বাচুভাই শুক্ল

বাচুভাই শুক্ল

বরোদা-আহমদাবাদ-বোম্বাই করছি, আর বার বার মনে পড়ছে, স্বৰ্গত বাচুভাই শুল্কের কথা। ইনি রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় শিষ্য ছিলেন।

১৯২১ বিশ্বভারতীয় কলেজ-(উত্তর)-বিভাগ খোলার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সেই সুদূর সৌরাষ্ট্র থেকে এসে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের পদপ্রান্তে আসন নেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে যে দু জন বিশ্বভারতীর শেষ পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে উপাধি লাভ করেন, ইনি তারই একজন। বিশ্বভারতীর সর্বপ্রথম সমাবর্তন উৎসব হয় ১৯২৭। বাচুভাই রবীন্দ্রনাথের হাত থেকে তার উপাধি-পত্র গ্রহণ করেন। শুনেছি স্বয়ং নন্দলাল সে উপাধি-পত্রের পরিকল্পনা ও চিত্রকর্ম করেছিলেন। পরবর্তী যুগে তিনি গুজরাতি ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুবাদকরূপে খ্যাতি লাভ করেন।

দাড়িগোঁফ গজাবার চিহ্নমাত্র নেই– সেই সুদূর কাঠিয়াওয়াড় থেকে এসে ছোকরাটি সিট পেল সত্য-কুটিরে। কয়েক দিন যেতে না যেতেই তার হল টাইফয়েড। বাসুদেব বিশ্বনাথ গোখলে ও আমি তাকে আমাদের কামরায় নিয়ে এলুম। সেই তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯২১ সালে। তার পর ১৯৫৭ সালে তার অকালমৃত্যুর দিন পর্যন্ত আমাদের যোগসূত্র কখনও ছিন্ন হয়নি।

তাঁর গুরু ছিলেন মার্ক কলিন্স। তাঁর কাছে বাচুভাই উপাধি লাভ করার পরও দীর্ঘ সাত বৎসর তুলনাত্মক ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। আমিও কলিনসের শিষ্য। তাই তার কিঞ্চিৎ পরিচয় দিই। ইনি জাতে আইরিশ, শিক্ষা লাভ করেন অক্সফোর্ড ও জনির লাইপসিগে। এই বছর দুই পূর্বে লাইৎসিগ বিশ্ববিদ্যালয় তার কোনও পরব উপলক্ষে মালমশলা যোগাড় করতে গিয়ে বিশ্বভারতাঁকে প্রশ্ন করে পাঠায়, কলিনস এখানে কী কী কাজ করে গেছেন। অর্থাৎ ছাত্র হিসেবেই তিনি সেখানে এত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে পরবর্তী যুগের অধ্যাপকের তাঁর কীর্তি-কলাপের সন্ধানে এদেশেও তার খবর নিতে উদগ্রীব হয়েছিলেন। কেউ দশটা ভাষা জানে, কেউ বিশটা জানে একথা শুনলে আমি কণামাত্র বিচলিত হইনে, কারণ মার্সেই, পোর্ট সঈদ, সিঙ্গাপুরের দালাল-দোভাষীরাও দশভাষী, বিশভাষী। কিন্তু কলিন ছিলেন সত্যকার ভাষার জহুরি। এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে, তিনি আমাকে তুর্কি ভাষায় বাবুরের আত্মজীবনী অনুবাদ করে করে শুনিয়েছেন, শেলির প্রমিথিয়ুস আনবাউন্ড পড়াবার সময় ইস্কিলাসের গ্রিক প্রমিথিয়ুস থেকে মুখস্থ বলে গেছেন, আমি তাকে একখানা আরবি স্থাপত্যের বই দেখাতে তিনি তার ছবিতে কুফি-আরবিতে লেখা ইনস্ক্রিপশন অনুবাদ করে করে শুনিয়েছিলেন। তার সঙ্গে মাত্র এইটুকু যোগ করি, আমার জীবনের সেই তিন বৎসরে আমি কখনও গুরু কলিকে কোনও প্রাচীন অর্বাচীন চেনা-অচেনা ভাষার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুনিনি, আমি তো এ ভাষা জানিনে–অবশ্য সে-সব ভাষারই কথা হচ্ছে যার যে-কোনও একটা একজন লোকও পড়তে পারে।

বাচুভাই ছিলেন তাঁর পুত্রপ্রতিম প্রিয় শিষ্য। কিন্তু বাচুভাই জানতেন, এদেশে বিস্তর ভাষা শেখার মতো মাল-মশলা নেই, তাই তিনি বিস্তারে না গিয়ে গিয়েছিলেন গভীরে। বস্তুত তিনি শান্তিনিকেতনে শিখেছিলেন মাত্র একটি জিনিস ভাষাতত্ত্ব। নিজের চেষ্টায় শিখেছিলেন সংস্কৃত। আমরা যেরকম খাবলে খাবলে– অর্থাৎ স্কিপ করে করে রাবিশ বাঙলা উপন্যাস পড়ি (সব বাঙলা উপন্যাস রাবিশ বলছিনে), বাচুভাই ঠিক তেমনি সংস্কৃত পড়তে পারতেন।

বোম্বায়ে ফিরে গিয়ে তিনি সর্বপ্রথম লেখেন একখানি অতি উপাদেয় গুজরাতি ব্যাকরণ। ভারতীয় অর্বাচীন ভাষাদের মধ্যে এই ব্যাকরণই যে সর্বোত্তম সে বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা সচরাচর বাঙলা ব্যাকরণের নাম দিয়ে লিখে থাকি সংস্কৃত ব্যাকরণ। ভারতের অন্যান্য অর্বাচীন ভাষাগুলোতেও তাই। গুজরাতি একমাত্র ব্যত্যয় বাচুভাইয়ের কল্যাণে। বরোদায় গাইকোয়াড় সিরিজে এটি প্রকাশিত হয়।

এই সময় তিনি অন্য লোকের সহযোগিতায় বোম্বায়ে একটি ইস্কুল খোলেন। সাধারণ ইস্কুল, কিন্তু অনেকখানি শান্তিনিকেতন ইস্কুল প্যাটার্নের। অন্যান্য বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গে শেখানো হত রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য। বাধ্য হয়ে তাঁকে তখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের গুজরাতি অনুবাদ করতে হয়, এবং শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তথা বাঙলা সাহিত্যের সঙ্গে গুজরাতি রসিকসম্প্রদায়ের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই তার জীবনের চরম ব্রত হয়ে দাঁড়ায়। বোম্বায়ে শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেন। সেখানকার টেগোর সোসাইটির তিনি অন্যতম উদ্যোক্তা।

বিয়াল্লিশের আন্দোলন আরম্ভ করার প্রাক্কালে মহাত্মাজী গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের শেষ অনুরোধ, এডুজ মেমোরিয়াল ফান্ডের জন্য অর্থ সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে বোম্বায়ে আসেন। এসেই খবর দেন বাচুভাইকে, তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবেন। বাচুভাই তার ইস্কুলের গুজরাতি ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁকে শুনিয়ে এলেন বিশ্বাস করবেন না– বাঙলা ভাষাতেই রবীন্দ্রসঙ্গীত। জীবন যখন শুকায়ে যায়, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে এবং আরও অনেক গান। রবীন্দ্রসঙ্গীতে বাচুভাইয়ের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল–তিনি জানতেন, মহাত্মাজী যখন শান্তিনিকেতন ইস্কুলে অধ্যক্ষ ছিলেন, ঠিক সেই সময় রবীন্দ্রনাথ কোন কোন গান রচেছিলেন এবং স্বভাবতই সেগুলোই মহাত্মাজীর বিশেষ করে জানার কথা। গাঁধীজীর ফরমায়েশ মতো বাচুভাই সেদিন তাঁকে সব গানই শোনাতে পেরেছিলেন। সেদিন, আজো, কজন বাঙালি পারে?

রবীন্দ্রনাথের তাবৎনৃত্য-নাট্য তিনি অনুবাদ করেছেন। গোরা, নৌকাডুবির মতো বৃহৎ উপন্যাসের পূর্ণাঙ্গ সর্বাঙ্গসুন্দর অনুবাদ করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথের আরও কত রচনা, কত গান, কত কবিতা, কত ছোটগল্প যে অতিশয় সাধুতার সঙ্গে অনুবাদ করেছেন তার সম্পূর্ণ ফিরিস্তি দেওয়া আমার ক্ষমতার বাইরে– যদিও ওই সময়ে আমি গুজরাতেই ছিলুম এবং সাহিত্যজগতে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ সানন্দে সোৎসাহে লক্ষ করেছি। এই সাধুতা আকস্মিক ঘটনা নয়। বাচুভাই তার অরিজিনাল আইডিয়া রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের ভিতর নিয়ে পাচার করতে চাননি সাধারণ অনুবাদকরা যা আকছারই করে থাকেন। কারণ তাঁর নিজের মৌলিক উপন্যাস এবং নাট্য গুজরাতি সাহিত্যে বছরের সেরা বইরূপে সম্মানিত হয়েছে।

নাট্যে, এবং নৃত্যনাট্যে, ফিল্ম এবং রঙ্গমঞ্চে বাচুভাইয়ের কৃতিত্ব-খ্যাতি গুজরাতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আকাশবাণী তাঁকে দিল্লিতে বড় চাকরি দিয়ে নিয়ে যান তাঁর কাজ ছিল সর্বভারতের তাবৎ রেডিও-ড্রামার মূল বিচার করে এই অনুযায়ী আকাশবাণীকে নির্দেশ দেওয়া। কিন্তু ওই সময়েও তিনি সমস্ত অবকাশ ব্যয় করেছেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প গুজরাতিতে অনুবাদ করাতে–সাহিত্য আকাঁদেমির অনুরোধে। এ কাজটি তিনি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন।

পঞ্চাশ পেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই গুজরাতি সাহিত্যের এই প্রতিভাবান লেখক সে সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি করে ইহলোক ত্যাগ করেন।

আমাদের শোক, বাঙলা সাহিত্যের গুজরাতি এম্বেসেডার প্লেনিপটেনশিয়ারি অকালে তাঁর কাজ পূর্ণ করে, কিন্তু আমাদের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে চলে গেলেন। আমার ব্যক্তিগত শোকের কথা বলব না। তার একমাত্র কিশোর পুত্রকে কাছে এনে আমাকেই দুঃসংবাদ দিতে হয়েছিল, তার পিতা ইহলোক ত্যাগ করেছেন।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *