বাতিকবাবু
বাতিকবাবুর আসল নামটা জিজ্ঞেস করাই হয়নি। পদবি মুখার্জি। চেহারা একবার দেখলে ভোলা কঠিন। প্রায় ছ’ ফুট লম্বা, শরীরে চর্বির লেশমাত্র নেই, পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকা, হাতে পায়ে গলায় কপালে অজস্র শিরা উপশিরা চামড়া ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। টেনিস কলারওয়ালা সাদা শার্ট, কালো ফ্ল্যানেলের প্যান্ট, সাদা মোজা সাদা কেডস—দার্জিলিঙের গ্রীষ্মকালে এই ছিল তাঁর মার্কামারা পোশাক। এ ছাড়া তাঁর হাতে থাকত মজবুত লাঠি। বনবাদাড়ে এবড়ো-খেবড়ো জমিতে ঘোরা অভ্যাস বলেই হয়তো লাঠিটার প্রয়োজন হত।
আমার সঙ্গে বাতিকবাবুর আলাপ দশ বছর আগে। কলকাতায় ব্যাঙ্কে চাকরি করি, দিন দশেকের ছুটি জমেছে, বৈশাখের মাঝামাঝি গিয়ে হাজির হলাম আমার প্রিয় দার্জিলিং শহরে। আর প্রথমদিনই দর্শন পেলাম বাতিকবাবুর। কী করে সেটা হল বলি।
চা খেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়েছি বিকেল সাড়ে চারটায়। দুপুরে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, আবার কখন হবে বলা যায় না, তাই রেনকোটটা গায়ে দিয়েই বেরিয়েছি। দার্জিলিঙের সবচেয়ে মনোরম, সবচেয়ে নিরিবিলি রাস্তা জলাপাহাড় রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখি হাত পঞ্চাশেক দূরে একটা মোড়ের মাথায় একটি ভদ্রলোক রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠির উপর ভর করে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে ভারী মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছেন। দৃশ্যটা তেমন কিছু অস্বাভাবিক বলে মনে হল না। জংলি ফুল বা পোকামাকড় সম্বন্ধে আগ্রহ থাকলে লোক ওইভাবে ঘাসের দিকে চেয়ে থাকতে পারে। আমি ভদ্রলোকের দিকে একটা মৃদু কৌতূহলের দৃষ্টি দিয়ে আবার এগোতে শুরু করলাম।
কিন্তু কাছাকাছি পৌঁছনোর পর মনে হল ব্যাপারটাকে যতটা স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছিল ততটা নয়। অবাক লাগল ভদ্রলোকের একাগ্রতা দেখে। আমি পাঁচ হাত দূরে দাঁড়িয়ে তাঁর হাবভাব লক্ষ করছি, অথচ উনি আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সেই একই ভাবে সামনে ঝুঁকে ঘাসের দিকে চেয়ে আছেন। শেষটায় বাঙালি বুঝে একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না।
‘কিছু হারালেন নাকি?’
কোনও উত্তর নেই। লোকটা কি কালা?
আমার কৌতুহল বাড়ল। ঘটনার শেষ না দেখে যাব না। একটা সিগারেট ধরালাম। মিনিট তিনেক পরে ভদ্রলোকের অনড় দেহে যেন প্রাণসঞ্চার হল। তিনি আরো খানিকটা ঝুঁকে পড়ে তাঁর ডান হাতটা ঘাসের দিকে বাড়ালেন। ঘন ঘাসের ভিতর তাঁর হাতের আঙুলগুলো প্রবেশ করল। তারপর হাতটা উঠে এল। বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মধ্যে একটা ছোট্ট গোল চাকতি। ভাল করে দেখে বুঝলাম সেটা একটা বোতাম। প্রায় একটা আধুলির মতো বড়। সম্ভবত কোটের বোতাম।
ভদ্রলোক বোতামটা চোখের সামনে এনে প্রায় মিনিটখানেক ধরে সেটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে জিভ দিয়ে চারবার ছিকছিক করে আক্ষেপের শব্দ করে সেটাকে শার্টের বুকপকেটে পুরে আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ম্যালের দিকে চলে গেলেন।
সন্ধ্যাবেলা ফেরার পথে ম্যালের মুখে ফোয়ারার ধারে দার্জিলিঙের পুরনো বাসিন্দা ডাঃ ভৌমিকের সঙ্গে দেখা হল। ইনি কলেজে বাবার সহপাঠী ছিলেন, আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। তাঁকে আজ বিকেলের ঘটনাটা না বলে পারলাম না। ভৌমিক শুনেটুনে বললেন, ‘চেহারা আর হাবভাবের বর্ণনা থেকে তো বাতিকবাবু বলে মনে হচ্ছে।’
‘বাতিকবাবু?’
‘স্যাড কেস। আসল নাম ঠিক মনে নেই, পদবি মুখার্জি। বছর পাঁচেক হল দার্জিলিঙে রয়েছে। গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কের কাছেই একটা বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। কটকের র্যাভেনশ্ কলেজে ফিজিক্স পড়াত। জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে। শুনেছি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। চাকরি-বাকরি ছেড়ে এখানে চলে এসেছে। পৈতৃক সম্পত্তি কিছু আছে বোধহয়।’
‘আপনার সঙ্গে আলাপ আছে?’
‘গোড়ার দিকে একবার আমার কাছে এসেছিল। রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে হাঁটুতে সেপটিক হবার জোগাড়। সারিয়ে দিয়েছিলাম।’
‘কিন্তু বাতিকবাবু নামটা…?’
ভৌমিক হো হো করে হেসে উঠলেন। ‘সেটা হয়েছে ওর এক উদ্ভট শখের জন্য। অবিশ্যি নামকরণটা কে করেছে বলা শক্ত।’
‘শখটা কী?’
‘তুমি তো নিজের চোখে দেখলে—রাস্তা থেকে একটা বোতাম তুলে পকেটে নিয়ে নিল। ওইটেই ওর শখ বা হবি। যেখান-সেখান থেকে জিনিস তুলে নিয়ে এসে সযত্নে রেখে দেয়।’
‘যে-কোনও জিনিস?’ কেন জানি না, আমার লোকটা সম্বন্ধে কৌতূহল বাড়ছিল।
ডাঃ ভৌমিক বললেন, ‘আমরা বলব যে-কোনও জিনিস, কিন্তু ভদ্রলোক ক্লেম করবেন সেগুলো অত্যন্ত প্রেশাস, কারণ সে সব জিনিসের সঙ্গে নাকি একেকটা ঘটনা জড়িয়ে আছে।’
‘কিন্তু সেটা উনি জানেন কী করে?’
ডাঃ ভৌমিক তাঁর হাতঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বললেন, ‘সেটা তুমি ওঁকেই জিজ্ঞেস করে দেখো না। উনি ভিজিটর পেলে খুশিই হন—কারণ ওঁর গল্পের স্টক প্রচুর। ওঁর কালেকশনের প্রত্যেকটি জিনিসকে নিয়ে একেকটি গল্প তো! ওয়াইল্ড ননসেন্স, বলা বাহুল্য, তবে উনি সেগুলো বলতে পারলে খুশিই হন। অবিশ্যি তুমি শুনে খুশি হবে কি না সেটা আলাদা কথা…’
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্কের কাছে বাতিকবাবুর বাড়ি চিনে বার করতে বিশেষ অসুবিধা হল না, কারণ পাড়ার সকলেই ভদ্রলোককে চেনে। সতেরো নম্বর বাড়ির দরজায় টোকা মারতেই ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, এবং আশ্চর্য এই যে, আমায় দেখেই চিনলেন।
‘কাল আপনি আমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু আমার তখন উত্তর দেবার অবস্থা ছিল না। ওই সময়টা কন্সেনট্রেশন নষ্ট হতে দিলেই সর্বনাশ! ভেতরে আসুন।’
ঘরে ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়ল আলমারি। বাঁদিকের দেয়ালের অর্ধেকটা অংশ জুড়ে একটা কাচে ঢাকা আলমারির প্রতিটি তাকে পাশাপাশি রাখা অতি সাধারণ সব জিনিস, যেগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার কোনও সম্পর্ক নেই। একবার চোখ বুলিয়ে একটা শেল্ফে পাশাপাশি চোখে পড়ল—একটা গাছের শেকড়, একটা মরচে ধরা তালা, একটা আদ্যিকালের গোল্ড ফ্লেকের টিন, একটা উল বোনার কাঁটা, একটা জুতোর বুরুশ, একটা টর্চলাইটের ব্যাটারি। আমি অবাক হয়ে এইসব দেখছি, এমন সময় ভদ্রলোক বললেন, ‘ওগুলো দেখে আপনি বিশেষ আনন্দ পাবেন না, কারণ ওসব জিনিসের মূল্য কেবল আমিই জানি।’
আমি বললাম, ‘শুনেছি এসব জিনিসের সঙ্গে নাকি একেকটা বিশেষ ঘটনার সম্পর্ক রয়েছে।’
‘আছে বইকী!’
‘কিন্তু সেরকম তো সব জিনিসের সঙ্গেই থাকে। যেমন আপনি যে ঘড়িটা হাতে পরেছেন—’
ভদ্রলোক হাত তুলে আমার কথা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, ‘ঘটনা জড়িয়ে থাকে অবশ্যই, কিন্তু সব জিনিসের উপর সে ঘটনার ছাপ থেকে যায় না। ক্বচিৎ কদাচিৎ একেকটা জিনিস মেলে, যার মধ্যে সে ছাপটা থাকে। যেমন কালকের এই বোতামটা—’
ঘরের ডানদিকে একটা রাইটিং ডেস্কের উপর বোতামটা রাখা ছিল। ভদ্রলোক সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। খয়েরি রঙের কোটের বোতাম। তার মধ্যে কোনওরকম বিশেষত্ব আমার চোখে ধরা পড়ল না।
‘কিছু বুঝতে পারছেন?’
বাধ্য হয়েই না বলতে হল। বাতিকবাবু বললেন, ‘এই বোতাম একটি সাহেবের কোট থেকে এসেছে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে জলাপাহাড় রোড দিয়ে যাচ্ছিলেন। বয়স ষাটের কাছাকাছি, রাইডিং-এর পোশাক পরা, সবল সুস্থ মিলিটারি চেহারা। যেখানে বোতামটা পেলুম, সেইখানটায় এসে ভদ্রলোকের স্ট্রোক হয়। ঘোড়া থেকে পড়ে যান। দু’জন পথচারী দেখতে পেয়ে তাঁর দিকে ছুটে আসে, কিন্তু তিনি অলরেডি ডেড। ঘোড়া থেকে পড়ার সময়ই বোতামটা কোট থেকে ছিঁড়ে রাস্তার ধারে পড়ে যায়।’
‘এসব কি আপনি দেখতে পান?’
‘ভিভিডলি। যত বেশি মনঃসংযোগ করা যায়, তত বেশি স্পষ্ট দেখি।’
‘কখন দেখেন?’
‘এই জাতীয় বিশেষ গুণসম্পন্ন কোনও বস্তুর কাছে এলেই আমি প্রথমে একটা মাথার যন্ত্রণা অনুভব করি। তারপর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, মনে হয় পড়ে যাব, সাপোর্ট দরকার। কিন্তু তারপরেই দৃশ্য দেখা শুরু হয়, আর পাও স্টেডি হয়ে যায়। এই এক্সপিরিয়েন্সের ফলে আমার শরীরের টেম্পারেচার বেড়ে যায়। প্রতিবার। কাল প্রায় রাত আটটা পর্যন্ত একশো দুই জ্বর ছিল। অবিশ্যি জ্বরটা বেশিক্ষণ থাকে না। এখন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।’
ব্যাপারটা আজগুবি হলেও আমার বেশ মজা লাগছিল। বললাম, ‘আরো দু’-একটা উদাহরণ দিতে পারেন?’
বাতিকবাবু বললেন, ‘আলমারি ভর্তি উদাহরণ। ওই যে খাতা দেখছেন, ওতে প্রত্যেকটি ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে। আপনি কোনটা জানতে চান বলুন।’
আমি কিছু বলার আগে ভদ্রলোক আলমারির কাচ সরিয়ে তাক থেকে দু’টো জিনিস বার করে টেবিলের উপর রাখলেন—একটা বহু পুরনো চামড়ার দস্তানা, আর একটা চশমার কাচ।
‘এই যে দস্তানাটা দেখছেন,’ বাতিকবাবু বললেন, ‘এটা আমার প্রথম পাওয়া জিনিস; অর্থাৎ আমার সংগ্রহের প্রথম অইটেম। এটা পাই সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন শহরের বাইরে একটা বনের মধ্যে। তখন আমার মারবুর্গে পড়া শেষ হয়েছে, আমি দেশে ফেরার আগে একটু কন্টিনেন্টটা ঘুরে দেখছি। লুসার্নে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছি। নির্জন বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। একটু বিশ্রাম নেব বলে একটা বেঞ্চিতে বসেছি, এমন সময় পাশেই একটা গাছের গুঁড়ির ধারে ঘাসের ভিতর দস্তানার বুড়ো আঙুলটা চোখে পড়তেই মাথা দপ্ দপ্ করতে আরম্ভ করল। তারপর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এল: তারপর চোখের সামনে ভেসে উঠল ছবি। একটা সুবেশ সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক, মুখে লম্বা বাঁকানো সুইস পাইপ। দস্তানা পরা হাতে ছড়ি নিয়ে হেঁটে চলেছেন রাস্তা দিয়ে। আচমকা ঝোপের পিছন থেকে দুটো লোক বেরিয়ে এসে তাঁকে আক্রমণ করল। ভদ্রলোক মরিয়া হয়ে হাত পা ছুড়লেন। ধস্তাধস্তির ফাঁকে তিনি তাঁর হাতের দস্তানাটি হারালেন, দুর্বৃত্তেরা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁর কোটের পকেট থেকে টাকাকড়ি ও হাত থেকে সোনার ঘড়িটি নিয়ে পালাল।’
‘সত্যিই এরকম কোনও ঘটনা ঘটেছিল কি?’
‘আমি তিনদিন হাসপাতালে ছিলুম। জ্বর, ডিলিরিয়াম, আর আরো অনেক কিছু। ডাঃ স্টাইনিটস রোগ ধরতে পারেননি। তারপর আপনিই সেরে উঠে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে অনুসন্ধান আরম্ভ করি। দু’বছর আগে ওই বনে ঠিক ওই জায়গায় কাউন্ট ফার্ডিনান্ড মুস্যাপ বলে একজন ধনী ব্যক্তি ঠিক ওইভাবেই খুন হয়। তার ছেলে দস্তানাটা চিনতে পারে।’
ভদ্রলোক এমন সহজভাবে ঘটনাটা বলে গেলেন যে, তাঁর কথা অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না। বললাম, ‘আপনি সেই তখন থেকেই আপনার সংগ্রহ শুরু করেন?’
বাতিকবাবু বললেন, ‘এই দস্তানাটা পাবার পর প্রায় দশ বছর আর ও ধরনের কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি। ততদিনে আমি দেশে ফিরে কটকের কলেজে প্রফেসারি আরম্ভ করেছি। ছুটিতে এখানে-ওখানে বেড়াতে যেতাম। একবার ওয়ালটেয়ারে গিয়ে দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটা হয়। সমুদ্রের তীরে একটা পাথরের খাঁজে এই চশমার কাচটা পাই। দেখতেই পাচ্ছেন প্লাস পাওয়ারের কাচ। একটি মাদ্রাজি ভদ্রলোক চশমা খুলে রেখে জলে নেমেছিলেন স্নান করতে। তিনি আর জল থেকে ফেরেননি। পায়ে ক্র্যাম্প ধরার ফলে তাঁর সলিল সমাধি হয়। জলের ভিতর থেকে হাত তুলে হেল্প হেল্প চিৎকার-—ভারী মর্মান্তিক। তাঁরই চশমার এই কাচটি চার বছর পরে আমি পাই। এটাও যে সত্যি ঘটনা সেটা আমি যাচাই করে জেনেছি। ওয়েল নোন ড্রাউনিং কেস। মৃত ব্যক্তি কোয়েম্বাটোরে থাকতেন, নাম শিবরমণ।’
ভদ্রলোক দস্তানা ও চশমার কাচ যথাস্থানে রেখে আবার জায়গায় এসে বসলেন। ‘আমার এই আলমারিতে কতগুলো জিনিস আছে জানেন? একশো বাহাত্তরটা। আমার গত ত্রিশ বছরের সংগ্রহ। বলুন তো, এরকম সংগ্রহের কথা আর শুনেছেন কী?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘আপনার এই হবিটি যে একেবারে ইউনিক সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনার প্রত্যেকটি জিনিসের সঙ্গেই কি মৃত্যুর একটা সম্পর্ক রয়েছে?’
ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে বললেন, ‘তাই তো দেখছি। শুধু মৃত্যু নয়—আকস্মিক, অস্বাভাবিক মৃত্যু। খুন, আত্মহত্যা, অপঘাত মৃত্যু, হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া—এই জাতীয় ঘটনার সঙ্গে যোগ থাকলে তবেই একেকটা জিনিস আমার মধ্যে এই বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।’
‘এগুলোর সবই কি রাস্তায় বা মাঠে-ঘাটে পাওয়া?’
‘অধিকাংশই। আর বাকিগুলো পাওয়া চোরাবাজারে, নিলামে, কিউরিওর দোকানে। এই যে কাট-গ্লাসের সুরাপাত্রটি দেখছেন, এটা পাই কলকাতার রাসেল স্ট্রিটের একটা নিলামের দোকানে। এই পাত্রতে ব্র্যান্ডির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে একটি বিশালবপু সাহেবের মৃত্যু হয় কলকাতা শহরে।’
আমি কিছুক্ষণ থেকেই আলমারির জিনিসপত্র ছেড়ে ভদ্রলোকের নিজের চেহারার দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলাম। অনেক লক্ষ করেও তাঁর মধ্যে ভণ্ডামির কোনও চিহ্ন ধরা পড়ল না। পাগলামির কোনও লক্ষণ রয়েছে কী! মনে তো হয় না। চোখে উদাস ভাবটা যেমন পাগলদের মধ্যে সম্ভব, তেমনই কবি, ভাবুক বা সাধকদের মধ্যেও সম্ভব।
আমি আর বেশিক্ষণ বসলাম না। বিদায় নিয়ে চৌকাঠ পেরোবার সময় ভদ্রলোক বললেন, ‘আবার আসবেন। আপনাদের মতো লোকের জন্য আমার দরজা সবসময়েই খোলা। কোথায় উঠেছেন আপনি?’
‘অ্যালিস ভিলা হোটেলে।’
‘ও। তা হলে তো দশ মিনিটের হাঁটাপথ। বেশ লাগল আপনার সঙ্গ। কোনও কোনও লোককে আদৌ বরদাস্ত করতে পারিনি। আপনাকে সহৃদয় সমঝদার বলে মনে হয়।’
বিকেলে ডাঃ ভৌমিক চায়ে বলেছিলেন। আমি ছাড়া নিমন্ত্রিত আরো দুটি ভদ্রলোক। চায়ের সঙ্গে চানাচুর আর কেক খেতে খেতে বাতিকবাবুর প্রসঙ্গটা না তুলে পারলাম না। ভৌমিক বললেন, ‘কতক্ষণ ছিলে?’
‘ঘণ্টাখানেক।’
‘ওরে বাবা!’ ডাঃ ভৌমিকের চোখ কপালে। ‘এক ঘণ্টা ধরে ওই বুজরুকের কচকচি শুনলে?’
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘যা প্যাচপেচে বৃষ্টি—স্বচ্ছন্দে বেড়ানোর তো উপায় নেই। হোটেলের ঘরে বন্দি হয়ে থাকার চেয়ে ওর গল্প শোনা বোধহয় ভাল। ‘কার কথা হচ্ছে?’
প্রশ্নটা এল একটি বছর চল্লিশেকের ভদ্রলোকের কাছ থেকে। মিস্টার খাস্তগির বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ডাঃ ভৌমিক। বাতিকবাবুর বাতিকের বর্ণনা শুনে খাস্তগির একটা বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ‘এসব লোককে এখানে আস্তানা গাড়তে দিয়ে দার্জিলিঙের বায়ু দূষিত করেছেন কেন ডাঃ ভৌমিক?’
ডাঃ ভৌমিক হালকা হেসে বললেন, ‘এত বড় একটা শহরের বায়ু দূষিত করার ক্ষমতা কি লোকটার আছে? বোধহয় না।’
মিস্টার নস্কর নামক তৃতীয় ভদ্রলোকটি ভারতবর্ষে বুজরুকদের কুপ্রভাব সম্বন্ধে একটা ছোটখাট বক্তৃতাই দিয়েছিলেন। শেষকালে আমি বলতে বাধ্য হলাম যে, বাতিকবাবু যেহেতু নেহাতই নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেন, তাঁর বুজরুকির প্রভাব আর পাঁচজনের উপর পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
ভৌমিক দার্জিলিঙে রয়েছেন প্রায় ত্রিশ বছর। খাস্তগিরও অনেকদিনের বাসিন্দা। শেষ পর্যন্ত এঁদের দু’জনকে উদ্দেশ্য করে একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না। ‘জলাপাহাড় রোডে কোনও অশ্বারোহী সাহেব হার্টফেল করে মারা যায়, এমন কোনও ঘটনা জানা আছে আপনাদের?
‘কে, মেজর ব্র্যাডলে?’ প্রশ্ন করলেন ডাঃ ভৌমিক। ‘সে তো বছর আষ্টেক আগেকার ঘটনা। স্ট্রোক হয়েছিল। সম্ভবত জলাপাহাড় রোডেই। হাসপাতালে এনেছিল, কিন্তু তার আগেই মারা যায়। কেন বলো তো?’
আমি বাতিকবাবুর বোতামের কথাটা বললাম। মিস্টার খাস্তগির একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। ‘লোকটা এইসব বলে অলৌকিক ক্ষমতা ক্লেম করছে নাকি? এ তো একের নম্বরের শয়তান দেখছি হে! সে নিজে দার্জিলিঙে রয়েছে অ্যাদ্দিন। ঘোড়ার পিঠে সাহেব মরেছে সে খবর তো এমনিতেই তার কানে পৌঁছতে পারে। সেখানে অলৌকিক ক্ষমতার প্রয়োজনটা আসছে কোত্থেকে?’
কথাটা অবিশ্যি আমারও মনে হয়েছিল। দার্জিলিঙে থেকে দার্জিলিঙেরই একটি ঘটনার কথা জানতে পারা বাতিকবাবুর পক্ষে মোটেই অসম্ভব নয়। আমি তাই আর প্রসঙ্গটা বাড়ালাম না।
চায়ের পর্ব এবং পাঁচরকম এলোমেলো কথাবার্তা শেষ হবার পর আমি ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মিস্টার নস্করও উঠে পড়লেন। বললেন উনিও অ্যালিস ভিলার দিকটাতেই থাকেন, তাই আমার সঙ্গে একসঙ্গেই হেঁটে ফিরবেন। আমরা ডাঃ ভৌমিকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে সন্ধে হয়ে এসেছে। আমি দার্জিলিঙে আসার পর এই প্রথম দেখলাম আকাশের ঘন মেঘে ফাটল ধরেছে, আর সেই ফাটলের মধ্যে দিয়ে অস্তগামী সূর্যের রশ্মি মঞ্চের স্পটলাইটের মতো শহর ও তার আশেপাশে পাহাড়ের গায়ে পড়েছে।
মিস্টার নস্করকে দেখে বেশ মজবুত মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি চড়াই উঠতে তাঁর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। হাঁপানির মধ্যেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার এই ভদ্রলোকটি কোথায় থাকেন?’
বললাম, ‘দেখা করবেন নাকি?’
‘না না। এমনি কৌতূহল হচ্ছিল।’
বাতিকবাবুর বাড়ির হদিস দিয়ে বললাম, ‘ভদ্রলোক বেড়াতে-টেড়াতে বেরোন। হয়তো পথেই দেখা হয়ে যেতে পারে।’
কী আশ্চর্য, হলও তাই। কথাটা বলার দু’ মিনিটের মধ্যেই একটা মোড় ঘুরতেই সামনে বিশ হাত দূরে দেখি বাতিকবাবু ডান হাতে তাঁর লাঠি আর বাঁ হাতে একটা খবরের কাগজের মোড়ক নিয়ে আমাদেরই দিকে এগিয়ে আসছেন। আমাকে সামনেই দেখতে পেয়ে ভদ্রলোকের মুখের যে ভাবটা হল সেটাকে যদিও হাসি বলা চলে না, কিন্তু সেটা অপ্রসন্নভাব নয় নিশ্চয়ই। বললেন, ‘বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি ফেল করেছে ভাই, তাই মোমবাতি কিনে নিয়ে যাচ্ছি।’
ভদ্রতার খাতিরে মিস্টার নস্করের সঙ্গে আলাপটা না করিয়ে পারলাম না। ‘মিস্টার নস্কর—মিস্টার মুখার্জি।’
নস্কর দেখলাম সাহেবি মেজাজের লোক। নমস্কার না করে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। বাতিকবাবু মুখে কোনওরকম সৌজন্য প্রকাশ না করে হাতটা ধরে হ্যান্ডশেক করলেন। তারপর যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনই দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার তো বটেই, মিস্টার নস্করেরও নিশ্চয়ই বেশ অপ্রস্তুত লাগছিল। প্রায় আধ মিনিট চুপ করে থাকার পর আর না পেরে নস্কর বললেন, ‘ওয়েল—আমি তা হলে এগোই। আপনার কথা শুনছিলাম, লাকিলি আলাপ হয়ে গেল।’
‘চলি, মিস্টার মুখার্জি।’ আমাকেও বাধ্য হয়েই কথাটা বলতে হল। বাতিকবাবুকে এবার সত্যিই পাগল বলে মনে হচ্ছিল। রাস্তার মাঝখানে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে কী যে ভাবছেন তা উনিই জানেন। আমাদের দু’জনের বিদায় নেওয়াটা উনি যেন গ্রাহ্যই করলেন না। নস্করকে না হয় পছন্দ না হতে পারে, আমার সঙ্গে তো আজ সকালেই দিব্যি ভাল ব্যবহার করেছেন। ভদ্রলোককে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে পিছন ফিরে দেখলাম তিনি এখনও ঠিক সেইভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন। নস্কর মন্তব্য করলেন, ‘আপনার কাছে শুনে যতটা ছিটগ্রস্ত মনে হয়েছিল, এখন দেখছি তার চেয়েও বেশ কয়েক কাঠি বেশি।’
রাত ন’টা। সবেমাত্র ডিনার শেষ করে একটা পান মুখে দিয়ে গোয়েন্দা উপন্যাসটা নিয়ে বিছানায় ঢুকব ভাবছি, এমন সময় বেয়ারা এসে খবর দিল একজন লোক নাকি আমার খোঁজ করছে। বাইরে বেরিয়ে এসে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম। এত রাত্রে বাতিকবাবু আমার কাছে কেন? আজই সন্ধেবেলা ভদ্রলোকের যে মুহ্যমান ভাবটা দেখেছিলাম, সেটা যেন এখনও সম্পূর্ণ কাটেনি। বললেন, ‘একটু বসবার জায়গা হবে ভাই—নিরিবিলি? বাইরে দাঁড়াতে আপত্তি ছিল না, কিন্তু আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে।’
ভদ্রলোককে আমার ঘরে নিয়ে এলাম। চেয়ারে বসে হাঁফ ছেড়ে বললেন, ‘পালসটা একবার দেখো তো। তোমায় তুমি বলছি, কিছু মনে কোরো না।’
গায়ে হাতে দিয়ে চমকে উঠলাম। রীতিমতো জ্বর। ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘একটা অ্যানাসিন দেব? আমার সঙ্গেই আছে।’
বাতিকবাবু হেসে বললেন, ‘কোনও সিনেই কাজ দেবে না। জ্বর থাকবে এ রাতটা। কাল রেমিশন হয়ে যাবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা জ্বর নয়। তোমার কাছে চিকিৎসার জন্য আসিনি। আমার যেটা দরকার সেটা ওই আংটিটা।’
আংটি? কোন আংটির কথা বলছেন ভদ্রলোক?
আমার হতভম্ব ভাব দেখে ভদ্রলোক যেন একটু অসহিষ্ণুভাবেই বললেন, ‘ওই যে লস্কর না তস্কর কী নাম বললে? তাঁর হাতের আংটিটা দেখোনি? সস্তা আংটি—পাথর-টাথর নেই, কিন্তু ওটি আমার চাই।’
এখন মনে পড়ল মিস্টার নস্করের ডান হাতে একটা রুপোর সিগনেট রিং লক্ষ করেছিলাম বটে!
বাতিকবাবু বলে চলেছেন, ‘হ্যান্ডশেকের সময় হাতের তেলোয় ঠেকে গেল আংটিটা। মনে হল শরীরের ভেতর একটা এক্সপ্লোশান হয়ে গেল। তারপর যা হয় তাই। রাস্তার মাঝখানে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটা দেখতে আরম্ভ করেছিলুম, এমন সময় উলটোদিক থেকে একটা জিপ এসে দিলে সব মাটি করে।’
‘তার মানে ঘটনাটা আপনার দেখা হয়নি?’
‘যতদূর দেখেছি তাতেই যথেষ্ট। খুনের ব্যাপার। আততায়ীর মুখ দেখিনি। আংটিসমেত হাতটা এগিয়ে যাচ্ছে একটা লোকের গলার দিকে। ভিকটিম অবাঙালি। মাথায় রাজস্থানি টুপি, চোখে সোনার চশমা। চোখ বিস্ফারিত। চেঁচাবে বলে মুখ খুলেছে। তলার পাটির একটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো…ব্যস, এই পর্যন্ত। ও আংটি আমার চাই।’
আমি কয়েক মুহূর্ত বাতিকবাবুর দিকে চেয়ে থেকে বাধ্য হয়েই বললাম, ‘দেখুন মিস্টার মুখার্জি—আংটির যদি আপনার প্রয়োজন হয় তো আপনি নিজেই মিস্টার নস্করের কাছে চেয়ে দেখুন না! আমার সঙ্গে তার আলাপ সামান্যই। আর যতদূর বুঝেছি, তিনি আপনার হবির ব্যাপারটা তেমন সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেন না।’
‘তা হলে আমি চেয়ে কী লাভ সেটা বলুন? তার চেয়ে বরং—’
‘ভেরি সরি মিস্টার মুখার্জি—’ আমি ভদ্রলোককে বাধা দিয়ে স্পষ্ট কথাটা না বলে পারলাম না—‘আমি চাইলেও কোনও ফল হবে বলে মনে হয় না। এসব আংটি-টাংটির প্রতি একেক সময় মানুষের কীরকম মমতা থাকে সেটা তো আপনি জানেন। উনি যদি জিনিসটা ব্যবহার না করতেন তা হলে তবু…’
ভদ্রলোক আর বসলেন না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে এই টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন। আমি মনে মনে বললাম, ভদ্রলোকের আবদারটা একটু বেয়াড়া রকমের। রাস্তা থেকে জিনিস কুড়িয়ে নেওয়া একটা সামান্য ব্যাপার, কিন্তু লোকের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিস নিয়ে তার কালেকশন বাড়ানোর প্রয়াসটা অন্যায় প্রয়াস। এ ব্যাপারে কেউই তাকে সাহায্য করত না, আমিই বা করি কী করে? আর নস্কর এমনিতেই বেশ কাঠখোট্টা লোক। তার কাছে চেয়ে ওই আংটি পাবার আশা করাটাই ভুল।
পরদিন সকালে মেঘ কেটে গিয়ে দিন ফরসা হয়েছে দেখে চা খেয়ে বার্চ হিলের উদ্দেশে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। খটখটে দিন। ম্যাল লোকে লোকারণ্য, ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ঘোড়া ও চেঞ্জারদের সঙ্গে কোলিশন বাঁচিয়ে ক্রমে গিয়ে পড়লাম অবজারভেটরি হিলের পশ্চিম দিকে অপেক্ষাকৃত জনবিরল রাস্তাটায়। কাল রাত থেকেই মাঝে মাঝে বাতিকবাবুর করুণ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল, আর মনে মনে একটা ইচ্ছে দানা বাঁধছিল যদি ঘটনাচক্রে নস্করের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তা হলে একবার আংটির কথাটা বলে দেখব। হয়তো আংটিটার প্রতি তাঁর তেমন টান নেই, চাইলে দিয়ে দেবেন। সেটা বাতিকবাবুর হাতে তুলে দিতে পারলে তাঁর মুখের ভাব যে কেমন হবে সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। ছেলেবেলায় ডাকটিকিট জমাতাম, কাজেই হবির নেশা যে কী জিনিস সেটা আমার জানা ছিল। আর বাতিকবাবু লোকটা সাতেও নেই পাঁচেও নেই, নিজের উদ্ভট শখ নিয়ে নিজেই মেতে আছেন। গায়ে পড়ে কাউকে দলে টানবার চেষ্টা করছেন না, হয়তো জীবনে এই প্রথম অন্যের একটা জিনিসের প্রতি লোভ দেখাচ্ছেন—তাও সেটা এমন মহামূল্য কিছুই নয়। সত্যি বলতে কী, কাল রাত্রের পরে আমার ধারণা হয়েছে যে, ভদ্রলোকের অলৌকিক ক্ষমতা-টমতা কিছুই নেই, ওঁর শখের সমস্ত ব্যাপারটাই ওঁর আধপাগলা মনের কল্পনার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তাতেই যদি এই নিঃসঙ্গ লোকটি খুশি থাকে, তাতে আর কী এসে যাচ্ছে? কিন্তু বার্চ হিলের রাস্তায় ঘণ্টাদুয়েক ঘুরেও নস্করের সঙ্গে দেখা হল না। ম্যালে যখন এসে পৌঁছেছি তখন প্রায় সাড়ে দশটা। ভিড় তখনও রয়েছে, কিন্তু যাবার সময় যেমন দেখে গেছি, তার চেয়ে যেন একটু তফাত। এদিকে-ওদিকে ইতস্তত ছড়ানো দশ-বিশ জনের জটলা, এবং সেই জটলার মধ্যে কী নিয়ে যেন উত্তেজিত আলোচনা চলেছে। এগিয়ে যেতে ‘পুলিশ’ ‘তদন্ত’ ‘খুন’ ইত্যাদি কথাগুলো কানে আসতে লাগল। একটি অপরিচিত প্রৌঢ় বাঙালিকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার মশাই? কিছু হয়েছে-টয়েছে নাকি?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘কলকাতা থেকে কে এক সাসপেক্টেড ক্রিমিন্যাল নাকি এখানে এসে গা-ঢাকা দিয়েছিল। তাকে ধাওয়া করে পুলিশ এসেছে, খানাতল্লাশি চলেছে!’
‘লোকটার নাম জানেন?’
‘আসল নাম জানি না। এখানে নাকি নস্কর বলে পরিচয় দিয়েছে।’
আমার বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। একটিমাত্র লোকই আসল খবরটা দিতে পারবেন—ডাঃ ভৌমিক।
তাঁর বাড়ি পর্যন্ত আর যেতে হল না। লেডেন-লা রোডে রিকশার স্ট্যান্ডের কাছে খাস্তগির ও ভৌমিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বললেন, ‘ভাবতে পারো! লোকটা কাল বিকেলে আমার বাড়িতে বসে চা খেয়ে গেল। পেটে একটা পেন হচ্ছে বলে তিনদিন আগে আমার কাছে এসেছিল চিকিৎসার জন্য, আমি ওষুধ দিয়েছি। একা লোক, নতুন এসেছে, তাই তাকে বাড়িতে খেতে ডাকলাম, আর আজ এই ব্যাপার!’
‘লোকটা ধরা পড়েছে?’ উদ্গ্রীব ভাবে প্রশ্ন করলাম।
‘এখনও পড়েনি। সকাল থেকে মিসিং। পুলিশ খুঁজে চলেছে। তবে এই শহরেই তো আছে, যাবে আর কোথায়। কিন্তু কী সাংঘাতিক ব্যাপার বলো তো!…’
ভৌমিক আর খাস্তগির চলে গেল। আমি বেশ বুঝতে পারছি আমার নাড়ি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। শুধু নস্কর ক্রিমিন্যাল বলে নয়, বাতিকবাবুর আংটির প্রতি লোভের কথা ভেবে। খুনির হাতের আংটি—ভদ্রলোক বলেছিলেন। তা হলে কি সত্যিই লোকটার মধ্যে একটা অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে?
রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে ইচ্ছে করল বাতিকবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করি। ভদ্রলোক কি খবরটা পেয়েছেন? একবার খোঁজ করে দেখা দরকার।
কিন্তু সতেরো নম্বর বাড়ির দরজায় বার তিনেক টোকা দিয়েও কোনও উত্তর পেলাম না। এদিকে আবার মেঘ করে এসেছে। আমি দ্রুত পা চালিয়ে আমার হোটেলে চলে এলাম। আধঘণ্টার মধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। ঝলমলে সকালটা এক নিমেষে একটা সুদূর অতীতের ঘটনায় পরিণত হল। পুলিশ সার্চ চালিয়ে চলেছে। কোথায় গা-ঢাকা দিলেন মিস্টার নস্কর? কাকে খুন করলেন ভদ্রলোক? কীভাবে খুন?
সাড়ে তিনটার সময় আমাদের হোটেলের ম্যানেজার মিঃ সোন্ধি খবরটা আনলেন। নস্কর যে বাড়িটায় ছিল, তার ঠিক পিছনেই পাহাড়ের খাদে ত্রিশ হাত নীচে মাথা থেঁতলানো অবস্থায় নস্করের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আত্মহত্যা, মস্তিষ্কবিকৃতি, পালাতে গিয়ে পা হড়কে পড়ে যাওয়া ইত্যাদি নানারকম কারণ অনুমান করা হচ্ছে। ব্যবসাগত ব্যাপারে পার্টনারের সঙ্গে শত্রুতা। সেই থেকে খুন, মৃতদেহ লুকিয়ে ফেলে দার্জিলিঙে এসে গা-ঢাকা, পুলিশ কর্তৃক কলকাতায় মৃতদেহ আবিষ্কার, ইত্যাদি।
নাঃ—বাতিকবাবুর সঙ্গে একবার দেখা না করলেই নয়! লোকটাকে আর হেসে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। সুইজারল্যান্ড ওয়ালটেয়ারের ঘটনা মনগড়া হতে পারে, দার্জিলিঙের ঘটনা তিনি আগে থেকে জেনে থাকতে পারেন, কিন্তু নস্কর যে খুনি সেটা তিনি জানলেন কী করে?
পাঁচটা নাগাদ বৃষ্টি একটু ধরতেই তাঁর বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। টোকা মারতেই দরজা খুলে গেল। বাতিকবাবু হেসে বললেন, ‘এসো ভায়া, ভেতরে এসো। তোমার কথাই ভাবছিলাম।’
ভেতরে ঢুকলাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাতিকবাবুর টেবিলের উপর টিমটিম করে একটা মোমবাতি জ্বলছে! ‘আজও ইলেকট্রিসিটি আসেনি’, ম্লান হাসি হেসে বললেন ভদ্রলোক। আমি বেতের চেয়ারে বসে বললাম, ‘খবর পেয়েছেন?’
‘তোমার সেই তস্করের খবর? খবরে আর আমার কী হবে বলো, আমি সবই জানতে পেরেছিলাম। তবে, আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।’
‘কৃতজ্ঞ?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
‘আমার সংগ্রহের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি সে আমাকে দিয়ে গেছে।’
‘দিয়ে গেছে?’ আমার গলা শুকনো।
‘ওই দেখো না টেবিলের উপর।’
আবার টেবিলের দিকে চাইতে মোমবাতির পাশেই খোলা খাতার সাদা পাতার উপর আংটিটা চোখে পড়ল।
‘ঘটনার বর্ণনাটা লিখে রাখছি। আইটেম নম্বর ওয়ান সেভেন থ্রি’, বাতিকবাবু বললেন। আমার মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরছে। ‘দিয়ে গেছে মানে? কখন দিয়ে গেল?’
‘এমনিতে কি দিতে চায়?’ বাতিকবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘জোর করে নিতে হল।’
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। ঘরের ভিতর একটা টাইমপিস টিক টিক করে বেজে চলেছে।
‘তুমি এসে ভালই হল’, বাতিকবাবু বললেন, ‘একটা জিনিস তোমাকে দিচ্ছি, সেটা তোমার কাছেই রেখে দিয়ো।’
বাতিকবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের উলটোদিকে অন্ধকার কোণটায় চলে গেলেন। সেখান থেকে খুটখুট শব্দ এল, আর তার সঙ্গে তাঁর কথা—
‘এটাও আমার সংগ্রহে রাখার উপযুক্ত, কিন্তু এটার প্রভাব আমি সহ্য করতে পারছি না। বারবার জ্বর আসছে, আর একটা ভারী অপ্রীতিকর দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।’
ভদ্রলোক কথা বলতে বলতে অন্ধকার থেকে আলোয় এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর ডান হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে রয়েছেন তিনি। সেই হাতে ধরা রয়েছে তাঁর অতি পরিচিত লাঠিটা।
মোমবাতির এই ম্লান আলোতেও বুঝতে পারলাম যে, লাঠির হাতলের মাথায় যে লাল দাগটা রয়েছে, সেটা শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ ছাড়া আর কিছুই না।