বাড়ন্ত ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু বিদগ্ধ উপকথা
Some Learned Fables for Good Old Boys and Girls
প্রথম পর্ব– বনের জীবজন্তুরা কেমন করে একটা বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রীদল পাঠাল
এক সময়ে বনের জীবজন্তুরা একটা মহা সম্মেলন ডেকে তাদের ভিতরকার সবচাইতে খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি কমিশন নিয়োগ করল। বনজঙ্গল পেরিয়ে অজ্ঞাত ও অনাবিষ্কৃত জগতে পাড়ি দিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার করা এবং তাদের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে যে সব বিষয় শেখানো হয়ে থাকে তার সত্যতা যাচাই করাই হবে কমিশনের কাজ। এত বিরাট একটা উদ্যোগে জাতি এর আগে কখনও আত্মনিয়োগ করে নি। এ কথা সত্য যে, জংলের দক্ষিণ কোন বরাবর জলাভূমির ভিতর দিয়ে একটা উত্তর-পশ্চিমমুখী পথের সন্ধনে এক সময় কিছু বাছা বাছা লোক সঙ্গে দিয়ে সরকার ডক্টর কোলা ব্যাঙ কে পাঠিয়েছিল, এবং সেই থেকে ড ক্টর কোলা। ব্যাঙের সন্ধনে অনেকগুলি অভিযাত্রী দলকেও পাঠিয়েছে; কিন্তু তার কোন খোঁজই পাওয়া যায় নি; সুতরাং শেষ পর্যন্ত সরকার তার মৃত্যুকে স্বীকার করে নিয়ে বিজ্ঞানের সেবায় ছেলের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার মাকে নানা গৌরবে ভূষিত করেছে। আর একবার সরকার স্যার কাঠ–ফড়িং-কে পাঠিয়েছিল যে নদীর জল এসে জলাভূমিতে পড়েছে তারই উৎস সন্ধনে; আর তারপরে স্যার। কাঠ-ফড়িং-এর খোঁজে অনেকগুলি অভিযাত্রী দলও পাঠিয়েছিল; শেষ পর্যন্ত তাদের সে কাজে তারা সফলও হয়েছিল-তার মৃতদেহটি তারা খুঁজে পেয়েছিল, কিন্তু মরবার আগে উ ৎসের সন্ধান সে পেয়েছিল কি না সেটা জানিয়ে যায় নি। সুতরাং সরকার যথোচিত মর্যাদায় তার সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল, আর সে অন্তেষ্টিক্রিয়া অনেকেরই ঈর্ষার কারণ হয়েছিল।
কিন্তু বর্তমান অভিযানের তুলনায় সেগুলো ছিল অতি তুচ্ছ; কারণ এই অভিযাত্রী দলে আছে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ তারাই; তাছাড়া আগেই তো বলেছি-এই মহান অরণ্যের ওপারে যে সম্পূর্ণ অপরিজ্ঞাত অঞ্চ ল আছে সেইখানে তাদের যেতে হবে। এই সদস্যদের নিয়ে কত ভোজসভা, কত স্তবস্তুতি, কত আলোচনা। তাদের মধ্যে যে কেউ যেখানেই দর্শন দিক, সেখানেই জনতার ভিড়, সেখানেই শত উৎসুক চোখের দৃষ্টি।
শেষ পর্যন্ত তারা যাত্রা করল। সে একটা দেখবার মত দৃশ্য। দীর্ঘ শোভাযাত্রা-বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিতে বোঝাই শুকনো দেশের কচ্ছপের দল, সংকেত পাঠাবার কাজের জন্য জোনাকির দল, খাবার-দাবার, সংবাদ আদান-প্রদান ও গর্ত খোঁড়ার জন্য পিঁপড়ে ও গুবরে-পোকা, জরিপের শিকল বয়ে নেওয়া ও অন্য নানাবিধ যন্ত্রবিদের কাজের জন্য মাকড়শার দল, এমনই আরও কত কিছু। কচ্ছপদের পরে জলপথের যান-বাহন হিসাবে আছে শক্ত ও চওড়া পিঠ বিরাট দেহ সব কাদা-কাছিমের লম্বা সারি; প্রতিটি কচ্ছপ ও কাছিমের সঙ্গে একটা করে চমৎকার উজ্জ্বল পতাকা; মিছিলের একেবারে মাথায় সামরিক বাদ্য বাজিয়ে চলেছে ভ্রমর, মশা, ফরিং ও ঝি ঝি পোকার দল; আর সেই গোটা মিছিলটা চলেছে ক্রিমি-কীট বাহিনীর বারোটা বাছা বাছা সেনাদলের আশ্রয়ে ও তত্ত্বাবধানে।
তিন সপ্তাহ চলার পরে অভিযাত্রী দলটি বন থেকে বেরিয়ে বিরাট অজ্ঞাত জগতের মুখোমুখি হল। একটি আকর্ষণীয় দৃশ্য তাদের দৃষ্টিকে স্বাগত জানাল। তাদের সম্মুখে একটা বিরাট সমতল প্রান্তর প্রসারিত; তার ভিতর দিয়ে বয়ে চলেছে স্রোতস্বিনী; আর তাকেও ছাড়িয়ে আকাশের প্রেক্ষাপটে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি দীর্ঘ সুউচ্চ প্রাচীর-সেটা যে কি তারা জানে না। গুবরে-পোকা বলল, তার বিশ্বাস মাটি টাই ঠেলে উঁচুতে উঠে গেছে, কারণ সেখানেও সে গাছপালা দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু অধ্যাপক শম্বুক ও অন্যরা বলল;
স্যার, আপনাকে ভাড়া করে আনা হয়েছে খোঁড়াখুঁড়ি করবার জন্য- বাস, ঐ পর্যন্তই। আমাদের প্রয়োজন আপনার মাংসপেশীর-মস্তিস্কের নয়। বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাপারে আপনার মতামতের দরকার হলে আমরাই আপনাকে জানাব। অন্য শ্রমিকরা যখন শিবির স্থাপনে কর্মরত তখন আপনার এই শান্ত ভাব অসহ-অকারণেই আপনি এখানে লেখাপড়ার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে এসেছেন। চলে যান, মালপত্র টানতে সাহায্য করুন গে।
গুবরে-পোকা কোন রকম বিচলিত বা বিমর্ষ না হয়ে পা চালিয়ে দিল; মনে মনে বলল, এটা যদি মাটির স্তূপ না হয় তাহলে আমার যেন পাপীর মৃত্যু হয়।
অধ্যাপক কোলা ব্যাঙ (স্বৰ্গত আবিষ্কারকের ভাই-পো) বলল, তার বিশ্বাস এই পাহাড় পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে। সে বলতে লাগল:
আমাদের পূর্বপুরুষরা অনেক জ্ঞান-ভাণ্ডার রেখে গেছেন, কিন্তু তারা তো দূর দেশে যান নি, তাই এটাকে আমরা একটি মহৎ নতুন
আবিস্কার বলে গণ্য করতে পারি। আমাদের প্রচেষ্টা যদি এই একটি মাত্র অপদানেই শুরু ও শেষ হয় তাহলেও আমাদের খ্যাতি সুনিশ্চিত। আমি শুধু ভাবছি, এই প্রাচীর কি দিয়ে তৈরি? ছত্রাক কি? প্রাচীর নির্মাণের পক্ষে ছত্রাক অবশ্যই একটি উৎকৃষ্ট জিনিস।
অধ্যাপক শম্বুক ফিল্ড–গ্লাসটাকে ঠিক মত চোখে লাগিয়ে দেয়ালটা ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখে বলল: এটা যে তরল পদার্থ নয় তা থেকেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তাপতাড়িত উৰ্দ্ধমুখী জলকণা উত্তপ্ত হওয়ার ফলে যে ঘণীভূত বাপ সৃষ্টি হয় তার দ্বারাই এই প্রাচীর গঠিত হয়েছে। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারাই এটা প্রমাণ করা যায়, কিন্তু তার কোন প্রয়োজন নেই। এটা একান্তই স্পষ্ট।
সুতরাং ফিল্ড–গ্লাসটা বন্ধ করে সে তার খোলসের মধ্যে ঢুকে পৃথিবীর শেষ সীমান্ত ও তার স্বরূপ আবিষ্যর বিষয়ক তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করতে বসল।
অধ্যাপক কোণ-কীট অধ্যাপক মেঠো ইঁদুরের দিকে তাকিয়ে বলল, কী গভীর মনীষা! এর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কাছে কোন কিছুই রহস্যাবৃত থাকতে পারে না!
ক্রমে রাত নেমে এল। শাস্ত্রী ঝি ঝি পোকারা ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে জায়গা নিল। জোনাকিদের আলো জ্বালানো হল। সারা শিবির নৈঃশব্দ ও নিদ্রায় ডুবে গেল। সকালে প্রাতরাশের পরে অভিযাত্রী দল আবার এগিয়ে চলল। দুপুর নাগাদ তারা একটা বড় রাস্তায় পড়ল। সেখানে দুটো সীমাহীন সমান্তরাল দণ্ড ছিল। তাদের উচ্চ তা সব চাইতে উঁচু কোলা ব্যাঙের সমান। বিজ্ঞানীরা সে দুটোর উপর চড়ে নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখল। সে দুটোর উপর চড়ে তারা অনেক দূর পর্যন্ত গেল, কিন্তু না পেল কোথাও ছেদ, না পেল তাদের অন্ত। তারা কিছুই বুঝতে পারল না। বিজ্ঞানের কোন তথ্য-পুস্তকে এ ধরনের জিনিসের উল্লেখ নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে যুগের প্রধান ভূগোলবিদ টাক-মাথা মাননীয় মেঠো কাছিম বলল;
বন্ধুগণ, এখানেও আমরা একটা নতুন আবিষ্কার করতে পেরেছি। আমাদের বিজ্ঞতম পূর্বপুরুষগণ যাকে মনে করত নিছক কল্পনা তারাই ইন্দ্রয়গ্রাহ্য অক্ষয় বাস্তুবরূপ আমরা এখানে প্রত্যক্ষ করেছি। বন্ধুণ, মস্তক অবনত করুন, কারণ এক মহান সত্ত্বার সামনে আমরা দাঁড়িয়েছি। এগুলো সমান্তরাল লঘিমা!
এই নব-আবিষ্কারের গুরুত্ব এতদূর মহত্ত্বপূর্ণ, এতদূর ভয়ংকর যে প্রতিটি অন্তর, প্রতিটি শির অবনত হল। অনেকের চোখে নামল জলধারা।
তাঁবু ফেলা হল। সারাটা দিন কেটে গেল এই মহাবিস্ময়ের বিস্তারিত বিবরণ লিখতে ও সৌরজাগতিক পরিসংখ্যানকে তদনুযায়ী। সংশোধন করতে। মধ্যরাত্রিতে শোনা গেল একটা দানবীয় আর্তনাদ, একটা খটাখট, খখস্ আওয়াজ; পরমুহূর্তেই একটা প্রকাণ্ড ভয়ঙ্কর চোখ জ্বলে উঠল, একটা দীর্ঘ লেজ তার সঙ্গে যুক্ত; জয়সূচক চীৎকার করতে করতে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
শিবিরের শ্রমিকরাও ভয়ে কাঁপতে লাগল। এক সঙ্গে পড়িমরি করে ছুটে বের হল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা সে রকম কিছুই করল না। তারা সংরাচ্ছন্ন নয়। তারা শান্তভাবে আলোচনা শুরু করে দিল। প্রবীণ ভূগোলবিদের মতামত জানতে চাওয়া হল। সে খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়ে অনেকক্ষণ ধরে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রইল। আবার যখন বেরিয়ে এল তখন তার ভক্তিন মুখ দেখেই সকলে বুঝতে পারল যে সে আলোর সন্ধান পেয়েছে। সে বলল: এই বিরাট বস্তুটিকে দেখবার সৌভাগ্য লাভ করেছি বলে সকলেই ধন্যবাদ জানও। এটাই মহাবিষুব সংক্রান্তি!
আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে সকলে হৈ-হৈ করে উঠল।
কোণ-কীট অনেক চিন্তা-ভাবনার পরে দেহটাকে প্রসারিত করে বলল, কিন্তু এখন তো ভরা গ্রীষ্মকাল।
কাছিম বলল, ঠিক কথা; আমরা তো নিজেদের দেশ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি; দুটি স্থানের দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঋতুরও পরিবর্তন ঘটে।
ঠিক, খুব ঠিক। কিন্তু এখন তো রাত। রাত্রিতে সূর্য আসবে কেমন করে?
নিঃসন্দেহে এই দূরবর্তী অঞ্চলে সূর্য রাতের বেলাতেই দেখা দিয়ে থাকে।
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে এটা খাঁটি কথা। কিন্তু এখন তো রাত, তাহলে আমরা সূর্যকে দেখতে পেলাম কেমন করে?
সেটাই এক পরম রহস্য। সেটা আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য যে এই সব দূরবর্তী অঞ্চলে বায়ুর আর্দ্রতা এমনই যে দিনের আলোর কণাগু লি সৌর-চক্রের সঙ্গে লেগে থাকে, আর সেগুলোর সাহায্যেই আমরা অন্ধকারেও সূর্যকে দেখতে পাই।
এটাকে সন্তোষজনক বিবেচনা করে তদনুসারে সব কথা লিপিবদ্ধ করা হল।
কিন্তু ঠিক এই সময়েই সেই ভয়ঙ্কর আর্তনাদ আবার শোনা গেল। রাত্রির বুক ভেদ করে আবার এল সেই বজ্র-গর্জন। আবারও সেই প্রকাণ্ড অগ্নিময় চোখ ঝলসে উঠেই অনেক দূরে হারিয়ে গেল।
শিবিরের মজুররা আতংকে জীবনের আশাই ছেড়ে দিল। পণ্ডিতজনরাও খুবই বিচলিত হয়ে পড়ল। এ রহস্যের তো কোন ব্যাখ্যা। পাওয়া যাচ্ছে না। তারা ভাবল আর আলোচনা করল; আলোচনা করল আর ভাবল। শেষ পর্যন্ত মহাপণ্ডিত বৃদ্ধ শ্রীমন্মহাপ্রভু দীর্ঘপদ ঠাকুর্দা ধ্যান ভঙ্গ করে হাত-পা ভেঙে বসে বলে উঠল: ভাই সব, আগে তোমাদের মতামত বল, তারপর শোনাব আমার মনের কথা-কারণ আমি মনে করি যে এ সমস্যার সমাধান করতে আমি পেরেছি।
শুটকো-দেহ অধ্যাপক গেছো-উকুন বলল, তাই হবে মহাপ্রভু, কারণ প্রভুর শ্রীমুখ থেকে আমরা অবশ্যই জ্ঞানগর্ভ বাণীই শুনতে পাব। হয়তো জ্যোতির্বিদ্যার ব্যাপারে নাক গলানো আমা উচিত নয়, তবু একান্ত সবিনয়ে আমি নিবেদন করতে চাই যে, যেহেতু এই শেষ আশ্চর্য ভৌতিক মূর্তিটি প্রথম মূর্তিটির ঠিক বিপরীৎ দিকে চলে গেল এবং যেহেতু প্রথমটি কে আপনারা মহাবিষুব সংক্রান্তি বলে মেনে নিয়েছেন, তখন কি এটাই সম্ভব নয়, অথবা নিশ্চিত নয় যে এই শেষেরটি হচ্ছে শরৎকালীন বিষুব-
ও-ও-ও! ও-ও-ও! শুয়ে পড় গে হে! শুয়ে পড় গে! চারদিক থেকে ঠাট্টা-বিদ্রুপের বান ডেকে গেল। বেচারি মেঠো-উকুন লজ্জায় মুখ কালো করে সরে পড়ল।
অনেক আলোচনার পর কমিশন একবাক্যে প্রভু দীর্ঘপদ-কে তার বাণী শোনাতে বলল। প্রভু বলতে লাগল:
সহকর্মী বিজ্ঞানীবৃন্দ, আমার বিশ্বাস আজ আমরা যা দেখেছি সৃষ্টির আদি থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র আর একটি বার সে জিনিস পূর্ণভাবে ঘটেছে। যে যাই মনে করুক, এই ঘটনা অকল্পনীয় গুরুত্ব ও আগ্রহের অধিকারী; তাছাড়া এটা আমাদের কাছে আরও বেশী গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে এর স্বরূপ সম্পর্কে আমরা যা জেনেছি আজ পর্যন্ত আর কোন পণ্ডিত লোক তা জানতে পারে নি, বা কল্পনাও করতে পারে নি। পণ্ডিতবন্ধুগণ, এইমাত্র আমরা যে মহারহস্য প্রত্যক্ষ করলাম সেটি শু গ্রহের পরিক্রমা ছাড়া আর কিছুই নয়!
বিস্ময়ে বিবর্ণ হয়ে প্রতিটি পণ্ডিত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর শুরু হল অশ্রুপাত, করমর্দন, উন্মত্ত আলিঙ্গন ও বল্গাহীন নানাবিধ উচ্ছ্বাস। কিন্তু ক্রমে ক্রমে উচ্ছ্বাস কমে গিয়ে যখন সুবিবেচনা ফিরে এল, তখন বহু গুণে গুণান্বিত প্রধান পরিদর্শক গিরগিটি মন্তব্য করল:
কিন্তু তা কি করে হয়? শুক্র তো সূর্যকে পরিক্রমা করে, পৃথিবীকে নয়।
তীর লক্ষ্যভেদ করল। উপস্থিত সকল পণ্ডিতের বুকই দুঃখে উদ্বেল হয়ে উঠল, কারণ এ সমালোচনা যে অখণ্ডনীয় তা কেউ অস্বীকার করতে পারল না। কিন্তু শ্রীমন্মহাপ্রভু কানের পিছনে দুই বাহু নিয়ে শান্ত গলায় বলল:
আমার বন্ধুটি এই মহা-আবিষ্ণুরের একেবারে মজ্জাকে স্পর্শ করেছেন। হ্যাঁ-আমাদের আগে পর্যন্ত সকলেই মনে করে এসেছে যে। সূর্যের উপর দিয়েই শুক্রের পরিক্রমণ হয়ে থাকে; এটাই তারা ভেবেছে, সমর্থন করেছে, বিশ্বাস করেছে: সরলপ্রাণ মানুষ তারা, তাদের সীমিত জ্ঞানের দ্বারা যতদূর জেনেছিল ঠিকই জেনেছিল; কিন্তু শুক্রের পরিক্রমণ যে পৃথিবীর উপর দিয়েই হয়ে থাকে সেটা প্রমাণ করবার অমূল্য সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছি আমরা, কারণ আমরাই তা প্রত্যক্ষ করেছি!
এই রাজকীয় মণীষার প্রশংসায় সমবেত গুণীজন নিশূ প হয়ে বসে রইল। বিদ্যুতের আলোয় যেমন রাতের আধার দূরে যায়, তেমনই তাদের মন থেকে সব সন্দেহ মুহূর্তে দূর হয়ে গেল।
এমন সময় শ্রীছারপোকা মশায় সকলের অলক্ষ্যে সেখানে হাজির হল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে পরিদর্শক গিরগিটির কাঁধে ডান বাহুটা রাখতেই-কঁধটা সক্রোধে সরে গেল আর শ্রীছারপোকা মাটি তে গড়িয়ে পড়ল। এইভাবে এর-ওর-তার ঘাড়ে ভর দিয়ে বার কয়েক ধরাশায়ী হবার পরে অধ্যাপক কোলা ব্যাঙ গর্জে বলে উঠল:
ও সব কায়দা থাক শ্রীছারপোকা। ওখানে থেকেই তোমার যা বলার আছে বলে চটপট সরে পড়। তাড়াতাড়ি-বল কি খবর এনেছ? আর একটু এগিয়ে এস; উঃ! তোমার গায়ে যে আস্তাবলের গন্ধ বলে ফেল-বলে ফেল।
দেখুন পূজ্যপাদ (ইক!) হঠাৎ একটা জিনিস আমার নজরে পড়েছে। ভাল কথা, প্রথম একটা (ইক!) কি যেন এখানে ঘটল?
মহাবিষুব সংক্রান্তি।
ঠিক। আমি ভদ্রলোককে দেখি নি (ইক!) তারপর আর একটা (ইক!) কি ঘটল?
শুক্রের পরিক্রমণ।
ঠিক। সেই সময় একট। (ইক!) জিনিস এখানে পড়েছে।
বটে! কী ভাগ্য! সুসংবাদ! শিগগির দেখা ও-সেটা কি?
দেখবেন তো বাইরে চলুন।
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আর কোন রকম ভোটাভুটি হল না। তারপর এই মন্তব্য লিপিবদ্ধ হল;
কমিশন একযোগে জিনিসটা দেখতে পেল। একটা কঠিন, মসৃণ, প্রকাণ্ড বস্তু। উপরকার গোলাকার দিকে আড়াআড়িভাবে কাটা। বাঁধাকপির ডাঁটার মত একটা ছোট অংশ। বাড়তি অংশটা নিরেট নয়-একটা লম্বা গোলাকার চোঙ কাঠের মত এমন একটা নরম জিনিস দিয়ে ঠাসা যা আমাদের অঞ্চলের লোকের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত-অর্থাৎ চোঙ টা ঐ ভাবে ঠাসা ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত। আমরা উপস্থিত হবার আগেই আমাদের অগ্রবর্তী খোঁড়াখুঁড়ি-বাহিনীর প্রধান নরওয়ে-ইঁদুর মশায় অনবধানতাবশত সেই কাঠের মত নরম জিনিসটাকে সরিয়ে ফেলেছিলেন। উজ্জ্বল মহাশূন্য থেকে আমাদের সামনে রহস্যজনকভাবে ভূপাতিত সেই প্রকাণ্ড ফাঁপা বস্তুটি অনেক দিন ধরে জমে থাকা বৃষ্টির জলের মত বাদামী রঙের দুর্গন্ধযুক্ত কোন জলীয় পদার্থে ভর্তি। আমাদের চোখের সামনে তখন সে কী দৃশ্য! নরওয়ে-ইঁদুর মশায় সেটার মাথায় চড়ে তার লেজটা চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে চাপ দিচ্ছেন আর তার ভিতর থেকে সেই জলীয় পদার্থ ফোঁটায় ফোঁটায় উপচে গড়িয়ে সমবেত যত কুলি-মজুর ও লোকজন সেটা চুষে চুষে খেতে লাগল। স্পষ্টতই এই জলীয় পদার্থের কিছু বিস্ময়কর শক্তি ছিল, কারণ যারাই সেটা খেল তারাই সঙ্গে সঙ্গে মহাউল্লাসে আনন্দে মেতে উঠল; গুরুজন ও কর্তৃপক্ষের কোন রকম তোয়াক্কা না করে টলতে টলতে মুখে ইতর শ্রেণীর গান গাইতে গাইতে নাচতে লাগল, পরষ্পরকে আলিঙ্গন করতে লাগল, লড়াই করতে লাগল। আমাদের চারপাশে সকলেই সেই হুল্লোড়ে মেতে উঠল-জনতা সব রকমেই হাতের বাইরে চলে গেল, কারণ সিপাই-শান্ত্রী থেকে আরম্ভ করে গোটা সেনাবাহিনীই সেই পানীয়ের গুণে বে-এক্তিয়ার হয়ে পড়ল। এই বেপরোয়া জীবরা ক্রমে আমাদের উপরেও চড়াও হল এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যেই অন্য সকলের থেকে আমাদের আলাদা করে চিনে নেবার আর কোন উপায়ই রইল না-অধঃপতন এতই পরিপূর্ণ ও সার্বিক হয়ে দেখা দিল। দেখতে দেখতে এই পান-মহোৎসবের ফলে গোটা শিবিরটাই একটা সকরুণ দৃশ্যে পরিণত হল-সেখানে দূরে গেল উচ্চ-নীচ ভেদাভেদ, কে কাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল তার কোন ঠিক-ঠিকানা রইল না। সেই মহাসন্ধিক্ষণে যে অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখলাম তাতে আমাদের চোখ ঝাপ্সা হয়ে এল, মন হল দূষিত। দেখলাম, অসহ্য দুর্গন্ধময় ঝাড়ুদার শ্রীছারপোকা আর বিখ্যাত শ্ৰীমন্মহাপ্রভু দীর্ঘপদ ঠাকুর্দা একে-অন্যকে গাঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে। গভীর নিদ্রায় ডুবে আছেন। এ হেন দৃশ্য কোন কালে কেউ দেখে নি এবং আমরা যারা এই ঘৃণ্য অপবিত্র দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছি তারা। ছাড়া আর কেউ ভবিষ্যতেও এ হেন দৃশ্যকে বিশ্বাস করবার কথা কল্পনাও করতে পারবে না। এইভাবে ঈশ্বরের লীলা বড়ই দুয়ে-তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক!
আজ সকালের নির্দেশে প্রধান যন্ত্রবিদ হের মাকড়শা উপযুক্ত কৌশলের সাহায্যে সেই মস্তবড় পাত্রটি কে উল্টে দিলেন এবং তার ভিতরকার সেই বিপজ্জনক পদার্থ সবেগে শুষ্ক মাটির উপর বয়ে যেতেই মাটি তাকে শুষে নিল; ফলে আর কোন বিপদই রইল না; শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এবং রাজাকে দেখিয়ে জাতীয় সংগ্রহশালার আশ্চর্য বস্তুনিচ য়ের সঙ্গে সংগ্রহ করে রাখার উদ্দেশ্যে সামান্য কয়েকটি ফোঁটা আমরা নিজেদের কাছে রেখে দিলাম। এই তরল পদার্থটি যে কি তা নির্ণীত হয়েছে। এটা যে বিদ্যুৎ নামক হিংস্র ও ধ্বংসকারী তরল সে বিষয়ে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। উড়ন্ত গ্রহের দুর্বার শক্তি তাকে তার মেঘের আবাস থেকে পাত্রসমেত ছিনিয়ে এনে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় এখানে ফেলে দিয়ে গেছে। এইভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি আবিষ্ণুর করা হল :
এই বিদ্যুৎ স্বয়ং অত্যন্ত শান্ত, স্থির; কিন্তু বজ্রের আক্রমণাত্মক সংযোগের স্থিতাবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে সেই বিদ্যুৎ ভয়ংকর অগ্নিদাহে জ্বলে ওঠে, ফলে দেখা দেয় অগ্নৎপাত ও বিস্ফোরণ, আর পৃথিবীর দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে সমূহ বিপদ ও জনহীনতা।
আরও একটা দিন বিশ্রাম নিয়ে সেই ধকল কাটিয়ে অভিযাত্রীদল আবার পথে নামল। কয়েকদিন পরে একটি সুন্দর প্রান্তরে তারা তাঁবু ফেলল; পণ্ডিতজনরা আবিষ্কারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। পুরস্কার মিলল হাতে-নাতে। অধ্যাপক কোলা ব্যাঙ একটি আশ্চর্য গাছ। দেখতে পেয়ে সহকর্মীদের ডাকল। গভীর আগ্রহে তারা গাছটাকে পরীক্ষা করল। গাছটা সোজা খাড়া হয়ে উঠে গেছে; গায়ে বাকল নেই, ডালপালা নেই, পাতা নেই। মহাপ্রভু দীর্ঘপদ ত্রিকোণমিতির সাহায্যে গাছটার লঘিমা স্থির করল; হের মাকড়শা গাছটার নীচের ব্যাস মেপে নিয়ে নানাবিধ গণিতিক পদ্ধতির সাহায্যে একেবারে শীর্যের ব্যাস-এর পরিমাপও করে ফেলল। এটাকে একটা অসাধারণ আবিষ্ণুর বলে গণ্য করা হল; আর যেহেতু এ ধরনের গাছ এতদিন ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞাত তাই অধ্যাপক গেছো-উকুন এটার নামকরণ করল অধ্যাপক কোলা ব্যাঙের নামের সঙ্গে মিলিয়ে। নব নব আবিষ্মরের সঙ্গে নিজেদের নামকে যুক্ত করে নামকে চিরস্মরণীয় ও সন্মানাই করে রাখার এই রীতি আবিষ্কারকদের মধ্যে বহুল প্রচলিত।
এদিকে অধ্যাপক মেঠো ইঁদুর গাছটার গায়ে কান লাগিয়ে একটা উদাও সুরেলা শব্দ শুনতে পেল। একে একে প্রত্যেকটি পণ্ডিতই এই বিস্ময়কর জিনিসটি পরীক্ষা করে দেখে প্রচুর আনন্দ লাভ করল। তখন অধ্যাপক গেছো উ কুনকে অনুরোধ করা হল, গাছটি র এই সুর-সাধনার গুণটি ও যাতে প্রকাশ পায় সেই ভাবে নামটি কে আরও একটু বড় করে রাখা হোক-আর সে অনুরোধ মেনে নিয়ে সে নামের সঙ্গে যোগ করল প্রার্থনাগীতিকার।
ইত্যবসরে অধ্যাপক শান্ধুক দূরবীণের সাহায্যে কিছু পর্যবেক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। সে দেখতে পেল, দক্ষিণে ও উত্তরে যতদূর তার দূরবীণের দৃষ্টি চলে ততদূর পর্যন্ত বেশ কিছু দূরে দূরে এই ধরনের অনেক গাছ সারিবদ্ধভাবে চলে গেছে। ইতিমধ্যে সে আরও আবিষ্মর করেছে যে একেবারে মাথার দিকে পর পর সাজানো চোদ্দটি বড় দড়ি দিয়ে এই গাছগুলি পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা, আর যতদূর দেখা যায় দড়িগুলো একটানা চলে গেছে। প্রধান যন্ত্রবিদ মাকড়শা অবাক হয়ে সেই দড়ির সঙ্গে ঝুলতে ঝুলতে দ্রুত ছুটে গেল এবং শীঘ্রই ফিরে এসে জানাল যে, এই দড়িগুলো তারই বংশের কোন দৈত্যাকার জীবের দ্বারা বোনা জাল মাত্র, কারণ সে দেখতে পেয়েছে এই জালের মাঝে মাঝেই কিছু মৃত শিকার ঝুলে রয়েছে। ঠিক যেমনটি থাকে মাকড়শার জালের মধ্যে। তখন আরও ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখবার উদ্দেশ্যে একটি দড়ি বেয়ে এগিয়ে যেতে যেতেই তার পায়ের পাতায় হঠাৎ একটা তীব্র ছ্যাঁকা লাগল, মনে হল যেন তার শরীরটাই অবশ হয়ে যাবে। তাই সে দড়িটা ছেড়ে দিয়ে নিজের বোনা একটা সুতো বেয়ে মাটিতে নেমে এল, এবং সকলকে সতর্ক করে দিয়ে তৎক্ষণাৎ শিবিরে ফিরে যেতে লাগল; বলা তো যায় না, সেই দৈত্যটা যে কোন সময় এসে তার মতই অন্য সব পণ্ডিতদের উপরেও হামলা করতে পারে। সুতরাং তারা সবেগে পা চালিয়ে দিল এবং যেতে যেতেই সেই বিরাট মাকড়শার জালটা সম্পর্কে আলোচনা করতে লাগল। সেদিন রাতেই দলের জীববিজ্ঞানী পণ্ডিতটি সেই দৈত্যাকার মাকড়শার একটা সুন্দর মডেল তৈরি করে ফেলল। মূর্তিটি র আছে লেজ, দাঁত, চোদ্দটা পা ও একটি শুড়; নির্বিচারে সে ঘাস, গরু-মোষ, পাথরের নুড়ি ও ধূলো-বালি খায়। এই জন্তুটি জীব-বিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত মূল্যবান সংযোজন। সকলেই আশা প্রকাশ করল যে একটা মরা জীব হয় তো পাওয়া যেতেও পারে। অধ্যাপক গেছো-উকুন বলল, সে ও তার সহকর্মী পণ্ডিতরা চুপচাপ লুকিয়ে থাকলে হয় তো একটা জীবন্ত প্রাণীকেও ধরে ফেলতে পারে। এ প্রস্তাব সকলেই সমস্বরে সমর্থন করল। যেহেতু ঈশ্বরের পরে এই জীব-বিজ্ঞানীই দৈত্যাকার মাকড়শাটার সৃষ্টিকর্তা সেই হেতু তার নামেই জীবটির নামকরণ করে সম্মেলনের অধিবেশন সমাপ্ত হল।
অদম্য কৌতূহল ও চিরদিনের অভ্যাস বশে শ্রীছারপোকাটি এই সময় মুখ বাড়িয়ে তো-তো করে বলে উঠল, এরা বোধ হয় অনেক দূর এগিয়েছেন।
.
দ্বিতীয় পর্ব– বনের জীবজন্তুরা কেমন করে তাদের বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ করল
এক সপ্তাহ পরে অভিযাত্রীদল যেখানে শিবির ফেলল সেখানে অনেক বিস্ময়কর প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু ইতস্তত ছড়িয়ে ছিল। নদীর তীর বরাবর বিরাট সব পাথরের গুহা কোথাও এককভাবে, কোথাও বা সারিবদ্ধভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। চওড়া রাস্তার একপাশে সারিবদ্ধ গাছ লাগানো হয়েছে। আর সেই পথের দু ধারেই গুহার লম্বা সারি। প্রতিটি গুহার মাথাই দুদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। পাতলা, চকচকে, স্বচ্ছ পদার্থ দিয়ে ঢাকা বড় বড় চৌকো গর্তের সারি প্রত্যেকটি গুহার সামনের দিকে শোভা পাচ্ছে। ভিতরে গুহার ভিতরে ও হা; যে কেউ ইচ্ছা করলে ঘোরানো পথ ধরে উঠে এই সব ছোট ছোট ঘরগুলো দেখতে পারে। প্রতিটি ঘরে অনেক বড় বড় বিকৃতদেহ বস্তু পড়ে আছে; একসময় এ সবই ছিল জীবন্ত প্রাণী, কিন্তু এখন তাদের পাতলা বাদামী চামড়া কুঁচকে ঢিলে হয়ে গেছে; হাত দিলেই খট খট শব্দ হয়। চারদিকে অনেক মাকড়শা; চতুর্দিকে প্রসারিত তাদের জাল সেই সব মৃতদেহকে জড়িয়ে যেন একসঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। এই সব মাকড়শার কাছ থেকে তথ্যাদি পাবার চেষ্টা করা হল, কিন্তু কোন ফল হল না। অভিযাত্রী দলের মাকড়শা আর এই মাকড়শাদের জাত আলাদা; তাদের ভাষা এদের কাছে অর্থহীন সুরেলা কথার কচ কচি বলেই মনে হল; তারা সব শান্ত, শিষ্ট, অত্ত, এবং অজ্ঞাত বহু ঈশ্বরের মূর্তিপূজকের দল। তাদের সত্য ধর্ম শেখাবার জন্য অভিযাত্রী দলের পক্ষ থেকে একটি ধর্মপ্রচারক দলকে পাঠানো হল। এক সপ্তাহের মধ্যেই এই অন্ধকারের জীবদের মধ্যে তারা মূল্যবান কাজ করে ফেলল, আর সেই জন্য কাজটা চালিয়ে যাবার উদ্দেশ্য প্রচারকদের একটা স্থায়ী উপনিবেশ সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হল।
কিন্তু সে সব কথা থাক। গুহার বাইরের অংশগুলি ভাল করে পরীক্ষা করে এবং অনেক ভাবনা-চিন্তা ও মত বিনিময় করে বিজ্ঞানীরা এই অদ্ভুত গঠনরীতি সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হল। তারা বলল, এগুলি সবই প্রধানত প্রাচীন লাল বেলেপাথরের যুগের জিনিস। কিন্তু বর্তমান আবিষ্ণুরের মধ্যে এমন একটা জিনিস আছে যাতে স্বীকৃত ভূবিজ্ঞানের সব মতামতই প্রবলভাবে খণ্ডিত হয়েছে। এই সব গুহা নানা স্তরে ক্রমাগত আকাশের দিকে মাথা তুলেছে; প্রাচীন লাল বেলেপাথরের প্রতিও দুটি স্তরের মধ্যে রয়েছে একটি করে বিকৃত চুনাপাথরের পাতলা শুর; কাজেই প্রাচীন লাল বেলেপাথরের যুগ শুধু একটি নয়, সে রকম যুগ ছিল ননপক্ষে একশ পঁচাত্তরটি বন্যা বয়ে গেছে এবং সমসংখ্যক চুনাপাথরের স্তর তার উপরে জমেছে। এই উভয়বিধ ঘটনা থেকে অনিবার্য অনুমান হিসাবে এই প্রবল সত্যকেই মেনে নিতে হয় যে এই পৃথিবী মাত্র দুই শত সহস্র বছরের পুরনো নয়, এর বয়স আরও লক্ষ লক্ষ বছর বেশী!
গ্রীষ্ম চলে গেল। শীত এল। অনেক গুহার ভিতরে ও বাইরে এমন কিছু দেখা গেল যাকে শিলালিপি বলে মনে হল। অধিকাংশ বিজ্ঞানীই সে কথা বলল, আবার কিছু বিজ্ঞানী সেটা অস্বীকার করল। প্রধান ভাষাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক গেছো-উকুন বলল, যে লিপিতে এগুলো লেখা হয়েছে তা পণ্ডিতদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, আর সে ভাষাও তাদের কাছে সমান অজ্ঞাত। শিল্পী ও নকশাকারকদের সে আগেই সবগুলি শিলালিপির হুবহু প্রতিলিপি তৈরির হুকুম দিয়েছে এবং এই অজ্ঞাত ভাষাটির মূল সূত্রটি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে সে নিজে। শিলালিপির অনেকগুলি প্রতিলিপিকে পাশাপাশি রেখে সামগ্রিকভাবে ও বিস্তারিতভাবে সেগুলিকে পরীক্ষা করেছে। প্রথমেই বলা যায়, নিম্নোক্ত প্রতিলিপিগুলিকে সে একসঙ্গে রেখেছে:
দি আমেরিকান হোটেলসব সময় খাবার
দি শেডস ধূমপান নিষেধ
নৌকো ভাড়া সস্তা সম্মিলিত প্রার্থনা সভা,বিকেল ৪টা
বিলিয়ার্ডস ওয়াটারসাইড পত্রিকা
১নং নাপিতের দোকান টেলিগ্রাফ অফিস
ঘাস থেকে দূরে থাকুন ব্র্যান ড্রেথস পিল খেয়ে দেখুন
সেচের মরশুমে ঘর ভাড়া পাওয়া যায়
সস্তায় বিক্রি সস্তায় বিক্রি
সস্তায় বিক্রি সস্তায় বিক্রি
প্রথমে অধ্যাপকের মনে হল যে এটা একটা প্রতীকী ভাষা, প্রতিটি শব্দের জন্য একটি বিশেষ প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে; আরও বিশদ পরীক্ষার ফলে সে নিশ্চিত হয়েছে যে এটা একটা লিখিত ভাষা এবং তার বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষরের একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে; আর শেষ পর্যন্ত সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে এই ভাষাটি কতকাংশ অক্ষরের সাহায্যে ও কতকাংশ প্রতাঁকের সাহায্যে নিজেকে প্রকাশ করে। নিম্নলিখিত কতকগুলি দৃষ্টান্ত আবিঙ্করের ফলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সে বাধ্য হল:
সে দেখতে পেল, কতকগুলি শিলালিপি অন্যগুলোর তুলনায় বারবার চোখে পড়েছে। যেমন সস্তায় বিক্রি বিলিয়ার্ড স্ এস. টি.-১৮৬০-এক্স, কেনো, এল অন্ ডুগ। স্বভাবতই এগুলি নির্ঘাৎ ধর্মীয় অনুশাসন কিন্তু ক্রমে ক্রমে এ ধারণা পরিত্যক্ত হল। এক সময়ে অধ্যাপক বেশ কিছু শিলালিপির মোটামুটি সহজবোধ্য অনুবাদ করতে সক্ষম হল। সকলে তা নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হলেও তার কাজে ক্রমাগতই উন্নতি ঘটতে লাগল।
শেষ পর্যন্ত এই রকম শিলালিপিসহ একটি গুহা আবিষ্কৃত হল :
ওয়াটারসাইড মিউজিয়ম
সব সময় খোলা থাকে-প্রবেশ মূল্য ৫০ সেন্ট
মোমের মূর্তি, প্রাচীন জীবাশ্ম প্রভৃতির
আশ্চর্য সংগ্রহ
অধ্যাপক গেছো-উকুন জানাল, মিউজিয়ম শব্দটা লুমগাথ মেলো বা কবরস্থান-এর সম-অর্থবাচক। সেখানে ঢুকে বিজ্ঞানীরা সকলেই অবাক হয়ে গেল। কিন্তু তারা কি দেখতে পেল সেটা বরং তাদের সরকারী প্রতিবেদনের ভাষায়ই বলা যাক:
এক সারিতে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি অনড় বড় মূর্তি দেখামাত্রই মনে হল, আমাদের প্রাচীন নথি-পত্রে দীর্ঘকাল অবলুপ্ত যে। সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীকে মানুষ বলে বর্ণনা করা হত এগুলি তাদেরই স্বগোত্র। এই আবিষ্ণুরটি বিশেষভাবে সন্তোষজনক এই জন্য যে ইদানিংকালে এই সব জীবদের কাল্পনিক ও কুসংস্কারের সৃষ্টি এবং আমাদের দূরতম পূর্বপুরুষদের কল্পনার জীব বলে মনে করবার একটা হিড়িক পড়ে গেছে। কিন্তু এই তো এখানে সত্যি সত্যি রয়েছে সেই মানুষ-শিলীভূত রূপে। আর শিলালিপি থেকেই জানা যায় যে এটাই তাদের কবরস্থান। কাজেই এখন সন্দেহ করা যেতে পারে যে আমরা যে সমস্ত গুহা পরিদর্শন করেছি সেগুলিই ছিল প্রাচীন যুগের ভ্রাম্যমান মানুষদের আশ্রয়স্থল-কারণ এই সব দীর্ঘদেহ জীবাশ্মের প্রত্যেকটির বুকের উপর রয়েছে একটি করে শিলালিপি। একটি তে লেখা জলদস্যু ক্যাপ্টেন কিড, আরেকটি তে লেখা কুইন ভিক্টোরিয়া, কোনটায় আবে লিংকন, কোনটায় জর্জ ওয়াশিংটন ইত্যাদি।
আমাদের সামনে যে সব জীবাশ্ম রয়েছে তাদের সঙ্গে আমাদের প্রাচীন বিজ্ঞানীদের নথিপত্রের বিবরণ মেলে কিনা দেখবার জন্য গভীর আগ্রহের সঙ্গে সে সব কিছু আনানো হল। অধ্যাপক গেছো-উকুন উচ্চৈঃস্বরে পড়তে শুরু করল:
আমাদের পূর্বপুরুষদের কালেও মানুষ পৃথিবীতে চলে-ফিরে বেড়াত, এ কথা আমরা ঐতিহ্যগতভাবে জেনেছি। মানুষ নামক এই জীব ছিল আকারে অনেক বড়, ঢিলে চামড়ায় শরীর ঢাকা, সে চামড়ার রং কখনও একই রকম, আবার কখনও নানা রকমের, সে ইচ্ছামত সেটা বেছে নিতে পারত; তার পিছনের পায়ে ছোট ছোট থাবা ছিল, আর সামনের পায়ের আঙুল গুলি ছিল অদ্ভুত সরু ও লম্বা, এমনকি ব্যাঙের আঙুলের চাইতেও সরু ও লম্বা, আর মাটি খুঁড়ে খাদ্য সংগ্রহ করবার জন্য তাতে ছিল চওড়া নখ লাগানো। অনেকটা ইঁদুরের মত হলেও তার চাইতে লম্বা লম্বা এক ধরনের পালক ছিল তার মাথায় আর গন্ধ শুঁকে খাবার খুঁজে নেবার জন্য ছিল পাখির মত ঠোঁট। সুখ উথলে উঠলে তার চোখ দিয়ে জল ঝরত, আর কষ্ট পেলে বা দুঃখিত হলে এমন নারকীয় চীৎকার সেটাকে প্রকাশ করত যে তা শুনলেইও ভয় করত, মনে হত এর চাইতে শতধা বিদীর্ণ হয়ে এর ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়াও অনেক ভাল। দুটি মানুষ একত্র হলেই পরস্পরকে লক্ষ্য করে এই ধরনের শব্দ করত: হ-হ-হ-খুব ভাল, খুব ভাল; তাছাড়া অনুরূপ আরও অনেক রকম শব্দ করত। কখনও কখনও সে একটা লম্বা লাঠির মত বস্তু মুখে পুরে তার ভিতর দিয়ে এমনভাবে আগুন ও ধোঁয়া বের করত যে তার শিকার ভয়েই মরে যেত, আর সেও নখর দিয়ে সেটাকে আঁকড়ে ধরে নিজের গুহায় নিয়ে গিয়ে হিংস্র শয়তানী উল্লাসের সঙ্গে সেটাকে ভোজন করত।
এখন দেখা যাচ্ছে আমাদের পূর্বপুরুষদের এই বিবরণ এই জীবন্মগুলির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন কিড চিহ্নিত নিদর্শনটিকেই ভাল ভাবে পরীক্ষা করে দেখা হল। তার মাথায় এবং মুখের কতকাংশে ঘোড়ার লেজের মত এক ধরনের লোম আছে। অনেক পরিশ্রম করে তার ঢিলে চামড়াটা খুলে নেওয়া হলে দেখা গেল তার দেহের রঙ চকচকে সাদা, যদিও এখন পুরোপুরি বিকৃত হয়ে গেছে। বহু যুগ আগে যে খড় বসে খেয়েছিল তা এখনও দেহের মধ্যে আছে-এমন কি পায়ের মধ্যেও আছে, এতটুকু হজম হয় নি।
এই সব জীবাশ্মের চতুর্দিকে যে সব জিনিস ছড়িয়ে রয়েছে সাধারণের কাছে তার কোন অর্থ না থাকলেও বিজ্ঞানের চোখে সেগুলি এক পরম প্রকাশ। মৃত যুগের গোপন কথা তারা মেলে ধরেছে। স্মৃতি-কথা থেকে আমরা জেনেছি, মানুষ কোন্ যুগে বাস করত, আর তার অভ্যাসই বা কেমন ছিল। কিন্তু এখানে মানুষ-এর পাশে পাশে আমরা আর যা দেখতে পাচ্ছি তাতেই প্রমাণিত হচ্ছে যে সে বাস করত সৃষ্টির একেবারে আদিম যুগে, যখন পৃথিবীর বুকে বেঁচে ছিল অন্য সব নিম্ন শ্রেণীর জীব। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই। নটি লাস-এর জীবাশ্ম যে আদিম যুগের সমুদ্রে ঘুরে বেড়াত; এখানে রয়েছে মাস্টোডন, ইথিয়োসরাস, গুহা-ভল্লুক ও বৃহদাকার হরিণের কংকাল। এখানে রয়েছে অনেক লুপ্ত জীব ও ছোট ছোট মানুষদের পোড়া হাড়; হাড়গুলি লম্বালম্বিভাবে দুভাগ করা; তা থেকেই বোঝা যায় যে মানুষ মজ্জা খেতে খুব ভালবাসত। যেহেতু সেই সব হাড়ের উপর কনো জানোয়ারের দাঁতের চিহ্ন নেই, সেই জন্যই পরিষ্যর বোঝা যাচ্ছে যে মানুষই এই সব হাড়ের ভিতরকার পদার্থ বের করে নিয়েছে। এখানে আরও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে শিল্প-কলার কিছু কিছু ধারণাও মানুষ-এর ছিল, কারণ কিছু কিছু জিনিসের গায়ে এই সব কথা লি লেখা রয়েছে-চ কমকি পাথরের টাঙ্গি, ছুরি, তীরের ফলা, প্রাচীন মানুষের হাড়ের অলংকারপত্র। এর অনেকগুলিই চকমকি পাথর দিয়ে তৈরি আদিম অস্ত্রশস্ত্র; একটা গু স্থানে পাওয়া গেছে এই ধরনের কিছু নির্মীয়মান অস্ত্রপাতি, আর তাদের পাশেই রয়েছে একটা পাতলা পাতের উপর অনুকরণীয় ভাষায় লেখা এই কাহিনীটি :
জোন্স, যদি মিউজিয়াম থেকে বরখাস্ত হতে না চাও তাহলে পরবর্তী আদিম অস্ত্রশস্ত্র আরও যত্ন নিয়ে তৈরি করো-শেষের দিকে তুমি যা
তৈরি করেছ তা দিয়ে কলেজ থেকে আসা ঘুমকাতুরে বুড়ো বিজ্ঞানীদেরও ফাঁকি দিতে পার নি। মনে রেখো, হাড়ের অলংকারের উপরে যে সব জানোয়ারের ছবি তুমি খোদাই করেছ তা এতই বাজে হয়েছে যে কোন আদিমতম মানুষকেও তা দিয়ে বোকা বানানো যায় না!–ভরনাম ম্যানেজার।
কবরস্থানের পিছনে রয়েছে ছাইয়ের গাদা; তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় মানুষ পান-ভোজন করত-নইলে এ রকম জায়গায় ছাই থাকবে কেন : আর বোঝা যাচ্ছে যে সে ঈশ্বরে এবং আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করত-নইলে এমন গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠান। করবে কেন?
উপসংহার। আমরা বিশ্বাস করি মানুষের একটা লিখিত ভাষা ছিল। আমরা জানি একসময়ে সত্যি মানুষ ছিল, সে কোন কল্পনামাত্র নয়; আরও জানি, সে ছিল গুহা-ভাল্লুক, মাস্টোভন ও অন্যান্য লুপ্ত জীব শ্রেণীর সমসাময়িক সেই সব জীবদের ও নিজেদের বাচ্চাদের তারা রান্না করে খেত; সে আদিম অস্ত্রশস্ত্র বহন করত এবং শিল্প-কলার কিছুই জানত না; সে মনে করত যে তার আত্মা আছে আর । কল্পনা করত যে সে আত্মা অমর। কিন্তু এ নিয়ে আমাদের হাসা উচিত নয়; কারণ হয় তো এমন কোন জীবেরও অস্তিত্ব আছে যাদের কাছে আমরা ও আমাদের সব গর্ব-অহংকার ও পাণ্ডিত্যও হাস্যকর মনে হতে পারে।
.
তৃতীয় পর্ব
এদিকে বড় নদীটার তীরের কাছে বিজ্ঞানীরা একটা মস্তবড় সুগঠিত পাথর দেখতে পেল। তাতে লেখা রয়েছে :
১৮৪৭-এর বসন্তকালে নদীর দুই তীর ছাপিয়ে গোটা শহরটাকে গ্রাস করল। জলের গভীরতা ছিল দুই থেকে ছ ফুট। ৯০০-এর বেশী গবাদি পশু মারা গেছে এবং অনেক ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্য মেয়র এই স্মৃতিস্তম্ব নির্মাণের আদেশ দিয়েছেন। ঈশ্বর করুন, এ ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে!
বহু কষ্ট স্বীকার করে অধ্যাপক গেছো-উকুন এই শিলালিপির একটা অনুবাদ করে দেশে পাঠিয়ে দিল এবং সেখানে প্রচণ্ড হৈ-চৈ পড়ে গেল। শিলালিপিতে দুএকটি এমন শব্দ ছিল যাকে ভাষান্তরিত করা যায় না; ফলে অনুবাদের সত্যতা কিছুটা ক্ষুণ্ণ হলেও তাতে অর্থের স্পষ্টতা নষ্ট হয় নি। অনুবাদটি এখানে তুলে দেওয়া হল :
এক হাজার আট শ সাতচল্লিশ বছর আগে (অগ্নিস্রোত?) নেমে এসে গোটা শহরকে গ্রাস করে ফেলল। মাত্র ন শ জীবন রক্ষা পেল, বাকি সবই ধ্বংস হয়ে গেল। (রাজা?)-র আদেশে এই পাথরটি স্থাপিত হল যাতে… (অনুবাদ করা গেল না) …পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
বিলুপ্ত প্রজাতি মানুষ যে রহস্যময় বর্ণমালা রেখে গেছে তার যত অনুবাদ আজ পর্যন্ত হয়েছে তার মধ্যে এটাই সর্বপ্রথম সার্থক ও
সন্তোষজন অনুবাদ। এর ফলে অধ্যাপক গেছো-উ কুনের খ্যাতি এতদূর ছড়িয়ে পড়ল যে তার স্বদেশের প্রত্যেকটি বিদ্যাপীঠ একযোগে তাকে অত্যন্ত সম্মানজনক ডি গ্রীতে ভূষিত করল। সকলেরই বিশ্বাস হল যে সে যদি সৈনিক হয়ে কোন আদিম সরীসৃপ জাতির ধ্বংসসাধনে তার এই উজ্জ্বল প্রতিভাকে নিয়োগ করত তাহলে রাজা তাকে গৌরবের আসন দিয়ে প্রচুর ধনৈশ্বর্যে ভূষিত করত। আর এর ফলেইও মানববিজ্ঞানী নামক একটি নতুন বিজ্ঞানী দলের সৃষ্টি হল; মানুষ নামক লুপ্ত পক্ষীশ্রেণীর প্রাচীন তথ্যাদির পাঠোদ্ধার করাই হল তাদের বৈশিষ্ট্য। [কারণ এখন এটা স্বীকৃত সত্য যে মানুষ পক্ষী, সরীসৃপ নয়।] কিন্তু অধ্যাপক গেছো-উকুন সকলেরই প্রধান কর্তা হয়ে রইল, কারণ সকলেই মেনে নিল যে আজ পর্যন্ত এতটা নির্ভুল অনুবাদ আর কখনও হয় নি। সকলেই ভুল করেছে-কিন্তু তার ভুল হতেই পারে না। লুপ্ত জাতির আরও অনেক স্মৃতিস্তম্ভ পরবর্তীকালে পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু এই মেয়রীর পাথর-এর মত সুখ্যাতি ও সম্মান আর কেউ অর্জন করতে পারে নি-শিলালিপিতে মেয়র শব্দটি ছিল বলেই মেয়রীয় বলা হল, কিন্তু অনুবাদে রাজা শব্দটি ব্যবহার করায় মেয়রীয় পাথর রাজকীয় পাথর-এরই অন্য নাম মাত্র।
অভিযাত্রীদল আরও একটি বড় আবিষ্কার করে ফেলল। একটা মস্ত বড় গোলাকার সমতল পদার্থ-ব্যাস দশ ব্যাঙ–মাপের সমান, উচ্চতায় পাঁচ অথবা ছয় ব্যাঙ–মাপ। অধ্যাপক শম্বুক নাকে চশমা এঁটে সেটার উপরে চড়ে মাথাটা ভালভাবে পরীক্ষা করে বলল:
পুংখানুপুংখরূপে সব কিছু দেখে শুনে আমার এই বিশ্বাস জন্মেছে যে স্তূপ-নির্মাতারা যে সব সৃষ্টি রেখে গেছে এটি তার একটি আশ্চর্য। বিরল নিদর্শন। অতএব এখানে খননকার্য চালিয়ে নব নব জ্ঞান-ভাণ্ডার সঞ্চয় করা হোক।
একটি পিপিলিকা-বাহিনী খননকার্য শুরু করে দিল। কিছুই পাওয়া গেল না। সকলের পক্ষেই এটা হতাশার কারণ হত, কিন্তু মাননীয় দীর্ঘপদ মহাশয় ব্যাপারটা বিশদভাবে বুঝিয়ে দিল। সে বলল:
এখন আমি পরিষ্ণুর বুঝতে পারছি যে রহস্যময় ও বিস্মৃত স্তূপ-স্থপতিরা সব সময়ই সমাধিস্তম্ভ হিসাবে এই সব স্তূপ নির্মাণ করত না; তা যদি করত তাহলে এই স্থলে, এবং অন্য আরও অনেক স্থলে, স্তূপের নীচে তাদের কংকাল ও তাদের ব্যবহৃত অন্য আদিম যন্ত্রপাতি পাওয়া যেত। এটা কি পরিষ্কার বোঝা গেল?
ঠিক ঠিক! সকলেই বলে উঠল।
তাহলে এখানেও আমরা একটি মূল্যবান আবিষ্ণুর করে ফেললাম; এই আবিষ্কারের ফলে একটি জাতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান হ্রাস না পেয়ে বরং আরও বিস্তার লাভ করল। কারণ-এই যে প্রথাগত কোন ধ্বংসাবশেষ এখানে নেই তার একটি ই অর্থ হতে পারে: এই স্তূপ-স্থপতিদের আমরা এতকাল যেরূপ অজ্ঞ, বর্বর সরীসৃপ বলে ভেবে এসেছি তা না হয়ে তারা ছিল সংস্কৃতি ও উচ্চ মণীষার অধিকারী জীব; স্বীয় শ্রেণীর উন্নত ও মহৎ ব্যক্তিদের কার্যাবলীর তারা যে শুধু প্রশংসা করত তাই নয়, সেগুলিকে স্মরণীয় করে রাখতেও জানত! সহকর্মী পণ্ডিতগণ, এই সুউচ্চ স্তূপ একটি সমাধি-স্তম্ভ নয়, এটি একটি স্মৃতিস্তম্ভ।
এ কথা শুনে সকলেই অভিভূত হয়ে পড়ল।
নক্সাকারকদের ডেকে বিভিন্ন কোণ থেকে স্মৃতিস্তম্ভটির নক্সা প্রস্তুত করতে বলা হল। বিজ্ঞানীসুলভ উৎসাহের বশে অধ্যাপক গেছো-উ কুন একটা শিলালিপির সন্ধনে স্তূপময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। কিন্তু সে রকম কোন লিপি গোড়ায় থাকলেও লুণ্ঠনকারীদের হাতে হয় নষ্ট হয়েছে, আর না হয় তো লুঠ হয়েছে।
পর্যবেক্ষণ শেষ করবার পর স্থির হল যে, চারটি বৃহদাকার কচ্ছপের পিঠে চাপিয়ে এই মূল্যবান স্মৃতিস্তম্ভটি কে স্বদেশে রাজার সংগ্রহশালায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক। তাই করা হল। স্বদেশে পৌঁছলে মহাধুমধামের সঙ্গে সেটাকে অভ্যর্থনা করা হল এবং হাজার হাজার উৎসাহী জনতা সেটাকে তার ভবিষ্যৎ স্থায়ী আবাসের দিকে নিয়ে চলল। রাজা দ্বাদশ কোলা ব্যাঙ স্বয়ং সে অনুষ্ঠানে যোগ দিল এবং সারা পথ সেটার উপর উপবিষ্ট হয়ে রইল।
এই সময় আবহাওয়া ক্রমেই কষ্টকর হয়ে ওঠায় বিজ্ঞানীরা আপাতত তাদের কাজকর্ম বন্ধ করে বাড়ি ফিরবার আয়োজন করতে লাগল। কিন্তু সেই সব গুহার মধ্যে কাটানো শেষ দিনটি ও যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়ে উঠল, কারণ তাদের মধ্যে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি সংগ্রহশালা বা কবরস্থান-এর অনাদৃত কোণে অত্যন্ত বিস্ময়কর ও অসাধারণ একটি জিনিস দেখতে পেল। সেটা অন্য কিছু নয়, একটি যমজ মানুষ-পক্ষী স্বাভাবিক বন্ধনীর দ্বারা বুকে বুক লাগিয়ে একত্রিত করা, আর তার গায়ে অনুবাদের অতীত ভাষায় লেবেল লাগানো-শ্যামদেশীয় যমজ। এতৎসংক্রান্ত সরকারী প্রতিবেদনটি এইভাবে শেষ করা হয়েছে:
এর থেকেই বোঝা যায় যে পুরাকালে এই মহান পক্ষীর দুটি শ্রেণী ছিল, একটি একক, অপরটি যুগল। প্রকৃতিতে সব জিনিসেরই একটা যুক্তি আছে। বিজ্ঞানের চোখে এটা পরিষ্কার যে গোড়ায় এই যমজ মানুষ বিপজ্জনক এলাকাগুলোতেই বসবাস করত; দুজনকে এই উদ্দেশ্যে নিয়ে একত্র জুড়ে দেওয়া হত যাতে একজন ঘুমোলে অপরজন জেগে পাহারা দিতে পারে, আর ঠিক সেই একইভাবে বিপদ দেখা দিলে একজনের জায়গায় দুজন একসঙ্গে তাকে প্রতিরোধ করতে পারে। দেবতাসদৃশ বিজ্ঞানের রহস্য-উন্মোচনকারী চক্ষুর জয় হোক!
সেই যমজ মানুষ-পক্ষীর নিকটে ই পাওয়া গেল একত্রে বাঁধানো অসংখ্য পাতলা সাদা পাতায় লিখিত একটি প্রাচীন তথ্য-সংগ্রহ। অধ্যাপক গেছো-উকুন সেটার প্রতি প্রথম দৃষ্টিপাত মাত্রই নিম্নলিখিত পংক্তিটি উদ্ধার করে কম্পিত কণ্ঠে সেটাকে অনুবাদ করে বিজ্ঞানীদের সম্মুখে মেলে ধরল। ফলে সকলেরই অন্তর আনন্দে ও বিস্ময়ে এক উচ্চ স্তরে উন্নীত হল।
আসলে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে নিম্ন শ্রেণীর জীবরাও একত্রে চিন্তা করে ও কথা বলতে পারে।
অভিযাত্রীদলের মহান সরকারী প্রতিবেদনটি যখন প্রকাশিত হল তখন উপরি-উক্ত পংক্তিটি সম্পর্কে এই মন্তব্য পাওয়া গেল।
তাহলে মানুষ-এর চাইতে নিম্নশ্রেণীর জীবও আছে! এই বিশিষ্ট অনুচ্ছেদটির তো আর কোন অর্থই হয় না। মানুষ নিজে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু তারা হয়তো এখনও বেঁচে আছে। তারা তাহলে কারা? কোথায় থাকে? বিজ্ঞানীদের সম্মুখে আবিষ্কার ও গবেষণার এই যে এক উজ্জ্বল ক্ষেত্র উন্মুক্ত হল তার আলোচনায় সকলেই অধীর হয়ে উঠল। আমাদের প্রচেষ্টার উপসংহারে আমরা এই বিনীত প্রার্থনা জানাই যে মাননীয় রাজা মহাশয় অবিলম্বে একটি কমিশন নিয়োগ করে নির্দেশ প্রচার করুন যে যতদিন পর্যন্ত ঈশ্বরের সৃষ্টি এই অজ্ঞাত জীবশ্রেণী সম্পর্কিত অনুসন্ধান সাফল্যমণ্ডিত না হবে ততদিন তারা বিশ্রাম করবেন না অথবা খরচাদি সম্পর্কে কার্পণ্য কবরেন না।
তারপর দীর্ঘ অনুপস্থিতির পরে স্বীয় কর্ম বিশ্বস্তভাবে সম্পাদনান্তে অভিযাত্রী দল গৃহাভিমুখে যাত্রা করল। কৃতজ্ঞ দেশবাসীও প্রচণ্ডভাবে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। অবশ্য আজেবাজে ছিদ্রান্বেষী লোকেরও অভাব হয় না; সে রকম কিছু লোক তো সব সময়ই থাকে, আর থাকবেও; স্বভাবতই তাদেরই একজন হল অশ্লীল শ্রীছারপোকা। সে বলল, এই ভ্রমণ থেকে সে তো এইটুকুই জেনেছে যে বিজ্ঞান মাত্র এক চামচ কল্পনা থেকেই ঘটনার ঘনঘটাসম্বলিত একটা পর্বত তৈরি করতে পারে; আর ভবিষ্যতে সে শুধু এইটুকু জেনেই সন্তুষ্ট থাকতে চায় যে ঈশ্বরের পবিত্র রহস্যের মধ্যে নাক না গলিয়ে যার যার মত করে চলবার স্বাধীনতা প্রকৃতি সকলকেই দিয়েছে।