বাজি
দিবানাথ ছিলেন আমার স্বামী৷ ছিলেন বলাটা বোধ হয় ঠিক হল না৷ ছিলেন শব্দটা বড়ো বেশি নেতিবাচক, এর মধ্যে বড়ো বেশি নেই নেই গন্ধ৷ এমনও হতে পারে দিবানাথ হয়তো এখনও বেঁচে আছেন৷ অবশ্য তাঁর মারা যাওয়াটাও কিছু বিচিত্র নয়৷ আমি তাঁর বাঁচা-মরার সঠিক সংবাদ জানি না৷
আমার সঙ্গে দিবানাথের বিয়ে হয় আজ থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে৷
দিনটার তেমন কোনো বিশেষত্ব ছিল না৷ শুধু মনে আছে অঘ্রাণের সেই দিনটিতে সকালের দিকে খানিকটা বৃষ্টি হয়েছিল৷ কাকভোরে যখন আমাকে দধিকর্মার জন্য ডেকে তোলা হল, তখন কে যেন, বোধ হয় আমার কোনো মাসি-টাসি হবে, বলেছিল এই অঘ্রাণে হঠাৎ মেঘ এল কোত্থেকে! তা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল একদম, কাজেকর্মে সেদিন কোনো বিঘ্নই ঘটেনি৷
কিন্তু আমার মনে যে মেঘ ছিল, সেটি সরলো না৷ কারণ একটাই৷ এই বিয়েতে আমার একটুও মত ছিল না৷
বিষয়টা তবে একটু বিশদ করা যাক৷ আমার বিয়ের ঠিক হয় আমি গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর পরই৷ বিবাহ স্বামী প্রেম ইত্যাদি সম্পর্কে ততদিনে আমার একটা নিজস্ব কল্পজগৎ গড়ে উঠেছে৷ আমার কল্পনার স্বামী হবেন ফরাসি ধরনের দুরন্ত প্রেমিক, তাঁর রূপটি হবে গ্রিক দেবতার মতো, অথচ তাঁর বুকের মধ্যে থাকবে এক নিখাদ বাঙালি হূদয়৷ রুচি সংস্কৃতি রসিকতাবোধ সব মিলিয়ে একটা দারুণ কিছু৷ যেমনটি আগে কেউ কখনো দেখেনি৷ দিবানাথের ছবি আমাকে দেখতে দেওয়া হয়েছিল, সেটি দেখামাত্র আমার স্বপ্ন চৌচির হয়ে যায়৷ ওমা, এ যে এক গাঁট্টাগোট্টা কেজো মানুষ! এক্কেবারে রসকষহীন দোকানদার দোকানদার চেহারা! তার ওপর কানে এল লোকটির লেখাপড়াও বেশি দূর নয়, স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরই মন দিয়েছেন পৈতৃক ব্যবসায়৷ বয়সেও তিনি আমার থেকে অন্তত বারো বছরের বড়ো৷
তখনকার দিনে বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের মতামত জানানোর রেওয়াজ ছিল না, তবে আমাদের বাড়ির হাওয়াটি ছিল একটু অন্যরকম৷ অনেকটাই খোলামেলা৷ বাবা শিক্ষকতা করতেন, আমার লেখাপড়ায় তাঁর ছিল দারুণ উৎসাহ৷ গল্প লেখার একটা ভূতুড়ে শখ ছিল আমার, সেটারও তিনি খুব তারিফ করতেন৷ আমার স্বাধীন চলাফেরাতেও বাধার সৃষ্টি করেননি কখনো৷ বাবা মানুষটি ছিলেনও ভারি আমুদে ধরনের৷ শক্তপোক্ত নয়, একটু ঢিলেঢালা স্বভাবের লোক, পড়াশোনা ছাড়া বাকি সময়টা তাঁর কাটত গানবাজনায়৷ কোথায় ফৈয়াজ খাঁ আসবেন, কোথায় আলাউদ্দিন খাঁ বাজনা বাজাবেন, কোথায় সারাফৎ হোসেন খাঁ-র গান হবে, এই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান৷ নিজেও বাজাতেন তিনি৷ এস্রাজ৷ আমি তাঁকে একটুও ভয় পেতাম না৷ দিবানাথের ছবি দেখার পর তাঁকেই বলতে পেরেছিলাম, বাবা, আমি কি তোমার খুব বোঝা হয়ে গেছি?
মনে আছে সেই সন্ধ্যায় বাবা গুনগুন করে একটা বন্দেশ ভাঁজছিলেন৷ গোরি সুরৎ মন ভইরে হাঁরেমোরে৷ থমকে গিয়ে বললেন, কেন রে, কী হল?
—আমি এম. এ.-টা পড়ব ভাবছিলাম…
বাবাকে মুহূর্তের জন্য চিন্তিত দেখাল, বিয়ে তো আজ হোক কাল হোক করতে হবে রে৷
—তা বলে এক্ষুনি?
—এত ভালো ঘর, দেনাপাওনা নেই, ছেলেটার তোকে এত পছন্দ, এসব কি বারবার পাব?
পূর্ব ঘটনাটা আমি জানতাম৷ আমারই এক পিসতুতো দিদির বিয়েতে দিবানাথ নাকি দেখেছিলেন আমাকে৷ দেখেই মুগ্ধ৷ পরদিনই সম্বন্ধ নিয়ে তাঁদের বাড়ির লোক হাজির৷ কুটোটি দিতে হবে না, শাঁখাসিঁদুরে মেয়ে নিয়ে যাব আমরা৷
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে বাবাকে বললাম— বারে, আমার বুঝি একটা পছন্দ অপছন্দ নেই?
এতক্ষণে বাবার মুখে হাসি ফুটেছে— দিবানাথ খারাপটা কী? ওদের অবস্থা এখন পড়তি, তাও তো আমাদের থেকে অনেক ভালো৷ কলকাতায় অত বড়ো একটা বাড়ি, ছেলেটাও খুব পরিশ্রমী, ব্যবসা ভালো চালাচ্ছে৷ বাড়িতে শাশুড়ি নেই, দেওর ননদ নেই শ্বশুর অথর্ব, তুই তো রানি হয়ে থাকবি রে৷
লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললাম, তুমি চেহারাটা দেখেছ বাবা? লেখাপড়াও শেখেনি…
—ছি খুকি, মানুষের রূপ নিয়ে কখনো সমালোচনা করতে নেই৷ সৌন্দর্য চামড়ায় থাকে না, থাকে অন্তরে৷ আর লেখাপড়ার কথাটা যদি বলো, সে যা ব্যবসা করছে তাতে বি. এ., এম. এ. পাস করে তার কি এমন মোক্ষলাভ হত? ডিগ্রির মাপকাঠিতে শিক্ষাকে মাপতে যাওয়া সব সময়ে ঠিক নয়৷
বাবার আকস্মিক রূঢ়তায় আমি স্তব্ধ৷ এ যেন আমার নিত্যদিনের বাবা নয়, এক অচেনা মানুষ৷ পরে জেনেছি এই বিয়ে নিয়ে বাবারও প্রথমটা খুঁতখুঁতুনি ছিল, কিন্তু মা-ঠাকুমার চাপে তাঁর আপত্তি ধোপে টেঁকেনি৷ হয়তো নিজের ওপর ক্ষোভটাই ফেটে পড়েছিল আমার ওপর৷ কে না জানে বাবাদের থেকে মায়েরাই মেয়েদের বিদায় করার জন্য বেশি উতলা হয়ে থাকে৷ তখনও৷ এখনও৷
বিয়েতে আর প্রতিবাদ করিনি, কিন্তু একটা মেঘ উড়ে এসে বাসা বাঁধল বুকে৷ সজল মনে বিয়েটাও ঘটে গেল৷
শুভদৃষ্টির সময়ে দিবানাথের দিকে তাকাইনি৷ তাকানোর ইচ্ছেও হয়নি৷ তবু নিজের অজান্তেই সপ্তপদীর সময়ে কী করে যেন চোখ পড়ে গেল৷ দেখলাম চন্দনচর্চিত হয়েও লোকটির চেহারা ছবির থেকে ঢের নিরেস৷ উচচতা মাঝারিও নয়, বেঁটেই বলা যায়৷ উজ্জ্বল আলোতেও কালো রং কেমন খসখস করছে৷ ঝাঁটার মতো বিশ্রী গোঁফও আছে একটা৷ এই মানুষের সঙ্গে সারাজীবন থাকবো আমি? এক বিছানায় শোব? এই পুরুষের সন্তান ধারণ করতে হবে আমাকে?
বাসরটিও জমল না৷ আমার কয়েকজন সখী হাসি-মস্করার চেষ্টা চালিয়েছিল, কেতকী আদিরসাত্মক গানও ধরেছিল একটা, কিন্তু আমার স্বামীটি এমন গোমড়া নিষ্প্রাণ মুখে বসেছিলেন যে কেতকীরা আর বেশি দূর এগোতে সাহস পায়নি৷
ফুলশয্যার রাতে দিবানাথের রূপ বদলে গেল৷ দরজা বন্ধ হতেই গোমড়া ভাব উধাও৷ রুক্ষ স্বরটিতে ছুনছুন গানের কলি৷ কানাকেষ্টর গান৷ ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সংগীত ভেসে আসে! ফুলশয্যার উপযুক্ত গানই বটে!
সংগীতর্চ্চা করতে করতেও আমাকে নিরীক্ষণ করছিলেন দিবানাথ৷ আমি কচি খুকিটি নই, কী কী হবে এখন আমার জানা, দু-দিনেই বিয়েটাকে ভবিতব্য বলে মেনেও নিয়েছি, তবু আমার গলা শুকিয়ে আসছিল৷
এক সময়ে গান থামিয়ে দিবানাথ বিছানায় এসে বসলেন, তোমার নামটি ভারি সুন্দর৷ বসুন্ধরা৷
আমি চুপ৷ আড়ষ্ট৷
তিনি আবার বললেন, বসুন্ধরা মানে তো পৃথিবী, তাই না?
এরকম বোকা প্রশ্নের কোনো মানে হয়!
তিনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন৷ হাতটি কাঁপছিল৷ বললেন, বসুন্ধরা নাম ডাকার পক্ষে ভালো না, ছোটো করারও অসুবিধে আছে৷ বসুও কেমন যেন, ধরাও ভালো শোনায় না৷
জড়সড় বসে থাকতে থাকতে এবার আমার হাসি পেল৷ কাঁধ ধরে দিবানাথ একটু কাছে টানলেন আমাকে, আচ্ছা, আমি যদি তোমাকে খুকি বলে ডাকি? তোমাদের বাড়ির মতো?
বাইরে সানাই বাজছিল৷ একটানা৷ নহবতখানা বানিয়ে গোটা রাত সানাই বাদনের বন্দোবস্ত করেছেন আমার স্বামী৷ বন্ধ দরজা ভেদ করে সানাই-এর সুর আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছিল ঘরে৷ আলো বেশি নেই, বিশাল কক্ষে একটি মাত্র বেডল্যাম্প জ্বলছে, আলো-আঁধারে সানাই-এর সুর অন্ধকারকে বেশি প্রকট করে তুলছিল যেন৷
আমি ঝট করে বলে উঠলাম, আপনি আমাকে খুকি বলে ডাকবেন কেন?
—কেন, ডাকটা কি খারাপ? বলেই বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিচিত্র স্বরে খুকি শব্দটাকে উচচারণ করলেন দিবানাথ৷
আমার রাগ হয়ে গেল, না, আপনি আমাকে খুকি বলে ডাকবেন না৷
—মুশকিল হল! কী বলে ডাকি তাহলে? তুমি আমার থেকে এত ছোটো…
—যা খুশি ডাকুন, কিন্তু খুকি নয়৷ পুরো নাম ধরে ডাকতে পারেন৷
আমার স্বরে বোধ হয় ঈষৎ তেজ ছিল, যাতে কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন দিবানাথ৷ কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বিছানা ছেড়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ বেশিক্ষণ থাকলেন না সেখানে, আবার ফিরে এসেছেন বিছানায়৷ আমার হাতে হাত৷ নাড়াচাড়া করছেন মীনমুখী বালা৷ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন— আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি, না?
সত্যি বলতে পারলে কী ভালোই যে হত!
—পছন্দ না হলেও উপায় নেই৷ হে-হে৷ আমার সঙ্গেই ঘর করতে হবে৷
মনে মনে বললাম— জানি৷
—তোমাকে কিন্তু পুরো সংসারটারই দায়িত্ব নিতে হবে৷ বিয়ের ভিড় কাটলে সব কিছু বুঝেশুনে নাও৷ শুনেছ তো রোজগারপাতি আমি খারাপ করি না৷ সবই এখন থেকে তোমার জিম্মায় থাকবে৷ আমিও৷ বলেই প্রস্তুতির অবকাশ না দিয়ে একটি চুম্বন সারলেন দিবানাথ৷ পুরুষের চুম্বন যে এত স্বাদহীন, কষটে হতে পারে আমার ধারণাই ছিল না৷
হায় ফরাসি প্রেমিক!
সংকোচ আর বিরক্তিমাখা মুখে আমি যখন পরবর্তী আক্রমণের অপেক্ষায়, দিবানাথ বললেন— খাঁ সাহেব সানাইটা কিন্তু দারুণ বাজাচ্ছেন৷
আমি অনেক কষ্টে হাসার চেষ্টা করলাম৷ হাসি ঠিক ফুটল না৷
দিবানাথ বললেন— এক রাতে দুশো টাকা নিচ্ছে, ভালো বাজাবে নাই-বা কেন? কী রাগ বাজাচ্ছে বোঝো? দরবারি কানাড়া৷
—আপনি ভুল করছেন৷ কাঁহাতক আর চুপ করে থাকা যায়! বলেই ফেললাম, ওটা মালকোষ৷
—না, দরবারি কানাড়া৷ একটু যেন দমে গেলেন আমার স্বামী৷
আমি শান্তভাবে বললাম— আমি মালকোষ চিনি৷ দরবারির সঙ্গে মালকোষের তফাত হল, মালকোষের ক্ষেত্রে…
—চুপ৷ একদম চুপ৷ চাপা স্বরে হঠাৎই হিসহিস করে উঠলেন দিবানাথ, আমার সঙ্গে তুমি তর্ক কোরো না৷ ওটা দরবারি কানাড়াই৷
মানুষটার আকস্মিক রুদ্র মূর্তিতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি আমি, তবু গোঁ ছাড়িনি— উঁহু, ওটা মালকোষ৷
—না, দরবারি কানাড়া৷
—বাজি রাখবেন?
কথাটা বেরিয়ে গেল মুখ থেকে৷ ছোট্ট থেকেই এই আমার এক বিটকেল নেশা৷ দুধঅলা আসবে কিনা তাই নিয়ে মা-র সঙ্গে বাজি ধরি৷ কাপড় কাচার লোকটা সপ্তাহে ক-টা কাপড় ফাটাবে তাই নিয়ে বাবার সঙ্গে বাজি হয়৷ এ ছাড়া দাদা তো আছেই৷ যেকোনো ছুতোয় বাজির লড়াই চলছে ভাইবোনে৷ বৃষ্টি রোদ্দুর শিলপড়া, কবিতার লাইন, পরীক্ষার রেজাল্ট কী নিয়ে নয়৷ আর মজার ব্যাপার, আজ পর্যন্ত বাজিতে আমি হারিওনি৷ বাবা ঠাট্টার ছলে বলতেন মেয়ের আমার বাজিলগ্নে জন্ম৷
দিবানাথেরও যেন জেদ চেপে গেছে৷ বললেন— রাখব বাজি৷
—হেরে যাবেন কিন্তু৷
—দেখা যাক৷ আধো অন্ধকারে দিবানাথের কালো কুচকুচে মণি দুটো জ্বলছিল— হারলে কী দিতে হবে?
দুম করে বলে বসলাম— আজ রাত্রে আমার পাশে শোবেন না৷ ছোঁবেনও না আমাকে৷ রাজি?
দিবানাথের নাকের পাটা ফুলছিল— আর যদি তুমি হারো?
—বলুন আপনি কী চান?
দিবানাথ কথা বললেন না৷ দরজা খুলে বেরিয়ে গেছেন৷ মিনিট কয়েক পর ফিরে এসে নিঃসাড়ে খিল তুললেন৷ এক পা এক পা করে এগোলেন আমার দিকে৷ ক্রুর চোখে দেখছেন৷ যেন অন্যায়ভাবে তাঁকে ঠকিয়ে দিয়েছি আমি৷ হিংস্র দৃষ্টি সরালেন এক সময়ে৷ ঘরে বেতের সোফা ছিল, সেখানে আধশোওয়া হয়ে কাটিয়ে দিলেন রাত৷ ঘুমোননি৷ তাঁর আগুনের হলকার মতো নিশ্বাস অঘ্রাণের রাতকেও তপ্ত করে তুলেছিল৷
জয়ের তৃপ্তি স্থায়ী হল না৷ পরের রাত্রেই আমাকে অধিকার করলেন দিবানাথ৷
আমাদের সম্পর্কে একটা শনি ঢুকে গেল৷
দুই
দিবানাথ ছিলেন আমার শ্বশুরমশাইয়ের একমাত্র সন্তান৷ একমাত্র সন্তান হওয়ার সুখ যেমন আছে, বিপদও কম নেই৷ এদের কামনায় কোনো লাগাম থাকে না৷ অনেক সময়েই তা সৃষ্টিছাড়া পর্যায়ে চলে যায়৷
আমার শ্বশুর হরনাথ তাঁর বিয়ের পর পরই জ্ঞাতিগোষ্ঠীর শরিকি বাড়ি ছেড়ে পৃথক হয়ে আসেন৷ নিজের ভাগটি বুঝে নিয়ে ভবানীপুরে একটি দোতলা বাড়ি তৈরি করেন তিনি৷ সেই বাড়িতেই আমাদের বাস৷ দিবানাথের জন্মের বছর খানেকের মধ্যেই হরনাথের স্ত্রী বিয়োগ হয়, কিন্তু তিনি আর বিয়ে করেননি৷ কেন যে করেননি! করলে হয়তো দু-একটা ভাইবোন থাকত দিবানাথের৷ নিদেনপক্ষে সংসারে একটা নারীর ছোঁয়া থাকলে দিবানাথের মধ্যে নিষ্ঠুরতা হয়তো কিছু কম থাকত৷ হয়তো বা কিছু সুকুমারবৃত্তির বিকাশও হতে পারত তাঁর হূদয়ে!
দিবানাথের নিষ্ঠুরতা ছিল ভিন্ন গোত্রের৷ শারীরিক নিগ্রহ তো দুরস্থান, কোনোদিন আমাকে একটি কটু কথা বলেননি তিনি৷ সত্যি বলতে কী, তাঁর নিষ্ঠুরতাকে ভালোবাসা বলে ভ্রম হওয়াও বিচিত্র নয়৷ কী করে যে বোঝাই সে কথা!
হত কী, রাস্তার গ্যাসবাতি জ্বলতে না-জ্বলতেই হাওড়ার কারখানা থেকে সোজা বাড়ি ফিরতেন দিবানাথ৷ মরিস মাইনর হাঁকিয়ে৷ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার আগেই পৌঁছে গেছেন দোতলায়৷ আমাকে একবার চোখের দেখা দেখে তবেই তাঁর স্বস্তি৷ যেন বা আমি এক অলীক মায়াবিনী, সকালে ছিলাম, বিকেলে মিলিয়ে যাব মহাশূন্যে৷ বাড়ির ঝি-চাকর কী ভাবছে পরোয়া নেই, শয্যাশায়ী বাবার পাশে দু-দণ্ড গিয়ে বসবেন তা নয়, ঠায় বসে আছেন আমার সামনে৷ বসেই আছেন৷ আমারও তখন কাজ একটাই৷ পাথরের মূর্তি হয়ে শুধু বসে থাকা৷ কোনো অছিলায় উঠতে গেলেও ঘোর বিপদ৷ প্রথম প্রথম বুঝিনি৷ হয়তো বা পানের-বাটা আনতে গেছি, পরের দিন শ্যামার মা বরখাস্ত হয়ে গেল! জলখাবারের দেরি হচ্ছে দেখে রান্নাঘরে ঢুকেছি, ঠাকুরের চাকরি খতম! অতএব কী আর করা৷ বসে থাকো৷ বসে থাকো৷ বসে থাকো নিস্তব্ধ৷ নির্বাক৷ আমার সঙ্গে তাঁর তেমন কথাই বা থাকত কই! কোনদিনই বা ছিল!
পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে বসে থাকতে মেয়েদের খারাপ লাগে না৷ পুরুষের চোখই তো মেয়েদের আসল আয়না৷ হোক সে আয়না আমার স্বামীর মতো ছ্যাতলা পড়া! কিন্তু আয়নার সামনেই বা কতক্ষণ আর স্থাণুবৎ বসে থাকতে পারে মানুষ!
আমার হাঁপ ধরছিল৷ বিয়ের ছ-সাত মাসেই নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার দশা৷ মনে হত জলের ভেতরে আমাকে ডুবিয়ে মাথাটি চেপে আছেন দিবানাথ, আর আমি প্রাণপণে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি নিজেকে৷ পারছি না৷ আর আমার কষ্ট, ছটফটানি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন আমার স্বামী৷
তখনই আমার পুরোনো ভূতুড়ে শখটা চাগাড় দিয়ে উঠল৷ লেখার৷ যা প্রাণ চায় লিখব৷ যা মনে আসে লিখব৷ এও তো এক ধরনের অর্গলমুক্তি৷ ভেতরের কথাগুলো যদি প্রাণ পায়, তাহলেও তো একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে পারি৷
একদিন বসেই গেলাম কালি-কলম নিয়ে৷ কাগজে ফুটে উঠল এক অন্ধ মেয়ের কাহিনি৷ মেয়েটা শুধু স্পর্শ দিয়ে সমস্তরকম রং অনুভব করতে পারে৷
লিখতে লিখতে আমি তন্ময়, ফিরলেন দিবানাথ৷ মিনিট কয়েক বুঝি উসখুস করলেন আরাম কেদারায়, তারপর উঠে এসে পিছনে দাঁড়িয়েছেন৷ একটু বিরক্ত স্বরেই জিজ্ঞাসা করলেন, কী করছ?
চেয়ার থেকে উঠলাম না, মুখও ঘোরালাম না— লিখছি৷
—তা তো দেখতেই পাচ্ছি৷ কিন্তু লিখছটা কী?
—গল্প৷
দিবানাথের যেন সামান্য কৌতূহল হল৷ ঝুঁকে পড়ে দেখলেন লেখাটা৷ দু-চার লাইন পড়ে তাঁর আগ্রহ উবে গেল৷ বললেন— আমি এসেছি৷
ঠোঁঠের কোণে বিদ্রুপ খেলে গেল আমার— দেখেছি তো৷ আর তাই তো নড়িনি এখান থেকে৷ তুমি বসে বসে আমাকে দ্যাখো, আমি লিখব৷
পরের দিন লেখার কাগজগুলো পেলাম না, কলমটাও না৷ সারা দুপুর তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম৷ কোথাও নেই৷ নিমাইকে ডেকে নতুন কাগজ কলম কিনে আনালাম৷ আবার লিখছি৷ অন্ধ মেয়ের কাহিনি৷
দিবানাথ সেদিন ফিরে ঠাট্টা জুড়লেন,— তোমার গল্পো শেষ হল?
—কী করে হবে? কাগজ-কলমটাই যে হারিয়ে গেল৷
দিবানাথ হাসছেন ফিক ফিক— এ বাড়ির লোকজন লেখাপড়ার মর্যাদা বোঝে না, ওসব ছেড়েই দাও৷
—আর সারাক্ষণ তোমার সামনে সঙ-এর মতো বসে থাকি, তাই তো?
—থাকো না৷ ক্ষতি কী?
—দোহাই তোমার, আমাকে একটা কাজ নিয়ে থাকতে দাও৷
—স্বামী খেটেখুটে ফিরলে তার সেবাযত্ন করাও বউয়ের কাজ৷
—তুমি তো আমার সেবা নাও না৷ তার জন্য তোমার ঠাকুর-চাকর আছে৷
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে যেন গুমোট নেমে এল৷ মাথার ওপর চার ডানার পাখা ঘুরছে, তবু যেন বাতাস স্থির৷ কেউ যেন টুঁটি টিপে রেখেছে হাওয়ার৷
পরদিন আবার কাগজ কলম নিরুদ্দেশ৷ আমি আর খুঁজলাম না, জানি খুঁজে লাভ নেই৷ নিতাইকে দিয়ে আবার আনিয়ে নিয়েছি কাগজ-কলম৷ আবার লিখছি৷ এক অন্ধ মেয়ের কাহিনি৷
দিবানাথ সেদিন খানিকটা ক্ষুব্ধ, যদিও তাঁর স্বরটি নীচু তারেই বাঁধা— তোমার এই এক গপ্পো লেখা কি চিরকাল চলবে?
—শেষ করতে না দিলে তো চলবেই৷ সরাসরি দিবানাথের দিকে তাকালাম৷
দিবানাথ এবার একটু মিইয়ে গেলেন৷ হাসলেন আলতো৷ শিশুরা দোষ করে ধরা পড়ে গেলে যেমনটি হাসে, ঠিক তেমনটি৷ সময় নিয়ে বললেন— লিখছ, ভালো৷ কিন্তু এসব ছাইপাশ লিখে লাভ কী?
—তুমি বুঝবে না৷ যেমন আমাকে ঘটের মতো বসিয়ে রাখাটা আমি বুঝি না৷
কথা বলতে আবার সময় নিলেন দিবানাথ৷ বললেন— নিজে লিখবে, নিজেই পড়বে, এত পরিশ্রমের কী দরকার? লাইব্রেরি থেকে ভালো ভালো বই এনে দেব, দুপুরে পোড়ো৷
কথাটা হয়তো দিবানাথ ভেবে বলেননি, কিন্তু কোথায় যেন বিঁধল আমাকে৷ বললাম— আমার লেখা আমি একা পড়ব কেন? আরও অনেকে পড়বে৷
—তুমি কি বাড়িতে আসর বসাবে নাকি? ওসব আমি পছন্দ করি না৷
—আসর বসাব না৷ কাগজে পাঠাব৷ ছাপা হবে, লোকে পড়বে৷
—তোমার লেখা…! ছাপা…! লোকে…! শব্দহীন হাসিতে আমার স্বামীর মুখ কেমন ভেঙেচুরে যাচ্ছিল— তুমি কি পাগল?
মনে মনে বললাম, হতে পারলে বোধ হয় ভালোই হত৷ মুখে বললাম— তোমার কি ধারণা আমার লেখা ছাপার যোগ্য নয়?
হাসি থেমে গেল৷ হঠাৎই মনে হল দিবানাথ যেন হাসছিলেন না, হাসির ভান করছিলেন এতক্ষণ৷ মনের কোনো গোপন কথা লুকিয়ে রাখছিলেন হাসিতে৷ নীরস স্বরে বললেন— তোমার কি সন্দেহ আছে? কোন মুখ্যু তোমার লেখা পুঁছবে? বাবার আদর পেয়ে পেয়ে তোমার মাথা বিগড়ে গেছে৷
এ-কথাগুলোও যেন মনের কথা নয়, আমাকে আঘাত করার জন্য বলা৷ অপমানে সম্বিৎ হারালাম আমি৷ বলে উঠলাম— বাজি? যদি আমার লেখা পূর্বাশায় ছাপা হয়?
সন্দিগ্ধ চোখে আমাকে দেখছিলেন দিবানাথ৷ বোধ হয় ফুলশয্যার স্মৃতিটা কাঁটা ফোটাচ্ছিল বুকে৷
আমি একদম সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম— বাজি ধরতে ভয় পাচ্ছ?
—কীসের ভয়? আমি ভয়-টয় পাই না৷
—তাহলে বলো, যদি গল্পটা ছাপা হয়, তুমি আর আমাকে লিখতে বাধা দেবে না? ওই নোংরা কাগজ লুকোনোর খেলা খেলবে না?
দিবানাথ সরে গেলেন৷ ঘরে পায়চারি করলেন খানিকক্ষণ৷ নিজের কুকর্মের জন্য এতটুকু ছায়া নেই তাঁর মুখে৷ একটু পরে বললেন— যদি ছাপা না হয় তাহলে কী হবে জানো? জীবনে কক্ষণো আর কাগজ-কলম ধরতে পারবে না তুমি৷ রাজি?
—বেশ রাজি৷
সত্যিই দু-তিনদিন আর বাধা এল না৷ গল্পটা মনের মতো করে লিখে নিজের হাতে ডাকে পাঠিয়ে দিলাম৷ পূর্বাশায়৷ এখন ফলাফলের প্রতীক্ষা৷
দিন যায়৷ দিন যায়৷ উত্তর আর আসে না৷ ভেতর থেকে এক গভীর অবসাদ ছেয়ে ফেলেছিল আমাকে৷ বাজিতে না গিয়ে দিবানাথকে হাতে-পায়ে ধরে বোঝালেই কি ভালো হত? লেখার সময়ে কল্পনাতে যেটুকুনি আকাশ দেখতে পেয়েছিলাম, তাও কি মুছে গেল চোখ থেকে?
এমন সময়ে আমার শ্বশুরমশাই মারা গেলেন৷ আগেই মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে অসাড় ছিলেন তিনি, দোতলার এক কোণে জীবন্মৃতের মতো বেঁচে ছিলেন, সন্ন্যাস রোগ তাঁর প্রাণটুকু হরণ করে নিল৷ আমার সঙ্গে শ্বশুরমশাইয়ের তেমন কোনো নৈকট্য গড়ে ওঠেনি, তাঁর মৃত্যুও তাই তেমনভাবে ছুঁতে পারল না আমাকে৷
শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেছে৷ দিবানাথ এমনিতেই স্বল্পভাষী, কথাবার্তা আরও কমে গেছে তাঁর৷ এ বাড়িতে এসে অবধি বাবার ওপর তাঁর তেমন টান দেখিনি, তবু যেন খানিকটা মনমরা দেখায় তাঁকে৷
মাসখানেক পর একদিন দাদা এল বাড়িতে৷ খুশিতে চকচক করছে দাদার মুখ— হ্যাঁরে খুকি, তুই পূর্বাশা পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছিলি নাকি?
আমার রক্ত ঝনঝন কেঁপে উঠল— হ্যাঁ৷ কেন?
—জেনেও না জানার ভান করা হচ্ছে অ্যাঁ? তোর লেখা তো বেরিয়ে গেছে৷ গত সংখ্যার আগের সংখ্যায়৷ ভাবিস বিয়ে দিয়ে পর করে দিয়েছি, কোনো খবর রাখি না? তুই একটা অন্ধ মেয়েকে নিয়ে ওরকম দারুণ গল্প লিখলি কী করে? আমার বন্ধুদেরও পড়িয়েছি৷ ও-রকম গল্প লেখা কি চাট্টিখানি কথা!
আরও কী সব বলেছিল দাদা আমার মনে নেই৷ তবে দাদা চলে যাওয়ার পর একটা সন্দেহ কুরে কুরে খাচ্ছিল আমাকে৷ কাঠের দেরাজে দিবানাথের একটা নিজস্ব কুঠুরি ছিল, অফিসের কাগজপত্র রাখতেন সেখানে৷ খুলে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করতেই যা ভেবেছি তাই৷ পূর্বাশাটি রয়েছে৷ পত্রিকার ভাঁজে পূর্বাশার সম্পাদকের চিঠিও৷ আমাকে লেখা৷ মাস চারেক আগে৷ আপনার সুলিখিত গল্পটি আমাদের চমৎকৃত করিয়াছে৷ আগামী সংখ্যায় রচনাটি প্রকাশিত হইবে৷ আপনার স্বামী আমাদের দপ্তরে লেখাটির খোঁজ করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাকে পূর্বেই সংবাদটি জানাইয়াছিলাম৷ আশা করি তাঁহার হস্তে প্রেরিত কিঞ্চিৎ সম্মানমূল্যটিও আপনি ইতিমধ্যে পাইয়াছেন৷ পূর্বাশার পাঠকমণ্ডলী আপনাকে আবার পাইতে ইচ্ছুক৷ আপনি আরও গল্প পাঠাইলে বাধিত হইব৷
চিঠি পড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগল শরীরে৷ এক দিকে মুক্তির অপার পুলক, অন্য দিকে এক তীব্র বিবমিষা৷ শিকল ছিঁড়ে গেছে আমার, তবু শরীর জুড়ে কেন এই তিৎকুটে স্বাদ!
আমি আমার স্বামীকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম৷
তিন
দিবানাথ ছিলেন এক কথার মানুষ৷ তাঁর কারখানার লোকজন বাড়িতে আসত মাঝে মাঝে, তারা বলত দিবানাথবাবুর কোনো আবেগ উচ্ছাস নেই, কিন্তু তিনি যা বলেন তাই করেন৷ মাইনে বাড়াবেন, তো বাড়াবেন৷ বাড়াবেন না, তো কিছুতেই বাড়াবেন না৷ যেখানে যে জিনিস যেদিন ডেলিভারি যাওয়ার কথা, পৃথিবী উল্টে গেলেও সেখানে সেদিন মাল পৌঁছবেই৷ তাতে যদি তাঁর লোকসান হয়, তবুও৷
কথাটা আমার বিশ্বাস হত না৷ যে মানুষের পেটে এত প্যাঁচ, সে কি এত সোজা হতে পারে৷ কিন্তু কী আশ্চর্য, সেদিনের পর থেকে সত্যিই তিনি আর আমার সাহিত্যসাধনায় কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করলেন না৷
উল্টে আমিই এক নতুন প্রতিশোধের নেশায় মাতলাম৷ সারা দুপুর ঘুমোই, সন্ধে থেকে কাগজ-কলম নিয়ে বসি৷ আকাশ ক্রমশ গাঢ় হতে থাকে, রাত নিশুত হয়, তারারা উজ্জ্বল থেকে আরও উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে৷ এক সময়ে ফ্যাকাশে হয় আকাশ, তারা নেবে, ভোর আসে ধীর পায়ে৷ আমি লিখতে থাকি৷ তখনও৷ একটি দিনের জন্যেও দিবানাথ আমাকে টানেন না বিছানায়৷ অথচ বুঝতে পারি তিনি জেগে আছেন৷ তাঁর রক্তবর্ণ চোখ ধারালো ছুরি হয়ে ফালাফালা করতে চায় আমাকে৷ তবু কলম থামাই না সারারাত৷ কী লিখছি তাতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু লোকটা পুড়ুক৷ নিজের বাসনার আগুনে পুড়ুক৷
খেলাটা বেশি দিন চলল না৷ বড়োজোর হপ্তা তিনেক৷ তারপর একদিন গা গুলিয়ে উঠল আমার, মাথা টলে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার বদ্যি, ছোটাছুটি করে চারদিক তোলপাড় করে ফেললেন দিবানাথ৷
মেয়ে ডাক্তার এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল আমাকে৷ হাসল৷
কেউ একজন আসছে পৃথিবীতে৷
দিবানাথ যেন খুশি হলেন না তেমনটা৷ প্রথম সন্তানের আগমনবার্তা বাবাদের প্রায় পাগল করে তোলে, সেই আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই দিবানাথের মধ্যে! আমি কাগজে কলমে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে দেখি প্রায় সন্ধ্যাতেই ম্লান মুখে বসে আছেন আমার স্বামী৷ আকাশপাতাল কী যেন ভাবছেন৷ বুঝি বা নিজের সঙ্গেই কোনো জটিল বোঝাপড়া চলছে তাঁর৷
এর মধ্যে একটা দুটো লেখাও ছাপা হল আমার৷ নিজেই পত্রিকাগুলো সংগ্রহ করে আনলেন দিবানাথ, সম্পাদকীয় দপ্তরে কয়েকটা প্রশংসার চিঠি এসেছিল, সেগুলোও নিজেই নিয়ে এলেন হাতে করে৷ আনন্দিত মুখে নয়, নিখুঁত কর্তব্য সারার মতো৷ বুঝলাম বাজিতে হারাটা তাঁর রক্তে সয়ে আসছে৷
আমার তখন পাঁচ মাস চলছে, দিবানাথের ম্লান ভাব অনেকটা স্তিমিত৷ বাড়ি ফিরে আমার শরীরের খোঁজখবর নেন, যত্নআত্তির ত্রুটি থাকতে দেন না, সামান্য হাসির কথায় অকারণে বেশি বেশি হাসেন৷ আমিও সহজ করার চেষ্টা করছি নিজেকে!
হঠাৎই একদিন পার্ক স্ট্রিটের নিলামঘর থেকে একরাশ কাচের পুতুল নিয়ে এলেন দিবানাথ৷ গাউনপরা পুতুল৷ শাড়ি পড়া পুতুল৷ ঘাঘরাপরা পুতুল৷
আমি তো হেসে বাঁচি না— তোমার হঠাৎ পুতুল নিয়ে ঘর সাজানোর শখ হল যে?
দিবানাথও হাসছিলেন— এসব পুতুল আমার মেয়ের জন্য৷
—মেয়েই হবে তোমায় কে বলল?
—মেয়েই হবে৷ আমি জানি৷
—ধরো যদি ছেলে হয়?
—হতেই পারে না৷ আমি মেয়ে চাই৷ ফুটফুটে পুতুলের মতো একটা মেয়ে৷
মেয়ের মধ্যে কি আমাকেই খুঁজতে চান দিবানাথ? মনটা পলকে বিষিয়ে গেল৷ যে শব্দটাকে মন থেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলাম, সেই শব্দটা ছিটকে এসেছে মুখ থেকে— বাজি? আমি বলছি ছেলে হবে৷
দিবানাথ যেন শুনতেই পেলেন না কথাটা৷ আনমনে বিড়বিড় করলেন— না, না দেখো মেয়েই হবে৷
—কক্ষনো না৷ ছেলে হবে৷
দিবানাথ নিষ্পলক তাকালেন আমার দিকে৷
আমি বলে উঠলাম— বাজি রাখতে সাহস হচ্ছে না?
দিবানাথের মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছিল৷ ঢোঁক গিলে বললেন— ভয় কীসের? বাজি রাখাই যায়৷
—শর্ত?
—তুমিই বলো৷
—ছেলে হলে আর কোনো সন্তান চাইতে পারবে না তুমি৷ আর মেয়ে হলে তুমি যা বলবে তাই৷ মেয়েকে কীভাবে মানুষ করবে তাই নিয়েও আমি নাক গলাতে যাব না৷ রাজি?
দিবানাথ অস্ফুটে কী যেন বললেন, ঠিক শুনতে পেলাম না৷
এতদিনে স্বামীর ওপর কেমন যেন মায়া জাগছিল আমার৷ মায়া, না করুণা? হূদয় নিংড়ানো কোনো অনুভূতি নয়, তবু কেন যে বুকটা টলটল করে ওঠে!
কেন?
চার
দিবানাথ ছিলেন আমার একমাত্র ছেলের পিতা৷ কিন্তু তিনি কোনোদিন ছেলেকে একটুও ভালোবাসতে পারেননি৷ মাতৃসদনে সদ্যোজাত শিশুকে দেখে মুখ পাংশু হয়ে গিয়েছিল তাঁর৷ শুনেছি বাড়ি এসে তিনি নাকি সেদিন জলস্পর্শ করেননি৷ ছেলেকে তিনি কখনো কোলে নিতেন না, আদর করতেন না, তাঁর কাছ থেকে এক ধরনের উপেক্ষাই পেয়ে এসেছে আমার ছেলে৷
দিবানাথের ওপর যেটুকু মায়া এসেছিল আমার সেটুকুও চলে গেল৷ ওই উপেক্ষা দেখেই৷ দিবানাথকে বাদ দিয়ে এক পৃথক দুনিয়া নির্মাণ করে নিলাম আমি৷ আমার ছেলেকে নিয়ে৷ আমার লেখা নিয়ে৷
ক্রমশ আমার লেখার জগৎ ছড়িয়ে পড়ছিল৷ আমার প্রথম দিকের গল্পে বড়ো বেশি আবেগের বাহুল্য থাকত, আতিশয্য থাকত, নাটকীয়তা থাকত, সেগুলো ধীরে ধীরে কমে এল৷ আমার কলম হয়ে উঠল রুক্ষতর৷ কঠিন৷ তবে ভাষার নিপুণ আঁচড়ে হূদয়ের আরও গভীরে পৌঁছতে সমর্থ হলাম আমি৷ অনেক নামি কাগজেই নিয়মিত আমার লেখা বেরোয়, ছোটো হলেও কিছু ভক্তকূল তৈরি হয়েছে আমার৷ বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে৷ তার মধ্যে চারটি উপন্যাস বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদও হয়ে গেছে৷ সভাসমাবেশ, সাহিত্য আসর থেকে ডাক আসে মাঝে মাঝে, প্রায়ই এখানে সেখানে যাই৷ পাঠক আর সমালোচকদের মতে আমি এখন বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট লেখিকা৷
ছেলেকেও আমি মনের মতো করে মানুষ করেছি৷ ছোটো থেকেই সে পড়াশুনায়ও অত্যন্ত মেধাবী, উচচমাধ্যমিক পরীক্ষায় রীতিমতো ভালো রেজাল্ট করে খড়্গপুর আই আই টি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে৷ বছর পাঁচেকের জন্য আমেরিকায় গিয়েছিল, ফিরে এসে এখানকারই এক বড়োসড়ো প্রতিষ্ঠানে উঁচু পদে বহাল এখন৷ স্বভাবে সে যথেষ্ট শান্ত৷ বিনয়ী৷ আমি তার মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ বপন করতে পেরেছি৷ নিজের পছন্দমতো একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে সে৷ নাতিনাতনি, ছেলে, ছেলের বউকে নিয়ে আমার এখন ভরাট সংসার৷
এই দীর্ঘ সময়ে দিবানাথের প্রায় কোনো বদলই হয়নি৷ তিনি মূলত কর্মী মানুষ, কারখানা নিয়ে পড়ে থেকেছেন বরাবর৷ একটা সময় গেছে যখন সকালে উঠে কাজে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন অনেক রাতে৷ মাঝে কারখানার অবস্থা কিছুকাল খারাপ গিয়েছিল৷ অর্ডার নেই, র-মেটিরিয়াল পাওয়া যাচ্ছে না, শ্রমিক অসন্তাোষ লেগে আছে, এই সব৷ সে সময়ে খুব দুশ্চিন্তায় থাকতেন দিবানাথ, কিন্তু কখনো সান্ত্বনা খুঁজতে আসেননি আমার কাছে৷ আমার ওপর এক অদ্ভুত ক্রোধে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি৷ ছেলে হওয়ার পর আমাদের বিছানা আলাদা হয়েছিল, ছেলে বড়ো হতে ঘরও আলাদা হয়ে গেছে৷ পাশের ঘরেই থাকেন, তবু যেন দূরত্ব বেড়ে গেছে বহু যোজন৷ কথাবার্তা হয় না যে তা নয়, তবে সে সব নিছকই মামুলি আলাপচারিতা৷ প্রাণহীন৷ শুকনো৷ আমার লেখা বা খ্যাতি সম্পর্কে তিনি বিন্দুমাত্র উৎসাহী নন, আমিও তাঁর ব্যবসার হালহকিকত নিয়ে সামান্যতম কৌতূহল দেখাই না৷ সংসারে থেকেও দিবানাথ আমাদের সংসারের বাইরের মানুষ৷
শুধু একটা জিনিস আমি টের পাই৷ বাবা আর ছেলের মধ্যে একটা চোরা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে৷ দিবানাথের সঙ্গে সম্পর্কটা তেমন কাছের না হলেও বাবার ওপর একটা টান আছে ছেলের, দিবানাথও যেন খানিকটা মান্য করেন ছেলেকে৷ ছেলের পীড়াপীড়িতেই ইদানিং কারখানা যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন দিবানাথ৷ বাড়িতেই থাকতেন, সার সার টবে বনসাই করে দিনরাত পরিচর্যা করতেন তাদের৷ স্বাভাবিক একটা গাছকে জোর করে বাড়তে না দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের চাপা নৃশংসতা আছে, যেটা আমার একদম পছন্দ নয়৷ হয়তো সেই জন্যই বনসাই-এর প্রতি দিবানাথের এত আকর্ষণ! তবু বাধা দিইনি আমি৷ ভেবেছি, পাশাপাশি দুটো রেল লাইনের মতো কেটে যাক না জীবনটা৷ যেমন কেটেছে এতদিন৷
কাটল না৷ নিয়তি বাধ সাধলেন৷
গত বছর শীতের শুরুতে, রাত্রে শুতে যাওয়ার সময়ে, হঠাৎই আমার বুকে যন্ত্রণা শুরু হল৷ যন্ত্রণা মানে সে এক অসহ্য অনুভূতি৷ কেউ যেন আমার হূৎপিণ্ডে ধারালো আঁচড় টানছে৷ মুঠোয় চেপে নিষ্পেষিত করছে আমার ফুসফুস৷ দরদর ঘামছি আমি৷ আর্তনাদও করে ফেলেছিলাম বোধ হয়৷ অমনি পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছেন দিবানাথ৷ ছেলেকে ডাকার আগেই ডাক্তারকে টেলিফোন করেছেন, ডাক্তারের নির্দেশে রাতদুপুরে আমাকে নিয়ে নার্সিং হোমে ছুটেছেন৷
ফাঁড়াটা কেটে গেল৷ সাত দিন পর ফিরে এলাম বাড়িতে৷ হূৎপিণ্ডের বাইরের দেওয়াল বড়োসড়ো ঝাঁকুনি খেয়েছে একটা, ভাঙেনি৷ পূর্ণ বিশ্রামে খাঁচা মেরামত হয়ে যাবে৷
ফিরে আসার পর রোজ অনেক রাত অবধি আমার ঘরে বসে থাকতেন দিবানাথ৷ কথা নেই, শুধু নিঃশব্দ উপস্থিতি৷ এক সময়ের কুচকুচে কালো চোখের মণি ধূসর হয়ে এসেছে, হয়তো বা নিষ্প্রভও, তবু যেন সেই চোখ বড়ো জীবন্ত মনে হত আমার৷ মনে পড়ত এইভাবেই এক সময়ে আমার দিকে তাকিয়ে কত সন্ধ্যা, কত রাত্রি কাটাতে চেয়েছিলেন তিনি, অথচ আমি ওই দৃষ্টি সহ্য করতে পারিনি৷ আজ পারছি৷ ওই চোখে এখন কোনো কাম নেই, মুগ্ধতা নেই, আসক্তি নেই, তবু ওই চোখে চোখ পড়লে কেন যে আমার গা ছমছম করে!
একদিন বলেই ফেললাম— কী অত দেখো? আমি তো এখন বুড়ি!
দিবানাথ আলগা হাসলেন৷ কুদর্শন মুখমণ্ডলটি ওই হাসিতে বড়ো মায়াবী ঠেকল আমার৷ স্মিত মুখে বললাম— আমার দিন তো ফুরিয়ে এল৷
দিবানাথের চোখ মুহূর্তের জন্য ঝলসে উঠল, পরক্ষণে আবার ধূসর৷ ওই নীরব ঝলসে ওঠাতে আমি আর তেমন নাড়া খাই না৷ আবার হাসলাম৷ বললাম— রাগো কেন? সত্যিই আমার শরীরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে, বাঁচার আর শক্তি পাই না৷ এবার বোধ হয় যাব৷
বহুকাল পর দিবানাথ আমার কপালে হাত রাখলেন— উঁহু, তোমার আগে আমিই যাব৷
—তা কী করে হয়! তুমি আমার থেকে অনেক শক্তসমর্থ আছ, রোগব্যাধির বালাই নেই৷ আর আমার তো প্রথম ঘণ্টা বেজেই গেল৷
—বাজুক, তবু আমি আগে যাব৷
হঠাৎই পাশার দানটা পড়ে গেল৷ তিন যুগেরও বেশি ভুলে থাকা কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে— বাজি?
সহসা হাত সরিয়ে নিলেন দিবানাথ৷
পড়ে থাকা দান ফিরিয়ে নিলাম আমি৷ বললাম— বাজি ধরতে ভয় পাচ্ছ?
দিবানাথ কখনো যা করেননি, তাই করলেন৷ আচমকা চিৎকার করে উঠেছেন— না-আ-আ৷ আমি ভয় পাচ্ছি না৷ রাখলাম বাজি৷ একবারও কি তুমি হারবে না জীবনে?
দিবানাথের চিৎকার আর্তনাদ হয়ে মথিত করছিল রাতটাকে৷ নীলাভ অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল৷ ঘরের প্রাচীন কড়িবরগাও যেন কাঁপছিল থরথর৷
পরদিন থেকে দিবানাথকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না৷ এক হিমেল ভোরে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন দিবানাথ৷
পাঁচ
দিবানাথ নেই৷ না, নেই বলাটা ভুল৷ নেই শব্দটাতে একটা সমাপ্তি আছে৷ তিনি কোথায় আছেন, আদৌ আছেন কি না, আমি এখনও জানি না৷
বাবাকে খোঁজার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেনি আমার ছেলে৷ পুলিশে খবর দিয়েছে, রেডিয়ো, টিভি, খবরের কাগজে নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপন দিয়েছে বারকয়েক৷ যেখান থেকেই খবর এসেছে ছুটে গেছে বারবার৷ প্রাইভেট ডিটেকটিভও লাগিয়েছিল, লাভ হয়নি৷ চুয়াত্তর বছরের দিবানাথ যেন কর্পূরের মতো উবে গেছেন৷
হঠাৎই গত আষাঢ়ে বেনারস থেকে একটি চিঠি এল৷ কোনো এক ঊষারঞ্জন নস্করের লেখা৷ আমার স্বামী নাকি জ্যৈষ্ঠ মাসে দশাশ্বমেধ ঘাটে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়৷ মৃত্যুর আগে ঊষারঞ্জনকে ঠিকানাটা দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি৷ বলেছিলেন যেন ঠিক এক মাস পর তাঁর ভবানীপুরের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়৷ সেটাই নাকি ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছে৷
বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল আমার৷ যে মানুষটা আমার জীবনে নেই, যাঁর অস্তিত্ব আমি বিয়ের দিন থেকেই মুছতে চেয়েছি, তাঁর মৃত্যুসংবাদ কেন এমন করে শূন্য করে দিল আমাকে৷
ছেলে খবর পেয়েই ছুটে এসেছিল অফিস থেকে৷ কিন্তু চিঠিটা দেখে কেমন যেন বিশ্বাস হয়নি তার৷ চিঠির ভাষাটি যেন বড়ো বেশি বাবার ছাঁদ ঘেঁষা! সেই রাত্রেই ট্রেন ধরল বেনারসের, চারদিন পর মুখ কালো করে ফিরে এল৷ গোটা শহর চষে বেড়িয়েও কোনো ঊষারঞ্জন নস্করের সন্ধান পায়নি সে৷ দশাশ্বমেধ ঘাটেও চার-ছ মাসের মধ্যে ওরকম কোনো অসুস্থতা বা মৃত্যুর খবর জানা নেই কারুর৷ ওখানকার কোনো হাসপাতালের না৷ পুলিশের না৷ আশপাশের লোকজনেরও না৷
আমি আর কাগজ-কলম নিয়ে বসতে পারি না৷ বসলেও একটি অক্ষরও আসে না মাথায়৷ ছেলে নাতি-নাতনি আমার এত প্রিয়, তাদেরও আজকাল সহ্য করতে পারি না৷ ঘরে এলে দুর দুর করে বিদেয় করি৷ কাজের লোকেরা আমাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করে৷ তারা কী বলে তাও আমি জানি৷ বলে, বুড়ো পালাতে বুড়ির মাথায় ছিট ধরেছে৷
তা তো ধরেছেই৷ আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাই কালোকুলো নির্বোধ লোকটা মরিয়া হয়ে একটা বাজি অন্তত জিততে চাইছেন৷ শেষ বাজি৷ আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে আগে পালাতে চান দিবানাথ৷
বসুন্ধরা তা হতে দেবে না৷ এ বাজিটাও জিততে হবে৷
বসুন্ধরা কি দিবানাথকে কম ভালোবাসে! ঘৃণা আর ভালোবাসায় কতটুকুই বা ব্যবধান!