২
অনেক লোক থাকে, যারা সবরকম বিপদ-বাধার বিরুদ্ধে লড়ে যেতে পারে। কোনো সমস্যাকেই তারা সমাধানের অতীত বলে মনে করে না। আমার মোটেই তেমন মনের জোর নেই। কোনো রকম গণ্ডগোলের সম্ভাবনা দেখলেই আমার মধ্যে পালাই পালাই ভাব জেগে ওঠে। যারা বিপর্যয়ের মুখোমুখি সাহসের সঙ্গে দাঁড়ায়, তারা লড়াই করে বুদ্ধি কিংবা গায়ের জোরে। আমার বুদ্ধিও তেমন সূক্ষ্ম নয়, আর গায়ের জোরেও অনেকের সঙ্গেই পারব না।
চেনাশুনো লোকেরা যদি আমাকে পলায়নবাদী বলে, তা অস্বীকার করতে পারি না আমি। এই যে আমি যখন তখন দিকশূন্যপুরে চলে যাই, সেটা পালিয়ে যাওয়াই তো বটে। সাহসী, বীরপুরুষ, আদর্শবাদীদের আমি শ্রদ্ধা করি, তবে সমাজে আমার মতন দু’চারটে পলায়নবাদী থাকলেই বা ক্ষতি কী? কেউ কি মধ্যাহ্নে মাঠে গাছের ছায়ায় শুয়ে একা একা বাঁশি বাজাবে না?
আমাদের বাড়িওয়ালা অংশুবাবু হঠাৎ একটা ঝামেলা বাধিয়ে বসলেন। মা আড়াল থেকে শুনেছেন অনেকটা, বৌদি স্কুল থেকে ফেরামাত্র তাকে জানানো হয়েছে। তারপর চলতে লাগল বাড়িওয়ালা শ্রেণীর পরিবর্তন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা। মা বিয়ের পর কলকাতায় এসে দেখেছিলেন, অনেক বাড়িতে তখন ‘টু-লেট’ বোর্ড টাঙানো থাকত। বাড়িওয়ালারা তখন ডাকাডাকি করতেন ভাড়াটেদের। আমি আর বৌদি অবশ্য সেই স্বর্ণযুগ দেখিনি। আমরা তো ছোটবেলা থেকেই শুনছি ঠিকমতন বাড়ি ভাড়া পাওয়া অতি শক্ত ব্যাপার
এই অংশুবাবুর বাবার সঙ্গে আমার বাবার পরিচয় ছিল। তিনি নিজে খাতির করে বাবাকে এই ফ্ল্যাট দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, আমার বেশি টাকার দরকার নেই, আমি চাই সজ্জন, ভালোমানুষ থাকবে আমার বাড়িতে। তিনি নিজে অতিশয় ভদ্রলোক ছিলেন, মাঝে মাঝে এ বাড়িতে আসতেন মিষ্টির বাক্স হাতে নিয়ে। দু’ বছর অন্তর চুনকাম ও রঙ করাতেন, ভাড়াটেদের কোনো রকম অসুবিধে হলে সংস্কারের ব্যবস্থা করে দিতেন। বাড়িওয়ালা হিসেবে তিনি ছিলেন আদর্শ পুরুষ! তাঁর ছেলে অংশুবাবু এরকম! গত দশ বছরে এদিকে একবারও আসেননি, বাড়ি রঙ করাননি, শুধু ভাড়ার টাকা গুনে নেওয়া ছাড়া ভাড়াটেদের সঙ্গে আর কোনো মানবিক সম্পর্ক রাখেননি। এখন তিনি এককথায় বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে আমাদের তাড়িয়ে দিতে চান?
বাবা যখন প্রথম এই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন, তখন এর ভাড়া ছিল দু’শো পঁচিশ। এখন বাড়তে বাড়তে সাড়ে ছ’শো হয়েছে। অংশুবাবুর মতে সেটা সামান্য টাকা, আমাদের মতে অনেক। যদিও স্বীকার করতেই হবে, এইরকম অতি সাধারণ ফ্ল্যাটেরও বাজার দর এখন যথেষ্ট বেশি, কিন্তু সে জন্য তো আমরা দায়ী নই!
অংশুবাবু শেষ পর্যন্ত চোখ রাঙিয়ে গেছেন। টাকাওয়ালা মানুষ, ওদের শক্তি বেশি। বাড়িটা যারা কিনবে, তাদের আরও অনেক গুণ বেশি টাকা। অর্থ মানেই ক্ষমতা। ওদের সঙ্গে আমরা কী করে পারব? পাড়ার ছেলেদের কথা তুলেছি বটে, কিন্তু সত্যি বলতে কী, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে আমার তেমন কিছু ভাব নেই। মুখ চেনা আছে, কখনো মিশিনি ভালো করে। কখনো ওদের সঙ্গে পুজোর চাঁদা তুলতে বেরোইনি, ওরা আমাকে পাত্তা দেবে কেন?
যদি মামলা মকদ্দমা করতে হয়, ওরে সর্বনাশ, আমি উকিলের বাড়ি ছোটাছুট করব? আমি? ওহে নীললোহিত, কোনো উকিলের বাড়িতে একগাদা মক্কেলের মধ্যে তুমি বসে আছ, সেই সময় তোমার চেহারাখানা কেমন দেখাচ্ছে, কল্পনা করো তো? তার চেয়ে এক দৌড়ে দিকশূন্যপুরে পালিয়ে যাওয়া অনেক ভালো। দিকশূন্যপুরের পাহাড়, গাছপালা, বন্দনাদি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
কিন্তু দাদা ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
এই বিপদের মধ্যে শুধু মা আর বৌদিকে ফেলে পালিয়ে যাওয়াটা বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। ফিরে এলে আর আমাকে এ বাড়িতেই ঢুকতে দেবে না। কিংবা ফিরে এসে দেখব, এ বাড়ি ভাঙা হয়ে গেছে, দাদারা উঠে গেছে অন্য জায়গায়, সেই ঠিকানাও আমি জানব না। তখন আমায় ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হবে রাস্তায় রাস্তায়।
মা বললেন, তোর এত লোকের সঙ্গে চেনাশুনো, কেউ একটু সাহায্য করতে পারে না?
আমি বললাম, এতে আবার কে সাহায্য করবে? এটা তো বাড়িওয়ালা—ভাড়াটের নিজস্ব ব্যাপার
মা আর একটু উষ্মার সঙ্গে বললেন, কেউ তো এতদিনেও তোকে একটা চাকরি জুটিয়ে দিতে পারল না!
আমি উঠে পড়লাম। এরপর আর এখানে থাকা চলে না। মাকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে আমি চাকরির কাঙাল নই। অনেকে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেও কিছু জোটাতে পারে না। আর আমি চাকরি পেলেও নেব না! আমার যোগ্য চাকরি পৃথিবীতে আজও তৈরি হয়নি। ‘পৃথিবীতে নাহি কোনো বিশুদ্ধ চাকুরি’, এই লাইনটা আমি বারবার বিড়বিড় করি!
বছর দু’এক আগে সিঙ্গাপুর থেকে মেজোমামা এসে কী ঝামেলাতেই না ফেলেছিল। যারা বিদেশে থাকে, তাদের মাঝে মাঝে দেশের উপকার করার নেশা জেগে ওঠে। মেজোমামা আমাকে চাকরিতে জুতে দেবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। সেবারে খুন হতে হতে কোনোক্রমে বেঁচে গেছি।
রাস্তায় বেরিয়ে ঠিক করতে পারলাম না, কোথায় যাব।
আমার আড্ডা মারতে যাওয়ার জায়গার অভাব হয়নি কখনো। কফিহাউস যাওয়া যেতে পারে, নিরুপমদা কিংবা চন্দনদার বাড়িতে যখন তখন যাওয়া যায়, আজ ছুটির দিন। তপনদার বাড়িতে গেলে দুপুরে না খাইয়ে ছাড়বে না।
তবু এক-একদিন মনে হয়, পৃথিবীতে কোথাও আমার ঠাই নেই, সব জায়গাতেই আমি বেমানান। কেউ অপেক্ষা করে নেই আমার জন্য, কল্পনাতেও কোনো নারী আমার কাছে আসে না। সব কিছুই সুদূর।
একটা লাল রঙের গাড়ি একটু দূরে হঠাৎ ব্রেক কষে পিছিয়ে এল।
জানলা দিয়ে মুখ বার করে লালুদা একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, সেনসাস ডিপার্টমেন্টে কাজ পেলে নাকি হে? রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষ গুনছো। ঠিক এই সময় লালুদার সঙ্গে সময় কাটাবার কোনো আগ্রহ জাগল না আমার। ভদ্রতা করে শুধু একটু হাসলাম।
লালুদা পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, উঠে পড়ো, উঠে পড়ো!
—না লালুদা, আমি উল্টোদিকে যাব।
—তার মানে? হাত গুনতে শিখেছ নাকি? কী করে জানলে আমি কোন্ দিকে যাচ্ছি! তোমার মতে কোটা সোজা দিক?
–আমি যাব দক্ষিণেশ্বর!
—ভেরি গুড। আমি যাচ্ছি শেয়ালদায়, ওখান থেকে দক্ষিণেশ্বর কাছেই।
—শেয়ালদার কাছে দক্ষিণেশ্বর?
—শেয়ালদা থেকে ট্রেনে চাপবে। দক্ষিণেশ্বর যেতে কতক্ষণ লাগবে? ওঠো, ওঠো, পেছনের গাড়ি হর্ন দিচ্ছে।
আর আপত্তি করার সুযোগ পাওয়া গেল না। লালুদা স্টার্ট বন্ধ করেনি, আমি উঠে বসতেই হুস করে মোড় পার হয়ে গেল। তারপর ড্যাশবোর্ড খুলে বলল, সিগারেটের প্যাকেট আছে, নাও!
পরোপকারী লালুদা। নিজে সিগারেট খায় না, তবু প্যাকেট রাখে। বেলা এগারোটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত লালুদার পরোপকারের সময়। যে—সময় স্বামীরা অফিসে যায় সেই সময় লালুদা বিভিন্ন বাড়িতে ঘুরে ঘুরে বউদের অনেক সমস্যার সমাধান করে দেয়। কার বাড়িতে কাজের লোক নেই, কে গ্যাস পাচ্ছে না, কার টেলিফোন খারাপ, কার বাড়ির দেয়ালে উই লেগেছে, এসব শোনামাত্র লালুদা তৎপর হয়ে ওঠে। অধিকাংশ স্ত্রীদের মতে তাদের স্বামীরা অপদার্থ, সংসারের কোনো কাজ করে না। লালুদা তাদের পরিত্রাতা।
লালুদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ক’মুহূর্ত কি যেন ভাবল। পরে জিজ্ঞেস করল, মোহিতলাল, তুমি এখন কলকাতায় আছ কিছুদিন, নাকি আবার কোথাও পালাবার মতলব করছ?
—আছি কিছুদিন। কেন বলুন তো?
–তোমার ওপর একটা কাজের ভার দিতে পারি? তুমি যখন ফ্রি আছ!
—কী কাজ বলুন তো?
—কাজটা তোমার বেশ পছন্দই হবে। ইয়াংম্যান, এটা হবে তোমার সঙ্গে কাজের সঙ্গে প্লেজার মেশানো ব্যাপার। তুমি একটা মেয়ে-ইস্কুলের সামনে ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে থাকবে। ছুটির সময় ফুটফুটে সুন্দর সব মেয়েরা বেরুবে। তুমি তাদের দিকে নজর রাখবে আর ফুকফুক করে সিগারেট টানবে। সিগারেটের খরচ আমিই দোবো!
—এটা কী ধরনের কাজ, লালুদা?
–কেন, এক ঘণ্টা ধরে মেয়ে দেখার কাজটা তোমার ভালো মনে হচ্ছে না?
—মেয়ে-দেখা নিশ্চয়ই খুব ভালো ব্যাপার। কিন্তু এটা কাজ হয় কী করে? আমি এই কাজটা করলে আপনার কী লাভ হবে, সেটাও তো জানা দরকার!
—হ্যাঁ। সেটা তুমি জানতে চাইবে, এটা খুব স্বাভাবিক। মোহিতলাল, তুমি আমাদের নিজেদের লোক, তোমাকে কনফিডেন্সে নিতে অসুবিধে নেই। আবার একটা সমস্যা হয়েছে পুপুকে নিয়ে।
—পুপু? পুপু কে?
–তুমি পুপুকে চেনো না? আরে আমাদের চন্দন আর নীপার মেয়ে।
—সে তো মুমু। আপনি পুপু বলছেন কেন?
—ঐ একই হলো। মুমু, মুমু, মুমু! হ্যাঁ ঠিক। আর ভুল হবে না।
—আর একটা কথা লালুদা, আপনি কি ঠিক জানেন, আমি কে? আমাকে অন্য কোনো লোক ভেবে কথা বলছেন না তো?
—তার মানে? তোমাকে চিনব না?
—এর আগে আপনি আমাকে ভুল করে নীলকান্ত, নীলমাধব, নীলকমল এরকম অনেক নাম ধরে ডেকেছেন। আজ হঠাৎ মোহিতলাল বলছেন কেন? এর মধ্য নীলটুকু পর্যন্ত নেই!
—ওঃ হো! তাই তো! তোমাকে আমি এত পছন্দ করি, কিন্তু তোমার নামটা কিছুতেই মনে রাখতে পারি না।। এক-একবার মনে আসে, আবার হারিয়ে যায়। এবার ফাইন্যালি বলে দাও, আর ভুল হবে না। কী নাম তোমার?
—নীললোহিত।
–এই জন্যই মনে থাকে না। এমন বিদঘুটে নাম জন্মে শুনিনি। কে রেখেছিল? এই নামের মানে কী?
—বাড়িতে বাংলা ডিক্সনারি নেই? ডিক্সনারি খুঁজে দেখে নেবেন।
—আমি বাংলা ভালো জানি, বুঝলে! লোহিত মানে তো লাল? তাহলে খুব ভুল বলিনি। মোহিতলালের মধ্যেও লাল আছে। যাক গে, আসল কথাটা হোক। আমাদের মুমুকে নিয়ে আবার একটা সমস্যা হয়েছে।
—আবার কী হলো?
—জানোই তো কেমন জেদি মেয়ে। ইস্কুলে কেউ ওকে পৌঁছে দেবে, নিয়ে আসবে এটা ও পছন্দ করে না। বড় হয়েছে, ক্লাস টেনে পড়ে। একা একা স্কুলে যায়। একা ফেরে।
—তাতে কী হয়েছে, ওর বয়েসী অধিকাংশ মেয়েই তো নিজে নিজে স্কুলে যায়।
—তা যায়। আমি অস্বীকার করছি না। ট্রামে-বাসে কত দল বেঁধে যায়। কিন্তু মুমুকে নিয়ে মুস্কিল হয়েছে। স্কুল ছুটি হয় সাড়ে তিনটের সময়। চারটের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসার কথা। কিন্তু মুমু প্রায়দিনই পেরে পাঁচটায়, কোনো কোনো দিন সাড়ে পাঁচটা হয়ে যায়।
—ট্রাম-বাসের যা অবস্থা, তাতে দেরি তো হতেই পারে।
—এক-আধদিন হতে পারে। কিন্তু রেগুলার? চন্দন আর নীপা দু’জনেই অফিস করে। কেউই ছ’টার আগে বাড়িতে আসতে পারে না। চন্দনের তো আরও অনেক দেরি হয়। মেয়েটা ঠিক নীপা ফেরার একটু আগে ফেরে।
–আপনি কী করে জানলেন?
–আমার কাছেই তো ধরা পড়েছে। মেয়েটা কী রকম চোখে-মুখে মিথ্যে কথা বলে তা তো তুমি জানোই! আমি জিজ্ঞেস করলুম, পুপু, তোর এত দেরি হয় কেন রে?
–ও কোনো উত্তর দিয়েছিল?
—প্রথমে তো উত্তর দিতেই চায় না।
—স্বাভাবিক, আপনি ওর নাম ভুল বললে ও উত্তর দেবে কেন? ও তো পুপু নয়। পুপু নামে কোনো মেয়ে দেরি করে ফেরার জন্য ও দায়ী হবে কেন?
—আহা, তোমার কাছে পুপু বলে ফেলেছি! ওর কাছে বলিনি। অনেক জেরা করার পর একবার বলল, ইস্কুলেই বেশিক্ষণ থাকে। একজন দিদিমণি একসট্রা টিউটোরিয়াল ক্লাশ নেয়। আবার বলল, এক-একদিন ও স্কুলের অন্য একটা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে পিংপং খেলে। তাদের বাড়িতে পিংপং বোর্ড আছে।! এর কোনোটাই আমার বিশ্বাস হয় না। কাঁচা বয়েসের মেয়ে, এরকম বাড়ির বাইরে থাকা তো ভালো নয়।
—আপনি বাজে সন্দেহ করছেন, লালুদা! কোনো বান্ধবীর বাড়িতে যদি পিংপং খেলতে যায়, তাতে দোষের কী আছে? ও যদি ছেলে হতো, তা হলে কি আপত্তি করতেন? আজকাল মেয়েদেরও অত আটকে রাখলে চলে না।
–তোমার কাছ থেকে আমি মুমুর হয়ে ওকালতি তো শুনতে চাইনি! নীপা এখনো কিছু জানে না। ব্যাঙ্কের কাজে বেচারাকে কত খাটতে হয়, তার ওপর মেয়েকে নিয়ে যদি ওকে দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়, সেটা কত খারাপ হবে বলো তো। তোমাকে আমি যে-কাজের ভার দিতে চাই, তুমি তা করতে রাজি আছ কি না, সেটা বলো! ছুটির সময় তুমি ওদের স্কুলের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকবে। মেয়েটা কী করে, কোথায় যায়, তার ওপর নজর রাখবে।
—মুমু যদি আমায় দেখতে পেয়ে যায়?
—একেবারে কি ইস্কুলের দারোয়ানের পাশে তোমাকে দাঁড়াতে বলেছি। সেখানে কোনো গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে।
—যদি কোনো গাছ না থাকে?
—বুদ্ধি খরচ করবে, বুদ্ধি খরচ করবে। কী ভাবে লুকোতে হয়, সেটা তুমি ভেবে বার করতে পারবে না? দিন সাতেক ওয়াচ করার পর আমাকে রিপোর্ট দেবে!
—আজকাল শুনেছি অনেক প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি হয়েছে। তাদের কোনো লোক লাগালেই পারেন!
—এটা যে উজবুগের মতন কথা হয়ে গেল, ভাই! তুমি নিজেদের লোক বলেই তোমাকে বললাম। আগেই ঘরের কেচ্ছা বাইরের লোককে জানায় কেউ? ছিঃ! কারুক্কে তুমি এখন কিছু বলবে না। কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। মুমুও না, নীপাও না। ভেরি কনফিডেনশিয়াল। তোমার যা খরচ-খর্চা লাগে, তা আমি দিয়ে দেব!
-খরচ দিতে হবে না, লালুদা। তার বদলে আপনি একটা বাড়ি দিতে পারবেন?
লালুদা এমনই চমকে উঠল যে আর একটু হলে পাশের গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা মেরে অ্যাকসিডেন্ট করতে যাচ্ছিল।
তাড়াতাড়ি রাস্তার ধারে গাড়িটা লাগিয়ে লালুদা চোখ গোল গোল করে প্রায় এক মিনিট তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, কী? এই সামান্য কাজের বিনিময়ে তোমাকে একটা আস্ত গোটা বাড়ি দিতে হবে? তুমি আমাকে ব্লাকমেইল করতে চাও?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, না, না, লালুদা। আমি আস্ত কিংবা ভাঙা, কোনো রকম গোটা বাড়ি চাই না। বাড়িটা এমনি কথার কথা। আসলে আমি বলতে চেয়েছিলাম, একটা ভাড়ার ফ্ল্যাট। আপনি একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিতে পারবেন?
লালুদা তবু গোমড়া মুখে বলল, কেন, হঠাৎ ফ্ল্যাটের কথা কেন? একটা জরুরি বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তার মধ্যে ফ্ল্যাট এল কী করে? তুমি বিয়ে করে আলাদা থাকতে চাও বুঝি?
—সেসব কিছু না। আমাদের বাড়িওয়ালা নোটিস দিয়েছে। আমাদের ফ্ল্যাটটা ছাড়তে হবে।
লালুদা আবার চুপ করে রইল একটুক্ষণ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, স্যরি, লালমোহন, আমি বাড়িওয়ালা-ভাড়াটেদের ব্যাপারে তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না। আমি নিজে বাড়িওয়ালাদের সাইডে। আমার দু’খানা বাড়ি আছে। ভাড়াটেগুলো মহা ঢেঁটিয়া। স্পেশালি আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটা ভাড়াটে দারুণ ট্রাবল দিচ্ছে। সে ব্যাটা মহা হারামজাদা! তাকে টাইট দিতেই তো এখন যাচ্ছি।
—কী করছে সেই ভাড়াটে?
–সেটা তোমাকে বলব কেন? তুমি সেই টেকনিকটা শিখে নিয়ে তোমার বাড়িওয়ালাকে টাইট দিতে চাও বুঝি? আমি নিজে বাড়িওয়ালা হয়ে অন্য বাড়ির মালিকদের বিট্রে করতে পারি না। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কোনো হেল্প করতে পারব না।
লালুদার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে আমি ধরালাম। ফস করে এইরকম ভাবে কথাটা বলা আমার ঠিক হয়নি। মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে। লালুদা শুধু মেয়েদের উপকার করে, ছেলেদের পাত্তা দেয় না। যতদূর মনে পড়ছে, একবার সুনন্দা বৌদির জন্য লালুদা সাতদিনের মধ্যে একটা ঝকঝকে নতুন ফ্ল্যাট খুঁজে দিয়েছিল।
লালুদাকে এই অনুরোধ করার বদলে আমাদের বাড়িতে একদিন নেমন্তন্ন করে আমার বৌদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। আমার বৌদিকে দেখতে শুনতে বেশ ভালোই। বৌদির প্রেমে পড়তে লালুদার বেশি দেরি লাগবে না। তখন কি বৌদির অনুরোধ ঠেলতে পারবে!
দুপুরবেলার প্রেমিক হিসেবে লালুদা বেশ নিরাপদ। বড় জোর হাতটাত ধরে, তার বেশি এগোয় না। আমার চেনাশুনো বেশ কয়েকজন বৌদির সঙ্গেই লালুদার এরকম নিরীহ বন্ধুত্ব আছে আমি জানি। একমাত্র নীপা বৌদির সঙ্গেই একটু মাখোমাখো সম্পর্ক। অথচ লালুদা সব জায়গায় বলে বেড়ায়, নীপা বৌদি ওর ‘বোনের মতন’। কোনো মেয়েকে ‘বোনের মতন’ ভেবেও তার সঙ্গে প্রেম করা কী ভাবে যে সম্ভব, তা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না।
পকেট থেকে পার্স বার করে লালুদা জিজ্ঞেস করল, কত অ্যাডভান্স নেবে? একশো? দেড়শো?
আমি লালুদার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বাড়ুক, আর একটু বাড়ুক! কিন্তু আমার নৈঃশব্দকেই সম্মতি ধরে নিয়ে লালুদা তিনখানা পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিল। যা পাওয়া যায়, তাই লাভ!
লালুদা বলল, আজ তো ছুটির দিন। কাল থেকেই কাজ শুরু করে দাও। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার কী জান? ড্রাগ্স্! আজকাল নাকি স্কুলের ছেলেমেয়েরাও ড্রাগ্স ধরছে! কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
আমি খুব চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম।
মৌলালি দিয়ে এসে শিয়ালদার কাছে ওভারব্রীজের মুখে আমাকে নামিয়ে দিল লালুদা। আমার অবশ্য দক্ষিণেশ্বরে যাবার কোনো প্রয়োজনই নেই, সেখানে কারুক্কে চিনি না। লালুদাকে এড়াতে চেয়েছিলাম, তবু লাভ হয়ে গেল দেড়শো টাকা।
এখন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে গিয়ে অনায়াসে মাটন ওমলেট খাওয়া যায়। মনখারাপের শ্রেষ্ঠ ওষুধ মাটন ওমলেট। একা খাওয়ার বদলে যদি কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে খাওয়াবার পয়সা পকেটে থাকে তা হলে মেজাজ আরও ফুরফুরে হয়ে যায়।
কফি হাউসের মুখে কাঁধে দুটো ক্যামেরা ঝোলানো প্রীতমের সঙ্গে দেখা। প্রচুর জায়গায় চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরাঘুরির পর কিছুই না পেয়ে প্রীতম এখন প্রফেশানাল ফটোগ্রাফার হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানির ছবি তোলে। মাঝে মাঝে ট্যাক্সি চাপে দেখে মনে হয়, রোজগার খারাপ নয়।
আমাকে দেখেই প্রীতম বলল, নীলু, তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, খুব ভালো হলো। দেবীগড় যাবি?
—দেবীগড়? সে আবার কোথায়?
—দেবীগড় জঙ্গলের নাম শুনিসনি? ওড়িশায়! খুব সুন্দর জঙ্গল, বেশি লোক যায় না। আমাকে একটা অ্যাসাইনমেন্টে যেতে হবে। তুই যদি যেতে চাস, শুধু ট্রেন ভাড়াটা ম্যানেজ করলেই—
আমার রক্ত ছলকে উঠল। জঙ্গলের আহ্বান। যে জঙ্গল দেখিনি। ওড়িশার যে-কোনো জঙ্গল আমার প্রিয়।
প্রীতম বলল, থাকা-খাওয়া নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। সব ব্যবস্থা আছে। যাবি তো বল, আগে টিকিট কাটতে হবে।
—কবে?
—সামনের সোমবার। সন্ধ্যের ট্রেন। সম্বলপুরে গিয়ে নামব।
আজ বুধবার, মাঝখানে চারটে দিন রয়েছে। দাদার সোমবারই ফেরার কথা। দাদা না ফিরলেই বা ক্ষতি কী? বাড়িওয়ালা অংশুবাবু তো দু’দশ দিনের মধ্যেই আমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিচ্ছে না! দাদা ফিরে এসে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করবে। বৌদি আর মা এমন কিছু অবলা নয়। আমি কয়েকটা দিন না থাকলেও ওঁদের ঠিক চলে যাবে। অরণ্যের আহ্বান তো উপেক্ষা করা যায় না।
মুমুর ব্যাপারটা নিয়ে আমি মাথাই ঘামাতে চাই না। মুমু যদি স্কুলের পর তার কোনো বন্ধুর বাড়িতে পিংপং খেলতে যায় তো বেশ করে!
আমি প্রীতমের দিকে চোখ রাঙিয়ে বললাম, ইস্টুপিড, তোর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল বলেই তুই আমাকে জঙ্গলে যাবার খবরটা দিলি? আজ আমি কফি হাউস না এলে আমার কথা মনেও পড়ত না। অকৃতজ্ঞ কোথাকার! এর আগে কতবার আমি তোকে কত জায়গায় নিয়ে গেছি!
প্রীতম আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলল, বিশ্বাস কর, আমি আজই তোর বাড়িতে যেতাম। বাড়িতে একটা টেলিফোন রাখিস না কেন, নীলু? অ্যাপ্লাই কর, যাতে তাড়াতাড়ি পাস আমি ব্যবস্থা করে দেব।
বাড়িটাই কদিন থাকবে তার ঠিক নেই, তার ওপর আবার টেলিফোন। এই প্রীতম কিছুদিন আগেও আমার পেছনে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াত, এখন বেশ ভারিক্কি চালে কথা বলে।
আমি বললাম, চল, ওপরে গিয়ে মাটন ওমলেট খেতে খেতে প্ল্যানটা করে ফেলা যাক।
প্রীতম খানিকটা চমকে গিয়ে বলল, মাটন ওমলেট? আমি তো এখন তোকে কিছু খাওয়াতে পারছি না ভাই। আমার কাছে ক্যাশ নেই, একটা চেক রয়েছে।
—আমি খাওয়াব।
প্রীতম তবু সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল।
—সিঙ্গল নয়, ডাব্ল! সঙ্গে কোল্ড কফি।
—ধার রাখার কথা বললে এরা বড্ড অপমান করে রে, নীলু।
আমি উদারভাবে প্রীতমের পিঠ চাপড়ে বললাম, চল, চল, ভয় পাচ্ছিস কেন? জনৈক বেকার কর্তৃক তার এক উচ্চ রোজগারি বন্ধুকে পেট ভরে খাওয়াবার একটা দৃষ্টান্ত আমি স্থাপন করতে চাই।