বাঙালীর ধর্মীয় চেতনার প্রকাশ

বাঙালীর ধর্মীয় চেতনার প্রকাশ

বর্ধমান জেলার উত্তরে ত্রিভুজাকার যে ভূখণ্ড আজ বীরভূম নামে পরিচিত, তাকে আমরা বাঙলার ধর্মীয় সাধনার ‘যাদুঘর’ বলে অভিহিত করতে পারি। বহু ধর্মেরই এখানে প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এবং বীরভূমের বিচিত্র ভূপ্রকৃতি তার সহায়ক হয়েছে। পশ্চিমে বিন্ধ্যপর্বতের পাদমূল থেকে যে তরঙ্গায়িত মালভূমি পূর্বদিকে ভাগীরথীস্নাত পলিমাটির দেশের দিকে এগিয়ে গিয়েছে, তা বীরভূমকে বিভক্ত করে দিয়েছে দুই ভাগে—পশ্চিমে বনজঙ্গল পরিবৃত রুক্ষ ও কর্কশ অঞ্চল ও পূর্বে কোমল রসাল সমতলভূমি। বীরভূমের বনজঙ্গলের মধ্যেই ছিল বহু মুনি-ঋষির তপোবন। যেমন ভাণ্ডীরবনে ছিল বিভান্ডক-ঋষির আশ্রম, শিয়ানে ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষির, শীতলগ্রামে সন্দীপন ঋষির, গর্গমুনির ও দুর্বাসা মুনির। বন-জঙ্গলের শাশ্বত নির্জনতা বীরভূমকে গড়ে তুলেছিল শাক্তধর্মীয় সাধনার প্রকৃষ্ট ক্ষেত্ররূপে। এজন্যই শাক্তধর্মের লীলাকেন্দ্র হিসাবে বীরভূমের প্রসিদ্ধি। বস্তুত শাক্তধর্মের লীলাকেন্দ্র হিসাবে বীরভূমের (এডু মিশ্রের উক্তি অনুযায়ী এর নাম ছিল কামকোটি) তুলনা আর কোথাও নেই। তন্ত্রবর্ণিত মহাপীঠসমূহের মধ্যে বীরভূমে যত মহাপীঠ আছে, তত মহাপীঠ বাঙলায় তো দূরের কথা, ভারতের আর কোথাও নেই। বীরভূমের প্রায় প্রত্যেক শহরের কাছেই সতীর দেহাংশের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি করে শাক্তপীঠ আছে। যথা বক্রেশ্বর, কঙ্কালীতলা, লাভপুর, ফুলবেড়িয়া, নলহাটি, বৈদ্যনাথধাম (১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে বীরভূমের অন্তর্ভুক্ত ছিল), তারাপীঠ ইত্যাদি। এদের মধ্যে তারাপীঠের সিদ্ধপীঠই প্রসিদ্ধ।

আবার বীরভূমের কোমল অঞ্চলসমূহে গড়ে উঠেছিল মধুর বৈষ্ণবধর্মের পুণ্যস্থানসমূহ; যথা জয়দেবের কেঁদুলি, চণ্ডীদাসের নানুর একচক্রাপুরের নিত্যানন্দ প্রভুর সাধনক্ষেত্র ইত্যাদি।

বীরভূমের গ্রামাঞ্চলসমূহে গ্রামদেবতা ধর্মরাজের পূজারও বহুল প্ৰচলন আছে। এ ছাড়া, মনসাদেবীর পূজার উদ্ভব বীরভূমেই হয়েছিল বলে মনে হয়। বাউল সম্প্রদায়ের প্রাদুর্ভাবও বীরভূমে খুব বেশি।

জৈনধর্মের উত্থানও বীরভূমের আশেপাশেই ঘটেছিল, কেননা, মহাবীরের পূর্বগামী কুড়ি জন তীর্থঙ্করকে সুমেতশিখর বা পরেশনাথ পাহাড়ে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। পরেশনাথ পাহাড় বীরভূমের সীমান্তরেখা থেকে মাত্র ৭০ মাইলের মধ্যে। সুতরাং এ সকল তীর্থঙ্কর যে বীরভূমের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। হয়তো, মহাবীরের মতো তাঁরাও বীরভূমে এসেছিলেন। মহাবীর যখন বীরভূমে এসেছিলেন, তখন এর নাম ছিল বজ্জভূমি। বোধ হয়, মাটির কঠিনতার জন্যই একে বজ্জভূমি (বা বজ্ৰভূমি) বলা হত।

বীরভূমের নানা জায়গা থেকে পাওয়া গিয়েছে বৌদ্ধ বজ্রযান। (বা কালযান) দেবদেবীর মূর্তি। এ থেকে বীরভূমে বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাবও বোঝা যায়। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাব বিশেষ করে ঘটেছিল পালারাজগণের আমলে। সেটা খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর ব্যাপার। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে বীরভূমের সম্পর্ক, একেবারে বুদ্ধের জীবনকাল থেকে। কেননা, বৌদ্ধগ্রন্থ “দিব্যাবদান’ থেকে আমরা জানতে পারি যে, গৌতম বুদ্ধ বীরভূম অতিক্রম করেই পুণ্ড্রবর্ধন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে বীরভূম যে মৌর্যসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। কেননা, তারনাথ তাঁর ‘বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন যে কিংবদন্তী অনুযায়ী সম্রাট অশোকের পিতা বিন্দুসারের জন্ম হয়েছিল গৌড়দেশে। এছাড়া, মহাস্থানের এক লিপি থেকেও আমরা জানতে পারি যে, পুণ্ড্রবর্ধন তখন মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক উয়াং চুয়াং বীরভূম অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখে গিয়েছেন যে, সে সময় বীরভূমের বহু বৌদ্ধবিহার ছিল। বস্তুত বাংলাদেশ মুসলমান কর্তৃক বিজিত হওয়ার সময় পর্যন্ত, বীরভূমে এই সকল বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব ছিল। বাঙলা বিজয়ের সময় মুসলমানগণ রাজমহলের পথ দিয়ে বীরভূমের ওপরই প্রথম ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা বৌদ্ধদের মঠ, বিহার ও মূর্তিসমূহ ধ্বংস করায়, বৌদ্ধরা তিব্বত, নেপাল ও চট্টগ্রামে পালিয়ে যায়। তখন থেকেই বীরভূমের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের ছেদ ঘটে।

দুই

আমরা আগেই বলেছি যে, বীরভূম হচ্ছে তন্ত্রধর্মের লীলাকেন্দ্র। তান্ত্রিক সাধন-সদৃশ ধর্মপদ্ধতি পূর্বভারতের প্রাক্-বৈদিক জনগণের মধ্যেই ছিল, এবং উহাই ‘ব্রাত্যধর্ম’ বা তৎসদৃশ কোন ধর্ম হবে। পরে বৌদ্ধ ও হিন্দুরা যখন উহা গ্রহণ করেছিল, তখন তারা দার্শনিক আবরণে তাকে মণ্ডিত করেছিল। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের ওপর অনার্য-সম্প্রদায় যে এক গভীর ছাপ রেখে গিয়েছে, তা আমরা পর্ণশবরী, জাঙ্গুলী, চোরী, বেতালী, ঘস্মরী, পুক্কসী, শবরী, চণ্ডালী, ডোম্বী ইত্যাদি বজ্রযানমণ্ডলের দেবীগণের নাম থেকেই বুঝতে পারি।

তিন

দেবীর দেহাংশের ওপর প্রতিষ্ঠিত একান্ন পীঠের অন্যতম পীঠ বক্রেশ্বর। শাক্ত পীঠস্থানসমূহের উৎপত্তি সম্বন্ধে, ‘পীঠনির্ণয়’-তন্ত্রে যে বর্ণনা আছে, সেই বর্ণনা অনুযায়ী এখানে দেবীর ভ্রমধ্য পতিত হয়েছিল। কিন্তু ‘শিবচরিত’ অনুযায়ী এখানে পড়েছিল দেবীর দক্ষিণবাহু। অষ্টাবক্র মুনি এখানেই তাঁর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাঁর সাধনায় প্রীত হয়ে শিব তাঁকে বর দিয়েছিলেন—’আজ থেকে আমার ভক্তগণ এখানে আমার পূজা করবে এবং তোমার নাম অনুযায়ী এর নাম হবে বক্রেশ্বর।

