ছয়
রিকশ চলছিল। তিনি যা চাইছিলেন তা ঘটে যাচ্ছে আজ। তিনি দেখতে পেলেন দেবেন মল্লিকই। হ্যাঁ, দেবেন। রাস্তার ধার দিয়ে হাঁটছে। আগের মতোই আছে। সেই রকম মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, চারদিক দেখতে দেখতে, সেই ঔদ্ধত্য নিয়ে যেন চারদিকে কেউ কিছুই নয়, সে নিজেই সব। তিনি ডাকতে যাচ্ছিলেন, থেমে গেলেন। দেবেন সাড়া দেবে তো? চিনতে পারবে? তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ছিল লোকটা। কিন্তু সার্ভিসে একই সময়ের। ডাক দিলেই বলবে, তুমি কি আছ আমার ইউনিয়নের সঙ্গে? না থাকলে তোমার অসুবিধে হবে। তোমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে। সবচেয়ে দূরে বদলি হয়ে যাবে। আর আমার ইউনিয়নের মেম্বার যদি হও, কলকাতায় বলো, বারাসত, আলিপুর যেখানে হয় পোস্টিং পেয়ে যাবে। তিনি আলিপুরদুয়ার, ডুয়ার্স গেলেন ন’পাহাড়ি থেকে। তখন কত কাছে ছিল সুমি। জানতেন না। আলিপুরদুয়ার থেকে একঘণ্টায় গিরিডাঙা শহর কিংবা গঞ্জ। ওদিক তাঁর চেনা, কোচবিহারের রাসমেলা তিনি দেখেছেন। মদনমোহন মন্দির, রাজবাড়ি, রসিকের বিল, আর সেই জল্পেশের মন্দির। সুমিকে বলবেন তিনি, না বলবেন না? পরে ভাবা যাবে। দেবেন কই, দেবেনদা?
তিনি দেখতে পেলেন না আর দেবেনকে, কোন দোকানে ঢুকে ভ্যানিশ। তখন সামনে একটি রিকশ চলে গেল তাঁর রিকশ অতিক্রম করে। অমল সেনগুপ্ত। হ্যাঁ, তিনি। সেই শীর্ণকায় প্রবীণ। পাশে মানসী সেনগুপ্ত। বৃদ্ধ কী সুন্দর ডাকতেন, মানসী শুনছ? মানসী তুমি একটু গান শোনাবে শচীনদেব বর্মণের! কতদূর চলে গেল রিকশ। আহা কৌন হে তেরা মুসাফির জায়েগা কাঁহা? তিনি অন্ধকারের শহর পার হয়ে যেতে লাগলেন ক্রমাগত। আলো নিভে রয়েছে রাস্তার। লাইন গেছে। এমনি হয় না এখন, কিন্তু হয়েছে আজ। রিকশওয়ালা বিড়বিড় করতে থাকে, অন্ধকার হলি গা-গেরামে অসুবিধে নেই, কিন্তু শহরে খুব ঝামেলা।
হোটেলটি ভালো। তখন এত ভালো হোটেল ছিল না এই শহরে। ক্লান্ত বোধ করছিলেন অনুপম। খেয়ালে চলে এসেছেন। ভিতরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে চা আর কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে টেলিভিশন দেখছিলেন। রাত আটটা। তাঁর চোখ জড়িয়ে আসছিল। বাস- জার্নি ক্লান্ত করেছে খুব। রাত নটায় ডিনার আসবে, তিনি কি ঘুমিয়ে নেবেন একটু? বিছানায় টান টান হলেন। ঘুমে তলিয়ে যেতে লাগলেন। তখনই ফোন বাজল। ভবতোষ। স্যার, আপনি কোথায়?
কে জানে কেন, ভবতোষের ফোন না কেটে রিসিভ করলেন তিনি। এই ডাক এখন ঘুম তাড়াবার পক্ষে যথেষ্ট। তিনি বললেন, কেন কী দরকার?
দুপুর থেকে আপনাকে দেখিনি, রাতে রুটি নিতে আসেননি, আমি আপনার ফ্ল্যাট অন্ধকার দেখছি।
অনুপম বললেন, আমি ফ্ল্যাটে নেই।
কোথায় স্যার? ভবতোষ জিজ্ঞেস করে।
কেন, কী দরকার? বিরক্ত হলেন অনুপম।
চাবি আমার কাছে রেখে যেতে পারতেন, আপনি যদি বলেন স্যার আমি নিয়ে আসতে পারি। ভবতোষ বলল, অতবড় ফ্ল্যাট অন্ধকার থাকবে স্যার, আমিই না হয় রাত্তিরে থাকতাম, বাড়ি খালি রাখতে নেই।
দরকার নেই। বলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ভবতোষবাবু আপনারা ক’ভাই?
কেন স্যার?
দরকার আছে, বোন ক’জন?
আমি কি বলিনি আপনাকে? ভবতোষ বলল, সবই বলেছি আপনাকে।
ভুলে গেছি। বললেন অনুপম।
আপনি কবে ফিরবেন স্যার? ভবতোষ প্রসঙ্গ বদলে নিজের কথায় ফিরে আসে।
দেরি আছে। বললেন অনুপম।
কেউ যদি আসে, কী বলব? ভবতোষ জিজ্ঞেস করলেন। চমকে ওঠেন অনুপম, জিজ্ঞেস করেন, কেউ মানে, কে আসবে?
আপনার আত্মীয়-স্বজন।
আমার আত্মীয়-স্বজন কি না বলে আসবে, ফোন তো করবে। অনুপম বললেন।
সারপ্রাইজ দিতে কি কেউ আচমকা চলে আসে না? না, সারপ্রাইজের দিন চলে গেছে। বললেন অনুপম, ফোন করেই আসে, লোকে কোনও রিস্ক নেয় না।
ল্যান্ড লাইনে করলে তো পাবে না স্যার। বলল ভবতোষ।
কেউ এসেছে? কেমন যেন আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন অনুপম। তারপর এই সিদ্ধান্তে এলেন যে ভবতোষ আন্দাজে ঢিল মারছে। যে-ই আসুক ফোন না করে তো আসবে না। শোভনের কাছে তাঁর নম্বর আছে। টুটুল দিয়েছে। কিন্তু ওরা তো সত্যিই ল্যান্ড লাইনে ফোন করে। মোবাইল নম্বর কি জানে না? পেতে কত সময়! ভবতোষ বলল, আপনি না বলে কোথায় গেলেন স্যার?
কাকে বলব?
ভবতোষ বলল, পাড়ায় বলে যাবেন, সিকিউরিটিও জানে না। কিছুই, আমরা কি আপনার কেউ নই স্যার?
অনুপম ঘড়ি দেখলেন, আরও মিনিট কুড়ি আছে ডিনার আসতে। কথা চালিয়েই যাওয়া যায়। কিন্তু ভবতোষের ফোনের বিল উঠছে তো। ফ্রি কল আছে নাকি? আজকাল প্রতিযোগিতায় নেমে কত মোবাইল কোম্পানি কত রকম সুবিধে দিচ্ছে। ভবতোষ বলল, অনেক দূরে গেছেন স্যার, আপনার মায়ের কাছে দাঁড়ের মাঠে?
আপনি তাও জানেন?
ইয়েস স্যার, মা আছেন, ছোটভাই মারা গেছে, বসিরহাটে মেজ ভাই।
লোকের অন্দরমহলের খোঁজ নেওয়া ভালো অভ্যাস নয়, আপনাকে খবর দিল কে?
ভবতোষ বলল, খবর সব পেয়ে যাই স্যার, আপনি কি মেয়ের কাছে সিউড়ি গেছেন, শান্তিনিকেতন?
অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, আর কোথায় যেতে পারি? ভবতোষ জিজ্ঞেস করল, কবে ফিরবেন স্যার? বলতে পারছি না, দেরি হবে। ভবতোষকে হতাশ করে বললেন তিনি।
আমাকে চাবিটা দিয়ে গেলে আমি ফ্ল্যাট দেখতাম স্যার, যখন আমেরিকা যাবেন আমাকে দিয়ে যাবেন স্যার চাবি, মানুষ না থাকলে বাড়ি ঘর নষ্ট হয়ে যায়, স্যার ডিনার হয়েছে?
অনুপম জবাব দিলেন না। সঙ্গে করে ওষুধ নিয়ে গেছেন তো স্যার? ভবতোষ জিজ্ঞেস করল।
কী ওষুধ? অনুপম আর অবাক হবেন না যদি ও সব হুবহু বলে দিতে পারে। হ্যাঁ, জানে সব। প্রেশারের ওষুধ, প্রস্টেটের ওষুধ এবং হার্টের একটি ইকো স্পিরিন জাতীয় ওষুধ, ঘুমের জন্য ট্রাঙ্কুলাইজার। যে ওষুধের দোকান থেকে তিনি ওষুধ নেন, সেখান থেকেই খোঁজ নিয়েছে হয়তো। লোকটাকে কি টুটুল লাগিয়ে দিয়েছে তাঁর পিছনে? খোচড়। টুটুল হয়তো ওকে কিছু মাসোহারার ব্যবস্থা করেছে। তিনি বললেন, রাখছি।
কোথায় আছেন বললেন না স্যার। ভবতোষ জিজ্ঞেস করল। অনুপম ফোন কেটে দিলেন। চুপচাপ শুয়ে থাকলেন। টেলিভিশনের সাউন্ড মিউট করা আছে। বিজ্ঞাপনের প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। স্প্যাগেট্টি পরা এক তরুণী তার মাথাভরা অনেক অনেক চুল ভাসিয়ে দিচ্ছে মস্ত ঘরে। শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন। তিনি চমকে উঠলেন, সুমি। একেবারে সুমি। তিনি উঠে বসলেন। সুমি বলল, এই দেখো আমার চুল, ও বাবলুদা, বাবলুদা।
অনুপম চুপ করে তাকিয়ে আছেন। কেশবতী কন্যার চুল উড়ছে মেঘের মতো। অনাবৃত কাঁধ, বুকের ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। তিনি বিস্ফারিত চোখে বিজ্ঞাপনের মেয়েকে দেখতে দেখতে চোখ বন্ধ করলেন। সুমি এমনি ছিল। তিনি দেখেছিলেন সুমিকে। সুমিই অনাবৃত করেছিল বুক। এমনি না, এর চেয়েও উদ্দীপক। অন্য রকম? চোখ খুললেন। সুমি আছে। সুমি হাসছে। অলিভ অয়েলের বিজ্ঞাপন। মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন, সুমির মুখ। টিভির পর্দা জুড়ে সুমির মুখ। সুমি বলত সে হিরোইন হবেই। আশা পারেখ। আশা পারেখের মতো পুরুষ্টু ঠোঁট ছিল সুমির। তিনি বন্ধ করলেন চোখ। তখন ফোন বাজল। আবার ভবতোষ? লোকটা তাঁকে বিব্রত করেই যাবে। একা হতে দেবে না। কিন্তু না। অচেনা নাম্বার। তিনি ধরবেন, না ধরবেন না করেও ধরলেন। সুমি। সুমির কণ্ঠস্বর যেন আছড়ে পড়ল। বাবলুদা, বাবলুদা…। বাবলুদা আশা পারেখ বেঁচে আছে বাবলুদা? তিনি ফোন কেটে দিলেন। সুইচড অফ। মোবাইল নম্বর কী করে পেল সে? ফোন এসেছিল কি? তিনি কি সুমির কণ্ঠস্বর শুনেছেন? যে হোক, তিনি ফোন বন্ধ রাখবেন। একা মানুষ, ফোনে কী হবে? কিন্তু ভবতোষ তাঁর মেয়েকে বলতে পারে তিনি ফ্ল্যাটে নেই। মেয়ে তখন খোঁজ নিতে আরম্ভ করবে। ফোন বন্ধ রাখলে পুলিসে খবর দেবে। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। রুম সার্ভিস বলা ছিল। কিন্তু তা বাতিল করলেন নিজে নিজে। ডাইনিং রুমে প্রবেশ করতে ওয়েটার চলে এল, এবার যাচ্ছে স্যার, রুমে যাবে তো?
অনুপম বললেন, না, দরকার নেই, এখানেই দেবেন।
ডাইনিং রুমে অন্তত জনা সাত লোক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছে তাঁকে। যেন সকলেই অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য। তিনি আসতে নিশ্চিন্ত হয়েছে। তিনি খালি টেবিলে বসেছেন। অপেক্ষা করছেন। একজন ঢুকল। তাঁর চোখ ডাইনিংয়ের প্রবেশ দ্বারে। লোকটি শীর্ণকায়, মাথাভরা কাঁচাপাকা চুল। চেক হাওয়াই শার্ট আর কটন প্যান্ট। চোখে চশমা। বয়স পঞ্চাশের ওপর হবে। কত ওপরে? তাঁর বয়সের নাকি? হতেও পারে। তিনি দেখলেন লোকটি তাঁর টেবিলের দিকে এগিয়ে এল, বসতে পারি?
তিনি ঘাড় কাত করলেন। চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলেন ফাঁকা ডাইনিং রুম। কত টেবিল ফাঁকা। লোকটি যে কোনও টেবিলেই বসতে পারত। কিন্তু না বসে, তাঁর সামনে। তাঁকে দেখছে। জিজ্ঞেস করল, আর কেউ আসবে?
অনুপমের কী মনে হল, বললেন, কথা ছিল, আসেনি এখনও।
কত নম্বর রুম, ইন্টারকমে ডেকে নিতে পারতেন।
না, এই শহরে আজ আসার কথা, এই হোটেলে।
শীর্ণকায় লোকটি বলল, এখনও আসেননি তিনি?
অনুপম বললেন, এখনও না, তবে আসার সময় যায়নি।
শীর্ণকায় বলল, আমার ঠিক উল্টো, আমি এসেছি, আর তিনিও।
অনুপম হাসলেন, বললেন, উল্টো নয় সোজা, তিনি কে? অনুপম জিজ্ঞেস করতে করতে বুঝতে পারছিলেন, তিনি যেমন বানিয়ে বলছেন, ইনিও।
অনুপম জিজ্ঞেস করলেন, কবে কথা হয়েছিল?
এই তো কদিন আগে, তাঁকে আমি দেখিনি কোনওদিন, কিন্তু শুনলাম তিনি আমার কাছে আসবেন আমাকে দেখতে। শীর্ণকায় জবাব দেয়।
শুনতে শুনতে অনুপমের মনে হয় কথাটা যেন খুব চেনা। কিছু কথা বহু বার বলা হলেও অচেনা হয়েই থাকে। আর কিছু কথা প্রথমেই চেনা মনে হয়। কথার ভিতরে যে কথারা থাকে তারা যেন আত্মীয়-স্বজনের মতোই থেকে যায়। অনুপম বললেন, তাঁকে কী করে চিনবেন?
আমি মনে মনে ভেবে নিয়েছি তিনি কেমন, একটা আদল আছে আমার কাছে, মিলে গেছে।
অনুপমের গা শিরশির করে ওঠে, প্রসঙ্গ বদলাতে চাইলেন, বললেন, অনেক বছর আগে এই শহরটা যেমন ছিল তেমন নেই তো।
না নেই। বলল শীর্ণকায়, অনেক বছর আগে আমিও এমন ছিলাম না, আপনিও না, আপনি আমাকে চিনতেন না, আমিও না, এই কদিন আগেও না, তো শহরে অনেক কিছুই নতুন তো হবেই।
এই হোটেল ছিল না। অনুপম বললেন।
শীর্ণকায় বলল, না ছিল না।
তাহলে এই হোটেলে সে আসবে কী করে?
তাহলে আপনার গল্প ভুল। শীর্ণকায় বলল।
কিন্তু আপনার গল্প? অনুপম জিজ্ঞেস করলেন।
শীর্ণকায় মৃদু হাসে। জবাব দেয় না। অনুপম জানেন, আসলে এমন একটি গল্প আছে। সেই গল্পে বাল্যকালে দুই বালকের তারিখ ঠিক করা ছিল। বিশ বছর পরে তাদের দেখা হবে কোথাও। দেখা হয়েছিল সেই পরিণত বয়সে। বিশ বছর বাদে তাদের একজন খুনী, অন্যজন সন্ত। জীবন এমন-ই।