বাছুর
তোমাদের জীবন কেমন হবে আমি জানি। উনবিংশতে বসে আমি বিংশকে ধারণা করতে পেরেছিলাম। তোমরা ইংরেজী শিখে সেরেস্তার কেরানি হবে। হ্যাট, ম্যাট, গ্যাট। ইংরেজীর অহঙ্কার। তোমাদের বলা হবে—’লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।’ ছেলেবেলা থেকে বিদ্যার সঙ্গে অর্থকে পাক করে যে-সন্দেশ, যে-বার্তা তৈরি হয়ে আসে তোমাদের কানে তা হলো—অর্থ উপার্জনের শিক্ষাই শিক্ষা। কেউ বলবে না, তুমি জ্ঞানী হও। তোমার চৈতন্য হোক। জ্ঞান, বিজ্ঞানের শাখা ধরে, বিচারের আলোতে পথ চিনে চিনে আত্মতত্ত্বের সিংহদুয়ারে হাজির হও! আমার নরেন যেমন বলছে তোমাদের— “বুদ্ধিরূপ জলদ্বারা বেষ্টিত এই ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আমাদের বিচারশক্তি কার্য করে—তাহার বাহিরে যাইতে পারে না। সুতরাং ইহার বাহিরে যাইবার জন্য আমাদের অপর কোন উপায়ের প্রয়োজন—প্রজ্ঞা বা অতীন্দ্রিয়বোধ। অতএব সহজাত জ্ঞান, বিচারশক্তি ও অতীন্দ্রিয়বোধ—এই তিনটি জ্ঞানলাভের উপায়।”
প্রজ্ঞাই বড় কথা। সে-পথে সহসা কেউ যাবে না। সেখানে বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, উপাধি নেই, জীবিকার ঘোড়ার লাগাম নেই। নরেন বলেছিল : “নিম্নশ্রেণীর জ্ঞানোপায়কে উচ্চশ্রেণীর উপায় বলিয়া ভুলকরা-রূপ ভয়ানক বিপদের সম্ভাবনা রহিয়াছে।” বিংশের শেষে সেই বিপদই বড় বিপদ হয়ে উঠেছে। বিষয়ের উপাসনাই একমাত্র কথা। ভজ গৌরাঙ্গ নয়, ভজ অর্থভাণ্ড। আমার সেই গল্পটা স্মরণ কর—
একটি স্যাকরার দোকান ছিল। বড় ভক্ত, পরম বৈষ্ণব-গলায় মালা, কপালে তিলক, হাতে হরিনামের মালা। সকলে বিশ্বাস করে ঐ দোকানেই আসে, ভাবে এরা পরমভক্ত, কখনো ঠকাতে যাবে না। একদল খদ্দের এলে দেখত কোন কারিগর বলছে, ‘কেশব!’ ‘কেশব!’ আরেক জন কারিগর খানিক পরে নাম করছে, ‘গোপাল!’ ‘গোপাল!’ আবার খানিকক্ষণ পরে একজন কারিগর বলছে, ‘হরি!’ ‘হরি!’ তারপর কেউ বলছে, ‘হর!’ ‘হর!’ কাজে কাজেই এত ভগবানের নাম দেখে খরিদ্দারেরা সহজেই মনে করত, ‘এ- স্যাকরা অতি উত্তম লোক। কিন্তু ব্যাপারটা কি জান? যে বললে, ‘কেশব!” ‘কেশব!’ তার মনের ভাব, এসব (খদ্দের) কে? যে বললে, ‘গোপাল!’ ‘গোপাল!’ তার অর্থ এই যে, আমি এদের চেয়ে চেয়ে দেখলুম, এরা গরুর পাল। যে বললে, ‘হরি হরি’ তার অর্থ এই যে, আমি তাহলে হরণ করি, নির্বোধ গরুর পাল যখন! যে বললে, ‘হর হর!’ তার মানে এই—তবে হরণ কর, হরণ কর; এরা তো গরুর পাল!
অতএব বুঝতেই পারছ, কি সেকাল, কি একাল, পরমার্থের চেয়ে অর্থকেই মানুষ বড় করে দেখেছে। সব কালের সব মানুষই একরকম। এক স্বভাব। কেমন স্বভাব! শিশ্নোদরপরায়ণ। কাম-কাঞ্চনে আসক্ত। ঈর্ষাপরায়ণ। পরশ্রীকাতর। কৃপণ, কোপন। অলস। উদ্যোগহীন। স্বভাবে মিথ্যাবাদী। এটা তো কলিকাল। “জীবের অন্নগত প্রাণ, আয়ু কম, দেহবুদ্ধি, বিষয়বুদ্ধি একেবারে যায় না।”
একটা কথা জেনে রাখ—”দেহবুদ্ধি থাকলেই বিষয়বুদ্ধি। রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ—এইসকল বিষয়। বিষয়বুদ্ধি যাওয়া বড় কঠিন।” একেবারে সত্য কথাটি জেনে রাখ—”আমি দেহ নই, আমি মন নই, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নই।” চতুর্বিংশতি তত্ত্ব কাকে বলে জান? ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ব্যোম; রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক; হস্ত, পদ, মুখ, পায়ু, লিঙ্গ; প্রকৃতি, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার। “আমি চতুর্বিংশতি তত্ত্ব নই, আমি সুখ-দুঃখের অতীত, আমার আবার রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু কই—এসব বোধ কলিতে হওয়া কঠিন। যতই বিচার কর, কোনখান থেকে দেহাত্মবুদ্ধি এসে দেখা দেয়। অশ্বত্থ গাছ এই কেটে দাও, মনে করলে মূলসুদ্ধ উঠে গেল, কিন্তু তার পরদিন সকালে দেখ, গাছের একটি ফেঁকড়ি দেখা দিয়েছে। দেহাভিমান যায় না।”
কলির মানুষ তুমি। তোমার শিক্ষাপদ্ধতি কখনো তোমাকে শেখায়নি, তত্ত্বমসি। জীবিকার জন্য যা শেখার শেখ; কিন্তু তারপর জ্ঞান ধরে বিজ্ঞানে পৌঁছবার চেষ্টা কর। আমার নরেন বলত: “তোমার নিজের আত্মা ব্যতীত তোমার অপর কোন শিক্ষাদাতা নেই।” সেই জায়গাটায় পৌঁছবার চেষ্টা কর। নরেন বলছে : “প্রত্যক্ষানুভূতিই যথার্থ জ্ঞান বা যথার্থ ধর্ম।” নরেন একেবারে সঠিক কথাটি বলেছে : “জগতে দুঃখবিরহিত সুখ, অশুভবিরহিত শুভ— কখনো পাবার সম্ভাবনা নেই। কারণ, জীবনের অর্থই হচ্ছে বিনষ্ট সাম্যভাব। আমাদের চাই মুক্তি; জীবন সুখ বা শুভ—এসবের কোনটাই নয়। সৃষ্টিপ্রবাহ অনন্তকাল ধরে চলেছে—তার আদিও নেই, অন্তও নেই, যেন একটা অগাধ হ্রদের উপরকার সদা-গতিশীল তরঙ্গ। ঐ হ্রদের এমন সব গভীর স্থান আছে, যেখানে আমরা এখনো পৌঁছাতে পারিনি; আর কতকগুলো জায়গা আছে, যেখানে সাম্যভাব পুনঃস্থাপিত হয়েছে—কিন্তু ওপরের তরঙ্গ সর্বদাই চলেছে, সেখানে অনন্তকাল ধরে ঐ সাম্যাবস্থা লাভের চেষ্টা চলেছে। জীবন ও মৃত্যু একটা ব্যাপারেরই বিভিন্ন নামমাত্র, একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। উভয়ই মায়া— এ-অবস্থাটা পরিষ্কার করে বোঝাবার জো নেই; একসময় বাঁচবার চেষ্টা হচ্ছে, আবার পরমুহূর্তে বিনাশ বা মৃত্যুর চেষ্টা। আমাদের যথার্থ স্বরূপ আত্মা এ- দুয়েরই পারে। আমরা যখন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করি, তা আর কিছু নয়, তা প্রকৃতপক্ষে সেই আত্মাই—যা থেকে আমরা নিজেদের পৃথক করে ফেলেছি, আর আমাদের থেকে পৃথক বলে উপাসনা করছি! কিন্তু সেই উপাস্য চিরকালই আমাদের প্রকৃত আত্মা—এক ও একমাত্র ঈশ্বর, যিনি পরমাত্মা।” নরেন তো আমার কথাই বললে : “প্রথমে তমঃকে ব্যর্থ করতে হবে রজঃ দ্বারা, পরে রজঃকে জয় করতে হবে সত্ত্ব দ্বারা। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে, দুটোকেই ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।” নরেনের কাছে শুনে নাও, ধর্ম কি, ঈশ্বর কি। সে বলছে : “ধর্ম ও ঈশ্বর বলতে অনন্ত শক্তি, অনন্ত বীর্য বুঝায়।”
রামকে আমি বলেছিলাম—রামকে উদ্দেশ করে সব গৃহীকেই বলা— “এ-ও কর, ও-ও কর। সংসারও কর, ঈশ্বরকেও ডাক। সব ত্যাগ করতে বলি না। কেশব সেন একদিন লেকচার দিলে, বললে, ‘হে ঈশ্বর, এই কর, যেন আমরা ভক্তিনদীতে ডুব দিতে পারি, আর ডুব দিয়ে যেন সচ্চিদানন্দ সাগরে পড়ি।’ মেয়েরা সব চিকের ভিতরে ছিল। আমি কেশবকে বললাম, ‘একেবারে সবাই ডুব দিলে কি হবে! তাহলে এদের (মেয়েদের) দশা কি হবে? এক-একবার আড়ায় উঠো, আবার ডুব দিও আবার উঠো!’
শতাব্দীর ওপারে বসে এপারে তোমাদের শেষ বিংশের জীবনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, শশধরকে বলেছিলাম, “হাজার লেকচার দাও, বিষয়ী লোকদের কিছু করতে পারবে না। পাথরের দেয়ালে কি পেরেক মারা যায়! তরোয়ালের চোট লাগলে কুমিরের কি হবে? সাধুর কমণ্ডলু চার ধাম করে আসে কিন্তু যেমন তেঁতো তেমনি তেঁতো।”
তবে আশার কথা এই—
“বাছুর একবারে দাঁড়াতে পারে না। মাঝে মাঝে পড়ে যায়, আবার দাঁড়ায়; তবে তো দাঁড়াতে ও চলতে শেখে।”