বক্রেশ্বরের সঙ্গে অষ্টাবক্র মুনির সম্পর্ক সম্বন্ধে দুটি প্রবাদ-কাহিনী প্রচলিত আছে। একটি কাহিনী অনুযায়ী সত্যযুগে বিষ্ণু নরসিংহরূপে হিরণ্যকশিপুকে বধ করে ব্রহ্মহত্যার পাপে লিপ্ত হন, এবং তাঁর হস্তপদযুগে ভীষণ জ্বালা উপস্থিত হয়। অষ্টাবক্র মুনি বিষ্ণুর এই জ্বালা নিজ মস্তকে ধারণ করলে, তিনি জ্বালা থেকে মুক্তি পাবার জন্য মুনিকে বক্রেশ্বর শিবের মস্তক স্পর্শ করতে বলেন, এবং ভারতের সকল তীর্থের তীর্থবারিকে সুড়ঙ্গপথে প্রবাহিত হয়ে তাঁর মস্তকে পতিত হতে নির্দেশ দেন। এই স্রোতোধারাই ‘পাপহরা’ নামে প্রসিদ্ধ।

অপর কাহিনী অনুযায়ী একদা লক্ষ্মীর স্বয়ংবর সভায় সুণ্বিত ও লোমশ নামে দুই ঋষি নিমন্ত্রিত হন। স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হলে, নিমন্ত্রণ-কর্তা ও দেবরাজ পুরন্দর সর্বাগ্রে লোমশ ঋষিকে বিশেষ সমাদরে গ্রহণ ও আপ্যায়ন করেন। এই দেখে তাঁর সহচর ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে সভাগৃহ ত্যাগ করেন। তিনি এমন ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ হন যে, তাঁর দেহের আট জায়গা বক্রতা লাভ করে। এর ফলে সকলে তাঁকে অষ্টাবক্র নামে অভিহিত করতে থাকে। মনের ক্ষোভে ও অশান্ত হৃদয়ে অষ্টাবক্র নানা জায়গায় পরিভ্রমণ করে অবশেষে কাশী বা বারাণসীতে এসে পৌঁছান। শিবকে তুষ্ট করে তিনি তাঁর দেহের বক্রতা দূর করবার সিদ্ধান্ত নেন। শিব তাঁকে বলেন যে তাঁর প্রার্থনার কোন ফল পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না তিনি পূর্বদিকে গিয়ে গৌড়দেশে গুপ্তকাশীতে শিবের কাছে তাঁর প্রার্থনা জানাচ্ছেন। তখন তিনি বক্রেশ্বরে এসে শিবের উপাসনা করেন। ভক্তের অনন্য সাধারণ সাধনায় তুষ্ট হয়ে, শিব অষ্টাবক্রের বক্রতা দূর করেন, এবং বলেন এখন থেকে যারা এখানে আমার পূজা করবে, তাদেরকে প্রথমেই অষ্টাবক্রের অর্চনা করতে হবে।

সিদ্ধপীঠ হিসাবে বক্রেশ্বর-এর প্রসিদ্ধি। কঠিন কঠিন তান্ত্রিক সাধনার জন্য একসময় উত্তর ভারতের নানা স্থান থেকে সাধকেরা এখানে আসতেন। বহু সাধকের যে এখানে সমাবেশ হত, তার নিদর্শন রয়েছে এক বিশালকায় শমীবৃক্ষের তলে এক উচ্চ প্রকাণ্ড গোলাকার বেদী। ওই বেদীতে বহু সাধক যে একসঙ্গে বসে সাধনা করতে পারতেন, সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। তান্ত্রিক সাধনভজনের জন্য যে সাধক-সাধিকা একসময়ে এখানে বাস করতেন, তারও নিদর্শন রয়েছে মন্দিরের চতুর্দিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ইষ্টকনির্মিত আবাসগৃহসমূহের ধ্বংসাবশেষে। তা থেকে মনে হয় যে, বক্রেশ্বর একসময়ে বীরভূমের বহু জনবহুল ও জনপ্রিয় মহাতীর্থ ছিল।

চার

যদিও উভয় পীঠস্থানই দেবীর দেহাংশের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা হলেও বক্রেশ্বরের ভৈরব যেমন প্রসিদ্ধ, তারাপীঠের ভৈরবী তারাদেবী তেমনই প্রসিদ্ধা। তা ছাড়া বামাক্ষ্যাপার সাধনক্ষেত্র হিসাবেও তারাপীঠ সিদ্ধপীঠ হিসাবে পরিচিত।

প্রথম যখন তারাপীঠে যাই তখন যে জিনিসটা আমাকে প্রথম আকৃষ্ট করেছিল সেটা হচ্ছে যে তারাদেবীর মন্দিরে যেতে হলে, রাস্তা থেকে অনেকগুলি সিঁড়ি ভেঙে তবে মন্দিরের প্রাঙ্গণে উঠতে হয়। তারপর মন্দির-প্রাঙ্গণ থেকে আবার সিঁড়ি ভেঙে মন্দিরের চাতালে (plinth) উঠতে হয়। এই দেখে আমার ধারণা হয়েছিল যে তারাদেবীর মন্দির একসময় কোন এক ছোট পাহাড়ের ওপর স্থাপিত ছিল। স্থানীয় লোকের কাছে এ জিনিসটা অজ্ঞাত। কেননা, অনেককেই প্রশ্ন করেছিলাম, কিন্তু এ-বিষয়ে কেউই আমাকে কোন তথ্য সরবরাহ করতে পারেননি। তারপর কলকাতায় ফিরে এসে পুরাতন রেকর্ডসমূহ অন্বেষণ করে জানতে পারি যে আমার অনুমানই ঠিক। পুরানো রেকর্ডে পরিষ্কার লেখা আছে যে তারাদেবীর মন্দির একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ের (hillock) ওপর অবস্থিত। তবে সত্যই কোন ক্ষুদ্র পাহাড় কি, কোন প্রাচীন বৌদ্ধ স্তূপের ধ্বংসাবশেষ তা বলা কঠিন। কারণ, প্রাচীনকালের ধ্বংসাবশেষ বক্রেশ্বরেও বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখেছি। মনে হয়, সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে তারাপীঠ তারা-সাধনার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। আগেকার দিনে মহাশ্মশানগুলিই তান্ত্রিক সাধনার প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র ছিল, এবং তারাপীঠ মহাশ্মশানের মধ্যেই অবস্থিত।

তারাপীঠ স্থানটি বহুদিন অপ্রচারিত ছিল। কথিত আছে যে, জয়দত্ত নামে গন্ধবণিক সমাজভুক্ত এক সদাগর দ্বারকানদী দিয়ে বাণিজ্যে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে তাঁর একটি পুত্র ছিল। পুত্রটি পথিমধ্যে মারা যায়। পরে জীবৎকুণ্ডের জল স্পর্শ করালে, ছেলেটি আবার জীবিত হয়। এর কারণ অন্বেষণ করতে গিয়ে, তিনি তারা-মায়ের মূর্তি দেখেন। তখন তাঁরা বিশেষ উপচারে তারা-মায়ের পূজা করেন। পরে সদাগর পীঠস্থানের সংস্কার করেন। সেই থেকেই তারাপীঠের মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়। তবে তারাপীঠের বর্তমান মন্দির নাটোরের মহারানী কর্তৃক নির্মিত হয়। পরে বজ্রবাসী কৈলাসপতি, বামাক্ষ্যাপা ও নাটোরের মহারাজার সাধনক্ষেত্র হিসাবে তারাপীঠের মাহাত্ম্য আরও প্রচারিত হয়।

অনেকেরই বোধ হয় জানা নেই যে, তারাপীঠের গিয়ে তাঁরা তারা- মায়ের যে মূর্তি দেখেন সেটা মায়ের আসল মূর্তি নয়। আসল মূর্তিটি পাথরের তৈরি। তার গঠনশৈলী দেখে মনে হয় যে, মূর্তিটি খ্রিস্টীয় সপ্তম- অষ্টম শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল। এই পাথরের মূর্তিটি ঢাকা দেওয়া আছে, বর্তমান এক খোলস মূর্তির আবরণ দ্বারা। পাথরের মূর্তির রূপও অন্যরূপ। এই পাথরের মূর্তিটি দেখবার সুযোগ সকলের ঘটে না। বাহ্যিক মূর্তিটি উন্মোচন করা হয়, মাত্র দেবীকে স্নান করাবার সময়। সেই সময় পাথরের মূর্তিটিকে স্নান করানো হয়। মাত্র দু-একজন বিশিষ্ট যাত্রীকে মায়ের আসল মূর্তিটি দর্শন করবার সুযোগ পাণ্ডারা দেয়। পাথরের মূর্তিটি মুণ্ডহীন। মুসলমান আমলে হিন্দুদ্বেষী মুসলমানরা মুণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। দেবী একটি শায়িত মূর্তির ওপর উপবিষ্টা।

তারার প্রথম প্রকাশ পায়, দক্ষযক্ষের পূর্বে যখন দেবী দশমহাবিদ্যা রূপ ধারণ করেন। তারপর বিষ্ণুচক্র দ্বারা ছিন্ন হবার পর দেবীর আটটি দেহাংশ পড়ে বীরভূমে। দেবীর নয়নতারা পড়েছিল চীনেদেশে। বশিষ্ঠমুনি ওই নয়নতারা চীনদেশ থেকে এনে তারাপীঠে স্থাপন করেন, এবং সেখানে তাঁর ধ্যান-জপ করে সিদ্ধিলাভ করেন।

তারার উপাসনা মহাচীনে থেকে আনা হয়েছিল বলে বৌদ্ধ বজ্রযান দেবীকূলে তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল মহাচীনতারা। উগ্রতারা নামেও তাঁকে অভিহিত করা হত।

মনে হয়, বজ্রযান (অপর নাম কালযান বা সহজযান) বীরভূমেই উদ্ভুত হয়েছিল। এই অনুমান যদি সত্য হয়, তাহলে বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্রধর্মের বিকাশ বীরভূমে সমানভাবেই হয়েছিল। সুতরাং তারার ধ্যান- কল্পনায় যে পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান ঘটেছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

পাঁচ

বীরভূমের ন্যায় এত বেশি শাক্তপীঠ আর কোথাও নেই। বক্রেশ্বর ও তারাপীঠে দেবীর দুই দেহাংশ পড়েছিল। বক্রেশ্বরের অদূরে ফুলবেড়িয়ায় পড়েছিল দেবীর দাঁত। সেজন্য ফুলবেড়িয়ায় আছে দেবী দস্তেশ্বরী। ওখানে তাঁর ভৈরব হচ্ছে মহাদেব ফুলেশ্বর। পূর্বদিকে চলে আসুন বোলপুরে। বোলপুরের চার মাইল উত্তর-পূর্বে হচ্ছে কঙ্কালীতলা। ওখানে পড়েছিল দেবীর কঙ্কাল, এখানে আছে বেদী কঙ্কালীর মূর্তি। এখানে তাঁর ভৈরব হচ্ছেন রুরু। কঙ্কালীতলার উত্তরে চলে আসুন লাভপুরে। তার পূর্বপ্রান্তে আছে ফুল্লরা মহাপীঠ। তন্ত্রে তাঁর নাম দেওয়া হয়েছে অট্টহাস। এখানে আছেন দেবী ফুল্লরা ও তার ভৈরব বিশ্বনাথ। কিন্তু ‘প্রাণতোষিণীতন্ত্র’ মতে দেবী চামুণ্ডা ও তাঁর ভৈরব মহানন্দ। এখানে অন্যান্য উপকরণের মধ্যে, সুরা না দিলে দেবীর ভোগ হয় না।

বোলপুরে থেকে পূর্বে চলে যান চণ্ডীদাস নানুরে। এটাও একটা শাক্তপীঠ। সেখানে আছেন দেবী বিশালাক্ষী। শায়িত মহাদেবের নাভিদেশ থেকে উদ্‌গত কমলে দেবী ললিতাসনে আসীনা।

এবার উত্তরে আসুন তারাপীঠের কাছে রামপুরহাটে। রামপুরহাট থেকে উত্তরে চলে যান নলহাটীতে। নলহাটতে পড়েছিল দেবীর কণ্ঠের নলী। এখানে আছেন দেবী ললাটেশ্বরী ও তাঁর ভৈরব মহাদেব।

বস্তুত আমরা বীরভূমের নানা জায়গায় দেখতে পাই দেবীর বিভিন্ন মূর্তি। বক্রেশ্বরে আছেন দেবী মহিষমর্দিনী, ফুলবেড়িয়ায় দস্তেশ্বরী, কঙ্কালীতলায় কঙ্কালী দেবী, লাভপুরে ফুল্লরা, নানুরে বিশালাক্ষী, তারাপীঠে তারাদেবী ও নলহাটীতে ললাটেশ্বরী। বাঙলার অন্যান্য জেলাতেও আমরা দেখতে পাই দেবীর অনেক পীঠস্থান, কিন্তু বীরভূমের মতো দেবীর দেহাংশের দ্বারা পূত এতগুলো পীঠস্থান আর কোথাও পাই না। এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে ভারতে তান্ত্রিক ধর্মবিকাশের ইতিহাসে বীরভূমের একসময় খুব অর্থবহ ভূমিকা ছিল। তান্ত্রিক সাধনার জন্য একটা নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস হচ্ছে নির্জনতা। বীরভূমের প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে আছে সেই নির্জনতা। বীরভূমের এই নির্জনতাই আকৃষ্ট করেছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্রহ্মোপাসনার জন্য তাঁর আশ্রম স্থাপন করতে বোলপুরে।

বীরভূমে যে মাত্র দেবীর পীঠস্থানেরই ছড়াছড়ি তা নয়। বীরভূমে হচ্ছে শিবের দেশ। বীরভূমের মাঠে ঘাটে, শহরের সন্নিকটে ও শ্মশানে আছে অসংখ্য শিবমন্দির বা শিবস্থান। দক্ষিণ-পশ্চিমে বক্রেশ্বর ও ফুলেশ্বর ছাড়া, আরও অনেক জায়গাতেই শিবঠাকুরকে দেখতে পাওয়া যায়। দুবরাজপুরে, অর্থাৎ যেখান দিয়ে বক্রেশ্বর ও ফুলেশ্বরে যেতে হয়, তারই অনতিদূরে পাহাড়ের পাদমূলে দেখতে পাওয়া যায় এক শিবমন্দিরের ভগ্নাবশেষ। এখানে মহাদেবকে বলা হয় পাহাড়েশ্বর বা পাহাড়ের অধিপতি। এখানে একখণ্ড শিলাই পূজিত হন দেবতার প্রতীকরূপে। কথিত আছে যে, শিলাখণ্ড একসময় পাহাড়ের শীর্ষদেশে ছিল, এবং ভক্তদের পূজা করতে হত পাহাড়ের পদতল থেকে পাহাড়ের শীর্ষদেশস্থ দেবতার দিকে ঊর্ধ্বনয়নে তাকিয়ে। একদিন এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের দিনে শীর্ষদেশস্থ ওই প্রস্তরখণ্ড পড়ল মূল পাহাড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে। তাতে একজন ভক্ত পুরোহিতের প্রাণনাশ ঘটল। এই ঘটনাকে নির্দেশ করে লোকে বলল, মহাদেবের ইচ্ছা পাহাড়ের কোলেই তাঁর এক মন্দির নির্মিত হোক, যাতে ভক্তদের তাঁকে আরাধনা করার জন্য ঊর্ধ্বদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আর ঘাড়ব্যথা করতে না হয়। কথাটা গিয়ে পৌঁছাল দুবরাজপুরের রাজা শঙ্কররাজের কানে। তিনিই ওই ভূপতিত শিলাখণ্ডের ওপর নির্মাণ করে দিলেন এক মন্দির। সেই থেকে শিব নীচের মন্দিরে পুজিত হতে লাগলেন। এ সম্বন্ধে আর এক কিংবদন্তীও প্রচলিত আছে। সেটা হচ্ছে এই যে, শিলাখণ্ড যখন পাহাড়ের শীর্ষদেশে ছিল, তখন এক ভক্তকে প্রতিদিনই পাহাড়ের উপরে উঠে পূজা করতে যেতে হত। যখন তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়লেন এবং তাঁর পক্ষে পাহাড়ের ওপরে ওঠা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল, তখন শিবই একদিন ভূপতিত হয়ে নিজেই নেমে এলেন নীচে ভক্তের পূজা গ্রহণ করবার জন্য। সেই রাত্রিতেই তিনি স্বপ্নে আবির্ভূত হলেন ভক্তের সামনে। তিনি বললেন——তুই বুড়ো হয়ে পড়েছিস, ওপরে উঠতে তোর কষ্ট হচ্ছে, সেজন্য আমি নীচে অবতরণ করেছি, তুই শিগগির আমার এক মন্দির তৈরি করে দে।’

এই যে প্রস্তরখণ্ডসমূহ যাকে আমরা পাহাড় বলছি, তার উৎপত্তি সম্বন্ধে এক কাহিনী প্রচলিত আছে। কাহিনীটি হচ্ছে এই যে, সেতুবন্ধের জন্য রামচন্দ্র যখন হিমালয় থেকে প্রস্তরখণ্ড আনছিলেন, তখন নাড়া পেয়ে কিছু পাথর দুবরাজপুরে পড়েছিল, সেই পাথরগুলো থেকেই এই পাহাড়ের সৃষ্টি হয়েছে।

দুবরাজপুরের ছয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে হচ্ছে ভীমগড়। ভীমগড় অজয় নদের উত্তর তীরে অবস্থিত। বহু প্রাচীনকাল থেকে লোক দেখে এসেছে এখানে এক পুরাতন দুর্গের নিদর্শন। কথিত আছে পঞ্চপান্ডব তাঁদের অজ্ঞাতবাসের সময় কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন এখানে। তাঁরাই স্থাপন করেছিলেন ভীমেশ্বর শিব। অজয়ের দক্ষিণ তীরেও তাঁরা কয়েকটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের নাম অনুসারেই জায়গাটার নাম হয়েছে পান্ডবেশ্বর।

ভীমগড় থেকে পূর্বদিকে চলে আসুন কেন্দুলি গ্রামে। এখানে আছে ফুলেশ্বরের শিবমন্দির। কথিত আছে যে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করবার আগে জয়দেব ছিলেন শাক্ত এবং এই ফুলেশ্বরের মন্দিরেই তিনি নিত্য পূজা করতেন শিবের। উত্তরে চলে যান ময়ুরেশ্বরী নদীর তীরে সিউড়ি শহর থেকে ছয় মাইল উত্তর-পশ্চিমে ময়ূরেশ্বরীর দক্ষিণ তীরে পাবেন ভাণ্ডীরবন। ভাণ্ডীরবনে আছে ভাণ্ডেশ্বর মহাদেবের এক মস্ত বড় মন্দির।

আবার চলে আসুন বোলপুরে। বোলপুরের সন্নিকটেই অবস্থিত সুপুর। সুপুর ছিল সুরথ রাজার রাজধানী। সুপুরে আছে মহাদেব সুরথেশ্বরের মন্দির। কথিত আছে যে, সুরথেশ্বরের মন্দিরেই রাজা সুরথ প্রত্যহ অৰ্চনা করতেন লিঙ্গরূপী মহাদেবের। আর তাঁর ছিল এক প্রসিদ্ধ কালীমন্দির। ওই কালীর কাছেই রাজা সুরথ এক লক্ষ বলি দিয়েছিলেন। যে জায়গাটায় বলি দেওয়া হয়েছিল, সে জায়গাটার নাম হচ্ছে বলিপুর। সেটাই পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয়েছে বোলপুরে।

এ ছাড়া, আদিত্যপুরে আছে কাঞ্চীশ্বর শিব, কোটাসুরে মদনেশ্বর শিব, খর- বোনায় শৈলেশ্বর শিব, জুবুটিয়ায় জপেশ্বর শিব, ডাবুকে ডাবুকেশ্বর শিব, নারায়ণপুরে ‘মল্লেশ্বর শিব, পাইকোড়ে বুড়োশিব, ময়ূরেশ্বরে ময়ূরেশ্বর শিব, মহুলায় মহুলেশ্বর শিব, মুলুকে রামেশ্বর শিব, রসায় আদিনাথ শিব, সাঁইথিয়ায় নন্দিকেশ্বর শিব ও হালিসোটে খগেশ্বর শিব। আরও বহুস্থানে শিবমন্দির আছে, যেমন আঙ্গোরায়, গোহালীআড়ায়, চারকলগ্রামে, জলন্দীতে, তেজহাটিতে, দাসকলগ্রামে, বালিগুনিতে, শেরান্ডীতে ও সুরুলে। আবার অনেক জায়গায় বহুসংখ্যক শিবমন্দির একসঙ্গে আছে, যেমন গণপুরে আছে ৩৭টা, চণ্ডীদাস-নানুরে ১৪টা, দুবরাজপুরে পাঁচটা, পারশুণ্ডীতে সাতটা ও মেহগ্রামে তিনটা।

দেবীর দেহাংশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে-সব শাক্তপীঠের কথা আগে বলেছি, তা ছাড়াও বীরভূমে আরও শাক্তপীঠ আছে। বক্রেশ্বরের উত্তর- পশ্চিমে অবস্থিত নগর বা রাজনগর। নগর ছিল হিন্দু আমলে বীররাজাদের রাজধানী। বীর-রাজাদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলেন কালী। দেবীর অবস্থান এখানে ছিল কোন মন্দিরে নয়, কালীদহ নামে এক হ্রদে। জনশ্ৰুতি যে, দেবী মাঝে মাঝে নিজেকে প্রকাশ করতেন জলের ওপর তাঁর হস্তদ্বয় ও মস্তক প্রদর্শন করে। খুব জাগ্রতা বলে দেবীর প্রসিদ্ধি ছিল। নগরের হিন্দুরাজারা যখন পরাভূত হন এবং নগর যখন মুসলমানদের করাধীনে যায়, তখন একদিন এক ইসলাম ধর্মাবলম্বী লোক গোমাংসের রক্তে রঞ্জিত এক ছুরিকা কালীদহের জলে ধৌত করবার জন্য নিয়ে আসে। এতে কালীদহের জল কলুষিত হয়। হ্রদের উত্তর দিকটা খসে পড়ে ও জলও স্রোতস্বিনী হয়ে খুসকর্ণী নদীতে গিয়ে পড়ে। স্রোতের সঙ্গে ভেসে মা-ও চললেন। মা-কে পাওয়া গেল বীরসিংহপুরে। বীরসিংহপুর হচ্ছে সিউড়ির ছয় মাইল উত্তর-পশ্চিমে, ভাণ্ডীরবন থেকে মাত্র আধ মাইল দূরে। মাকে লোকে বীরসিংহপুরে স্থাপন করে এক মন্দির নির্মাণ করে দেয়। এইভাবে উদ্ভব হয় বীরসিংহপুরের কালীমন্দিরে মায়ের প্রস্তরমূর্তি।

বীরভূমের মানচিত্রের অনেকবার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমান আকারের চেয়ে একসময় বীরভূমের আকার বিশালকায় ছিল। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সাঁওতাল পরগনা বীরভূমেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুর্শিদাবাদের কিছু অংশও বীরভূমের মধ্যে ছিল। ভবিষ্যপুরাণের ব্রহ্মাণ্ডখণ্ডে বলা হয়েছে যে এই অংশের দুই প্রধান তীর্থ ছিল বৈদ্যনাথধাম ও বক্রেশ্বর। বৈদ্যনাথধামও (দেওঘর) এক শাক্তপীঠ। এখানে পড়েছিল দেবীর হৃদয়। দেবী এখানে জয়দুর্গা ও ভৈরব বৈদ্যনাথ।

ছয়

মনে হয় শিবকে ব্যাপকভাবে স্বীকার করে নেবার আগে, আর্যসমাজে ভাগবত-ধর্মের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। ভাগবত-ধর্মের উপাস্য দেবতা হচ্ছেন বিষ্ণু। যাঁরা বিষ্ণুর আরাধনা করেন, তাঁদের বৈষ্ণব বলা হয়। ‘বৈষ্ণব’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে মহাভারতের একেবারে শেষের দিকে (১৮|৬|৯৭–১০৩)। কিন্তু বৈষ্ণবধর্মের মূলতত্ত্ব আমরা বৈদিক সাহিত্যে পাই। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের (৭।১০০।২) এক মন্ত্রে বলা হয়েছে—’হে প্রাপ্তকাম বিষ্ণু, তুমি তোমার সর্বজন হিতকারী দোষ-বিরহিত অনুগ্রহ-বুদ্ধি আমাদিগকে দাও।’ বৈষ্ণবধর্ম ভগবৎ-প্রেমের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তৈত্তিরীয় উপনিষদে (২|৭) বলা হয়েছে—’ভগবান প্রেমস্বরূপ, তাঁকে পেলে আনন্দ লাভ ঘটে।’ মুন্ডক উপনিষদে (৩|২|৩) আছে—’যে যাকে বরণ করে, সেই তাকে লাভ করে।’ ‘ভগবৎপ্রসাদ ব্যতীত তাঁকে পাওয়া যায় না।’ এইসব মূলতত্ত্বের ওপরই বৈষ্ণবধর্ম প্রতিষ্ঠিত।

বুদ্ধের অনেক আগেই ভাগবত-ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কেননা পাণিনি বাসুদেবভক্তদের সম্বন্ধে এক জায়গায় (৪।৩।৯৮) ইঙ্গিত করেছেন। পাণিনির ভাষ্যকার পতঞ্জলিও বাসুদেবের পুজকগোষ্ঠীর কথা বলেছেন। চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় গ্রীক-রাজদূত মেগাস্থিনিস শৌরসেন জাতির (যাঁদের দেশের মধ্যে মথুরা নগরী অবস্থিত ছিল) মধ্যে হেরাক্লিস দেবতার আরাধনার কথা বলেছেন। ‘হেরাক্লিস’ শব্দ মনে হয় ‘হরেকৃষ্ণ’ শব্দের গ্রীক রূপান্তর। পঞ্চম শুঙ্গরাজ ভাগভদ্রের সভায় তক্ষশিলার অধিবাসী হেলিওদোরাস নামক গ্রীকদূত এসে আনুমানিক ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্যপ্রদেশের বেসনগরে এক বিরাট গরুড়ধ্বজ স্থাপন করেন এবং নিজেকে ভাগবত-সম্প্রদায়ের লোক বলে পরিচয় দেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, সে সময় ভাগবত-ধর্ম-তক্ষশিলা। পর্যন্ত বিস্তারলাভ করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষের দিকে বৈষ্ণবধর্ম রাজপুতানাতেও প্রভাব বিস্তার করে। ওই সময় মহারাষ্ট্রেও বৈষ্ণবধর্মের প্রাদুর্ভাব ঘটে। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের মধ্যেই বৈষ্ণবধর্ম পূর্বভারতে বিস্তার লাভ করে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ে মহারাজ চন্দ্রবর্মা চক্রস্বামী বিষ্ণুর পূজার জন্য গুহা ও চক্রচিহ্ন নির্মাণ করে দেয়। পঞ্চম শতকে ত্রৈকূটক রাজ দর্ভসেন ‘পরমবৈষ্ণব’ বলে নিজেকে অভিহিত করেন। ওই সময় সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নিজেকে ‘পরম ভাগবত’ বলে বর্ণিত করেন। কৃষ্ণের উপাসনা ও কৃষ্ণ-সম্পর্কিত যে সকল উপাখ্যান আছে, সেগুলি যে বাঙলা দেশে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর মধ্যেই জনপ্রিয় উঠেছিল, তার প্রমাণ আমরা পাই উত্তরবঙ্গের পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত এক দেবায়তনে। এই দেবায়তনে ভাগবতে বর্ণিত কৃষ্ণলীলার বিভিন্ন পাথরের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।

পালবংশীয় রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ, এবং বৌদ্ধধর্মেরই তাঁরা পরিপুষ্টি সাধন করেছিলেন। পালরাজবংশের অবনতির পর বাঙলায় রাজত্ব করেন সেনবংশীয় রাজারা। তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মী। সেনবংশের রাজত্বকালে খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেনবংশের তৃতীয় রাজা ছিলেন লক্ষ্মণসেন। লক্ষ্মণসেন ‘পরমবৈষ্ণব’, ‘পরমনারসিংহ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং তাঁর সময়ে বৈষ্ণবধর্মের আবার প্রাদুর্ভাব হয়েছিল।

এই লক্ষ্মণসেনেরই রাজসভা অলঙ্কৃত করেছিলেন ‘গীতগোবিন্দ’-এর কবি জয়দেব।

জয়দেবের জন্মস্থান হিসাবে কেন্দুলি বৈষ্ণবদের একটা তীর্থস্থান। জয়দেব এখানে রাধামাধব বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন, এবং একটা মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। তবে কেন্দুলিতে এখন যে মন্দির রয়েছে, তা নির্মিত হয়েছে জয়দেবের অনেক পরে ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের রাজমাতা নৈরানী দেবী কর্তৃক। শ্যামারূপার গড় (সেনপাহাড়ী) থেকে রাধাবিনোদের বিগ্রহ এনে তিনি এখানে প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির এখন নিম্বার্ক সম্প্রদায়ভুক্ত মোহন্তদেব হাতে। নিম্বকরা সমন্বয়বাদী।

প্রতি বৎসর মকর-সংক্রান্তিতে কেন্দুলিতে একটা মেলা বসে। নানান জায়গার বাউলরা এসে এই মেলায় সমবেত হয়। বাউলদের গানই এই মেলার একমাত্র আকর্ষণ।

কেন্দুলির মাইলখানেক পশ্চিমে ছিল সেকালের বেলুরিয়া গ্রাম অনেকেই মনে করেন এই বেলুরিয়া গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ‘শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃতে’র রচয়িতা বিল্বমঙ্গল ঠাকুর। কিন্তু ‘শ্রীভক্তমালগ্রন্থ’ অনুযায়ী বিল্বমঙ্গলের আবাসস্থল ছিল দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণাবেম্বা নদীতীরে।

কেন্দুলি ছেড়ে চলে আসুন পূর্বদিকে বোলপুরে। বোলপুর ভেদ করে আরও পূর্বে প্রায় মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্তে অবস্থিত নানুর গ্রাম। কেন্দুলি যেমন ধন্য হয়েছে জয়দেবের স্মৃতিবহন করে, নানুর তেমনই ধন্য হয়েছে সাধক চণ্ডীদাসকে স্মরণ করে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনার যে পন্থাকে বলা হয় রাগাত্মিক বা সখী অনুগত অথবা পরকীয়া এবং যা রসসাধনা পদ্ধতি বলে পরিচিত, তারই কবি ছিলেন চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাস প্রাক-চৈতন্য যুগের লোক ছিলেন। রসিক কবি হিসাবে তাঁর রচিত পদাবলী বৈষ্ণবসমাজে বিশেষ সমাদৃত।

এবার উত্তরে চলে আসুন একচক্রাপুরে। বৈষ্ণবদের কাছে এটাও একটা পীঠস্থান। এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন চৈতন্যদেবের প্রধান পার্ষদ নিত্যানন্দ মহাপ্রভু নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর জন্মস্থান হিসাবে একচক্রাপুর বৈষ্ণবদের কাছে পুণ্যস্থান।

বীরভূমে বৈষ্ণবদের আরও কয়েকটি পুণ্যস্থান আছে। ভাণ্ডীরবনে আছে গোপালের বিগ্রহ ও মন্দির। এই বিগ্রহ সম্বন্ধে এইরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে যে, একজন সাধক নানা তীর্থ ভ্রমণ করে ভাণ্ডীরবনে এসে পৌঁছান। তাঁর কাছে ছিল গোপালের এক বিগ্রহ। তিনি বিশ্রাম করবার জন্য গোপালটিকে নামিয়ে রাখেন, কিন্তু ওঠবার সময় দেখেন গোপালটিকে আর নাড়ানো যাচ্ছে না। সেই থেকে গোলাপটি ভাণ্ডীরবনে থেকে গিয়েছে।

বীরচন্দ্রপুরে বৈষ্ণবদের দুটি মেলা বসে—একটা কার্তিক মাসে, আরেকটা ফাল্গুন মাসে। এখানে আছে বাঁকারায়ের মন্দির। বীরচন্দ্রপুরের উপকণ্ঠে যমুনার ওপারে হচ্ছে গর্ভাবাস। এ জায়গাটা মহাপ্রভু নিত্যানন্দের জন্মস্থান বলে চিহ্নিত। এর পাশেই হচ্ছে ভদ্রপুর। নিত্যানন্দ সম্বন্ধে নানা কাহিনী এখানে প্রচলিত আছে।

চৈতন্য-উত্তরকালে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম বীরভূমে যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছিল। এর প্রমাণ আমরা পাই বীরভূমের নানা স্থানে অবস্থিত বৈষ্ণব মন্দিরে। এছাড়া, বৈষ্ণব সাধকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি পুণ্যস্থানও আছে।

খ্রিস্টায় সপ্তদশ শতাব্দীতে বীরভূমে চলেছিল এক ঘোরতর দ্বন্দ্ব- বৈষ্ণব ও শাক্তদের মধ্যে। সেজন্যই বোধহয় আমরা বীরভূমের কয়েকটি মন্দিরে বিগ্রহের অভাব দেখি। মনে হয় যে প্রতিপক্ষ সম্প্রদায়ের লোকরা সেগুলি সরিয়ে ফেলেছিল। এরূপ শূন্য মন্দিরের অন্যতম হচ্ছে ইলামবাজার ও কবিলাসপুরের মন্দিরদ্বয়। দুই ধর্মের মধ্যে সমন্বয়সাধনের জন্যই ঠাকুর রামকানাই একদিকে চৈতন্য মহাপ্রভু ও রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি ও অপরদিকে বাণেশ্বর শিব ও অপরাজিতা দেবীর মূর্তি স্থাপন করে, বৈষ্ণব এবং শাক্ত আরাধনার ব্যবস্থা করেছিলেন।

সাত

বীরভূমে গ্রামদেবতারও খুব প্রচলন আছে। বীরভূমের গ্রামদেবতাদের মধ্যে ধর্মঠাকুরের পূজাই সবচেয়ে বড় পূজা। নিম্নকোটির লোকদের মধ্যে, বিশেষ করে বাউরী, বাগদি, হাড়ি, ডোম ইত্যাদি জাতিসমূহের মধ্যেই এই পূজার প্রচলন সবচেয়ে বেশি। ব্রাহ্মণ্যধর্মের দ্বারা এই ধর্ম যদিও প্রভাবান্বিত হয়েছে, তথাপি ডোম জাতির লোকই শিলারূপী ধর্মঠাকুরের পুরোহিত। তবে রাজা-রাজড়ারাও যে একসময় এই পূজা করতেন, তা ‘ধর্মপুরাণ’সমূহ থেকে জানতে পারা যায়।

যে গ্রামে ধর্মঠাকুরের স্থায়ী মন্দির আছে, সেখানে প্রতিদিনই তাঁর পূজা হয়। সে পূজা সম্পুর্ণ আড়ম্বরহীন। তবে যদি কারও ‘মানসিক’ থাকে, তাহলে সেদিন পাঠা বা কবুতর বলি দেওয়া হয়। আবার কোন কোন অঞ্চলে উচ্চবর্ণের হিন্দুর বাড়িতেও শালগ্রাম শিলার পরিবর্তে ধর্মশিলা প্রতিষ্ঠিত আছে। তবে ধর্মঠাকুরের সবচেয়ে বড় পূজা যেটা, সেটা হচ্ছে বাৎসারিক পূজা। এটা সাধারণত বৈশাখী পূর্ণিমায় হয়। তবে কোন কোন জায়গায় চৈত্রী পূর্ণিমা বা জ্যৈষ্ঠী বা আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে ও বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এইরূপ পূজাকে ‘ধর্মের গাজন’ বলা হয়, এবং যাঁরা এই পূজায় সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যা হন, তাঁরা শিবের গাজনের ন্যায় নানা প্রকার আচার-অনুষ্ঠান পালন করেন। ধর্মশিলাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্নান করানো, এই পূজার এক প্রধান অঙ্গ। এটা বারো দিনে সমাপ্ত হয় বলে, একে বলা হয় ‘বারোমতী গাজন’। বারো দিন ধরে নানা আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই গাজন পূজা সম্পন্ন হয়।

আগেই বলা হয়েছে যে ধর্মঠাকুর শিলারূপে পূজিত হয়। সুতরাং ধর্ম- ঠাকুরের ধ্যান কি? তাঁর কল্পিত মূর্তি কি? ধর্মমঙ্গল কাব্যসমূহে ধর্মঠাকুরের যে বর্ণনা আছে, তা থেকে জানতে পারা যায় যে ধর্মঠাকুর নিরাকার ও নিরঞ্জন। তিনি আকারহীন শূন্যময় দেবতা। নিরাকাররূপে কল্পিত হলেও তাঁর বর্ণ হচ্ছে শ্বেত এবং তিনি শ্বেতবর্ণ সিংহাসন বা পর্যঙ্কের উপর আসীন।

এই ধর্মঠাকুর কে? এবং এঁর প্রকৃত পরিচয় কি? এ সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে যথেষ্ট মতভেদ আছে। নানাজনে নানারকম ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ এঁকে বুদ্ধ, কেউ কচ্ছপ, কেউ যম, কেউ সূর্য, কেউ বিষ্ণু, কেউ বরুণ ইত্যাদি নানা আখ্যা দিয়েছেন। তবে দেখতে পাওয়া যায় যে, এঁর পূজার প্রাদুর্ভাব নিম্নশ্রেণীর জাতিগণের মধ্যেই আছে। তাছাড়া, এই পূজার পৌরোহিত্য করবার অধিকার একমাত্র ডোম জাতিরই আছে। বাউরী, বাগদি, হাড়ি, ডোম ইত্যাদি নিম্নজাতির হিন্দুরা যে বাঙলার আদিমবাসিসম্ভূত, এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বীরভূমে একসময় যে বৌদ্ধধর্মের বিশেষ প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল, সে সম্বন্ধেও কোন সন্দেহ নেই। সেজন্য মনে হয়, আজ যেমন এই সকল জাতি পারিপার্শ্বিক হিন্দুধর্মের চাপে পড়ে হিন্দু হয়েছে, তেমনই বৌদ্ধধর্মের প্রচলনের সময় এরা সকলে বৌদ্ধ হয়েছিল। প্রাচীন বৌদ্ধ চর্যাপদসমূহে পুনঃপুনঃ ডোম-ডোমনীর উল্লেখ তার সাক্ষ্য দেয়। আদিবাসী সমাজে গোড়া থেকেই কোন-না-কোন সৃজন-উদ্দীপক ঐন্দ্রজালিক অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। তা থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল পরবর্তীকালের শিব প্রভৃতি দেবতা। সুতরাং মনে হয়, বাউরী, বাগদি, হাড়ি, ডোম প্রভৃতি জাতি বৌদ্ধ হয়ে গেলেও তারা তাদের প্রাচীন দেবতাকে পরিহার করেনি। একসঙ্গেই তারা বুদ্ধ ও সেই আদিম দেবতার আরাধনা করত। সুতরাং বাউরী, বাগদি, হাড়ি, ডোম প্রভৃতি জাতিসমূহ যখন বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন তারা নিরাকার বুদ্ধের সাধনা করত, এবং যেহেতু বুদ্ধ ধর্ম ও সংঘ এই তিনই এক, তারা বুদ্ধকেই ধর্মরাজ বলত। তারপর যখন বৌদ্ধধর্মের পতন ঘটল, তখন তারা আবার হিন্দু হয়ে গেল এবং ধর্মরাজকেই হিন্দুসমাজের মধ্যে টেনে নিয়ে এল। নিরাকার ধর্মরাজ, নিরাকারই রয়ে গেলেন। বৈশাখী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের কাছে অতি পুণ্য তিথি। বুদ্ধের জন্ম ও পরিনির্বাণ ওই তিথিতেই ঘটেছিল। সেজন্য ওই তিথিটাই ধর্মঠাকুরের গাজনের প্রশস্ত দিন। আবার যেখানে আদিম শৈবধর্মের প্রভাব বিদ্যমান ছিল, সেখানে ধর্মরাজের গাজন বৈশাখী-পূর্ণিমার পরিবর্তে শিবের গাজনের সময় চৈত্র মাসেই হত।

গ্রামদেবতা হিসাবে ধর্মঠাকুরের পূজা বীরভূম জেলায় খুব ব্যাপক। বীরভূমের প্রায় প্রতি গ্রামেই ধর্মঠাকুর পূজিত হন। সেজন্য মনে হয় যে ধর্মঠাকুরের প্রায় পূজার উদ্ভব বীরভূম জেলাতেই হয়েছিল এবং সেখান থেকে এর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বর্ধমান, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার কিয়দংশে। এখনও এসব জেলায় ধর্মপূজার যথেষ্ট প্রাদুর্ভাব আছে।

আবার অনেক জায়গায় ধর্মঠাকুর, শিবঠাকুরের সঙ্গেই মিশে গিয়েছে।

আট

বাঙলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো বীরভূমেও গ্রামদেবতা হিসাবে পূজিতা হন মনসা-দেবী মনসা সর্পের দেবতা। সর্পদংশনের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যই মনসাদেবীর পূজা করা হয়। ‘সর্পপূজা’ অতি প্রাচীন অনুষ্ঠান। গৃহ্যসূত্রে এর উল্লেখ আছে। মহেঞ্জোদারো-সভ্যতা এবং ভারহুতের যুগ হতে ভারতের সর্বত্র নাগ-নাগিনী মূর্তি দেখা যায়। নাগমুকুট ও ঘটসহ দেবমূর্তি সাতনা, খিচিং, দিনাজপুর, রাজশাহী এবং অন্যত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। বৃন্দাবন দাস লিখেছেন, চৈতন্যের আবির্ভাবকালে লোকে নানা প্রতিমা নির্মাণ করে ঘটা করে মনসার পূজা করত। আষাঢ়ের কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে ও শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে ঘটে অথবা সিজগাছে কিংবা চালির পিছনে মনসাদেবীর মূর্তি অঙ্কিত করে দুধকলা দিয়ে দেবীর পূজার প্রচলন বঙ্গের নানা স্থানে আছে। পল্লী অঞ্চলে পূজার পর আটদিন ধরে মনসার ভাসান বা অষ্টমমঙ্গলা গীত হয়।

বজ্রযানী বৌদ্ধসমাজেও জাঙ্গুলী নামে এক সর্পদেবীর পূজা, সাধনা, মন্ত্রাদি, বহুল পরিমাণে প্রচলিত ছিল। সর্পদংশন হতে রক্ষা করতে এবং সর্পদংশন করলে তার বিষ নষ্ট করতে জাঙ্গুলী ছিল অদ্বিতীয়া। জাঙ্গুলীর নামে শুনলে সাপ পালিয়ে যায়, এ বিশ্বাস সেকালের বৌদ্ধদের ছিল। তাঁর নাম করলে সাপের বিষ শরীরে সঞ্চারিত হয় না বলেও তাদের বিশ্বাস ছিল। জাঙ্গুলীর মূর্তি-কল্পনা নানারূপে করা হয়েছিল। তাঁর রঙ কখনও শাদা, কখনও হরিৎ, আবার কখনও পীত হত। বৌদ্ধদের মন্ত্র থেকে বুঝতে পারা যায় যে, জাঙ্গুলীর উপাসনা আদিবাসী সমাজ থেকে গৃহীত হয়েছিল। কেননা, নিম্নস্তরের সমাজে সাপের ‘রোজা’রা যে সকল মন্ত্ৰ উচ্চারণ করে, এ মন্ত্র তার অনুরূপ।

লৌকিক পূজা হিসাবে এঁর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য বাঙলাদেশে যে মঙ্গল-কাব্যসমূহ রচিত হয়েছিল, তা থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে মনসাপূজা আদিবাসী সমাজ থেকেই গৃহীত হয়েছিল। কেননা, মানসামঙ্গল কাহিনীতে লখিন্দরের জন্য যে বাসগৃহ নির্মিত হয়েছিল, তা সান্তালী পাহাড়ের ওপর। এর দ্বারা বীরভূমের

এর দ্বারা বীরভূমের পশ্চিম অঞ্চলে সাঁওতাল পরগনাই সূচিত হচ্ছে। এছাড়া মনসামঙ্গল কাব্যে মনসাদেবীর জন্ম সম্বন্ধে যে কাহিনী আছে, তার সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনীর বৈপরীত্যও তাই সূচিত করে। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী ইনি জরৎকারু মুনির স্ত্রী ও আস্তিকের মাতা এবং বাসুকির ভাগিনী। ব্রহ্মার উপদেশে কশ্যপ সর্পমন্ত্র সৃষ্টি করে তপোবলে মন দ্বারা এঁকে মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে উৎপাদন করেন। সেজন্য একে মনসা বা কশ্যপের মানসী কন্যা বলা হয়। (ব্রহ্মবৈবর্ত-পুরাণ)। কিন্তু মনসামঙ্গল কাব্যে ইনি শিবকন্যা। কালিদহে পদ্মপত্রের ওপর এঁর জন্ম। সেজন্য মনসার অপর নাম পদ্মাবতী। শিব ছিলেন আদিবাসী সমাজের দেবতা। সেই হেতু আদিবাসী সমাজের মনসার সঙ্গে শিবের সম্পর্ক।

মনসামঙ্গল কাব্যের দ্বারাই হিন্দুসমাজে মনসাপূজা প্রচলিত হয়। চাঁদসদাগর কর্তৃক এই পূজা প্রবর্তিত হয়েছিল। বীরভূমে গন্ধবণিক সমাজে মনসা পূজা বিশেষভাবে সমাদৃত। তবে সকল সম্প্রদায়ের লোকরাই মনসাপূজা করে। মনসা-পূজার সময় মনসাগাছকে মনসার প্রতীক হিসাবে ধরে নেওয়া হয়, আর তা নয়তো চালির পিছনে অঙ্কিত মনসাদেবীর পূজা করা হয়। বীরভূমের অনেক গ্রামে সর্পাসীনা প্রস্তরমূর্তি বা সিন্দুর লেপিত প্রস্তরখণ্ডও মনসাপূজায় ব্যবহৃত হয়। এই প্রস্তরনির্মিত মনসামূর্তি বা সিন্দুর লেপিত প্রস্তরখণ্ড সাধারণত অশ্বত্থ বা অন্য কোন বৃক্ষমূলে স্থাপিত হয়। কখনও কখনও কোন কুটিরেও এইরূপ মনসামূর্তি পূজিত হয়। কোন কোন জায়গায় মনসার জন্য ছোট দেউলও নিৰ্মিত আছে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বীরভূমের মুরারই থানার অন্তর্গত ভাদীশ্বর গ্রামে একটি প্রস্তরনির্মিত সুন্দর মনসামূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। কোন কোন জায়গায় মন্দির অলঙ্করণের মধ্যেও মনসার প্রতিকৃতি লক্ষিত হয়। ঘুরিষার (শ্রীপুরে) রঘুনাথ জিউরা মন্দিরে ও তারাপীঠের মন্দিরের স্ত ভুগাত্রেও মনসার প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ আছে। চন্দ্রকেতুগড়েও পোড়ামাটির নাগমূর্তি পাওয়া গিয়েছে।

নয়

বীরভূমের ধর্মীয় চেতনা ও নান্দনিক অনুভূতি বিশেষভাবে প্রকাশ পায় মন্দির-গাত্রের অলঙ্করণে। বীরভূমের অনেকগুলি মন্দিরের অলঙ্করণে আমরা রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের দৃশ্যাবলী ও অনেক দেবদেবীর মূর্তির রূপায়ণ দেখতে পাই। এগুলি হয় মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির কাজ দ্বারা, আর তা নয়তো মন্দিরের প্রবেশ-পথের মাথায় স্থাপিত প্রস্তরের ওপর উৎকীর্ণ। এছাড়া, কয়েকটি মন্দিরের প্রবেশপথের নিকট অবস্থিত স্তম্ভের ওপরও অঙ্কিত আছে এইসব দৃশ্য। নানুর থানার অন্তর্গত আঙ্গোরার শিবমন্দিরের প্রবেশপথের মাথার ওপর দেখতে পাই বৃষবাহন শিব ও ষড়ভুজ কৃষ্ণকে; বোলপুর থানার অন্তর্গত আদিত্যপুরের দেউলের প্রবেশপথের উপর এক মৃৎফলকে আমরা দেখি লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, হনুমান ও গণেশকে; বোলপুর থানার অন্তর্গত ইটাণ্ডায় প্রবেশপথের কাছে এক স্তম্ভগাত্রে আমরা দেখি শুম্ভ-নিশুম্ভদলনী চণ্ডী, কালভৈরব, মহিষাসুরমর্দিনী ও কালীকে; ওই থানারই অন্তর্গত ইলামবাজারের হাটতলার মন্দিরগাত্রে দেখি দশমহাবিদ্যা, দশাবতার, রাসমণ্ডল, বামুনপাড়ার লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরের খিলানের উপর দেখি গিরিগোবর্ধন, গোষ্ঠলীলা, রামরাবণের যুদ্ধ ও রামসীতা ও নিকটস্থ অন্য একটি মন্দিরে দেখি অনন্তশায়ী বিষ্ণুকে; নানুর থানার অন্তর্গত উচকরণে সরখেলদের মন্দিরগাত্রে দেখি কৃষ্ণলীলা, গোপিনীসহ কৃষ্ণ, বৃষোপরি শিব-পার্বতী, জটায়ুবধ, সুর্পনখার নাসিকাচ্ছেদন, মহিষাসুরমর্দিনী ও দশমহাবিদ্যা; মহম্মদবাজার থানার অন্তর্গত গণপুরের কালীতলার মন্দিরের খিলানের উপর দেখি রামরাবণের যুদ্ধ, মহিষমর্দিনী, অনন্তশায়ী বিষ্ণু, ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন, কার্তিক, গণেশ, রাসমন্ডল, কৃষ্ণলীলা, কৃষ্ণের জন্ম ও অন্যান্য দেবদেবী ও কিছুদূরে অন্য একটি মন্দিরে দেখি দুঃশাসন কর্তৃক দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ও কৃষ্ণ কর্তৃক দ্রৌপদীকে রক্ষা, সমুদ্রমন্থন, দেবাসুরের মধ্যে মোহিনী কর্তৃক অমৃত বিতরণ, ও গোপিনীগণসহ কৃষ্ণ; বোলপুর থানার অন্তর্গত ঘুরিষায় (শ্রীপুর) রঘুনাথজিউর মন্দিরের দরজার উপরে দেখি বৃষারূঢ় শিব, কালী, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি দশমহাবিদ্যা, রাম-রাবণের যুদ্ধ, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, ত্রিবিক্রম, বলরাম, মনসা, বৃষোপরি শিব-পার্বতী, মহালক্ষ্মী, দুর্গামহিষমর্দিনী, নবনারীকুঞ্জর, রাসমণ্ডল, গজেন্দ্রমোক্ষ, দুর্গা, বিষ্ণু অনন্তশায়ী, কালীয়দমন ও গোচারণে কৃষ্ণ; নানুর থানার অন্তর্গত চণ্ডীদাস-নানুরে কৃষ্ণলীলা, দশাবতার, জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি; বোলপুর থানার অন্তর্গত সুপুর গ্রাম সংলগ্ন চন্দনপুরে রামসীতা, কল্কি, জগন্নাথ, বলরাম, পরশুরাম, ত্রিবিক্রম ও দশমহাবিদ্যা ইত্যাদি; অজয় নদীর তীরে ইলামবাজার থানার অন্তর্গত জয়দেব-কেন্দুলীতে রাধাবিনোদ মন্দিরের মৃৎফলকের উপর দেখি শিব, বিষ্ণু, বায়ু, যম ইন্দ্র প্রভৃতি দিক্‌পাল, দশাবতার, জটায়ু কর্তৃক সীতার উদ্ধার, কৃষ্ণলীলার ঘটনাবলী ইত্যাদি; দ্বারকা নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত রামপুরহাট থানার অন্তর্গত তারাপীঠের মন্দিরের খিলানের ওপর দেখি মহিষমর্দিনী, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঘটনাবলী, ভীষ্মের শরশয্যা, ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ কাহিনী, কৃষ্ণলীলা, রামায়ণের ঘটনাবলী, গজলক্ষ্মী ও মনসা; নানুর থানার অন্তর্গত বীরভূমের প্রায় পূর্বসীমানায় অবস্থিত দাসকলগ্রামের শিবমন্দিরের গায়ে দেখি গরুড়বাহনের উপর বিষ্ণু; দুবরাজপুর থানার অন্তর্গত দুবরাজপুরের মন্দিরের প্রবেশপথের খিলানের উপর শিবের কৈলাস আক্রমণের ঘটনাবলী ও অন্যান্য পৌরাণিক দৃশ্যাবলী ও দেবদেবীসমূহ; ময়রাপাড়ার মন্দিরগাত্রে দেখি দশাবতার, অন্নপূর্ণা, শিব, রাম-সীতা, কৃষ্ণলীলা, শিববিবাহ ও ওঝাপাড়ার শিবমন্দিরের দুই পার্শ্বের মৃৎফলকের ওপর রামায়ণের ঘটনাবলী, নরসিংহ অবতার, নারদ ও নৌকাবিহার, খয়রাশোল থানার অন্তর্গত পাথরকুচিতের চারবালা মন্দিরের পাশে দেখি দশাবতার, গণেশ ইত্যাদি; নানুর থানার অন্তর্গত বালিগুনিতে মন্দিরের প্রবেশপথের খিলানের ওপর রাম-রাবণের যুদ্ধের দৃশ্য, গরুড়-বাহনারূঢ় বিষ্ণুর সহিত বৃষারূঢ় পঞ্চানন শিবের সংঘর্ষ; ময়ূরেশ্বর থানার অন্তর্গত মল্লারপুরে কৃষ্ণলীলা, দুর্গা, শিব ইত্যাদি; সিউড়ি থানার অন্তর্গত মহুলায় কৃষ্ণের গাভীদোহন; নলহাটী থানার অন্তর্গত মেহগ্রামে রাম-রাবণের যুদ্ধের দৃশ্যাবলী, দশাবতার, গৌর-নিতাইয়ের প্রতিকৃতি, দুর্গা ও কালী; সিউড়ি থানার অন্ত গত রায়পুরের এক আটচালা মন্দিরের গায়ে বৃষোপরি নন্দীভৃঙ্গীসহ শিব; বোলপুর থানার অন্তর্গত শেরান্ডীতে রাধাকৃষ্ণ ও শিবের প্রতিকৃতি; সিউড়িতে মাকড়া পাথরের তৈরি ‘ঘুনসা’ মন্দিরের দরজার খিলানের ওপর কালীয়দমন, নৃত্যরত শ্রীকৃষ্ণ, রাসমণ্ডল, বস্ত্রহরণ, রাধাকৃষ্ণ, অনন্তশায়ী বিষ্ণু, বাহনোপরি ব্রহ্মা, বায়ু, ইন্দ্র, কার্তিক, গণেশ ইত্যাদি; বোলপুর থানার অন্তর্গত সুপুরে ‘শ্যামসায়রে’র দক্ষিণে অবস্থিত মন্দিরে দশাবতার ও কৃষ্ণলীলা,গৌরাঙ্গ-নিত্যানন্দের প্রতিকৃতি ও ওই থানারই অন্তর্গত সুরুলের লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দিরের গায়ে দেখি রামায়ণের ঘটনাবলী, রাম-রাবণের যুদ্ধ, অশোকবনে চেড়ী পরিবৃতা সীতা, মহিষাসুরমর্দিনী, ভগীরথ কর্তৃক গঙ্গা আনয়ন, পার্বতী ও গণেশ, রামসীতা ইত্যাদি; দুবরাজপুর থানার অন্ত গত হেতমপুরের চন্দ্রনাথ মন্দিরের গায়ে গণেশজননী, জগদ্ধাত্রী, গজলক্ষ্মী, ও দেওয়ানজী শিবমন্দিরের ওপর রামসীতা, গোপিনীগণসহ শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণের মথুরাযাত্রা ও অন্যান্য পৌরাণিক দশ্যাবলী। এছাড়া, অনেক মন্দিরের গায়ে তৎকালীন সামাজিক ও সাধারণ জীবনাযাত্রার চিত্রও রূপায়িত আছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে মন্দিরগাত্রে এরূপ অলংকরণ বাঙলার অন্যান্য সব জেলার মন্দিরেই আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *