দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

বাঙালির শরীর তেলে আর জলে

বাঙালির শরীর তেলে আর জলে

আমি বাঙালি। আর সেই অপরাধে এ যাবৎ যৎপরোনাস্তি গালাগাল খেয়েছি। যত দিন বাঁচব এই গালাগাল খেয়ে যেতে হবে। স্বজাতির গালাগাল। সম্প্রতি যে বিশেষণে ভূষিত হয়েছি, তা হল আত্মঘাতী। বাঙালি আত্মঘাতী। সেই ইংরেজ আমলে এক লেখিকা বলে গেছেন—চিকেনারি, পারজারি, ফোরজারি প্রভৃতি অসাধারণ গুণ আমাদের রক্তে। কবি বললেন, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি। ডি. এল. রায় লিখলেন :

আমরা বাংলা গিয়েছি ভুলে

আমরা শিখেছি বিলিতি বুলি

আমরা বিলিতি ধরনে হাসি

আমরা ফরাসি ধরনে কাশি

আমরা পা ফাঁক করে সিগারেট

খেতে বড্ডই ভালোবাসি।

সব আমরা সাহেবি রকমে হাঁটি

স্পীচ দেই ইংরেজ খাঁটি

কিন্তু বিপদেতে দেই বাঙালিরই

মতো চম্পট পরিপাটি।

আবার রবীন্দ্রনাথ লিখলেন : আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না; ভুরি পরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না; আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধুলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য। এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল।

স্বামী বিবেকানন্দ বললেন, কপট, হিংসুক, দাসভাবাপন্ন, কাপুরুষ, যারা কেবল জড়ে বিশ্বাসী, তারা কখনও কিছু করতে পারে না। ঈর্ষাই আমাদের দাসসুলভ জাতীয় চরিত্রের কলঙ্কস্বরূপ। ঈর্ষা থাকলে সর্বশক্তিমান ভগবানও কিছু করে উঠতে পারেন না।

এই সব পড়ে-টড়ে আমারও খুব সাহস বেড়ে গেল। আমিও বাঙালিকে র‌্যান্ডাম গালাগাল দিতে শিখে গেলুম। অবশ্যই মনে-মনে বিড়-বিড় করে। বেশ ভালোই লাগত। স্বজাতিকে গালাগাল দিতে বেশ উপাদেয় লাগে। নিজের চরিত্র সংশোধন করার দিকে কখনই নজর দিইনি। রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি। তা নিজে কখনও মানুষ হবার চেষ্টা করিনি। সে বড় কঠিন কাজ। হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হও উন্নত শির, সে তো গান। বীর রসের গান। টেবিল চাপড়ে গাও। গেয়ে নিজের স্বভাবের দাসত্ব করো। তা ছাড়া, কিছু করার চেয়ে সমালোচক হওয়াই ভালো। নিজের ছিদ্র থাক না। চালুনির ছিদ্র তো থাকবেই। চালুনি সেইভাবেই তৈরি। তা বলে ছুঁচের বিচার ছাড়ব কেন? সেইটাই তো বাঙালির স্বভাব।

নিজের দিকে যখন তাকাই অবাক হয়ে যাই। তেত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি। হাতের কবজি দেড় ইঞ্চি, এমন একটা ভাব করি যেন হারকিউলিস। ডিসপেপটিক হারকিউলিস। সারাটা জীবন পেট নিয়েই নাকাল। গাঁদাল, থানকুনি, থানকুনি, গাঁদাল। আবার লোভের শেষ নেই। তেলেভাজা দেখলেই হামলে পড়ি। তারপর অ্যান্টাসিড। লিভার এর পরিধি খুঁজতে-খুঁজতে ডাক্তারবাবু প্রায় হাঁটুর কাছে নেমে এলেন। অ্যাঁ, করেছেন কী? ফ্যান্টাস্টিক গ্রোথ। পাঁঠা হলে আপনার দাম বেড়ে যেত। মাংস চল্লিশ হলে মেটে ষাট। মানুষ হয়েই ভুল করলেন। এখন তেতো আর সেদ্ধ খেয়ে জীবন কাটান। বাঙালির অপবাদ তো আছেই—পেটরোগা বাঙালি। আরে তাতে কি হয়েছে? বায়ু, পিত্ত, কফ তিন নিয়ে বাঙালি। বায়ুর জোরে কল্পনাপ্রবণ। বায়ুকে ঠিক পরিমাণমতো রাখতে পারলে ভালো ভালো স্বপ্ন। আর যদি চড়ে যায় তাহলেই বা কি। ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরব। বগলে কাপড় তুলে নৃত্য। কখনও লেনিন, কখনও স্ট্যালিন। বায়ুর জোরেই তো বাঙালির দাপট। অবশ্যই গৃহে। সব মেজাজ স্ত্রীর ওপর। তিনিও বাঙালি। প্রথমে একটু খেলতে দেবেন। যাকে বলে লং রোপ। শেষে এক দাবড়ানি। কর্তা ফিউজ। বাঙালি কিছু ইংরেজি শব্দকে বাংলা করে নিয়েছে। তার মধ্যে একটি শব্দ হল ‘টাইট’। টাইট দেওয়া। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে টাইট দিচ্ছে। আগে অফিসের বড় সায়েব হয়ে বাঙালি খুব হম্বিতম্বি করত। এখন আর সে যুগ নেই। টাইট দেবার জন্যে ইউনিয়ান আছে। বেশি ট্যাঁফো করলে পাঁচকড়ি বানিয়ে দেবে। বাঙালির স্বভাবই হল, শক্তের ভক্ত। প্রবাদ তৈরিই আছে—সিন্নি দেখে এগোয়, কোঁতকা দেখে পেছোয়। আমি তো পাড়ার বড়দা, যার অ্যাকাউন্টে আটটা মাথা জমা পড়েছে, সামনাসামনি তাকে স্যার বলি, দাদা বলি; আর বাড়িতে এসে বলি—জাতটা এই করেই শেষ হয়ে গেল। সব ওয়ান পিস, টু পিস আর বেরলো না। এক রবীন্দ্র, এক চৈতন্য, এক রামকৃষ্ণ, এক বিবেকানন্দ, এক সুভাষ। সব এক। কেউ যদি বলে, বাছা তুমি কী? আমি বোধি। সুযোগ পেলে কি না হতে পারতুম। বাঙালি হয়েই যে মরেছি। কাছা টেনে ধরে রাখার জাত। নিজেও এগোবে না। অন্যে এগিয়ে গেলে টেনে ধরে রাখবে। আমেরিকা হলে আইনস্টাইন; তেমন কিছু হতে না পারলেও আমি চৈতন্য। সব বাঙালিই যা ভাবে, আমিও তাই ভাবি—আমি অসাধারণ, বাকি সব সাধারণ। আমি ছাড়া দেশে আর মানুষ আছে না কি? সবই তো ছাগল। ছেলেকে বলি, ডোন্ট ফরগেট, তুমি কোন বাপের ছেলে। ছেলে অবাক হয়ে বাপকে দেখে। মাথা জোড়া টাক। মরা মাছের মতো চোখ। পুরু চশমা। পিলপিলি সায়েবের মতো পোশাক। ঢলঢলে পাজামা। সামনে ফাঁসির দড়ির মতো পাজামার কোমরের ফিতে লটরপটর। রোজ সকালে অফিসের দেরি হয়ে গেল রে বাপ বলে, নাকেমুখে গুঁজে তীর বেগে বাসের পেছনে দৌড়চ্ছে। আর রাতে বাড়ি ফিরেই চেল্লাচ্ছে—আমার বুকপকেটে দশটা টাকা ছিল, কে সরিয়েছে! সত্য কথা বলার সৎ সাহস নেই কারোর! গান্ধিজী বই লিখেছিলেন—মাই একস্পেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ। কেউ যদি জিগ্যেস করেন—সেই বইটা আপনি পড়েছেন? বাঙালির পড়ার দরকার হয় না। বাঙালি না পড়েই পণ্ডিত। না খেলেই খেলোয়াড়। না গেয়েই গাইয়ে। বসার ঘরে বুককেস। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, বিভূতিভূষণ, তার পাশেই শিডনি শেল্ডন, জেফ্রি আর্চার , গীতা, উপনিষদ। রবীন্দ্রনাথ পথের পাঁচালি লিখেছিলেন, বললেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। আর উপনিষদের আধখানা শ্লোক জানা আছে, ওই যথেষ্ট—উত্তিষ্ঠত জাগ্রত—সুযোগ পেলেই শুয়ে পড়ো। বাঙালি আবার বাঙলা ইংরিজি মিশিয়ে বেশ বলে—রেস্ট করছি।

বিখ্যাত কবিরাজ মশাইকে বললুম—মশাই, ভীষণ পিত্ত। তিনি হেসে বললেন, সারিয়ো না। পিত্ত থেকেই সৃজনী প্রতিভা বেরোয়। খালি পেটে কাপের পর কাপ চা। সৃজনী প্রতিভা বাড়ছে। মুখ সব সময় টক। দাঁতের এনামেল খুলে গেল। ইন্টেলেকচুয়াল এসে বললেন—চাটাকেও ইন্টেলেকচুয়াল করো। চিনি আর দুধ বিসর্জন। শুধু লিকার। ঢুকু ঢুকু খাও আর গালাগাল দাও। সোর তোলো—কেউ কিস্যু করছে না—এর নাম সাহিত্য, এর নাম শিল্প, এই কি সংগীত! জাতটা কোথায় নেমে গেল! বাংলা সিনেমা জঘন্য, বাংলা টিভি সিরিয়াল অখাদ্য।

বাঙালির মজা হল আজ যাকে মাথায় তুলে নাচছে, কালই তাকে ধপাস করে ফেলে দেবে। বাঙালির এক জিনিস বেশি দিন ভালো লাগে না। আর স্বজাতির কেউ বড় হলে, সবসময় চেষ্টা কি করে তাকে ফেলা যায়। বিশ্বনিন্দুক বলতেও আপত্তি নেই। প্রতিভার দিক থেকে কিছু করতে না পারলে চরিত্র ধরে টানবে। রামচন্দ্রকে বলবে রামছাগল। রামকৃষ্ণকে বলবে হিস্টিরিয়ার রোগী। গলায় ছুরি লাগালে বলবে, তুমি আমার বাপ। পেছন ফিরলেই বলবে লোফার। অভাবী মানুষ একটাকা সাহায্য চাইলে বলবে— খেটে খাও। গলায় গামছা দিলে পুজোর চাঁদা দেবে পাঁচশো টাকা। প্রতিবেশীর বিপদে খড়খড়ি ফাঁক করে মজা দেখবে। নিজের বিপদে কেউ না এলে বলবে স্বার্থপর, হনুমান। মেলামেশা তেমন না থাকলেও প্রত্যেকেই আমরা প্রত্যেকের হাঁড়ির খবর রাখি। কার মেয়ে কার ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে! কার বাড়িতে ভি. সি. আর. এল। কার ঘরের দেয়ালে প্ল্যাস্টিক রঙ বসল। কে কাল রাতে বড় বড় গলদা চিংড়ি সহ একটু ঢুকু করেছে। বাঙালির কান আর চোখ যেন রাডার যন্ত্র। প্রত্যেকেই এক-একটি সংবাদ সংস্থা। প্রতিদিন কে কি বাজার করছে, তাও জানি; কিন্তু পাড়ায় কেউ আমরা কারোর সঙ্গে মিশি না। আগের সেই আড্ডা, সেই গুলতানি সবই আমাদের গেছে। আগে ঘরে-ঘরে একটা করে পরচর্চা ক্লাব ছিল। উঠে গেছে। ঢুকেছে—টিভি। পরচর্চা করলে দিল বেশ খোলসা হয়। বাঙালি পরচর্চা করে পরচর্চার জন্যে নয়—স্বশিক্ষার জন্যে—নিজের আত্মিক উন্নতির জন্যে। একটা উদাহরণ—

‘বুঝলে, ছেলের বিয়ে দিয়ে বিশ্বনাথ তো পথে বসল। পুত্রবধূ তো উঠতে বসতে কিলোচ্ছে।’

‘ধর্মের কল ভাই। বিশ্বনাথ নিজে কি করেছে। বউ সিট বললে সিটডাউন, আপ বললে গেটআপ। বিশুর বাবা তো কাঁদতে-কাঁদতে গেছেন। এইবার বিশুর পালা। যেমন বীজ বুনবে সেইরকম ফসল তুলবে। এই তো নিয়ম ভাই।’

‘আমি ভাই আমার ছেলের বিয়ে একটু দেখে শুনে দেব। লেখাপড়া না হয় একটু কমই জানুক; কিন্তু মেয়েটি যেন ভালো হয়।’

‘ছেলের বিয়ে আর তোমাকে দিতে হচ্ছে না। যা যুগ পড়েছে। ধরে আনবে, এনে বলবে, ফাদার এই আমার মিসেস। কি সব হচ্ছে চারদিকে। আরে ছি ছি। যুগটা একেবারে চেঞ্জ করে গেল।’

‘যুগ কিছু চেঞ্জ করেনি ভাই, যা ছিল তাই আছে। শোন না, সেই কতকাল আগে তুলসীদাস কি বলেছেন—গোউয়া দোকে কুত্তা পালে ওসকি বাছুর ভুখা। শালেকে উত্তম খিলাওয়ে বাপ না পাওয়ে রুখা।। ঘরকা বহুরি প্রীত না পাওয়ে চিত চোরাওয়ে দাসী। ধন্য কলিযুগ তেরী তামাসা দুখ লাগে ঔর হাসি। মানেটা বুঝলে, শ্যালককে ভুরি ভোজ আর পিতার ভাগ্যে একটা শুকনো রুটিও জোটে না। স্ত্রী ফেলে কত্তা গেল বেশ্যার গলায় চন্দ্রহার দোলাতে। দাসীর হাত ধরে টানাটানি।’

‘আরে ভাই সেম কেস। আমাদের বাড়ি যে মেয়েটা কাজ করে সে তো চন্দরদের বাড়ি ছেড়ে দিলে।’

‘ও চন্দর। লুজ ক্যারেকটার। রিসেন্টলি বড়লোক হয়েছে লরির ব্যবসা করে। লরি কালচার। ব্যাটা ভালচার।’

‘বাঙালি ক্যারেকটার হুতোম যা স্টাডি করেছিলেন তার কোনও তুলনা নেই। একেবারে চাবকে শেষ করে দিয়েছেন।’

বাসের একেবারে পেছনে একটা আসন থাকে। পাঁচজন বসতে পারেন, ঠেলেঠুলে ছজন। ওই আসনটা হল বাসের কাশ্মীর। ষষ্ঠতম ব্যক্তি হবার সময় বাঙালি বলবে—’যদি হয় সুজন তেঁতুল পাতায় নজন। আমি এইভাবেই ঢুকি। আর নিজের বেলায়, কেউ যখন এসে বলেন—দাদা, একটু সরে-সরে বসবেন—আমি তখন কালা হয়ে যাই। বাঙালির জন্যেই ওই প্রবাদ—বাঙালিরই রচনা—নিজের বেলায় আঁটিসুঁটি পরের বেলায় দাঁতকপাটি। কেড়ে না নিলে বাঙালি সহজে কিছু ছাড়তে চায় না। যানবাহনে বাঙালির যে স্বরূপ সেইটাই আসল রূপ। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া। মুখে জ্ঞান-বিজ্ঞান ব্যবহারে চরম অজ্ঞান। খাঁচায় পুরে বিশ্বরূপ দর্শন। ঝগড়ায় ভাষা ফুরিয়ে যাবার পর চলতে থাকে, চপ, চপ। এ বলে চোপ, ও বলে চোপ। বাঙালি নিদ্রাবিলাসী। বসতে পারলে তো কথাই নেই। পাশের সহযাত্রীর কাঁধ হল বালিশ। সময়-সময় দুজনেই ঢুলতে থাকেন। মাথায়-মাথায় হেড। সময়-সময় কাঁধ আর মাথার লড়াই। অনেকের নাকও ডাকে। অনেকে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েও ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম, ধুম ঝগড়া, খেলা, রাজনীতির আলোচনা, অন্যের শ্রাদ্ধ, চরিত্র হনন, কন্ডাক্টারের লম্ভঝম্প, ড্রাইভারের কেরামতি, ট্র্যাফিক-জ্যাম, বাস চলেছে অফিস। অফিসকেও আমরা আমাদের চরিত্রের ছাঁচে ঢেলেছি। আবর্জনায় মনোরম। প্রস্রাবাগারের সুবাসে সুবাসিত। দাগধরা টেবিল, হাতল ভাঙা চেয়ার। ক্লিনলিনেস ইজ নেকস্ট টু গডলিনেস। বলতেন ইংরেজরা। ইংরেজ বিদায়। বিদায় তাদের কু-অভ্যাস ফ্রিডম মানে, যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। যেখানে-সেখানে করব। অফিসে বসে আগে কাগজ পড়ব; তারপর আলোচনা, হট ডিবেট। অত:পর চা। চায়ের পর চা। কাজ করি না করি টিফিন তো আছেই। ঘণ্টাখানেক, ঘণ্টা দেড়েক রোদে বেরব। কাটা ফলও খেতে পারি। ফুটপাথ জোড়া বিশাল বিচিত্র ভোজনের আয়োজন। বাঙালি খেয়ে আর খাইয়ে ফতুর। মানুষ মরে গেল। সংসার হয়তো পথে বসার জোগাড়। এদিকে ছাতজোড়া সামিয়ানা। গিজগিজ লোক। শ্রাদ্ধের সঙ্গে রাধাবল্লভী, পান্তুয়ার শ্রাদ্ধ। মেয়ের বিয়ে, দেড়লাখের ধাক্কা। বাবাজীবন তো ঝেঁপেইছেন, এদিকে শ-চারেক ফিশফ্রাই আর ফ্রায়েডরাইস নিয়ে যত না খাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ফেলছে। মেয়ের বাবার কান্না সানাই হয়ে ঝরছে।

মুজতবা আলি লিখেছিলেন —পাড়ায় বাঙালির ছেলে স্টেশেনারির দোকান দিয়েছে। দুপুরবেলা, আলিসায়েব সারা কলকাতা চষে ফিরছেন। একটা সাবান কেনার প্রয়োজন ছিল। মনেও পড়েছিল। ভাবলেন, পাড়ার ছেলেকে সাপোর্ট করা উচিত। তাই আর কোথাও কেনেননি। পাড়ার দোকানে এসে দেখলেন, ছেলেটি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ডাকাডাকিতে মাথা তুলে তাকাল। —ভাই, ভালো সাবান আছে? ব্যাজার মুখে বললে—নেই। আলিসায়েব দেখছেন—তাকে সারি-সারি সাবান সাজানো। তিনি বললেন, ওই তো ভাই সাবান। ছেলেটি বললে, ও সাবান বিক্রির জন্যে নয়। সেই একই ট্র্যাডিশন। ব্যাঙ্কের কাউন্টারে—হাঁ করে খাড়া দাঁড়িয়ে। ভেতরে গল্প চলছে। হঠাৎ বললে, যান মশাই, এ ব্যাঙ্ক সে ব্যাঙ্ক নয়, তাড়া থাকে গ্যাঞ্জেস ব্যাঙ্ক-এ যান। চেয়ারে কোট ঝুলিয়ে করপোরশানের বাবু অন্য জায়গায় খেপ মারতে গেছেন, পুরনো গল্প।

শিবনাথ শাস্ত্রী মশাই লিখেছিলেন—বাঙালির শরীর তেলে আর জলে। তৈল স্নেহজাতীয় পদার্থ। তুমি আমাকে স্নেহ করো, আমি তোমাকে স্নেহ করি। এই তৈল-বিজনেসে বাঙালি অদ্বিতীয়। অবাঙালি মনিবের সামনে নিজেদের জাতকে গাল দিলে যদি পদোন্নতি হয় তাতেও পিছপা নই। বড় মানুষের সামনে নতজানু। কখনও গাইব, কখনও নাচব, কখনও হাসব, কখনও কাঁদব, দুকান ধরে জিভ বের করে দাঁড়াব। নিজের ইলেকট্রিক বিল জমা দিতে বিরক্ত; কিন্তু বড়মানুষের টেলিফোন বিল জমা দিতে ছুটব। নিজের বাপ হাসপাতালে দেখতে যেতে বিরক্ত; বড় মানুষের শ্বশুর নার্সিংহোমে, তপতপে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ঠায়, যেন আমারই জীবন মরণ সমস্যা। সবই নিজের আখের গোছাতে। আবার সেই বড় মানুষটি চেয়ার থেকে হড়কে গেলেই মারব বাঁপায়ে লাথি। সেইজন্যেই প্রবাদ—কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি। বড় মানুষ বাঙালিও ভারি সুন্দর। ঈশ্বরের সমগোত্রীয়। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের অধিকর্তা। যেন জগৎকারণ। সবেতেই ফু:। ফু: বাঙালি। তিনি যা বুঝবেন, যা করবেন সেইটাই ঠিক। নিজের স্বার্থে তিনি সকলকে খেলাবেন। কাজ আদায়ের সময় মুখে মধু, কাজ ফুরিয়ে গেলেই হলাহল। সেই কারণেই এই উক্তি—বড়র পিরিতী বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি, ক্ষণেতে চাঁদ। বড় মানুষ বাঙালি ক্ষণে-ক্ষণে স্বভাব পাল্টান। এই চেনেন তো, এই চেনেন না। পয়সা পদমর্যাদা বাড়লে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কেন, বাপ-মাকেও চিনতে পারেন না। সুন্দরী রমণী ছাড়া উঁচু নয়নে আর কিছুই তল পায় না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ একদিন উত্তর পাড়া থেকে নৌকোয় এঁড়েদার ঘাটে এসে নামলেন। ঘাটে বসে আছেন এক ভদ্রলোক যিনি আগে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা-টেখা করতেন। ইদানিং পয়সা হওয়ায় আর যেতেন না। ঠাকুরকে দেখে বললেন,—অ্যায় যে ঠাকুর! আছো কেমন? রামকৃষ্ণ ভাগনে হৃদয়কে বললেন—হৃদে পালিয়ে আয়। ওর পয়সা হয়েচে।

ট্র্যাফিক জ্যামে গাড়ি আটকে আছে। একটা গাড়ির সামনের আসনে যে বসে আছে, মনে হল আমার চেনা। আমার সহপাঠী। অনেক দিন পরে দেখা। এগিয়ে গিয়ে বললুম—মানস না! থমথমে মুখে ভদ্রলোক বললেন—আই কান্ট প্লেস ইউ। সেই প্রথম শিখলুম—বাঙালি বড় হলে ‘প্লেস’ করতে পারে না। স্থান খুঁজে পায় না, না নিজের, না অন্যের। সরকারি বড় চাকুরে তাই এখন ও সায়েব ঘোষ, বোস, মিত্তির সায়েব। বাঙালিকে দেখে গাও—চিনি গো, চিনি গো, চিনি ফিনিশ হতে আর কতদিন বাকি। বাঙালি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে বাঙালিকে। আর নিজের ভাইকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *