বাতাসী

বাতাসী

বাতাসী চোখ তুলতেই দেখল, কিছু গাছের জঙ্গল এবং পরে পায়ে-হাঁটা পথ! আশ্বিনমাস বলে গাছের মাথায় ভোরের রোদ চিকচিক করছে। আশ্বিন মাস বলে রাতের শিশির এখন ঘাসে ঘাসে শ্যামা পোকার মত জ্বলছে অথবা ডালে পাতায় স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ ছড়াচ্ছিল। অথবা মনে হল বাতাসীর, এই রোদটুকুর উত্তাপে চাপ চাপ ভারী বাতাস এবং গেরস্ত বাড়ির সুখ দুঃখ সব ক্রমশ হাল্কা হচ্ছে। সে কোলের শিশুটিকে কোলের কাছে আরও ঘন করে এবং নাবালক নিবারণের হাত ধরে এবার হাঁটতে থাকল।

দূরে পূজার বাজান বাজছে। এই সব শিশুদের পূজামণ্ডপ দেখার বাসনা। আর আশ্বিন মাস সুতরাং নদী-নালার কথা মনে আসছিল। কাশফুলের কথা মনে আসছে।

 সে দেখল পায়ে পায়ে অনেকদূর এই হাঁটাপথ। ওর আর হেঁটে যেতে সাহস হচ্ছে না। হাঁটু ভেঙে আসছে ক্রমশ। সে অসহায়, কারণ শেষ আশ্রয়স্থলটুকু পর্যন্ত গেছে। বাতাসী সারা রাত কেঁদেছিল। চোখ দুটো ফুলে গেছে। চোখের নীচে দুঃখের দাগ। বাতাসী বলল, নিবারণ বাপ আমার, জোরে পা চালাইয়া হাঁট। ওরা পূজামণ্ডপে প্রসাদের জন্য হাঁটতে থাকল।

গতকাল নিবারণ ও কোলের শিশুটি সারাদিন চ্যাঁ চ্যাঁ করেছে। অন্নাভাব এবং নিখোঁজ স্বামীর জন্য বার বার ঈশ্বরকে দায়ী করেছে বাতাসী। বাতাসী ক্ষুধায় কাতর সুতরাং হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বাতাসীর এবং এক ধরনের অন্যমনস্কতা এ-সময় ভিতরে ভিতরে কাজ করছিল। ছোট চালা ঘর, বড় রাস্তার ধারে বাবুদের বাড়ি পূজামণ্ডপ সবই ভয়ঙ্কর দীর্ঘ মনে হচ্ছে, যেন শেষ নেই এবং কেবল একটানা হেঁটে যেতে হবে। বাতাসী ভেবেছিল—দুদিন সময় পেলে কোথাও কাজের সন্ধান করবে, দুটো মুখের জন্য ভাবনা থাকবে না। সে মণ্ডপে মণ্ডপে প্রসাদের জন্য ঘুরে বেড়াতে থাকল।

অথচ প্রসাদে পেটের জ্বালা বাড়ছে। বাতাসী স্থির করতে পারছে না কি করণীয়। ওর শেষ আশ্রয়ের কথা মনে হল। মামা মোহনচন্দ্রের কথা মনে হল। মামা মোহনচন্দ্র মণ্ডলের দু বিঘে জমি এবং গেরস্ত বাড়ি। মোহনচন্দ্র বাতাসীকে গতকাল বলেছিল, তর মত আমি-অ রিফুজী। আমি আর তরে খাওয়ান দিতে পারমু না। তর তিন প্যাটের যোগাড় ইবারে তুই কর দ্যাহি।

বাতাসী বলেছিল, দুইটা দিন সবুর কর‍্যান মামা। আপনের ভাগিনারে আইতে দ্যান।

—হ্যায় আর আইছে! মোহনচন্দ্র একটুকু বলে হুঁকা সাজতে বসে গেল। মোহনচন্দ্রের রুগ্ন স্ত্রী জল খেতে খেতে বলছিল, সংসার, যার যার তার তার। এবং এক গ্রাম্য শ্লোকে বাতাসীকে তীক্ষ্ণ খোঁচা দিল। মোহনচন্দ্রের সন্তানেরা খেল, মোহনচন্দ্র এবং তার রুগ্ন স্ত্রী খাচ্ছে—বাতাসী এবং তার সন্তানেরা শুধু দেখছিল আর চোখে অন্নের ছবি জলের মত ভেসে যাচ্ছিল … বাতাসী রাতে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করতে করতে উঠে এসেছিল এবং বলেছিল, মামা তবে আপনে আমারে কি করতে কন?

সন্তানেরা না খেয়ে আছে দিনমান। বাতাসী দুঃখ কষ্ট আর সহ্য করতে পারছে না। সে তার মামার সৎ পরামর্শ চাইল এবং কাঁদতে থাকল, আমার কি হৈব।

 মোহনচন্দ্র বুদ্ধিমানের মত জবাব দিয়েছিল, কি হৈব আবার! যার কে-অ নাই তার দশজন আছে, ভগবান আছে। তর দশদুয়ার আছে।

সুতরাং অনেকক্ষণ বাতাসী পথের উপর দাঁড়িয়ে এই পথ দেখল। হাঁটতে হাঁটতে সে অনেকদূর চলে এসেছে। ইতস্তত গেরস্ত বাড়ি অতিক্রম করলে সড়ক এবং সড়ক ধরে শহরের পথ। বাতাসী পথে নিবারণকে বলল, নিবারণ বাপ আমার, তুই বড় হৈবি কবে! তর বাপের আর কৈ খোঁজ করমু!

নিবারণ এসে সামনে দাঁড়াল এবং বলল, মা।

বাতাসী বলল, আমি কি করমুরে নিবারণ।

নিবারণ বলল, মা তর মামার কয় বাবারে কাইটা ফ্যালাইছে।

বাতাসী নিবারণের মুখ চেপে ধরল। নিজে কোন কথা বলতে পারছে না। ওর বুকে ভয়ঙ্কর কষ্ট এবং দম বন্ধ হয়ে আসার মত ভাব। পূজার বাজনা বাজছে দূরে। ঢাকের শব্দ সানাইয়ের শব্দ আর নিবারণ বায়না ধরেছে, মা খামু, খুদা পাইছে।

বাতাসী টগরের মুখে শুকনো স্তনটি সব সময়ের জন্য দিয়ে রেখেছিল। আনাজ তরকারীর বাগান এখন তারা অতিক্রম করছে। নিবারণ মার কাছ থেকে কোন উত্তর পাচ্ছে না। সে চারিদিকে তাকাতে থাকল এবং বলল, মা একটা ঢেঁড়স তুইলা আনমু।

এই সব গাছে এখন ঢেঁড়স ফলে আছে। গাছগুলি শেষ ফলদানে বৃদ্ধের মত। এবং ইতস্তত পোকায় খাওয়া সব ঢেঁড়স। নিবারণ মার অনুমতির জন্য প্রতীক্ষা করল না। সে বাগানে ঢুকে দুটো ঢেঁড়স তুলে ফেলল।

নিবারণকে ঢেঁড়স খেতে দেখে কিঞ্চিৎ নিশ্চিন্ত হল বাতাসী। কারণ পিতার মৃত্যু সম্পর্কে নিবারণ আর কৌতূহলী নয়। নিবারণ ঢেঁড়স খাচ্ছে আর চারিদিকের পাখ-পাখালি দেখছে। বাতাসী নিবারণের চোখ দেখে বুঝল ঠিক ঠিক যেন সেই এক নিরাপত্তাবোধ ওর চোখে। সীমান্ত অতিক্রম করার সময় নিবারণ মার হাত ধরে বলেছিল, আমার বাবার এহানে পালাইয়া আইছে না মা?

সীমান্ত অতিক্রম করার সময় সবই আনন্দজনক। সেই একই মানুষ—তারা হাল চাষ করছে; পাখিরা উড়ছিল—কোথাও কোন বিষণ্ণতা ছিল না। না রোদে, না মাঠে, এমন কি মানুষের ভিতরেও নয়। জমিতে বীজ বোনবার সময়। সীমানার দু দিকে সেই এক ঝোপজঙ্গল এবং এ-পারের পাখ-পাখালিরা অন্য ধারে উড়ে যাচ্ছে এবং সেই এক অশ্বত্থ গাছ নদী পার হলে, অথবা সেই এক বৃদ্ধ, আব্বাসের মত ঘোলা চোখে সকল কিছু সামলাচ্ছে। আব্বাস বলেছিল ডোলের ভিতরে লুকাইয়া পড় মা। তর পোলারে একটা তফন পরাইয়া দ্যা। আর বাতাসী সীমানা অতিক্রম করার সময় ভেবেছিল, এখানে কোথাও না কোথাও বৃদ্ধ, আব্বাসের দেখা পাওয়া যাবে। সুতরাং সে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের জন্য, নিখোঁজ স্বামীর জন্য কখনও রেলে চড়ে অথবা কখনও ইতর মানুষদের ভোগ্য দ্রব্যের মত সে নিজেকে সীমান্ত অতিক্রম করতে সাহায্য করেছিল।

বাতাসী কত পথ ভাঙল কত হাট-বাজার অতিক্রম করে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত সব মানুষদের ভিতর স্বামীকে খুঁজল। কখনও সরকারের দয়া, কখনও কায়িক শ্রম অথবা দূর-সম্পর্কের পরিচিত ব্যক্তির সাহায্যে সে অন্নাভাব দূর করছিল আর, নিজের দুঃখকে নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর জন্য ধরে রেখে শুধু কান্না আগলাত। বলত, তুমি ঠাকুর কৈ আছ? তোমার পোলাপান দুইডা কেবল কয় বাবায় কৈ গ্যাল মা! আমাগ ফ্যালাইয়া তাইন কৈ গ্যাছে? অথবা যেন বাতাসী বলতে চাইল, এই যে এত দুঃখ, এত বেদনা এবং বিষণ্ণতা সবই যেন তোমার প্রত্যাশাতে।

বাতাসী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কিছু ভাবতে পারছে না। মাথাটা কেমন ঘুরতে থাকল। যখন চাষীরা বীজ বুনছিল, যখন চৈত্র বৈশাখ মাস ছিল এবং যখন নদী-নালা জলের জন্য হাহাকার করছিল, তখন যেন কোথাও না কোথাও তার স্বামী সাধুচরণ মণ্ডল সন্ন্যাসীর মত বসে ছিল–এ-কল্পনা সে করেছে কত।

ওরা মুলি বাঁশের বেড়া অতিক্রম করল। নিবারণ মার পাশে আঁচল ধরে হাঁটছে। ছোট মেয়েটা কেবল স্তন খাচ্ছিল। বাতাসী কাপড় আলগা করে রেখেছে এবং এই বুকের প্রতি নিদারুণ অবহেলা–খালি গা বাতাসীর। ভোরের কুয়াশা এখনও গাছের ফাঁকে ফাঁকে ধোঁয়ার মত লেগে আছে। ফুরফুরে বাতাস এবং কলাগাছের পাতা নড়ছে। নিবারণ কলাগাছের পাতা ছিঁড়ল ভেঁপো বাজল। নিবারণের প্যাণ্ট ছেঁড়া, খালি গা এবং নাক থেকে সর্দি ঝরছে। বাতাসীর চোখ দুটো বড় উদ্দেশ্যবিহীন–বারান্দায় বাবুলোক বসে, চেয়ারে পা তুলে বাতাসীকে তিনি লক্ষ করছেন। মেয়েটা নির্বোধের মত বাড়ির উঠোনে ঢুকে গেল। কোন কথা বলছে না—চারিদিকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে।

বাবুলোকটি বললেন, এখানে কি চাই?

বাতাসী আমতা আমতা করতে থাকল। সে ভয়ে তার সন্তানদের আরও কাছে টেনে আনল। তারপর মরিয়া হয়ে বলল, কর্তাগ আমার পোলাপানেরে দুইডা খাইতে দ্যান। কথাগুলো খুবই অস্পষ্ট। বাতাসী নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাথা এবং মুখ যেন জ্বালা করছে! সে ফের কথাটা আবৃত্তির মত বলতে চাইল কিন্তু পারল না।

বাবুমানুষটি এবং তার স্ত্রী ওর দুঃখে যেন কিঞ্চিৎ কাতর। সুতরাং ওরা ওকে নানাভাবে প্রশ্ন করছিল।

বাতাসী বলল, তখন খাইতে বইছি। বাতাসী দাঙ্গার বিবরণ দিতে চাইল। বাতাসীর সেই সব কথার ভগ্নাংশ একই দৃশ্যকে প্রকাশ করছে—ওদের হাতে মশাল, ওরা শীতলক্ষার চর ধরে ভয়ঙ্কর নাম নিতে নিতে ছুটছে। নিরীহ মানুষেরা পেট ভরে খেতে পারল না। শীতলক্ষার জলে রক্তের নদী বইতে থাকল।

বাতাসী বলল, তাইন কাম থাইক্যা আর ফিরল না।

বাতাসী বলল, লোকে কয় তাইন মাইনষের লগে ঠিক হিন্দুস্থানে চইলা গ্যাছে। আর আমি-অ মাইনষের লগে ঠাকুর খুঁজতে চইলা আইলাম।

নিবারণ মার আঁচলের ফাঁক থেকে জাদুকরের লাঠির মত সহসা মুখ বের করে বলল, মাইনসে কয়, আমার বাবারে কাইটা ফ্যালাইছে।

হত্যার কথা শুনে আবেগে বাবুটি তিনজনের মত চাল দিতে বললেন স্ত্রীকে এবং কিছু নগদ পয়সা। তারপর এক কোচ মুড়ি ভরে দিতেই বাতাসী হাউ-হাউ করে কাঁদতে থাকল। সারা মাস ধরে পূজা-পার্বণ, মা দুগগা ঠাকুর এসেছেন।

মার কান্না দেখে নিবারণও কাঁদল। কোলের শিশুটি একবার মার মুখ দেখে ফের স্তন খেতে থাকল। সদাশয় ব্যক্তিটি এই দুঃখজনক ঘটনা সহ্য করতে পারছেন না। বাতাসী ঠাঁই খোঁজার জন্য নতুন বাতিঘরের দিকে রওনা হয়েছে। সদাশয় ব্যক্তিটি যেন দেখতে পেলেন, এই বাতিঘরের আলো একমাত্র সমুদ্রে যাবার পথ বাতলে দিচ্ছে—ঘরে ফেরার কথা অথবা কোন বন্দরে নোঙর ফেলতে সাহায্য করছে না।

তিনি বললেন, কেঁদে কি করবে। অথবা যেন বলতে চাইছেন, দুঃখ মানুষকে মহৎ করবে। তারপর তিনি বললেন, যতদিন সাধুচরণ না ফিরছে, ততদিন তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে।

বাতাসী হেঁটে চলে গেল। নিবারণ পিছনে পিছনে হাঁটছে। নিবারণের চোখে দুঃখের জল, বাতাসীর চোখে দুঃখের জল। দরজায় দরজায় হাত পাতার অসম্মান বাতাসীকে যথার্থই আজ কাতর করছে।

বাতাসী ডাকল, বাপ নিবারণ।

নিবারণ বলল, ভাত হৈয়া গ্যাছে মা।

নিবারণের বোন টগর হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। কাক ডাকছিল বড় রাস্তায়। তখন সকাল। মা খাবে, টগর খাবে আর নিবারণ বসে থাকবে। মার খাওয়া হলে নিবারণ সব ধুয়ে পাকলে আনবে।

নিবারণ ভাত বেড়ে বলল, খাইতে বও মা।

বাতাসী খেতে বসে বলল, কাইল দুইটা আলু আনছিলাম।

নিবারণ বলল, রাইখ্যা দিছি। বাগুন পাইলে রসা রানমু।

বাতাসী ডাল সেদ্ধ দিয়ে ভাত মাখল। সোনা-বৌমা তিনটে কাঁচালঙ্কা দিয়েছে—বাতাসী সযত্নে ব্যাগ থেকে তা বের করল। বাতাসী একটা লঙ্কা ঘষে ঘষে মাখল এবং নাকের কাছে গন্ধ নিল তারপর সযত্নে ভাত ডাল মেখে বড় বড় গ্রাসে তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে ঢকঢক করে এক ঘটি জল খেল।

বাতাসী পান মুখে দেবার সময় বলল, নিবারণ কাইল টগর কি কয় জানস? কয় আমার বাবারে স্যাখেরা কাইটা ফ্যালাইছে। ঠিক তর মত কইল।

নিবারণ বলল, আমি সুর ধইরা কইতে পারতাম।

বাতাসী বলল, দুই চাইর দিন বাদে টগর কইতে পারব।

নিবারণ বলল, মা তর হেই মানুষটার কথা মনে আছে? তুই আমি কানছিলাম, টগর কানছিল।

বাতাসী বলল, যাই। তবে আগের মত ভিক্ষা দেয় না। অর বৌটা মইরা গ্যাছে।

বাতাসী পান খাচ্ছে। গালের এক পাশে পান এবং মুখে এক ধরনের সুখী ভাব ফুটে উঠেছে। নিবারণ ফের বলল, মা আমারে ইটু পান দাও। নিবারণকে বাতাসী মুখ থেকে চিবানো পান এনে খেতে দিল। সুতরাং টগরেরও বাসনা পান খাওয়ার। সেও হাত পাতল, অস্পষ্ট কথা টগরের মুখে। বাতাসী টগরকে চিবানো পান দেবার সময় বলল, আইজ যদি রাস্তায় তুই মাইয়া না হাঁটস, তবে তর একদিন কি আমার একদিন–বলে, বাতাসী এক ধরনের বিরক্তিকর শব্দ করল। ভোরের সংসার এইটুকু বাতাসীর। এখন স্বামী সাধুচরণের কথা মনে আসছে না। এই সময়টুকু বাতাসী, টগর এবং নিবারণ গতদিনের ভিক্ষালব্ধ সব জিনিসপত্রের একটা মোটামুটি হিসাব নিয়ে বেঁচে থাকে। জীবনে সুখ আছে, কারণ, গরম ভাত একটু পান। তারপর সামনে লাউমাচানে কিছু কচি লাউ অথবা গাছে গাছে বসন্তের ফুল ফুটছে—ঠিক এমনি এক জীবন যা ছেড়ে চলে এসেছে এবং যার জন্য ধীরে ধীরে এক মমতাবোধ গড়ে উঠছে বাতাসীর।

বাতাসী ঝোলাঝুলি নিয়ে টগরকে নিয়ে বের হয়ে পড়ল। বড় রাস্তা ধরে সে হাঁটছে। বসন্তকাল—গাছে গাছে নতুন পাতা এবং রোদে উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে—আবার বীজ বুনবার সময় হয়ে এল। সামনে সব পরিচিত পথ। শহরে বাস যাচ্ছে, গরুর গাড়ি যাচ্ছে, ক্যাচক্যাচ শব্দ অথবা পাখ-পাখালির শব্দ বাতাসীকে ঘর থেকে শহরে এবং আশেপাশে গেরস্ত বাড়ির ভিতরে যাবার জন্য মরিয়া করে রাখে।

একটা পরিচিত কামরাঙা গাছ—বাতাসী সেখানে দাঁড়াল। একদা এই গাছ ওকে মৃত ডাল দিয়ে সাহায্য করত সুতরাং আজও দেখল সঙ্গে কোন মৃত ডাল কিংবা পাকা কামরাঙা ঝুলছে কিনা। অথবা কখনও কয়েতবেলের আচার খাবার জন্য জিলা বোর্ডের সদর রাস্তায় আমীনকে—বলা নেই কওয়া নেই, আমীনকে এক কোঁচড় শাক তুলে দিয়েছিল। মিষ্টি কথা, সেই জাদুকরের লাঠির মত টগর আঁচলের তলা থেকে বের হয়ে বলেছে, মাইনসে কয় বাবারে কাইটা ফ্যালাইছে। যেন একটা ভেল্কি—ভিক্ষার জন্য বাতাসী সকলকে টগরের সাহায্যে এই ভেল্কি দেখাচ্ছিল। এবং জীবনধারণের জন্য এই ভেল্কি মানুষের প্রয়োজন। এজন্য রাতে বাতাসী মোটা কাঁথায় শুয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমোতে পারত, কোন অনুশোচনা থাকত না।

বাতাসী আজ শহরের দিকে হাঁটছে না। সে ভিন্ন পথে কলোনীতে উঠে যাচ্ছে। পরিচিত পথ বলেই টগর আগে আগে হাঁটছিল। টগর ছুটছে কখনও, যেন পার্বণের নিমন্ত্রণ পেয়েছে। পরিচিত পথ বলেই সে জানত এ-সময় এখানে ঢেঁকিশাক অথবা কাঁটাশাক এবং অন্য অনেক রকমের বন্যলতা ফুল এবং ফল পাওয়া যাবে। বাতাসী ফুল ফল শাকপাতা সংগ্রহ করল। ঝোপের পাশ থেকে তখন টগর ডাকছে—মা দ্যাখ, কত গিমা শাক!

অসময়ে এত গিমা শাক পেয়ে বাতাসী খুব খুশি। সে টগরকে নিয়ে বসল। দূরে পাঠশালা। শিশুদের কোলাহল বাতাসে ভেসে আসছে। বাতাসী বলল, টগর তুই বড় হৈলে তরে ইস্কুলে পড়ামু। বাতাসী সযত্নে শাক তুলছিল এবং টগরের সঙ্গে কথা বলছিল। কখনও গুনগুন করে সুখের গান গাইছে। সারাদিন এখন বাতাসীর জীবনসংগ্রাম অথবা এ যেন এক নূতন কৌতূহল প্রতিদিন। অতীব এক সুখ এই জীবনসংগ্রামে। সে তার কোঁচড় টিপল। অনেক শাক, কোনও পল্লীতে এই শাকের বিনিময়ে সে কিছু পাবে। এক ব্যবসায়ী বুদ্ধি নিয়ত তার ভিতরে কাজ করছে।

 সে বাড়ি বাড়ি হাতের খঞ্জনী বাজাল এবং গান করল … এ কি হেরিলাম নয়নে। টগর ভাঙা ভাঙা গলায় দুয়া দিল। বৃদ্ধারা বলল, আর একটা গাও।

বাতাসী গাইল, নদীয়ায় এলেন শ্রীহরি …। তারপর বাতাসী ঝোলা খুলে বলল, দ্যান গ মা ঠাইরেন। বাড়ির সকলে পরিচিত সুতরাং বাতাসী বলল, আপনে গ সোনাবউরে দ্যাখতাছি না? ঝোলাতে চাল পড়তেই সে বিড়বিড় করে আশীর্বাদের মত কি সব বলল। সব কিছু বাতাসী ধীরে ধীরে রপ্ত করেছে—জীবনধারণের জন্য কিছু ভিন্ন ভিন্ন কৌশল আয়ত্ত করার মত। আর পরিচিত বলেই কিছু কিছু পরিবার তার আত্মীয়ের মত। সে গিমাশাকটুকু এক বাড়িতে রেখে বলল, বউদি খাইয়েন। সে দাওয়ায় বসে এক ঘটি জল খেল।

বাতাসী বলত, বুঝলেন মা সরকার গ পুষ্কণীতে এত বড় একটা উদবিড়াল ধরা পড়ছে।

বাতাসী বলত, তখন আমরা খাইতে বইছি। ঠাকুর কামে গ্যাছেন। ভোরের রোদ যখন দুপুরের মাথায় এসে থামত বাতাসী বলত, ঠাইরেন আমাগ বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। নাম শুনছেন নি? নদীর ঐ পারে বন্দর। আমার ঠাকুর গঞ্জির কলে কাম করত। ঠাইরেন মাইনসের দিন সমান যায় না। পরিবারের লোকেরা হয়ত ব্যস্ত, বাতাসীর কথা কেউ শুনছে না—বাতাসীকে গান গাইতে বারণ করছে, তখন সে বলত, নাঙ্গলবন্দের নাম শুনছেন? আপনা গ দ্যাশত প্যারাব পোনাবর কাছেই আছিল। নাঙ্গলবন্দের কামার কুমার কে-অ নাই। সব পোড়াইয়া দিছে।

তখন পরিবারের লোকজন দেশের খবর এবং সেই মাঠঘাটের খবর নিচ্ছে, আর বাতাসী কথকঠাকুরের মত বলছে মাঠঘাটের খবর আর কি কমু! এবং এভাবেই সে যুদ্ধ জয় করে চলেছে। ওকে দেখলেই সকলের সেইসব মাঠের ছবি দেখার ইচ্ছা—এমন একটা দেশ যার পাখ-পাখালি, মাঠ এবং শস্য প্রাণের চেয়েও মহৎ।

বাতাসী বলত, মা’গ সব দ্যাখলাম। জীবনটা আমার এক বছরে একশ বছরের কৈরা দিছে। তার বলার ইচ্ছা যেন, মাসের পর মাস ঝোপে জঙ্গলে কাটা মানুষের মাথা, কলমীলতার ভিতরে বিবস্ত্র যুবতীর মুখ অথবা বাদাম তুলে যাত্রীরা কোথায় যেন চলে যাচ্ছে—এই সব দেখতে দেখতে বাতাসীর এক বছর একশ বছর হয়ে গেল। বাতাসী বলত, এক জীবনে কত দ্যাখলাম গ মা। অরা লুটতরাজ করল, নাঙ্গলবন্দের ভৈরবীর ঠ্যাং ভাইঙ্গা দিল। সে চোখ বড় বড় করে বলত, বুজলেন নি মাসি, একটা লোক পাতিলের নীচে মুখ ঢাইকা জলে লুকাইয়া আছিল পাঁচদিন। ড্যামরার ঘাটে অরা কয়, হ্যারে সোতের পানি ভাইসা যায়, পাতিলডাত ভাইসা যায় না লগে লগে। দিল এক বাড়ি। টগর এই কথায় মুখটা হাঁ করে ফেলল আর বাতাসী একটু থেমে বলল, আহাগ মানুষটার মাথা বাঙ্গির মত ফাইট্টা গ্যাল।

বাতাসী তারপর টগরের হাত ধরে বলত যাইগ ঠাইরেন।

পরিবারের লোকজন বলত, খাড়ও। ওরা বাতাসীকে দুমুঠো চাল বেশি দিত।

তখন বাতাসী বলত, খ্যাতে মেলা বাগুন হৈছে ঠাইরেন। একটা দ্যান না! নিবারণের বড় সখ আলু দিয়া বাগুন দিয়া রসা করব।

এখন রোদ হেলতে আরম্ভ করেছে। সে আরও দু বাড়ি ভিক্ষার জন্য ঢুকে গেল।

এই ভরদুপুরে, মানুষেরা বলল, তোমার সময় অসময় নেই।

আঁচলের নীচে বাতাসী জাদুর লাঠি লুকিয়ে রেখেছিল। এবং মুখের চেহারা এখন করুণ। গলার স্বর অভিনয়ের মত।

টগর আঁচলের ফাঁক দিয়ে লোকগুলোর চেহারা দেখছে। গিন্নীমার চোখ ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল। তবু টগর ফাঁক থেকে বের হয়ে বলল, মাইনসে কয় বাবারে কাইট্টা ফ্যালাইছে। বাতাসীর এটাই শেষ অস্ত্র। বাতাসী আকাশ দেখে বুঝল এবার ফেরার সময়। কারণ চাষীরা মাঠ থেকে ফিরছে। সারাদিন ভিক্ষার জন্য শরীরে ক্লিষ্ট ভাব—বাতাসী শিমূলগাছের নীচে টগরকে নিয়ে বসল। কৌটা থেকে পান বের করে সামনের মাঠ দেখল। মাঠ দেখলেই মৃত মানুষের সব মুখ মনে আসে, মাঠ দেখলেই অন্ধকারের কথা মনে হয়, অথবা দূরে দূরে মশালের আলো, ঈশ্বরের নামে ভয়াবহ চীৎকার। সাধুচরণ যেন সর্বদা তার কাছে হেঁটে আসছে। সাধুচরণ আর ফিরবে না। সাধুচরণকে হয়ত কলের মানুষেরাই কেটে ফেলেছে। রাতে যখন ওর কুঁড়েঘরটা নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকে, যখন ঝোপেজঙ্গলে জোনাকী জ্বলে অথবা মোটরের আলো হর্ন দিতে দিতে দ্রুতগতিতে বড় শহরের দিকে যায় তখন সাধুচরণ যেন ফিসফিস করে বলে, বাতাসী আমি আইছি দরজা খোল।

চারিদিকটা পোড়া ইটের মত খাঁখাঁ করছে। বাতাসীর ঝিমুনি আসছিল টগর মার কোলে মাথা রেখে শুয়েছে। বাতাস বইছে না, দূরে কোথাও কাক-শালিখের শব্দ। শহরে লোক যাচ্ছে সাইকেলে চড়ে—ওরা ঘণ্টি দিচ্ছিল, সাধুচরণের ভাঙা সাইকেলের কথা মনে আসছে। পাশে ঝোলাঝুলিতে চাল, আলু, বেগুন। সুতরাং কোন কষ্টই নেই। এখন শুধু সাধুচরণ। সাধুচরণের উপস্থিতি একান্ত কাম্য। সাধুচরণকে সে এখন খাওয়াতে পারে। সারা দিন সঞ্চয়ের জন্য উৎসাহ উদ্দীপনা, সুতরাং দিনটা বড় তাড়াতাড়ি নিঃশেষ হয়। রাত দীর্ঘ, বাতাসীর ঘুম আসে না, তখন শুধু কান্না পায়। সাধুচরণের জন্য সে রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।

 রোদের তেজ তীব্র তীক্ষ্ণ বলে অথবা জায়গাটা খুব নিরিবিলি বলে বাতাসী গায়ের কাপড় নামিয়ে রেখেছিল। ঝোপজঙ্গলে কীটপতঙ্গের আওয়াজ। চাষের জন্য মাঠ অমসৃণ। গাছের ফাঁকে টিনের চাল এবং দেয়ালের ঘর দেখা যাচ্ছে। সে টগরকে নিয়ে ঝোলাঝুলি সঞ্চয় নিয়ে দুপুরের রোদে গাছের ছায়ায় বসে ফের গুনগুন করে একটা গান গাইল। এইসব পায়ে হাঁটা পথ ভিন্ন ভিন্ন পরিচিত পরিবার এবং ঝোপজঙ্গলের পাশে ফুল, কয়েতবেলের গাছ। অথবা রিকশায় চড়ে শহরে চলে যাওয়ার ভাবনা, সবই এক পরম উত্তেজনা বহন করছে। এর জন্য তার বাঁচার প্রবল ইচ্ছা, প্রবল এক স্বাধীনতাভোগ। এবং বাতাসীর সহসা মনে হল এরা সকলেই ধীরে ধীরে তার ভালবাসার সামগ্রী হয়ে গেছে। সাধুচরণকে এইসব কীটপতঙ্গ পাখপাখালি এবং কুল কয়েতবেলের পাশে বড় ম্রিয়মাণ দেখাচ্ছিল।

যখন রোদ নরম হল, যখন শহর থেকে সারি সারি গরুর গাড়ি বড় রাস্তা ধরে গ্রামের দিকে নেমে যাচ্ছে তখন বাতাসী টগরকে ডাকল, টগর ইবারে উঠ। ঘরে যাইবি না!

বাতাসী সামনের পুকুরে স্নান করে নিল। তারপর অবেলার রোদে চুল ছেড়ে শ্যামা সংকীর্তন করতে করতে ঘরের দিকে ফিরল। সে গাইল, শ্যামা বসন পর, ভূষণ পর…আর ওর মনে হল এই বসনভূষণের জন্য এক অজ্ঞাত ইচ্ছা মানুষকে সব সময় তাড়না করে ফিরছে। সে বলল, টগর কাইল আমরা শহরে ভিক্ষা করতে যামু। এই বলে ওরা ঘরে ফিরছিল। যেন এইমাত্র কোন দ্রুতগামী তীর্থের শকট থেকে নেমেছে। তাদের মুখ এবং চোখ বড় উদাস দেখাচ্ছে।

রাতে বাতাসী ঘুমিয়ে আছে। ঘরে কোন আলো জ্বলছে না। ঘরের কোণায় একটা ব্যাঙ থেকে থেকে ডাকছে। বর্ষার দিন, মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছিল। কড়কড় করে গাছের মাথায় মেঘের শব্দ—নিবারণ তখন খুব ঘুমোচ্ছে। টগর স্বপ্নে কেঁদে উঠেছিল একবার আর বাতাসী থেকে থেকে দুঃস্বপ্ন দেখছিল, যেন সাধুচরণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকছে, দরজা খোলা ঝড় বৃষ্টির জন্য মেঘের কড়কড় শব্দের জন্য ঘটনাটাকে স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল।

দরজার পাশে মানুষের গলা। বাতাসী কান খাড়া করে রাখল। বাতাসী শুনল, মোহনচন্দ্র ডাকছে, বউ দরজা খোল। সাধু আইছে।

বুকে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা এবং ভূত দেখার মত ভয়। সে বড় বড় চোখে এবং কাঁপতে কাঁপতে দরজা খুলতে গেল। দরজার ফাঁকে দুজন মানুষের ছায়া শুধু দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সুতরাং বাতাসী কুপি জ্বালাল। কুপিটা এক হাতে রেখে বেড়ার ফাঁকে ফের প্রশ্ন করল, আপনেরা ক্যাডা।

—আমি মোহন। সাধুরে লইয়া আইছি।

বাতাসী দরজা খুলে যথার্থই সাধুচরণকে দেখল। এখনও সব কিছু রহস্যজনক ভেবে বাতাসী ভাল করে কথা বলতে পারছে না। সে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকল। সাধুচরণের গায়ে ময়লা জামা, মুখে বড় দাড়ি এবং চোখ দুটো জ্বলছিল। মোহনচন্দ্র চলে গেলে বাতাসী সাধুচরণের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং গা হাত শরীর টিপে মানুষটা সাধুচরণ এই সত্য জেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল।

বাতাসী বলল, তোমার পোলাপানেরে ঠাকুর কষ্ট পাইতে দেই নাই।

সাধুচরণ শুধাল, তুই আব্বাসের বাড়িতে আছিলি?

বাতাসী বলল, হ। কিন্তু রাইতের ব্যালায় মনে হৈল আব্বাস আমাগ বাঁচাইতে পারব না। আমি নাকে নথ পৈরা, আব্বাসের বৌর বোরখা গায়ে দিয়া আর নিবারণেরে তফন পরাইয়া বাইর হৈয়া পড়লাম।

সাধুচরণ এবার নিজের কথা বলতে গেলে বাতাসী বলল, দুঃখের কথা পরে হৈব। তুমি জামাকাপড় ছাড়। বাতাসী নিজের হাতে ওর চুল মুছে দিল। বলল, ঠাকুর তোমার লাইগ্যা রাইতে আমার চক্ষে ঘুম নাই। তোমার মামায় কয়, তোমারে কাইটা ফ্যালাইছে। বাতাসী এবার তার দু’হাত সাধুচরণের দাড়ির ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। তারপর ঘন হয়ে বলল, তোমারে-অ কষ্ট দিমু না।

সাধুচরণ বলল, কাছে আয় তুই। দূরে দূরে থাকবি না।

বাতাসী বলল, ক্যামন লজ্জা লজ্জা লাগতাছে।

সাধুচরণ এবার উঠে দাঁড়াল। তারপর বাতাসীকে এত ঘন করে নিল যে—বাতাসী ভয়ে বলে উঠল, নিবারণ বড় হৈছে, টগর বড় হৈছে। কুপিটা ফু দিয়া নিভাইয়া দ্যাও।

সাধুচরণ ফুঁ দিয়ে কুপি নেভাল না। বরং কুপির আলোতে সে বাতাসীর মুখ দেখল, অথবা যেন গন্ধ নিচ্ছে মুখের—এই মুখে কোন দুরারোগ্য ব্যাধির গন্ধ আছে কিনা দেখতে চাইল।

বাতাসী সহসা মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল, দুফরে কি খাইছ?

—কিছু না।

বাতাসী তাড়াতাড়ি নিজেকে ওর দু হাতের ভেতর থেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল, ঠাকুর সিদ্ধ ভাত কৈরা দিই। খাও।

বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। নিবারণ, টগর তখনও ঘুমোচ্ছিল। বাতাসী ঘরের কোণ থেকে শুকনো ঘাসপাতা এনে উনুনের পাশে রাখল। বাটিতে চাল, কুমড়া একসঙ্গে ধুয়ে হাঁড়িতে ছেড়ে দিল। উনুনে আগুন জ্বলছে। সাধুচরণ উনুনের পাশে বসে সুখ দুঃখের গল্প করছে। ওর শরীরে কাপড়ের খোঁট জড়ানো এবং সে কেবল বাতাসীর মুখ দেখছিল। মুখে এক ধরনের লাবণ্য—উনুনের উজ্জ্বল আলোতে বড় মায়াময়—সে এই উনুনের পাশেই বাতাসীকে ফের জড়িয়ে ধরল এবং বলল, বাতাসী তর মুখটা আমার ভগমান। কত দ্যাশে গ্যাছি, কেবল চাইয়া রৈছি—তর মুখের মত যদি পাই। লোকে আমারে পাগল কৈত। মারধর করত।

বাতাসী তখন সাধুচরণের দিকে তাকাতে পারছে না। সাধুচরণের লম্বা দাড়ি, বড় বড় চুল এবং কোটরাগত চোখ এতক্ষণ পর যেন বড় অসহায় ঠেকছে। সুতরাং সাধুচরণকে সন্তানের মত মনে হল। সোহাগ করার ইচ্ছাতে হাত বাড়াল বাতাসী। বলল, য্যায় তোমারে মারছে তার হাত য্যান খইয়া পড়ে। সে এই রাতে বসে বসে তাদের শাপ শাপান্ত করল।

সাধুচরণ বলল, নবদ্বীপে সন্তোষ পালের কাছে খোঁজ পাইলাম তরা মামার কাছে গেছিলি।

বাতাসী মোহনচন্দ্রের নাম শুনে ক্ষেপে গেল। মুখটা ওর থমথম করছে। সাধুচরণকে নিয়ে মোহনচন্দ্র ঘরে এলে ঘৃণায় সে চোখ তুলতে পারেনি। ততক্ষণ সে বিমূঢ়ের মত বসেছিল।

সাধুচরণ ঘরের চারপাশটা দেখল। পাটকাঠির বেড়া, খড়ের চাল। তারপর বাইরে বৃষ্টি পড়ছে তখনও। ট্রাকের শব্দ ভেসে আসছে, ব্যাঙের শব্দ হচ্ছিল। আর সাধুচরণ বাতাসীর কাছে বসে ভাবছিল যেন সে জীবনের শেষ তীর্থক্ষেত্রে পৌঁছে গেছে। সে বাতাসীর মুখ কছে টেনে বলল, আমার এত সুখ কি সহ্য হৈব। বলে, সাধুচরণ হাউহাউ করে পাগলের মত কেঁদে ফেলল।

সাধুচরণ কাঁথার নীচে শুয়ে এক সময় প্রশ্ন করল, বাতাসী মামায় কয় তুই ভিক্ষা করস?

—কী করমু কও তবে!

সাধুচরণ কোন জবাব দিতে পারল না। পরদিন বাতাসী বলল, তুমি আইছ, আইজ আর ভিক্ষা করতে যামু না।

সুতরাং সারাদিন সাধুচরণের সঙ্গে বাতাসীর দেশ গাঁয়ের গল্প। নিবারণ টগর বাপের কাছাকাছি থাকছে। এই সংসারের ছোট ছোট ইচ্ছারা আজ হালকা হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ছে। সাধুচরণ পাশের নালা থেকে কিছু পুঁটি মাছ ধরল বঁড়শিতে। বাতাসী মাছের ঝোলে ধনেপাতা দিল। সাধুচরণ খেতে বসে নিবারণ এবং টগরকে ডাকল। ওরা বাপের সঙ্গে খেয়ে এখন বড় বড় ঢেঁকুর তুলছে। আজ রোদ ছিল বলে, বাতাসে আর্দ্রতা কম। বাতাসীর শুকনো কাপড় হাওয়ায় উড়ছে। তারপর যখন রাত হল, রাতের জ্যোৎস্না এই নরম মাটিতে আশ্রয় নিচ্ছে এবং কীটপতঙ্গ গরুর গাড়ির চাকার শব্দ দূরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে তখন সাধুচরণ বলল, বাতাসী তরে একটা কথা কৈতে চাই।

—কও।

—কথাটা কিন্তু তর রাখন লাগব।

—কথাটা আগে কও।

—তুই কাইল থাইক্যা ভিক্ষা করতে যাইস না।

বাতাসী জবাব দিল না।

সাধুচরণ বলল, চুপ কৈরা থাকলি যে বড়!

—চুপ কৈরা থাকমু না ত কি করমু!

—জবাব দ্যা।

—দিমুনে। আইজ জবাব দিলে চলব কি কৈরা।

—ক্যান চলব না ক।

—আগে কাম কৈরা আন।

সুতরাং পরদিন সাধুচরণ গ্রামে কামলা খাটবার জন্য ভোরে ভোরে বের হয়ে গেল। বাতাসীও অন্যান্য দিনের মত নিবারণকে সব বুঝিয়ে টগরের হাত ধরে পরিচিত পথ ধরে এবং পরিচিত পাখিদের ডাক শুনতে শুনতে বাড়ি বাড়ি ঘুরল।

সেইসব খবর, কখনও গান গেয়ে—য্যান বাতাসী উজানী নৌকার মাঝি—সে সওদাগরের মত বাণিজ্য করল।

কাজ থেকে ফিরে সাধুচরণ বলল, তর মায় কৈরে নিবারণ?

—মায় টগরের লৈয়া ভিক্ষা করতে গ্যাছে।

সাধুচরণের ভাল লাগছিল না। সুতরাং সাধুচরণ তিক্ত মুখে বসে থাকল।

নিবারণ বলল, আপনে সান কৈরা আইয়েন। ভাত খাইতে বন।

সাধুচরণের তিক্তমুখ এই অবেলাতে বড় করুণ দেখাচ্ছে। যখন বাতাসী বাণিজ্য করে ফিরল সাধুচরণ কথা বলল না। সাধুচরণ উঠানে বসে অপরিচিত ব্যক্তির মত হুঁকা টানছে।

বাতাসী ফিরে সোজা ঘরে ঢুকে গেল। নিবারণের হাতে ঝোলাঝুলি দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ল। বলল, কিগ মুখ ব্যাজার কৈরা বৈসা আছ ক্যান। দ্যাখ তোমার লাইগ্যা কি আনছি। বাতাসী একটা ছোট কচি শসা সাধুচরণের পায়ের কাছে রাখল। গরম গরম মুরি দিয়া খাইয়া।

নিবারণ হুঁকা টানছিল যেন সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। সে ট্যাঁক থেকে তার রোজগার বের করে দিল।—নে, কাইল আর ভিক্ষা করতে যাইস না। তুই আমার বৌ, আমি গেঞ্জির কলের সাধুচরণ। কথাটা মনে থাকলে ভিক্ষা করতে তর মন চাইব না।

বাতাসী ঠোঁট টিপে হাসল। বলল, তুমি খাইছনি?

—খাইছি। সাধুচরণের গলায় এখনও তিক্ততা আছে সুতরাং বাতাসী পায়ের কাছে গিয়ে বসল। বলল, কার লাইগ্যা করি কও। তোমার লাইগ্যা, তোমার পোলাপানের লাইগ্যা করি। তুমি যদি রাগ কর তবে কোনখানে যাই কও দ্যাখি।

সাধুচরণ বলল, আমি আবার কৈলাম, তুই যাইস না।

বিকেল মরে যাচ্ছে। সাধুচরণ কোথাও আর বের হল না। দুজন অত্যন্ত কাছাকাছি থাকার জন্য, রাতের জ্যোৎস্নার জন্য প্রতীক্ষা করল।

যখন উঠানে জ্যোৎস্না নেমে এল যখন ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে এবং শরীরে যখন আর ঘাম হচ্ছে না তখন সাধুচরণ বলল, কাইল শহরে যামু। যদি গেঞ্জির কলে কাম লইতে পারি।

এবং একদিন যথার্থই গেঞ্জির কলে কাজ নিয়ে সাধুচরণ যখন ফিরে এল সেই অবেলায় সাধুচরণ বলল, তরে ইবারে কৈতাছি—আমার শ্যাষ কথা, তুই আর ভিক্ষা করতে পারবি না। বাতাসী দুঃখে নুয়ে পড়ল। অন্যান্য দিনের মত বাতাসী আজও কোন উত্তর করল না। সে পাশের নালা অতিক্রম করে বড় রাস্তার পারে দাঁড়াল। এইসব বিচিত্র পথ কত এঁকে বেঁকে চলে গেছে। পরিচিত গাছ, পরিচিত পাখ-পাখালী সকলে নিঃসঙ্গ যেন। বাতাসী অনেকক্ষণ টগরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। তার কথকঠাকুরের মত কথামৃত কেউ শুনবে না তার গলায় শ্যামা গান কেউ শুনবে না অথবা সে যখন পাখিদের ডাক শুনতে শুনতে গ্রাম্যপথে হারিয়ে যাবে তখন তাকে দেখলে কেউ বলবে না—বাতাসী দুঃখী। ভিক্ষা বাতাসীর তীর্থের মত। কি ভেবে আজও বড় রাস্তা থেকে বাতাসী উজানী নৌকার মাঝির মত ঘরে ফিরল আর শ্যামা গান গাইল—শ্যামা বসন পর ভূষণ পর। এবং সে তার বাণিজ্য করার ঝোলা ঝুলিগুলোকে রিপু করতে বসল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *