বাণেশ্বরের রোগমুক্তি
বাণেশ্বর সরকার একসময়ে খুব সিগারেট খেতেন। প্রতিদিন প্রায় তিরিশ-চল্লিশটা। একবার তার খুব গলা ফুলে যায়, ডাক্তারকে দেখান। ডাক্তারবাবু বলেন, আপনাকে সিগারেট খাওয়া ছাড়তে হবে। আপনার গলার মধ্যে চাকা চাকা, লাল হলুদ দাগ দেখা যাচ্ছে। সিগারেট খাওয়া বন্ধ করলে এগুলো মিলিয়ে যাওয়ার আশা আছে। আর সিগারেট খাওয়া যদি না ছাড়তে পারি বাণেশ্বরের এই সংলগ্ন প্রশ্নে নির্বিকার কণ্ঠে ডাক্তারবাবু মোক্ষম জবাব দিয়েছিলেন, ক্যান্সার হয়ে মারা পড়বেন।
এ ধরনের মর্মান্তিক কথা ডাক্তারবাবুরা সাধারণত বলেন না। বাণেশ্বরের দুর্বল চরিত্র সম্বন্ধে সবিশেষ জ্ঞান থাকায় ডাক্তারবাবু তাকে ভয় দেখিয়েছিলেন।
ভয়ে কিন্তু কাজও হয়েছে। বাণেশ্বর সিগারেট খাওয়া কমিয়েছেন, যদিও কেনা কমাননি। এখনও দৈনিক কুড়িটা সিগারেটের প্যাকেট দুটো কেনেন। খুব বেশি বিলি বিতরণ করেন তা নয়। তবে কোনও সিগারেটই ধরানোর পর একবারের বেশি দুবার টান দেন না। একটান দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে এক মুখ ধোয়া ছেড়ে মেঝেতে বা রাস্তায় যখন যা পায়ের নীচে থাকে সেখানে ফেলে দেন সিগারেটের টুকরোটা, তারপর নির্মমভাবে পায়ের জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দেন জ্বলন্ত সিগারেটটি।
এইভাবে যাচ্ছিল। সারাদিনে চল্লিশটা সিগারেটে চল্লিশ টান, মোটমাট দুটো পুরো সিগারেটের সমান। বাণেশ্বরের গলা আর তাকে ভোগাচ্ছে না। কিন্তু সিগারেট খাওয়া দুম করে ছেড়ে দেওয়ার জন্যেই হোক অথবা অন্য কোনও কারণেই হোক, গলা সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাণেশ্বর সরকারের কেমন যেন মাথার গোলমাল দেখা দিল।
প্রথম গোলমাল দেখা দিল তার জুতো নিয়ে। দৈনিক চল্লিশটি জ্বলন্ত সিগারেট হজম করতে গিয়ে তার জুতোর নাকি ক্যান্সার হয়েছে–এই রকম একটা সমস্যা দেখা দিল বাণেশ্বরের। একজন নামজাদা ডাক্তারকে তিনি যোগাযোগ করে দেখা করতেও গেলেন। এমনিতে তার কথাবার্তা শুনে কিছু বোঝা যায় না, ফলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট অনুযায়ী বাণেশ্বরের যথাসময়ে ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছাতে বিশেষ কোনও অসুবিধে হল না। কিন্তু জুতো পরীক্ষা করতে, জুতো দেখতে ডাক্তারবাবুর রাজি হওয়া অসম্ভব।
বাণেশ্বরবাবুর যে মতিবিভ্রম হয়েছে একথা বুঝতে ডাক্তারবাবুর কোনও কষ্টই হল না। বহু রোগীই বহু কাল্পনিক অসুখ নিয়ে আসে ডাক্তারখানায়। কিন্তু ডান পায়ের থেকে জুতো খুলে টেবিলের উপরে উলটো করে রেখে বাণেশ্বর যখন অগ্নিদগ্ধ, ক্ষতবিক্ষত রবারের সোলটায় অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখালেন, অতিরিক্ত সিগারেট খেয়ে এ জুতোটার কর্কট রোগ হয়েছে। অথচ বাঁ পায়ের জুতোটা, বাণেশ্বরবাবু এবার সেটাও পা থেকে টেবিলের উপরে রাখলেন, এটার কিচ্ছু হয়নি, এটা তো সিগারেট খায় না ততক্ষণে বিহ্বল ও হতভম্ব ডাক্তারবাবু তার নিজের চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে পড়েছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে বাণেশ্বরের তীব্র প্রতিবাদ এবং উচ্চ ভিজিট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ডাক্তারবাবুর দুজন সহকারী, তারা সবল ও বয়েসে তরুণ, বাণেশ্বরবাবুকে চ্যাংদোলা করে ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে বার করে দিল। তখনও বাণেশ্বরবাবুর দু হাতে ধরা রয়েছে একটি ক্যান্সারগ্রস্ত এবং অন্য একটি ক্যান্সারমুক্ত পাদুকা।
ব্যাপারটা কিন্তু এখানে মিটল না। তাঁর প্রিয় পাদুকার ক্যান্সারমুক্তি না হওয়া পর্যন্ত বাণেশ্বর বিরত হওয়ার পাত্র নন। অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতার প্রথিতযশা চিকিৎসকেরা প্রায় প্রত্যেকেই বাণেশ্বর অথবা বাণেশ্বরের পাদুকার সম্মুখীন হলেন। রীতিমতো কেলেংকারি বেধে গেল চিকিৎসক মহলে। কারও চেম্বারে কোনও রোগী নিজের জুতোর দিকে দুবার তাকালেই সকলের সন্দেহ হত এই বোধ হয় বাণেশ্বর সরকার।
কিন্তু চিকিৎসকদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পাদুকার জন্যে কোনও চিকিৎসা এমনকী সামান্য সহানুভূতিও পেলেন না তিনি। অতঃপর হাসপাতালমুখী হলেন বাণেশ্বরবাবু।
কলকাতার এস-এস-কে-এম, মেডিক্যাল কলেজ, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার শুধু নয়, শোনা যায়, তিনি ভেলোরে, বোম্বাইয়ের যশলোক এমনকী দিল্লির ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেলথে পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি করেছেন ক্যান্সারাক্রান্ত জুতো নিয়ে।
বহু দূর-দূর, বড় বড় জায়গা, অনেক পয়সা খরচ। সর্বভারতীয় উন্মাদ হিসেবে অতি অল্পদিনের মধ্যেই বিখ্যাত হয়ে উঠলেন কলকাতার বাণেশ্বর সরকার, যাকে পাড়ার ডাক্তার সিগারেট খাওয়া ছাড়তে বলেছিল।
অবশেষে এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, বেরসিক এবং সহানুভূতিহীন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বাণেশ্বর সরকার মশায়কে জোর করে নিয়ে গেলেন এক মনোচিকিৎসক অর্থাৎ পাগলের ডাক্তারের কাছে।
সবাই ধরে নিয়েছিল পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ায় বাণেশ্বর যথেষ্ট উত্তেজিত বোধ করবে, কিন্তু তা হল না। বরং তিনি মোটামুটি খুশিই হলেন, কারণ মনোচিকিৎসক, বলতে গেলে ইনিই প্রথম ডাক্তার যিনি বাণেশ্বরবাবুর জুতোজোড়াকে গুরুত্ব দিলেন। হাতে দস্তানা পরে জুতো তুলে উলটেপালটে দেখলেন। টর্চের আলো ফেলে যেভাবে গলার ভিতর পরীক্ষা করে সেই ভাবে জুতোর ভিতরে তন্নতন্ন করে দেখলেন, অনেক প্রশ্ন করলেন জুতো এবং বাণেশ্বরবাবুকে জড়িয়ে।
যেন কোনও নিকট আত্মীয়ের দুরারোগ্য অসুখে ডাক্তার তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছেন এই ভাবে অত্যন্ত ধৈর্য এবং নিষ্ঠা সহকারে ডাক্তারবাবুর প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন বাণেশ্বর।
পরপর সাতদিন এরকম সিটিং দেয়ার পর রায় জানা গেল মনোচিকিৎসকের। অতি পরিষ্কার, সংক্ষিপ্ত ব্যাপার, চিরকুমার, অকৃতদার মধ্যবয়সি বাণেশ্বরবাবু তার পায়ের জুতোর প্রেমে পড়েছেন। এ কোনও হালকা, খেলো প্রেম নয়, রোমিয়ো-জুলিয়েট, লায়লা-মজনু এমনকী পার্বতী-দেবদাসের প্রেম যে ঘরানার এও ঠিক তাই এক জাতের।
অকৃতদার বাণেশ্বরবাবু একান্নবর্তী পরিবারের লোক। তার নিজের ভাই নেই, খুড়তুতো ভাইদের সঙ্গে থাকেন। তারই প্রায় সমবয়সি এক খুড়তুতো ভাই রামেশ্বর, ডাক্তারের কাছ থেকে সব শুনে এসে তাকে জানালেন, বানেশ, ডাক্তার বলেছে তোমার জুতোর কিছুই হয়নি, সামান্য ফোঁসকা, তাও শুকিয়ে এসেছে, সিগারেট খাওয়া বন্ধ করলেই সেটা সেরে যাবে। তারপর ছোট একটা হেঁচকি তুলে রামেশ্বর বললেন, তবে একটু গোলমাল হয়েছে তোমার দিক থেকে, ডাক্তারবাবু বললেন, মনোসমীক্ষণ করে ধরা পড়েছে তুমি নাকি তোমার জুতোর গভীর প্রেমে আচ্ছন্ন, তার প্রতি আসক্ত।
জুতোর ক্যান্সার হয়নি জেনে বাণেশ্বর যতটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন, প্রেমের প্রসঙ্গটা শুনে বাণেশ্বর রীতিমতো হকচকিয়ে গেলেন। এই বিগত যৌবনেও তার কর্ণমূল রাঙা হয়ে উঠল, কেমন যেন আমতা আমতা করতে লাগলেন, দ্যাখ রামেশ্বর, ডাক্তার ওই পরের কথাটা মোটেই ঠিক বলেননি। হ্যাঁ আমার জুতো, আমার নিজের জুতো, আমি তাকে পছন্দ করি, তাকে আমার ভাল লাগে, কিছুটা শ্রদ্ধাও করি, একটু স্নেহও আছে তার প্রতি আমার, কিন্তু তাই বলে আমি তার প্রেমে পড়েছি, তার প্রতি আসক্ত, ছি ছি, এতবড় কথা তোমরা বলছ, বলতে পারছ! খুব তাড়াতাড়ি এতগুলি কথা বলে নিজের সংকোচ ও লজ্জা এড়াতেই বুঝি উঠে গেলেন বাণেশ্বর।
খুড়তুতো ভাই রামেশ্বর সরকার আমদানি রপ্তানির ব্যবসা করেন, সাহেব-সুবোদের চরিয়ে খান। তার বাস্তববুদ্ধি অতি প্রখর। তিনি দেখলেন মনোচিকিৎসক ঠিকই ধরেছে, বাণেশ্বরের যথেষ্ট প্রেম ও আসক্তি রয়েছে জুতোর প্রতি। তিনি এক মতলব করলেন, বেশ সোজা মতলব।
বাড়িতে একটা নতুন কাজের লোক এসেছে, তাকে দেখলেই বাণেশ্বরের মাথা গরম হয়ে যায়। গায়ে গোলাপি গেঞ্জি, মাথায় টেরি কাটা, কেমন বাবু বাবু ভাব। লোকটা কাজ খারাপ করে না, কিন্তু লোকটাকে বাণেশ্বরের মোটেই পছন্দ নয়। একদিন সকালবেলায় বিছানায় শুয়ে বাণেশ্বর খবরের কাগজ পড়ছিলেন, নতুন চাকরটা ঘর মুছছিল, হঠাৎ বাণেশ্বর দেখেন খাটের নীচে রাখা জুতোজোড়া লোকটা নিজের পায়ে গলিয়ে দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে দূর-দূর করে ঘর থেকে বার করে দিয়েছিলেন। তারপর রামেশ্বরকে ডেকে বলেছিলেন, বউমাদের বলে দিও, এই লোকটা যেন কখনও আমার ঘরে না ঢোকে। কত বড় সাহস ব্যাটার, আমার জুতোয় পা গলাচ্ছে।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই রামেশ্বর তার মতলব হাসিল করলেন। একদিন দুপুরবেলা বাণেশ্বর তার ঘরে দিবানিদ্রায় মগ্ন, সেই সময় রামেশ্বর চুপি চুপি বাণেশ্বরের ঘরে ঢুকে খাটের নীচ থেকে বিখ্যাত জুতোজোড়া বার করে বারান্দায় এসে নতুন ভৃত্যটিকে ডাকলেন, এই জুতোজাড়া তোর পছন্দ? নোকটা কিছু বুঝতে না পেরে, কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে স্বীকার করল, হ্যাঁ, জুতোজোড়া ভাল। সঙ্গে সঙ্গে রামেশ্বরবাবু জুতোজোড়া তাকে দিয়ে আর বকেয়া মাইনে চুকিয়ে, সঙ্গে দশ টাকা বখশিশ দান করে লোকটাকে বললেন, যা এ বাড়ি থেকে বিদায় হ। আর কোনওদিন এ মুলুকে আসবি না। লোকটি এই অভাবিত সৌভাগ্যে বিগলিত হয়ে দাঁত বার করে হেসে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে জুতোজোড়া হাতে করে দ্রুত প্রস্থান করল।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠে জুতোজোড়া না দেখতে পেয়ে বাণেশ্বর রীতিমতো মুষড়ে পড়লেন, বলা উচিত একেবারে ভেঙে পড়লেন। যখন তাঁকে জানানো হল যে নতুন বাবুবাবু চাকরটাই জুতো নিয়ে পালিয়েছে, তিনি একদম ম্লান হয়ে গেলেন। কেবল ছি-ছি করতে লাগলেন আর স্বগতোক্তি করতে লাগলেন, আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম, ধরেও ফেলেছিলাম। ছি ছি সাধে কি আর জুতো বলে, কত কষ্ট করে কত ডাক্তার দেখিয়ে কঠিন অসুখ থেকে বাঁচালাম–ছি ছি শেষে একটা চাকরের সঙ্গে ছি ছি ছি।
সর্বশেষ খবর, বাণেশ্বরবাবু ভাল হয়ে গেছেন। একজোড়া নতুন জুতো কিনেছেন, তবে তার প্রতি তার তেমন আসক্তি নেই, প্রয়োজনমতো পায়ে দেন। আর সিগারেট খাওয়া সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছেন। আসুন আমরা সবাই তার নীরোগ, দীর্ঘজীবন কামনা করি।