সতেরো
তপতী উঠে গেছে। তার মানে তপতী জানে। মা গল্প করেছে। আবার এমনও হতে পারে বিশুই বলেছিল মায়ের সইয়ের মেয়ে সুমিত্রার সঙ্গে সেই পনেরো ষোলোর বড়দার গল্প। সাক্ষী ছিল সে। সুমি নিরুপমের বয়সি। তখন চোদ্দো। নিরুপম ছিল না বাগানে। অন্ধকারে বসে মা চাপা গলায় গর্জন করল যেন, বলল, বউমারে খেইছে ও, বউমা সারাজীবন কষ্ট পেয়েছে, সুমি সব্বোনাশী, তুই এখনও বুজিসনি, তুই আমেরিকা চলে যা, আমার কিছু হবে না, নিজে বাঁচ।
বিরক্ত হলেন অনুপম, বললেন, কী যে তুমি বলো, সে আমার খোঁজই রাখত না, যোগাযোগ ছিলই না, নর্থ বেঙ্গলে থাকে।
হিংসেয় বাণ মেরেছে দূর থেকে, ওসব মেয়ে অমনি হয়, আমি সব বুজতাম, তারে সাবধানও করিছিলাম, ওইটুকুনি বয়েস, ওর ভিতরেই পুরুষ চিনেছিল, কিছু কিছু মেয়ে এমনি হয়, দেহ না, কয়লার উনুন, গনগন করে জ্বলতেছে সব সময়।
অনুপম চুপ করে থাকলেন। মায়ের রাগ এখনও পড়েনি। সইয়ের মেয়ে। সইয়ের খুব ভয় হয়েছিল। সই তার কাছে মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। না পাঠালে মেয়ে অতদিনে সিনেমা করতে ঢাকায় চলে যেত মহসিন না কার সঙ্গে। মুসলমান হয়ে যেত। কিন্তু এখানে এসে যা করছে, সামলানো মুশকিল। পাকিস্তানে আবার পাঠিয়ে দিতে না হয়। মা বলল, রাগ পড়বে কেন, ভয় তো দেখতিছি যায়নি, সে কেন তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে?
অনুপমের মনে হল বলে, বুড়ো হয়ে গেছি মা, এখন সে আর কী ক্ষতি করতে পারে, ছেলেটা মানুষ হয়নি, কষ্টে আছে।
মা বলল, তোরে নষ্ট করতি এইছিল।
অনুপম বলতে চাইলেন, থাক মা, আমাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল সে।
মা যেন অনুচ্চারিত কথার জবাব দিল, আছরয় নিয়ে যা করতে গেল, ছিহ! যা আমেরিকা চলে যা, আমার কষ্ট হবে না, বিশু চলে গেল, তুইও যাবি, আমেরিকা থেকে যেন না ফিরিস আর।
অনুপম চেয়ার থেকে উঠে মায়ের পাশে গিয়ে বসেন, দুহাতে জড়িয়ে ধরেন, বলেন, কী যে বলো মা, তোমার বউমার যে অসুখ হয়েছিল, তা ধরা যখন পড়ল, কিছু করার ছিল না, আমি একা তাঁকে নিয়ে ছুটোছুটি করেছি।
মা বলল, সে কি আমি জানিনে, বিশুর যাবার উপায় ছিল না, তারেও তো তখন ভিতরে ভিতরে রোগে ধরিছে, সব ওই সব্বোনাশীর জন্যি।
ছি মা, অন্যের মেয়েকে এখনও দোষ দাও কেন, আমারও কি দোষ ছিল না?
আমি তারে বলেছিলাম এ তুই কী করিস সুমি, ফের পাকিস্তানে পাঠায় দেব। সে বলেছিল, তাই দাও, গিয়ে নাকি করাচি চলে যাবে, সিনেমায় নামবে।
অল্প বয়স ছিল, এখন সে অন্যের ঘরের বউ, বয়স হয়ে গেছে, আমার সঙ্গে আর তো দেখা হয়নি।
মা বলল, আমি তারে বললাম, বাবলু তোর দাদার মতন, তার সঙ্গে কী করিস, সে বলল, কিছুই করিনে, বাবলুদারে আমি ভালোবাসি।
আহ মা, ভিতরে ওরা শুনবে।
আমার সই চিনত নিজির মেয়েরে, তারে কম ভুগয়ছে? মা চাপা গলায় বলল, ফোন ধরবিনে, আমার বউমা কেন অকালে সুখের দিনে চলে গেল তা আমি বুজতি পেরিছি এতদিন পরে।
থাক মা, তোমার কোনও ভয় নেই, সে এখন আর কিছু করতে পারবে না।
পারবে পারবে, শুনিছি যেমন মেয়ে, স্বামীও তেমন পেয়েছিল, মার খেত, তারপর তার স্বামীর কথায় তার উপরওয়ালার ঘরে যেতে হতো, ভুটান বেড়াতে গিয়ে স্বামী তাঁকে উপরওয়ালার কাছে রেখে চলে এসেছিল, এসব জানিস তুই?
এসব কথা তোমাকে বলল কে? অনুপম কষ্ট পেলেন শুনতে শুনতে।
সই চিঠি লিখত, দুঃখের কথা লিখত। মা বলল, তার স্বামী খুব ঘুষ খেত, নিজের বউকে সাহেবের বাংলোয় পাঠাত, তাতে তার খুব উন্নতি হয় চাকরিতে, মেয়ে দুঃখের কথা তার মাকে বলেছিল। মা বলল, যেমন চরিত্র তেমন হয়েছে, হয়তো সে নিজেই যেত উপরওয়ালার কাছে, মিথ্যে করে লিখেছিল সই, তাই-ই হবে, তুই যোগাযোগ রাখবিনে
মা বলল, দেখ বাবলু, খারাপ কথা বাতাস বয়ে আনে, ও সেই উত্তরবঙ্গে থাকুক আর বসিরহাট থাকুক, মুখে মুখে চলে আসে, ছি ছি ছি, এসডিও না কি অফিসার, তার সঙ্গে ভুটান ঘুরতে চলে গেল, ফিরে আবার স্বামীর কাছে, অফিসার নামিয়ে দিয়ে গেল।
সে তো ওর স্বামী রেখে এসেছিল বললে।
ও তো সই লিখেছিল তার মেয়েকে নির্দোষ প্রমাণ করতে, আসল এইটা কিনা জানতে চেয়ে আমি চিঠি দিয়েছিলাম, জবাব পাইনি, সই আর চিঠি দিত না।
অনুপম বললেন, তুমি লিখে ভুল করেছিলে, এমন হয়, লোভী পুরুষ নিজের ওয়াইফকে বসের কাছে পাঠিয়ে দেয়।
তুই সরে আসতি পেরেছিলি, বেঁচি গিইছিস, ওর স্বামী বউয়ের জন্যই রোগে পড়ল আগে মরে গেল, লোকটার কী কষ্টের জীবন!
অনুপম বলল, থাক মা, ভালো লাগছে না।
লাগবে কী করে, ওই মেয়ের পাল্লায় যে পড়েছে, তার জীবন শেষ, অফিসারকে বিয়েই করতে দেয়নি, টাকা নিত তার কাছ থেকে, বাড়ির উপরতলা তার টাকায় করা।
এসব কথা তোমাকে কে বলেছে? অনুপম ক্ষুব্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
এরকম তো ঘটে, বসিরহাটে ঘটেছিল, আমি শুনেছিলাম।
তাই তুমি ভেবে নিলে…।
তৃপ্তি তো তার মেয়ের পক্ষে কথা বলত।
থাক মা, কাল সত্যনারায়ণ হবে, এখন ওসব কথা না বললেই ভালো, কী সুন্দর জ্যোৎস্না, জ্যোৎস্নায় দাগ লাগছে কালো।
মা চুপ করে গেল। অনুপমের মনে পড়ছিল বাবার কথা। বিকেলে ভটচায্যি মশায় পুজো করলেন। সন্ধেয় আকাশ জুড়ে কাঁসার বগি থালার মতো চাঁদ। বাড়িতে সেদিন রাখালবাবুও এসেছেন। বাবা বললেন, আয় সকলে মিলে লুকোচুরি খেলি, জ্যোৎস্নায় সব নেমে যা উঠোনে।
রাখালবাবু বললেন, জীবন, আমি তো লুকুতি পারব না।
বাবা বললেন, আপনি কি বসে থাকবেন?
জীবন, মেয়েডার কথা খুব মনে পড়ে, থাকলিই পারতাম ওপারে, মেয়ে মুসলমান হয়েছে সেই অপমানে চলি আলাম, এখন ভাবি, হয়েছে হয়েছে, সুখেই তো আছে, ভালোবেসে বিয়ে করেছে ওরা, জামাই বলেছিল ও হিন্দুই থাকবে, পুজো-আচ্চা সব করবে, কিন্তু তা কি হয়, কিন্তু না হলিই বা কী, ভালোভাবে বাঁচাটাই তো আসল কথা।
বাবা বললেন, আসুন জ্যোৎস্নায় নামি, এই তোরা যে যার পারিস লুকো, আমি আর মাস্টারমশায় খুঁজে বের করি।
অনুপম ডুবে গিয়েছিলেন নিজের ভিতরে। তখন তাঁর মোবাইল বাজল। শোভন ডাকছে, মামা, তুমি কোথায় আছ?
কী দরকার?
এখন দশটা বাজে, তুমি ফ্ল্যাটে নেই কেন? শোভন রাগত গলায় জিজ্ঞেস করল।
জানিনে কেন? তিনি সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন।
আমি এখন কোথায় যাব? শোভনের গলায় ঝাঁজ।
বাড়ি চলে যাও, রাতে অনেক ট্রেন নর্থ বেঙ্গলের, কতদিন কলকাতায় থাকবে?
কী সব ফালতু কথা বলছ, কলকাতায় আমার অনেক কাজ, তুমি আমাকে না বলে ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে কোথায় বসে আছ? শোভন গরগর করে উঠল।
ফোন কেটে দিলেন অনুপম। শোভন আবার ফোন করল, তুমি এটা ঠিক করছ না, অতবড় ফ্ল্যাট, একা থাকো, আমি একটা ঘরে থাকতে পারব না, আমি হোটেলে যাচ্ছি, কাল সকালে যেন খোলা থাকে ফ্ল্যাট।
তিনি চুপ করে থাকলেন।
আমি টুটুলদাকে হোয়াটস আপ করেছি, মামা তুমি একা থাকবে অতবড় ফ্ল্যাটে, আর আমি রাস্তায় ঘুরব, তা হবে না।
তিনি বললেন, তুমি কেন নিজের শহরে ফিরতে চাও না, কী করে এসেছ?
কে বলেছে এসব কথা, মা?
তিনি বললেন, আমি ব্যস্ত। ফোন কেটে দিলেন আবার।
বিরক্ত অনুপম দেখলেন জ্যোৎস্নায় মেঘের ছায়া পড়ল। বসে থাকলেন চুপচাপ। তখন অদ্রি আর অভ্র, দুই ভাই আর তাদের মা তপতী উঠোনে জ্যোৎস্নার ভিতরে তালপাতার পাটি পেতে বসল, তিনি নেমে এলেন উঠনে। মা বনতরু নেমে এলেন টুরটুর করে, বসলেন নাতি আর ছেলের বিধবা বউয়ের পাশে। অনুপম ঘুরছিলেন উঠোনে, বললেন, আমরা ভাই বোনেরা এখানে বড় হয়েছিলাম, জানো অদ্রি?
অদ্রি বলল, জানি, ঠাকমা সব বলেছে, আমার ভাইয়ের মাথা খুব, ও বড় হবে, দুকান করবে না আমার মতো, কিন্তু কবিতা লিখে কি জীবন চলবে?
দোকান করা খারাপ?
না জ্যাঠাবাবু, কিন্তু জগতের তো কিছুই জানা হয় না, দেখা হয় না, তেল-মশলার হিসেবের বাইরে জগৎ কত বড়!
তপতী বলল, ওর বাবা চলে যাওয়ার পর, এক রাত্তিরেই ও বড় হয়ে গেল, ছেলে আর মেয়েডারে আমি ভালো করে মানুষ করতে চাই দাদা।
মেয়ের বয়স দশ। ক্লাস ফোরে পড়ে। মাকে জড়িয়ে বসে আছে। সারাদিন ড্যাবড্যাবে চোখে দূর থেকে জ্যাঠামশায়কে দেখছে। কথাই বলে না প্রায়। তিনি হাতছানি দিলেন। সে হাসল। এল না। অদ্রি বলল, জেঠাবাবু, আর বছরে, এখেনে খুব গোলমাল হল।
জানি, ফোন করতে চেষ্টা করলাম, বন্ধ ছিল।
অদ্রি বলল, হ্যাঁ, মোবাইল, ইন্টারনেট, সব বন্ধ ছিল।
কিন্তু সে তো হয়েছিল বাদুড়িয়া, বেড়াচাঁপার দিকে।
বসিরহাট বাদ যায়নি। অদ্রিনীল বলল, সে সময় খুব টেনশন গেছে, বসিরহাটে খুব গোলমাল হয়েছিল, বাস বন্ধ ছিল কতদিন।
আবার ফোন করল শোভন, তিনি ফোন তুলেই বললেন, আমি একটা কাজে এসেছি, ফোন করবে না।
গরগর করে উঠেও সামলে নিল শোভন, বলল, তুমি তন্দ্ৰিমা বউদির কাছে চাবি রেখে গেছ?
না, কে বলল? অনুপম অবাক।
আমি তন্দ্রিমার কাছে যাচ্ছি মামা, তুমি কাল সকালেই ফিরে এসো, আমি ওকে বলছি তুমি বলেছ চাবি ওর কাছে, ওদের ফ্ল্যাটে না হয় এক রাত্তির থাকতে দিক।
তুমি হোটেলে যাও, ওখানে কেন তোমাকে থাকতে দেবে?
দেখি দেয় কি না, আমি তো তোমার কথায় যাচ্ছি। শোভন বলল।
কথা হচ্ছিল, কথা চলছিল। তিনি রাগে কাঁপছিলেন। ফোন কেটে দিয়ে তন্দ্রিমাকে ফোন করে সাবধান করলেন। তারপর সিকিউরিটির ছেলেটিকে বললেন, ঢুকতে না দিতে।
সিকিউরিটি বলল, সে ঢুকতে দেয়নি। ভাগ্নে রাস্তায় পায়চারি করছে ভবতোষ আর দুজনকে নিয়ে। ওই দুজন নাকি ভাগ্নের সঙ্গে বর্ধমান থেকেই এসেছে। কথাবার্তার ভিতরে ভাগ্নে তাই বলেছে।
কী হয়েছে? অদ্রি জিজ্ঞেস করল তিনি কথা বন্ধ করতে। তিনি মাথা নাড়লেন, কিছু না। কিন্তু কিছু। তখন শোভন আর ভবতোষ যাচ্ছে বেলগাছিয়া মোড়ের এক হোটেলের দিকে। রিকশয় তারা দুজন। শোভন বলছে, আমার বাবাটা হারামি ছিল, এই বুড়ো আরও হারামি, হারামি আর ক্যারেক্টারলেস, মা সব বলেছে, মা ছোটবেলায় ওদের বাড়ি থেকেছিল, তখন মাকে… মা বলত আর কাঁদত, মাকে নষ্ট করে বিয়ে করেনি, করলে আমি আজ আমেরিকায় থাকতাম।
ভবতোষ বলল, ক্যারেক্টারলেস যে তা সে জানে, একা থাকে কেন, চারতলার বউটা নিশ্চয়ই ওর কাছে আসে, তার স্বামী বাইরে থাকে।
যা বলেছ মাইরি, আমি বাড়াভাতে ছাই দিয়েছি, বুড়ো ঝামেলায় পড়বে।
ভবতোষ বলল, শালা আমাদের থাকার জায়গা নেই, উনি তিনটে ঘর নিয়ে অতবড় ফ্ল্যাটে একা থাকবে।
বুড়ো ঢেঁসে গেলে ওই ফ্ল্যাটের মালপত্তর সব ঝেড়ে দেব, তন্দিমা আর বুড়োর অভিসারে আমি কাঁটা হয়ে গিয়েছি, মা বলল, আমার ডিউটি মামাকে দেখা, ওর ছেলে মেয়েরে বলে দেব তন্দ্রিমার কথা, শালা লাগুক ক্যাঁচাল।
তখন দাঁড়ের মাঠে সেই জ্যোৎস্নাময়ী রাতে অনুপম শুনছিলেন আগের বছরের দাঙ্গার কথা। তার ক’মাস আগে বিশু মারা গেছে। কাল অশৌচ যায়নি, কিন্তু তারা দুই ভাই প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে মিলে গ্রাম পাহারা দিয়েছিল। দিনের বেলা মাইক নিয়ে প্রচার করেছিল। রাতের অন্ধকারে অদ্রির দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল বাইরের লোক। কিন্তু তারা কারা বলতে পারো জ্যাঠাবাবু? গুন্ডার দল এসেছিল জামতলা ঘাট পেরিয়ে। তারা বাংলা বোঝে না, বাংলায় কথা বলে না। একজনকে ধরে ফেলেছিল তারা। তার নাম শ্যামলাল আহির। বিহারের লোক। তাকে পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছিল। দোকানের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। বোঝো জ্যাঠাবাবু, কেমন রায়েট, আগুন লাগিয়ে দিয়ে বলত মুসলমানে করেছে। আবার মুসলমানের দোকানে আগুন মুসলমানে দিয়ে বলত হিন্দু করেছে। সে একটা দিন গেছে দু-পক্ষকে ঠেকাতে হয়েছিল জ্যাঠাবাবু। তিনি অবাক হয়ে শুনতে লাগলেন। কী সুন্দর করে বলছে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র অদ্রিনীল সেন। তাতে যোগ দিচ্ছে তপতী, অভ্র আর মা বনতরু। তিনি উঠোন থেকে তাকিয়ে দেখলেন কারা যেন বারান্দায় বসে আছেন। তিনি স্পষ্ট দেখলেন বাবা জীবন সেন আর মাস্টার দাদু রাখাল ভট্টাচার্য। তিনি চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, এমন সুন্দর চাঁদের আলো, আমি আমার ছোটবেলায় রেখে গিয়েছিলাম এখানে, ফিরে পেয়েছি।
মা বনতরু বললেন, বাবলু তুই কি সত্যনারায়ণের পর চলে যাবি?
কী করব বুঝতে পারছি না, অনুপম-বাবলু বলল, আয় অদ্রি, সকলকে নিয়ে লুকোচুরি খেলি।
অদ্রিনীল উঠে দাঁড়াল। অভ্রনীল, তপতী, বনতরু, রিমঝিম। উঠোনের নিমগাছটির আড়াল থেকে তখন একজন বেরিয়ে এল যে তা স্পষ্ট দেখতে পেলেন অনুপম। কে? বিশু। বিশ্বনাথ। কে নেমে এল বারান্দা থেকে? রাখালবাবু। তাঁর সঙ্গে কে? জীবন সেন। এখানে সেই মেয়েটা, সুমিত্রা নেই। জ্যোৎস্না রাতে সে চুল খুলে দাঁড়িয়েছিল বাড়ির পিছনের আমবাগানে। বিশু তাঁকে ডাকল, দাদা।
তিনি বললেন, তোরা লুকিয়ে পড়, আমি খুঁজে বের করি।
অদ্রিনীল বলল, জ্যাঠা আমার ভাই যেন বড় হয়।
হবে হবে।
বিশু বলল, দাদা আমি তোমার কাছে রেখে গেছি এদের, তুমি দেখো।
অভ্রনীল বলল, আমি কবিতা ভালোবাসি, কবিতার জন্য জন্মেছি মনে হয় জ্যাঠাবাবু, মনে হওয়াটা কি ভুল?
না, না, কাল আমি তোকে নিয়ে পানিতর যাব, বিভূতিভূষণের বাড়ি।
ওদিকে একটা বিল আছে, কত পাখি সেখানে। অভ্রনীল বলল।
তোরা সব লুকো, এমন চাঁদের আলো, আমি তোদের খুঁজে বের করব…। তিনি দেখলেন নিম গাছের আড়ালে চলে গেল বিশু। বাবা আর রাখালবাবু কথা বলতে বলতে বাগানের দিকে চলে যাচ্ছেন। তপতী তার মেয়ের হাত ধরে ভিটের কোণের আমগাছটির আড়ালে গিয়ে হারিয়ে গেল। একে একে অদ্রি, বনতরু, অভ্র। উঠোন ফাঁকা হয়ে গেল। তখন হাওয়া উঠল। হু হু করা বাতাস উড়ে এল কোন সুদূর থেকে। সেই টুটুলের ব্লু রিজ মাউন্টেনের হাই উইন্ড এলাকা, বাতাসবাড়ি থেকে। জ্যোৎস্না ঢেউ হয়ে বয়ে যেতে লাগল। এখন ওদের খুঁজে বের করতে হবে এই চাঁদের আলোর ভিতরে। বাবা এই জ্যোৎস্না দিয়ে গেছেন। বাবা পেয়েছিলেন ঠাকুরদার কাছ থেকে। এই চাঁদের আলো আর এই সংসার সব নির্মাণ করেছিলেন তাঁরা। তিনি ঘুরতে ঘুরতে সংসারটিকে খুঁজতে খুঁজতে ঠিক করে নিতে লাগলেন কী করবেন। ফিরে যাবেন না থেকে যাবেন এই দাঁড়ের মাঠে?
থেকেই যাবেন। থেকে গেলেন। চতুর্দশী, পৌর্ণমাসী গেল। কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদ গেল। দ্বিতীয়ায় চাঁদ উঠল দুই প্রহর বাদে। সেই জ্যোৎস্না সেই বাতাস। আবার লুকোচুরি খেলা শুরু হল। এই তো বাবার রেখে যাওয়া ঘরবাড়ি জ্যোৎস্নাবাড়ি বাতাসবাড়ি, আনন্দবাড়ি। অভ্রনীল, অদ্রিনীল, রিমঝিম, তপতী, মা বনতরু সকলে জ্যোৎস্নার ভিতরে লুকিয়ে গেল। অনুপম একা। ঠিক তখনই সেই নির্মল বাতাস আর জ্যোৎস্নার ভিতরে কুয়াশা আর মেঘের মতো নেমে এল কে? মস্ত এক ছায়া। অন্ধকার। বড় বড় পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল সে। কিংকং আসছে, গডজিলা আসছে। দানব আসছে। সে খ্যানখ্যানে গলায় বলল সে, মামা এসে গেছি, বহুত চালাক ভাব নিজেকে, ভেবেছ আমি একটা গাধা, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব আর তুমি মস্তি মারবে চাঁদের আলোয়, এখন কী করবে, পেটে চাকু ঢুকে যাবে, সব তো লুকিয়ে গেছে জোছনার ভিতরে, শালা ফ্ল্যাটের চাবিটা দিয়ে তুমি এখানে থেকে যাও, আমি আমার মা-কি আউলাদ, তোমার উপর আমার রাইট আছে, চাবি না নিয়ে যাবই না, শালা এর নাম ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর, আসা কম ঝক্কি, মা ডিরেকশন দিল তো আসতে পারলাম।
অনুপম বুঝলেন তাঁর পরিত্রাণ নেই। তিনি ডেকে উঠলেন, আয় তো আমার অদ্রিনীল অভ্রনীল, রিমঝিম, আয়রে আমার লালকমল নীলকমল। আমি তোদের খুঁজে পাচ্ছি না, এই দেখে যা কে এসেছে আবার, সেই আগের বছর যেমন এসেছিল ঘর পুড়াতে অন্ধকারে।
অন্ধকার ফেটে জ্যোৎস্না ফুটে উঠতে লাগল আবার। বাতাসবাড়ির জ্যোৎস্নায় ঢেউ উঠল, ঢেউ।
সমাপ্ত