1 of 2

বাড়ি, বুড়ো, বুট

বাড়ি, বুড়ো, বুট

বাড়িখানি ভারী ভালো লাগল। চারধারে বাগান—যদিও ফুলগাছের চেয়ে বড়ো বড়ো গাছই বেশি। টেনিস খেলার জমি, মাঝে মাঝে শ্বেতপাথরের বেদি, একটি ছোটো বাহারি ফোয়ারা, এখানে-ওখানে লাল কাঁকর বিছানো পথ।

দোতলা বাড়ি—একেবারে হাল ফ্যাশানের না হলেও সেকেলে নয়। বাড়ির জানলায় বা দেওয়ালে প্রাচীনতার কোনো চিহ্নই নেই। কোথাও ফাট ধরেনি, কোথাও অশ্বত্থ-বট এসে জোর করে জুড়ে বসেনি।

কিন্তু তবু মনে হল বাড়িখানা যেন রহস্যময়। ভাবলুম বাড়ির মাথা ছাড়িয়ে উঠে মস্ত মস্ত গাছগুলো নিজেদের জন্যে একটি ছায়ার জগৎ সৃষ্টি করেছে বলেই হয়তো এখানে এমন রহস্যের আবহ গড়ে উঠেছে। আমার পক্ষে এও এক আকর্ষণ। আমি রহস্য ভালোবাসি। রহস্যের মধ্যে থাকে রোমান্সের গন্ধ।

সাঁওতাল পরগনার একটি জায়গা। স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়েদের বায়ু পরিবর্তনের দরকার— ডাক্তারের মতে এ জায়গাটি নাকি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। বন্ধু প্রকাশের সঙ্গে এখানে এসেছি, মনের মতন একটি বাড়ি খুঁজে নিতে। আজকের ট্রেনেই কলকাতায় ফিরব।

খানিক ডাকাডাকির পর বাগানের ভেতর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এল—তার চেহারা না মালি, না দ্বারবান, না ভদ্র ও ইতর লোকের মতো। তার বয়স আশিও হতে পারে, একশো-ও হতে পারে। তার মাথায় ধবধবে সাদা, এলোমেলো লম্বা লম্বা চুল। তার কোমর এমন ভাঙা যে, হাড়-জিরজিরে দেহের ওপর অংশ একেবারে দুমড়ে পড়েছে। কিন্তু হাতের লাঠি ঠকঠকিয়ে সে এত তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল যে, তার অসম্ভব ক্ষিপ্রতা দেখে বিস্মিত হলুম। সে জিজ্ঞাসা করলে, ‘আপনারা কী চান?’

‘বাড়ির ফটকের ওপরে লেখা রয়েছে—টু লেট। আমরা এই বাড়িখানা ভাড়া নিতে চাই।’

লোকটা হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল। সে এতক্ষণ মাথা হেঁট করে ছিল বলে তার চোখ দেখতে পাইনি। এখনও দেখতে পেলুম না, কারণ তার চোখ দুটো এমনি অস্বাভাবিকভাবে কোটরগত যে, প্রথম দৃষ্টিতে তাদের আবিষ্কার করাই যায় না। মনে হয়, লোকটি বুঝি অন্ধ। কিন্তু তারপর লক্ষ করে দেখলুম, দুই কোটরের ভেতর দিকে কী যেন চকচক করছে—দুই অন্ধকার গর্তের মধ্যে যেন দুই দীপশিখার ইঙ্গিত।

লোকটা আবার মুখ নামিয়ে ফেলে থেমে থেমে বললে, ‘ভাড়া নিতে চান? এই বাড়ি ভাড়া নিতে চান? বেশ!’

‘বাড়িখানা আমাদের পছন্দ হয়েছে। এ বাড়ির মালিক কে?’

‘বাড়ির এখনকার মালিক থাকেন বিলাতে। আগেকার মালিক কোথায় থাকেন, কেউ জানে না।’

‘তাহলে ভাড়া দেব কাকে?’

‘আমাকে?’

‘কত ভাড়া?’

‘সেটা ঠিক করবেন আপনারাই।’

রহস্যময় বাড়ি, রহস্যময় বৃদ্ধ এবং তার কথাগুলোও কম রহস্যময় নয়। মনে হল, রহস্যের মাত্রা যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এতটা ভালো নয়।

কী বলব ভাবছি, হঠাৎ গায়ে পড়ল এক ফোঁটা জল। চমকে মুখ তুলে দেখি, ইতিমধ্যে আমাদের অজান্তেই আকাশে হয়েছে মেঘের সঞ্চার।

বুড়ো বললে, ‘বৃষ্টি আসছে। আপনারা একটু ভেতরে গিয়ে দাঁড়াবেন চলুন।’

বুড়োর পিছনে পিছনে বাড়ির নীচের তলার বারান্দার তলায় গিয়ে দাঁড়ালুম।

ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামল।

প্রকাশ আমার দিকে ফিরে বললে, ‘বৃষ্টিতে এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। চল, আগে বাড়ির ওপরকার ঘরগুলো একবার দেখে আসি।’

বুড়োর দিকে ফিরে দেখি, সে ঊর্ধ্বমুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে ডাকলুম, সে যেন শুনতেই পেল না। খানিক পরে হঠাৎ বললে, ‘ঘড়িতে ক-টা বেজেছে?’

হাতঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করে বললুম, ‘এখন সাড়ে পাঁচটা।’

বুড়ো যেন শীতার্ত কণ্ঠে কাঁপতে কাঁপতে বললে, ‘আকাশে মেঘ আরও জমে উঠছে! অন্ধকারে সন্ধ্যা নামবে তাড়াতাড়ি। এ বৃষ্টি সন্ধ্যার পরেও পড়বে!’

‘না পড়তেও পারে।’

‘না, না, এ বৃষ্টি এখন থামবে না, হয়তো আজ সারারাত ধরেই পড়বে। আমি মেঘ দেখেই বুঝতে পারি।’

প্রকাশ বললে, ‘কী সর্বনাশ, তাহলে আমরা স্টেশনে যাব কী করে? আজই যে আমাদের কলকাতায় ফেরবার কথা!’

বুড়ো ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললে, ‘এ বৃষ্টি আজ আর থামবে না—আজ আর থামবে না! পাহাড়ে নদী ফুলে উঠবে, মাঠ ভেসে যাবে, পথ ডুবে যাবে। পালাতে চান তো এখনি পালান। সন্ধ্যার পর রাত আসবে, ঝড় উঠবে, বন কাঁদবে—এ বৃষ্টি আজ আর থামবে না! এখনও সময় আছে, এখনও পালিয়ে যান।’

বুড়োর কথাবার্তার ধরন দেখে রাগ হল। বিরক্ত কণ্ঠে বললুম, ‘ঠাট্টা রাখো। শোনো। এ বাড়ি আজ থেকেই আমি ভাড়া নিচ্ছি। বৃষ্টি না থামে, আজ আমরা এইখানেই রাত কাটাব। কত টাকা দিতে হবে বল?’

বুড়ো আবার মুখ তুললে—আবার দেখলুম তার চক্ষুকোটরাগত দুই দীপশিখার ঝিলিক। দন্তহীন মুখব্যাদান করে নীরব হাসি হেসে সে বললে, ‘আজ রাতে এখানে থাকবেন? থাকতে পারবেন?’

‘কেন পারব না?’

‘বাড়ির আগেকার মালিক আজ রাতে এখানে আসবেন। তিনি কোথায় থাকেন কেউ তা জানে না, কিন্তু বৃষ্টির রাতে ঠিক এখানে বেড়াতে আসেন। তাঁকে দেখলে মানুষ খুশি হয় না। দোতলার হলঘর তাঁর জন্যে খোলাই থাকে। এক বৃষ্টির রাতে ও-ঘরে একটি কাণ্ড হয়েছিল।’

‘কী হয়েছিল!’

‘রক্তাক্ত কাণ্ড! সন্ধ্যার সময় মালিক ফিরে এলেন—তখন ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হাতে তাঁর বন্দুক, পরনে তাঁর শিকারের পোশাক। তারপর—না, না, সেসব কথা আপনাদের আর শুনে কাজ নেই। কিন্তু সেইদিন থেকে এ বাড়ি খালি—এ বাড়ি কেউ ভাড়া নিতে চায় না।’

আমি হো-হো করে হেসে উঠলুম, ‘তুমি কি আমাদের ছেলেমানুষ পেয়েছ, যে যা-তা বলে ভয় দেখাতে চাও?’

‘বেশ, তবে তোমরা থাকো, আমি চললুম। কিন্তু সাবধান, সাবধান, সাবধান!’ বলতে বলতে বুড়ো লাঠি ঠকঠকিয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রপদে আবার বাগানে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।

প্রকাশ বললে, ‘পাগল!’

আমি বললুম, ‘পাগল নয়, পাজি। বুড়োর হয়তো ইচ্ছা নয়, আর কেউ এ বাড়ি ভাড়া নেয়। সে একলাই এখানে রাজত্ব করতে চায়। কিন্তু বাইরে যখন ভাড়া-পত্র টাঙানো আছে, তখন আমাদের ভাবনা কী? চল, একবার দোতলার ঘরগুলো দেখে আসি।’

দোতলার বারান্দায় উঠে দাঁড়ালুম। সেখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।

আরও পুরু, আরও কালো হয়ে উঠেছে আকাশের মেঘ। আরও জোরে আরও ঘন ধারায় পড়ছে বৃষ্টি…ঝম ঝম ঝম ঝম! সন্ধ্যার আগেই দ্রুত নেমে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকার। দূরের ছোটো ছোটো পাহাড়গুলো ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। দুই কূল ভাসানো নদীর ছবি আঁকা, জল থই থই করা প্রান্তরে মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো গাছগুলো মাতাল হয়ে টলমল করছে ঝোড়ো বাতাসের দীর্ঘশ্বাসে।

প্রকাশ বিষণ্ণ স্বরে বললে, ‘বুড়োর একটা কথা কিন্তু ঠিক। আজ এইখানেই বন্দি হতে হবে।’

‘উপায় নেই।’

‘কিন্তু খাবে কী?’

‘আকাশের জল।’

‘শোবে কোথায়?’

‘পিছন ফিরে ওই হলঘরটা দেখ। ওর তিনটে দরজাই খোলা। এখনও যেটুকু আলো আছে তাইতেই দেখা যাচ্ছে, ঘরের ভেতরে রয়েছে বড়ো বড়ো সোফা, কৌচ আর চেয়ার। দেওয়ালের গায়ে রয়েছে সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো মস্ত মস্ত ছবি আর আয়না। মেঝের ওপরে কার্পেট পাতা। আশ্চর্য এই, এমন সাজানো বাড়ি খালি পড়ে আছে!’

প্রকাশ সন্দেহ-ভরা কণ্ঠে বললে, ‘তবে কি বুড়োর কথা মিথ্যা নয়? এখানা কি—’

‘ভূতের বাড়ি? খেপেছ? তা মানলে বলতে হয় এ বাড়ির আসল ভূত হচ্ছে ওই বুড়োই!’

‘বিচিত্র কী? বুড়োর মতন চেহারা আমি কোনো মানুষেরই দেখিনি!’

আচম্বিতে কানে এল অপূর্ব এক সংগীত! হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে যেন কোনো মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের গান। গায়িকার গলা চমৎকার।

সবিস্ময়ে দু-জনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ ধরে সেই গান শুনলুম।

আকাশে বেড়ে উঠল বিদ্যুতের জীবন্ত অগ্নিচিত্র ও উন্মত্ত বজ্রের চিৎকার। ঘরে-বাইরে কোথাও আর চোখ চলে না।

আমি বললুম, ‘এ গান আসছে কোথা থেকে?’

প্রকাশ বললে, ‘ওই হলঘরের ভেতর থেকে।’

বিদেশে আসছি বলে সঙ্গে টর্চ আনতে ভুলিনি। টর্চটা জ্বেলে দু-জনেই হলঘরের ভেতরে ঢুকলুম। সব আসন খালি। ঘরের ভেতরে একটি অর্গান রয়েছে, তার সামনেও কেউ নেই।

প্রকাশ তবু জোর করেই বললে, ‘যে গাইছে সে এই ঘরেই আছে।’

আমি বললুম, ‘অসম্ভব। অন্য কোনো ঘরে কেউ গান গাইছে।’

প্রকাশ অস্বস্তি-ভরা স্বরে বললে, ‘না, না, গান হচ্ছে এইখানেই। যে গাইছে তাকে দেখতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু আমি তার উপস্থিতি অনুভব করতে পারছি! আমার মনে হচ্ছে, এ ঘরটা যেন হিমালয়ের বরফ দিয়ে গড়া! উঃ কী ঠান্ডা! এ মানুষের ঘর নয় বন্ধু, এ হচ্ছে মড়ার ঘর!’

আমরা তাড়াতাড়ি আবার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালুম। প্রকাশের কথা মিথ্যা নয়। ঘরের চেয়ে বাইরেটা বেশি গরম—অথচ ঝোড়ো হাওয়ার তোড়ে সেখানে এসে পড়ছিল শীতল বৃষ্টিধারা।

অবাক হয়ে এর কারণ বোঝবার চেষ্টা করছি, এমন সময় কানে এল আর একটা নতুন শব্দ।

গটগট করে ভারী জুতোর আওয়াজ হচ্ছে।

প্রকাশ বিস্মিত স্বরে বললে, ‘সিঁড়ি দিয়ে কে ওপরে উঠছে? এ বুড়োর পায়ের শব্দ নয়।’

আমি বললুম, ‘বুড়ো মিছে কথা বলেছে। এ বাড়ি নিশ্চয়ই খালি নয়। কে গান গায়? কে ওপরে ওঠে?’ সিঁড়ির দিকে টর্চের আলো ফেলে অপেক্ষা করতে লাগলুম।

সিঁড়ির ধাপগুলো শব্দিত করে ওপরের বারান্দায় এসে স্থির হয়ে রইল এক জোড়া শিকারি বুট—যা পরলে লোকের হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা পড়ে।

নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলুম না—মানুষ নেই, অথচ এক জোড়া শিকারি বুট ওপরে এসে উঠল জ্যান্ত বীরের মতো!

মন বললে, ওই দৃশ্যমান বুট পরে আছে কোনো অদৃশ্য দেহ এবং বারান্দায় হঠাৎ আজ দুই অনাহৃত অতিথি দেখে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে, সবিস্ময়ে।

প্রকাশ অস্ফুট স্বরে বলল, ‘শিকারি বুট! বুড়োও বলেছিল, বৃষ্টির রাতে বাড়ির মালিক এসেছিল শিকারির পোশাক পরে।’

আমি উত্তর দেওয়ার আগেই বুট জুতো জোড়া যেন বেজায় ভারী দেহের চাপ নিয়ে আবার গটগট শব্দে মাটি কাঁপিয়ে অগ্রসর হতে লাগল আমাদের দিকেই।

আমরা মহা আতঙ্কে পিছু হটতে লাগলুম পায়ে পায়ে। আমাদের দৃষ্টি স্তম্ভিত, হৃৎপিণ্ড করছে ধড়ফড়।

হলঘরের তৃতীয় দরজার কাছে এসে বুট জুতো জোড়া আবার থেমে পড়ল—ক্ষণিকের জন্যে। কিন্তু তারপরেই সবেগে প্রবেশ করল ঘরের ভেতরে। গানের স্বর থেমে গেল— সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম গুড়ুম করে বন্দুকের শব্দ ও তীব্র এক আর্তনাদ।

আমরা পাগলের মতো দৌড়ে এক এক লাফে সিঁড়ির তিন-চারটে করে ধাপ পেরিয়ে নীচে নেমেই দেখি, সেখানে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই অদ্ভুত বুড়োর ভাঙা দুমড়ে পড়া মূর্তি। সে একবার মুখ তুলে আমাদের পানে তাকালে—টর্চের আলোতে তার চক্ষুকোটরের খুব ভেতরে জ্বলে উঠল দুটো আগুনের কণা!

খিলখিল করে হেসে বুড়ো খনখনে গলায় বলে উঠল, ‘মালিকের সঙ্গে দেখা হল? মালিক কী বললে? বাড়ি ভাড়া নেবে নাকি? হি হি হি হি হি!’

দৌড়োতে দৌড়োতে বাগান পার হয়ে যখন বাইরে এসে পড়লুম, তখনও সেই ভয়াবহ বুড়োর অপার্থিব হাসির শব্দ থামেনি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *