বাঙালির বই-ব্যাবসা এবং বিদ্যাসাগর
আশিস পাঠক
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বয়স এবং বাঙালির বই-ব্যাবসার বয়স এই ২০২০-তে কাছাকাছি। মোটের ওপর দুশো বছর। ১৮২০-তে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম। আর প্রথম সার্থক বাঙালি বই-ব্যবসায়ী গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের প্রেস খুলেছে ১৮১৮-য়।
তারও কম-বেশি পঞ্চাশ বছর আগে থেকে ছাপার অক্ষরে বাংলা হরফ দেখা যাচ্ছে। বাংলা হরফ প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল হালেদ-এর ব্যাকরণ-এ। ১৭৭৮-এ প্রথম প্রকাশিত সে বইয়ের নাম, আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ, লেখক নাথানিয়েল ব্রাসি হালেদ। হুগলির যে প্রেসে এ বই ছাপা হয়েছিল তার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মি. অ্যান্ড্রুজ, একজন বই-বিক্রেতা।
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর ক্যালকাটা গেজেট লিখছে, ‘The first book in which Bengalee types were used was Halhed’s Bengalee grammar printed at Hoogly at the press established by Mr Andrews, a book seller in 1778.’ খুব স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায়, অ্যান্ড্রুজের দোকানে বাংলা বই খুব বেশি রাখা হত না। তবে সেই সময় ইউরোপীয়দের বইয়ের দোকানে দেশীয় ভাষার বই থাকত৷ ১৮২২-এ প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি থেকে দেখা যায়, থ্যাকার ও সেন্ট অ্যান্ড্রুজের বইয়ের দোকানে বিদেশি বইয়ের সঙ্গে থাকছে কিছু দেশীয় ভাষার বইও। সেই বিজ্ঞপ্তিতে যেসব বইয়ের নাম পাওয়া যাচ্ছে তার মধ্যে সংস্কৃত, হিন্দি, ফারসির সঙ্গে বাংলা ভাষার বইও যৎসামান্য আছে। বাংলা বই বলতে প্রধানত ছিল চণ্ডী ও গীতার অনুবাদ, রামায়ণ, বারমাস্যা প্রভৃতি। লালদিঘিতে সেন্ট অ্যান্ড্রুজের নামে যে বিলিতি বইয়ের দোকান ছিল তার মালিক আর হুগলির ওই প্রেসের মালিক একই ব্যক্তি বলে অনুমান করা যায়।
আসলে, বইয়ের প্রকাশক তখন মূলত ছাপাখানাই। বইয়ের দোকানও ছাপাখানাই। মুদ্রণের সংস্কৃতি তখনও জনসমাজের এলাকায় আসেনি বলে চাহিদার অভাবেই প্রকাশক, মুদ্রক এবং পরিবেশক এই তিনটি পৃথক ধারণা তখনও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি বঙ্গীয় গ্রন্থভুবনে। ভুবন বলাটা অবশ্য সুভাষণ। কারণ ওই শব্দটির মধ্যে যে ব্যাপ্তি তার ছিটেফোঁটাও ছিল না তখন বাংলা বইয়ের সামগ্রিকতায়। কয়েক শতকের শ্রুতি- এবং পুথি-ধার্য যে বৈচিত্র্যময় বাংলা সাহিত্য তার প্রায় কিছুই মুদ্রিত হয়নি সেই আদি যুগের ছাপাখানায়। হালেদের ব্যাকরণ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে শ্রীরামপুরে কেরির ছাপাখানা পর্যন্ত কলকাতায় ছাপা বইয়ের তালিকা বলছে, সেই সময়ে মোটামুটিভাবে বাংলা বা বাংলা-ইংরেজি বইপত্র যা ছাপা হয়েছে তার বেশিরভাগই আইনের অনুবাদ আর অভিধান। বণিকের মানদণ্ড তখন রাজদণ্ড রূপে দেখা দিয়েছে৷ সেই রাজদণ্ডকে প্রতিষ্ঠিত রাখতে গেলে শাসিতের ভাষা শেখাটা প্রথম জরুরি। সেই ভাষাশিক্ষার চাহিদাই মূলত মেটাতে উদ্যোগী ছিল তখনকার ছাপাখানা।
খুব বেশি না থাকলেও বইয়ের চাহিদা একেবারেই ছিল না, সেটা বলা যাবে না৷ তার প্রমাণ, নতুন নতুন ছাপাখানার উদ্ভব। বই ছাপাটা সেকালে অর্থের দিক থেকে খুব সহজ কাজ ছিল না। বই কেনাটাও ছিল মূলত উচ্চবিত্ত অভিজাত মহলে সীমাবদ্ধ। তবু ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি। কলকাতার ছাপাখানার প্রথম যুগ সম্পর্কে অতি বিশিষ্ট গবেষক গ্রাহাম শ-র পরিসংখ্যান অনুসারে শ্রীপান্থ তাঁর বটতলা বইয়ে দেখিয়েছেন, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কলকাতায় পেশাদার এবং শৌখিন মুদ্রক ছিলেন প্রায় চল্লিশজন। তাঁদের সূত্রে সতেরোটি বিভিন্ন ছাপাখানার কথা পাওয়া যাচ্ছে। অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে এইসব ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় চারশো। তার মধ্যে কিছু বাংলা বইও ছিল। সেদিনের কলকাতার ঠিকানা ধরে গ্রাহাম শ যে মানচিত্র তৈরি করেছিলেন তা থেকে দেখা যাচ্ছে সেকালের প্রায় সব ছাপাখানা ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে দি গ্রেট ট্যাঙ্ক বা লালদিঘির আশেপাশে। তার মানে সাহেবপাড়ায়। সেসব বই বিক্রি হত নিশ্চয়, কিন্তু বাঙালির বই-ব্যাবসার ইতিহাসে এই পর্ব নিছক পূর্বভূমিকামাত্র।
এই পর্ব পূর্বভূমিকার বেশি গুরুত্ব পাবে না আরও এই কারণে যে এইসব মুদ্রণ-উদ্যোগ মূলত ইংরেজ-পরিচালিত। গ্রাহাম শ-র গবেষণা থেকেই জানা যাচ্ছে, ওই সতেরোটি ছাপাখানার সব ক’টিরই মাথায় ছিলেন কোনও-না-কোনও ইউরোপিয়ান। বেশ কিছু ছাপাখানার কর্মীরা যদিও নেটিভ, বা এদেশীয়, কিন্তু তারা বাংলা ভাষা জানে না, চোখে দেখে হরফ মিলিয়ে কাজ করে। সম্পূর্ণ দেশীয় লোকের প্রথম ছাপাখানা খিদিরপুরে বাবুরামের ছাপাখানা, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮০৭-এ। আর আদিযুগের বাঙালির বাংলা বইয়ের ব্যাবসা যথার্থভাবে শুরু হয়েছিল গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের হাতে।
বাংলা বইয়ের ইতিহাসে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য মূলত বিখ্যাত তাঁর মুদ্রিত সচিত্র অন্নদামঙ্গল-এর জন্য। এটিই বাংলা ভাষার প্রথম সচিত্র গ্রন্থ। সে বইয়ে ছবি ছিল ছ’টা। তার দু’টিতে শিল্পীর নাম লেখা আছে রামচাঁদ রায়। বইয়ের দাম চার টাকা। সেকালের তুলনায় দাম যথেষ্ট বেশি। তবু, বইয়ে ছবি দেওয়ার পিছনে বইয়ের বিক্রির কথাটাও নিশ্চয় মাথায় রেখেছিলেন গঙ্গাকিশোর। বইয়ের ব্যবসায়ী হিসেবে কালের হিসেবেই শুধু গঙ্গাকিশোর পথিকৃৎ নন, ভাবনাতেও তিনি কিছুটা নতুন পথ কেটে দিয়েছিলেন।
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি, সমাচার দর্পণ লিখছে, ‘এতদ্দেশীয় লোকের মধ্যে বিক্রয়ার্থে বাঙ্গালা পুস্তক মুদ্রিতকরণের প্রথমোদ্যোগ কেবল ১৬ বৎসরাবধি হইতেছে।… প্রথম যে পুস্তক মুদ্রিত হয় তাহার নাম অন্নদামঙ্গল।… শ্রীযুত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য তাহা বিক্রয়ার্থে প্রকাশ করেন।’ ১৮১৪-য় অন্নদামঙ্গল ছাপার কাজ শুরু হয়, শেষ হয় ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে। গঙ্গাকিশোরের অন্নদামঙ্গল ভালই বিক্রি হয়েছিল। নইলে সে বছরই বাংলায় লেখা ২১৬ পৃষ্ঠার ইংরেজী ভাষার ব্যাকরণ গঙ্গাকিশোর ছাপতেন না। শুধু তাই নয়, ১৮২০ থেকে ১৮২৪-এর মধ্যে গঙ্গাকিশোর প্রকাশ করেছিলেন আরও চারটে বই— দায়ভাগ, চিকিৎসার্ণব, শ্রীভগবদ্গীতা, দ্রব্যগুণ। ১৮১৮-তেই তিনি হরচন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় একটি ছাপাখানাও প্রতিষ্ঠা করেন, বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস, যে প্রেস থেকে প্রকাশিত হত বাঙ্গাল গেজেটি, বাংলা ভাষার দ্বিতীয় কিন্তু বাঙালি পরিচালিত প্রথম পত্রিকা।
মনে রাখতে হবে, গঙ্গাকিশোর বড়লোক ছিলেন না। ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা তাঁর শখ ছিল না। শ্রীরামপুরের মিশনারিদের ছাপাখানায় কম্পোজিটরের চাকরি করতেন। তখনই হয়তো বই-ব্যাবসার ইচ্ছে হয়। কিন্তু প্রথমেই ছাপাখানা কেনার সম্বল বা সাহস কোনওটাই ছিল না বলেই অন্নদামঙ্গল ছাপতে দিয়েছিলেন ফেরিস কোম্পানির প্রেসে। কিন্তু নিছক মুদ্রক ছিলেন না গঙ্গাকিশোর। হরফ দেখে হরফ মেলানোর সামান্য কেরানিগিরিও করেননি। অন্নদামঙ্গল ছাপতে দেওয়ার আগে পণ্ডিত পদ্মলোচন চূড়ামণিকে দিয়ে সংশোধন করিয়ে নিয়েছিলেন একটি পুথি। ছাপার আগে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার এই প্রয়োজন যে তিনি বুঝেছিলেন তাতে তাঁর প্রকাশক হিসেবে সম্পূর্ণতার একটা পরিচয় পাওয়া যায়।
এর পাশাপাশি বাংলা বইয়ের ব্যবসায় আর একটা ধারা চলেছিল বটতলার বইয়ে। গঙ্গাকিশোরে সম্পূর্ণত বটতলার উত্তরাধিকার নেই। সুকুমার সেন তাঁকে তাঁর বটতলার ছাপা ও ছবি বইয়ে ‘ইউরোপীয় রীতিতে পুস্তক প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথম’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর পূর্বে পুথির আকারে ছাপা হয়েছিল নরোত্তমবিলাস এবং জগদীশচরিত্র বা জগদীশবিজয়। গোপালচন্দ্র রায় এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন, ‘এই বক্তব্যের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি-প্রমাণ আছে বলে মনে হয় না। পুথির আকার প্রাচীনত্বের প্রমাণ হতে পারে না। কারণ বর্তমান শতকেও অনেক ধর্মীয় পুস্তক পুথির আকারে ছাপা হয়েছে।’১
বিষয়টি একটু গভীরে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। সুকুমার সেন সম্ভবত ইউরোপীয় রীতি বলতে কোডেক্স-এর কথা বলতে চেয়েছেন। কোডেক্স ধারণাটিকে এই সূত্রে একটু সবিস্তার করা দরকার। কারণ, কোডেক্স শুধু গ্রন্থনির্মাণবিদ্যার একটি পরিভাষা নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে গ্রন্থসংস্কৃতির সমাজতত্ত্বও। আসলে সাধারণভাবে ইংরেজিতে বুক আর বাংলায় বই বললে কিছু ছাপা বা না ছাপা পাতার একটা বিশেষ চেহারায় বাঁধানো সমষ্টি বোঝায়। সেই চেহারা বা আঙ্গিকটার নাম কোডেক্স। ছাপা বইয়ের যে চেহারাটা আমরা এখন দেখি সেই চেহারা বা, ইংরেজিতে বললে, ফর্মটাকেই বলে কোডেক্স।
কোডেক্স শব্দটা এসেছে লাতিন caudex শব্দ থেকে, যার মানে গাছের ডাল বা কাঠের খণ্ড। ইংরেজিতে শব্দটার বহুবচন codices. বইয়ের যে চেনা চেহারাটা এখন আমাদের অতি পরিচিত সেটাই কোডেক্স। এই চেহারাটা এখন খুব চেনা হয়ে যাওয়ায় আমরা বই বা পুথির যে অন্য চেহারা হতে পারে তা ভাবতেই পারি না। তাই, বই তৈরির ইতিহাসে এই কোডেক্সের উদ্ভাবন যে কত বড় যুগান্তকারী ঘটনা সেটাও বুঝতে পারি না।
কোডেক্সের বিশেষত্ব হল, ছাপানো বা হাতে-লেখা পাতাগুলো দু’ মলাটের মধ্যে থাকবে। কোডেক্স সোজা করে ধরলে বাঁধাই থাকবে সবসময় পড়ুয়ার বাঁ-দিকে। পড়তে গেলে পাঠককে পাতা ওলটাতে হবে, গোটানো পুথি খোলার থেকে এই বিষয়টা একেবারে নতুন। কোডেক্সেই পাতার ক্রমিক সংখ্যা প্রথম এল, ইংরেজিতে যাকে বলে পেজিনেশন। প্রথম দিকে অবশ্য শুধু ফোলিয়ো-র নম্বর দেওয়া হত, অর্থাৎ পাতার শুধু একদিকে পৃষ্ঠাসংখ্যা বসত। এই পৃষ্ঠাসংখ্যা লেখা বা ছাপার বিষয়টি বই পড়াকে অনেক সহজ করে দিল, কোডেক্সের চেহারাও বইকে অনেক বেশি বহনযোগ্য করে তুলল স্ক্রোল বা গোটানো পুথির তুলনায়। মোটামুটিভাবে দ্বিতীয় শতকের আগে ওই কোডেক্স আঙ্গিকটার তেমন কোনও অস্তিত্বই ছিল না ইউরোপে। তখনও বাইবেল বা অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ ও পুথিতে স্ক্রোল বা গোটানো পাণ্ডুলিপিরই দাপট। চতুর্থ শতক থেকে এখনকার বইয়ের আকারে বাঁধানো পুথির চল বেশ ভালরকম দেখা যেতে থাকে।
গবেষকেরা দেখেছেন, এই ব্যাপারটার সঙ্গে রোমে খ্রিস্টান ধর্মের বিস্তার ও প্রাধান্যের একটা সম্পর্ক আছে। আসলে কোডেক্সের প্রাধান্যের যুগেও ইহুদি পুথি গোটানো বা স্ক্রোলের আকারেই তৈরি হত। খানিকটা যেন সেটা থেকে আলাদা হতেই খ্রিস্টান ধর্মের পুথিতে কোডেক্স ফর্মটিকে বহুলভাবে প্রচলিত করা হয়। এমনকী, চতুর্থ শতকের পরেও ম্যাজিক বা অন্যান্য অ-ধর্মীয় বিষয়ের পুথিতে স্ক্রোলের প্রাধান্য ছিল। তবে বাইবেলের সঙ্গেই কোডেক্সের সম্পর্কটা গভীর।
রোমানরাই বই-এর এই বিশ্ব-পরিচিত আঙ্গিকটির জনক। মায়া বা আজটেক সভ্যতায়ও কোডেক্স আঙ্গিকটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। কিন্তু তার বেশিরভাগ ছিল কনসার্টিনা, অর্থাৎ ভাঁজ-করা পাতাগুলোকে একটার ওপর আর একটা রেখে ওপর দিয়ে ফুঁড়ে সেলাই করে বাঁধানো। পাতা বলতে কিন্তু কেবল কাগজ বুঝলে চলবে না। প্রাচীন কোডেক্স লেখা এবং তৈরি হত কাগজ ছাড়াও প্যাপিরাস আর ভেলামেও। ভেলাম মানে লেখার জন্য প্রস্তুত করা চামড়া আর প্যাপিরাস এক ধরনের গাছের ছাল।
প্রাচ্যের দেশগুলিতে এই কোডেক্স বা আজকের বইয়ের চেহারাটা এসেছে অনেক পরে। চিনে ভাঁজ-করা প্যামফ্লেট বা প্রচারপুস্তিকা তৈরি থেকে এই কোডেক্সের ধারণার বিকাশ আনুমানিক নবম শতকে। ভারতবর্ষের প্রাচীন পুথি এই আঙ্গিকে তৈরি হত না। এদেশে কোডেক্স আঙ্গিকটির বহুল প্রচার শ্রীরামপুর মিশনারিদের আসার পরে, ছাপা বইয়ের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে। মনে রাখতে হবে গঙ্গাকিশোরের গ্রন্থ-জীবনও শুরু শ্রীরামপুরে, মিশনারিদের ছাপাখানায়। তাই ইউরোপীয় রীতিতে গ্রন্থপ্রকাশের বিষয়টা তাঁর মূল্যায়নে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বাঙালির বই-ব্যবসায় ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধটি গঙ্গাকিশোরে সমাচ্ছন্ন। আর এই প্রেক্ষাপটেই তার দ্বিতীয়ার্ধে আসবেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। যে সময়ে তিনি বাংলা বইয়ের ব্যবসায় এসেছিলেন তখন কলকাতায় হাতে-গোনা কিছু বইয়ের দোকান, তার বেশিরভাগই সাহেবপাড়ায়। বস্তুত, বই কেনা এবং বই পড়াটা তখনও অভিজাত উচ্চমহলের সংস্কৃতি, বাংলার জনসংস্কৃতিতে বই তখনও আসেনি। তার একটা কারণ দীর্ঘকালের শ্রুতি-অভ্যাস, আর একটা সাক্ষরতার স্বল্পতা। কিন্তু বই পড়ার একটা আগ্রহ যে ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিক থেকেই ছিল তার একটা পরোক্ষ প্রমাণ অন্যভাবে পাওয়া যায়।
১৮০২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে একটি গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। এদেশে ছাপা বইপত্রের অধিকাংশই সেখানে ছিল। সংগৃহীত হয়েছিল অনেক মূল্যবান পুরনো পুথিও। প্রথমে মূলত কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকেরাই সেসব ব্যবহারের সুযোগ পেতেন। কিন্তু পরে কিছু আগ্রহী সাধারণ নাগরিকও সে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তার ফল যা হল সেটা বেশ চিন্তার বিষয়। গ্রন্থাগার থেকে বই লোপাট হয়ে যেতে লাগল। এবং কর্তৃপক্ষ খবর পাচ্ছিলেন যে চোরাই বই অনেক বেশি দামে বাইরের বাজারে বিক্রিও হচ্ছে। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে কলেজ কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিলেন যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব বই প্রকাশিত হচ্ছে তার বেশ কিছু বাজারেও বিক্রি হবে। এই বাজার আসলে চলমান বাজার। পুরনো বইয়ের স্থায়ী বাজারের প্রশ্ন তখন ওঠেই না। বইওয়ালারাই তখন বই বিক্রির আসল ভরসা। আর সেই অনিয়ন্ত্রিত, অনির্দিষ্ট ফেরিওয়ালাদের কাছেই নিশ্চয় চলে যেত চোরাই বই। ঠিক যেমন গিয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত সংগ্রহের একটি দুষ্প্রাপ্য সংস্কৃত বই। সে ঘটনা চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিদ্যাসাগর বইয়ে জানিয়েছিলেন। আর তারই অনুসরণে লিখেছেন ইন্দ্রমিত্র, তাঁর করুণাসাগর বিদ্যাসাগর-এ। বিদ্যাসাগরের লাইব্রেরি থেকে তাঁর সেই বন্ধু বইটি পড়তে নিয়েছিলেন। কিন্তু বারবার তাগাদা দিয়েও বিদ্যাসাগর বইটি তাঁর কাছ থেকে ফেরত পাননি। শেষে একদিন বন্ধু বইটা যে নিয়েছেন সে-কথাটাই বেমালুম অস্বীকার করলেন। বিদ্যাসাগর বিরক্ত হলেন। ঠিক করলেন কস্মিনকালেও আর কাউকে বই ধার দেবেন না। কিন্তু সে বইয়ের দুঃখ কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না তিনি। ভুলবেন কী করে, ও বই যে মহা দুর্লভ, জার্মানি ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যায় না। শেষে কাকতালীয়ভাবেই চেনা-জানা এক বইওয়ালার কাছে বিদ্যাসাগর পেয়ে গেলেন ওই বইয়ের নিজের কপিটাই, এবং কিনে নিলেন আবার।
বাংলা প্রকাশনার আদি যুগে ওই ভ্রাম্যমাণ বইওয়ালারাই ছিল বইয়ের বিপণন-ব্যবস্থার মেরুদণ্ড। আজ আবার সেই ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হতে চলেছে। বই-ব্যাবসা কলেজ স্ট্রিটের মতো একটি বিশেষ পাড়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তার চাইছে গ্রাম-মফস্সল এমনকী ক্রেতার দোরগোড়া পর্যন্ত। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। বিদ্যাসাগরের বই-ব্যাবসার কেন্দ্র ছিল কলেজ স্ট্রিট-ই। আর, কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া হয়ে ওঠার একেবারে আদিযুগের ভরসা ছিল বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত প্রেস ও ডিপোজিটরি। আর সেইখানে আর-এক বিদ্যাসাগরকে আমরা পাই, বণিক বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগরের যে মূর্তি আমরা চিরাভ্যাসে লালন করে চলি, ওই বণিক শব্দটা হয়তো তাতে আঘাত করবে। কারণ লক্ষ্মীর সঙ্গে সরস্বতীর বিরোধ কল্পনাতেই আমাদের মন শান্তি পায়। তা ছাড়া, ঋষিপ্রতিম মানুষের সঙ্গে অর্থচিন্তাকে আমরা কখনও মেলাতে পারি না। কিন্তু বিদ্যাসাগর একটু অন্যরকম মানুষ ছিলেন, একটু অন্যরকম বাঙালি ছিলেন। ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছেন, কোনও কাজকেই ছোট মনে করতেন না।
তবে খুব সুপরিকল্পিতভাবে বই-ব্যাবসা করবেন এমনটা বোধহয় কখনও ভাবেননি বিদ্যাসাগর। একটা তাৎক্ষণিক জেদ আর তাগিদ থেকেই নেমে পড়েছিলেন বই-ব্যবসায়। সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের চাকরি তখন ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। বিরোধটা বেধেছিল সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে। কীভাবে পড়ানো হবে ছাত্রদের, তাই নিয়ে। মতভেদ যখন চরমে পৌঁছল তখন, সম্ভবত ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলের গোড়ায় দস্তুরমতো পদত্যাগপত্র পেশ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। রসময়বাবু তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করতে লাগলেন আড়ালে, চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদ্যাসাগর খাবে কী! বিদ্যাসাগর শুনে বললেন, ‘রসময়বাবুকে বলো বিদ্যাসাগর আলু পটল বেচে খাবে।’
আলুপটল অবশ্য বেচেননি বিদ্যাসাগর। কিন্তু বই বেচেছিলেন। সেটাও ছিল তাঁর সময়ে যথেষ্ট ব্যতিক্রমী কাজ। বাঙালির ছেলে তখনও নিতান্ত ব্যাবসাবিমুখ ছিল। গঙ্গাকিশোর, বিদ্যাসাগররা সেখানে নিছক ব্যতিক্রম। সে পথ কতটা অন্য ছিল সেটা বোঝা যায় তারও প্রায় চল্লিশ বছর পরে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট্রাল প্রিন্টিং প্রেসের সুপারিনটেনডেন্ট উইলিয়াম রস-এর লেখা পড়লে:
In Europe, typographic printing is considered a highly respectable profession, and youths who enter it have generally received a fair education. But this is not the case in India, where natives who have been educated in the English language prefer to work as copying clerks on small salaries rather than become compositors and earn better wages.
বোঝাই যাচ্ছে, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের পথে সেভাবে বাঙালি যুবকেরা তখনও হাঁটেননি। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা কতটা নতুন পথে হাঁটা সেটা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সেই নতুন পথের শুরু। এভাবেই বলতে হল, কারণ, বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত প্রেস ও ডিপোজিটরি প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ পাওয়া যায় না। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘১৮৪৮/৪৯ খৃষ্টাব্দে যখন বিদ্যাসাগর মহাশয় ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয় সংস্কৃত কালেজে চাকরি করিতেন, সেই সময়ে উভয়ে সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করেন। আপনাদের রচিত গ্রন্থ ঐ যন্ত্রে মুদ্রিত হইবে, আপনাদের পছন্দমতো পুস্তক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইবে, ইহাই তাঁহাদের যন্ত্র স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।’২ বিদ্যাসাগর নিজে লিখেছেন, ‘যৎকালে আমি ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কলেজে নিযুক্ত ছিলাম, তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে সংস্কৃত যন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা সংস্থাপিত হয়। ঐ ছাপাখানায় তিনি ও আমি উভয়েই সমাংশভাগী ছিলাম।’ ১৮৪৬-এর ২৭ জুন মদনমোহন সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন। বিদ্যাসাগর চাকরি ছাড়েন ১৮৪৭-এর এপ্রিল নাগাদ। সুতরাং এর মধ্যেই প্রেসের প্রতিষ্ঠা, ধরে নেওয়া যায়।
প্রেসের প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট সাল-তারিখ নিয়ে পণ্ডিতেরা বিবাদ করুন, আপাতত আমরা বিদ্যাসাগরের সময়টিকে বোঝার চেষ্টা করি। সংস্কৃত প্রেস ও ডিপোজিটরিরও প্রথম দিকের বই অন্নদামঙ্গল। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যও শুরু করেছিলেন অন্নদামঙ্গল দিয়ে। মদনমোহন ও বিদ্যাসাগর যখন প্রেস খোলার পরিকল্পনা করেন তখন প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থাভাব। একটা কাঠের প্রেস পছন্দ হয়েছিল, যার দাম ছশো টাকা। নানা চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে শেষে বন্ধু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের কাছে ওই ছশো টাকা ধার করে প্রেস কেনেন বিদ্যাসাগর এবং তর্কালঙ্কার। কিন্তু ধার মেটাবেন কী করে? উপায় হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের মার্শাল সাহেবের সঙ্গে কথা বলে। কথাপ্রসঙ্গেই বিদ্যাসাগর মার্শালকে জানিয়েছিলেন যে তিনি একটি ছাপাখানা খুলেছেন, কিছু ছাপার দরকার হলে তাঁকে বললে ভাল হয়। মার্শাল অন্নদামঙ্গল-এর কথা বলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বিদ্যার্থী সিভিলিয়ানদের তখন অন্নদামঙ্গল পড়ানো হত। কিন্তু অন্নদামঙ্গল-এর যে বই তাঁরা পড়তেন তা নিয়ে মার্শাল সাহেবের ঘোর আপত্তি। তিনি বলেছিলেন, ওই অন্নদামঙ্গল—
অত্যন্ত জঘন্য কাগজে ও জঘন্য অক্ষরে মুদ্রিত; বিশেষত অনেক বর্ণাশুদ্ধি আছে। অতএব যদি কৃষ্ণনগরের রাজবাটী হইতে আদি অন্নদামঙ্গল পুস্তক আনাইয়া শুদ্ধ করিয়া ত্বরায় ছাপাইতে পার, তাহা হইলে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জন্য আমি একশত পুস্তক লইব এবং ঐ একশতের মূল্য ৬০০ টাকা দিব। অবশিষ্ট যত পুস্তক বিক্রয় করিবে, তাহাতে তুমি যথেষ্ট লাভ করিতে পারিবে, তাহা হইলে যে টাকা ঋণ করিয়া ছাপাখানা করিয়াছ, তৎসমস্তই পরিশোধ হইবে।৩
বিদ্যাসাগর তা-ই করেছিলেন। কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকেই পুথি আনানো হয়েছিল। তার পরে মূলত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রেস দাঁড়িয়ে গেল। কলেজ লাইব্রেরি যে পরিমাণ নতুন নতুন বই নিত, তার টাকায় ছাপার খরচ উঠে গেল। সাধারণ পাঠকের কাছে বিক্রির টাকা লাভ হতে থাকল।
কিন্তু গঙ্গাকিশোরের অন্নদামঙ্গল তার অনেক আগে প্রকাশিত হয়েছিল। তাতেও এক পণ্ডিত পাঠ দেখে দিয়েছিলেন। সে বই হয়তো তখন আর বাজারে সুলভ ছিল না। তার চাহিদাও হয়তো ক্রমে কমে এসেছিল। সেটা স্বাভাবিক। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে চার টাকা দিয়ে গঙ্গাকিশোরের অন্নদামঙ্গল কেনা বা মাঝপর্বে ছ’টাকা দিয়ে বিদ্যাসাগরের অন্নদামঙ্গল কেনার সাধ্য সাধারণ বাঙালি পাঠকের ছিল না বলেই মনে হয়। তা ছাড়া সাধারণ বাঙালি পাঠক জনপ্রিয় সাহিত্যের পাঠ নিয়ে ততটা উৎসাহী কোনওকালেই নয়। কাগজ বা টাইপ কত ভাল সে বিষয়েও তার মাথাব্যথা তেমন নেই। আজ, এই ২০১৯-এও, গ্রন্থনির্মাণ বিষয়ে যাবতীয় তাত্ত্বিক আলোচনা সত্ত্বেও বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর প্রমুখের সাহিত্য যে পাঠে, যে কাগজে যেমন ছাপায় বিকিয়ে চলেছে তা দেখলে এ কথাটা আরও বেশি করে মনে হতে বাধ্য।
কিন্তু সেই সস্তার জনরুচির সঙ্গে বিদ্যাসাগর আপস করতে পারবেন না, বলা বাহুল্য। পাঠ বিষয়ে তিনি অত্যন্ত মনোযোগী ছিলেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয় খুব পরিশ্রম করিতে পারিতেন, তাঁহার অনেকগুলি বই ছিল। তিনি সব বইয়ের প্রুফ নিজে দেখিতেন এবং সর্ব্বদাই উহার বাংলা পরিবর্ত্তন করিতেন। দেখিতাম প্রত্যেক পরিবর্ত্তনেই মানে খুলিয়াছে। তিনি প্রেসের কাজ বেশ জানিতেন-বুঝিতেন।’
শুধু জানা-বোঝাই নয়, ছাপাখানার এবং বাংলা মুদ্রণব্যবস্থার উন্নতির জন্যও বিদ্যাসাগর ভেবেছেন। টাইপকেসে কোন অক্ষরটা কোথায় রাখলে সুবিধে হয়, কম্পোজিশন দ্রুততর হয়, তারও একটা নিয়ম উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। তাকে বলে বিদ্যাসাগরী সাট। আর বইয়ের শেষ প্রুফ নিজে দেখে দিতেন বিদ্যাসাগর। শেষ প্রুফ দেখার পরেও কেউ ভুল বের করে দিতে পারলে টাকা পেত। সেরকম ভুল নাকি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ছাড়া আর কেউ ধরে দিতে পারেননি।
কিন্তু এই সূক্ষ্মতার জন্য, এই যত্নের জন্য বিদ্যাসাগরের প্রেস দাঁড়িয়ে যায়নি। প্রায় চার দশক প্রেস চলেছিল বিদ্যাসাগরের অধীনে। তার পরে বিক্রি হয়ে যায়। বাংলা উপন্যাস, ছোটগল্প তখনও নিজের পায়ে পুরোদস্তুর দাঁড়ায়নি। আর বটতলার নানা বিষয়ের আকর্ষণীয় বই বিদ্যাসাগর স্বভাবতই ছাপতে পারতেন না। সুতরাং সেকালে চার দশক প্রেস বাঁচিয়ে রাখার মতো বই বিদ্যাসাগরের হাতে ছিল না। বিদ্যাসাগর ওই প্রেস থেকে মূলত পাঠ্য বই ছাপতেন। বেশিরভাগই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সিলেবাসের বই। তার মধ্যে ছিল সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা, বৈয়াকরণ ভূষণসার, ধাতুপাঠ, ঋজুপাঠ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, কাদম্বরী, দশকুমার চরিত, শিশুশিক্ষা ইত্যাদি। পরমেশ আচার্য লিখেছেন:
বিদ্যাসাগরের বিদ্যা-মূলধন করে ব্যবসা শুরু হয়নি। ঐ ভাষায় বলতে গেলে আসল মূলধন ছিল মুরুব্বীর জোর। ধার তাকেই দেয় লোকে, যার ধার শোধ করার ক্ষমতা থাকে।… এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, বিদ্যাসাগরের বইয়ের ব্যবসা সরকারি সহযোগিতায় বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠেছিল।… শিক্ষাবিভাগে চাকরির সুবাদে কী ধরনের বই বাজারে চলবে, তা তিনি ভালোই বুঝেছিলেন। আর নিজের বই পাঠ্য করায়ও কিছু বাড়তি সুবিধা নিশ্চয় পেয়েছিলেন। তিনি একদিকে সংস্কৃত কলেজে কী পড়ানো হবে তার সুপারিশকারী, অন্যদিকে বাংলা শিক্ষা প্রসারের জন্য কী ধরণের বই পাঠ্য করা দরকার তার প্রধান পরামর্শদাতা। স্বাভাবিকভাবেই তিনি আজীবন পাঠ্যবইয়ের ব্যবসাই করেছেন।… ১৮৫৫ সালে বাংলা স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সংস্কৃত কলেজের যে নর্মাল স্কুল স্থাপিত হয়, তার পাঠ্যসূচিও তিনি তৈরি করেন।৪
এ মতের উলটোদিকে ১৩ জুলাই ১৮৭৩-এ অ্যাটকিনসনকে লেখা বিদ্যাসাগরের একটি চিঠির উল্লেখ করেছেন অভিজিৎ নন্দী। বাংলা সাহিত্য পড়ানো এবং ছাত্রদের বাংলা শিক্ষা দেওয়ার উপযোগী বই লেখায় উৎসাহদান ও ভাল বই নির্বাচনের জন্য সরকার তখন সেন্ট্রাল টেক্সট বুক কমিটি গঠন করেছে। অ্যাটকিনসন তখন শিক্ষাবিভাগের অধিকর্তা। তিনি চিঠি লিখে বিদ্যাসাগরকে ওই কমিটিতে থাকতে অনুরোধ করেন। বিদ্যাসাগর প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সে প্রত্যাখ্যান কিন্তু প্রকাশক হিসেবে ছিল না, ছিল লেখক হিসেবে।৫
সিলেবাসের বই-ই ছাপতেন বিদ্যাসাগর, সংস্কৃত প্রেস থেকে। তাঁর বইয়ের দোকান সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি ছিল কলেজ স্ট্রিটে। ‘বইপাড়া’ হয়ে ওঠা তো দূর অস্ত্, কলেজ স্ট্রিটে তখন বইয়ের দোকানই ছিল না। তখন বটতলার বইওয়ালাদের যুগ। প্রধানত চিৎপুর এলাকায় ছাপা হত বটতলার বই। বিক্রি হত বই ফিরিওয়ালাদের মাধ্যমে। অর্থাৎ বই পৌঁছে যেত ক্রেতার কাছে। সে ইতিহাস আজকের বই-ব্যবসায় পুনরাবৃত্ত হয়েছে। কলেজ স্ট্রিটের গণ্ডি ছাড়িয়ে সরাসরি সম্ভাব্য ক্রেতার ঘরে হানা দিচ্ছেন প্রকাশকেরা। কিন্তু আজকের মতো সংগঠিত, গতিময় হোম ডেলিভারি বটতলার যুগে ছিল স্বপ্নেরও অতীত। সুতরাং, তখন দরকার ছিল, বইয়ের একটা স্থায়ী ঠিকানার। আর সে দরকারটা ধরা পড়েছিল বীরসিংহের সিংহশিশুর দূরদর্শিতায়। এতটাই সে দূরদর্শিতা এবং ব্যাবসায়িক বুদ্ধি যে তাঁর সময়ে বিদ্যাসাগর ছিলেন পাঠ্যবইয়ের রীতিমতো তাক-লাগানো ব্যবসায়ী।
অভিজিৎ নন্দী তাঁর প্রবন্ধটিতে দেখিয়েছেন, ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বইয়ের ব্যাবসা থেকে মাসে অন্তত হাজার তিনেক টাকা আয় হত বিদ্যাসাগরের। বছর দুয়েক পরে কলকাতার ছেচল্লিশটি প্রেস থেকে ৫৭১৬৭০ কপি বাংলা বইয়ের মধ্যে সংস্কৃত প্রেস থেকে ছাপা বই ছিল ৮৪২২০টি। এক বছরে বিদ্যাসাগরের বইয়ের ২৭টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এমন তথ্যও আছে। আজকের বিচারে পরিসংখ্যানগুলোর মানে দাঁড়ায় সেকালে পাঠ্যবইয়ের বাজারের অনেকটাই ছিল বিদ্যাসাগরের দখলে।
এর পিছনের রসায়নটা কী তা নিয়ে বহু তর্ক আছে। সরকারি সাহায্যের অবদান এর পিছনে কতটা সে প্রশ্নও অনেকে তোলেন। অন্তত এই বিষয়বুদ্ধি বিদ্যাসাগরের ইমেজের সঙ্গে যায় কি না তা-ও অনেকের ভাবনার বিষয়। কিন্তু সেই বিতর্কের অনেক ওপরে বেঁচে থাকেন বিদ্যাসাগর, বাঙালির পূর্ণাঙ্গ বই-ভাবনার ইতিহাসে এক আদি বিপ্লবী হয়ে।
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বাংলা বইয়ের ব্যবসা’, দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন, (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি.)।
২. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর (কলকাতা: কলেজস্ট্রীট, ১৪০৪)।
৩. অভিজিৎ নন্দী, ‘বইপাড়ায় বিদ্যাসাগর’, মুদ্রণের সংস্কৃতি ও বাংলা বই, স্বপন চক্রবর্তী সম্পাদিত (কলকাতা : অবভাস, ২০০৭)।
৪. পরমেশ আচার্য, ‘ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগর’, বাঙালী প্রবুদ্ধ সমাজের সীমা ও বিদ্যাসাগর বিতর্ক (কলকাতা : নিউ হরাইজন বুক ট্রাস্ট, ২০০২)।
৫. অভিজিৎ নন্দী, ‘বইপাড়ায় বিদ্যাসাগর’।