বাঙালীর জীবনচর্যার বিবর্তন

বাঙালীর জীবনচর্যার বিবর্তন

এখন বাঙালীর জীবনাত্রা-প্রণালী, ঘরবাড়ি, খাদ্যখাদ্য, পোশাক-আশাক ও মেয়েদের অলঙ্কার-ভূষণ প্রভৃতির বিবর্তন সম্বন্ধে কিছু বলা যাক। প্রাচীন বাঙলার গ্রামের লোক বাস করত এখনকার মতোই কুঁড়ে-ঘরে। মাটির দেওয়াল গড়াই বাঙলাদেশের রীতি। অনেক জায়গায় ছ্যাঁচা বাঁশের বেড়া তৈরি করে তার দুপিঠে মাঠি লেপেও দেওয়া হত। পূর্ববঙ্গের লোকেরা অনেক জায়গায় তলতা-বাঁশ চিরে সুন্দর টাটি বুনে তা দিয়ে দেওয়াল করে, এবং অনুমান করা যেতে পারে যে, প্রাচীন কালেও করত। বাঙলাদেশে অধিকাংশ স্থানেই খড় বা ছনের চাল দেওয়া হয়। তবে হাওড়া, হুগলী প্রভৃতি জেলায় খোলার চালেরও প্রচলন আছে। পশ্চিম বাঙলার রীতি হচ্ছে ঘরের চালকে হাতির পিঠের মতো কতকটা গোলাকার করা। একে চালে ‘রাগ’ দেওয়া বা ‘কোর’ দেওয়া বলা হয়। সাধারণত কুটিরগুলি চারচালা হয়। মোট কথা, কুটিরগুলিকে চালু করা হয় যাতে বৃষ্টির জল গড়িয়ে মাটিতে পড়তে পারে। মেঝে শক্ত করা হত গোবর দিয়ে, তবে অনেক সময় চুনের ব্যবহারও করা হত। বসতবাড়ির চারদিক ঘেরা থাকত বাঁশ বা কাঠের বেড়া দিয়ে। ঘরের মধ্যে বসবার এবং শোবার জন্য ব্যবহার করা হত মাদুর। কখনও কখনও কাঠের চৌকিও ব্যবহার করা হত। খাবার সময় বসবার জন্য ব্যবহার করা হত পিঁড়ি এবং খাওয়া- দাওয়া করা হত সাধারণত মাটি বা ধাতুনির্মিত বাসনে।

নগরের লোকরা অবশ্য ইট দিয়ে কোঠাবাড়ি তৈরি করত। এগুলি ছাদ সমপৃষ্ঠ হত। ইটগুলি গাঁথা হত মাটি দিয়ে। পরে চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথবার পদ্ধতিও লক্ষ্য করা যায়। দেওয়ালে পলস্তরা দেওয়া হত চুনবালির। অনেক সময় ‘পঙ্খের কাজও করা হত। নগরের লোকরা সাধারণত শোবার জন্য ব্যবহার করত খাট বা পালঙ্ক। তাছাড়া, নগরের ধনীলোকরা ব্যবহার করত সোনা-রূপার বাসন।

দুই

গ্রামে সাধারণ গৃহস্থের খাওয়া-দাওয়া ছিল খুব সাদাসিধে ও সরল। সবচেয়ে যে প্রাচীন বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায় যে, বনিতা তাঁর পুণ্যবন্ত স্বামীকে পরিবেশন করে খাওয়াচ্ছেন—কলাপাতে গরম ভাত, সঙ্গে গাওয়া ঘি, দুধ, মাছ, নালিতা বা পাটশাক; আদা ও নুনও দেওয়া হত। ধনী সমাজের খাদ্য যে অন্যরকম ছিল তা বলা বাহুল্যমাত্র। বাঙলার উচ্চকোটি সমাজে ব্যবহৃত চৌষট্টি রকম ব্যঞ্জনের কথা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাবের সময়ও বাঙালী যে তার খাদ্যের কোনরূপ পরিবর্তন করেনি তার প্রমাণ আছে। মৎস্য বাঙালীর প্রিয় খাদ্য এবং বাঙালী বৌদ্ধ হয়ে গেলেও মৎস্য আহার বর্জন করেনি। সহজযানের প্রবর্তক লুইপাদ তো মাছের আঁতড়ি (অন্ত্র) বা তেলচচ্চড়ি খেতে ভালবাসতেন। নিম্নশ্রেণীর লোকরা যে শূকরের মাংস খেত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কেননা, শূকর পোষা তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। (এখানে উল্লেখযোগ্য যে ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’য় বলা হয়েছে যে, ইন্দ্রকে শূকর বলি দিতে হবে)। বস্তুত বৌদ্ধ ও হিন্দু যুগে বাঙালীর কোনও রূপ খাদ্যাখাদ্য বিচার ছিল না। এ বিষয়ে বিধিনিষেধ প্রবর্তিত হয় ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এর যুগে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’ চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রচিত হয়েছিল। বাঙালী ব্রাহ্মণের খাদ্যের ওপর তখন পঞ্জিকার শাসনও এসে গিয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, একাদশী, রামনবমী, শিবরাত্রি ও জন্মাষ্টমীতে ব্রাহ্মণ উপবাসী থাকবেন। যদি তিনি ওই সকল দিনে আহার করেন, তা হলে তিনি বিষ্ঠা-মূত্র আহার করবেন। এতে আরও বলা হয়েছে যে, দ্বিপক্ক অন্ন বা চিঁড়া ব্রাহ্মণের প্রশস্ত খাদ্য নয়। তা ছাড়া, ব্রাহ্মণ যদি তামার বাসনে আহার করেন বা নুন দিয়ে দুধ খান বা এঁটো পাতে ঘি খান, তা হলে তা গোমাংস খাওয়ার সমান হবে। মদ্যপান বোধ হয় ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল, কেননা বলা হয়েছে যে, কাঁসার বাসনে নারিকেলের

জল ও তামার বাসনে মধু ও আখের রস খাওয়া মদ্যপানের সমান। কার্তিক মাসে বেগুন ও মাঘ মাসে মূলা খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আরও বিধান দেওয়া হয়েছিল যে, ব্রাহ্মণ যদি তাল, মসুর ডাল ও মাছ খান, তা হলে তাঁকে তার জন্য প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তিন রাত্রি উপবাসী থাকতে হবে। তবে বাঙালী ব্রাহ্মণ যে এ সকল বিধান মানতে নারাজ ছিল তার প্রমাণ হচ্ছে দ্বাদশ শতাব্দীতে ভবদেব ভট্ট ও জীমূতবাহন বলেছিলেন যে, বাঙালী ব্রাহ্মণ মাছ খেতে পারে। ঘোড়শ শতাব্দীতে রঘুনন্দনও রায় দিলেন যে, বাঙালী ব্রাহ্মণের পক্ষে মসুর ডাল নিষিদ্ধ নয়। ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’ আর যা যা খাদ্য নিষিদ্ধ বলেছিল, তা হচ্ছে তৃতীয়ায় পটল, চতুর্থীতে মূলা, ষষ্ঠীতে নিম ও চতুর্দশীতে মাষকলাই। সকলের চেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে যদিও ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ’-এ ব্রাহ্মণের পক্ষে মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তথাপি বলা হয়েছিল যে, পূর্ণিমা ছাড়া অন্য তিথিতে ব্ৰাহ্মণ দেবতার কাছে বলি দেওয়া মাংস খেতে পারে।

তিন

তবে পরবর্তী কালে উপবাসও খাদ্যাখাদ্য সম্বন্ধে এ সকল বিচার-বিধান যে অনেক পরিমাণে পরিবর্তিত হয়েছিল তা চলতি বচন, পঞ্জিকার অনুশাসন ও লৌকিক রীতি থেকে বুঝতে পারা যায়। ‘বাঙালী সংস্কৃতির লৌকিক রূপ’ সংজ্ঞক অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে আগেই আলোচনা করেছি। তবে পাঠকদের আর একবার সেকথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। উপবাস সম্বন্ধে পরবর্তী কালে যে চলতি বচন রচিত হয়েছিল তা হচ্ছে—”শোয়া ওঠা পাশ মোড়া। / তার অর্ধেক ভীমে ছোঁড়া॥ / ক্ষেপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট। / এই নিয়ে কাল কাট।” এর মানে হচ্ছে এই যে, শয়ন একাদশী (আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী), পার্শ্বপরিবর্তন (ভাদ্র বা আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী), ভীম একাদশী (মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী), উত্থান একাদশী (কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী), শিবরাত্রি (ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী) ও দুর্গাষ্টমী (আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী)—এইগুলিই হচ্ছে উপবাসের বিশেষ দিন। এছাড়া, অরণ্যষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠীর দিন সন্তানবতী স্ত্রীলোকের পক্ষে মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার জয়মঙ্গলবার হিসাবে গণ্য হয়। ওদিনও মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইতুপূজার দিন। ওই সকল দিনেও মেয়েরা মাছ খায় না। পশ্চিমবঙ্গে শ্রীপঞ্চমীর দিন স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে হিন্দুরা মাছ খায় না। দশহরার দিন ফলার আহার করবার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া কোন কোন দিনে ঠাণ্ডা খাদ্য খাবার নিয়ম আছে। তার মধ্যে পড়ে ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে অরন্ধন। ওইদিন তপ্ত খাদ্য খাওয়া নিষিদ্ধ। মাত্র পূর্বদিনের রান্না-করা জিনিসই খাওয়া চলে। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী শীতল-ষষ্ঠী নামে অভিহিত। ওদিনও ঠাণ্ডা খাদ্য খাওয়া বিধেয়। মাঘ মাসে মূলা খাওয়া নিষিদ্ধ। এগুলির মধ্যে প্রায় সবগুলিই বাঙালী হিন্দু আজ পর্যন্ত পালন করে আসছে। তবে পঞ্জিকায় যেসকল খাদ্য বা কর্ম বিভিন্ন তিথিতে নিষিদ্ধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তার সবগুলি বাঙালী হিন্দু আজ আর পালন করে না। সে সকল নিষিদ্ধ দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে প্রতিপদে কুমড়া, দ্বিতীয়ায় ছোট বেগুন, তৃতীয়’য় পটল, চতুর্থীতে মূলা, পঞ্চমীতে বেল, ষষ্ঠীতে নিম, সপ্তমীতে তাল, অষ্টমীতে নারিকেল, নবমীতে লাউ, দশমীতে কলমিশাক, একাদশীতে শিম, দ্বাদশীতে পুঁইশাক, ত্রয়োদশীতে বেগুন, চতুর্দশীতে মাষকলাই। এছাড়া অষ্টমী, নবমী, চতুর্দশী ও পূর্ণিমা বা অমাবস্যাতে স্ত্রী, তেল, মংস্যামাংসাদি সম্ভোগও নিষিদ্ধ। আগেকার দিনে বিধাবারা আলুও খেত না, কেননা আলু বিদেশ থেকে আগত সবজি।

শাক-সবজির মধ্যে আগেকার দিনে বাংলার খাদ্যে যা স্থান পেত, তা হচ্ছে—শাকের মধ্যে পলতা, নটে, কলমি, হিঞ্চে, বিম্মি, পুঁই, কুমড়া, পাট- শাক ইত্যাদি; সবজির মধ্যে লাউ, কুমড়া, পটল, বেগুন, ঝিঙ্গা, চালতা, কাঁচকলা, কন্দ-আলু, রাঙা-আলু প্রভৃতি। পিঁয়াজ ও রসুনের চাষও ছিল, তবে ভদ্রসমাজে তার ব্যবহার ছিল না। অতি প্রাচীন বাঙলায় চা-ও যে ব্যবহার করা হত উয়াং চুয়াং তা বলে গিয়েছেন।

ফলমূলের মধ্যে ছিল কন্দ, মাদার বা লকুচ, বেল বা শ্রীফল, কলা, কাঁকুড়, তেঁতুল, ইক্ষু বা আখ, নারিকেল, তাল, তালশাস, কাঁঠাল, আম, কালজাম, লেবু প্রভৃতি।

গৃহপালিত পশুর মধ্যে ছিল গরু, ষাঁড়, ঘোড়া, হাতি, গাধা, পুকর, কুকুর ও ভেড়া। নানারকম পাখিও পোষা হত এবং অনেক সময় তাদের বার্তাপ্রেরণের কাজে ব্যবহার করা হত।

বেশভূষার দিক থেকে চিরকালই বাঙালী পুরুষরা ধুতি ও মেয়েরা শাড়ি পরে এসেছে। নানারকম শাড়ির নাম আমরা প্রাচীন সাহিত্যের পাই, যথা— ‘নিয়রমেলানী’ ‘মেঘ-উদুম্বর’ ‘গঙ্গাসাগর’, ‘লক্ষ্মীবিলাস’, ‘দ্বারবাসিনী’, ‘সিলহাটি’, ‘গাঙ্গেরী’, প্রভৃতি। সূক্ষ্ম মলমলের সুতা কাটা হত ঘরে ঘরে এবং তাঁতিকে দিয়ে সেই সূতায় ধুতি-শাড়ি বানিয়ে নেওয়া হত। বাঙালী মেয়েদের ঘরে ঘরে সূতাকাটার রীতি উনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এছাড়া পট্টও নেতবস্ত্রের (সিল্কের) শাড়িরও প্রচলন ছিল। শণের তৈরি ক্ষৌমবস্ত্রের প্রচলনও চৈনিক পরিব্রাজক উয়ং চুয়াঙের সময় পর্যন্ত ছিল। আর বাঙলার মসলিন তো জগদ্বিখ্যাত ছিল। তা ছাড়া ছাতার ব্যবহারও বাঙলাদেশে অতি প্রাচীন কাল থেকে ছিল।

বাঙালী মেয়েরা তখনও মাথায় সিঁদুর দিত এবং হাতে নোয়া, রুলি ও শাঁখা পরত। এখনও তাই পরে। তবে মেয়েদের হাতে রুলি পরার প্রথা এখন প্রায় উঠে গেছে। এগুলি সবই লোকসমাজের অলঙ্কার ছিল বলে মনে হয়। অতি প্রাচীন লোকায়ত সমাজ থেকে এগুলি যুগ-পরম্পরায় চলে এসেছে। এ ছাড়া পুরুষ ও মেয়েরা উভয়েই নানা রকম অলঙ্কার পরত। বাঙালী পুরুষদের অলঙ্কার পরা মাত্র কয়েক দশক আগে উঠে গেছে। এখন মাত্র আংটি, মাদুলী ও কারও কারও গলায় একগাছা সরু হারে এসে দাঁড়িয়েছে। তা-ও ছিনতাইয়ের ভয়ে সোনার বদলে রূপার। বাঙালী মাথার টিকিও রাখত, তাও আজ উঠে গেছে।

প্রাচীন কালে মেয়েরা মাথায় নানারকম খোঁপা বাঁধত; এখনও বাঁধে, তবে তার ঢঙ পালটে গেছে। তখনকার দিনের মেয়েদের অনেক অলঙ্কার আজ উঠে গিয়েছে, যেমন- নাকের নোলক ও নথ, হাতের বাউটি ও তাগা, ও গলার হাঁসুলি এবং সাতনরী হার, পায়ে তোড়া ও মল, কোমরে গোটহার ইত্যাদি। আজকালকার শহুরে মেয়েরা অনেকে হাতে নোয়া পরে না, পরে হাতঘড়ি।

গত কয়েক দশকে মেয়েদের বেশভূষা ও পোশাক-আশাকের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত বাঙালী মেয়েরা পাছাপেড়ে শাড়ী পরত। আজ মেয়েদের শাড়ী থেকে মধ্যেকার এই তৃতীয় পাড়টা মুছে গেছে। তাছাড়া মেয়েরা আর বুক পর্যন্ত ঘোমটা দেয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *