এক
সকালে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পশ্চিম মুখেই হাঁটি। রাঢ় দেশের বড় বড় মাঠের ওপর দিয়ে। রাঙা বালি, দিগন্তে তালবনের সারি। হয়তো মাঠের মাঝে প্রাচীন কালের প্রকাণ্ড দিঘি, তালবনে ঘেরা কি ফাঁকা জায়গা এ-সব! মনে হতো যেন সীমাহারা দিক সমুদ্রে ভেলা ভাসিয়ে চলেছি, কোন অজ্ঞাত দিগন্তের বননীল উপকূলে গিয়ে ভিড়ব…’
বিভূতিভূষণের দৃষ্টিপ্রদীপ পড়তে পড়তে অনুপম ফোন পেলেন। বেজে বেজে থেমে গেল। অনেক পরে দেখলেন, তাঁর পুত্র টুটুলের কলকাতার কলিগ আভাসের ফোন। আগডুম বাগডুম বকে। কেমন আছেন তিনি, শরীর কেমন, প্রেশার কত, সুগার… এই সব ফালতু খোঁজ নেয়। তিনি বইটি রাখলেন। কতবার পড়া, তবু ঘুরে ফিরে এক এক অংশ পড়েন। টুটুল সারা কলকাতায় যেন ওয়াচ ম্যান রেখে দিয়েছে, বিরক্ত লাগে। এক একদিন এই আভাস বলে, সে অমুক দিন আসবে। তিনি বলেন, সেদিন তিনি থাকবেন না।
টুটুল যে বছর জন্মায় সে বছর খুব বৃষ্টি। পাঁচদিন ধরে অবিশ্রান্ত। টুটুল–সূর্যনীল এখন চৌত্রিশ। তাঁদের প্রথম সন্তান। জন্মেছিল মে মাসে। বৃষ্টিও সেই মে মাসে। মেঘ ভেঙে পড়েছিল আচমকা। তখন তাঁরা থাকেন মেদিনীপুর শহরে। মিশন কম্পাউন্ডে। অমল সেনগুপ্তর বাড়ি। বৃদ্ধ বৃদ্ধা থাকতেন দোতলায়, তাঁরা একতলায়। অমল সেনগুপ্ত এবং ইতি সেনগুপ্তর দুটি সন্তান। দু’জনেই বাইরে। দিল্লি এবং মালদা। খুব কম আসে। অমল পেনশনভোগী। তাঁর স্ত্রীও তাই। গান শুনতে ভালোবাসতেন। রেকর্ড ছিল অনেক। অনুপমের মনে পড়ে সব। সে আর কুন্তলা উপরে উঠে যেত গান শুনতে। লং প্লেয়িং রেকর্ডে হেমন্ত, শচীন দেববর্মণ, লতা, সন্ধ্যা, বেগম আখতার, জোছনা করেছে আড়ি…। তখন টেপ রেকর্ডার আসছে সবে। ক্যাসেট ধীরে ধীরে সরিয়ে দিচ্ছে ৭৮, ৪৫ এবং ৩৩ আরপিএম রেকর্ড। কিন্তু তাঁরা রেকর্ড ছাড়া কিছু বুঝতেন না। তাঁদের গ্রামোফোন ছিল হল্যান্ডের ফিলিপস কোম্পানির। সোনালি চোঙা লাগানো। মনে পড়ে অনুপমের। তাঁদের গান শুনতে ডাকতেন অমল আর ইতি। বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা, দূর নীলিমায় ওঠে চাঁদ বাঁকা… চমৎকার সাজানো বাড়ি। গেটে দুটি দেবদারু গাছ। জানালা দিয়ে চাঁদ দেখা যেত। পূর্ণিমায় অতি বৃহৎ সোনার থালা। একচিলতে ফুলের বাগান। বাড়ির পেছন দিকে পেয়ারা আর আতা। হাসপাতালে টুটুল হয়েছিল। অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ভিতর। সেনগুপ্ত মশায় বলেছিলেন, ছেলের নাম রাখো বর্ষণ।
বর্ষণ! ভারী সুন্দর নাম। অমল সেনগুপ্ত যৌবনে কবিতা লিখতেন। কিন্তু কুন্তলা সেই নাম রাখেনি। বর্ষণ কেন হবে? মানে শুধু কাঁদবে। কিংবা কাঁদাবে। না, অবিরাম বৃষ্টিপাতের স্মৃতি ওর নামে থাকবে না। সেই টুটুল এখন বিদেশে। কুন্তলা চলে গেছে। অনুপম এখন একা। অনুপম কাজরী শোনেন এক একদিন ইউটিউবে। গিরিজা দেবী আর রবি কিচলু, বর্ষণ লাগি বাদরিয়া রুমঝুমকে …। টুটুলের পর অনুপমের এক মেয়ে। সে হয়েছিল বছর তিন বাদে। তখন ছিল শীত। টুটুলের নাম সূর্য। বুবুলের নাম বিদিশা। বিদিশা এক প্রাচীন নগরের নাম। অনুপম এখন তাঁর ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে। মর্নিংওয়াক সেরে ফিরেছেন। মর্নিংওয়াক করে, বাজার সেরে, দুধ নিয়ে ফিরতে তাঁর আটটা হয়ে যায়। বের হয় সাড়ে পাঁচটায়। ওঠে পাঁচটায়। সকাল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা, এই আধ ঘণ্টা খুব দ্রুততায় সব কাজ করে অনুপম। ঘুম ভাঙার পর ৩০-৩৫ মিনিট খুব তাড়াতাড়ি সব করতে হয়। মনে হয় এখনই ছটা বেজে যাবে। ছটা বেজে গেলে তাঁর সমস্ত পরিকল্পনা নষ্ট হয়ে যাবে। সমস্ত দিন যায় বিলম্বিত লয়ে, ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে, কিন্তু ওই তিরিশ পঁয়তিরিশ মিনিট যেন এই এতটা জীবনের মতো। কী করে যে সব হয়ে গেল। কাজ শেষ। এখন অপেক্ষা। জীবন আরম্ভ কবে হল, কোন ফাঁকে জীবন এতটা বয়ে গেল, ধরাই গেল না। তিরিশ থেকে পঁয়তিরিশ মিনিট। ব্রাশ করতে করতে চা বসান। ব্রাশ শেষ করে লিকার চা আর দুটি বিস্কুট। তার আগে এক গ্লাস জল। সেই জলে সারারাত একটি তুলসীপাতা ভেজে। এই অভ্যাসটি বাবার কাছ থেকে পাওয়া। চা শেষ করে টয়লেট শেষ করে বেরিয়ে পড়া। হাতে থলেটি থাকে। থাকে থাকুক। থাকলে কী হয়েছে। বাজার করে ফিরবে। সকাল সাড়ে পাঁচটায় জুনের আরম্ভে রোদ উঠে যায়। পৌনে ছটায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় অনীশের। অনীশ রায়। সে আসে বেলগাছিয়ার দিক থেকে। তাঁর কলিগ ছিল। এখন সকালের সঙ্গী। অনীশের পর সসীম পাল। রুনা, জয়দেববাবু, প্রাক্তন এমএলএ জিতেন তেওয়ারি, হরিশ মুখুটি… পরপর দেখা হতেই থাকে। এইটুকুই মেলামেশা। তারপর তো একা। অনুপম জানেন, ওই পঁয়তিরিশ মিনিট এদিক-ওদিক হলে, যার সঙ্গে যেখানে দেখা হওয়ার কথা, তা হবে না। হয়তো চিনিকে নিয়ে হাঁটা দেবে টেকো লোকটা। রতন শেঠ। বলে জগৎ শেঠের বংশধর। বলে বুক চিতোয়। বার্নপুর ইস্পাত কারখানায় কাজ করত। অবসরের পর এদিকে ফ্ল্যাট কিনে এসেছে। লোকটার নজর পড়েছে চিনির দিকে। সসীমের স্ত্রীকে কী বলেছে তার নামে, সসীম লোকটার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। চিনিকে নিয়েই হয়তো। চিনি একা থাকে। বাবার পেনশন পায়। জমানো টাকাও আছে। বছর তেত্রিশ-চৌত্রিশ। গুরু নামে সকল মুক্তি, আধ্যাত্মিকতা নিয়েই তার গুনগুন। অদ্ভুত মেয়ে। বাবা, মা, দিদির মৃত্যু দেখেছে চোখের সামনে, কিন্তু ভেঙে পড়েনি। মুখভরা হাসি। সারাদিন যে লোকটা একা থাকে তার কাছে সকালের এই সময়টুকু খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি সকালের রুটিন ব্যাহত হয়, খুব মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় বাকি জীবনই বদল হয়ে যাবে। সমস্ত রুটিন ভেঙে যাবে। দিনটা ভালো যাবেই না। অনুপম তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ শুনেছিলেন এমনি একটা দিনেই বোধ হয়। বসিরহাট হাসপাতাল, সেখান থেকে কলকাতা। তারপর মৃত্যু। তাঁর ঘুম ভেঙেছিল সেদিন অনেক দেরিতে।
দরজা খোলা ছিল। টপ ফ্লোরের অবিন এসে ঢুকল, আমি তাহলে যাচ্ছি আঙ্কেল।
এসো। তিনি এগিয়ে গেলেন, কবে ফিরবে?
দিন পনেরো বাদে। অবিন বলল।
তুমি তো পুরুলিয়ায় নিয়েই যেতে পারো ওদের।
পারি, কিন্তু ছেলের পড়া, আর এমন ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে, এত কম ভাড়ায় পাব এমনি?
অবিন ভাড়ায় আছে। ওর ফ্ল্যাটের মালিক থাকে অসলো, নরওয়েতে। যুক্তি অসত্য নয়, কিন্তু এইভাবে পরিবার ছেড়ে বাইরে থাকাও তো বিড়ম্বনা। এই সাততলা আবাসনে একুশটি ফ্ল্যাট। নীচে গাড়ি রাখার জায়গা। সিকিউরিটি আছে দুজন। পালা করে ডিউটি দেয়। তাদের টাকা দেয় মালিকরা। উনিশটি ফ্ল্যাটে তালা। সিকিউরিটিদের দায়িত্ব সব ফ্ল্যাট পরিদর্শন করে ঠিকঠাক রাখা। আসলে অবিন যদি চলে যায়, অনুপমের খুব খারাপ লাগবে না। এই নিঃঝুম আবাসনে তিনি একা থাকেন, এই বোধই যথেষ্ট।
অবিন আর কথা বাড়ায় না। হয় সে এই আলোচনা করতে চাইছে না, না হয় তার হাতে সময় নেই। কাঁধে ব্যাগ। ট্রেন ধরবে হাওড়া থেকে। এখন কি এইসব আলোচনা করা যায়? অবিন বেশ আছে। মা, ছেলে নিয়ে ওর বউ এই নিঃঝুম আবাসনে থাকে। নিঃঝুম কেন, না অনেক ফ্ল্যাটেই আবাসিকরা নেই। কিনে রেখেছে ফ্ল্যাট। ইনভেস্টমেন্ট। মাঝেমধ্যে এসে দেখে যায়। ভাড়া দিয়েছিল একজন তার ফ্ল্যাট। সব আইটি-র ছাত্র। খুব হল্লা করত রাত্তিরে। তখন অবিনের বাবা বেঁচে। তাদের তুলে দেওয়া হল। তারপরে আর কেউ অমন ভাড়া দেয়নি। আর অনেকেই বিদেশে থাকে। দু’বছরে একবার আসে। অনুপমের ফ্ল্যাট তিনতলায়। ব্যালকনি থেকে অনেকটা দূর দেখা যায়, কারণ রাস্তার ওপারে একটি প্রায় জীর্ণ হয়ে আসা দোতলা বাড়ি। এক বৃদ্ধা থাকেন। তাঁর পুত্র দিল্লিতে। তিনি বসে থাকেন ব্যালকনিতে প্রায় সমস্ত দিন। সঙ্গে একটি মধ্যবয়সিনী থাকে। তাকে রেখে গেছে পুত্র। অনুপমের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। অনুপম এড়িয়েই চলেন। পরিচয় হলে তার উপর দায়িত্ব দিয়ে যাবে দিল্লিবাসী। ভয় আছে।
রান্নার মহিলা এলেন। আনুর মা। আনুর মা খুব তাড়াতাড়ি রান্না করে। অতিরিক্ত হল সপ্তাহে দুদিন আসেন জামাকাপড় ওয়াশিং মেশিনে ধুতে। এরপর আসবে রুকসানা। ঘর পরিষ্কার, বাসন ধোয়াধুয়ি করে চলে যায়। বিকেলে আবার আসে বাসন ধুতে। রাতের রুটি কিনে আনেন অনুপম। বেশ আছেন।
সিউড়ি থেকে মেয়ে বিদিশার ফোন এল, বাবা, কী করছ?
কিছু না তো। অনুপমের মগ্নতা ভেঙে গেল।
একা বসে আছ?
হ্যাঁ, আর কে থাকবে? বিরক্ত হলেন অনুপম, তার মগ্নতা ভেঙে দিল। আসলে তার সন্দেহ আছে। ক’দিন একটি কম বয়সি মেয়ে কাজ করছিল। খুব চটপটে। বুবুল এসেছিল তখন। তাকে ছাড়িয়ে দিল। সেই মেয়েটি ফ্ল্যাট ঝকঝকে করে দিয়ে যেত। তাঁকে পিসেমশায় বলত। মাসখানেকের জন্য বুবুল এসে তার সঙ্গে খিটিমিটি লাগাল। ছাড়িয়েই দিল। মেয়েটা নিঃশব্দে কাজ করত। দুঃখী ছিল। দুই সন্তান নিয়ে অনাথ। স্বামী আর একটা বিয়ে করেছে। তার জায়গায় রুকসানা মাসি এসে কাজ করছে। বুবুল–বিদিশা কেন এত সন্দেহপ্রবণ হল? তাদের সিউড়িতে এক ভদ্রলোক একা থাকতেন। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কাজের মেয়ে তার একটি বাচ্চা নিয়ে সেই ভদ্রলোকের বাড়িতে উঠে এসেছে। তিনি তাকে নিয়ে আবার সংসার পেতেছেন। জীবন নতুন করে আরম্ভ করেছেন। শোনার পর থেকে বাবাকে লক্ষ রাখে বুবুল। ইউএস থেকে টুটুলের নির্দেশ পেয়েছে হয়তো। টুটুল তাকে ডাকছে। কতবার ডাকছে। বাবা আমার কাছে ছ’মাস থেকে যাও, একা কী করো? অনুপম না করেই যাচ্ছেন। বন্দি হতে যাবেন না। সে দেশে সোম থেকে শুক্র কাজ, শনি রবি ছুটি। ওদের মেয়েকে ক্রেসে রেখে স্বামী-স্ত্রী চাকরিতে যায়। তিনি গিয়ে আটকা থাকতে চান না। পাঁচ দিন সারাদিন একা।
বাবা, ভাবছি, তিন্নির সামার ভ্যাকেশনে তোমাকে এনে রাখব আমার এখানে।
তিন্নি তাঁর দৌহিত্রী। তিন্নির কাছে যেতে ভালোই লাগে। কিন্তু ক’দিন? দিন চারেকের পরই মন যাই যাই করতে থাকে। এই তিনটি শূন্য ঘর, লিভিং স্পেস, শূন্য দোলনা, ইজি চেয়ার, নিঝুম আবাসন, ব্যালকনি, ওপারের বৃদ্ধা, সকালের মানুষগুলি… সব তাকে টানতে থাকে। ক্ষুধিত পাষাণের সেই তুলোর কারবারির মতো। এই আবাসনের বয়স কত হবে? বছর পনেরো। যখন টুটুল চাকরি পেল বি-টেক পাশের পরপর, তার বছর দুইয়ের ভিতর এই ফ্ল্যাট কেনা। তার আগে জেলায় জেলায় ঘুরে কেটেছে। ইংল্যান্ডে থাকতেন এর মালিক। টুটুল বোধ হয় এই দেশে অন্যত্র আর একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। দিল্লি কিংবা মুম্বইয়ে। তিনি ঠিক জানেন না। কৌতূহল নেই। আর ওই দেশে তার নিজস্ব বাংলো। শোনা কথা। সে কুন্তলার অসুখে আসেনি। আসতে পারেনি। কুন্তলা সময়ও দেয়নি। জীবনের আরম্ভে, সেই মিশন কম্পাউন্ডে অমল সেনগুপ্তর বাড়িতে থাকার বছর আট খুব ভালো কেটেছিল, তারপর থেকে সে কম কষ্ট করেনি ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে। বসিরহাট বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে দাঁড়ের মাঠ তাঁদের গ্রাম। সেখান থেকে ওপারে তাঁদের গ্রাম মাইল কুড়ি দূরে। সাতক্ষীরে শহরের মাইল আটেক দূরে বড় গাঙদিয়া। দাঁড়ের মাঠে এখনও ছোট ভাইয়ের পরিবার থাকে। সে নেই। আর তাঁর মা আছেন। মা নব্বই হবেন। মেজভাই বসিরহাট শহরে বাড়ি করেছে নিজের অংশ বিক্রি করে। মাইনের টাকার একটা অংশ বাবা- মাকে পাঠাতে হতো। ছেলে-মেয়ের জন্য ত্যাগ করতে হয়েছিল অনেক ভালো মন্দ। তাদের ভালো ইস্কুলে পড়ানো, টিউশন …, উত্তরবঙ্গে বদলি, আলিপুরদুয়ারে কত কষ্ট করে থাকা, সব মেনে নিয়েছিল কুন্তলা সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে। ওদিকে দাঁড়ের মাঠ গ্রামে বাবা, মা, দুই ভাই– সকলে তার দিকে চেয়ে থাকত। কুন্তলা খুব হতাশ হয়েছিল টুটুলের বিদেশ যাত্রায়। ওর বউ সুমনাও কৃতী ছাত্রী। দুজনের কত আয়! তখন অনুপমের সারা বছর যা আয়, ওদের এক মাসের আয় তাই। কিন্তু গেল। কুন্তলার অসুখের চিহ্ন তখন ফুটতে শুরু করেছে। সমস্ত জীবন যে ক্ষয় হয়েছিল গোপনে, তা দেখা দিল টুটুলের বিদেশ যাত্রার পর। ভোগই করতে পারেনি সুখের জীবন, জীবনের সামান্য সুখ, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য। সারাজীবন তো অন্যের বাড়িতে ভাড়াটে হয়েই কেটেছে তার। এই ফ্ল্যাট কেনা হয়েছিল তারই কথায়। টুটুল যোগাযোগ করছিল ইংল্যান্ড নিবাসী মালিকের সঙ্গে।
মেয়ে ডাকছে–বাবা, বাবা, কথা বলছ না কেন?
অনুপম বললেন, আমি ওই সময় মেদিনীপুর যাব।
মেদিনীপুর কেন?
শালবনি, ঠিক মেদিনীপুর না।
শালবনি, ওখানে তো খুব গরম এই সময়।
সে তো সিউড়িতেও। তিনি বললেন।
শালবনিতে কী করতে? বিদিশা জিজ্ঞেস করে। আমার এক বন্ধু অনেক দিন ধরে যেতে বলছে, যাই ঘুরে আসি।
বিদিশা জিজ্ঞেস করে, কে বন্ধু, কী নাম?
অনুপম বললেন, নাম শুনে তোর কী হবে, তুই কি চিনিস?
চিনতেও তো পারি। বিদিশা যেন জেরা করতে থাকে।
না, বিজন সিংহ কে তুই চিনবি কী করে? অনুপম বললেন। বিজন সিংহ কেউ নয়। নামটা এক কল্পিত খুনির। একটা রহস্য উপন্যাসে আছে। গতকালই পড়ছিলেন। বিদিশা বলল, পরে যেও, আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে যেও, তিন্নি শুধু বলে দাদাই কবে আসবে।
যাব, বিজনের বাড়ি ঘুরে আসি, অসুস্থ হয়েছে, ওর ছেলে ফোন করেছিল, বিজন খুব ভালো মানুষ, আমাকে অনেক হেল্প করেছিল মেদিনীপুরে থাকার সময়, সেই যে লম্বামতো, মাথা ভর্তি চুল, খুব রোগা। অনুপম বলতে লাগলেন বইয়ে পড়া বিজন সিংহর বিবরণ। কিন্তু সে একটা খুনি। খুব পরিকল্পনা করে খুনটি করেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাতে পারল না। অথচ বিজন বেশ লেখাপড়া করা মানুষ। সকলে তাকে সমীহের চোখে দেখে। খুনটা করেছিল সে ঠান্ডা মাথায়। পড়তে পড়তে অনুপমের পছন্দ হয়নি। এমন একটা মানুষ কেন খুনি হবে? অনুপম তাই বিজন সিংহকে ভালো মানুষ বললেন। বিজনের খুন কিন্তু বাঁচিয়ে দিয়েছিল অন্য একজনকে।
বিদিশা বলল, বাবা, আগে তো এঁর নাম শুনিনি।
শুনেছিস, তোর মনে নেই।
শচীন আঙ্কেল, রতন আঙ্কেল, অতনুপ্রজ্ঞান রায়, কিন্তু বিজন সিংহ তো শুনিনি বাবা। বিদিশা বলল, তোমাকে শালবনি যেতে হবে না, তুমি সিউড়ি এসো, আমরা শান্তিনিকেতনে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি, তুমি এলে ক’দিন শান্তিনিকেতন যাব।
শালবনি থেকে ফিরে এসে যাব। বললেন অনুপম। কথাটা শেষ করে দিতে চাইলেন।
তখন ওর সামার ভ্যাকেশন শেষ হয়ে যাবে। বিদিশা বলল, ভ্যাকেশনের পরই এক্সাম।
এক্সামের পরই যাব। অনুপম বললেন। কথা থামিয়ে দিলেন, এত চাপ দিস কেন?