বাজারদর

বাজারদর

একশো বছর পর ঘুম ভাঙতেই রামবাবু ভারি অস্বস্তি বোধ করলেন। যে কাচের বাক্সে তিনি শুয়ে আছেন, সেটার ভিতরটা ভীষণ ঠান্ডা। তার ওপর চোখে তিনি সবকিছু ধোঁয়াটে দেখছেন, কান দুটো ভোঁ ভোঁ করছে, হাত—পা খিল—ধরা, মাথাটা খুব ফাঁকা।

কিছুক্ষণ একেবারে ভোম্বলের মতো শুয়ে রইলেন রামবাবু। তারপর আস্তে আস্তে শরীর গরম হল, কানের ভোঁ ভোঁ কমে গেল, হাত—পায়ের খিল ছাড়ল, সবকিছু মনে পড়তে লাগল। মনে পড়তেই তিনি ভীষণ আঁতকে উঠে বসলেন এবং চারদিকে প্যাট প্যাট করে তাকাতে লাগলেন। ১৯৭৯ সালে তাঁকে গভীরভাবে ঘুম পাড়িয়ে একটা ঠান্ডা বাক্সে ভরে মাটির নীচে একটা স্টোর রুমে রেখে দেওয়া হয়েছিল। কথা ছিল ঠিক একশো বছর পর পরবর্তী সমাজের মানুষ তাঁর ঘুম ভাঙাবে।

একশো বছর কী কেটে গেল এর মধ্যেই? চোখের দৃষ্টি কিছু স্বচ্ছ হতেই তিনি দেখলেন, কাচের বাক্সটা একটা টেবিলের ওপর রাখা, টেবিলের চারধারে দাঁড়িয়ে সাদা পোশাক পরা কয়েকজন লোক তাঁকে গম্ভীরভাবে দেখছে।

রামবাবু প্রথমে একটা হাঁচি দিলেন, একটু কাশলেন, একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙলেন। ভারি লজ্জা লজ্জা করছিল তাঁর। স্বাভাবিক নিয়মে এতদিন তাঁর বেঁচে থাকার কথা নয়। হিসেব করলে, এখন তাঁর বয়স ঠিক একশো চল্লিশ বছর। তা ছাড়া এই একশো বছর পরেকার দুনিয়ায় কত কী পালটে গেছে। কেমন লাগবে কে জানে বাবা! তিনি প্রথমেই দেখে নিলেন মানুষগুলোর এই একশো বছরের বিবর্তনে লেজ বা শিং গজিয়েছে কি না। গজায়নি। লোকগুলো খুব লম্বা বা বেঁটে হয়ে যায়নি তো? না। লোকগুলো ভালো, না খারাপ? বোঝা যাচ্ছে না। তবে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা তাঁর জানতে ইচ্ছে করছিল, সেটা হল বাজারদর। এখন চাল কত করে কিলো? আলু কত? মাছ কত? পালং, কপি, কড়াইশুঁটিই বা কীরকম?

রামবাবু একটু হেসে বললেন, ‘খুব একচোট ঘুম হল বাবা। টানা একশো বছর একেবারে।’

লোকগুলো তাঁর কথার জবাব দিল না। ভারি অভদ্র। এখনও খুব খরচোখে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। সকলের মুখেই কাপড়ের ঢাকনা।

রামবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘হাঁ করে দেখছ কী সবাই? গত একশো বছরে আমার পেটে কিছু পড়েনি তা জানো? দাঁতে কুটোটি পর্যন্ত কাটিনি। ছুটে গিয়ে খাবারদাবার নিয়ে এসো। আর শোনো, চায়ের নাম শুনেছ তো? চা? জানো? হ্যাঁ, এক কাপ গরম চা দাও সবার আগে।’

লোকগুলো মৃদু মৃদু হাসছে। রামবাবু ভাবলেন, এরা বোধহয় বাংলা ভাষা বোঝে না। তার আর দোষ কী? একশো বছরে ভাষারও কত পরিবর্তন হয়ে থাকবে। এখনকার বাংলা ভাষা হয়তো চীনে ভাষার মতোই দুর্বোধ্য। তাই তিনি একটু চীনে ভাষার মিশেল দিয়ে বললেন, ‘খাবারচুং জলদিচি লাওং। গরমং চাং দরকারং।’

বলে নিজের ওপর একটু বিরক্তই হলেন রামবাবু। চীনে ভাষা তাঁর কস্মিনকালেও জানা নেই। অজানা ভাষার ভেজাল দিতে গিয়ে বাংলাটা কেমন সংস্কৃতঘেঁষা হয়ে গেল না?

লোকগুলো কিছু বুঝতে পেরেছে বলে মনে হল না। তবে অপারেশন থিয়েটারের মতো নানারকম যন্ত্রপাতিওলা ঘরটায় তারা হরেক কলকাঠি নাড়তে লাগল। রামবাবু হাই তুলে বললেন, ‘আর কতক্ষণ এই প্রায় দেড়শো বছরের বুড়োটাকে তোরা দগ্ধে মারবি বাপ? খাবার না দিস একটা আয়না অন্তত দে। বুড়ো মুখটার কী ছিরি হয়েছে দেখি।’

লোকগুলো এ—কথাটা যেন কী করে বুঝতে পারল। একজন কোত্থেকে ছোট্ট গোল হাত—আয়না বের করে ধরিয়ে দিল তাঁর হাতে। রামবাবু কী দৃশ্য দেখবেন সেই ভয়ে আয়নাটা মুখের সামনে ধরেও কিছুক্ষণ চোখ বুজে রইলেন। চোখ খুলবেন কী খুলবেন না ঠিক করতে—না—করতেই অবাধ্য চোখ দুটো বে—আক্কেলের মতো খুলে গেল। কিন্তু রামবাবু খুশিই হলেন। মুখের চামড়া একটু ঝুলে গেছে ঠিকই, দাড়িও একটু হয়েছে, তবে সব মিলিয়ে তাঁর চেহারায় বয়সের ছাপ তেমন পড়েনি। চল্লিশ বলেই চালানো যায়।

অবশ্য এরকমই কথা ছিল। কাচের বাক্সে যন্ত্রপাতি লাগিয়ে তাঁকে এমনভাবেই রাখা হয়েছিল যাতে তাঁর শরীরে অতি মৃদু হৃৎস্পন্দন হয়, অতি মৃদু গতিতে রক্ত চলাচল করে, অতি মৃদু শ্বাস—প্রশ্বাস চলে এবং শরীরের ক্ষয়ক্ষতি নগণ্য মাত্রায় ঘটে। এই একশো বছর আসলে তিনি ছিলেন মৃত। কাজেই শরীরটার বয়স বাড়েনি।

একটা লোক তাঁর বাঁ হাতটা বাগিয়ে ধরে ইনজেকশন দিচ্ছে। তিনি তাকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন বাজারদরটা কীরকম বলতে পারো হে? আলু কত করে যাচ্ছে?’

লোকটা খুব অবাক হয়ে রামবাবুর দিকে তাকাল। রামবাবু ভাবলেন, লোকটা বোধহয় বাংলা জানে না। ইংরিজিতে বললেন, ‘পট্যাটো?’

লোকটা মাথা নাড়ে। রামবাবু আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘রাইস? ডোন্ট ইউ ইট রাইস?’

লোকটা মাথা নাড়ে। রামবাবু হাল ছেড়ে দেন। ইংরিজিও বিস্তর পালটে গেছে বোধহয়। একটা ভারি অস্বস্তি হচ্ছে মনের মধ্যে। একশো বছর আগে অজ্ঞান হওয়ার সময় তাঁর বন্ধু বৈজ্ঞানিক গয়েশ হালদারের সঙ্গে একটা বাজি ধরেছিলেন। দুশ্চিন্তা সেই বাজিটা নিয়ে।

একশো বছর পর তাঁর ঘুম ভাঙলে লোকেরা তাঁর ওপর বিস্তর এক্সপেরিমেন্ট চালাবে, এরকম কথাই ছিল। লোকগুলো চালাচ্ছিলও তাই। ইনজেকশন দিল, রক্ত নিল, ব্লাডপ্রেশার দেখল, হাঁ করাল, শুইয়ে, বসিয়ে, চিত করিয়ে, উপুড় করে, বিস্তর পরীক্ষা চালাল।

রামবাবু আপনমনে বকবক করতে লাগলেন, ‘চল্লিশের মতো দেখতে বলেই কী আর চল্লিশের খোকা আছি রে বাবা? বয়সটা হিসেব করে দ্যাখ না! তারপর বুঝেসুঝে খোঁচাখুঁচি করিস।’

কিন্তু কে শোনে কার কথা! গোমড়ামুখো লোকগুলো নাগাড়ে তাদের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রামবাবুর নিজের পরিবারের কথা মনে পড়ল। এতক্ষণ পড়েনি কেন সেটাই আশ্চর্যি! একশো বছর আগে অজ্ঞান হওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী বেঁচে ছিলেন, দুটো ছেলে আর চারটে মেয়ে ছিল, মাথার ওপর বুড়ো বাপ—মা, তিন ভাই আর সাত বোনও ছিল। এই একশো বছরে তাদের কারোই আর বেঁচে থাকার কথা নয়।

ভাবতেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন রামবাবু। চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। একটা লোক তাড়াতাড়ি একটা টেস্ট টিউবে সেই চোখের জল ধরে রাখল।

তবে শোকটা খুব বেশিক্ষণ রইল না রামবাবুর। আত্মীয়স্বজনরা এতকাল বেঁচে থাকলে খুনখুনে বুড়োবুড়ি হয়ে যেত সব। সেটাও ভালো দেখাত না। তিনি লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার বউ—বাচ্চচারা এতকাল বেঁচে নেই জানি, কিন্তু নাতিপুতি বা তস্য পুত্রপৌত্রাদি কে আছে জানো? একটু খবর দেবে তাদের?’

একটা কিম্ভূত এক্স—রে মেশিনে তাঁকে ঝাঁঝরা করছিল লোকগুলো। পাত্তাও দিল না। তবে তারা চটপট যন্ত্রপাতি গুটোচ্ছিল। রামবাবুর মনে হল পরীক্ষা আপাতত শেষ হয়েছে। তিনি মটকা মেরে পড়ে রইলেন।

লোকগুলো কোনো সম্ভাষণ না জানিয়েই বেরিয়ে গেল। রামবাবু শুয়ে শুয়ে চোখ পিট পিট করতে লাগলেন। একশো বছরে বাইরের দুনিয়াটার কতটা পরিবর্তন হয়েছে, তা বুঝবার উপায় নেই এখান থেকে। এ ঘরে নিরেট দেয়াল আর যন্ত্রপাতি। একটা পুরু দরজা আছে বটে, কিন্তু তার ওপাশে একটা করিডোর। বাহিরে হয়তো এখন তুষার যুগ চলছে, সূর্য হয়তো নিভু—নিভু হয়ে এসেছে, মানুষ হয়তো এখন বিজ্ঞানের বলে শূন্যে হাঁটে, জিনিসপত্রের দাম হয়তো একশো গুণ করে বেড়েছে। হয়তো…!

রামবাবু শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ ঠ্যাং নাচালেন, তারপর ‘দুত্তোর’ বলে উঠে পড়লেন। ঘুরে ঘুরে ঘরের যন্ত্রপাতিগুলো দেখতে লাগলেন। এক সময়ে তিনি নামকরা বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তবু এই একশো বছর পরেকার আধুনিক যন্ত্রপাতিগুলোর কলাকৌশল তিনি ভালো বুঝতেই পারলেন না। একটা বোতাম টিপতেই ঝড়ের মতো শোঁ শোঁ শব্দ ওঠায় তাড়াতাড়ি সরে এলেন সেখান থেকে এবং গিয়ে দরজার হাতল ধরে টানাটানি করতে লাগলেন। ভাগ্য ভালো, দরজাটা হড়াক করে খুলে গেল।

কিন্তু করিডোরে পা রেখেই আঁতকে উঠলেন রামবাবু। করিডোরের মেঝেটা ঠিক নদীর ধীর স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। তবে চলন্ত ফুটপাথ, এসক্যালেটার বা কনভেয়ার বেল্ট রামবাবুর আমলেও ছিল, তাই খুব বেশি অবাক হলেন না। মাথাটা ঘুরছিল বলে তিনি চলন্ত করিডোরে বসে রইলেন। খানিকটা ওপরে উঠে এবং অনেকটা নীচে নেমে, খানিক ডাইনে গিয়ে এবং ফের কিছুটা বাঁয়ে মোড় নিয়ে করিডোর চলতে লাগল। একটু বাদে আর একটা দরজা পেলেন। করিডোর থেকে লাফ দিয়ে নেমে দরজাটা টানলেন রামবাবু। দরজাটা খুলেও গেল।

বাইরে বেরিয়ে এসে রামবাবু একটা গভীর শ্বাস ছাড়লেন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন, যা ভেবেছিলেন তাই। না, তুষার যুগ আসেনি বা সূর্যও নিভু নিভু হয়নি। বরং একটার বদলে আকাশের চারধারে চারটে এবং মাঝখানে একটা, মোট পাঁচটা সূর্য জ্বলজ্বল করছে। আবহাওয়া খুবই মনোরম। না গরম, না ঠান্ডা। চারদিকে একশো দুশো তলা বাড়ি একেবারে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে। আকাশেও তিনি বিস্তর বাড়িঘর ভেসে বেড়াতে দেখলেন। তারই ফাঁকে ফাঁকে শোঁ করে নানান সাইজের রকেট উড়ে যাচ্ছে, পিরিচের মতো দেখতে কিছু জিনিসকেও উড়ে যেতে দেখলেন তিনি, আরও দেখলেন রকেট—লাগানো চেয়ারের মতো দেখতে ছোটো ছোটো আকাশ—গাড়িতে মানুষ চলাফেরা করছে।

সামনের চলমান ফুটপাথে উঠে পড়লেন রামবাবু। আশেপাশে আরও সব লোকজন রয়েছে। তারা হাঁ করে দেখছে তাঁকে। দেখবেই। তাঁর পরনে সেই একশো বছর আগেকার ধুতি আর পাঞ্জাবি। এদের পরনে শুধু জাঙ্গিয়ার মতো খাটো একটু জিনিস, গা আদুড়।

রামবাবুর পাশেই একটা বুড়ো লোক। তার বয়স সত্তর বছর হবে। তা হোক, সত্তর হলেও এ লোকটা রামবাবুর চেয়ে না হোক সত্তর বছরের ছোটো। তাই আপনি বলবেন না তুমি বলবেন, তা ঠিক করতে না পেরে রামবাবু বারকয়েক গলাখাঁকারি দিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন ক—টা বাজে?’

বুড়ো লোকটা একটু অবাক হয়ে তাকাল বটে, তবে একটু খোনাসুরে বলল, ‘রাত ন—টা বেজে ছত্রিশ মিনিট তেরো সেকেন্ড।’

রামবাবু নিজে বৈজ্ঞানিক। কাজেই অবাক হলেন না। এতক্ষণে বরং বুঝলেন, আকাশে পাঁচটা সূর্য নয়, ওগুলো কোনোরকমের কৃত্রিম আলো যার ফলে চারদিকটা দিনের মতো দেখাচ্ছে। সম্ভবত ওগুলো পৃথিবীর অন্য পাশের সূর্যের আলো থেকে এপাশে আলো প্রতিফলিত করছে। এ ধরনের একটা আইডিয়া একশো বছর আগে তাঁর মাথাতেও এসেছিল।

রামবাবু ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ তারিখটা কত বলবে বাবা?’

লোকটা অবাক চোখে ফের তাকিয়ে বলল, ‘জানুয়ারি, বিশ শো উনআশি।’

রামবাবু তা জানেন। তবু লোকটার সঙ্গে একটু খেজুরে আলাপ করছেন। তাঁর আসল উদ্দেশ্য অন্য। একশো বছর পর পৃথিবীতে কীরকম পরিবর্তন হবে না—হবে, মানুষ কতটা এগোবে না—এগোবে, তা তাঁর মোটামুটি আন্দাজ ছিল। সুতরাং তিনি চারদিকের পরিবর্তন দেখে খুব অবাক হননি। কিন্তু গয়েশের সঙ্গে একটা বাজি ছিল। সেইটে বড়ো খোঁচাচ্ছে।

রামবাবু বললেন, ‘আচ্ছা সুকিয়া স্ট্রিটটা কোনদিকে বলতে পারো বাবা?”

লোকটা বলে, ”সুকিয়া স্ট্রিট? সুকিয়া স্ট্রিট বলে কিছু শুনিনি তো!’

‘নর্থ ক্যালকাটায়!’

লোকটা হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, ‘ক্যালকাটা? ওঃ ক্যালকাটা নামে একটা গ্রাম আছে বটে। সে তো অনেক উত্তর দিকে।’

‘এ শহরটার নাম কী বাবা?’

‘এ হল গোসাবা, সুন্দরবন!’

‘বটে! গোসাবার এত উন্নতি?’ বলে রামবাবু চোখ কপালে তোলেন।

লোকটা হঠাৎ রামবাবুর একটা হাত খপ করে ধরে বলল, ‘আচ্ছা, আপনি কী রামবাবু? একশো বছর আগে যাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল?’

রামবাবু খুব জোরে মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি সে—ই। কী করে বুঝলে বাবা?’

‘বুঝব না? আপনার ঘুমন্ত মুখের ছবি যে প্রায়ই টেলিভিশনে দেখানো হয়। খবরের কাগজেও বেরোয়।’

‘তাই বুঝি?’ বলে খুব হাসলেন রামবাবু। বললেন, ‘তা কলকাতার কী হল বলতে পারো বাবা?’

‘সে তো আরও সত্তর—আশি বছর আগেই মশা, লোডশেডিং আর জলের অভাবে হেজে গিয়েছিল। শহরে জঙ্গল গজিয়ে যায়। তারপর এখন অবশ্য কলকাতা আবার বর্ধিষ্ণু গ্রাম হয়ে উঠছে। ভালো চাষবাস হচ্ছে। চৌরঙ্গির আলু খুব বিখ্যাত, বাগবাজারের কুমড়ো পৃথিবীর সেরা, খিদিরপুরে মোচার সাইজের পটল জন্মায়। তা ছাড়া কলকাতায় এখন ‘মশা বাঁচাও’ আন্দোলনের একটা হেড কোয়ার্টার হয়েছে।’

‘বটে? সে আবার কী? মশা বাঁচাবে কেন বাবা?’

‘মশা মেরে মেরে মানুষ তো মশার প্রজাতিই ধ্বংস করে দিয়েছিল কিনা। যেমন এক সময় আপনারা বাঘ—সিংহ মেরে মেরে সব প্রায় নিকেশ করেছিলেন। পরে আপনারা যেমন ‘ব্যাঘ্র প্রকল্প’ করে বাঘ বাঁচাতে চেয়েছিলেন, এখন ঠিক সেইভাবেই মশা জিয়োনোর চেষ্টা চলছে।’

রামবাবু এবার আসল কথাটায় এলেন। খুব সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা বাবা, একটা কথা বলবে? খুব সাবধানে বোলো। তেমন শকিং কিছু শুনলে আমার বুড়ো হার্ট থেমে যেতে পারে। এখনকার বাজারদরটা কীরকম বলতে পারো?’

‘বাজারদর?’ লোকটা একটু অবাক হয়, হেসেও ফেলে। বলে, ‘খুব চড়া।’

‘খুব?’ বলে রামবাবু বড়ো বড়ো চোখে তাকান। গয়েশের সঙ্গে এই নিয়েই বাজি। গয়েশ বলেছিল, একশো বছর পর বাজারদর হবে একশো গুণ, রামবাবু বলেছিলেন, কক্ষনো না। দশগুণ বড়োজোর হতে পারে। রামবাবুর বুকটা তাই ঢিবঢিব করছিল। বললেন, ‘তবু বলো বাবা, শুনে রাখি। আচ্ছা, আগে বলো চাল কত করে।’

‘চাল?’ লোকটা হাসিমুখেই বলে, ‘চাল যাচ্ছে তিনশো টাকা।’

রামবাবু শকটা সামলাতে পারলেন না। চোখ উলটে ফেললেন, হাত—পা কাঠ হয়ে গেল, ভিরমি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময়ে লোকটা বলল, ‘কিলো নয়, কিলো নয়। কুইন্টাল।’

রামবাবু আবার সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে একটা শ্বাস ছাড়লেন। আর যা হোক তা হোক, বাজারদরটা ঠিক আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *