ছদ্মবেশ – সাদাত হোসাইন
উৎসর্গ
আমার কখনো কখনো মনে হয়, মানুষটাকে আমি চিনি। আবার কখনো কখনো মনে হয় চিনি না। মানুষটা অদ্ভুত, অনুনমেয়। বুকের ভেতর আস্ত এক নোনাজলের সমুদ্র পুষে রেখেও ঝলমলে রোদের মতন হাসেন। তাঁর সেই হাসি বড় সংক্রামক। তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর চারপাশের অসংখ্য মানুষের মধ্যেও। নিজেদের অগোচরেই সকল বিষাদ বুকে চেপে সেই মানুষগুলোও ক্রমশই যোগ দিতে থাকে তার অদ্ভুত রহস্যময় আনন্দ মিছিলে।
হাসিবুর রেজা কল্লোল
চারপাশে আনন্দ ছড়িয়ে দেয়া অদ্ভুত, অনুনমেয় সেই রহস্য মানব। আপনার আনন্দ ছড়িয়ে দেয়ার এই মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক।
.
ভূমিকা
মানুষ রহস্যময়তা পছন্দ করে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সে সেটা বুঝতে পারে না। জীবনভর সে তার প্রিয়তম মানুষটিকেও পুরোপুরি বুঝে ফেলতে চায়, কিন্তু পুরোপুরি বোঝা হয়ে গেলে তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সে আসলে অবচেতনে সবসময়ই অনুদঘাটিত কিছু রহস্য উদঘাটন করতে চায়। যতক্ষণ অবধি সেই রহস্য থাকে, ততক্ষণ অবধি একটা প্রবল আগ্রহ, আকর্ষণ কাজ করে। রহস্য শেষ হয়ে গেলে আকর্ষণ ফুরিয়ে যায়। অথচ জীবনজুড়েই সে ভাবে, সে রহস্য পছন্দ করে না।
মানুষের ভেতরে এই দ্বান্দ্বিক সত্ত্বাটা আছে। মানুষ ভাবে, সে ভয় পেতেও পছন্দ করে না, নৃশংসতা পছন্দ করে না। কথা সত্য না। সে অতি আগ্রহ নিয়ে গা হিম হয়ে আসা হরর সিনেমা দেখে, ভূতের বই পড়ে, সিরিয়াল কিলারের ভায়োলেন্ট মুভি দেখে, সাহিত্য পড়ে।
এ কারণেই শিল্প-সাহিত্যে বৈচিত্র্যময় নানান ঘরানার সৃষ্টি হয়েছে। রহস্যোপন্যাস সাহিত্যের সেরকমই একটি সমৃদ্ধ শাখা। এই শাখাঁটির প্রতি আমার আগ্রহ একদম শৈশবেই। তবে তা শুধুই পড়ার জন্য, লেখার জন্য নয়। কারণ, এই ঘরানাটিকে আমার খুবই কঠিন এবং একই সাথে গাণিতিক ‘ক্যালকুলেটিভ’ মনে হয়। ফলে এতোদিনে কখনোই রহস্যোপন্যাস লেখার কথা আমি ভাবিনি।
তাহলে এই উপন্যাসটি কেন লিখেছি?
এই উপন্যাস লেখার কারণটা মজার। বহুবছর আগে এক দৈনিক পত্রিকায় হঠাৎ করেই একটি খুনের ঘটনা পড়েছিলাম। ঘটনাটি খুবই সাধারণ। পুলিশ লাশসহ খুনিকে গ্রেপ্তারও করেছে। কিন্তু তারপরও একটা রহস্য রয়ে গেছে। সেই রহস্যের কোনো কুল কিনারা করতে পারছে না পুলিশ। বিষয়টা আমার মাথায় গেঁথে গেলো। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছি না। অবচেতনেই ঘুরেফিরে বারবার মাথায় চলে আসতে লাগলো সেই ঘটনা। এই করতে করতেই আচমকা একদিন একটা গল্পও চলে এলো মাথায়। সেই গল্প লিখেও ফেললাম। লিখতে গিয়ে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম, গল্পের প্রধান চরিত্রটিকে আমি বিশেষ পছন্দ করে ফেলেছি। এই চরিত্রটি নিয়ে আমি ধারাবাহিকভাবে আরো লিখতে চাই। প্রতিটি বইতে সে একেকটি রহস্যের সমাধান করবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রহস্য গল্প লেখা কঠিন। এই কঠিন কাজটি আমি নিয়মিত করতে পারবো কিনা, সেটি নিয়ে খানিক সংশয়ও আছে। সেই সংশয় নিয়েই আমার প্রথম রহস্যোপন্যাস ‘ছদ্মবেশ’।
‘ছদ্মবেশ’ শেষ অবধি রহস্যোপন্যাস হয়ে উঠতে পেরেছে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত পাঠকের।
সাদাত হোসাইন
শ্যামলী, ঢাকা
০৬.০৭.২০১৯
.
০১.
বাড়ির নাম ‘অপেক্ষা’। অপেক্ষার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অধ্যাপক লতিফুর রহমান। তিনি এই বাড়ির মালিক। তার চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চশমা ছাড়া তিনি খুব একটা ভালো দেখতে পান না, তারপরও চশমার ফাঁক দিয়েই তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শেষ মুহূর্তে বাড়ির নামটা আরেকবার দেখে নিলেন। তারপর সন্তুষ্ট গলায় বললেন, এবার ঠিক আছে।
যে ছেলেটা গেটের বা দিকের দেয়ালে খোদাই করে বাড়ির নাম লিখছিল, সে বিরক্ত গলায় বলল, বানাম লইয়া আপনে হুদাই পেরেশানি করলেন পোরবেচার সাব। এইটাতো আর আপনের কলেজের বাংলা কেলাস না যে মাইনষে আইসা এইখানে বানাম শিখব। অপেকথা লেখলে কী এমন সমস্যা আছিল সেইটাই বোঝলাম না।
লতিফুর রহমান মৃদু হাসলেন, তবে জবাব দিলেন না। তার সারা জীবনের সঞ্চয় এই বাড়ি। তিনি ছিলেন কলেজের বাংলার অধ্যাপক, প্রাইভেট টিউশন ছিল না, বাড়তি রোজগার ছিল না, তারপরও বাড়ির এই স্বপ্নটা তিনি সযত্নে বুকে পুষে রেখেছিলেন। স্বপ্নটা শেষ অবধি হয়তো অবিকল স্বপ্নের মতো করে ধরা দেয়নি, তারপরও চোখের সামনে যে তিনতলা অবয়বটি দাঁড়িয়ে আছে, তা এখনো অবিশ্বাস্যই লাগে লতিফুর রহমানের। জীবনভর অবর্ণনীয় কৃচ্ছতা আর শেষ বয়সের পেনশনের টাকাটাও যখন যথেষ্ট হলো না, তখন বিক্রি করে দিলেন গ্রামের ফসলি জমিটুকুও। তাতেও যে সব ঠিকঠাক হয়েছে এমন নয়, বরং বাড়িটা এখনো অনেকটাই অসমাপ্ত। তিনতলার একপাশের ছাদ এখনো বাকি। নিচতলার কিছু ঘরের প্লাস্টারও হয়নি। গেটটা যেমন করার ইচ্ছে ছিল, তাও পারেননি। নামফলকটাও না।
প্রায় দুই বছর ধরে আস্তে আস্তে এই বাড়ির কাজ চলেছে। লতিফুর রহমান নিজে এই বাড়ির কত কাজ যে করেছেন। মিস্ত্রিদের সঙ্গে থেকে থেকে তাদের বহু
কাজে সহায়তাও করেছেন। সামান্য খরচও যদি তাতে বাঁচে। একটা সুবিধাও অবশ্য এতে হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক কাজ তিনি শিখেও গিয়েছেন। সেদিন নিচের বাথরুমের সামনের জায়গাটা তিনি নিজে সিমেন্ট কিনে এনে ঢালাই করেছেন। হয়তো মিস্ত্রিদের মতো অমন মসৃণ হয়নি, কিন্তু তারপরও দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটা তিনি নিজে করেছেন।
বাড়ি নিয়ে অনেক আক্ষেপ থাকলেও মনের মতো করে যদি কিছু করে থাকেন, তাহলে দোতলাটা। দোতলার পুরোটাই লতিফুর রহমান আর তার স্ত্রী নাসিমা বেগমের। দোতলাজুড়ে খেলার মাঠের মতো বড় বড় ঘর। দখিন দিকের দেয়ালজুড়ে বিশাল জানালা। সেই জানালাটা খুলে দিলে মনে হয় ঘরের ভেতর আস্ত আকাশ ঢুকে গেছে। লতিফুর রহমান সেই আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেন, আহা, জীবন!
.
তবে তার এই ‘আহা জীবনে’র আনন্দময় নিঃশ্বাসেও বুকের ভেতর একটা ব্যথা চিনচিন করে বেঁধে। সেই ব্যথার নাম সৈকত। ঠিক ষোল বছর তিনি ছেলেটাকে দেখেন না। জীবন কখনো কখনো প্রিয়তম মানুষদের মধ্যেও অদ্ভুত অভিমানের দেয়াল তুলে দেয়। ভালোবেসে কাছে এসে সেই দেয়াল ভাঙা হয় না বলে তা ক্রমশই মহাপ্রাচীর হয়ে উঠতে থাকে। একসময় হয়ে ওঠে অলঙ্নীয়ও।
.
লতিফুর রহমান বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ঘিরে হাঁটতে হাঁটতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজকাল তার ডান পা-টা আবার সমস্যা করছে। বহু বছর আগে এক দুর্ঘটনায় ডান পায়ে ভয়াবহ চোট পেয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই পুরনো চোট যেন ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসছে। আজকাল কখনো কখনো তাই ক্র্যাচ নিয়েও হাঁটতে হয়।
.
লতিফুর রহমান হেঁটে বাড়ির পেছন দিকটায় চলে এলেন। বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে বাইরে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তারপরই নদী। নদীর দুধারে প্রচুর ইটভাটা আর বালির ট্রলার। দ্রুত গড়ে উঠতে থাকা যেকোনো নতুন শহরের জন্যই সবচেয়ে লাভজনক দুই ব্যবসা। তবে সমস্যা হচ্ছে, এসব ব্যবসার বেশির ভাগেরই মালিক গোলাম মাওলা। গোলাম মাওলা এলাকার নব্য ধনী। ধীরে ধীরে রাজনীতিতেও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। সম্ভবত এ কারণেই উপজেলা চেয়ারম্যান চুন্নু মিয়ার সঙ্গে তার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। বর্ষকাল বলে নদীর দু’কূল ছাপিয়ে জল উঠে গেছে ইটভাটার ভেতরেও। ফলে ইটভাটাগুলো আপাতত বন্ধই রাখতে হয়েছে। শীতকাল এলে আবার জমে উঠবে নদীর দুই ধার।
লতিফুর রহমান ঘুরে বাড়ির সামনের দিকে চলে এলেন। তারপর বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সৈকত নিশ্চয়ই কোনো একদিন তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখানে আসবে। এই বিশাল বাড়িটা সেদিন ঝলমল করে উঠবে আলোয়, মুখরিত হয়ে উঠবে শব্দে, গানে। তিনি ভেবে পান না, বুকের ভেতর চোরা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বিদেশ বিভুঁইয়ে একজন মানুষ এত দীর্ঘ সময় ধরে থাকে কী করে!
.
নাসিমা বেগমের প্রেসারটা আবার বেড়েছে। তিনি বিছানায় শুয়ে জড়ানো গলায় বললেন, তুমি ডালিয়াকে বলো আমি রাতে তেতুলের রস ছাড়া আর কিছু খাব না।
লতিফুর রহমান বুক শেলফে বই সাজিয়ে রাখছিলেন। ঘরের মাঝখানের দেয়ালের পুরোটা জুড়েই বিশাল বুক শেলফ বানিয়েছেন তিনি। নাসিমা বেগমের কথা শুনে বললেন, কিন্তু কিছু না খেলে প্রেসারের ওষুধটা কী করে খাবে?
ওসব প্রেসারের ওষুধে কিছু হবে না, তার চেয়ে এটাতে ভালো কাজ হয়।
তুমি সবসময়ই কেন ডাক্তারের চেয়ে অন্যদের কথায় বেশি গুরুত্ব দাও?
কেন দিই, তা তুমি ভালো করেই জানো।
কিন্তু ভুলতো সবারই হয়, তাই না? আমরা এই যে এত কাজ করি, আমাদের ভুল হয় না? হয়। এত বছর বাংলার শিক্ষক ছিলাম, এখনো কত জানা বানানও লিখতে ভুল করে ফেলি। আর সেই কবে একবার এক ডাক্তার ভুল করেছে বলে, তুমি সেটা ধরে এখনো বসে থাকবে? তা ছাড়া, সে ভুল করেছে দেখে যে সব ডাক্তারই ভুল করবে তাতো না।
.
নাসিমা বেগম এই কথার পিঠে কোনো কথা বললেন না। তিনি নিজেই গলা উঁচু করে ডালিয়াকে ডাকলেন। ডালিয়ার বয়স সাতাশ আটাশ বছর। দেখতে সুশ্রী। গায়ের রং ফর্সা। তার একবার বিয়েও হয়েছিল, স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলেও যোগাযোগ বন্ধ। কী কারণে যোগাযোগ বন্ধ, সে বিষয়ে অবশ্য লতিফুর রহমান বা নাসিমা বেগমের কোনো আগ্রহ নেই। তারা এই দুর্দিনে একজন কাজের মানুষ পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত। দুই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার নিরস সংসারে কোনো কাজের মেয়েই এসে বেশিদিন টেকে নি। ডালিয়া সেখানে আশ্চর্য ব্যতিক্রম। সে এসেছে প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল। চুপচাপ শান্ত ধরনের মেয়ে ডালিয়ার যেন সাত চড়েও রা নেই। সম্ভবত এ কারণেই সে এ বাড়িতে টিকে গেছে। না হলে নাসিমা বেগমের মতো তিরিক্ষি মেজাজের কারো সঙ্গে একই বাড়িতে থাকা সহজ ব্যাপার নয়।
.
আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে। খোলা জানালায় সেই চাঁদ দেখে লতিফুর রহমানের মন খারাপ হয়ে গেল। এত বড় বাড়ি বানালেন, কিন্তু সেই বাড়ির ছাদে বসে চাঁদ দেখার উপায় নেই। ছাদটা মনের মতো করে বানাতে পারলেন না। অর্ধেকটা বানিয়েই ফেলে রাখতে হয়েছে। বাকি অর্ধেকের টাকা কী করে জোটাবেন, সেই চিন্তায়ই দিশেহারা অবস্থা। আপাতত উপায় বলতে নিচতলা আর তিনতলার অসমাপ্ত-অর্ধসমাপ্ত ঘরগুলোই ভাড়া দিয়ে দেয়া। সেই ভাড়ার টাকা থেকে যদি বাড়িটা সম্পূর্ণ করা যায়। এ কারণেই কাজ শেষ হওয়ার আগেই গেটের বাইরে ‘টু লেট’ও লাগিয়ে রেখেছেন তিনি।
এরমধ্যেই ভাড়া নেয়ার জন্য কিছু লোকও এসেছে। কিন্তু ঘরগুলোর কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি বলে ভালো ভাড়াটেও পাওয়া যাচ্ছে না। আর যাদের পাওয়া যাচ্ছে, তারাও বেশির ভাগই এলেবেলে ধরনের লোক। এদের হাতে ঘরগুলো ছেড়ে দেয়ার ভরসাও পান না লতিফুর রহমান। তিনি আসলে অপেক্ষায় আছেন ভালো কোনো পরিবারের, যারা অ্যাডভান্স বেশ কিছু টাকা দিতে পারবে। সেই টাকাটা তিনি বাড়ি তৈরির কাজে লাগাতে পারবেন।
.
নতুন থানা শহর বলে বড় ভাড়াটে পাওয়া খানিক সমস্যাজনক। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য এখনো তেমন গড়ে ওঠেনি। তবে ব্যাংক, বীমা, টেলিকমের মতো নাগরিক সুবিধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যে শীঘ্রই চলে আসবে, তার একটা পূর্বাভাসও পাওয়া যাচ্ছে। সেই আশায়ই বুক বেঁধে আছেন লতিফুর রহমান। এগুলো চলে এলেই ভালো ভাড়াটে পাওয়ায় আর অসুবিধা হবে না। যদিও শহর থেকে সামান্য কিছু দূরে বাড়িটা। তবে মূল রাস্তার সঙ্গেই হওয়ায় সুবিধাও আছে। তারপর চারপাশটা খোলামেলা। বারান্দা বা ছাদে গেলেই বুক ভরে যায় তাজা বাতাসে।
.
সম্ভবত এসব কারণেই আজকাল আগ্রহী ভাড়াটের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তবে কারো সঙ্গেই কথা খুব বেশি এগোয় না।
.
আজও প্রায় সাত-আটজন ভাড়াটে এসেছে। রোজকার মতো লতিফুর রহমান নিজেই ঘুরে ঘুরে তাদের ঘরগুলো দেখিয়েছেন। এই কাজটি করতে অবশ্য লতিফুর রহমানের বেশ ভালো লাগে। সারা জীবনের কাঁচুমাচু, সদাসন্ত্রস্ত ভাড়াটে থেকে মুহূর্তেই নিজেকে প্রবল প্রতাপশালী বাড়িওয়ালা মনে হয়। তার হাতের চামড়ার ব্যাগে এক ব্যাগ চ । এই ব্যাগ তিনি মুহূর্তের জন্য হাতছাড়া করেন না। নিজ হাতে দরজার তালা খুলে ঘর দেখান। গম্ভীর মুখে ঘরের গুণগান করেন। শেষ পর্যন্ত বাড়ি ভাড়া দিলে যেসব নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে, তা অক্ষরে অক্ষরে বলে দিতে থাকেন। কিন্তু বাড়ি ভাড়াটা আর হয় না। অর্ধসমাপ্ত-অসমাপ্ত ঘরগুলো যেমন সচ্ছল পরিবারের পছন্দ হয় না, তেমনি কম আয়ের পরিবারগুলো লতিফুর রহমানের চাহিদানুযায়ী অগ্রিম টাকা দিতেও সক্ষম নয়।
.
এই নিয়ে লতিফুর রহমানের দুশ্চিন্তার কমতি নেই। তারপর নাসিমা বেগমের শরীরটাও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। গতকাল রাতে বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছেন। প্রেসারটাও যখন-তখন ভয়াবহরকম বেড়ে যাচ্ছে। লতিফুর রহমানের মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে। এই যে এত কষ্ট করে, এই শেষ বয়সে এসে এত বড় বাড়ি করলেন, লাভ কী হলো! সেইতো জীবন ধু ধু বালুচরের মতো শূন্য। কোথাও যেন কোনো শান্তি নেই, স্বস্তি নেই, স্থিরতা নেই। কিংবা তিনি হয়তো এসব কখনো ঠিকভাবে চানই নি! প্রায় রাতেই এমন কত কত এলোমেলো ভাবনায় তার ঘুম হয় না। তিনি সেসব রাতে ঘুমান ফজরের নামাজ পড়ে এসে। মসজিদ থেকে বের হয়ে কষ্ট করে হলেও কিছুক্ষণ হাঁটেন। তারপর বাসায় ফিরে নাশতা করে ঘুমান। তার ঘুম ভাঙে জোহরের আজান শুনে। উঠে গোসল করে আবার নামাজে ছোটেন মসজিদে।
আজকাল অবশ্য এই ঘুমটায়ও সমস্যা হচ্ছে। ভাড়ার জন্য বাড়ি দেখতে আসা লোকজন যখন তখন কলিংবেল চাপে। লতিফুর রহমান ঘুম থেকে উঠে চাবির ব্যাগ হাতে দ্রুত নিচে নেমে যান। তারপর মূল ভবনের কলাপসিবল গেট খুলে ছোট্ট উঠানটা পেরিয়ে হেঁটে গিয়ে মেইন গেটের তালা খুলে দেন। এই কাজ তাকে দিনের মধ্যে অসংখ্যবার করতে হয়। নাসিমা বেগম মাঝে মাঝেই বিরক্ত গলায় বলেন, দারোয়ানের মতো প্রতিবার তোমাকেই গিয়ে কেন গেট খুলে দিতে হবে? ডালিয়াকে দিলেওতো হয়?
লতিফুর রহমান মৃদু হেসে বলেন, নিজের বাড়িতে দারোয়ানি করতেও আনন্দ বুঝলে?
অত বুঝে আমার কাজ নেই। একটা দারোয়ানওতো রাখতে পারো, পারো না?
দরকার হলে রাখতাম। শুধু শুধু পয়সা নষ্ট করারতো কোনো মানে নেই।
তোমার কাছেতো সব কিছুই শুধু শুধু পয়সা নষ্ট। সারাটা জীবন ধরে এই ইতো শুনলাম।
লতিফুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, আর কিছু শোনননি? আর কী শুনব?
এই যে দীর্ঘশ্বাস।
কারো দীর্ঘশ্বাস কেউ শোনে না।
শোনে না?
নাহ, শোনে না। তুমি আমার দীর্ঘশ্বাস কখনো শুনেছো?
এই প্রশ্নে এসে লতিফুর রহমান চুপ করে যান। তিনি জানেন, এখন অবধারিতভাবেই সৈকতের প্রসঙ্গ আসবে। সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নাসিমা বেগম হাউমাউ করে কাঁদবেন। তার সেই কান্না আর সারা রাতেও শেষ হবে না।
.
নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে বাড়িতে শুক্রবার ভোরটা হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস নিয়ে এলো। সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে লতিফুর রহমান আর ঘুমালেন না। আজ সারাদিনই লোকজন আসবে বাড়ি দেখতে। তিনি তাই নামাজ পড়ে এসে বসেছিলেন বারান্দায়। এই মুহূর্তে কলিংবেল বাজল। এত ভোরে কেউ বাড়ি দেখতে আসতে পারে, এটা লতিফুর রহমানের ধারণায় ছিল না। তিনি হন্তদন্ত হয়ে নিচে এসে গেট খুললেন। গেটের বাইরে আলী আকবর দাঁড়ানো। এই সাত সকালে অত দূর থেকে আলী আকবর এসেছে দেখে তিনি রীতিমতো চমকে গেলেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, কীরে আলী, এই সাত সকালে, খবর কী!
আলী আকবর সাইকেল চালিয়ে এসেছে। সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আম্রিকা থেইক্যা চিডি আইছে ছার।
লতিফুর রহমান প্রথমে বুঝতে পারলেন না। আমেরিকা থেকে চিঠি আসলে আলী আকবর তার কাছে কেন এসেছে? তিনি দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললেন, কিসের চিঠি? কার চিঠি?
আপনের চিডিই মনে হয়। আগে যেই বাসায় ভাড়া থাকতেন, সেই বাসার বাড়িওয়ালা গতকাইল রাইতে এই চিডিখান আব্বার কাছে দিয়া বলল আপনের কাছে পৌঁছাই দিতে।
আলী আকবর কলেজের দপ্তরির ছেলে। লতিফুর রহমান কলেজ থেকে রিটায়ার করলেও এতদিনকার কলেজ, কলেজের মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক রয়েই গেছে। এখান থেকে কলেজের দূরত্ব মাইল দশেক হবে। দীর্ঘ ত্রিশ বছর সেখানেই, কলেজের পাশে ভাড়া বাসাতেই ছিলেন তারা। বছরখানেক হলো সেই ভাড়া বাসা ছেড়ে এখানে এসে উঠেছেন। লতিফুর রহমান হাত বাড়িয়ে চিঠিখানা নিলেন। পুরনো বাড়ির ঠিকানায়ই চিঠি এসেছে। চিঠি কলেজের ঠিকানায়ও আসতে পারত। কিন্তু সৈকত ইচ্ছে করেই সেই ঠিকানায় চিঠি পাঠায়নি। সে বাবার নামে চিঠি পাঠাতে চায়নি। চিঠি পাঠিয়েছে মায়ের নামে। খামের ওপর প্রাপকের নামের জায়গায় ইংরেজিতে স্পষ্ট করে নাসিমা বেগমের নাম লেখা। নামের পাশে ব্র্যাকেটে সে লিখে দিয়েছে মা। এমনকি কেয়ার অব হিসেবেও লতিফুর রহমানের নাম নেই। লতিফুর রহমান দীর্ঘ সময় সেই চিঠির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঘুরে বাড়িতে ঢুকলেন।
.
নাসিমা বেগম অবশ্য চিঠি খুললেন না। তিনি বন্ধ খাম হাতে নিয়ে বসে রইলেন। দুপুরের দিকে খানিক ঘুমিয়েও গেলেন। এমনিতেই তিনি বারো মাসই অসুস্থ থাকেন। তার মধ্যে গতরাত থেকেই শরীরটা ভীষণ খারাপ করছে। ভোরের দিকে বার দুই বমিও হয়েছে। তিনি বালিশের তলায় খামটা রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। তার বন্ধ চোখের পাতায় বারবার সৈকতের ছবি ভেসে আসছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, যে সৈকতের ছবি তিনি দেখছেন, সেই সৈকতের বয়স পাঁচ কী ছয়! বড় হয়ে যাওয়া সৈকতের ছবি তিনি কল্পনায় আনতে পারছেন না। অবশ্য আনবেনই বা কী করে! প্রায় ষোল বছর তিনি সৈকতকে দেখেন না। তবে সেই পনেরো ষোল বছর আগের সৈকতের চেহারাও তার কল্পনায় আসে না। তার কল্পনায় ভাসে সৈকতের একদম ছোট বয়সের ছবি। সৈকতের সঙ্গে তার শেষ যোগাযোগ হয়েছিল, তাও বছর পাঁচেকের কম হবে না। সৈকতের বয়স কত হবে এখন? ছত্রিশ, সাইত্রিশ? নাসিমা বেগমের মাথা কাজ করছে না। তিনি গুছিয়ে এইটুকুও হিসেব করতে পারছেন না।
.
নাসিমা বেগম চিঠি খুললেন সন্ধ্যার দিকে। মাত্র চার পাঁচ লাইনের লেখা। কিন্তু সেই লেখাটুকুই যেন তার এতদিনকার এত এত অসুস্থতা নিমেষই কর্পূরের মতো হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। তিনি সন্ধ্যার পরপর উঠে দাঁড়ালেন। ডালিয়াকে ডেকে বললেন রান্নার ব্যবস্থা করতে। আজ তিনি নিজেই রান্না করবেন। রান্না শেষে তিনি ডালিয়াকে কাছে ডেকে নরম গলায় বললেন, আজ এতদিন পর আমি কেন রান্না করেছি, বলত?
ডালিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল, জানি না।
অনেক দিনতো রান্না-বান্না করি না, তাই দেখলাম, রান্না ভুলে গিয়েছি কি! রান্না কি ভুলে গিয়েছি?
না।
শুধু না বলছিস কেন, বল রান্না কেমন হয়েছে?
ভালো হয়েছে।
শুধু ভালো হয়েছে? কম না বেশি ভালো হয়েছে?
বেশি ভালো হয়েছে।
সত্যি বলছিস, না আমার ভয়ে বানিয়ে বানিয়ে বলছিস?
ডালিয়া এই কথার উত্তর দিল না। সে মাথা নিচু করে ফেলল। ডালিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে নাসিমা বেগমের রেগে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো আজ তিনি রেগে গেলেন না। বরং শান্ত গলায় বললেন, রান্না খারাপ হয়েছেতো কী হয়েছে! অনেকদিন রাধি না বলে এই অবস্থা। এখন থেকে রোজ রাঁধব। দু চার দিন রাঁধলেই ঠিক হয়ে যাবে।
জি খালাম্মা।
এবার বল আমি হঠাৎ এতদিন পর রান্না করছি কেন?
ডালিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমেরিকা থেকে ভাইজান আসব, এইজন্য।
নাসিমা বেগম খুবই অবাক হলেন, এই কথা তুই জানলি কী করে? তোর খালুজান বলছে? সে আমার চিঠি আমার আগে নিজে খুলে পড়ছে?
আমারে কেউ কিছু বলে নাই খালাম্মা।
তাহলে বুঝলি কীভাবে?
সকালে চিঠি আসনের পর থেইকা আপনেরে দেইখা আন্দাজ করছি।
নাসিমা বেগম কিছুক্ষণ ডালিয়ার দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, দুনিয়াতেতো দেখি আমি ছাড়া আর সকলেই বুদ্ধির মহাসাগর। আমিই একমাত্র গাধা!
.
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে নাসিমা বেগম লতিফুর রহমানকে ডেকে বললেন, আমি গ্রামে যাব।
গ্রামে? এখন? বাড়ির এই অবস্থা রেখে?
বাড়ির কী অবস্থা?
এখনো ভাড়ার কোনো ব্যবস্থা হলো না। কত কাজ বাকি। এখন গ্রামে গেলে এসব দেখবে কে?
আমিতো বলিনি যে তোমাকেও যেতে হবে।
এই শরীরে তুমি একা অতদূর যেতে পারবে?
পারব। আমাকে বাসে তুলে দিলেই হবে।
কিন্তু এখনই গ্রামে কেন?
এখনতো বলিনি! আরো দিন পনেরো পর। আগেভাগেই জানিয়ে রাখলাম।
কিন্তু বাড়িতে কী?
নাসিমা বেগম এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তিনি ঘর বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন। সৈকত দেশে আসছে, এটা তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, সৈকতের জন্য কী করবেন! সৈকত কি এখনো আগের মতো গুঁড়ো চিংড়ি দিয়ে কচুর লতি, ঝাঁজালো সর্ষে তেলে কচুমুখির ভর্তা, বোম্বাই মরিচ দিয়ে খেসারির ডাল পছন্দ করে? ইলিশের মাথা দিয়ে লাউ, কড়কড়ে ভাজা পুঁটি মাছ, আগের রাতে রান্না করা গরুর মাংসের তরকারির কথা মনে আছে তার? থাকলেও এখানে এগুলো কোথায় পাবেন তিনি? আর পেলেও সেগুলোতো আর সেই আগের মতো নেই। জমিতে কৃত্রিম সারের কারণে সব হাইব্রিড ফলন, বাজারে আসতে না আসতেই ফরমালিন, এসব তিনি তার ছেলেকে খাওয়াবেন না। নাসিমা বেগম নিজেই তাই গ্রামে যাবেন, দীর্ঘ সময় থেকে, দেখে বুঝে-শুনে সৈকত আসার আগে আগেই রাজ্যের খাবার-দাবার নিয়ে ফিরে আসবেন।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য নাসিমা বেগমের একা যেতে হলো না। লতিফুর রহমানই নিয়ে গেলেন নাসিমা বেগমকে। সঙ্গে গেল ডালিয়াও। অত বড় বাড়ি খালি ফেলে আসতে মন সায় দিচ্ছিল না লতিফুর রহমানের। যদিও বাড়ির সীমানাপ্রাচীর যথেষ্টই উঁচু এবং অনতিক্রম্য। তারওপর মূল ভবনের কলাপসিবল গেটখানাও দুর্ভেদ্যই। আর এখানে চিন্তারও অবশ্য কিছু নেই। বড়জোর ছিঁচকে চোরেদের উৎপাত হতে পারে। তবে অবস্থাদৃষ্টে তাও কঠিন।
.
দিন সাতেক গ্রামে থেকে তারা ফিরে এলেন। নাসিমা বেগম রাজ্যের তরি তরকারি, মাছ, খাবার নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন এনায়েত নামের সতেরো-আঠারো বছরের এক ছেলেকেও। এই ছেলে বাড়ির দারোয়ানের কাজটা অন্তত করতে পারবে। নাসিমা বেগমকে খুব ফুরফুরে লাগছে। বাড়িতে আসার পরপরই তিনি ঢুকে গেলেন রান্নাঘরে। লতিফুর রহমানও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এই প্রতিটি দিন তিনি সারাক্ষণ বাড়ির চিন্তায় তটস্থ হয়ে ছিলেন। বাড়িতে ঢুকেই তাই চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখলেন। যেমন রেখে গিয়েছিলেন, সবকিছু ঠিক তেমনই আছে। কোথাও কোনো সমস্যা নেই, পরিবর্তন নেই। বুকের ভেতর চেপে থাকা তীব্র অস্বস্তিকর অনুভূতিটা দ্রুতই কেটে গেল।
.
দুঃসংবাদ দুটি এলো এর পরপরই। বাড়ি ফিরেই সৈকতের আরো একটি চিঠি পেলেন নাসিমা বেগম। চিঠিতে সৈকত জানিয়েছে, সে আগামী মাসে দেশে আসতে পারছে না। স্কুল বাস দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে তার ছোট মেয়ে। প্রায় ছয় জন বাচ্চা মারাও গিয়েছে। যদিও সৈকতের ছোট মেয়েটির অবস্থা ততটা গুরুতর কিছু নয়, কিন্তু তারপরও এই ঘটনায় পুরো পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। ফলে এই মুহূর্তে দেশে আসার ডেট বলতে পারছে না সে।
.
দ্বিতীয় ঘটনাটি ভয়াবহ। গ্রাম থেকে ফেরার পরদিন দুপুরে আবার ভাড়াটে এলো। শহরে যে নতুন ব্যাংক এসেছে তার ম্যানেজার সাহেব এসেছেন বাসা দেখতে। তার সঙ্গে কথা বলে রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলেন লতিফুর রহমান। তিনি আগ্রহ নিয়ে তাকে তিনতলার ঘরগুলো দেখাতে নিয়ে গেলেন। নিচের তুলনায় এখানকার ঘরগুলো বেশ বড়, খোলামেলা। অগ্রিম কিছু টাকা পেলে ঘরগুলোকে চমৎকার বসবাস উপযোগী করে দেয়া যাবে।
লতিফুর রহমান ঘরের তালা খুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়লেন। নতুন তালা লাগিয়েছিলেন প্রতিটি দরজায়। সেই তালা প্রায় আট-দশ দিন ভোলা হয়নি বলে শক্ত হয়ে আটকে আছে। অনেক কসরত করে খুলতে হলো তালাগুলো। কিন্তু ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই বিকট দুর্গন্ধে লতিফুর রহমানের পেট গুলিয়ে উঠল। পাকস্থলী যেন ঠেলে বের হয়ে আসতে চাইছে। লতিফুর রহমান দুহাতে নাক মুখ চেপে ধরে দরজার কাছটায় খানিক দাঁড়িয়ে রইলেন। দীর্ঘ দিনের আকাঙ্ক্ষিত ভাড়াটে তার সঙ্গে। অথচ তার সামনেই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি! এর চেয়ে বাজে, বিব্রতকর আর কিছু হতে পারে না।
.
লতিফুর রহমান হতভম্ব অবস্থা কাটানোর জন্য হাসতে চেষ্টা করলেন, ইঁদুর বেড়াল কিছু একটা পচে আছে, বুঝলেন ভাই সাহেব? এত বড় বাড়ি, মানুষ বলতে আমরা মাত্র দুজন। তাও আপনার ভাবি হলেন বারো মাসি রোগী। আমি একা তো এই বাড়ি দেখাশোনা করে রাখতে পারি না। আপনারা যদি আসেন, তাহলে একদম নিজেদের বাড়ি মনে করে থাকবেন, দেখাশোনা করবেন।
রুমালে নাক মুখ ঢেখে মুখভঙ্গি আড়াল করে রাখা নতুন ভাড়াটে তাতে সন্তুষ্ট হলেন কি না বোঝা গেল না।
লতিফুর রহমান ড্রইং, ডাইনিং, রান্নাঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজলেন, কোথাও পচা-গলা কিছু দেখতে পেলেন না। দেখতে পেলেন না প্রথম দুটি বাথরুমেও। তৃতীয় বাথরুমটি মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে। লতিফুর রহমান সেই বাথরুমের দরজাটা খুললেন। তারপর চিৎকার করতে গিয়েও আচমকা থমকে দাঁড়ালেন। তার হাত-পা কাঁপছে। তিনি টলছেন। মনে হচ্ছে তার চারপাশের জগৎটা চরকির মতো পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরছে। পেটের ভেতর গুলিয়ে বমি হয়ে উঠে আসছে নাড়ি-ভুঁড়ি। তিনি তীব্র আতঙ্ক নিয়ে আরো একবার চোখ মেলে তাকালেন।
বাথরুমের মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে আছে একটা লাশ। লাশটার গলা থেকে মাথাটা প্রায় ছুটে এসে বিভৎসভাবে ঝুলে আছে বুকের ওপর। পচে যাওয়া লাশটার শরীর বেয়ে ভনভন করে উড়ছে মাছি।
.
০২.
লতিফুর রহমান ঝট করে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে ফেললেন। যেন আচমকাই বুঝতে পারলেন, এই ঘটনা এখুনি কাউকে জানতে দেয়া যাবে না। আগে বুঝতে হবে ঘটনা আসলে কী ঘটেছে! ব্যাংকার ভদ্রলোকের নাম রফিকুল ইসলাম। তিনি তখনো ড্রইংরুমেই দাঁড়িয়ে। তার ঘুণাক্ষরেও ধারণা নেই যে ঠিক পাশের ঘরেই কী অবিশ্বাস্য এক ভয়াবহ ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন লতিফুর রহমান। তিনি নাকে-মুখে রুমাল চেপে ধরেই বেড রুমের দরজায় উঁকি দিলেন, কিছু পেলেন স্যার?
লতিফুর রহমান যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললেন, কিছুতো পেলাম না। দেখি, বাইরের ঘরে বা ছাদে কিছু মরে পচে রয়েছে কি না!
রফিকুল ইসলামও আর বেশিক্ষণ এখানে থাকতে চাইছিলেন না। লতিফুর রহমানের সঙ্গে তিনিও তটস্থ ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হয়ে এলেন।
.
রফিকুল ইসলামকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন লতিফুর রহমান। তারপর ‘টু লেট’ লেখা সাইনবোর্ডটা সরিয়ে ফেললেন গেট থেকে। তিনি চান না, এই মুহূর্তে আর কেউ বাড়ি ভাড়া নিতে আসুক। ঘটনা এখনো মাথায় ঢুকছে না লতিফুর রহমানের। এই বাড়ির প্রতিটি ঘরের চাবি প্রতি মুহূর্তে তার কাছেই থাকে। তিনি ছাড়া অন্য কারো কাছে কোনোভাবেই এই চাবি যাওয়ার সুযোগ নেই। শুধু তাই-ই না, গ্রামে যাওয়ার আগে তিনি নিজ হাতে প্রতিটি ঘরের দরজা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে তারপর গিয়েছিলেন। এরপর এই এতদিনে যে আর একটা ঘরও খোলা হয়নি সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। এমনকি এই ঘরটা আজ চাবি দিয়ে খুলতে গিয়েও প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়েছে তার। ঘরের কোনো দরজা কোথাও ভাঙা নেই, কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, তাহলে ঘটনা কী ঘটেছে? কীভাবে ঘটেছে?
লতিফুর রহমান বাকিটা সময় থম মেরে বসে রইলেন। জোহরের আজান হলেও তিনি উঠলেন না। তার মাথায় হাজারটা প্রশ্ন, কিন্তু সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। এ যেন রীতিমতো ভৌতিক ঘটনা! মাঝখানে একবার মনে হলো তিনি ভুল দেখেছেন, এই বয়সে এসে হ্যাঁলুসিনেশন হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তিনি উঠে গিয়ে আবার দেখে এলেন। বাথরুমের দরজা খোলার সাহস এবার আর তার হলো না। কিন্তু পচা লাশের বিকট গন্ধেই তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন, তিনি ভুল কিছু দেখেননি।
লতিফুর রহমান সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। সারা জীবন পড়িয়েছেনও বাংলা সাহিত্য। সেই সুবাদেই প্রচুর বই পড়ার অভ্যাস তার রয়েছে। কঠিন জীবনবোধ সম্পন্ন ধ্রুপদি সাহিত্য যেমন পড়েছেন, পড়েছেন নানা ধরনের গল্প, উপন্যাস, দেশি-বিদেশি থ্রিলারও। ঠিক এসব কারণেই কিনা কে জানে, এই পরিস্থিতিতেও খানিকটা হলেও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে ভাবতে পারছেন তিনি। স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারছেন, একটা অবশ্যম্ভাবী ভয়ংকর বিপদে পড়তে যাচ্ছেন তিনি। কিংবা পড়েই গেছেন। এই বিপদ এড়িয়ে যাওয়ার সহজ কোনো উপায় তার জানা নেই। মৃত মানুষটাকে তিনি চেনেন না, জানেন না। কীভাবে কী ঘটেছে সে সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই। অথচ তারপরও বিপদের পুরোটাই এখন তার ঘাড়ে। এই বিপদ থেকে সহজে মুক্তি নেই তার। পচা-গলা লাশটা এখনো পড়ে আছে তার বাড়িতে।
.
সেই সারাটা দুপুর-বিকেল তিনি থম মেরে বসেই রইলেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। খেতে গেলেন না। এক মনে ঘণ্টার ঘণ্টা বসে রইলেন একা। কী জানি কী ভাবনায় বুঁদ হয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ উঠে নতুন ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে মাগরিবের নামাজ পড়তে গেলেন পলাশবাড়ি শহরে। তার বাড়ি থেকে পলাশবাড়ি কিছুটা দূরে হলেও এই মসজিদে তিনি প্রায়ই নামাজ পড়তে আসেন। আজ নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে আবিষ্কার করলেন মসজিদের সিঁড়িতে রাখা তার জুতো জোড়া খুঁজে পাচ্ছেন না। কিছুদিন আগেও এই ধরনের সমস্যাগুলো এখানে ছিল না। যত দ্রুত শহর গড়ে উঠছে, তত দ্রুত মানুষ বাড়ছে, তারচেয়েও বেশি দ্রুত বাড়ছে অপরাধ। সঙ্গে আরো একটা জিনিস বেড়েছে, তা হলো শহরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি। এই বর্ষার মৌসুমেও যেন বিরাম নেই। মাসের পর মাস ধরে এই খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই। রাস্তায় হাঁটতে গিয়েও ভারি বিড়ম্বনায় পড়তে হয় পথচারীদের।
চারদিকে গর্ত, খানাখন্দে ভরে গেছে রাস্তা। এই রাস্তায় এখন খালি পায়ে হেঁটে এতটা দূর পথ ফিরবেন কী করে তিনি! মসজিদের উল্টোদিকে রাস্তার পাশে হারাধন মুচির দোকান। শহরে মানুষের আনাগোনা ক্রমশই বাড়ছে। ফলে প্রায় ছ সাত মাস হলো আগের জায়গা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে এখানে চলে এসেছে হারাধন। এখানে তার ব্যবসা জমেছেও ভালো। যদিও দোকানে ইলেক্ট্রিসিটির সংযোগ এখনো পায়নি। কেরোসিনের কুপির আলোয় কাজ করছে হারাধন আর তার দু’জন কর্মচারী। লতিফুর রহমান রাস্তা পার হয়ে হারাধনের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই হারাধন মাথা তুলে তাকাল। তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণামের ভঙ্গি করে বলল ছারের পাও খালি কেন? জুতা ছিঁড়ছে?
লতিফুর রহমান বললেন, নারে হারাধন, জুতা ছেড়ে নাই। নামাজ পড়ে বের হয়ে দেখি জুতাজোড়া নেই, এখন এতটা পথ খালি পায়ে হেঁটে যাব কী করে! তোর কাছে অতিরিক্ত স্যান্ডেল থাকলে একজোড়া দিতে পারিস। কাল দিয়ে যাব।
হারাধন কিছুক্ষণ কী ভাবল! তারপর একজোড়া স্যান্ডেল বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই জোড়া নিয়া যান স্যার। এই স্যান্ডেলের কাস্টোমার কবে আসে ঠিক নাই। অন্যদেরটা দিলে টেনশন। একটু পরেই আইসা আচমকা চাইয়া বইলে তখন কী করব?
লতিফুর রহমান স্যান্ডেল জোড়া পায়ে দিলেন। কম বয়সি ছেলেদের স্যান্ডেল হলেও পায়ে বেশ মাপ মতোই হয়েছে। হাঁটতেও সমস্যা হচ্ছে না।
.
শহর থেকে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্রও কিনলেন লতিফুর রহমান। সঙ্গে কিনলেন নাইলনের শক্ত দড়ি আর একজোড়া গ্লাভস। তারপর মোবাশ্বেরের চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চাও খেলেন। রাস্তার খনন কাজ করতে আসা শ্রমিকরা সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর এই সন্ধেবেলা একটু বিশ্রাম পায়। আর তারপরই মোড়ের এই চায়ের দোকানটাতে সস্তা বিড়ি-সিগারেট ধরিয়ে জমিয়ে আড্ডায় দেয়। তাদের কাছ থেকেই খবরটা প্রথম শুনলেন লতিফুর রহমান। এলাকার বর্তমান চেয়ারম্যান চুন্নু মিয়ার ভাগ্নে লিখনকে নাকি বেশ কিছুদিন ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এই নিয়ে থানা পুলিশও হয়েছে। কিন্তু কোথাও তার কোনো খোঁজ নেই।
লতিফুর রহমান কান খাড়া করে বাকি আলোচনাও শুনলেন। শুনে বুঝলেন, শুধু শ্রমিকদেরই না, শহরের বাদ বাকি আর সবার আলোচনার বিষয়বস্তুই ওই একই। নানাজন একইসঙ্গে নানা কথা বলছে। কেউ কারো কথা শুনছে না। তবে লতিফুর রহমান মনোযোগ দিয়ে সবার কথাই শুনলেন। শুনে যা বুঝলেন, লিখন বছরখানেক ধরেই এখানে মামার বাসায় থাকছে। পড়াশোনায় ভালো না বলে তার মা তাকে বড় ভাই চুন্নু মিয়ার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যদি চুন্নু মিয়া তাকে কোনো কাজে লাগতে পারেন! কিন্তু তিন-তিনবার ম্যাট্রিক ফেল করা লিখনকে কোনোভাবেই বশে আনতে পারেননি চুন্নু মিয়াও। শেষ অবধি সামনের নির্বাচনের জন্য যে নির্বাচনী প্রচারণা হবে, তার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন ভাগ্নের হাতে। সঙ্গে প্রচারণার কাজে খরচ করার জন্য বেশ কিছু টাকা-পয়সাও দিয়েছিলেন। সেই টাকা নিয়েই সম্ভবত ভেগেছে লিখন।
.
লতিফুর রহমান বাসায় ফিরে কারো সঙ্গে তেমন কোনো কথাবার্তা বললেন না। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন বারান্দায়। আকাশে থেমে থেমে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রাতে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এটি একদিক থেকে ভালো। তিনি মনে মনে বৃষ্টির অপেক্ষাই করছেন। আজ রাতে ঝড়-বৃষ্টি হলে তার জন্য খুব সুবিধা হয়। মনে মনে একটা পরিকল্পনা করেছেন তিনি। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ঝড় বৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই।
প্রকৃতি যেন তার ইচ্ছেটাই পূরণ করে দিল। রাত এগারোটার দিকে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। সন্ধ্যে নামতেই ঘুমিয়ে জল হয়ে গেছে ডালিয়া। এমনিতে নাসিমা বেগমের রাতে ঘুম হয় না। সারারাত বলতে গেলে জেগেই থাকেন তিনি। কিন্তু আজ তাকে গোপনে ডাবল ডোজ ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন লতিফুর রহমান। ফলে তিনিও এখন বেঘোরে ঘুমুচ্ছেন। শত ডাকলেও এই রাতে আর তাদের ঘুম ভাঙবে না। লতিফুর রহমান অবশ্য তা চানও না।
.
তিনি গভীর রাতে তিনতলার ঘরটাতে গেলেন। তার এক হাতে টর্চ। আরেক হাতে প্লাস্টিকের শক্ত বস্তা। বস্তার ভেতর রাজমিস্ত্রিদের নানা যন্ত্রপাতি। এ বাড়িতে এখনো কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে বলে ছোটখাটো যন্ত্রপাতিগুলো তারা রেখে গিয়েছিল। লতিফুর রহমান ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর বেডরুমের বাথরুমটার সামনে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে শক্ত করে নিজের নাক বেঁধে নিলেন।
সন্ধ্যায় শহর থেকে একজোড়া গ্লাভস কিনে এনেছিলেন, সেই গ্লাভসজোড়া হাতে পরে নিয়ে দরজাটা খুললেন তিনি। হাতের টর্চটা জ্বালাতেই দুপুরের সেই গা হিম করা অনুভূতিটা যেন শতগুণ বেশি হয়ে ফিরে এলো।
বাইরে তখন প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝোড়ো হাওয়ায় আশপাশে কোথাও গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে। একটানা বৃষ্টির শব্দ কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে। লতিফুর রহমান জানেন না, এ কারণেই কি না, তিনি নিজেকে একটা ঘোরের মধ্যে আবিষ্কার করলেন। এরপরের ঘটনাগুলো যেন বাস্তবের লতিফুর রহমান নন, এক ঘোরগ্রস্ত মানুষ করে চললেন। অনেক কষ্টে লাশটাকে বস্তার ভেতর ঢোকালেন তিনি। হাতে গ্লাভস থাকলেও লাশের পচা মাংসে দেবে যাওয়া হাতজুড়ে বিশ্রি একটা গা ঘিনঘিনে অনুভূতি লেগে রইল। পেটের ভেতরের নাড়ির ভূড়িগুলো যেন সব বের হয়ে যেতে চাইছে বমি হয়ে।
.
লাশটাকে বস্তাবন্দি করে বস্তার দু পাশটা শক্ত করে নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলেন লতিফুর রহমান। তারপর দু প্রান্তের দড়ি একসঙ্গে ধরে টেনে বের করে আনলেন বাথরুম থেকে। এবার পাশে সাজিয়ে রাখা ছোটখাটো যন্ত্রপাতিগুলোর ভেতর থেকে একটা ধারালো হ্যাক স’ ব্লেড বের করে নিলেন তিনি। তারপরের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পেছনের দিকের বড় জানালাটার গ্রিল কেটে জানালাটা ফাঁকা করে ফেললেন। সেই ফাঁক দিয়ে গলিয়ে দিলেন লাশসহ বস্তাটা। উল্টাদিকের জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে রাখলেন বস্তার সঙ্গে বাঁধা নাইলনের দড়িগুলোর প্রান্ত। তারপর ধীরে ধীরে ছেড়ে দিতে লাগলেন দড়ির অবশিষ্ট অংশগুলো।
.
দড়িতে ঢিল দিতেই বস্তাসহ লাশটা তিনতলা ভবনের পেছনের দেয়াল ঘেঁষে নেমে যেতে লাগল নিচে। সীমানাপ্রাচীরের উচ্চতা থেকেও বেশ খানিকটা নিচে নেমে আসতেই দড়িতে ঢিল দেয়া থামিয়ে দিলেন লতিফুর রহমান। দড়ির দু পাশের প্রান্তই আবার শক্ত করে বেঁধে দিলেন উল্টো দিকের জানালার গ্রিলে। তারপর টর্চ হাতে বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে। হাতে একখানা কাস্তে নিয়ে আপাদমস্তক রেইন কোট আবৃত হয়ে সন্তর্পণে নেমে গেলেন বৃষ্টির মধ্যে। তারপর বা দিকটা ঘুরে চলে এলেন ভবনের পেছনে যেখানে দড়ির মাথায় বস্তাটা আড়াআড়ি ঝুলছে।
ছাদ ঢালাইয়ের সময় ব্যবহৃত অসংখ্য বাঁশ সেখানে স্থূপ করে রাখা হয়েছে। সেই বাশ থেকে একটা বাঁশ তুলে নিলেন লতিফুর রহমান। তারপর দড়ির মাথায় ঝুলতে থাকা বস্তাবন্দি লাশটাকে বাঁশের মাথায় ঠেলে দেয়ালের বাইরে নিয়ে গেলেন। এই বয়সে এসে এতটা মানসিক এবং শারীরিক পরিশ্রম তার শরীর নিতে পারছে না। প্রবল ঝড় বৃষ্টির মধ্যেও কুলকুল করে ঘামছেন তিনি। ভারি নিঃশ্বাসের সঙ্গে হাপরের মতো কাঁপছে বুক। শ্বাস নিতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কিন্তু এখনো অনেক কাজ বাকি।
লতিফুর রহমান এবার হাতের কাস্তেখানা বাঁশের মাথায় শক্ত করে বেঁধে নিলেন। তারপর আবার ঘুরে চলে এলেন বাড়ির সামনের দিকে। জায়গাটাতে এর মধ্যেই প্রায় হাঁটু পানি জমে গেছে। তিনি আলো না জ্বালিয়েই অন্ধকারে হেঁটে গেটের কাছে পৌঁছে গেলেন। বাড়ির নবনিযুক্ত দারোয়ান এনায়েত এরই মধ্যে ঘুমিয়ে জল হয়ে গেছে। এমন ঝড়-বৃষ্টি না থাকলে এতক্ষণে হয়তো তার নাসিক্যধ্বনিও শোনা যেত!
লতিফুর রহমানের অবশ্য এতে সুবিধাই হয়েছে। তিনি চান না, এই ঘটনা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানুক। তাই খুব ভেবে-চিন্তে, সতর্ক ভঙ্গিতে পা ফেলতে হচ্ছে তাকে। সন্তর্পণে গেটের তালা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। ডান পায়ে সমস্যা বলে জল-কাদায় হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তারপরও যতটা সম্ভব দ্রুত সীমানাপ্রাচীরের পাশ ঘুরে বাড়ির পেছনে চলে এলেন। সেখানে দেয়ালের বাইরে দড়ির সঙ্গে লাশভর্তি বস্তাটা ঝুলছে। লতিফুর রহমান বাঁশের মাথায় বাঁধা কাস্তেখানা দিয়ে বস্তার দুই পাশে বাধা দড়িগুলো কেটে দিলেন। প্রথমে ঝপাৎ করে একটা শব্দ হলো। দেয়ালের গা ঘেঁষে পায়ে হাঁটা সরু পথের ওপর বস্তাটা পড়েই গড়িয়ে নেমে গেলে ও পাশের জলাশয়ে। বর্ষাকলে জলে টইটম্বুর নদীটা আশেপাশের খানাখন্দগুলোকেও গভীর জলাশয় বানিয়ে ফেলেছে।
লতিফুর রহমান বাঁশের মাথায় ঠেলে বস্তাটাকে আরো দূরে সরিয়ে দিলেন। প্রবল বৃষ্টির কারণে চারপাশের উঁচু ভূমি থেকে স্রোতের মতো নেমে আসছে জল। সেই জলের স্রোতে ডুবতে ডুবতেও ক্রমশই মূল নদীর দিকে চলে যেতে থাকল বস্তাবন্দি লাশটা! লতিফুর রহমানের শরীরে যেন আর বিন্দুমাত্র শক্তিও অবশিষ্ট নেই। প্রায় শেষ রাতের দিকে তিনি যখন তার নিজের ঘরে ফিরে এলেন, তখনো লতিফুর রহমানের বিশ্বাস হচ্ছে না, খানিক আগের কাজগুলো সত্যি সত্যিই তিনি করেছেন। মনে হচ্ছে, এই পুরো ঘটনাটাই তার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। বাস্তবে এমন কিছুই ঘটেনি।
.
পরদিন লতিফুর রহমানের ঘুম ভাঙল বেলা করে। প্রচণ্ড জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে গা। সারা শরীরে অসহনীয় ব্যথা। কিন্তু তারপরও তিনি উঠে দাঁড়ালেন। কাল রাতের ঘটনা এখনো তার অবিশ্বাস্য লাগছে। মনে হচ্ছে পুরোটাই স্রেফ কল্পনা। লতিফুর রহমান টলতে টলতে উঠে তিনতলার ঘরটাতে গেলেন। সেখানে জানালার গ্রিলের সঙ্গে বাঁধা নাইলনের দড়ি জোড়া এখনো তেমনি আছে। উল্টোদিকের জানালার গ্রিল কাটা। কাটা গ্রিলখানা জানালার পাশেই দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে রাখা। লতিফুর রহমান মুহূর্তেই সতর্ক হয়ে উঠলেন। দড়িগুলো এখনো বাইরে ঝুলছে! তিনি দড়িগুলোকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলেন। তারপর গ্লাস টেনে ভালো করে বন্ধ করে দিলেন জানালাটা, যেন বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা না যায়!
ওই ভয়াবহ অসুস্থ শরীরেও বাথরুমের মেঝেটা ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে ফেললেন। দরজাটা তালাবন্ধ করে যখন তিনি নিজের ঘরে ফিরলেন, তখন তার শরীরে আর দাঁড়িয়ে থাকারও শক্তি নেই। কোনো মতে নিজেকে টেনে নিয়ে ফেললেন বিছানায়। তারপর আর কিছু মনে নেই লতিফুর রহমানের।
.
লতিফুর রহমানের জ্ঞান ফিরল কিংবা ঘুম ভাঙল রাতে। তার পাশে বসে আছেন উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার। তিনি জ্বরের ওষুধের সঙ্গে স্বল্পমাত্রার ঘুমের ওষুধও দিয়ে দিলেন। পরদিন দুপুর অবধি আবারো একটানা ঘুমালেন লতিফুর রহমান। জ্বরটা ততক্ষণে কমেছে। তবে শরীর ভীষণ দুর্বল। দুপুরে কিছু খাবার আর ওষুধ খেয়ে আবার ঘুমালেন তিনি। ঘুমের ভেতর আজেবাজে সব স্বপ্নও দেখলেন। তার ঘুম ভাঙল রাতে। সেই সারা রাত আর ঘুমাতে পারলেন না। মাথার ভেতর গিজগিজ করছে অসংখ্য প্রশ্ন, অসংখ্য জিজ্ঞাসা, সঙ্গে শঙ্কাও। লতিফুর রহমান এখনো ভেবে পাচ্ছেন না, ওই লাশটা তার বাড়ির তিনতলার ওই ঘরে এলো কী করে? এই বাড়িতে প্রতিটি মানুষকে তার চোখের সামনে দিয়ে ঢুকতে হয়। তার চোখের আড়ালে ঢোকার কোনো উপায় নেইও। অতি ধূর্ত, বেপরোয়া কেউ যদি কোনোভাবে দেয়াল টপকে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে, তারপরও সে মূল ভবনের কলাপসিবল গেট না ভেঙে কোনোভাবেই দোতলা-তিনতলায় উঠতে পারবে না। অথচ সেই তিনতলার একটি কক্ষেই জ্বলজ্বান্ত একটি মানুষকে খুন করা হয়েছে? কীভাবে? লতিফুর রহমান কোনোভাবেই, কোনো যুক্তিতেই হিসেব মেলাতে পারেন না। পুরো বিষয়টিই তার কাছে অসম্ভব মনে হয়, অবিশ্বাস্য লাগে!
.
এই বাড়ির চাবিগুলো কেবল তার কাছেই থাকে। ফলে তালা না ভেঙে অন্য কারো পক্ষে কখনোই ওই ঘরের দরজা খোলা সম্ভব না। লতিফুর রহমান তালাটা বারবার পরীক্ষা করে দেখেছেন। কোথাও সামান্য আঁচড় অবধি নেই। তাছাড়া, ওভাবে একটা মানুষকে একা একা কারো পক্ষে খুন করাও সম্ভব নয়। এর মানে খুনি একাধিক। তার চোখের অগোচরে এই বাড়িতে একাধিক মানুষ ঢুকে একজনকে খুন করে রেখে চলে গেল, আর তিনি কিছুই টের পেলেন না, এটা অসম্ভব! এমনও নয় যে তিনি যখন গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন তখন এই ঘটনা ঘটেছে। সে সম্ভাবনাও তিনি তলিয়ে দেখেছেন। কোনো উত্তর পাননি। বাড়ির মূল গেট, কলাপসিবল গেট এমনকি যে ঘরে ঘটনা ঘটেছে, সেই ঘরের চাবি অবধি তিনি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবং যেমন রেখে গিয়েছিলেন, প্রতিটি গেট অবিকল তেমনই ছিল। খুন হওয়া ঘরের দরজা, দরজার তালা, কোথাও সামান্য দাগও নেই। ফলে এটাও মেনে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই যে ওই সময়েই ঘটনাটা ঘটেছে। তা ছাড়া লতিফুর রহমান লাশটা দেখেছেন। ওই লাশ দু-চার-পাঁচ দিনের লাশ নয়। লাশ দেখে তিনি মোটামুটি নিশ্চিত যে খুনটা হয়েছে তারা গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগেই। কিন্তু কিভাবে?
লতিফুর রহমান কিছুতেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেন না। তার খুব অস্থির এবং দিশেহারা লাগতে লাগল। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘটনা তিনি কাউকে বলতেও পারছেন না।
.
০৩.
পলাশবাড়ি থানার নতুন সাব-ইন্সপেক্টরের নাম রেজাউল হক। রেজাউল হকের বয়স একত্রিশ। লোকে তাকে সংক্ষেপে রেজা বা হক সাহেব বলেই ডাকে। তিনি এ এলাকায় এসেছেন মাস চারেক হবে। নতুন থানার ওসি সাহেব এখনো আসেননি বলে রেজাউল হকের ওপর বেশ দায়িত্ব। তার নাকের নিচে বিছার মতো ছড়ানো গোঁফ। এই গোঁফের কারণেই তাকে দেখতে তার বয়সের চেয়ে ভারিক্কী লাগে। রেজা এই মুহূর্তে তার গোঁফ নিয়ে মহা বিরক্ত। তার অনেক বদ অভ্যাসের মধ্যে একটি হচ্ছে পিরিচে চা ঢেলে চুমুক দিয়ে চা খাওয়া। গত কয়েকদিনের নানা ঝামেলার কারণে তিনি তার গোঁফটা ঠিকঠাক মতো ছাটতে পারেননি। ফলে পিরিচে চুমুক দিয়ে চা খেতে গিয়ে পড়েছেন ঝামেলায়। যতবারই চায়ে চুমুক দিতে গিয়েছেন, ততবারই ঠোঁটের সঙ্গে সঙ্গে তার গোঁফও চুমুক দিয়েছে চায়ে। পিরিচ থেকে মুখ তুলতেই দেখা যাচ্ছে গোঁফ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় দুধ চা টুপটাপ ঝরে পড়ছে। ব্যাপারটা দেখতে বিশ্রী। এই মুহূর্তে আরো বেশি বিশ্রী লাগছে, কারণ তার সামনে পচা-গলা একটা লাশ পড়ে আছে।
.
এই লাশ পেয়েছে নদীর জেলেরা। তাদের জালে লাশ উঠে এসেছে। তবে ঘটনা হচ্ছে, লাশ মূল নদীতে পাওয়া যায়নি, পাওয়া গেছে নদীর পাশের অগভীর জলাশয়ে। লাশের তীব্র গন্ধে কেউ কাছে ভিড়তে পারছে না। অথচ সেই লাশের
পাশে বসেই নির্বিকার ভঙ্গিতে পিরিচে ঢেলে চা খাচ্ছেন রেজাউল হক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না, এই লাশ নিয়ে তিনি খুব একটা চিন্তিত।
তবে বিষয়টা চিন্তিত হওয়ার মতোই। লাশের চেহারা ছবি দেখে এখন আর পরিচয় বোঝার উপায় নেই। তবে পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে ধারণা করা হচ্ছে। বর্তমান চেয়ারম্যান চুন্নু মিয়ার ভাগ্নে লিখনের লাশ এটি। চুন্নু মিয়া এলাকার প্রভাবশালী লোক। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় রাজনীতিতে তার ভূমিকা প্রবল। দিন দশেক আগে লিখন যখন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, তখনই বিষয়টা পুলিশকে জানিয়েছিলেন চুন্নু মিয়া। পুলিশ অবশ্য বিষয়টিকে তখন তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। দেখার কথাও না। লিখনের অতীত রেকর্ড ভালো নয়। যখন-তখন যেখানে-সেখানে ঝামেলা পাকানো ছিল তার স্বভাব। মামা এলাকার প্রভাবশালী লোক হওয়ায় ধরাকে সরাজ্ঞান করেই চলত সে। তার চরিত্রেও নানা দোষ ছিল। ফলে লিখনের নিখোঁজের খবর শুনে রেজাউল হক নিজেও ভেবেছিলেন মামার নির্বাচনী প্রচারণার টাকা নিয়েই সে হয়তো পালিয়েছে। কিন্তু এই শান্ত নিরুপদ্রব শহরে এমন করে একটা ছেলে খুন হয়ে যাবে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি।
রেজা অনেকক্ষণ ধরেই চুন্নু মিয়ার অপেক্ষায় বসে আছেন। তিনি এলেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। চুন্নু মিয়া এলেন ঘণ্টাখানেক পরে। লিখনকে চিনতে তার এক মুহূর্তও সময় লাগল না। লাশ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়াবহ চিঙ্কারে লাশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন তিনি। তার সঙ্গের লোকেরা অবশ্য তাকে শক্ত করে ধরে রাখল। চুন্নু মিয়ার কান্নায় ভারি হয়ে উঠল চারপাশ। লিখনের গলায় অতি সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ণ কোনো তার পেঁচিয়ে খুন করা হয়েছে। ধারালো তারের চাপে কণ্ঠনালির পুরোটাই কেটে গেছে।
এর পরের কয়েক দিনে শান্ত পলাশবাড়ি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে লাগল। আগামী উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে চুন্নু মিয়ার প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা। চুন্নু মিয়া এই খুনের জন্য সরাসরি গোলাম মাওলাকে অভিযুক্ত করে বসলেন। সমস্যা হচ্ছে তারা দুজনই একই রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা। পরের নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে সমর্থন আদায়ের জন্য দুজনই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দলের কাছে দুজনের গুরুত্বই সমান। উপজেলা নির্বাচনের বছরখানেক পরেই হবে সংসদ নির্বাচন। সুতরাং এই মুহূর্তে কেন্দ্র থেকে নীতিনির্ধারকরা চাইছেন না দলের মধ্যে
কোনো বিভেদ সৃষ্টি হোক। ফলে চুন্নু মিয়া মুখে মুখে গোলাম মাওলাকে অভিযুক্ত করলেও তার বিরুদ্ধে খুনের মামলা করার সবুজ সঙ্কেত দল থেকে পেলেন না। তা ছাড়া এই খুন যে গোলাম মাওলা করিয়েছেন এমন কোনো অকাট্য প্রমাণও চুন্নু মিয়ার কাছে নেই। তবে লিখনের খুনের বিচার চেয়ে মিছিল মিটিং, সভা-সমাবেশ হতে থাকল। সেই সভা সমাবেশে গোলাম মাওলার কর্মিদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষও হতে থাকল।
সবচেয়ে বেশি চাপে আছেন এসপি এবং এএসপি সাহেব। ঊর্ধ্বতন মহল থেকে তাদের চাপ দেয়া হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের খুঁজে বের করতে হবে। দিনের মধ্যে অসংখ্যবার এএসপি সাহেব রেজাকে ফোন করছেন। প্রতিবার ফোন করেই তিনি রেজাকে নতুন নতুন আইডিয়া দিচ্ছেন। শেষবার ঘন্টাখানেক আগে ফোন দিয়ে বললেন, শোনেন হক সাহেব।
জি স্যার।
আমার ধারণা খুনটা কে করেছে আমি সাসপেক্ট করতে পেরেছি।
কে করেছে স্যার?
আপনি বলুনতো কে হতে পারে?
আমি পারছি না স্যার।
গেজ করেন?
গেজ করতেও পারছি না স্যার।
আমার ধারণা খুনটা করেছেন চেয়ারম্যান সাহেব নিজেই।
তিনি খুন করবেন কেন?
কেন করবেন মানে? নির্বাচনের আগে আগে একটা ইস্যু তৈরি করে ফেললেন। পাবলিক সেন্টিমেন্ট তার নিজের দিকে চলে এলো। দলও তার প্রতি একটু সিমপ্যাথাইজড হয়ে গেল। বুঝলেন না বিষয়টা? রাজনীতি-রাজনীতি। রাজনীতিতে অসম্ভব বলে কিছু নেই। চুন্নু মিয়া আগেভাগেই বুঝতে পারছিলেন, এবার দল থেকে নমিনেশন পেতে তার খবর হয়ে যাবে। তা ছাড়া এতদিন চেয়ারম্যান ছিলেন, ভালো কাজতো কিছু করেন নাই। লোকজনও তার ওপর সন্তুষ্ট না, দলও না। কিন্তু এখন দেখেন? ঘটনার পর সবকিছু কিন্তু ভোজবাজির মতো পাল্টে গেছে। গেছে না?
রেজাউল হক এখন মগভর্তি করে চা খাচ্ছেন। ঠিক চা-না, তিনি আসলে মগভর্তি চায়ে ডুবিয়ে পুরি খাচ্ছেন। এটি তার খুব পছন্দের খাবার। তিনি পুরিতে কামড় বসাতে বসাতে বললেন, জি, স্যার।
একটু শার্প হতে হবে বুঝলেন হক সাহেব। এমনিতেই পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বদনামের অভাব নেই। এর মধ্যে যদি একটু চিন্তা-ভাবনা না করেন, তাহলে কেমনে হবে?
জি স্যার। রেজা পুরির বাকি অংশটুকু একসঙ্গে মুখে পুড়ে দিতে দিতে বললেন।
কী তখন থেকে শুধু জি স্যার জি স্যার করছেন? এএসপি সাহেব কিছুটা মনোঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন, বোঝা যাচ্ছে, এখন চিন্তা করে বের করেন, বিষয়টা প্রমাণ করবেন কিভাবে? অপরাধী কিন্তু প্রমাণ না রেখে অপরাধ করে না।
কিন্তু স্যার নিজের আপন ভাগ্নেকে কী কেউ…।
এএসপি সাহেব এবার যেন রেগেই গেলেন, আপনাকে পুলিশে আসতে কে বলেছে, বলেনতো রেজা সাহেব? আপনার উচিত ছিল স্কুলমাস্টার হওয়া। আদর্শলিপি পড়াতেন, আর আদর্শ প্রচার করতেন। এতদিন পুলিশে চাকরি করে এখন কী সব সাধু সন্তুর মতো প্রশ্ন করছেন, হ্যাঁ?
জি স্যার।
আরে ভাই, নিজের সন্তানকে পর্যন্ত খুন করে অন্যকে ফাঁসানোর ঘটনাও ঘটেছে, বুঝলেন?
জি স্যার।
শোনেন রেজা সাহেব, অপরাধী ধরতে হলে নিজেকে আগে অপরাধীর মতো হতে হবে। মানে, অপরাধীর মতো চিন্তা করতে হবে, বুঝলেন।
জি স্যার।
এএসপি বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোন রেখে দিলেন। রেজা আরো কিছুক্ষণ ফোন কানে চেপে ধরে বসে রইলেন। তার খুব ইচ্ছে করছে এএসপি সাহেবকে ফোন করে নরম গলায় বলতে যে, স্যার, আপনি যদি দিনের মধ্যে আমাকে এত বার ফোন দেন, তাহলে আমি ইনভেস্টিগেশন করব কখন?
রেজা অবশ্য ফোন দিলেন না। তিনি আরো এক মগ চা এবং দুটো পুরির অর্ডার দিলেন। সবচেয়ে ভালো হতো কফি হলে। কিন্তু এখানে ভালো কফি বানাতে পারে এমন কেউ নেই।
.
০৪.
পরদিন খুব ভোরে হাঁটতে বের হয়েছেন রেজা। তার সঙ্গে পুলিশের হাবিলদার শরিফুল। অল্পদিনেই নতুন সাব ইন্সপেক্টরের ভক্ত বনে গেছে সে। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে বলে বাতাস স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই ঠাণ্ডা। রেজার গায়ে পাতলা চাদর জড়ানো। তিনি ভোরের ফুরফুরে হাওয়ায় হাঁটতে হাঁটতে নদীর পারে এসে দাঁড়ালেন। ঠিক এখান থেকেই লাশটা তোলা হয়েছিল। রাস্তা থেকে সামনের জল থৈথৈ বিস্তীর্ণ এলাকাটিকেই নদী মনে হচ্ছে। যদিও রেজা জানেন, এটিও বর্ষার তৈরি একটি বিভ্রম। ছোট নদী উপচে বর্ষার জলে প্লাবিত হয়েছে দু পাড়ের নিচু জমি, খানা খন্দ, জলাশয়ও। রেজা রাস্তার পশ্চিম পাশে জল ছুঁই ছুঁই প্রান্তে এসে দাঁড়ালেন। তারপর চিন্তিত ভঙ্গিতে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, লাশটাতো এখানটাতেই পাওয়া গেছে, তাই না শরিফুল?
শরিফুল হাত তুলে খানিক বাঁয়ে ইশারা করে বলল, ওইখানে স্যার।
রেজা পশ্চিম দিকে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া সরু পথটার মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। পথের গা ঘেঁষেই লতিফুর রহমানের বাড়ির দক্ষিণ দিকের সীমানাপ্রাচীর। তিনি সেই সীমানা প্রাচীরের দিকে মুহূর্তকাল তাকিয়ে থেকে আবার চোখ ফেরালেন তার সামনের বিস্তৃত জলরাশির দিকে। তারপর বললেন, কী মনে হয়, খুনটা কী পানিতেই হয়েছে, নাকি খুন করার পর লাশ পানিতে ফেলা হয়েছে?
শরিফুল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, খুন করে এতদূর লাশ নিয়ে আসাটা রিস্কি না স্যার? আমারতো মনে হয় নদীতেই খুনটা হয়েছে।
রেজা বললেন, হুম।
শরিফুল বলল, ওইটাই সহজ। নৌকায় করে রাইতের বেলা বন্ধুবান্ধব ঘুরতে বের হইছে, বাকিরা বিষয়টা আগে থেকেই জানত। আচমকা তিন-চাইরজন মিলে ধরে…।
রেজা কথার মাঝখানে শরিফুলকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার কেন মনে হলো, বন্ধু-বান্ধব মিলে খুন করেছে? অন্য কেউওতো করতে পারে?
তা পারে। কিন্তু স্যার শরীরের আর কোথাও কিন্তু কোনো জখম নাই, আঘাতও নাই। তারপরও চিন্তা করে দেখেন, যেভাবে গলায় তার পেঁচিয়ে মারা হয়েছে, সে আগে থেকে ধারণাই করতে পারে নাই বিষয়টা। ঘটনা ঘটেছে একদম অপ্রস্তুত অবস্থায়। আচমকা।
এগুলো চিন্তা করে বের করেছো? রেজা মৃদু হাসলেন।
জি না স্যার। এমনি এমনিই মাথায় আসছে। আপনার কাছে বলতে ভালো লাগে।
আচ্ছা, কিন্তু শরিফ, যদি নদীর মাঝখানেই সে খুন হয়, তাহলে লাশ এখানে পাওয়া যাবে কেন?
নদীর যা স্রোত, ভাইসা চলে আসছে স্যার।
অত গভীর নদী থেকে এই তীরের অগভীর কোমর পানিতে ভেসে আসাটা কী স্বাভাবিক?
অস্বাভাবিকের কী হইল? এমনতো কতই হয়?
হ্যাঁ, হয়। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে লাশটা ভাসমান থাকে। এখানে লাশটা কিন্তু ডুবন্ত ছিল। ডুবন্ত লাশ নদীর ভেতর থেকে এখানে উঠে আসার কথা না।
তাইলে কী স্যার লাশটা এইখানেই ফালানো হয়েছে? শরিফুল আচমকা প্রশ্নটা করেই চুপ করে গেল, আবারো ভুল কিছু বলে ফেলেনিতো! কিন্তু রেজা তার কথাই সমর্থন করলেন, ঠিক! আমার ধারণা এটাই হয়েছে। খুনটা নদীতে হয়নি। খুন হয়েছে ডাঙায় এবং খুন করার পর লাশ এখানে ফেলে রাখা হয়েছে।
কিন্তু স্যার, তাহলে তো লাশ সবার চোখে পড়ে যাওয়ার কথা। অবশ্য ভারি কিছুতে বেঁধে ডুবাই দিয়া থাকলে ভিন্ন কথা!
একদম! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জেলেরা লাশের বা লাশের বস্তার সঙ্গে ভারী কিছু পায় নি, যা দিয়ে লাশটাকে ডুবিয়ে দেয়া হতে পারে।
তাহলে?
রেজা সামান্য চুপ করে থেকে বললেন, হতে পারে লাশটা যখন এখানে ফেলা হয়েছিল, তখন সেটির অবস্থা এমন ছিল যে, কোনোকিছু ছাড়াই সেটি আপনা আপনিই পানিতে ডুবে গেছে।
তার মানে খুন করার অনেক দিন পর পচা গলা লাশ ফালানো হইছে?
হুম, হতে পারে। হয়তো লাশটা যখন এখানে ফেলা হয়েছে, তখন সেটি পচা গলা অবস্থায়ই ছিল। তার মানে খুন করার দিন কয়েক পরে লাশটা এনে এখানে ফেলা হয়েছে!
কিন্তু এত রিস্ক নিয়া কেউ এইখানে কেন ফেলে রাখবে? রিস্ক যখন নিয়েছেই, সেতো তাহলে লাশটা মাঝ নদীতেই ফেলতে পারত, তাই না? সেইটাইতো সবচেয়ে সেফ হতো তার জন্য?
প্রশ্ন এটাই। তার মানে খুনটা যে করেছে, সে সময়মতো লাশটা সরাতে পারেনি। পরে তাড়াহুড়া করে কোনোমতে ফেলে গেছে।
কিন্তু স্যার এইখানেই কেন ফেলে যাবে?
রেজা খানিক চুপ করে থেকে বললেন, এক্ষেত্রে দুই ধরনের ঘটনা ঘটে। এক, অপরাধী তার কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতে চায় ঘটনা বা প্রমাণ। যাতে কোনোভাবেই তাকে সন্দেহ করা না যায়। দুই, সময় এবং সুযোগের অভাবে অপরাধী প্রমাণটা তার কাছাকাছি রাখতে বাধ্য হয়। সেক্ষেত্রে হয় খুনটা যেখানে হয়েছে, বা যে খুন করেছে, তার কাছ থেকে এই জায়গাটা অনেক বেশি দূর। অথবা একদম কাছে।
শেষের কথাটা বলার সময় রেজা আচমকা লতিফুর রহমানের বাড়ির দিকে তাকালেন। তার কপালে একটা চিন্তার রেখা মুহূর্তের জন্য উঁকি দিয়ে আবার উধাও হয়ে গেল। শরিফুল বলল, স্যার, আপনার কি মনে হচ্ছে, কাছে না দূরে?
রেজা আনমনা ভঙ্গিতে বললেন, এটাইতো প্রফেসর সাহেবের বাড়ি, তাই না?
জি স্যার।
এই বাড়িতে কে কে থাকে, জানো?
উনার স্ত্রী, একটা কাজের মেয়ে আর উনি।
আর কেউ না?
না স্যার।
আচ্ছা, আমি একটু এই বাড়িটাতে যেতে চাই।
কখন স্যার?
এখুনি।
.
লতিফুর রহমানের শরীর এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে এ কদিন আর মসজিদে নামাজ পড়তে যাননি তিনি, বাড়িতেই পড়েছেন। আজও নামাজ পড়ে বিছানায় শুয়েছিলেন। খানিক তন্দ্রামতোও লেগে এসেছিল। এই মুহূর্তে আতঙ্কিত ভঙ্গিতে ছুটে এলো দারোয়ান এনায়েত। সে এসে লতিফুর রহমানকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠাল, খালুজান, পুলিশ আইছে, পুলিশ।
লতিফুর রহমান ধীরে-সুস্থে উঠে বসলেন। খুব একটা তাড়াহুড়া করলেন না, যেন পুলিশ আসবে এটি তিনি আগে থেকেই জানতেন! জানালার পর্দা ফাঁক করে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে নিচে। তাদের দেখে পুলিশ বলে মনে হচ্ছে না। পুলিশ হলেও তারা আছে সাদা পোশাকে। তিনি এনায়েতের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই বুঝলি কিভাবে এরা পুলিশ?
বাড়িতে ঢুকতে চাইল, আমি বললাম, পরিচয় দেন আগে। তখনই বলল, আমরা পুলিশ।
লতিফুর রহমান ঘরের দরজা খুলে দিলেন। একটা ক্র্যাচে সামান্য ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। রেজা সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তারপর বসতে বসতে বললেন, সরি স্যার, এত ভোরে আপনাকে বিরক্ত করছি।
লতিফুর রহমান হেসে বললেন, না না। বিরক্ত কিসের?
ঘুমাচ্ছিলেন নিশ্চয়ই?
অবসর মানুষ, সারাদিনতো ওই শুয়ে-বসেই থাকি। বাড়িতেও তেমন লোকজন নেই। কেউ এলে বরং একটু গল্পগুজব করা যায়।
এত বড় বাড়ি, ভাড়া দিলেওতো পারেন। লোকজনও পেতেন কথা বলার।
এখনোতো পুরোপুরি কাজ শেষ হয়নি। আবার কাজ শেষ করার মতো টাকা পয়সাও এই মুহূর্তে হাতে নেই। কত কষ্টে যে এইটুকু করেছি, না দেখলে বোঝা যাবে না। গত একটা বছর, আমি নিজেও যেন মিস্ত্রিদের সঙ্গে থেকে থেকে তাদের কাজ শিখে-টিখে তাদের মতো মিস্ত্রিই হয়ে গেছি। হা হা হা। কত কাজ যে আমি নিজেই করেছি, আপনি দেখলে অবাক হয়ে যাবেন! এখন ভাড়া দিতে হলেওতো অন্তত মোটামুটি একটা থাকার মতো ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু আপনিতো আরো আগেই টু লেটও লাগিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তা লাগিয়েছিলাম।
কিন্তু আজতো সেটা দেখলাম না। আমিতো আরো ভাবলাম, সব ঘর ভাড়া হয়ে গেছে বলে হয়তো সরিয়ে ফেলেছেন।
লতিফুর রহমান হাসলেন, না না, তা নয়। আসলে মনমতো ভাড়াটে পাচ্ছিলাম না বলে সরিয়ে ফেলেছি। যারা আসছিল, তাদের আমার পছন্দ হচ্ছিল না, আবার আমার যাদের পছন্দ হচ্ছিল, তাদের বাসা পছন্দ হচ্ছিল না। এই জন্য ভাবলাম, আস্তে আস্তে হলেও ঘরগুলো পুরোপুরি কমপ্লিট না করা পর্যন্ত আর ভাড়াটে খুঁজব না। তাই নোটিশটাও সরিয়ে দিলাম। রোজ রোজ শুধু শুধু লোকজনের যন্ত্রণা।
এলাকায় এখন ভাড়া বাসারতো খুব চাহিদা, তাই না?
তা আছে। শহর বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। মানুষতো আসবেই। তবে ভালো ভাড়াটে পাওয়া খুব মুশকিল বুঝলেন?
ভালো ভাড়াটে কেমন?
মানে ধরেন শিক্ষিত, ছোট, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। ফাইন্যান্সিয়ালি সলভেন্ট। সারাজীবনের সঞ্চয়ের এই বাড়ি। ভাড়া দিতে কষ্টও লাগে। কিন্তু কী করব বলুন, উপায়তো নেই! ভেবেছিলাম, ভালো কিছু ভাড়াটে পেলে, অগ্রিম বাবদ কিছু টাকা নিয়ে বাকি কাজগুলো শেষ করব। কিন্তু তেমন ভাড়াটে আর পেলাম কই? এজন্যই একটু দেখে-শুনেই দিতে চাই।
তা অবশ্য ঠিক। এখন কি তাহলে পুরো বাড়িই ফাঁকা?
তা একরকম ফাঁকাই।
.
রেজা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন। শরিফুল বলল, কিছুই বুঝলাম না স্যার।
কী বুঝলে না?
প্রফেসর সাবের বাড়িতে আসলেন কেন?
দেখা করতে এলাম। বয়সতো কম হলো না শরিফুল, এবার বিয়ে শাদিতো করতে হবে। তা বৌ নিয়ে এসে কই রাখব? তোমাদের ওই ভাঙা থানায়?
এইখানে বাসা ভাড়া নেবেন?
নিতেওতো পারি। অবশ্য প্রফেসর সাহেব দেবেন কি না, সেটা একটা প্রশ্ন।
দেবেন না কেন?
ওই যে বললেন যাদের বাসা পছন্দ হয়, তাদের প্রফেসর সাহেবের পছন্দ হয় না, আবার যাদেরকে প্রফেসর সাহেব পছন্দ করেন, তাদের বাসা পছন্দ হয় না।
আপনার কোনটা স্যার?
আমিতো বাসাই দেখতে পারলাম না। বুঝব কি করে পছন্দ হলো কি না?
শরিফুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কোন একটা ঝামেলা আছে স্যার, আপনি আমার কাছে গোপন করতেছেন?
তেমন সিরিয়াস কিছু না। পুলিশের এই এক সমস্যা বুঝলে, সব কিছুতেই সন্দেহ করে।
এইখানে সন্দেহ করার কী দেখলেন?
রেজা ফস করে সিগারেট ধরিয়ে এক গাল ধোয়া ছেড়ে বললেন, হঠাৎ করেই উনি টু লেটটা সরিয়ে ফেললেন কেন, সেটাই বুঝলাম না। উনি বললেন, ঘরের অনেক কাজই এখনো বাকি। আবার সেগুলো করার মতো পয়সাও ওনার হাতে নেই। তো এমন অবস্থায় যেকোনো বুদ্ধিমান মানুষই যেটি করবে, তা হলো যেকোনো উপায়ে বাসা ভাড়া দিয়ে সেই টাকায় আগে বাকি কাজগুলো শেষ করবে। কিন্তু উনি করলেন উল্টোটা, হঠাৎ করেই টু লেট সরিয়ে দিলেন। এবং…?
এবং কী?
ঠিক এই ঘটনার সময়টাতেই। ভুলে গেলে চলবে না, লাশটা কিন্তু উনার বাড়ির পাশেই পাওয়া গেছে। অতি সতর্ক হতে গিয়ে মানুষ অনেক অস্বাভাবিক আচরণ করে।
কিন্তু স্যার, প্রফেসর সাব এইসবের লোক না। তারে এই অঞ্চলের সবাই চেনে।
রেজা এবার আর জবাব দিলেন না। তার পকেটে ফোন বাজছে। নিশ্চয়ই এএসপি সাহেব ফোন দিয়েছেন। তিনি বিরক্ত মুখে পকেট থেকে ফোন বের করলেন। ফোন করেছেন তার মা রেহানা আখতার। রেজা ফোনটা ধরলেন না।
.
০৫.
চুন্নু মিয়া থানায় এসেছেন লোকজন নিয়ে। তার সঙ্গে রয়েছে তার সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী সোহরাব মোল্লাও। সোহরাব মোল্লা দেহরক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে চুমু মিয়ার পেছনে। চুন্নু মিয়া কথা বলছেন উত্তপ্ত ভঙ্গিতে, কী শুরু করছেন আপনারা? কী শুরু করেছেন? যে খুন করছে তার কোনো খবর নাই, মাঝখান থেকে নিরীহ লোকজনকে হয়রানি করা শুরু করছেন?
রেজা বললেন, আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন চেয়ারম্যান সাহেব।
শান্ত হয়ে বসব মানে? আমার ভাগ্নেকে খুন করা হলো, সেই খুনি আর তার লোকজন এখন আমার চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, আর আপনি আমাকে বলছেন শান্ত হয়ে থাকতে?
আমাদেরতো একটু সময় দিতে হবে। আর আপনিতো ভালো করেই জানেন, চাইলেই আমরা যখন খুশি যাকে গ্রেপ্তার করতে পারি না। আমাদেরওতো অনেক জায়গায় হাত-পা বাঁধা থাকে, এটুকুতো বোঝেন?
চুন্নু মিয়া আবারও উত্তেজিত গলায় কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন, আমার একটা মাত্র ভাগ্নে, ছোট থাকতে বাবা মারা গেছে ছেলেটার। ওর জন্যই বোনটা আর বিয়ে-শাদিও করে নাই। সেই ছেলেটার…।
তিনি কথা শেষ করতে পারলেন না। ক্রোধে কিংবা কান্নায় তার গলা আটকে এলো। তিনি চাপা কিন্তু ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, দল আমাকে মামলা করার অনুমতি দেয়নি, তারা চায় আগে প্রমাণ। অযথা হয়রানি হোক এটা তারা চাচ্ছে না। কিন্তু আপনি বলেন, আপনি জানেন না, খুনটা কে করছে? জানেন না?
না, চেয়ারম্যান সাহেব। আমি সত্যিই জানি না।
আমি জানি। আমি জানি, কে খুন করছে, কেন খুন করছে? শুধু আমি না, সবাই ই জানে।
আমার ধারণা আপনিও জানেন না।
চুন্নু মিয়া এবার রীতিমতো চটে গেলেন, অবশ্যই জানি। গোলাম মাওলা, সে আমার ভাগ্নেকে খুন করেছে। সে…। সে আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছে, আমি যাতে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াই। আমার কাছে প্রমাণ আছে।
কী প্রমাণ আছে?
সে নিজে এক মিটিংয়ে বলেছে, আমি যেন সামনের বার নমিনেশন নিতে মুভ করি। আমাকে থ্রেটও করেছে সে। বলেছে, আমি যদি উল্টাপাল্টা কিছু করি, তাহলে আমার বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে। এমন ক্ষতি হবে, যা আমি চিন্তাও করতে পারব না।
তিনি এমন কিছু বলে থাকলে সেটা অবশ্যই আমরা খতিয়ে দেখব। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব, এমন কথা আপনারা পলিটিক্যাল লিডাররা একে অন্যকে অহরহ বলেন। সবকিছু যে করে দেখানোর জন্য বলেন বা চিন্তা-ভাবনা করে বলেন, তা কিন্তু না।
আপনি কিন্তু এখন জোর করে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইছেন। আপনি বলেন, সে ছাড়া এই কাজ আর কে করবে? আমার ভাগ্নেকে খুন করার সাহস এই এলাকায় আর কার আছে? সে ছাড়া আর কার বুকের পাটা এত বড়? আমার ভাগ্নে আর কার কোনো ক্ষতি করছে? আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি, হি ইজ দ্যা মার্ডারার। দল বলুক আর না বলুক, আমি মামলা করব। আই উইল ফাইল আ মার্ডার কেস এগেইনস্ট হিম। দিস ইজ ফাইনাল।
তাতেও খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
লাভ হবে না মানে?
আপনি ইমোশনালি কথা বলছেন। একটু লজিক্যালি চিন্তা করেন, সামনে ইলেকশন, আপনাদের দুজনেরই দল থেকে নমিনেশন পাওয়ার সুযোগ আছে। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য যে এবার নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনা মাওলা সাহেবেরই একটু বেশি। তার ফিল্ডও ভালো। একজন বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে, এই মুহূর্তে এত বড় একটা ভুল তিনি করবেন? আপনিই বলেন?
এখানে ভুলের কী দেখলেন?
রেজা বেল টিপে চা আনালেন। তারপর পিরিচে চা ঢালতে ঢালতে বললেন, আপনি ভালো করেই জানেন, এই ঘটনা ঘটলে উল্টো সব পাবলিক সিম্প্যাথি চলে যাবে আপনার দিকে, দলও আপনার প্রতিই সিম্প্যাথাইজড হয়ে পড়বে। এবং ঘটনা যে-ই ঘটাক, দোষটা শেষ পর্যন্ত আপনার প্রধান প্রতিপক্ষের ঘাড়েই পড়বে। আর যদি না-ও পড়ে, তারপরও আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে দোষটা তার ঘাড়ই চাপানোর। এই সুযোগটা অন্তত আপনি হাতছাড়া করতে চাইবেন না…।
দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরার মতো ফস করে জ্বলে উঠলেন চুন্নু মিয়া, তার মানে আপনি কী বলতে চাইছেন?
আমি বলতে চাইছি আপনি শান্ত হোন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। ওপর মহল থেকেও এর একটা সুষ্ঠু তদন্ত চাইছে। কোনো ধরনের ভুল ভ্রান্তি হোক, এটা তারা চাইছেন না। এখন আপনি যদি কোনো পার্টিকুলার ব্যক্তির বিরুদ্ধে দোষ চাপানোর জন্য এত তাড়াহুড়া করেন, তাহলে বিষয়টি কিন্তু
অন্যদিকে যায়।
অন্যদিকে যায় মানে? পুলিশ খুব খারাপ বুঝলেন? তাদের নানা রকম সন্দেহ হয়। আর উদ্ভট উদ্ভট সব অপরাধ দেখতে দেখতে আমাদের এখন আর কাউকেই বিশ্বাস হয় না। স্বার্থের জন্য মানুষ করতে পারে না, এমন কোনো কাজ নেই!
আপনার ধারণা আমি আমার ভাগ্নেকে খুন করেছি? আমি? নিজের ভাগ্নেকে নিজে খুন করেছি অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্য? নির্বাচনে জেতার জন্য? নমিশেন পাওয়ার জন্য? আপনার কি মাথা ঠিক আছে? আপনি কি বুঝতে পারছেন, আপনি কার সামনে বসে কি কথা বলছেন? আমার সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে? আছে কোনো ধারণা?
রেজা জবাব দিলেন না। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে পিরিচে চুমুক দিয়ে চা খাচ্ছেন। আজ তার গোঁফজোড়া সুন্দর করে ছাটা। চা খেতে কোনো সমস্যাই হচ্ছে না তার।
চুন্নু মিয়া ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন, আপনার ব্যবস্থা আমি করব ইন্সপেক্টার সাব। তলে তলে যে আপনি গোলাম মাওলার লোক, তাতো আমি এতদিন বুঝি নাই। কত টাকা খেয়েছেন তার কাছ থেকে? বলেন, কত?
রেজা এবারও জবাব দিলেন না। তিনি চা খাওয়া শেষে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কাপ-পিরিচ সরিয়ে রাখলেন পাশে। তারপর মৃদু হেসে বললেন, তারটা জেনে লাভ কী? আপনি কত দিতে পারবেন সেটা বলেন?