…বাচ্চা
বোধহয় পৃথিবীর সব ভাষাতেই গালাগালের একটা অঙ্গ হল প্রতিপক্ষকে কোনও জন্তুর সন্তান বলে সম্বোধন বা অভিহিত করা। বাংলা ও হিন্দি ভাষায় শুয়োরের বাচ্চা কথাটি একটি অত্যন্ত চালু অশালীন গাল। কুত্তার বাচ্চাও চলে।
অবশ্য পিগ অথবা সন অফ এ বিচ (কুত্তির বাচ্চা) রূপে এ দুটি গালাগালে ইংরেজ এবং মার্কিনিরাও বেশ রপ্ত।
এই কুত্তির বাচ্চা বা সন অফ এ বিচ গালটি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মহামতি রোনালড রিগান সম্প্রতি কিঞ্চিৎ বিপাকে পড়েছেন।
সেই বিপাকের প্রশ্নে যাওয়ার আগে এই বাচ্চাজড়িত গালের ব্যাপারটা একটু ছুঁয়ে যাই। কাউকে যদি বাঘের বাচ্চা বা সিংহের বাচ্চা বলা হয় সেটা হবে প্রশংসাব্যঞ্জক। যাকে বা যার উদ্দেশে বলা হবে সে হয়তো খুশিই হবে।
অন্যদিকে কুকুর মানুষের এত উপকারী এবং প্রিয় জন্তু অথচ কোনও কুকুর প্রেমিককেও যদি কুকুরের বাচ্চা বলে অভিহিত করা যায়, সে হয় মারবে না হলে মানহানির মামলা করবে। এদিকে কেউ যদি কাউকে বেড়ালের বাচ্চা বলে সে তাতে খুশি হবে না হয়তো কিন্তু রাগও হয়তো করবে না।
রিগান সাহেবের ব্যাপারে আসি।
পৃথিবীর যে কোনও রাষ্ট্রের কর্ণধারের মতোই মার্কিন প্রেসিডেন্ট খবরের কাগজের লোকদের বিশেষ পছন্দ করেন না। খবরের কাগজের লোকেরা উলটোপালটা প্রশ্ন করে, যা নয় তাই জানতে চায়, বড় বেশি কৌতূহল তাদের। একজন ক্ষমতাবানের পক্ষে এসব সহ্য করা কঠিন।
ফিলিপাইন সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হঠাৎ রিগান সাহেব দাঁত চেপে কোনও একজন সাংবাদিকের উদ্দেশে উচ্চারণ করেন, ‘সন অফ এ বিচ।’
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলি, যথা রয়টার, এ পি, ইউ পি আই ইত্যাদি তাদের বাঘা বাঘা ব্যক্তিদের পাঠিয়েছিল এইদিন প্রেসিডেন্টের কাছে হোয়াইট হাউসে। সূক্ষ্ম ইলেকট্রনিক যন্ত্রে রিগানের এই উক্তি ধরা পড়েছে।
বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি বড় অসুখে ভুগে উঠেছেন তদুপরি তিক্ত প্রশ্ন, তাঁর পক্ষে ‘কুত্তির বাচ্চা’ উক্তি করা খুব অসম্ভব নয়। কিন্তু প্রেসিডেন্টের প্রবক্তা ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে রিগান সাহেব আদৌ ও রকম কিছু বলেননি, তিনি যা বলেছেন তা হল, ‘He’s sunny and you are rich,’ ওই কথাটা ধ্বনি সমতার জন্য ‘সন অফ এ বিচ’ শুনিয়েছে।
বলা বাহুল্য এই ব্যাখ্যাটি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এই সূত্রে অনেকদিন আগের একটা গল্প মনে পড়ছে। আমার এক বন্ধু আমাকে গল্পটি বলেছিলেন।
বন্ধুটি তাঁর ছোট কন্যাকে মাত্র কয়েকদিন আগে একটি ইংরেজি মাধ্যম নার্সারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ‘এক ছুটির দিনে’ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বন্ধুটি দেখেন তাঁর মেয়ে ইস্কুলের খাতা খুলে ক্লাসের পড়া করছে একমনে। হঠাৎ তাঁর কানে গেল ‘সন অফ এ বিচ’ শব্দটি। বারবার ওই কুৎসিত শব্দটি উচ্চারণ করছে তাঁর নিস্পাপ বালিকা কন্যাটি।
ভদ্রলোক মনোযোগ দিয়ে কান পাতলেন মেয়ের পড়ায়। দেখলেন অঙ্কের খাতা খুলে মেয়েটি মুখস্থ করছে, সামান্য সাধারণ যোগ অঙ্ক। ‘ওয়ান প্লাস টু সন অফ এ বিচ থ্রি’, ‘টু প্লাস টু সন অফ এ বিচ ফোর।’…ইত্যাদি ইংরাজি বাক্যের প্রত্যেকটিতে ওই অশালীন শব্দমালা। ভদ্রলোক পরের দিনই মেয়ের স্কুলে গেলেন। ‘এ কী রকম বিলিতি নামতা, এ সব কী শেখাচ্ছেন আপনারা ?’
ভদ্রলোকের মুখে সব শুনে স্কুলের দিদিমণিরাও অবাক। কই এ রকম কিছু শেখানো তো হয় না। বলা উচিত শেখানোর প্রশ্নই আসে না। অনেক তত্ত্বতালাশের পর আবিষ্কার হল, গোলমালটা কোথায়। ক্লাসে শেখানো হয়েছে ‘ওয়ান প্লাস টু সাম অফ হুইচ থ্রি’ সেটা ছাত্রীর কানে গেছে ‘সান অফ এ বিচ।’ ইংরেজি ‘Sum of which’ যদি ‘Son of a bitch’ হয়ে যায় স্কুলের দোষ কোথায় ?
দোষের কথা থাক, বাচ্চা বিষয়ক শেষ গল্পটি বলে ফেলি। গল্পটি গোলমেলে কিন্তু চমৎকার।
প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের কথা বোধ হয়। কলকাতায় তখনও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের যুগ আসেনি। সেটা ছিল প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আমল। ডালহৌসি স্কোয়ারে জিপিওর পিছনে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তখন একজন প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, ভদ্রলোকের উপাধি চৌধুরী, মৈথিলি ব্রাহ্মণ।
একবার সেই ভদ্রলোকের আদালতে এক ব্যক্তিকে বউবাজার থানার পুলিশ চালান দিয়েছে, বউবাজারের একটি মেসে এই ব্যক্তিটি ঘুষি মেরে তার রুমমেটের নাক ফাটিয়ে দিয়েছে।
আসামিটি আপাত নিরীহ দর্শন, ধুতি পাঞ্জাবি পরা রীতিমতো ভদ্রলোকের চেহারা। হঠাৎ এমন কী উত্তেজনার কারণ ঘটল যে, ইনি একজনের নাক ঘুষি মেরে ফাটিয়ে দিলেন ? ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কৌতূহল হল, ব্যাপারটা কী, কী এমন ব্যক্তিগত বিবাদ লোকটিকে আদালতের কাঠগড়ায় আসামি করে ঠেলে দিয়েছে।
আসামিকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করতেই আসামিটি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়ল, ‘হুজুর, ও আমাকে বাঙালের বাচ্চা বলেছিল।’
অভিযোগটা অকল্পনীয় নয়। উদ্বাস্তুসংকুল কলকাতায় তখন বাঙাল-ঘটির কলহ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ব্যাপারটা বুঝলেন, তবু আদালতের খাতিরে আসামিকে নরম করে প্রশ্ন করলেন, ‘একজন লোক আপনাকে বাঙালের বাচ্চা বলেছে তাই বলে আপনি তার নাক ঘুষি মেরে ফাটিয়ে দেবেন ?’
আগুনে ঘৃতাহুতির মতো এই প্রশ্নে আসামি একেবারে জ্বলে উঠল, ‘হুজুর আপনাকে যদি কেউ ঘটির বাচ্চা বলত আপনি রাগ সামলাতে পারতেন ?’
হাকিম মৃদু হেসে বললেন, ‘ঘটির বাচ্চা বললে আমি রাগ করতে যাব কোন দুঃখে, আমি তো আর ঘটি নই।’
হাকিমের এই কথা শুনে আসামি উৎফুল্ল হয়ে উঠল, ‘তা হলে হুজুর আপনিই বলুন, আপনাকে কেউ বাঙালের বাচ্চা বললে আপনার মাথায় রক্ত উঠে যেত না ?’
মৈথিলী ব্রাহ্মণ আবার মৃদু হাসলেন, ‘আমি তো বাঙাল নই যে বাঙালের বাচ্চা বললে রাগ করব।’
আসামি এবার একটু বিব্রত এবং চিন্তিত হল। কিন্তু সে হাল ছাড়বার পাত্র নয়, সে গম্ভীর হয়ে হাকিমকে বলল, ‘তা হলে হুজুর আপনি যে ধরনের বাচ্চা কেউ যদি আপনাকে ঠিক সেই ধরনের বাচ্চা বলে গালাগাল দেয় তবে আপনি কী করবেন ? আপনি ঘুষি মেরে তার নাক ফাটিয়ে রক্ত বের করে দেবেন না ?’
প্রশ্ন শুনে হতভম্ব হাকিম সাহেব উত্তেজিত আসামির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
অতঃপর একটি সরল বাচ্চা কাহিনী দিয়ে এই আপাত অমার্জিত রচনাটি শেষ করি।
ঠিক কাহিনী নয়, একটি কথোপকথন, একটি বাবার সঙ্গে তার বাচ্চার কথোপকথন :
বাচ্চা : বাবা হাতির দুধ কি খুব ভাল ?
বাবা : তা হবে।
বাচ্চা : শুনেছ, একটা বাচ্চার হাতির দুধ খেয়ে এক মাসে পাঁচ কেজি ওজন বেড়েছে।
বাবা : এক মাসে পাঁচ কেজি ? এ তো অসম্ভব !
বাচ্চা : অসম্ভব হবে কেন ? হাতির দুধ খেয়ে পাঁচ কেজি ওজন যে বাচ্চার বেড়েছে, সেটা একটা হাতির বাচ্চা।
পুনশ্চ : বাচ্চা সংক্রান্ত সেই বাজে গল্পটা মনে আছে তো ? সেই যে বাস থেকে নেমে ক্যাঙারু মা পকেটে হাত দিয়ে পকেট খালি দেখে হাউমাউ করে উঠেছিল, ‘আমার সর্বনাশ হয়েছে। আমার বাচ্চাটা পকেটমার হয়ে গেছে।’