বাঙালীর প্রাগৈতিহাসিক পটভূমিকা
জাতি হিসাবে বাঙালী কত প্রাচীন? এর উত্তর দিতে হলে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক যুগে যেতে হবে। পৃথিবীতে নরাকার জীবের বিবর্তন ঘটে প্লাওসীন যুগে। এর পরের যুগকে প্লাইস্টোসীন যুগ বলা হয়। মানুষের আবির্ভাব ঘটে এই যুগে।
যদিও প্লাইস্টোসীন যুগের মানুষের কোনও নরকঙ্কাল আমরা ভারতে পাইনি, তবুও তার আগের যুগের অনু-নর জীবের কঙ্কাল আমরা এশিয়ার তিন জায়গা থেকে পেয়েছি। জায়গাগুলি হচ্ছে ভারতের উত্তর-পশ্চিম কেন্দ্রস্থ শিবালিক গিরিমালা, জাভা ও চীনদেশের চুংকিঙ। এই তিনটি বিন্দু সরলরেখা দ্বারা সংবদ্ধ করলে যে ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়, বাঙলাদেশ তার কেন্দ্রস্থলে পড়ে। সুতরাং এরূপ জীবসমূহ যে সে যুগে বাঙলাদেশের ওপর দিয়েই যাতায়াত করত সেরূপ অনুমান করা যেতে পারে।
যদিও সঠিকভাবে নির্ণীত প্লাইস্টোসীন যুগের মানুষের কোনও নরকঙ্কাল আমরা এদেশে পাইনি, তবুও মানুষ যে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই বাঙলাদেশে বাস করে এসেছে তার প্রমাণ আমরা পাই বাঙলাদেশে পাওয়া তার ব্যবহৃত আয়ুধসমূহ থেকে। এই আয়ুধসমূহের অন্যতম হচ্ছে পাথরের তৈরি হাতিয়ার, যার সাহায্যে সে যুগের মানুষ পশু শিকার করত তার মাংস আহারের জন্য। এটা খুব বিচিত্র ব্যাপার যে, এই হাতিয়ারগুলির আকার ও নির্মাণরীতি পশ্চিম ইউরোপে যেরূপ ছিল ভারতেও সেরূপ ছিল। এরূপ হাতিয়ার বাঙলাদেশের বহুস্থানে পাওয়া গিয়েছে, যথা- বাঁকুড়া, বর্ধমান, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার নানাস্থান থেকে। (পরে দেখুন)। এই সকল আয়ুধকে প্রত্নপ্রস্তর-যুগের আয়ুধ বলা হয়। প্রত্নপ্রস্তরযুগের পরিসমাপ্তি ঘটে আনুমানিক দশ হাজার বৎসর পূর্বে। তখন নবপ্রস্তর বা নবোপলীয় যুগের সূচনা হয়। নবপ্রস্তর যুগের মানুষের জীবনযাত্রা-প্রণালীর এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। ভ্রাম্যমাণ জীবনের পরিবর্তে মানুষ স্থায়িভাবে বিশেষ বিশেষ জায়গায় বসবাস করতে শুরু করে। এই যুগেই কৃষি ও বয়নের উদ্ভব হয় এবং মানুষ পশুপালন করতে শুরু করে। এ যুগের ধর্মীয় আচার সম্বন্ধে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা নেই। তবে প্রত্নপ্রস্তর-যুগের মানুষের মতো তারা ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিত ও মৃত ব্যক্তির সমাধির উপর একখানা লম্বা পাথর খাড়াভাবে পুঁতে দিত। এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত পাথর আমরা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলি প্রভৃতি জেলায় লক্ষ্য করি। সেগুলিকে ‘বীরকাড়’ বলা হয়।
এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তরফলক আমরা পশ্চিম বাঙলার যেসব জায়গায় পেয়েছি, তার একটা বিবরণ দিচ্ছি। বাঁকুড়া শহর থেকে দশ মাইল পশ্চিমে ছাতনায় এক পুকুরের নিকট আমরা এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত স্মৃতিফলক দেখতে পাই। এগুলি চার-পাঁচ ফুট উঁচু এবং এগুলির গায়ে অপরিণত শৈলীর ক্ষোতিদ মূর্তি আছে। এগুলি সম্বন্ধে নানারূপ জনশ্রুতি বিদ্যমান, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যে সকল সাহসী বীর সৈনিক যুদ্ধে নিহত হয়েছে এগুলি তাদেরই সমাধির ওপর প্রোথিত। মেদিনীপুরের কিয়া চাঁদ গ্রামেও এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত বহু প্রস্তর-ফলক দেখতে পাওয়া যায়। এগুলির বর্ণনায় বলা হয়েছে—’Rounded at the top, they seemed to have been deliberately chiselled and stand on the open field as rigid and uncommunicative sentinels which they certainly are, continuing to baffle historians as to how they originated’. এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তর- ফলক বাঁকুড় জেলার ছাতনার দু-মাইল দূরে মৌলবনায় ও হুগলি জেলাতেও পাওয়া গিয়েছে। হুগলি জেলাতে এগুলিকে ‘বীরকাড়’ বলা হয়। মনে হয় এগুলি অনু-অস্ট্রোলীয়া বা প্রোটো- অস্ট্রোলয়েড জাতির অবদান। কেননা, দক্ষিণভারতের আদিবাসীদের মধ্যেও আমরা এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তুর ফলক দেখি। নীলগিরি পাহাড়ের অধিবাসী কুড়ুম্বা উপজাতির লোকরা এরূপ প্রস্তর-ফলককে “বীরকন্তু” নামে অভিহিত করে ও এগুলির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদেন করেন। কুড়ুম্বা এবং ইরুলা উপজাতিদের ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে ‘বীরপুরুষদের স্মৃতিফলক’। এক কথায় এগুলি হচ্ছে সমাধির ওপর স্মারক-ফলক। সমাধির ওপর এরূপ স্মারক-ফলক ডালটন ছোটনাগপুরের হো ও মুণ্ডা উপজাতিদের গ্রামেও দেখেছিলেন। নীলগিরি পাহাড়ের কুড়ুম্বাদের মত ছোটনাগপুরের হো ও মুণ্ডা জাতিরাও এগুলির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। ছোটনাগপুরের খেরিয়া উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত এরূপ স্মৃতিফলক সম্বন্ধে বলা হয়েছে—Beside the grave-stones monumentals stones set up outside the village to the memory of men of note. The Kherias have collections of these monuments in the little enclosure round their houses and libations are constantly made to them.’ মনে হয়, বাঙলাদেশের মানুষের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পর গ্রামের বাইরে যে, ‘বৃষকাষ্ঠ’ স্থাপন করা হয়, সেগুলি এরূপ প্রস্তর-ফলকেই কাষ্ঠ নির্মিত উত্তর সংস্করণ। ( A. K.Sur’s ‘History & Culture of Bengal’ (1963, Pages 20-21 দ্রষ্টব্য)
বস্তুত নবোপলীয় যুগের অনেক কিছুই আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধরে রেখেছি। যথা ধামা, চুবড়ি, কুলা, ঝাপি, বাটনা বাটবার জন্য শিল-নোড়া ও শস্য পেষাইয়ের জন্য জাঁতা ইত্যাদি। এগুলি সবই আজকের বাঙালী নবোপলীয় যুগের ‘টেকনোলজি’ অনুযায়ী তৈরি করে।
দুই
নবপ্রস্তর-যুগ পর্যন্ত মানুষ আয়ুধ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি প্রস্তর দ্বারাই নির্মাণ করত। এর পরে মানুষ তামার ব্যবহার করতে শুরু করে। এই দুই যুগের সন্ধিক্ষণে যে সভ্যতার উদ্ভব হয় তাকে তাম্রাশ্ম-যুগের সভ্যতা বলা হয়। এ যুগের মানুষ নগর নির্মাণ করতে শুরু করে। তার মানে এ যুগেই প্রথম নাগরিক সভ্যতার উদ্ভব হয়। সিন্ধু-উপত্যকায় মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভৃতি সে যুগেরই নগরের প্রতীক। বাঙলাদেশে এরূপ সভ্যতার নিদর্শন হচ্ছে পাণ্ডুরাজার ঢিবি। পান্ডুরাজার ঢিবি বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম থানার (বোলপুল শান্তিনিকেতনের নিকটে) অবস্থিত। এখানে উৎখনন কার্য চলে ১৯৬২-৬৫ সময়কালে। অজয়, কুনুর ও কোপাই নদীর উপত্যকার অন্যত্রও আমরা এই সভ্যতার পরিচয় পাই। সম্প্রতি (১৯৯০) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অজয় ও কুনুর নদীর সঙ্গমস্থলের কাছে মঙ্গলকোটে তাম্রপ্রস্তর যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত একটানা উন্নত সভ্যতার নানাবিধ প্রত্নসম্ভার আবিষ্কার করেছে)। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে এই সভ্যতা যে ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্র’ রচনার বহু পূর্ববর্তী, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এখানে ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রে’র নাম এজন্য উল্লেখ করা হচ্ছে, ‘বৌধায়ন ধর্মসূত্রে’ই (২/২/৩০) আমরা সর্বপ্রথম ‘আর্যাবর্ত’ নামে উল্লেখ পাই।
তিন
পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে আমরা চারটি বিভিন্ন যুগের সভ্যতার অস্তিত্ব লক্ষ্য করি। এখানে মানুষ বাস করতে শুরু করেছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিসহস্রক থেকে। এ যুগের লোকরা কাঁকরপেটা (‘মুরাম’)। গৃহতল নির্মাণ করত, চক্রে লাল- কালো ও ধূসর রঙের মৃৎপাত্র তৈরি করত ও ধান্যের চাষ করত। প্ৰথম যুগের পর পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে এক প্লাবন ঘটেছিল এবং স্থানটি সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত হয়। দ্বিতীয় যুগের লোকরাই তাম্রাশ্ম-যুগের সভ্যতার বাহক ছিল। তারা সুপরিকল্পিত নগর ও রাস্তাঘাট তৈরি করত। তারা গৃহ ও দুর্গ—এই উভয়ই নির্মাণ করতে জানত। তারা তামার ব্যবহার জানত। কৃষি ও বাণিজ্য তাদের অর্থনীতির প্রধান সহায়ক ছিল। তারা ধান্য ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন করত এবং পশুপালন ও কুম্ভকারের কাজও জানত। পূর্ব-পশ্চিম দিকে শয়ন করিয়ে তারা মৃত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করত এবং মাতৃকাদেবীর পূজা করত।
পাণ্ডুরাজার ঢিবির দ্বিতীয় যুগের মানুষেরা ব্যবহার করত লাল-কালো রঙের কোশীপাত্র এবং অপরাপর সুদৃশ্য কলস, ভাণ্ড ও তৈজসপত্রাদি। এ যুগের মৃৎপাত্রসমূহের ওপর অঙ্কিত চিত্রাদি তাদের নান্দনিক মানসের সাক্ষ্য দেয় এবং প্রতিফলিত হয় নগরভিত্তিক এক অনুপম সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক রুচি। লাল-কালো মৃৎপাত্রগুলির গঠন ও চিত্রিত নিদর্শনগুলি নর্মদা উপত্যকা (নাভদা টোলি), রাজস্থান (আহাড়), মধ্যপ্রদেশ (এরণ) ও মহারাষ্ট্রের (বাহাল) অনুরূপ বিভিন্ন মুপাত্রের সঙ্গে তুলনীয়। আরও যেসব জিনিস দ্বিতীয় যুগে পাওয়া গিয়েছে সেগুলি হচ্ছে ক্ষুদ্রাশ্মর ছুরিকা, হাড়ের আয়ুধ, তামার অলংকার, পোড়ামাটির তকলি ও শিমূল তুলা হতে বোনা চিকন ও শুভ্র বস্ত্র। কার্বন ১৪ পরীক্ষায় দ্বিতীয় যুগের বয়স নির্ণীত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ১০১২+১২০ বৎসর।
তৃতীয় যুগে পাওয়া গিয়েছে নবাশ্মর কুঠার, অঙ্গারমিশ্রিত লোহার অস্ত্র এবং কালো রঙের মসৃণ মৃৎপাত্র। তবে লাল-কালো রঙের মৃৎপাত্রের ব্যবহার অব্যাহত ছিল। এছাড়া পাওয়া গিয়েছে লৌহ ঢালাইকরণের জন্য ব্যবহৃত চুল্লিসমূহ। ধারাবাহিক খননকার্যের ফলে জানা গিয়েছে যে এক বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডের ফলে তৃতীয় যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে ও এই বসবাস পরিত্যক্ত হয়। একাধিক অগ্নিকাণ্ড অবশ্য দ্বিতীয় যুগেও ঘটেছিল।
পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে আবার বসবাস শুরু হয় বহু পরে চতুর্থ বা ঐতিহাসিক যুগে মৌর্যদের সময় থেকে।
পাণ্ডুরাজার ঢিবির দ্বিতীয় যুগটাই ছিল গৌরবময় ও সমৃদ্ধিশীল যুগ। এটাই ছিল তাম্রশ্ম যুগ এবং বাণিজ্যই তাদের জীবনের প্রধান অবলম্বন ছিল। তারা অভ্যন্তরস্থ দেশসমূহ ব্যতীত ‘সাত সমুদ্দুর, তের নদী অতিক্রম করে বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করত। ক্রীটদ্বীপ ও ভূমধ্যসাগরীয় অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। ক্রীটদেশের প্রচলিত লিপি-পদ্ধতিতে লিখিত একটি চক্রাকার সীলমোহর পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে পাওয়া গিয়েছে। তাদের বাণিজ্যের পণ্যসম্ভারের অন্তর্ভুক্ত ছিল মসলা, তুলা, বস্ত্র, হস্তিদন্ত, স্বর্ণ রৌপ্য, তাম্র এবং বোধ হয় হীরক। মনে হয়, গুড় বা শর্করাও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। কেননা, পরবর্তীকালে বাঙলার গুড় ও শর্করা রোমসাম্রাজ্যে বিশেষভাবে আদৃত হত।
সীলমোহর ছাড়া পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে আরও পাওয়া গিয়েছে একটি মাটির ‘লেবেল’। এরূপ মাটির ‘লেবেল’ সেই ধরনের ঝুড়ির সঙ্গে বাঁধা থাকত যার মধ্যে থাকত মৃতফলকের ওপর লিখিত পণ্য ও বাণিজ্যিক লেনদেন-সম্পর্কিত হিসাবপত্র।
চার
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, বাণিজ্য উপলক্ষে বাঙালীরা ক্রীটদেশে গিয়ে ও ক্রীটদেশের লোকরা বাঙলাদেশে এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ওই অঞ্চলে বাঙালী বণিকদের উপনিবেশের কথা আমরা পরবর্তীকালে ইজিপ্টবাসী এক নাবিক প্রণীত ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থেও উল্লেখ পাই। ভেলেরিয়াস ফ্লাকাস-ও তাঁর ‘আরগনটিকা’ পুস্তকে লিখে গিয়েছেন যে, গঙ্গা-রিডিদেশের বাঙালী বীরেরা কৃষ্ণসাগরের উপকূলে ১৫০০ খ্রিস্ট- পূর্বাব্দে (ঋগ্বেদ রচয়িতা নর্ডিক আর্যদের পঞ্চনদে এসে উপস্থিত হবার সমসাময়িককালে) কলচিয়ান ও জেসনের অনুগামীদের সঙ্গে বিশেষ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। এরই প্রতিধ্বনি করে ভার্জিলও তাঁর ‘জর্জিকাস’ নামক কাব্যে লিখে গিয়েছেন যে, গঙ্গারিডির বাঙালী বীরদের শৌর্যবীর্যের কথা “আমি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখব।” বলা বাহুল্য বিদেহ বা মিথিলার পূর্বে অবস্থিত বাঙালী বীরদের এই শৌর্যবীর্যই প্রতিহত করেছিল অগ্রগামী বৈদিক আর্যদের।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সাড়ে তিন হাজার বছর আগে বাঙালীরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপরিচিত ছিল। অনুরূপভাবে আমরা একথাও ভেবে নিতে পারি যে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের বণিকদের বাঙলাদেশেও উপনিবেশ ছিল। দুই দেশের বণিকদের মধ্যে যে বিবাহঘটিত সম্পর্ক স্থাপিত হত তাও আমরা অনুমান করতে পারি। চেহারা দেখে মনে হয় যে বাঙলার সুবর্ণবণিক সম্প্রদায় তাদেরই বংশধর। পরবর্তীকালে সুবর্ণবণিকদের সপ্তগ্রামী সমাজের অবস্থানও এরূপ নির্দেশ করে। এই বণিকদেরই আমরা ঋগ্বেদে ‘পণি’ নামে অভিহিত হতে দেখি। বস্তুত ‘বণিক’, ‘পণ্য’ প্রভৃতি শব্দ ‘পণি’ শব্দ থেকেই উদ্ভুত হয়েছে। আর সমবাচক ‘শ্রেষ্ঠী’ শব্দ উদ্ভুত হয়েছে আল্পীয় অসুরদের ‘হট্টি’ বা ‘হিট্টি’ শব্দ থেকে।
পরস্পর এই মেলামেশার ফলে রাঢ়দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে ক্রীটদেশের সংস্কৃতির অনেকে সাদৃশ্য প্রকাশ পেয়েছিল। তার অন্যতম হচ্ছে উভয়দেশেই মাতৃদেবীর সঙ্গে সিংহের সম্পর্ক। এ ছাড়া আমরা উভয় দেশের রূপকথার মধ্যেও অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করি। ১৯৬৫ সালের ‘হিন্দুস্থানে স্ট্যাণ্ডার্ড’ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় বর্তমান লেখক এক প্রবন্ধে ক্রীটদেশে প্রচলিত লিপি ও প্রাচীন বাঙলার পাঞ্চ-মার্কযুক্ত মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপি পাশাপাশি রেখে উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়েছিলেন। তা ছাড়া ক্রীটদ্বীপের মেয়েরা দেহের উপর অংশ অনাবৃত রাখত। বাৎসায়ন তাঁর ‘কামসূত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, পূর্ব-ভারতের রাণীরা তাদের দেহের উপরাংশ অনাবৃত রাখে।
পাঁচ
মনে হয়, ‘ভূমধ্যসাগরীয়’ গোষ্ঠীর জাতিরা তাম্র আহরণের জন্যই বাঙলাদেশে এসে হাজির হয়েছিল। আরও মনে হয় যে, এদেরই অনুসরণ করে এসেছিল আর্যভাষা-ভাষী ‘অসুর’ জাতীয় আল্পীয় গোষ্ঠীর বণিকরা। তারাও এদেশে বসতি স্থাপন করেছিল। বোধ হয় ভূমধ্যীয়’ গোষ্ঠীর তুলনায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। বর্তমান বাঙলায় আল্পীয় নরগোষ্ঠীর গরিষ্ঠতা তাই প্ৰমাণ করে। তা ছাড়া পরবর্তীকালের সাহিত্যে আমরা বাঙলাদেশকে অসুরদের দেশ হিসাবেই বর্ণিত হতে দেখি। এরা পশ্চিমদিকে অন্তত অঙ্গদেশ পর্যন্ত নিজেদের বিস্তৃত করেছিল। মহাভারত ও পুরাণ অনুযায়ী অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুক্ষ্ম অসুররাজ বলির ক্ষেত্রজ সন্তান। তার মানে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুক্ষ্ম অসুরজাতি-সম্ভূত। আমরা আগেই বলেছি যে অসুররা ছিল বিস্তৃত- শিরস্ক জাতি। এবং অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুহ্ম বিস্তৃত- শিরস্ক জাতিরই বাসভূমি।
মোট কথা, দ্রাবিড়ই বলুন আর আর্যভাষা-ভাষী অসুরজাতিই বলুন, এরা ভারতের আদিবাসী প্রাক্-দ্রাবিড়দের সঙ্গে কিভাবে মিশে গিয়েছিল তা আমরা জানি না। সম্ভবত এই মিশ্রণ হয়েছিল বাণিজ্য-সম্পর্কিত বন্ধুত্বের সুযোগে ও বিবাহের মাধ্যমে। অসুররা বৈদিক আর্যদের মত দুর্ধর্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে এদেশের আদিবাসীদের বিজিত করেনি বলেই মনে হয়। কেননা, আগন্তুক ‘নর্ডিক’ বা বৈদিক আর্যরা এদেশে বাণিজ্য উপলক্ষে আসেনি। তারা এসেছিল ধর্মধ্বজী যোদ্ধা হিসাবে। আর্যসংস্কৃতির ধ্বজা সামনে রেখে দুর্ধর্ষ সংগ্রাম করতে করতেই তারা এগিয়ে এসেছিল উত্তরভারতের পূর্বদিকে। তাদের মনের মধ্যে ছিল আর্যসংস্কৃতির গরিমা ও এদেশের লোকদের ও তাদের সংস্কৃতির প্রতি ঘোরতর ঘৃণা ও বিদ্বেষ। এজন্য তারা নিজেদের অধীনস্থ এলাকাকে স্বতন্ত্র করে তার নাম দিয়েছিল ব্রহ্মর্ষিদেশ, আর্যাবর্ত ইত্যাদি। আর্যসংস্কৃতির সীমানার বাইরের অংশকে তারা ‘দস্যু’দের দেশ বলে অভিহিত করত। বিদেহ পর্যন্ত এলে তারা প্রতিহত হয়েছিল প্রাচ্যদেশের অসুরগণ দ্বারা। অসুরগণের দেশকে তারা ‘ব্রাত্য’দেশ বা বেদ-বহির্ভূত দেশ বলে অভিহিত করত।
ছয়
পাণ্ডুরাজার ঢিবি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মহাভারতের কথা। পঞ্চপাণ্ডব বহুদিন ধরে বাঙলার বীরভূম জেলার একচক্রানগরে বাস করেছিল। অজয়নদের তীরে যেখানে পাণ্ডুরাজার ঢিবি অবস্থিত, তার নিকটে ও অদূরে পাণ্ডুবদের স্মৃতির সঙ্গে বিজড়িত একাধিক স্থান আছে। ভীমেশ্বরে আছে মধ্যমপাণ্ডব ভীম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ। পাণ্ডবেশ্বরেও অনুরূপ লিঙ্গ আছে।
মনে হয় ভরতবংশীয় রাজাদের অভ্যুত্থান পূর্বভারতে হয়েছিল। ভরতবংশীয় রাজারা ঋগ্বেদে বর্ণিত সম্মিলিত দশ রাজার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। পাণিনি ও পতঞ্জলি ভরতদের প্রাচ্যদেশীয় বলে অভিহিত করেছেন। মহাভারতের আদিপর্বে উল্লিখিত এক কাহিনী থেকে আমরা জানতে পারি যে, ভরতবংশীয় রাজা দুষ্যন্তের এক পূর্বপুরুষ অরিহ অঙ্গদেশের এক মেয়েকে বিবাহ করেছিলেন। “কাশিকা’ টীকা অনুযায়ী পাণিনি-উল্লিখিত প্রাচ্যদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল পঞ্চাল, বিদেহ, অঙ্গ ও বঙ্গ। ‘কাশিকা’র এই মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, মহাভারতের কাহিনী থেকে আমরা অবগত হই যে, পঞ্চপাণ্ডব একচক্রানগরে অবস্থানকালে পঞ্চাল রাজার কন্যা দ্রৌপদীকে বিবাহ করেছিলেন। সুতরাং পঞ্চালদেশ বীরভূমের একচক্রানগরেরই নিকটবর্তী কোন রাষ্ট্র ছিল বলে মনে হয়।
মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত জতুগৃহদাহের পর পাণ্ডবদের পলায়নের কাহিনী উপরি-উক্ত তথ্যসমূহকে সমর্থন করে। জতুগৃহ নির্মিত হয়েছিল গঙ্গা নদীর উত্তর তীরে বারণাবত নগরে। মনে হয় মহাভারতের বারণাবত ও বর্তমান বরৌনী অভিন্ন। বিদূর কর্তৃক প্রেরিত ‘বাষ্পীয়’ জলযানে আরোহণ করে পাণ্ডবরা পূর্বদিকে রওনা হয়ে প্রভাতকালে গঙ্গানদীর দক্ষিণতীরে অবতরণ করেছিলেন। মনে হয় সে জায়গাটা রাজমহলের নিকটবতী কোনও স্থান। তারপর তাঁরা ঘোর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পথ অতিক্রম করে অবশেষে একচক্রানগরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। এই ঘোর জঙ্গল সাঁওতাল পরগনার জঙ্গলই হবে এবং তা অতিক্রম করেই তাঁরা বীরভূম প্রদেশে প্রবেশ করে একচক্রানগরে এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন। এখান থেকেই তাঁরা একদিন পঞ্চালরাজ্যে গিয়ে স্বয়ংবর সভা থেকে দ্রৌপদীকে জয়
জয় করেছিলেন। সুতরাং পঞ্চালরাজ্য যে একচক্রানগরের নিকটবর্তী কোন দেশ, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। পণ্ডিতগণ যে মনে করেন পঞ্চালরাজ্য উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত ছিল, তা ভুল বলেই মনে হয়। এরূপ মতবাদ পাণিনির ‘কাশিকা’ টীকার বিরোধী। ‘কাশিকা’ টীকায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, পঞ্চালরাজ্য বিদেহ, অঙ্গ ও বঙ্গের সঙ্গে প্রাচ্যদেশে অবস্থিত। (এ সম্বন্ধে লেখকের ‘মহাভারত ও সিন্ধুসভ্যতা’ দ্রষ্টব্য)।
এ সকল ঘটনা বৈদিক যুগের পূর্বেই ঘটেছিল। তার সাক্ষ্য বহন করে মহাভারতে বর্ণিত ঘটনাবলী। প্রথমত, বহুপতিগ্রহণ বৈদিক ও বেদোত্তর যুগে প্রচলিত ছিল না। জটিলার বহুপতিগ্রহণ আর্যদের পঞ্চনদে আসবার আগেকার ইতিহাসের ঘটনার প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, মহাভারত অনুযায়ী পান্ডবেরা প্রথমে দ্রৌপদীকে স্বয়ংবরসভা থেকে জয় করে এনে বহুদিন স্বামী-স্ত্রী রূপে বসবাস করেছিলেন। তারপর তাঁর দ্রুপদরাজার গৃহে আবার গিয়েছিলেন আনুষ্ঠানিকভাবে দ্রৌপদীকে বিবাহ করবার জন্য। এটা সকলেরই জানা আছে যে, মহাভারতের মধ্যে বহু প্রক্ষিপ্ত অংশ আছে। পরে দ্রুপদরাজার গৃহে গিয়ে দ্রৌপদীকে পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ করার কাহিনীটি এরূপ প্রক্ষিপ্ত অংশ বলেই মনে হয়। আমি আমার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস (১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮৭) গ্রন্থে দেখিয়েছি যে, বেদোত্তর যুগে যখন সপ্তপদীগমন ও বিবাহের অন্যান্য অনুষ্ঠানের প্রবর্তন হয়েছিল তখনই কালোপযোগী করবার জন্য এই অংশ মহাভারতের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়েছিল। এই সকল ঘটনা থেকে মনে হয় যে, পাণ্ডুরাজার ঢিবির সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবদের সম্বন্ধ অলীক নয়, এবং মহাভারতের মূলকাহিনী তাম্রাশ্ম-যুগের সমকালীন ও প্রাক্-আৰ্য যুগের।
মহাভারতীয় যুগের কাল সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে নানা মত প্রচলিত আছে। কিন্তু বাদবিতণ্ডার মধ্যে প্রবেশ না করে আমরা এক সহজ উপায় মহাভারতের কাল নিরূপণ করতে পারি। ‘বৃহৎসংহিতা’র গণনানুসারে ৬৫৩ কল্যব্দে পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। বর্তমানে (১৩৯২ বঙ্গাব্দ) ৫০৮৬ কল্যব্দ চলছে। সুতরাং সেই হিসাব অনুযায়ী যুধিষ্ঠিরের রাজ্য অভিষেকের সময় ছিল ৪৪৩৩ বৎসর পূর্বে বা খ্রিস্টপূর্ব ২৪৪৮ অব্দে। এটা তাম্রাক্ষ্ম-যুগের সমকালীন।
এ সম্বন্ধে একটা বক্তব্য আছে। C-14 পরীক্ষায় পাণ্ডুরাজার ঢিবির বয়স নির্ণত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ১০১২ +১২০। এটা যে অভ্রান্ত নয়, তা Carlton S. Coon-রচিত “The History of Man’ পুস্তকের ১৬৪ পৃষ্ঠায় লিখিত মন্তব্য পড়লেই বুঝতে পারা যায়। তিনি বলেছেন C-14 পরীক্ষার জন্য আহৃত দ্রব্য সঙ্গে সঙ্গে polythylene tube-এর মধ্যে সীল করে না রাখলে পরীক্ষার ফল ভুল হবে। যেহেতু পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে আহৃত যে বস্তুর C-14 পরীক্ষা হয়েছে তা এরূপভাবে সংরক্ষিত হয়নি, সে কারণে এর নির্ণীত বয়সও অভ্রান্ত নয়।
সাত
পণ্ডিতমহল ধরে নিয়েছেন যে, সিন্ধুসভ্যতার অপমৃত্যু ঘটেছিল। এর জন্য তাঁরা নানারকম কারণও দর্শান। যথা বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প, বহিরাক্রমণ ইত্যাদি। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সর্বময়কর্তা স্যার জন মারশালের নির্দেশে ১৯২৮-৩১ খ্রিস্টাব্দে আমি যখন এ সম্বন্ধে অনুশীলন করেছিলাম, তখনই প্রমাণ করেছিলাম যে সিন্ধুসভ্যতার বিলুপ্তি ঘটেনি। বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প ও বৈদিক বিরোধিতা সত্ত্বেও সিন্ধুসভ্যতা পরবর্তীকালে জীবিত ছিল হিন্দুসভ্যতার মধ্যে। (ক্যালকাটা রিভিউ’, এপ্রিল-মে ১৯৩১ দ্রষ্টব্য)। তখনই আমি বলেছিলাম যে, রীতিমত খননকার্য চালালে দেখা যাবে যে, সিন্ধুসভ্যতা গঙ্গা-উপত্যকার সুদূর প্রত্যন্তদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীকালের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন ও আবিষ্কার আমার সে-উক্তির যথার্থতা প্রমাণ করেছে।
বাঙালীরা আজও সিন্ধুসভ্যতাকে আঁকড়ে ধরে আছে। চলুন না একবার ঠাকুরঘরের দিকে যাই। ঠাকুরঘরে ব্যবহৃত বাসন-কোশনগুলি সবই তাম্রাশ্ম-যুগের। পাথরের থালা, তামার কোশাকুশি প্রভৃতি তার নিদর্শন। তামাশ্ম-যুগের কোশাকুশি সম্প্রতি মহিষদলে পাওয়া গিয়েছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে বাঙালী এগুলো তাম্রাশ্মযুগ থেকেই ব্যবহার করে আসছে।
তাম্রাক্ষ্মযুগের সভ্যতার অভ্যুদয়ে তামাই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। মিশর বলুন, সুমের বলুন, সিন্ধু উপত্যকা বলুন সর্বত্রই আমরা সভ্যতার প্রথম প্রভাতে তামার ব্যবহার দেখি। সুতরাং আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, তামাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ এমন কোন জায়গায় হয়েছিল, যেখানে তামা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এখানে সেখানে অবশ্য তামা সামান্য কিছু কিছু পাওয়া যেত, কিন্তু তা নগণ্য। বাঙলাই ছিল সে-যুগের তামার প্রধান আড়ত। তামার সবচেয়ে বৃহত্তর খনি ছিল বাঙলাদেশে। বাঙলার বণিকরাই ‘সাত সমুদ্দুর তের নদী’ পার হয়ে, ওই তামা নিয়ে যেত সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রসমূহে বিপণনের জন্য। এজন্যই বাঙলার সবচেয়ে বড় বন্দর-নগরের নাম ছিল তাম্রলিপ্ত। এই তামা সংগৃহীত হত ধলভূমে অবস্থিত তৎকালীন ভারতের বৃহত্তম তাম্রখনি হতে।
আট
সিন্ধুসভ্যতার এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাতৃদেবীর ও আদি-শিবের পূজা ভারতের অন্যান্য প্রদেশে তুলনায় মাতৃদেবীর পূজার প্রাবল্য বাঙলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। এটা মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার যুগ থেকে চলে এসেছে। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভৃতি নগরে আমরা মাতৃদেবীর পূজার নিদর্শনরূপে পেয়েছি মাতৃকাদেবীর বহু মৃন্ময়ী ক্ষুদ্রকায়া মূর্তি। অনুরূপ মূর্তি বাঙলাদেশেও বর্তমান কাল পর্যন্ত তৈরি হয়ে আসছে। তবে এগুলি সাধারণত বাচ্চাদের খেলার পুতুল হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এরূপ পুতুলগুলিকে ‘কুমারী পুতুল’ বলা হয়। এ নামটা খুব অর্থপূর্ণ। কেননা মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা ও সমসাময়িক সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে মাতৃদেবী ‘কুমারী’ (virgin goddess) হিসাবে পূজিতা হতেন। মহাষ্টমীর দিন বাঙালী সধবা মেয়েদের ‘কুমারী পূজা’ তার স্মৃতি নিদর্শন। যদিও তাম্রাশ্মযুগে মাতৃদেবী কুমারী হিসাবে পরিকল্পিত হতেন, তথাপি তাঁর ভর্তা ছিল। এই ভর্তার প্রতিকৃতি আমরা মহেঞ্জোদারোতে পেয়েছি। তাঁকে পশুপতি শিবের আদিরূপ বলা হয়েছে। শিব যে প্রাগার্য দেবতা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এ সম্পর্কে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, বাঙলায় শৈবধর্মের প্রাধান্য বস্তুত বাঙলায় যত শিব মন্দির দেখতে পাওয়া যায়, তত আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। সুতরাং শিব ও শক্তিপূজা যে মহেঞ্জোদারো হরপ্পার কাল থেকেই চলে এসেছে সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
নয়
সিন্ধুসভ্যতার অনুরূপ সভ্যতা সুমেরেও পাওয়া গিয়েছে। সুমেরের কিংবদন্তী অনুযায়ী সুমেরের লোকরা পূর্বদিকের কোন পার্বত্য অঞ্চল থেকে এসেছিল। সে জায়গাটা কোথায়? নিকট-প্রাচীর বিখ্যাত ইতিহাসকার হল (Hall) সাহেব বলেছিলেন যে সুমেরের লোকরা ভারতবর্ষ থেকে গিয়েছিল। এ সম্বন্ধে যোগিনীতন্ত্রে’ উল্লিখিত ‘সৌমার’ দেশের সঙ্গে ‘সুমের’-এর বেশ শব্দগত সাদৃশ্য ও সঙ্গতি আছে। ‘সৌমার’ দেশ সম্বন্ধে ‘যোগিনীতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে—’পূর্বে স্বর্ণনদী যাবৎ করতোয়া চ পশ্চিমে/ দক্ষিণে মন্দশৈলশ্চ উত্তরে বিহগাচল/অষ্টকোণম্ চ সৌমারম্ যত্র দিক্করবাসিনী। দিক্করবাসিনীর আবাসস্থল ‘সৌমার’ অষ্ট- কোণাকৃতি দেশ, যার সীমারেখা হচ্ছে পূর্বে স্বর্ণ নদী (স্ববর্ণসিরি), পশ্চিমে করতোয়া নদী, দক্ষিণে মন্দ-পর্বতসমূহ (মুণ্ডাজাতি অধ্যুষিত পর্বতমালা) ও উত্তরে বিহগাচল (হিমালয়)।’ সুমেরের লোকরা যে প্রাচ্যভারত থেকে গিয়েছিল এবং তাদের নূতন উপনিবেশের নাম আগত দেশের নাম অনুযায়ী করেছিল (এরূপ নামকরণ-পদ্ধতি অতি প্রাচীনকাল থেকে প্ৰচলিত আছে), মাতৃ-পূজাই তার প্রমাণ।
বাঙলার ও সুমেরের মাতৃদেবীর কল্পনার মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (১) উভয় দেশেই মাতৃদেবী ‘কুমারী’ হিসাবে কল্পিত হতেন, অথচ তাঁর ভর্তা ছিল, (২) উভয় দেশেই মাতৃদেবীর বাহন সিংহ ও তাঁর ভর্তার বাহন বৃষ, (৩) উভয় দেশেই মাতৃদেবী তাঁর নারীসুলভ কার্যাদি ছাড়া, পুরুষোচিত কর্ম (যেমন যুদ্ধাদি) করতে সক্ষম হতেন। সুমেরের লিপিসমূহ পুনঃপুনঃ তাঁকে ‘যুদ্ধবাহিনীর নেত্রী’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। ভারতেও ‘মার্কন্ডেয়পুরাণ” এর দৈবীমাহাত্ম্য’ অংশে বর্ণিত হয়েছে যে, দেবতারা অসুরগণ কর্তৃক পরাহত হয়ে মাতৃদেবীর শরণাপন্ন হন, এবং তাঁর সাহায্যেই অসুরাধিপতি মহিষাসুরকে নিহত করেন। (৪) সুমেরে মাতৃদেবীর সহিত পর্বতের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। তাঁকে পুনঃপুনঃ ‘পর্বতের দেবী’ বলা হয়েছে। ভারতেও মাতৃদেবীর পার্বতী, হৈমবতী, বিন্ধ্যবাসিনী প্রভৃতি নাম সে-কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। (৫) উভয় দেশেই ধর্মীয় আচরণ হিসাবে মেয়েরা সাময়িকভাবে তাদের সতীত্ব বিসর্জন দিত। এ সম্পর্কে ভারতে কুলপূজায় অনুরূপ আচরণ লক্ষণীয়। ‘গুপ্তসংহিতা’য় স্পষ্টই বলা হয়েছে—’কুলশক্তিম বিনা দেবী ষো জপেৎ স তু পামর।’ আবার ‘নিরুত্তরতন্ত্রে’ বলা হয়েছে—’বিবাহিতা পতিত্যাগে দূষণম ন কুলাচনে। এসব ছাড়া, আরও সাদৃশ্যের কথা ১৯২৮-৩১ খ্রিস্টাব্দে আমি আমার অনুশীলনের প্রতিবেদনে বলেছিলাম। (‘ক্যালকাটা রিভিউ’, এপ্রিল-মে ১৯৩১ দ্রষ্টব্য)।
দশ
বাঙালীরা যে মাত্র মধ্য-প্রাচীতেই শক্তিপূজার বীজবপন করেছিল, তা নয়। তারা শক্তিপূজা ভূমধ্যসাগরের সুদূর ক্রীটদ্বীপ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। কেননা, ক্রীটদেশেও মাতৃদেবীর বাহন ছিল সিংহ। আগেই বলেছি, ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় আমি ক্রীটদেশে প্রচলিত লিপি ও বাঙলার পাঞ্চমার্কযুক্ত মুদ্রায় উৎকীর্ণ লিপি পাশাপাশি রেখে উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য দেখিয়েছিলাম। তা ছাড়া, ক্রীটদেশের অভিজাত সম্প্রদায়ের মেয়েরা দেহের উপর অংশ অনাবৃত রাখত। বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামসূত্র’ গ্রন্থে বলেছেন যে, পূর্ব-ভারতের রাজমহিষীরা তাঁদের দেহের উপর অংশ অনাবৃত রাখেন। ক্রীট দেশের সঙ্গে বাঙলাদেশের যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল, তা পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত ক্রীটদেশীয় লিপি-পদ্ধতিতে লিখিত এক চক্রাকার সীলমোহর থেকে জানতে পারা যায়।
অতি প্রাচীনকালে ভূমধ্যসাগরে যে বাঙালী বণিকদের উপনিবেশ ছিল, তা আমরা অন্য সূত্র থেকেও জানতে পারি। ভেলেরিয়াস ফ্লাকাস তাঁর ‘আরগনটিকা’ পুস্তকে লিখে গেছেন যে গঙ্গারিডি দেশের বাঙালী বীরেরা কৃষ্ণসাগরের উপকূলে ১৫৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (ঋগ্বেদ রচয়িতা নর্ডিক আর্যদের পঞ্চনদে এসে উপস্থিত হবার সমসাময়িককালে) কলচিয়ান ও জেসনের অনুগামীদের সঙ্গে বিশেষ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। এরই প্রতিধ্বনি করে ভার্জিল তাঁর ‘জর্জিকাস’ নামক কাব্যে লিখে গেছেন যে গঙ্গারিডির বাঙালী বীরদের শৌর্য-বীর্যের কথা ‘আমি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখব।’ এ সকল বাঙালীদের সেখানে উপনিবেশ ছিল, এবং সেখানে তাঁরা শিবের আরাধনা ও কালীর পূজা করতেন।
এগারো
মহেঞ্জোদারোয় আমরা হস্তীর প্রতিকৃতি পেয়েছি। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে নিবদ্ধ কিংবদন্তী অনুযায়ী হস্তী প্রাচ্যভারতের পালকাপ্য মুনি কর্তৃক বশীভূত জন্তু। তিনিই হস্তীকে প্রথম বশ করেন ও হস্তিবিদ্যা সম্বন্ধে একখানা গ্রন্থ রচনা করেন। পালকাপ্য মুনি নিজের যে পরিচয় দিয়েছেন, তা হচ্ছে—’হিমালয়ের নিকটে যেখানে লৌহিত্য নদ সাগরাভিমুখে যাইতেছে সেখানে সামগায়ন নামে এক মুনি ছিলেন; তাঁহার ঔরসে ও এক করেণুর গর্ভের আমার জন্ম। আমি হাতীদের সহিত বেড়াই, তাহারাই আমার আত্মীয়, তাহারাই আমার স্বজন। আমার নাম পালকাপ্য।’ সুতরাং পালিত পশু হিসাবে হাতীর আদিম নিবাস বাঙলাদেশ। মহেঞ্জোদারোয় হাতীর উপস্থিতি বাঙলাদেশের সঙ্গে ওই সভ্যতার সম্পর্ক সূচিত করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মহেঞ্জোদারোর ওই হাতীর প্রতিকৃতির সঙ্গে প্রাচীন বাঙলার পাঞ্চ-মার্কযুক্ত মুদ্রায় উৎকীর্ণ হাতীর বিশেষ মিল আছে।
আরও অনেক জিনিস সিন্ধু উপত্যকায় বাঙালীরা নিয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়। তার মধ্যে ছিল চাউল ও মৎস্য ধরবার বড়শি। চাউল ও মৎস্য- এ দুই-ই বাঙালীর প্রিয় খাদ্য। ধান্যের চাষ যে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের কোন জায়গায় শুরু হয়েছিল এ সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। কারলো চিপোলো তাঁর ‘দি ইকনমিক হিস্ট্রি অফ ওয়ার্লড পপুলেশন’ পুস্তকে এই মত প্রকাশ করেছেন। পরেশ দাশগুপ্ত ‘একস্ক্যাভেশনস অ্যাট পাণ্ডুরাজার ঢিবি’ বইয়েও বলেছেন যে ধান্যের চাষ বাঙলাতেই শুরু হয়েছিল, এবং বাঙলা থেকে তা চীন দেশে গিয়েছিল।
পশুপালন ও চাষবাস মানুষকে বাধ্য করেছিল স্থায়ী বসতি স্থাপন করতে। এর ফলেই গ্রাম্য-সভ্যতার পত্তন ঘটে। এটা নবোপলীয় যুগেই প্রথম আরম্ভ হয়। কেননা, প্রত্নোপলীয় যুগের লোকেরা যাযাবরের জীবন যাপন করত। সুতরাং সভ্যতার সূচনা কোথায় হয়েছিল, এ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে হলে, আমাদের প্রথমে নির্ণয় করতে হবে, নবোপলীয় সভ্যতা উৎপত্তিকেন্দ্র কোথায় ছিল। কিছুদিন আগ পর্যন্ত পণ্ডিতমহলে (অবশ্য এখনও অনেক পণ্ডিত এই ভ্রান্ত মত পোষণ করেন) যে মত প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল, তা হচ্ছে আজ থেকে প্রায় আট-নয় হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচীর জারমো, জেরিকো ও কাটাল হুয়ুক নামক স্থানসমূহেই নবোপলীয় সভ্যতার প্রথম উন্মেষ ঘটে, এবং তা বিকশিত হয়ে ক্রমশ ইরানীয় অধিত্যকা ও মধ্য এশিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু আরও পরেকার আবিষ্কারের ফলে জানা গিয়েছে যে, তার চেয়ে আরও আগে নবোপলীয় সভ্যতার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল থাইল্যাণ্ডে। এ সভ্যতার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন রোনালড্ শিলার। সি. ও. সয়ার তাঁর ‘এগ্রিকালচারাল অরিজিনস্ অ্যান্ড ডিসপারসাল’ নামক গ্রন্থেও বলেছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই নবোপলীয় বিপ্লবের সবচেয়ে প্রাচীন লীলাভূমি ছিল বলে মনে হয়।
বারো
নবোপলীয় সভ্যতার পরের যুগেই তাম্রাক্ষ্ম সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটে। হরপ্পা নগরীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে, আমরা নবোপলীয় যুগ থেকে শুরু করে পরিণত তাম্রাক্ষ্ম সভ্যতার বিকাশের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করি। মধ্যপ্রাচীতে এবং থাইল্যাণ্ডে যেমন স্বতন্ত্রভাবে নবোপলীয় সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটেছিল, সেরূপ ভারতেও নবোপলীয় সভ্যতা স্বতন্ত্রভাবেই উদ্ভূত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্রত্নোপলীয় যুগ থেকে নবোপলীয় যুগ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতা আমরা ভারতেও লক্ষ্য করি। এ ধারাবাহিকতা আমরা বাঙলাদেশেও লক্ষ্য করি। প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহ আমরা বাঙলার নানাস্থান থেকে পেয়েছি। সেই সকল স্থানের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে—মেদেনীপুর জেলার অরগণ্ডা, শিলদা, অষ্টজুড়ি, শহারি, ভগবন্ধ, কুকড়াধুপি, গিডনি ও চিলকিগড়; বাঁকুড়া জেলার কাল্লা লালবাজার, মনোহর, বন অসুরিয়া, শহরজোড়া, কাঁকড়াদাড়া বাউড়িডাঙা, ঝাড়গ্রাম, শুশুনিয়া ও শিলাবতী নদীর প্রশাখা জয়পান্ডা নদীর অববাহিকা; বর্ধমান জেলার গোপালপুর, সাতখনিয়া, বিলগভা, সাগরডাঙা, আরা ও খুরুপির জঙ্গল। পুরুলিয়ার ঝালদা অঞ্চলে হেলামু গুহার আশপাশ থেকে পাওয়া গিয়েছে প্রত্নোপলীয় যুগের মানুষের আয়ুধ। বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় ময়নামতী থেকে নয় কিলোমিটার দক্ষিণে লালমাই পাহাড়ের মধ্য প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহার করা ৫০টির ওপর প্রত্নবস্তু পাওয়া গিয়েছে। বাঁকুড়া জেলায় শুশুনিয়া থেকে আমরা যে সকল জীবের অশ্মীভূত কঙ্কালাস্থি পেয়েছি তার গুরুত্ব এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি। এগুলি প্লাইস্টোসীন যুগের, তার মানে যে-যুগে পৃথিবীতে প্রথম মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল। আগের অধ্যায়েই বলেছি যে মানুষের বিবর্তন ঘটেছিল পূর্বগামী নরাকার জীব থেকে। এরূপ নরাকার জীবের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন আমরা পেয়েছি এশিয়ার তিন জায়গা থেকে। এই জায়গাগুলি হচ্ছে ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত শিবালিক গিরিমালা, ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও চীনদেশের চুংকিঙ। এই তিনটি বিন্দু সরলরেখার দ্বারা সংবদ্ধ করলে যে ত্রিভুজের সৃষ্টি হয়, বাঙলাদেশ তার কেন্দ্রস্থলে পড়ে। সুতরাং এরূপ জীবসমূহ যে বাঙলাদেশেও ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। এই সকল জীব থেকেই প্রকৃত মানবের (homo sapiens) বিবর্তন ঘটেছে। সুতরাং বাঙলদেশেও প্রকৃত মানবের যে বিবর্তন ঘটেছিল, সে অনুমান আমি অনেক আগেই করেছিলাম। সম্প্রতি আমার এই অনুমান সমর্থিত হয়েছে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের দ্বারা। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মেদিনীপুর জেলার রামগড়ের অদূরে কংসাবতী নদীর বামতটে অবস্থিত সিজুয়া নামক স্থান থেকে এক মানব চোয়ালের অশ্মীভূত ভগ্নাংশ পায় (নির্ণীত বয়স ১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। আজ পর্যন্ত প্রাচীন প্রকৃত মানবের অশ্মীভূত যত নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রাচীন। সুতরাং হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর অনেক পূর্ব থেকে বাঙলাদেশে যে প্রকৃত মানব বাস করত এবং তারা প্রত্নোপলীয় যুগের কৃষ্টির ধারক ছিল, তা প্রমাণিত হচ্ছে।
আগেই বলেছি যে প্রত্নোপলীয় যুগ ও নবোপলীয় যুগের মধ্যকালীন যুগের কৃষ্টিকে মেসেলিথিক (mesolithic) কালচার বলা হয়। মেসোলিথিক কৃষ্টির প্রচুর নিদর্শন ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৫৪-৫৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার বীরভানপুর থেকে আবিষ্কার করেছিল।
মেসোলিথিক যুগের পরেই নবোপলীয় যুগের উদ্ভব হয়েছিল। এই যুগেই মানুষ প্রথম কৃষি, পশুপালন, বয়ন, মৃৎপাত্র নির্মাণ ও স্থায়ী বসবাস শুরু করেছিল। নবোপলীয় যুগের বৈশিষ্ট্যমূলক আয়ুধ ছিল মসৃণ পরশু। এরূপ পরশু আমরা পেয়েছি বাঁকুড়া জেলার বন অসুরিয়া, কাচিন্তা ও জয়পাণ্ডার; মেদেনীপুর জেলার অরগণ্ডা, কুকড়াধুপি, তারাফেনি, দুলুঙ নদীর মোহনায় ও কংসবতী নদীর অববাহিকায় কাঁকড়াদাড়া থেকে। নবোপলীয় যুগের পরশু আমরা উত্তরে দার্জিলিঙ জেলার কালিমপঙ থেকেও প্রচুর পরিমাণে পেয়েছি। সুতরাং প্রত্নোপলীয় যুগ থেকে নবোপলীয় যুগের বিবর্তন যে বাঙলাদেশে স্বাভাবিকভাবেই ঘটেছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।
নবোপলীয় যুগের গ্রামীণ সভ্যতাই পরবর্তীকালে তাম্রাশ্মযুগের নগরসভ্যতায় বিকশিত হয়েছিল। যেহেতু তামার সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার বাঙলাদেশেই ছিল, তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, এই বিবর্তন বাঙলাদেশেই ঘটেছিল, এবং বাঙলার বণিকরাই অন্যত্র তামা সরবরাহ করে সেসব জায়গায় তাম্রাশ্মযুগের নগরসভ্যতা গঠন সাহায্য করেছিল। এটা মেদিনীপুরের লোকদের দ্বারা সাধিত হয়েছিল। মেদিনীপুরের লোকেরা যে সামুদ্রিক বাণিজ্যে বিশেষ পারদর্শী ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে ওই জেলার পান্না গ্রাম থেকে। ওই গ্রামে (ঘাটালের ছয় মাইল দক্ষিণে) এক পুষ্করিণী খননকালে, ৪৫ ফুট গভীর তল থেকে পাওয়া গিয়েছে সমুদ্রগামী এক নৌকার কঙ্কালাবশেষ।
তেরো
বাঙলায় যে এক বিশাল তাম্রাশ্ম সভ্যতার অভুদ্যয় ঘটেছিল, তা আমরা খন্ড খন্ড আবিষ্কারের ফলে জানতে পারি। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থানার আগাইবনিতে ৪০ ফুট গভীর মাটির তলা থেকে আমরা পেয়েছিলাম তামার একখানা সম্পূর্ণ পরশু ও অপর একখানা প্ৰমাণ সাইজের পরশুর ভাঙা মাথা, ছোট সাইজের আধভাঙা আর একখানা পরশু, এগারোখানা তামার বালা এবং খানকতক ক্ষুদ্রকায় তামার চাঙারী। পুরাতাত্ত্বিক দেবকুমার চক্রবর্তীর মতে এগুলি হরপ্পার পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক কোন মানব-গোষ্ঠীর। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে মেদেনীপুরের বিনপুর থানার অন্তর্গত তামাজুড়ি গ্রামেও তাম্রপ্রস্তর যুগের অনুরূপ নিদর্শনসমূহ পাওয়া গিয়েছে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ওই জেলারই এগরা থানার চাতলা গ্রামে আরও এই ধরনের কিছু নিদর্শন মেলে। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে পার্শ্ববর্তী জেলা পুরুলিয়ার কুলগড়া থানার হাড়া গ্রামেও কিছু কিছু ওই ধরনের নিদর্শন পাওয়া যায়। অনুরূপ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আজ থেকে ত্রিশ বছর পূর্বে মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলার পাণ্ডিগাঁয়ে পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর অন্তর্ভুক্ত ছিল ঠিক আগাইবনির ধরনের ৪৭টি তামার বালা ও পাঁচটি পরশু। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার পরিযান (migration) পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে ঘটেছিল।
আগেই বলেছি যে বাঙলার তাম্রাক্ষ্ম সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে বর্ধমান জেলার অজয়নদের তীরে অবস্থিত পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে। অজয়, কুনুর ও কোপাইনদীর উপত্যকার অন্যত্রও আমরা এই সভ্যতা পরিচয় পাই। পাণ্ডুরাজার ঢিবির দ্বিতীয় যুগের লোকেরাই তামা সভ্যতার বাহক ছিল। তারা সুপরিকল্পিত নগর ও রাস্তাঘাট তৈরি করত। তারা গৃহ ও দুর্গ— এই উভয়ই নির্মাণ করতে জানত। তারা তামার ব্যবহার জানত। কৃষি ও বৈদেশিক বাণিজ্য তাদের অর্থনীতির প্রধান সহায়ক ছিল। তারা ধান্য ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন করত এবং পশুপালন ও কুম্ভকারের কাজও জানত। পূর্ব-পশ্চিম দিকে শয়ন করিয়ে তারা মৃত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করত এবং মাতৃকাদেবীর পূজা করত।
এসব নিদর্শন থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সুদূর অতীতে পুরুলিয়া মেদিনীপুর- বাঁকুড়া-বর্ধমান অঞ্চল জুড়ে এক সমৃদ্ধিশালী তাম্রাশ্ম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
খণ্ড খণ্ড আবিষ্কারের ফলে আমরা সেই লুপ্ত সভ্যতার মাত্র সামান্য কিছু আভাস পাই। তাম্রাশ্মযুগ থেকেই বাঙালী ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল। এ বাণিজ্য খ্রিস্টজন্মের পর পর্যন্ত বলবৎ ছিল এবং আমরা তার বহুল প্রমাণ পূর্ব মেদিনীপুর ও চব্বিশ পরগনায় পেয়েছি। আজ যদি আমরা হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, কারিবঙ্গান প্রভৃতি স্থানের ন্যায় প্রণালীবদ্ধভাবে রীতিমতো খননকার্য চালাই, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই জানতে পারব যে, তাম্রাক্ষ্ম সভ্যতার উন্মেষ বাঙলাদেশেই ঘটেছিল ও বাঙলাই এ সভ্যতার জন্মভূমি ছিল।