1 of 2

‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!

‘বাজলে বাঁশি কাছে আসি’!

তোমরা কোনারকের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। কোনারক হচ্ছে একটি জায়গার নাম। পুরী থেকে প্রায় আঠেরো মাইল দূরে। সেখানে খুব পুরোনো একটি ভাঙাচোরা সূর্যমন্দির আছে। মন্দিরের বেশিরভাগ এখন ভেঙে পড়েছে বটে, কিন্তু যেটুকু এখনও দেখতে পাওয়া যায়, তা এত সুন্দর যে, পৃথিবী সব দেশ থেকে দর্শকের দল আসে সেখানে মহা আগ্রহে।

কোনারক ও পুরীধামের মাঝখানকার আঠারো মাইল জায়গাটাকে মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এই মরুভূমির একদিকে দাঁড়িয়ে আছে জগন্নাথের মন্দির, একদিকে আছে কোনারকের সূর্যমন্দির, একদিকে দেখা যায় অনন্ত সমুদ্র এবং আর একদিকে আকাশের সীমারেখা পর্যন্ত চলে গেছে অনন্ত বালির প্রান্তর। এই বালুকার রাজ্যে ছোটোখাটো একটি বনজঙ্গলের শ্যামলতা পাওয়া যায় কেবল কোনারকের ভাঙা দেউলের আশেপাশে।

এই বনজঙ্গলের মধ্যেই একটি সরকারি ডাকবাংলো আছে। আমি যখন সেই বাংলোয় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলুম, তখন সেখানে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর নির্জন আশ্রম দেখেছিলুম। বাংলোর ভেতরে দু-খানি শোওয়ার ঘর— তার একখানিতে ছিলুম আমি এবং আর একখানি দখল করেছিলেন আর একজন অপরিচিত ভদ্রলোক। পরে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাঁর নাম পূর্ণবাবু, কলকাতার কোনো কলেজের অধ্যাপক। এখানে এসেছেন কোনারকের মন্দির দেখবার জন্যে।

কোনারকের মন্দির থেকে খানিক তফাতে এগিয়ে গেলে পাওয়া যায় চন্দ্রভাগা নদী। একদিন সন্ধ্যার কিছু আগে এই নদীর ধারে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ আমার পায়ে কীসের ঠোক্কর লাগল। হেঁট হয়ে চেয়ে দেখি, বালির ভেতর থেকে কী-একটা জিনিসের আধখানা বাইরে বেরিয়ে রয়েছে। খানিক টানাটানি করতেই জিনিসটার সবখানাই বেরিয়ে পড়ল। ভালো করে পরীক্ষা করে বুঝলুম সেটা হচ্ছে অদ্ভুত আকারের এক বাঁশি। অন্যমনস্কভাবে সেটাকে হাতে নিয়ে আমি আবার বাংলোর দিকে ফিরলুম।

যখন বাংলোর খুব কাছে এসে পড়েছি, তখন কেন জানি না আমার মনে হল, একবার পিছন পানে ফিরে তাকানো উচিত। সঙ্গে-সঙ্গে ফিরে দাঁড়িয়েই দেখি, নদীর ধার থেকে একটা মানুষের মূর্তি হনহন করে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। তার যেন খুব তাড়া অথচ সে কিছুতেই তাড়াতাড়ি আসতে পারছে না— অন্তত তার ভাবভঙ্গি দেখে আমার এইরকমই মনে হল। সে যেন আসছে, আসছে, আসছেই। সে আসছে অথচ আসতে পারছে না। সন্ধ্যার আসন্ন অন্ধকারে মূর্তিটাকে স্পষ্টভাবে দেখা যায় না; অথচ তাকে ভালো করে দেখবার জন্যে মনের ভেতরে একটা অকারণ কৌতূহল জেগে ওঠে।

বাংলোর ঘরের ভেতর বসে বাতির আলোতে বাঁশিটাকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলুম। বাঁশিটা মোটেই একালের নয়। তামার বাঁশি এবং বয়সে এ হয়তো কোনারকের মন্দিরেরই মতন সুপ্রাচীন। তার গায়ে কতকগুলো যেন অক্ষর খোদা রয়েছে, কিন্তু সেগুলো যে কোন ভাষার অক্ষর, কিছুই বোঝা গেল না।

এই সেকেলে বাঁশিটা এখনও বাজে কিনা দেখবার জন্যে তার রন্ধ্রে একবার ফুঁ দিলুম। আমার সেই সামান্য ফুঁয়েই বাঁশিটা হঠাৎ আশ্চর্য তীক্ষ্ন ও তীব্র স্বরে বেজে উঠল। বাঁশি যে অত জোরে বাজতে পারে এটা ছিল আমার কল্পনার অতীত। অত্যন্ত চমকে উঠে বাঁশিটা টেবিলের ওপরে রেখে দিলুম এবং সঙ্গে-সঙ্গে শুনলুম, একটা এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়া বাইরে থেকে ঘরের ভেতরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাতিটা গেল নিবে। জানলা বন্ধ করে আমি আবার বাতিটা জ্বাললুম। এবং তার পরেই শুনলুম, ঘরের দরজায় কে করাঘাত করছে। আস্তে আস্তে উঠে দরজা খুলে দিলুম। আর একটা ঝোড়ো-হাওয়ার দমকা এসে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু দরজা খুলে কারুকেই দেখতে পেলুম না। ভাবলুম, আমারই মনের ভ্রম, দরজায় শব্দ হয়েছে হাওয়ার জন্যেই।

সে রাত্রে হাওয়ার জোর ক্রমেই বেড়ে উঠতে লাগল। দরজা-জানলায় ক্রমাগত ঠেলা মেরে পাগলা হাওয়া কেবলই যেন ঘরের ভেতরে আসতে চায়। তার আওয়াজ শুনে আমার মনে হল কোনারকের প্রাচীন ভগ্নমন্দিরের আত্মা যেন করুণ আর্তনাদ করছে! যেন দেউলের সমস্ত পাথরের মূর্তি হঠাৎ আজ জ্যান্ত হয়ে কাতর কান্না শুরু করে দিয়েছে! অসংখ্য যক্ষ রক্ষ কিন্নর ও নাগকন্যার দল যেন এই বাংলোর চারদিক ঘিরে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে! দরজায় করাঘাত করছে তারাই!

এরকম সবকথা মনে হওয়া মনের খুব ভালো অবস্থার লক্ষণ নয়। মন থেকে এইসব দুশ্চিন্তা তাড়িয়ে এখন ঘুমোবার চেষ্টা করাই উচিত।

চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লুম। খানিক পরেই চোখে একটু তন্দ্রার আমেজ এল। কিন্তু ঘুম আসবার আগেই আমার কেমন সন্দেহ হল যে, বিছানায় আমি আর একলা নই; আমার পাশেই যেন আর একজন কেউ শুয়ে আছে। টেবিলের ওপরে বাতিটা তখনও জ্বলছিল। সেই আলোতে আড়ষ্টভাবে পাশ ফিরে দেখলুম, বিছানায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। নিজের মিথ্যা ভয়ে নিজেই মনে মনে হেসে আমি আবার চোখ মুদে ফেললুম। কিন্তু তখনি আবার মনে হল আমার পাশে আর একজন কে এসে শুয়ে পড়েছে। কিন্তু এবারে এই অলীক কল্পনা নিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে আমি নিদ্রাদেবীর আরাধনায় নিযুক্ত হলুম।

সকাল বেলায় বেড়াতে বেরিয়েছি, পূর্ণবাবুর সঙ্গে দেখা। তিনি কীরকম এক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আপনি আমাকে কিছু বলতে চান?’

পূর্ণবাবু বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। কাল সারারাত কি আপনার ভালো ঘুম হয়নি?’

‘কেন বলুন দেখি?’

‘কাল সারারাত আপনার ঘরের ভেতর থেকে নানারকম শব্দ এসেছে। কে যেন চেয়ার-টেবিল সরাচ্ছে, ঘরময় লাফালাফি আর ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, দুমদাম করে জানলা-দরজা খুলছে আর বন্ধ করছে— এইসব গোলমালে আমিও কাল রাতে ঘুমোতে পারিনি!’

আমি বললুম, ‘এ তো ভারি আশ্চর্য কথা! কাল সারারাত আমার তো ঘুমের কোনো ব্যাঘাতই হয়নি!’

পূর্ণবাবু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘তাহলে আমারই বোধ হয় শুনতে ভুল হয়েছে। শব্দগুলো অন্য কোনো জায়গা থেকে এসেছে!’

এমনি সব কথা কইতে কইতে ফিরে এসে আমরা বাংলোর বারান্দার ওপরে উঠেছি, এমন সময়ে আমার ঘরের ভেতর থেকে হাঁউমাঁউ করে চ্যাঁচাতে-চ্যাঁচাতে একটা বালক ছুটে বেরিয়ে এল। বাংলোর রক্ষকের ছেলে।

ভয়ে সে ঠকঠক করে কাঁপছে দেখে আমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কীরে, কী হয়েছে?’

‘ও-ঘরের খাটে কে বসে আছে!’

দৌড়ে ঘরের ভেতরে গিয়ে হাজির হলুম। খাটের ওপরে কেউ নেই। কেবল বিছানার চাদরখানা এলোমেলো হয়ে গুটিয়ে-পাকিয়ে ঘরের মেঝেয় পড়ে রয়েছে।

বালক বললে, ‘না, সে ওই খাটেই বসেছিল। ঠিক যেন একটা সাদা কাপড়ে তৈরি মূর্তি! আমাকে দেখেই সে খাট থেকে নেমে এল!’

পূর্ণবাবু বললেন, ‘বোধ হয় এখানকার কোনো লোক চাদর মুড়ি দিয়ে ছেলেটাকে ভয় দেখিয়ে আবার পালিয়ে গেছে!’

আমারও মন বলল, তাই-ই হবে।

সেদিন সন্ধ্যার পর টেবিলের ধারে বসে বই পড়ছিলুম।

হঠাৎ চোখ পড়ল সেই তামার বাঁশিটার দিকে। এই ছোট্ট বাঁশিটা কাল কীরকম জোরে অস্বাভাবিক স্বরে বেজে উঠেছিল, সেই কথা মনে পড়ল। এমন অদ্ভুত গড়নের বাঁশিও কখনো দেখিনি, এমন তীব্র আওয়াজও কখনো শুনিনি।

বাঁশিটাকে আবার তুলে নিয়ে বাজাবার চেষ্টা করলুম। একটিমাত্র ফু দিতেই বাঁশিটা এমন বিকট স্বরে বেজে উঠল যে আমার কান যেন ফেটে গেল।

পরমুহূর্তেই বাইরে থেকে একটা বিষম ঝোড়ো হাওয়া হুহু করে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে আলোটাকে দিলে নিবিয়ে। ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ করে আলোটা আবার জ্বেলে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম, বাইরে কোনো দুর্যোগ নেই, তবু আচমকা এমন ঝোড়ো হাওয়া জাগে কেন? কালও এই ব্যাপার হয়েছিল, আজও তাই!

খাটের দিকে চোখ গেল। বিছানার চাদরখানা আপনা-আপনি তাল পাকিয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে! এও কি সম্ভব? নিজের চোখকে বিশ্বাস হল না।

চোখদুটো দু-হাতে রগড়ে ভালো করে আবার তাকিয়ে দেখি, খাটের ওপরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক কিম্ভূতকিমাকার মূর্তি! ধবধবে কাপড়ের মতো সাদা তার দেহ! তার হাত আছে, পা আছে, মাথা আছে, কিন্তু চোখ-নাক-ঠোঁট দেখা যায় না!

কী ভয়ানক! মূর্তিটা উঠে দাঁড়াল, দু-দিকে দু-হাত বাড়িয়ে বাধো-বাধো পায়ে যেন কী ধরবার চেষ্টা করতে লাগল। তার ভাবভঙ্গি অন্ধের মতো!

কিন্তু সে কাকে খুঁজছে আমাকে? একথা মনে হতেই দারুণ আতঙ্কে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালুম। সেই শব্দ পেয়েই অন্ধ মূর্তিটা বেগে আমার দিকে আসতে লাগল!

আমি একলাফে দরজার কাছে এসে পড়লুম। পাগলের মতো দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ে চ্যাঁচাতে লাগলুম, ‘রক্ষা করো! রক্ষা করো!’

চারদিক থেকে দ্রুত পায়ের শব্দ পেলুম। পূর্ণবাবুর গলায় শুনলুম, ‘ব্যাপার কী মশাই, ব্যাপার কী?’

দু-হাতে চোখ চেপে মাটির ওপরে বসে পড়ে আকুল স্বরে বললুম, ‘ঘরের ভেতরে সেই সাদা কাপড়ের মূর্তিটা!’

সকলে ঘরের ভেতরে গেল। পূর্ণবাবু উচ্চস্বরে বললেন, ‘কই, কেউ তো এখানে নেই!’

হতভম্বের মতো ঘরে ঢুকে দেখলুম, মূর্তি অদৃশ্য হয়েছে! মেঝের ওপরে দরজার কাছে বিছানার চাদরখানা গড়াগড়ি দিচ্ছে!

এমন সময়ে কোনারকের মাঠের সেই তান্ত্রিক সন্ন্যাসী ঘরের ভেতরে ঢুকে বললেন, ‘কী হয়েছে, এখানে এত গোলমাল কেন?’— বলতে বলতে তাঁর চোখ হঠাৎ টেবিলের ওপরে পড়ে খানিকক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর তিনি এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে তামার বাঁশিটা তুলে নিয়ে সেটা গম্ভীরভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘এটা এখানে কেমন করে এল?’

আমি বললুম, ‘ওটা চন্দ্রভাগা নদীর তীরে কুড়িয়ে পেয়েছি।’

সন্ন্যাসী ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘এ বাঁশিটাকে আমি সমুদ্রে বিসর্জন দিতে চললুম। এ হচ্ছে জাদুকরের অভিশপ্ত বাঁশি, এ অমঙ্গলকে ডেকে আনে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *