৫
তপনদার সঙ্গে আমার প্রায়ই বাজারে দেখা হয়।
তপনদার তো আর সব কিছুই ভালো, শুধু একটাই মুস্কিল, তপনদা মনে করে বাজার করার ব্যাপারে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট।
আমি কিছু কিনতে গেলেই তপনদা খবরদারি করবে। আমি হয়তো কচুর শাক কিনতে গেছি, তপনদা ঘাড়ের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে বলবে, এই ইডিয়ট, ওটা কী কিনছিস? সবুজ রঙের কচুর শাক কেউ কেনে? সব সময় লোহার মরচে রঙের কচুর শাক কিনতে হয়, ওগুলোই শুধু ভালো, অন্যগুলোতে গলা ধরে।
রঙ বিষয়ে তপনদার অনেক থিয়োরি আছে।
কাঁচালঙ্কা কিনতে গেলেও তপনদা বলবে, আরে, আরে, ওগুলো কী কিনছিস? সাদাটে মতন সবুজ, ওগুলো কেউ কেনে? ওগুলো তো কাঁচা কাঁচা—লঙ্কা। গন্ধ নেই, ঝাল নেই!
আমি বলি, তপনদা, আমি তো কাঁচালঙ্কাই কিনতে চাই। পাকা লঙ্কা তো চাই না!
—দু’বার কাঁচা বললুম, তা শুনলি না? তার মানে কাঁচালঙ্কা ফল হিসেবে ওগুলো বেশি কাঁচা। সাদাটে ভাব থাকা মানে এখনো ঠিক তৈরি হয়নি, আগেই গাছ থেকে তুলে এনেছে। ভালো কাঁচালঙ্কা ভালো সবুজ হবে। কাঁচালঙ্কাও যে একটা ফল, তা জানিস তো? পেয়ারার মতন। দুটোর মধ্যেই বিচি থাকে।
—কাঁচালঙ্কা যে ফুল নয়, তা জানি!
—পেয়ারার ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক উল্টো। একেবারে গাঢ় সবুজ রঙ হলে বুঝবি সে পেয়ারা কাঁচা কষ্টি, খাওয়া যায় না। সবুজের মধ্যে একটু সাদা ভাব এলে তবেই পেয়ারা তৈরি হয়। সবুজ টমাটো যেমন অখাদ্য। আবার আম যদি লাল টুকটুকে হয় তা হলে সন্দেহ করবি, সেগুলো ভালো জাতের হয় না।
—কালো জাম? সেগুলো সবুজ হতে পারে!
—কালো জাম আসলে কালোই নয়। কেউ কখনো পারফেক্ট কালো রঙের জাম দেখেনি, তবু ওদের নাম দেওয়া হয়েছে কালো জাম! স্টুপিডিটি! ওগুলোর রঙ আসলে নীল আর বেগুনি মেশানো।
পাতলা ছিপছিপে চেহারা তপনদার। এক মাথা চুল। লুঙ্গির ওপর শার্ট চাপিয়ে বাজারে আসে। ইদানীং বাজার করতে আসা লুঙ্গি পরা ভদ্রলোক অতি বিরল। সাজপোশাকের ব্যাপারে তপনদার কোনোদিনই মনোযোগ নেই। দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না উনি অঙ্কে এক নামজাদা পণ্ডিত, প্ল্যানিং কমিশনের বড় অফিসার। মাছের বাজারে তপনদার মুখোমুখি পড়তেই আমার মুখ শুকিয়ে গেল। এত জ্ঞান দেবে যে মাছ আর কেনাই হবে না।
ভুরু নাচিয়ে তপনদা জিজ্ঞেস করলো, কী মাছ কিনবি ভাবছিস? জ্যান্ত মাছ সম্পর্কে পচা কিংবা খারাপের প্রশ্ন উঠতে পারে না বলে আমি বললাম, কই!
তপনদা এক গাল হাসলেন। যেন আমাকে ঠিক ফাঁদে ফেলেছেন। কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন, গাড়ল আর কাকে বলে! ভালো করে বর্ষা নামেনি, এখন কেউ কই মাছ খায়? সব চালানি! কোনো স্বাদ নেই। শোন, মাছ কেনার আগে পুরো মাছের বাজারটা আগে ঘুরে দেখতে হয়। এক একদিন এক একটা মাছ বেশি ওঠে, সেদিন সেটা শস্তা হয়। আজ দ্যাখ, পার্শে মাছ বেশ ভালো উঠেছে। কাঁকড়াও নিতে পারিস।
–কালকেও পার্শে নিয়েছিলাম, তপনদা। আমার বৌদি কাঁকড়া খায় না।
—রোজ রোজ এক মাছ চলে না, তাই না? হ্যাঁরে, নীলু, তুই কতদিন চেতল মাছের পেটি খাসনি?
–ওরে বাবা, সে অনেক দাম! ছোঁয়াই যায় না।
—তুই ভালোবাসিস তো চেতল মাছের পেটি?
–কে না ভালোবাসে?
—আমার বৌটা ভালোবাসে না। সেই চেংড়িটা কোনো তেলালো মাছ পছন্দ করে না। কিন্তু তোর মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি, তুই চেতল মাছের পেটি খুবই ভালোবাসিস, তবে অনেকদিন খাসনি! কতদিন খাসনি রে?
–তা মাস ছয়েক তো হবেই!
—তোর বাড়ির জন্য যা হোক এলেবেলে মাছ নিয়ে যা, আজ আমি তোকে চেতল মাছের পেটি খাওয়াব!
-কী ব্যাপার তপনদা? বাড়িতে বুঝি কোনো ফাংশান আছে?
–কেন, হঠাৎ এ কথা বললি কেন?
—বছর দু’এক আগে তোমার মেয়ের মুখেভাত ছিল, সেদিন তুমি আমাকে এই বাজারেই নেমন্তন্ন করেছিলে। ইলিশ মাছ খাইয়েছিলে। আজ বুঝি তোমাদের বিবাহবার্ষিকী?
–তুই যে দেখছি একটা রাম গবেট রে! বাড়িতে একগাদা লোক ডেকে কেউ চেতল মাছের পেটি খাওয়ায়? তা হলে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে হবে না? না, না, কোনোরকম উপলক্ষ নেই, তোকে কিছু উপহারও নিয়ে যেতে হবে না। শুধু তুই আর আমি খাব, দু’ পীস দু’ পীস চার পীস। বেশ বড় সাইজের পেটি উঠেছে আজ বউটাকে আজ নিরামিষ খাওয়াব! বেশ হবে!
—কী ব্যাপার, তপনদা, হঠাৎ আমার ওপর এত দয়া?
—তোকে দেখেই একটা কথা মনে পড়ল রে, নীলু। তোকে একটা কাজ করে দিতে হবে। তুই ঠিক পারবি।
-কী কাজ?
—তুই চট করে তোর বাড়িতে বাজারটা দিয়ে চলে আয় না আমাদের ওখানে। তখন কথা বলা যাবে।
—কিন্তু আজ তো ছুটির দিন না, তপনদা। আজ তুমি দুপুরে বাড়িতে থাকবে কী করে?
-ওরে অফিস-টফিস সব মাথায় উঠেছে। মাথার ওপর কী যে বিপদ, তোকে কী বলব! তা হলে বেশি দেরি করিস না, তাড়াতাড়ি চলে আয়!
তপনদা চলে গেল বড় মাছের দোকানের দিকে। আমিও বাজার সেরে ফেলাম চটপট।
বাড়ি ফিরেই দেখি আমার বিছানায় শুয়ে আছে প্রীতম। সিগারেটের ধোঁয়ায় রিং পাকাচ্ছে। ভালো ফটোগ্রাফার হতে গেলে এটাও শেখা দরকার।
প্রীতম উঠে বসে বলল, তাহলে তুই দেবীগড়ের জঙ্গলে যাচ্ছিস তো আমার সঙ্গে? কনফার্ম করতে এলুম।
—জঙ্গলের কথা শুনেও আমি যাব না বলতে পারি? এত দিনে তুই আমাকে এই চিনলি?
–ঠিক আছে, সোমবার সন্ধেবেলা ট্রেন। তুই ঠিক সাতটায় হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির নীচে আসবি—ও হ্যাঁ, টিকিটের টাকাটা দে।
–তুই অ্যাডভান্স কর। আমি পরে শোধ দিয়ে দেব।
নিঃশব্দ হাসিতে চোখ দুটো প্রায় বুজে গেল প্রীতমের। সেই অবস্থায় বলল, এটা তুই কী বললি, নীলু? ‘পরে শোধ করে দেব।’ কথাটার মানে কি আমি জানি না? আমি নিজেও তো কত লোককে ও কথাটা বলেছি।
—এমনকি আমাকেও বলেছিস, তাই না?
—ওঃ হো! তুই বুঝি সেই সব পুরোনো ধার কাটাকুটি করতে চাইছিস? ওসব তামাদি হয়ে গেছে ভাই। আমার কিছু মনে নেই!
—পুরোনো ধার আমিও মনে রাখি না। তা বলে নতুন ধার করতে তো বাধা নেই। ভয় পাসনি, টিকিটটা কাট, সোমবার হাওড়া স্টেশনেই তোকে টাকাটা দিয়ে দেব।
—অল রাইট! দেবীগড়ে আমরা একটা বাংলোতে থাকব। খাওয়া-টাওয়ার কোনো খরচ লাগবে না। আমি তো একটা কাজে যাচ্ছি। তোকে শুধু আমার অ্যাসিস্টেন্ট সাজতে হবে।
—জঙ্গলে আবার কিসের কাজ রে?
—ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, তা জানিস না? ফটোগ্রাফারের কাজ ছবি তোলা!
—তুই জঙ্গলের ছবি তুলবি? বাঃ, এটা তো বেশ ভালো কাজ।
—এত সহজ নয় রে। আমাদের যে কত রকম রিকের মধ্যে পড়তে হয়, তা তুই জানিস না। ফটোগ্রাফারদের অনেক ঝঞ্ঝাট সহ্য করতে হয়। চল না, গেলেই বুঝতে পারবি।
প্রীতমের ঐ আফশোসের সুরের কথায় আমি মন দিলুম না। দেবীগড় বেশ চমৎকার নাম, সেখানকার জঙ্গলটা আমার এখনো অদেখা রয়ে গেছে। সব জঙ্গলই আলাদা, কোনো জঙ্গলে গিয়েই মনে হয় না, এরকম আগে দেখেছি। প্রত্যেকটা গাছেরই একটা নিজস্ব রূপ আছে। সোমবার দাদা ফিরুক বা না ফিরুক, আমি হাওয়া!
প্রীতম চলে যেতেই মা বললেন, এই দ্যাখ, একটা রেজিস্ট্রি চিঠি এসেছে। মনে হচ্ছে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে!
আমি বললাম, এই রে, তুমি সই করে নিলে? ফেরত দিতে পারলে না।
মা বললেন, সে কি রে, পিওন চিঠি দিতে এলে নেব না?
আমি শুনেছি, এসব চিঠি সহজে নিতে নেই। পোস্টম্যানদের ঘোরাতে হয়। দাদার নামে চিঠি। মা অনায়াসে ফিরিয়ে দিতে পারতেন।
অংশুবাবু মাত্র দু’-তিন দিন আগে আমাদের এখানে কথা বলতে এসে—ছিলেন। এত তাড়াতাড়ি চিঠি চলে আসছে নাকি আজকাল? তারিখটা দেখেই বোঝা গেল, চিঠিটা আরও চার দিন আগেকার। অতি ঘোড়েল লোক, চিঠিটা পাঠাবার পর আমাদের মিষ্টি ভাষায় ভয় দেখাতে এসেছিলেন।
বাড়িওয়ালার পক্ষে চিঠিটি লিখেছেন এক উকিল। সেই উকিলি ভাষার মার—প্যাঁচ বোঝে কার সাধ্য। মোট কথা হলো, নানারকম আইনের মারপ্যাঁচ দেখিয়ে বলা হয়েছে যে, আমরা যেন অবিলম্বে এই বাড়ি ছেড়ে দিই। এই বাড়ির অবস্থা বিপজ্জনক। পুরসভা এই বাড়ি অবিলম্বে ভেঙে ফেলার সুপারিশ করেছেন। সুতরাং ভাড়াটেরা বাড়ি না ছাড়লে তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে বাড়িওয়ালার আর কোনো দায়িত্ব নেই।
একটিও বাক্য ব্যয় না করে আমি চিঠিটা জানলা দিয়ে ছুঁড়ে দিলাম বাইরে।
মা হা-হা করে উঠে বললেন, ও কী করলি? ও কী করলি? ফেলে দিলি?
আমি বললাম, ভবিষ্যতে যা হবার তা তো হবেই। ও চিঠিখানা রেখে লাভ কী? বরং, এ চিঠি যে আমরা গ্রাহ্য করি না, সেটা দেখানোই দরকার।
–কে দেখবে? এখানে কে দেখছে? এখানে কি বাড়িওয়ালার কেউ আছে?
—তুমি আর আমি তো দেখলাম। সেটাই যথেষ্ট।
মা এতেও আশ্বস্ত হলেন না। ছুটে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। চিঠিখানা উড়তে উড়তে নামছে। একতলার কাছে জলের পাইপে লেপ্টে রইল কয়েক মুহূর্ত, আবার খসে পড়ল।
যে ছেলেটা আমাদের বাড়িতে খবরের কাগজ দেয়, সে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। মা চিৎকার করে বললেন, শম্ভু, ও শম্ভু, ঐ চিঠিটা ধরো তো! নিয়ে এসো ওপরে। আমার দিকে ফিরে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে মা বললেন, তোর দাদাকে চিঠিটা দেখাতে হবে না?
আমি বললাম, ঠিক আছে, দাদাকে দেখিও। আমি এখন বেরুচ্ছি। দুপুরে খাব না!
যাক, একটা ব্যাপার বেশ ভালোই হলো। আমার ওপর মায়ের কোনো ভরসাই নেই। মা ধরেই নিয়েছেন যে বাড়িওয়ালার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমি একটা তালপাতার সেপাইয়ের চেয়েও কমজোরি। যা কিছু সবই দাদাকে করতে হবে। এ তো খুব চমৎকার কথা!
তপনদার বাড়িতে পৌঁছে আবার একটি সাঙ্ঘাতিক চমক। সত্যি তপনদাকে নিয়ে আর পারা যায় না। এদিকে এত বড় বিদ্বান ও দায়িত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন, কিন্তু বাড়িতে যেন একটা পাগল!
দরজা খুলে দিল শিখা বৌদি, তার মুখে স্টিকিং প্লাস্টার আঁটা। লম্বালম্বি তিনটে।
আমি প্রায় বিষম খেয়ে বললাম, এ কী?
শিখা টেলিফোনের টেবল থেকে একটা প্যাড আর পেন্সিল নিয়ে লিখল, তোমার তপনদা বাথরুমে গেছে। একটু বসতে বলেছে!
–তোমার মুখ কে শেলাই করে দিয়েছে?
শিখা বৌদি আবার লিখল, আমার এখন কথা বলা বারণ!
—কে বারণ করেছে? তোমাকে বিচ্ছিরি দেখতে লাগছে!
শিখা বৌদি লিখল, পাঁচ মিনিট বাদে খোলা হবে!
আমি ওর হাতের দিকে তাকালাম। হাত তো বাঁধা নয়, দিব্যি লিখছে, তা হলে মুখের ওগুলো নিজে খুলে ফেলছে না কেন?
শিখা তপনদার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোট। একসময় তপনদার ছাত্রী ছিল, তাই তপনদা এখনো তুই তুই করে। শিখা ঠিক আমার বয়েসী, ওকে বৌদি বলারও কোনো মানে হয় না। কিন্তু তপনদা বলে দিয়েছে, অ্যাই, আমার বউ তোদের গুরুজন, খবরদার নাম ধরে ডাকবি না!
তপনদা শিখা বৌদিকে সব সময় দাবড়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু নারী জাতির ওপর এই অত্যাচার আমার সহ্য হয় না।
শিখা বৌদি জোরে জোরে মাথা নাড়লেও আমি জোর করে ওর মুখ থেকে স্টিকিং প্লাস্টারগুলো টেনে খুলে দিলাম।
তারপর ধমক দিয়ে বললাম, তপনদা তোমার মুখ বন্ধ করে রাখতে চাইছে বলেই তুমি মেনে নিলে? আজকাল রাশিয়ায় পর্যন্ত সবাই মুখ খোলার স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। তুমি নিজে খুলে ফেলতে পারলে না?
শিখা বৌদি একটু দম নিয়ে বলল, ও হাত বাঁধেনি এই শর্তে যে আমি নিজে খুলব না।
—সেই শর্তটাই বা তুমি কেন মানবে? এটা কোন্ সেঞ্চুরি? এখন বৌদের ওপর সামান্য অত্যাচার করলে স্বামীদের জেল হয়ে যায়!
—না গো, নীলু, আজ আমারই দোষ। আমি আজ বড্ড ঝগড়া করেছি ওর সঙ্গে। এক একদিন আমার মাথা খুব গরম হয়ে যায়!
—ঝগড়া করেছ বলেই তপনদা তোমার মুখ বেঁধে রাখবে? এ ভারি অন্যায়। আমার বদলে অন্য কেউ এসে দেখলে কী ভাবত বলো তো?
–আমি ম্যাজিক আই দিয়ে আগে দেখে নিয়েছি। তুমি ছাড়া অন্য কেউ হলে দরজাই খুলতাম না।
এই সময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে তপনদা হুংকার দিয়ে বলল, বিশ্বাসঘাতিনী! বিশ্বাসঘাতিনী! খুলে ফেলেছিস! এর মধ্যে কথা বলতে আরম্ভ করেছিস?
ভয়ে চুপসে গিয়ে শিখা বৌদি বলল, না, না, আমি খুলিনি। নীলু জোর করে খুলে দিয়েছে! তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো!
তপনদা আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম, এ কী কাণ্ড তোমার, তপনদা? তুমি আজকাল নিজের বউকে বেঁধে রাখতে শুরু করেছ?
তপনদা বলল, বেশ করেছি! আজ ও আমাকে টানা এক ঘণ্টা বকুনি দিয়েছে। কালকে দেড় ঘণ্টা। কনস্টান্ট বকবক। অনর্থক। তার জন্য শাস্তি দিতে হবে না? হাত বাঁধিনি, পা বাঁধিনি। গায়ে হাত তুলিনি। কড়া কথা বলিনি। মেয়েদের সবচেয়ে কঠিন শাস্তি কী জানিস, এক বেলা কথা বলতে না দেওয়া। কত মুনি-ঋষি মৌনব্ৰত পালন করেন, গান্ধীজী সারাদিন মৌনী থাকতেন। আজ পর্যন্ত তুই কোনো মেয়ে মৌনী দেখেছিস।
—কথা বলাটা তো মেয়েদের একটা অলংকার। আমার শুনতে ভালো লাগে। মেয়েদের বকুনি শুনতেও ভালো লাগে।
—তাই নাকি? তাই নাকি? হা-হা-হা-হা।
তপনদা বিরাট অট্টহাসি করে উঠলেন বেশ তৃপ্তির সঙ্গে।
তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আসলে তোর মুখটা আজ বেঁধেছিলুম কেন জানিস? নীলুকে পরীক্ষা করার জন্য। নীলু যদি এসে তোর প্লাস্টারগুলো জোর করে খুলে না দিত, তা হলে ওকে আমি ছ্যা ছ্যা করতুম! যাক, তা হলে বোঝা গেল, এখনো ইয়াংম্যানদের শিভারি বলে একটা জিনিস আছে। অবলাদের ওপর নির্যাতন দেখলে তাদের বীরত্ব চাগিয়ে ওঠে। আমি ভেবেছিলুম, ওসব বুঝি আজকাল একেবারে চুকে বুকে গেছে। ব্রাভো, নীলু, ব্রাভো! হবে, তোর দ্বারা এখনো হবে!
—তপনদা, তোমার যত সব অদ্ভুত পরীক্ষা। কী নিয়ে তোমাদের ঝগড়া হয়েছিল, শুনি?
—তা তোর শোনার দরকার নেই। শুনলে শিভালরি উপে যাবে। বিয়ে থা করিসনি—এখন মেয়েদের সব কথাই তোর মিষ্টি লাগে,…যতদিন মিষ্টি লাগাতে পারিস, চালিয়ে যা!
তারপর শিখা বৌদির দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছেমরী, আমাদের একটু চা-টা খাওয়াবি, নাকি?
শিখা বৌদি সে-কথায় কান না দিয়ে বলল, নীলু জানো তো, আমরা খুব মুস্কিলে পড়ে গেছি।
তপনদা অস্থির হয়ে বলল, আরে সেই কথাটা বলার জন্যই তো নীলুকে আজ ডেকে এনেছি। আমি বুঝিয়ে বলছি, তুই চা-টা করে আন্
শিখা বৌদি দরজার কাছে গিয়ে বলল, ভুতুর মা, তিন কাপ চা করে নিয়ে এসো তো!
তারপর নিজে এসে বসল সোফায়।
তপনদা বলল, শোন্ নীলু, তোর ওপর একটা কাজের ভার দিতে চাই। তোর তো হাতে সময় আছে। হাজরা থেকে টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো, ওদিকে যাদবপুর, এর মধ্যে প্রত্যেকটা পানের দোকানে যেতে হবে। পান কিনবি, দুটো একটা সিগারেটও কিনতে পারিস। ওদের সঙ্গে গল্প করবি। ওরা সব খবর রাখে। আগেকার দিনে নাপিতরা সব বাড়ির খবর রাখত। এখন পাড়ার সব খবর পানওয়ালাদের নখদর্পণে। ওদের কাছে তুই ঠিক খোঁজ পেয়ে যাবি। এর বদলে দক্ষিণাও পাবি তুই। শিখা তোকে মাঝে মাঝে রান্না করে খাওয়াবে। আমি তোকে শ পাঁচেক টাকা ধার দেব।
—কিসের খোঁজ নিতে হবে সেটা বললে না?
–ওমা, সেটা তুই এখনো বুঝিসনি? হেড অফিস কি একেবারে ফাঁকা করে ফেলেছিস? লোকে পানের দোকানদারের কাছে কিসের খোঁজ নেয়? আমার কি বিবাহযুগ্যি মেয়ে আছে যে তোকে তার জন্য পাত্রের খোঁজ করতে বলব? একটা ভদ্রগোছের ফ্ল্যাট, দু’খানা বেডরুম, হাজার বারোশোর মধ্যে ভাড়া।
–সে কী! তোমরা বাড়ি বদলাতে চাও? এ ফ্ল্যাটটা তো চমৎকার, কী অসুবিধা হচ্ছে? এটা তোমাদের কত দিনের পুরোনো বাড়ি।
-সাধ করে কি ছাড়ছি রে? বাড়িওয়ালা তাড়িয়ে দিচ্ছে।
—তাড়িয়ে দিচ্ছে মানে?
—এত সহজ কথার মানে বুঝতে তোর এত দেরি হয় কেন? তাড়িয়ে দিচ্ছে মানে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এখানে আর থাকা যাবে না।
শিখা বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে করুণ সুরে বলল, আচ্ছা বলো তো, বাড়িওয়ালা উঠে যেতে বললেই কেউ যায়? এত ভালো পাড়া, বাজার-টাজার সব কিছু কাছাকাছি।
তপনদা বলল, এই মেয়েটা কিছুতেই বুঝবে না! বলছি না, বাড়িটা ভেঙে ফেলবে। জানিস নীলু, আজকাল বাড়িওয়ালা নতুন ট্যাকটিক্স বার করেছে। এমনি উঠে যেতে বললে তো ভাড়াটেরা শুনবে না, মামলা-টামলা করতে পারে। তাই করপোরেশানের লোকদের ঘুস দিয়ে এখন এরা এক একটা বাড়িকে ডায়লাপিডেটেড বাড়ি বলে ডিক্লেয়ার করে দেওয়াচ্ছে। বিপজ্জনক বাড়ি। ইমিডিয়েটলি ভেঙে ফেলতে হবে। ব্যাস, এরপর আর ভাড়াটেরা ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারবে না। করপোরেশানের লোক এসে বাড়ি ভাঙতে শুরু করে দেবে। ভাড়াটেরা তখন কোথায় যাবে, সে ব্যাপারে করপোরেশানের কোনো দায়িত্ব নেই। বাড়িওয়ালারও কোনো দায়িত্ব নেই। ভাড়াটেরা চুলোয় যাক। আসলে এ বাড়িটাকে ভেঙে এখানে একটা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং বানাবে!
শিখা বৌদি বলল, আমাদের বাড়িওয়ালা কিন্তু লোক খুব খারাপ নয়। নতুন ফ্ল্যাট পেতে গেলে যদি সেলামি-টেলামি দিতে হয়, সেই জন্য উনি আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা অফার করেছিলেন। তোমার দাদা কিছুতেই নিতে রাজি হলো না। পঞ্চাশ হাজার টাকা কি কম বলো?
তপনদা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে হুংকার দিয়ে বলল, শাট আপ! আবার মুখ বেঁধে দেব কিন্তু বলে দিচ্ছি! জানিস নীলু, এই পাজি মেয়েটা আজ সারাদিনে অন্তত পঞ্চাশবার এই কথাটা শুনিয়েছে বলেই তো আমি ওর মুখে শেলোটেপ আটকে দিয়েছিলুম! বাড়িওয়ালার কাছ থেকে আমি টাকা নিতে যাব কেন? চিরকাল ভাড়াটেরাই বাড়িওয়ালাদের টাকা দেয়। বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ভাড়াটে টাকা নেবে, এরকম কথা কেউ কখনো শুনেছে? দয়ার দান? গাছতলায় থাকব, না খেয়ে থাকব, সেও ভি আচ্ছা, তবু বংশের নাম ডোবাতে পারব না। কোনো শালার কাছ থেকে দয়ার দান নিতে পারব না!
শিখা বৌদি বলল, শোনো কথা! একে বুঝি দয়ার দান বলে? এটা তো ক্ষতিপূরণ! আজকাল অনেকই নেয়।
তপনদা বলল, চোপ! শোন, নীলু, তোকে এই উপকারটা করে দিতে হবে ভাই! বাড়ি খোঁজা আমার কম্মো না! তুই বেকার বসে আছিস, তুই ঠিক পারবি। সামনের মাসের মধ্যেই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাই!
আমি এতক্ষণ চোখ গোল গাল করে শুনছিলাম, এবার হো-হো করে হেসে উঠলাম। এমন মজা বহুদিন পাইনি।
তপনদা বলল, কি রে, কী হলো? আমি অসুবিধেয় পড়েছি বলে তুই হাসছিস?
হাসতে হাসতে আমার বিষম লেগে গেল।
তপনদা বৌকে তাড়া দিয়ে বলল, চা কি হলো; ভুতোর মা নিজেই ভূত হয়ে গেল কি না দ্যাখ না! ছেলেটার দম আটকে গেল যে!
শিখা বৌদি বলল, তুমি অত টাকা নিতে চাওনি শুনে নীলু হাসছে।
আমি দু’ হাত নেড়ে জানালাম, না, না।
তারপর একটু সামলে নিয়ে বললাম, তপনদা, একজন ডুবন্ত মানুষকে যদি কেউ বলে, আমার একটু উপকার করে দাও না ভাই, তা হলে তার এরকম হাসি পাবে না?
—তার মানেটা কী হলো?
—আমাদের বাড়িওয়ালাও নোটিস দিয়েছে। আমাদের বাড়িটাও ভাঙছে।
—অ্যাঁ, সত্যি?
—আমাদের বাড়ি ভেঙেও মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং হবে। আমরা কোথায় যাব তার ঠিক নেই!
শিখা বৌদি ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কত টাকা পাচ্ছ?
আমি বললাম, এক পয়সা ও না। আমাদের কিছু অফার করেনি। বরং বলেছে, পাড়ার ছেলেদের লেলিয়ে দিয়ে আমাদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়াবে।
তপনদা অস্ফুট গলায় বলল, পুরো কলকাতা শহরটাই ওরা কিনে নিচ্ছে। এই সব ছোটখাটো বাড়ি ভেঙে-গুঁড়িয়ে সেখানে আট-দশতলা বাড়ি বানাচ্ছে মাড়োয়ারিরা। আমরা কলকাতার তিনশো বছর হচ্ছে বলে লাফাব আর আর্ট—কালচার নিয়ে গর্ব করব, আর ওরা আমাদের এই শহরে থেকে তাড়িয়ে মফস্বলে পাঠাবে!
শিখা বৌদি আর একটা খোঁচা মেরে বলল, তুমিই তো আগে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের কত প্রশংসা করতে। কী নীলু, তুমি শোননি?
আমাকে ঘাড় নাড়তেই হলো।
বিভিন্ন সময়ে অন্যদের সঙ্গে তর্কে তপনদা মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীশ্রেণীর সমর্থনে জোরালো সব যুক্তি দিয়েছে। ওরা অ্যাডভেনচারাস জাত। দেশের অনেক কিছু উন্নতির জন্য ওরা দায়ী। ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ওরাই ভারতীয় ব্যবসাকে অনেকখানি দাঁড় করিয়েছে। উত্তরবঙ্গে, আসামে, নাগাল্যাণ্ডে, সুদূর পাহাড়ে, পাহাড়ে-জঙ্গলে ওরা কতরকম ঝুঁকি নিয়ে নিজস্ব ঘাঁটি বানিয়েছে!
একবার ডুয়ার্সে সামসিং নামে একটা জায়গায় এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ করে তপনদা এমনই অভিভূত হয়েছিলো যে, কলকাতায় ফিরে এসে সবাইকে তাঁর গল্প শুনিয়েছিল। সেই মাড়োয়ারি ভদ্রলোক আগরওয়াল অল্প বয়েসে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় রাজস্থান থেকে এসে উত্তর বাংলার পাহাড়ী এলাকায় প্রথমে একটা ছোট্ট মুদিখানা খুলেছিলেন। এখন তিনি চা বাগান, পেট্রল পাম্প, কাঠের ব্যবসা আরও অনেক কিছুর মালিক, ওখানে ইস্কুল, হাসপাতাল করে দিয়েছেন। বিরাট এক কর্মবীর। তপনদা সবাইকে বলেছিল, দূর দূর, বাঙালিরা সেই আগরওয়াল ভদ্রলোকের পা ধোওয়া জল খাওয়ারও যুগ্যি নয়! অত দূর থেকে এসে একটা লোক নিজের চেষ্টায় এত বড় একটা ব্যবসা ফেঁদে ফেলল, বাঙালিরা পারল না কেন? এই রকম লোকদের শ্রদ্ধা করা উচিত! মাড়োয়ারীরা বাংলায় এসে এতরকম ব্যবসাপত্র করছে। বাঙালিদের রাজস্থানে গিয়ে ব্যবসা করতে কে বারণ করেছিল? বাঙালিদের নিজেদের কিছু ক্ষমতা নেই, শুধু অন্যদের গালাগালি দেবার ব্যাপারে ওস্তাদ!
শিখা বৌদি সেই সব কথা মনে করিয়ে দেওয়ায় তপনদা মুখ গোঁজ করে রইল।
হঠাৎ আমার মনে পড়ল মুমুদের সেই ক্লাবে দেখা শংকর নামে ছেলেটির মুখ। সেও তো মাড়োয়ারি। শুধু সে রূপবান নয়, অমন ভদ্র ও বুদ্ধিমান ছেলে আমি আর একটিও দেখিনি। ওই ছেলেটিকে দেখার পর মাড়োয়ারিদের নিন্দে করতে আমারও আটকাবে। জাতিগতভাবে কিংবা শ্রেণীগতভাবে গালাগাল দেওয়া একেবারেই উচিত নয়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপনদা বলল, তা হলে তো মুস্কিলের ব্যাপার হলো রে নীলু! এক সঙ্গে দুটো ফ্ল্যাট তুই কি জোগাড় করতে পারবি? নাঃ, সেটা ইমপসিবল! শুধু শুধু তা হলে তোকে এত দামি চিতল মাছের পেটি খাওয়াবার জন্য ডাকলুম কেন!
শিখা বৌদি বলল, একী একী একী! একজনকে খাওয়ার নেমন্তন্ন করে এসব কী বলছ?
তপনদা বলল, ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট! ওর দ্বারা যখন কাজ হবেই না, তখন মিছিমিছি ওর জন্য পয়সা খরচ করার কোনো মানে হয়! ঠিক আছে, ওকে একটা পীস দিস!
আমি বললাম, ওসব কথা শুনছি না, তপনদা। এসেছি যখন, চিতল মাছের পেটি আমি খাবই। পুরো দু’ পীস!
শিখা বৌদি বলল, আড়াই। মোট পাঁচ পীস এনেছে। এই অ্যাত্ত বড় বড়। আমি তো খাই না!
আমি বললাম, আচ্ছা শিখা বৌদি, তোমরা এতদিনে একটা ফ্ল্যাট কেনোনি কেন? আজকাল অনেকেই কিনে নিচ্ছে। চন্দনদা-নীপাবৌদিরা কী দারুণ একটা ফ্ল্যাট কিনল যোধপুর পার্কে।
তপনদা আবার গা ঝাড়া দিয়ে বলল, ফ্ল্যাট কিনব? টাকা কি গাছে ফলে? চন্দন প্রাইভেট ফার্মের ম্যানেজার হয়েছে, বহু টাকা রোজগার করে, আমি সরকারি চাকুরে, কত টাকা মাইনে পাই জানিস? চন্দনের বউ নীপাও ব্যাঙ্কের অফিসার, আর আমার বৌটা! রোজগার নেই, শুধু খরচ করতে জানে! গান শেখে, গান গায়! তার জন্য আমার অনেক গচ্চা যায়! গান গেয়ে উনি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় হবেন! হুঁঃ! লোককে ডেকে ডেকে এনে গান শোনাতে হয়, তার জন্য চা বিস্কুট সন্দেশ খেসারত দিতে হয় আমাকে!
শিখা বৌদি হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা বলো তুমি, নীলু, বাড়িওয়ালা পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চাইছিল, সেটা নিলে কী ক্ষতি হতো? সেই টাকায় একটা ফ্ল্যাটের জন্য অ্যাডভান্স দেওয়া যেত না? তারপর আস্তে আস্তে, ধার-টার করে…।
তপনদা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ঘুষ! আমাকে ঘুস নিতে বলছিস! উঃ, মেয়েরা আজকাল কী লোভী হয়েছে রে মাইরি! কোথায় আমাকে আত্মমর্যাদা নিয়ে থাকার প্রেরণা দেবে তা না, আমাকে বলে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ঘুষ নিতে! এরপর বলবি, অফিস থেকেও ঘুষ নিতে, তাই না?
শিখা বৌদি বলল, বাজে কথা বলো না। তোমাকে অফিসে কে ঘুষ দেবে? তোমার অঙ্ক কষা কাজ। ঘুষের কোনো স্কোপই নেই। বাড়িওয়ালার কাছ থেকেও টাকা নেওয়াটাকে ঘুষ বলে না। এটা কমপেনসেশান!
—আলবাৎ ঘুষ! বাড়িওয়ালার কাছ থেকে জমিটা নিচ্ছে যে প্রমোটার, সেই ত্রিলোচন জৈন এখানে দশ-তলা বাড়ি হাঁকাবে। এক একখানা ফ্ল্যাটের দাম হবে দশ-বারো লাখ। তা হলে ওর কত লাভ হবে, সেটা বুঝে দ্যাখ। আমাকে পঞ্চাশ হাজার ধরিয়ে দিয়েও এত লাভ করবে। একেই বলে ঘুষ। কিংবা বখশিস! তপন সরকার ওসব ছোঁয় না।
—ত্রিলোচন জৈন নামটা প্রায়ই কাগজে দেখি। অনেক উঁচু উঁচু বাড়ি বানাচ্ছে, তাই না, তপনদা?
–প্রচুর, প্রচুর! এই মুহূর্তে অন্তত দশখানা মাল্টিস্টোরিড তৈরি হচ্ছে ওর কোম্পানির। আমি খোঁজ নিয়েছি, মাত্র কয়েক বছরে ব্যাটা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। ব্যাটা মাল্টিস্টোরিড বানাবার সব রকম জোচ্চুরি জানে। টালিগঞ্জে একটা বাড়ি ভেঙে পড়ল না? তিনজন লোক মারা গেল। সেটাও তো ওর বাড়ি। পুলিশ ওর গায়ে হাত ছোঁয়াতে পারেনি। তার পরেও ত্রিলোচন আবার সব চালিয়ে যাচ্ছে!
—এত কোটি কোটি টাকা নিয়ে ওরা কী করে বলো তো? নিশ্চয়ই নিরামিষ খায়, আমাদের মতন মাছ-মাংসের খরচও নেই। একটার বেশি বিয়েও করতে পারে না, বৌকে কত টাকার গয়নাই বা গড়িয়ে দেবে?
-ওসব কিছু নয় রে। এরা হচ্ছে এ যুগের রাজা। টাকাপয়সার জোরে প্রচুর লোকের ওপর আধিপত্য করে, তাদের প্রজা বানিয়ে ফেলে, তাতেই এদের আনন্দ।
শিখা বৌদি বলল, চলো, চলো—এবার খেতে চলো!
ওঁদের একটি মাত্র সন্তান, তার বয়েস মাত্র দু’ বছর। সে মেয়ের দুটো ভালো নাম। শিখা বৌদি রেখেছ কমলিকা আর তপনদা রেখেছে চণ্ডালিকা! তপনদার নিজস্ব যুক্তিও আছে এমন নাম রাখার। শ্রেণীবৈষম্য সম্পূর্ণ ঘুচিয়ে দিতে হলে এই রকমই নাম নাকি রাখা দরকার। শিল্পী, কবি, ইঞ্জিনিয়ারদের মতন চণ্ডালও একটা পেশায় নিযুক্ত, তাকে ঘৃণা করার তো কোনো কারণ নেই। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, হে ভারত ভুলিও না, মূর্খ, দরিদ্র, নীচ, চণ্ডাল সবাই তোমার ভাই। কিন্তু আজো বিবেকানন্দের ভক্তরা কেউ কোনো চণ্ডালকে ভাই বলে জড়িয়ে ধরে না। আর যারা শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলে, তারাও কি কোনো চণ্ডালকে…। মালিনী যদি কোনো মেয়ের নাম হতে পারে, তা হলে চণ্ডালিকাতেই বা দোষ কী!
ওর ডাকনাম পুপু। স্কুলে ভর্তি হবার সময় ওর কোন্ ভালো নামটা লেখানো হবে, সেটা জানার জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি।
পুপুও আমাদের সঙ্গে বসেছে খাবার টেবিলে।
তপনদা ও শিখা বৌদির মতন এমন চমৎকার, টেনসানমুক্ত, সুখী দম্পতি খুব কমই দেখা যায়। বাইরের লোক হঠাৎ দেখলে মনে করতে পারে, ওরা বুঝি সব সময় ঝগড়া করছে। আসলে ওদের মধ্যে রয়েছে প্রগাঢ় ভালবাসা, ঝগড়টা ওদের একটা মজার খেলা। দু’জনেই খুব বন্ধুবৎসল। তপনদা ডেকে ডেকে লোকজনদের খাওয়াতে ভালবাসে। যা উপার্জন করে, তা খরচ করে দু’ হাতে। শিখা বৌদি গান গায়, এর মধ্যেই খানিকটা নাম হয়েছে। এম এস সি-তে ভালো রেজাল্ট, অনায়াসে একটা উপযুক্ত চাকরি পেতে পারত, তপনদাই ওকে চাকরির বদলে গানের চর্চায় উৎসাহ দেয়।
এই ছোট্ট সুখী সংসারটাকে এবারে এখান থেকে সমূলে উৎপাটন করা হবে, এটা ভাবলে কষ্ট হয়। আমি অনেক বাচ্চা বয়েস থেকে এসেছি তপনদার কাছে, এই বাড়িটার সঙ্গে আমারও অনেক মধুর স্মৃতি আছে।
তপনদা কোনোদিন বাড়ি ভাড়া বাকি ফেলেনি, বাড়িওয়ালার সঙ্গে ঝগড়াও করেনি। সে-রকম মানুষই সে নয়, বরং মাঝে মাঝে বাড়িওয়ালার প্রস্তাবমত ভাড়া বাড়িয়েছে। কোনো দোষ করেনি তপনদা, তাও তাকে জোর করে হটিয়ে দেওয়া হবে এখান থেকে।
সব সময় মজা ও ঠাট্টা-ইয়ার্কি করা স্বভাব তপনদার। আজ বেশ ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। খেতে খেতে কোনো গল্প জমছে না।
রান্না বেশ ভালোই। শিখা বৌদির জন্য ডিমের ঝোল। মেয়েকেও ডিম খাওয়াচ্ছে। মাছের পীসগুলো এত বড় বড় যে, দুটো খাওয়া বেশ শক্ত।
নিজের ঘরে বসে তপনদা রাজা-উজির মারে বটে কিন্তু সে খুব একটা করিৎকর্মা, উদ্যোগী পুরুষ নয়! পণ্ডিত মানুষ, বাস্তবজ্ঞান কম। নীতিবোধ খুব প্রখর। অন্য লোকে বাড়িওয়ালাদের ওপর রাগ করে, তপনদার হয়েছে অভিমান। তপনদা আর এ বাড়িতে কিছুতেই থাকতে চায় না।
এক সময় তপনদা বলল, তা হলে নীলু, তোরা আর আমরা একই রকম বিপদে পড়েছি! সাধ্যমতন ভাড়ায় একটা ফ্ল্যাট জোগাড় করা তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার! এই সব পাড়ায় সাধারণ বাড়ি ভাড়া তো পাওয়াই যায় না। হয় মাল্টিস্টোরিড না হয় তো কোম্পানি এগ্রিমেন্ট।
আমি বললাম, তপনদা, তুমি এক কথায় এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছ, আমরা অত সহজে ছাড়ছি না।
—তা হলে কী করবি?
—লড়ে যাব! শেষ পর্যন্ত দেখব! একটা জলজ্যান্ত বাড়ি, তাতে লোকজন রয়েছে, সেটা হঠাৎ ভেঙে দেবে, এ কি মামদোবাজি নাকি?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তপনদা বলল, পারবি না রে, এদের সঙ্গে পারবি না। আমাদের ক্ষমতায় কুলোবে না। বললুম না, এই সব কোটিপতিরা হচ্ছে একালের রাজা। কিছু কিছু পুলিশ অফিসার, কিছু করপোরেশানের কর্মচারী, কিছু রাজনৈতিক নেতাদের এরা গোপনে গোপনে প্রজা বানিয়ে রেখেছে। এই বিরাট শক্তির বিরুদ্ধে তুই কী করে দাঁড়াবি?
শিখা বৌদি বলল, কেন পারবে না? গোলায়াথ নামে এক বিরাট দৈত্যের বিরুদ্ধে ছোট্টখাট্টো ডেভিড একা লড়ে গিয়েছিল না? সাহস থাকলে ঠিকই পারা যায়। ডেভিডের মার খেয়েই তো গোলায়াথ ধরাশায়ী হয়েছিল!
ডেভিড! একটা কোনো অপ্রচলিত নাম কিংবা নতুন শব্দ একবার শুনলে দু’—একদিনের মধ্যেই সেটা আবার ঠিক শোনা যায়। বাইবেলের ডেভিড আর বাথশিবা, মাত্র দু’ দিন আগেই তো মুমুদের সেই ক্লাবে এই নাম শুনেছি। প্রিসিলার বদলে একজন নতুন রানী হলো, সে বেছে নিল ডেভিডকে। কে যেন ডেভিড হলো শেষ পর্যন্ত? শংকর জৈন? না, অন্য একজন। কিন্তু শংকরকেই সবচেয়ে ভালো মানাত!