উঠিয়া গেলেন। সরেজমিনে বাদল মুখের মধ্যে চারিটি আঙুল দিয়া দাঁড়াইয়া আছে, দুই হাতের কনুই পর্যন্ত ঝোলে হলুদ হইয়া গিয়াছে, বাম হাতের মুঠোর মধ্যে একমুঠো মাছ। কান্না থামিয়া গিয়াছে, কিন্তু তখনও তাহাব মাকে অতিক্রম করিয়া এদিকে আসিয়া পড়িবার মতো সাহস যোগাইয়া উঠে নাই।

দাদা একেবারে হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, “ও মা, তোমার সাধুপুরুষের সর্বজীবে সমভাবের আর একটা নমুনা দেখ, এইখানে এস, ওই জলের টবটার আড়ালে।” সেখানটায় হঠাৎ কাহারও দৃষ্টি যায় না, আর বাদল কিংবা লুসী ভিন্ন কেহ প্রবেশ করিতেও পারে না। সেই অন্ধকার কোণে ঝকঝকে একখানি রেকাবিতে আধ সের পরিমাণ মাছের মুড়া একটা, রেকাবির এধারে ওধারে কাঁটাকুটা দুই-একটা পড়িয়া আছে। লুসী আরম্ভ করিয়াছিল, এখন সভয়ে গুটিসুটি মারিয়া দীন নয়নে আমাদের মুখের দিকে চাহিয়া আছে।

দাদা হাসিতে হাসিতে রাঙা হইয়া উঠিয়া বলিলেন, “আবার মাজা রেকাবিতে তোয়াজ করে। বাদল, ওটি আমাদের নাতবউ নাকি?”

দার্শনিক হিসাবে বাদল একজন সুবিধাবাদী। বুঝিল, আর দেরি করা নয়। যেন মস্ত একটা ইয়ার্কি চলিতেছে; যাহার মর্ম শুধু দাদা আর সে বুঝে, এইভাবে দাদার পানে চাহিয়া, “তাতবউ!” বলিয়া খুব বড় করিয়া একগাল হাসিয়া পা বাড়াইল, কিন্তু আবার সঙ্গে সঙ্গে ই তাহার মার চোখের দিকে নজর পড়ায় থমকিয়া মুখে চারিটি আঙুল পুরিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

রেখা হাসিয়া বলিল, “ও মহাপুরুষ! তোমার আবার চুরিবিদ্যে!”

মার ধমক খাইয়া আড়ষ্ট হইয়া গেল।

আমরা সরিয়া গেলেই বউমাকে আর রোখা যাইবে না; অন্তত রুখিবার পূর্বেই লুসীঘটিত এই নূতন আবিষ্কারের ঝাল তিনি ঝাড়িয়া লইবেনই। মা তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্য ঢুকিয়া বাদলকে বাহির করিয়া আনিলেন। পরমহংসদেব হইতে একেবারে চুরির দায়ে গ্রেপ্তার, নাতি তাহাকে একটু অপ্রতিভ করিয়া ফেলিয়াছে বইকি।

কাহারও দিকে না চাহিয়া বলিলেন, “ও আমার ননীচোরা, তাঁরও চুরি করে না খেলে পেট ভরত না। নে, আর জটলা করতে হবে না সব, হাতে-নাতে পাট সেরে নে।”

এই রকম কাণ্ডের পর খুব খানিকটা হল্লা-হাসি হয়, যোগদান করি, তারপর বিষণ্ণ হইয়া পড়ি। একটা গোটা ছেলের ভবিষ্যৎ, সোজা কথা নয় তো! এদিকে দেশের এই দুর্দিনে—”

মাকে বলিলাম, “দেখ মা, এ ঠিক হচ্ছে না। এতে করে নাতি তোমার পরমহংসদেবও যত হবে, ননীচোরাও তত হবে, আর বাবার রোঘো-ডাকাতও খুব হবে। এঁর ধড়, তাঁর মুড়ো নিয়ে কিম্ভূতকিমাকার যা হয়ে উঠবে, তা দেখবার মতো হবে নিশ্চয়। তার চেয়ে দিনকতক আমার হাতে দাও। বেশ তো, সাধুপুরুষ চাও, সেই রকম ভাবেই—”  

মা বলিলেন, “তোর কাছে সব রকমের ছাঁচ আছে নাকি যে, ঢালাই করে যেমনটি চাইবি গড়ে টেনে তুলবি? তা রাখ না বাপু, তোর কাছেই। এতগুলো লোককে নাজেহাল করে তুলছে, পারবি তো ওকে সামলাতে?”

দাদা বলিলেন, “কিছু না, ওকে একটা ঘোড়া কিনে দে আপাতত; কিছুদিন ঠাণ্ডা থাকবেখন।”

বলিলাম, “ঘোড়ার খেয়ালটাই মাথা থেকে সরিয়ে দিতে হবে। ওই জিদ ভাঙা দিয়েই আরম্ভ করব।”

“আর ও-ও তোমার প্ল্যান ভাঙা দিয়ে শেষ করবে, এই বলে রাখলাম। কি বাদল, পারবি তো?”

দাদা হাসিতে লাগিলেন।

.

সেইদিন হইতেই আরম্ভ করিয়া দিলাম। ঠিক হইল, এক খাওয়ার সময় ছাড়া বাদল সমস্ত দিন আমার কাছে থাকিবে! সন্ধ্যা হইতে দাদার চাই-ই; অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজী হইলাম, কিন্তু সমস্ত দিনের অপকীর্তির বিচারের ভারটা দাদার হাত হইতে তুলিয়া লইলাম। বলিলাম, “ও ব্যাপারটাকে অত হালকাভাবে নিলে চলবে না, বিচারটা বেশ সূক্ষ্মভাবে ওর সমস্ত দিনের কাণ্ডকারখানা আলোচনা করে করতে হবে। রোজকার রোজ ওর মনের কোনো বিশেষ বৃত্তিকে একটু একটু করে উসকে দিতে হবে, আবার কোনোটাকে বা অল্প অল্প করে নিবিয়ে আনতে হবে।”

দাদা হাসিয়া বলিলেন, “মন্দ হয় না; তাহলে শিগগির মনোবৃত্তির একটা টেম্পারেচার-চার্ট তোয়ের করে ফেল। তা রোগীটিকে বাইরের ধুলো বাতাস থেকে বাঁচিয়ে কোন্ ঘরে পুরে রাখবি?”

রাগিয়া বলিলাম, “ঘরে পোরবার দরকার আছে বলেছি কি? হাসবে খেলবে একটু মারামারিও করবে; এমন কি, চুরিও করতে পারে মাঝে মাঝে, তবে একটা সিস্টেমের মধ্যে। স্পার্টানরা তো তাদের ছেলেদের চুরি করতেও—”

দাদা আবার হাসিয়া উঠিলেন, “অর্থাৎ ছেলেটাকে তুই একটা সিস্টেমেটিক চোর করতে চাস? হাঃ হাঃ হাঃ।”

দাদাকে পারিবার জো নাই।

পরের দিন সতেরো টাকা দামের দুই ভলুম বই আনিতে দিলাম। অথর আমেরিকার একজন বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক; সমস্ত জীবন অবিবাহিত থাকিয়া কেবল শিশুমনের আলোচনা করিয়াছেন।

মা শুনিয়া বলিলেন, “নে, আর জ্বালাস নি বাপু, যে বিয়েই করলে না, ছেলেপিলের মুখ দেখলে না, সে নাকি কচিদের মন নিয়ে বই লিখবে! ঢঙ একটা!”

দাদা বলিলেন, “কেন, এক সময় তিনি নিজেই তো শিশু ছিলেন!”

এসব ঠাট্টায় কান দিলে চলে না। বই দুইখানা সযত্নে মলাট দিয়া আলমারিতে তুলিলাম। আমার অন্যান্য বইগুলোকেও ঝাড়িয়া-ঝুড়িয়া সাজাইয়া রাখিলাম।

দুই-চারি দিন গেল। আমার কেতাবের ছত্রগুলি লাল নীল দাগের উর্দি পরিয়া আমার সাহায্যের জন্য মোতায়েন হইয়া উঠিল। প্রথমটা বাদলকে একচোট অগাধ মুক্তি দিয়া দিলাম। বাড়িতে অষ্টপ্রহর সামাল সামাল রব পড়িয়া গেল।

মা বলিলেন, “এই কি তোর শাসন হচ্ছে? এর চেয়ে সে যে ঢের ভালো ছিল।”

মাকে ছকটা বুঝাইয়া দিলাম, “হোমিওপ্যাথি ওষুধে প্রথমে রোগটা একচোট বাড়িয়ে তোলে। আমি ওর সমস্ত দোষগুণগুলো ভালো করে ফুটিয়ে তুলে ওকে ভালো করে চিনে নিচ্ছি আগে, সপ্তাখানেক লাগবে।”

মা বলিলেন, “তদ্দিনে বাড়ির অন্য ছেলেপিলেদের আর চিনতে পারবে না কিন্তু, এই বলে দিলাম। আজ ঘুমন্ত আভার মুখে পাউডারের সমস্ত কৌটো গেছে, দম আটকে যায় আর কি। ওই গো, আবার বুঝি কি কাণ্ড বাধালে! ওরে, কে আছিস, দেখ দেখ।”

চার দিন গেল, ছয় দিন গেল, দশ দিন গেল, চিনতে অত্যধিক দেরি হইতেছে, উত্তরোত্তর শক্তও হইয়া উঠিতেছে যেন—পূর্ণ মুক্তির মধ্যে দুষ্টামিতে বাদলের নিত্য নূতন আবিষ্ক্রিয়ার জন্য। ক্রমে দেখিতেছি—এবেলা এক রকম, ওবেলা এক রকম। নালিশের চোটে বাতিব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছি। দাদা বলেন, “শৈলেনের কাছে যা।” মা বলেন, “শৈলেনের কাছে যা, কিছু বললে আমাদের ওপর চটবে।” বউদের মুখেও ওই কথা। আবার তাঁহাদেরও নিজের নিজের নালিশ আছে।

অথচ আমি চটিব না, একটুও চটিব না; কিন্তু সে কথা বলি কি করিয়া? ছেলেপিলেদের মধ্যে যে নালিশ করিতে আসিতেছে, সে-ই উল্টা মার খাইয়া গেল, এমন ব্যাপারও ঘটিতেছে দুই-একটা। বলি, “মাথায় ধূলো দিয়ে দিয়েছে তো দিক দুদিন; আমায় বই পড়ে নেবার একটুও অবসর দিবি নি তোরা?”

আসলে ঠিক বই পড়া নয়। বইয়ে দাগ দেওয়া হইতে এখন সমস্ত পাতার উপর ঢেরা কাটায় দাঁড়াইয়াছে, বোধ হয় রাগের মাথায় দুই-একখানা পাতা ছিঁড়িয়া ফেলিয়াও থাকিবে। আমার মুখ দিয়া কি ইহারা ‘না’ না বলাইয়া ছাড়িবে না? এদিকে সপ্তাহখানেক ছুটি বাড়াইব বলিয়া যে ঠিক করিয়াছিলাম, সে সংকল্প ত্যাগ করিয়াছি; বোধহয় ছুটি ফুরাইবার সপ্তাখানেক আগেই চলিয়া যাইতে পারি।

আজ পনরো দিনের দিন। নবীনতম সংবাদ—বাদল বাবার গড়গড়ায় তামাক টানিতেছিল, বাবার মতো ইজিচেয়ারে হেলান দিয়া। আভা চোখ দুইটা বড় বড় করিয়া আসিয়া খবর দিল, “একবার দেখবে এসে আস্পদ্দাটা!”

একটা চড় কষাইয়া দিয়া বলিলাম, “আর তুমি কোথায় ছিলে বাঁদরী? ছোট ভাইটিকে একটু চোখে চোখে রাখতে পার না?”

অর্থাৎ আভার হাতেও অভিভাবকত্বের ভারটা ছাড়িয়া দিতে রাজী আছি। বলিলাম, “ধরে নিয়ে আয় হতভাগাকে।”

কিন্তু সেটা আভার দৈহিক সম্ভাবনার বাহিরে জানিয়া নিজেই গেলাম। দেখি, একবর্ণও মিথ্যা নয়। অবশ্য কলিকাতে আগুন নাই, কিন্তু টানার ভঙ্গী নিখুঁত, মায় বাবার কাশিটি পর্যন্ত। বাবা প্রতিবেশী বন্ধু উপেনবাবু আসিলে নলটি বাড়াইয়া দেন, সেটুকুও বাদ গেল না, আমি সামনে আসিতেই মুখ হইতে নলটি সরাইয়া “খুলো, এতো” বলিয়া হাতটি বাড়াইতে যাইতেছিল, আমার ভাবভঙ্গী দেখিয়া মাঝপথেই থামিয়া গেল।

খানিকক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া আমি কানমলা কি ওইরকম একটি ছোটখাটো সাজা দিতে যাইতেছিলাম, একটা কথা ভাবিয়া থামিয়া গেলাম। হঠাৎ মনে হইল, বাদল নিশ্চয় এটা দোষ বলিয়া আগে জানিত না। কেননা, জানিয়া শুনিয়া যে দোষ করা, তাহাতে ধরা পড়িলেই বাদল নিজে হইতেই কান ধরিয়া পূর্বাহ্নেই হাঙ্গামা মিটাইয়া রাখে। তাহা ছাড়া দোষ বুঝিলে আমাকে দেখামাত্রই ভয় পাইত নিশ্চয়ই; ‘খুড়ো, এস’ বলিয়া এভাবে সটকাটা বাড়াইয়া দিতে সাহস করিত না।

আমি এইটিকে নিছক একটি দৈব সুযোগ বলিয়া ধরিয়া লইলাম। অপরাধটি একেবারে নূতন; কেননা বাবা কখনও নল বাহিরে ছাড়িয়া যান না, আজ কেমন ভুল হইয়া গিয়াছে। দামী রবারের নল, এখানে পাওয়া যায় না, তাঁহার অত্যন্ত হেফাজতের জিনিস

এই অপরাধটিকে ভিত্তি করিয়া শিক্ষা আরম্ভ করিয়া দেওয়া যাক। এখন হইতেই অপরাধের গুরুত্বটি মাথার মধ্যে এমন করিয়া ঢুকাইয়া দিতে হইবে, যেন এই জাতীয় অপরাধ সমস্ত জীবনে আর না করে।

নিজের ঘরে লইয়া আসিয়া বাদলকে একখানি মাদুরে বসাইলাম এবং সামনে একটি টুলের উপর নলসুদ্ধ গড়গড়াটি বসাইয়া রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “ওই দেখ, আর মুখ দিবি ওটাতে?”

এ রকম নূতন ধরনের অভিজ্ঞতায় বাদল একেবারে হকচকিয়া গিয়াছিল, আস্তে আস্তে ঘাড় নড়িল।

“ঠিক ওইভাবে বসে থাক, বজ্জাত কোথাকার!”—বলিয়া আমি শেল্ফ হইতে একটা বই টানিয়া লইয়া বিছানায় শুইয়া পড়িতে লাগিলাম।

একটু পরে আবার ফিরিয়া তাকাইলাম, বাদল জড়ভরতের মতো ঠায় সেই ভাবে বসিয়া আছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, “দিবি আর মুখ ওটাতে?” পেরেকের মাথায় একটি একটি করিয়া ঘা দেওয়া হইতেছে।

সে সেই রকম মাথা নাড়িল, না।

“বসে থাক ঠিক ওই ভাবে, ঐটের দিকে চেয়ে।”

বইয়ে ঠিক এই ধরনের চিকিৎসার কথা লিখিতেছে; সেইখানটা খুলিয়া পড়িতে লাগিলাম। বলিতেছে, সাজা কড়া হইবার কোনো দরকার নাই; একটি গাম্ভীর্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করিয়া দোষের গুরুত্বটা মাথার মধ্যে অল্পে অল্পে প্রবেশ করাইয়া দিতে হইবে। বার্লিনের পাঁচটা দুশ্চিকিৎস্য শিশুর কেস দেওয়া আছে; রীতিমতো রেকর্ড রাখিয়া দেখা গিয়াছে, সাত বৎসরের মধ্যে তাহারা সে দোষ আর করে নাই, অথচ সব জার্মান-বাচ্চা—কালে হিন্ডেনবার্গ, লুডেনডর্ফ হইবার কথা।

বিবৃতিটি এতই চিত্তাকর্ষক যে চোখ ফেরানো যায় না। পড়িতে পড়িতে থাকিয়া থাকিয়া চক্ষু না তুলিয়া তিন-চার বার প্রশ্ন করিলাম, “আর দিবি মুখ ওতে?”

উত্তর নাই, না দেখিলেও বুঝিতেছি, সেই রকম ভাবে মাথা নাড়িতেছে।

খানিক পরে সমস্ত অধ্যায়টি শেষ করিয়া বইটা মুড়িয়া রাখিলাম। নিজের পরীক্ষার এই আশু সফলতায় মনে মনে তৃপ্তিবোধ হইতেছিল। বেশ নিশ্চিন্তভাবে, “আর ওটাতে দিবি না তো মুখ, অ্যাঁ?” বলিয়া ফিরিয়া উঠিয়া বসিলাম।

কোথায় বাদল? মাদুর শূন্য, টুলের উপর খালি গড়গড়াটা, সটকা নাই।

হাঁকিলাম, “বাদল!”

ও-বারান্দা হইতে উত্তর আসিল, “অঁগ্যেন!

ওর বাবার শেখানো ভদ্রতা, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বাদল ব্যবহার করে।

উঠিয়া গিয়া ব্যাপার যাহা দেখিলাম, তাহাতে তো চক্ষুস্থির!

রবারের নলের আধখানা লইয়া লুসীর বাচ্চারা খেলা করিতেছে, আধখানা ঘোড়ার লাগামের আকারে লুসীর মুখে, বাদলের হাতে তাহার খুঁট দুইটা, মুখে “হ্যাট হ্যাট” শব্দ চলিতেছে।

লুসী মাংসভ্রমে পরম পরিতোষ সহকারে চিবাইয়া যাইতেছে, এটারও দুইখানা হইয়া যাইতে আর দেরি নাই। বাবার শখের নল, সমস্ত বাজার উজাড় করিয়া বাছিয়া কেনা

একটুখানির মধ্যেই বাড়িতে হুলস্থূল পড়িয়া গেল, বাবা আসিয়া সটকার খোঁজ করিতেই। বউমার নির্দয় প্রহারে বাদলের বাড়ি-ফাটানো কান্না, মা’র বউমাকে বকুনি; এর সমস্তটাই এমন দ্ব্যর্থক যে, প্রত্যেকটি কথা আমার উপর একটু বক্রভাবে খাটে; লুসীর চিৎকার করিতে করিতে গৃহত্যাগ এবং তাহার বাচ্চাদের গৃহের মধ্যে থাকিয়া অসহায়ভাবে চিৎকার।

দাদা ক্রমাগতই বলিতেছেন, “বলছি, ওকে একটা ঘোড়া কিনে দে, সেদিন পইপই করে বুঝিয়ে বললাম।”

বাবা “ন ভূতো ন ভবিষ্যতি, তিরস্কার লাগাইয়াছেন, তাহার মধ্যে সেকাল-একালের তুলনামূলক ব্যাখ্যান আছে, এ সংসারে তামাক ধরার জন্য আত্মধিক্কার আছে, আধুনিক বিজ্ঞানমাত্রেরই—বিশেষ করিয়া মনস্তত্ত্বের শ্রাদ্ধ-কামনা আছে।

বলিতেছেন, “ভড়ঙের যেন যুগ পড়ে গেছে, ছেলে তো আমিও মানুষ করেছি, একটা আধটা নয়—”

মা শেষ করিতে দিলেন না, আমার দিকে চাহিয়া ছিলেন, মুখটা বিরক্তভাবে ঘুরাইয়া লইয়া ঝাঁজিয়া বলিলেন, “ছাই মানুষ করেছ, ওই নমুনা নিয়ে আর বড়াই করতে হবে না।”

.

শিশু-মনস্তত্বমূলক সাতখানি নামজাদা পুস্তকের গ্রাহকের জন্য ‘স্টেটসম্যানে’ বিজ্ঞাপন দিয়া দিয়াছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *