বাড়ি
পাঁচ বছর আগে আমার ভারী অসুখ হয়েছিল। সেই সময়ে রোজই রাত্রে আমি ঠিক একই স্বপ্ন দেখতুম।
স্বপ্নে দেখতুম, আমি যেন শহরের বাইরে এক পাড়াগাঁয়ে গিয়েছি।
আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে রোজই এগিয়ে যাই। পথের দু-ধারে কোথাও কলা গাছের ঝাড়, বাতাসে সবুজ নিশান উড়িয়ে দিয়েছে; কোথাও মেদি গাছের বেড়া দেওয়া নানান ফুলের বাগান, মৌমাছি আর প্রজাপতিরা সেখানে মধু চয়নের খেলা খেলছে; কোথাও তালকুঞ্জের ছায়া-দোলানো এবং কাঁচা রোদের সোনা-ছড়ানো ঝরঝরে সরোবর, ঘাটে ঘাটে নববধূরা ঘোমটায় মুখ ঢেকে কলসিতে জল ভরে নিচ্ছে।
পথ যেখানে ফুরিয়ে গেছে, সেইখানে একখানি মস্ত বাড়ি—দূর থেকে ছবির মতন দেখতে।
সামনেই ফটক, কিন্তু সেখানে কোনো দারোয়ান নেই। বাড়ির চারিদিকে জমিতে কত রকমের গাছ—গন্ধরাজ, বকুল, রঙন, শিউলি, আরও কত কী! মাঝে মাঝে কিছু ঝোপে রং-বেরঙের মেলা।
রোজই বেড়াতে বেড়াতে বাড়িখানির সামনে গিয়ে দাঁড়াই—অপলক চোখে তার পানে তাকিয়ে থাকি, ভিতরে যাবার জন্যে প্রাণে সাধ জাগে।
কিন্তু জনপ্রাণীকে দেখতে পাই না। ফটকের কাছ থেকে চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করলেও কেউ সাড়া দেয় না। পরের বাড়ি, না-জানিয়ে ভিতরে ঢুকতেও ভরসা হয় না। ফিরে আসি।
রাতের-পর-রাত যায়, আমি খালি ওই একই স্বপ্ন দেখি। বার বার অনেক বার ওই একই স্বপ্ন দেখে দেখে আমার মনে দৃঢ় ধারণা হল যে, অজ্ঞাত শৈশবে নিশ্চয়ই কারুর সঙ্গে আমি ওই বাড়িতে গিয়েছিলুম।
আমার অসুখ সেরে গেল। কিন্তু তবু সেই স্বপ্নে-দেখা বাড়িকে ভুলতে পারলুম না। মাঝে মাঝে এদেশ-ওদেশ বেড়াতে যেতুম। পথে বেরুলেই চারিদিক লক্ষ করে দেখতুম, স্বপ্নের বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায় কি না।
একবার এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে কুসুমপুর গ্রামে যাই।
বৈকালে বেড়াতে বেরিয়ে একটা গেঁয়োপথ পেলুম। দেখেই চিনলুম, এ আমার সেই স্বপ্নে দেখা পথ। পথের দু-ধারে সেই কলা গাছের ঝাড়, মেদি গাছের বেড়া দেওয়া বাগান, আলো-ছায়া-ভরা পুকুরঘাট। অনেক দিন অদর্শনের পর পুরোনো বন্ধুকে দেখলে মনে যে আনন্দের ভাব জাগে, আমারও মনে তেমনি ভাবের ছোঁয়া লাগল।
আঁকাবাঁকা পথের শেষে ছবির মতন সেই বাড়িখানি।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে ফটকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। ডাকাডাকি করতে লাগলুম।
ভেবেছিলুম, কারুর সাড়া পাব না। কিন্তু আমার ডাক শুনেই একজন বুড়ো দারোয়ান ভিতর থেকে বেরিয়ে এল।
‘কাকে চান?’
‘কারুকে নয়। এই বাড়িখানা আমার বড়ো ভালো লেগেছে। ভিতরে ঢুকে একবার দেখতে পারি কি?’
‘আসুন না! এ বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে।’
‘বাড়িওয়ালা কোথায় থাকেন?’
‘এইখানেই থাকতেন। কিন্তু কিছুদিন হল, এ বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন।’
‘বলো কী! এমন চমৎকার বাড়ি কেউ ছেড়ে দেয়?’
‘ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।’
‘কেন?’
‘ভূতের উপদ্রবে।’
‘ভূত! একালেও লোকে ভূত বিশ্বাস করে নাকি?’
দারোয়ান গম্ভীর মুখে বললে, ‘আমিও বিশ্বাস করতুম না। কিন্তু এখন বিশ্বাস না-করে উপায় নেই। যে ভূতটার ভয়ে আমার মনিব এ বাড়ি ছেড়েছেন, রাত্রে আমিও তাকে স্বচক্ষে অনেকবার দেখেছি। তার মুখ আমি ভুলিনি।’
অবহেলার হাসি হেসে আমি বললুম, ‘ডাহা গাঁজাখুরি গল্প।’
দারোয়ান বিরক্তভাবে আমার মুখের দিকে তাকালে। বললে, ‘গাঁজাখুরি গল্প? অন্তত আপনার মুখে এ কথা শোভা পায় না। অনেকবার যে ভূতকে আমি দেখেছি, যার মুখ আমি এ জীবনে ভুলব না—সে হচ্ছেন আপনি নিজে! আমি আপনাকেই দেখেছি!’
—