বাঙালির দেব-দেবী প্রসঙ্গ – অর্ধেন্দু চক্রবর্তী
আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার পুরোধা পুরুষ সুধীরকুমার মিত্র শুধুমাত্র ইতিহাস নিয়েই কালাতিপাত করেননি, তাঁর সৃষ্টি বিচিত্রগামী। বাঙালির অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি নানা গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং একথা বলতেই হবে সেইসব গ্রন্থগুলিকে সহজেই আকরগ্রন্থও বলা চলে। মানব সমাজের উত্থান-পতনের সঙ্গে ধর্মের যোগ নিরবচ্ছিন্ন। বাঙালিও এই ধারার বাইরে নয়। বিশ শতকে ধর্মের বিরোধীতায় তাৎপর্যপূর্ণ উত্থান ঘটলেও আজ দেখতে পাচ্ছি সেই উত্থান তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। আবার এটাও লক্ষ করছি ধর্ম ‘ছল-ধর্ম’ হয়ে মানবতায় দিচ্ছে ছোবল, পৃথিবী রোজই রক্তাক্ত হচ্ছে। অথচ ধর্মের মূল কথা শান্তি, স্বস্তি ও আত্মোন্নতি। ধর্মের সূত্র ও তত্ত্ব কঠিন বিষয় সন্দেহ নেই, কিন্তু তার ক্রমপরিবর্তনের কাহিনিটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম ও লোকধর্ম ছিল দুই দিগন্ত, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরস্পর কাছে এসেছে, আদান-প্রদান হয়েছে, নতুন চেহারায় জন্ম নিয়েছে নতুন ধর্ম। সত্ত্বিক বোধ কখনো কখনো তামসিক হয়েছে। সেই তামসিকতা থেকে মানবকে উদ্ধার করবার জন্যে আবির্ভূত হয়েছেন অবতার-সম ধর্মীয় পুরুষ যাঁরা বারবার কলঙ্কমুক্ত করেছেন দেশ ও সমাজকে। সুধীরকুমার মিত্রের গ্রন্থ দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী পড়লে ভারতীয় বৈদিক ধর্ম ও তন্ত্র সম্পর্কে যেমন স্বচ্ছ সামাজিক ধারণা লাভ করা যায়, সেইসঙ্গে জানতে পারি সামাজিক ইতিহাসের পাশাপাশি ধর্মের ইতিহাসও।
দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী সম্পর্কে লেখক সুধীরকুমার মিত্র আমাদের জানিয়ে দিতে ভোলেননি, যে, ‘সাড়ে তিন দশক ধরে বিভিন্ন পত্রিকার পূজা সংখ্যায় প্রাচীন কাহিনিমূলক দেব-দেবীর উদ্ভব সম্বন্ধে বিচিত্র কথা এবং সমসাময়িক পুস্তক ও তৎকালীন সংবাদপত্র থেকে উদ্ধার করে দুর্গাপূজা নিয়ে নানা লেখা ছাড়া আমায় একাধিকবার কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা সম্বন্ধেও অর্ধশতাধিক প্রবন্ধ রচনা করতে হয়েছিল। এই সব ছোটো ছোটো নিবন্ধাবলির মধ্যে কেবল ধর্ম নয়—এর মধ্যে নিহিত রয়েছে ধর্মসাধনার দিক থেকে ধর্মের আবরণে সেকালে প্রচলিত বঙ্গসমাজের একটি সমাজচিত্র …’। অর্থাৎ লেখক সচেতন তাঁর লক্ষ্য সম্পর্কে। তাঁকে লিখতে প্রেরণা দিয়েছে সমাজ। তিনি সচেতন ছিলেন মানবধর্মের সঙ্গে ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মের যোগ যেখানে, সেই বিন্দুতে, সেই সেতুবন্ধের দিকটাতে।
দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী বইটি যে আমাদের আলোচ্য বিষয় সে-কথাটা আলাদা করে উল্লেখের আর বোধহয় প্রয়োজন নেই। গ্রন্থটিতে তিনটি অধ্যায়। এই তিন অধ্যায়ে রয়েছে বেদ বেদান্ত গীতা ও বাঙালির নিত্যদিনের পূজা ও ব্রত ইত্যাদি নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের মূল্যবান নিবন্ধ। প্রথম অধ্যায়ের দু-টি রচনা আমাদের বিস্ময়কর মনে হবে। একটি ‘গীতা শ্লোকের ছন্দ’ এবং দ্বিতীয়টি ‘গাজন’। ‘গীতা শ্লোকের ছন্দ’, জনৈক জিতেন্দ্রনাথ শাস্ত্রীর একটি রচনার পটভূমিকায় রচিত। সুধীরকুমার মিত্র ওই লেখকের ‘কিছু ত্রুটি’ সংশোধন করেছেন। জিতেন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছিলেন গীতার শ্লোকগুলি অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত, ‘‘মাঝে মাঝে কিছু কিছু ১১ অক্ষর বিশিষ্ট ‘উপজাতি’ ছন্দের সংস্কৃত পদ্যও আছে’’। সুধীরকুমার মিত্র লিখেছেন, ‘শ্রীমদভাগবত গীতা অনুষ্টুপ ছাড়া কেবল উপজাতি নয়, ইন্দ্রবজ্রা, উপেন্দ্রবজ্রা ও বিপরীতপূর্বা ছন্দে রচিত হয়েছে। লেখক কিন্তু সে-কথার উল্লেখ করেননি। গীতা-র সাত-শো শ্লোকের মধ্যে ৬৪৫ শ্লোক অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত এবং অবশিষ্ট ৫৫টি শ্লোক যে যে ছন্দে রচিত হয়েছে এখানে তা উল্লেখিত হল।’ তারপর তিনি ওই ৫৫টি শ্লোক কোন কোন অধ্যায়ে রয়েছে তা সবিস্তারে লিখেছেন। ছন্দ সম্পর্কে সুধীরকুমার মিত্রের এই বিচার হয়তো সংস্কৃত পন্ডিতেরা জানেন, আমাদের জানার কিন্তু উপায় ছিল না—কেউ এমন সহজ বাংলায় কোথাও লিখেছেন কিনা জানি না। এই গ্রন্থ থেকে অথচ জানতে পেরে যাব। দ্বিতীয়টি ‘গাজন’। ‘গাজন’-এর অর্থ কী? ‘শিবের প্রীতিকামনায় সন্ন্যাস গ্রহণ করে শিব-সম্বন্ধীয় গীতগানকে বলা হয় গাজন।’ এবার তিনি যে তথ্য জানাবেন তাতে আমরা আশ্চর্য না হয়ে পারি না। তিনি বলবেন ‘অতীত কালে বৌদ্ধযুগে মহাযান সম্প্রদায়ের বৌদ্ধগণ শিবপূজা করতেন।’ হিন্দু এবং বৌদ্ধদের মধ্যে সমন্বয়ের একটা দিক যেন এটা। বৌদ্ধ ধর্ম সম্বন্ধে আমরা প্রায় কিছুই জানি না। যে মন্ত্রটা একমাত্র আমাদের শোনা আছে, সেটা হল :
বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি
ধর্মং শরণং গচ্ছামি
সংঘম শরণং গচ্ছামি
এই মন্ত্রের বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘ যে তিনজন দেবতা, এটা, আমরা অন্তত জানতাম না। এই ‘গাজন’-এর আলোচনা পড়ে জানতে পারছি। আবার ‘এই তিন দেবতার মধ্যে ধর্ম ছিল ডোমেদের দেবতা।’ এইরকম, ছোটো ছোটো নিবন্ধগুলিতে অজস্র জানার বিষয় রয়েছে, যেগুলির সঙ্গে হয়তো আমাদের পরিচয় আছে কিন্তু সে পরিচয় অর্থবহ নয়। এই গ্রন্থটি যোগ করে দিচ্ছে সেই অর্থটি। এখানে বেশ কয়েকটি লোকজ শিব-গীত রয়েছে যার একটি অতীব মনোরম। এক শিবভক্ত শিবের নগ্ন দেহ, ভিক্ষে করা, ইত্যাদিতে কাতর হয়ে শিবকে বলছেন :
আক্ষার (আমার) বচনে গোসাঞ্চি তুক্ষি (তুমি) চষ চাষ।
কখন অন্নছত্র গোসাঞ্চি কখন উপবাস।।
পুখরি কাঁদা এ (কাদায়) লইব ভূমখানি।
আরসা (রসহীন, শুকনো) হইলে যেন ছিচ এ দিব পানি।।
* * * *
ঘরে ধান্য থাকিলে পরভু সুখে অন্ন খাব।
অন্নর বিহনে পরভু কত দুঃখ পাব।। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
সম্পূর্ণ গানটি তুলিনি। কারণ আমরা চেয়েছি সামান্য উদাহরণ হাজির করতে। এই নিবন্ধে শিব সম্পর্কিত নানা বিষয় আমরা জানতে পারব যার অনেককিছুই মনে হবে এই প্রথম জানলাম। যাঁরা শিব-অন্ত প্রাণ তাঁরা হয়তো সবই জানেন—কিন্তু তাঁদের সংখ্যা আর কত! গাজন মেলার নাম বৈশাখি মেলা এটাও জানলাম। এই অধ্যায়ে রয়েছে কার্তিকপূজার বিবরণ ও ধুমধাম, বিশ্বকর্মা সম্পর্কে নিবন্ধ, শনিপূজা পাটবাড়ি প্রভৃতি অনেক কিছু।
দ্বিতীয় অধ্যায়ের বিষয় মূলত দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজার গোড়ার কথা দিয়ে শুরু একটি নিবন্ধ, তারপর আরও নিবন্ধ রয়েছে ওই দুর্গাপূজা নিয়ে। কত অজানা তথ্য, কত বিবরণ ও আবিষ্কার। আমরা খুশি হতে থাকি বাঙালির সবচেয়ে প্রাণের দেবী, যিনি আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে গেছেন দেবত্ব থেকে ছুটি নিয়ে, তাঁর সম্পর্কে এতসব জেনে। এখানে বিস্তারিত লেখার অবকাশ নেই কিন্তু একটি বিজ্ঞাপন সম্পর্কে দু-একটি কথা বলব। সুশীলকুমার দে তাঁর বাংলা প্রবাদে উল্লেখ করেছেন—
ধনীর মধ্যে অগ্রগণ্য রামদুলাল সরকার
বাবুর মধ্যে অগ্রগণ্য প্রাণকৃষ্ণ হালদার।
এই প্রাণকৃষ্ণ হালদারমশাই, ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বাড়ির দুর্গাপূজায় বাঙালিদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কলিকাতা গেজেট পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে। তাঁর সামান্য অংশ উধৃত করছি :
… who will favour him with their company, and that he will be happy to furnish them tiffin, Dinner, wines etc. during their stay there. Prankissen Holder.
শেষ বা তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে কালীপূজা, শাক্তধর্ম, শাক্ত-গান, মা লক্ষ্মীর পূজা, সরস্বতী পূজা, শীতলা পূজা, মা মনসা দেবী পূজা ইত্যাদির কথা ও কাহিনি, নানা অজ্ঞাত বিষয়।
গল্পের মতো করে সরল ভাষায় লেখা সেকালের কাহিনিমূলক পৌরাণিক বিষয়ের নিবন্ধগুলি সুধীরকুমার মিত্র লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে আদর্শ করে। লেখকের মনে ছিল রবীন্দ্রনাথের উক্তি ‘যার ধর্ম যেটা সেটা তার পক্ষে বন্ধন নয়, সেটাই তার আনন্দ’। এই নিবন্ধগুলি শেষ অবধি শুধুমাত্র ধর্মের কাহিনি হয়েই শেষ হয়নি, সেখানে পেয়ে যাব সমাজ, আবিষ্কার ও বাঙালির সুখ-দুঃখ ঘেরা জীবন। সেই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে দেব-দেবীরাও যেন ঘরের লোক। অথচ এই দেব-দেবীকে ঘিরেই রয়েছে গভীর দার্শনিক তত্ত্ব যে তত্ত্বকে অবলম্বন করে কত মহাপুরুষ সাধু-সন্ন্যাসী খুঁজেছেন ঈশ্বরকে, আমরা পেয়েছি শ্রীরামকৃষ্ণকে, স্বামী বিবেকানন্দকে। মহাপ্রাণ সুধীরকুমার মিত্র তাঁর গ্রন্থ দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী-তে এইসব কথাই সবিস্তারে লিখেছেন অনবদ্য ভাষায়। এমন গ্রন্থ বাংলাভাষায় আর আছে কিনা জানি না। লেখকের জন্মশতবর্ষে আমরা তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই এই গ্রন্থটিকে উপলক্ষ্য করে।
আলোচিত গ্রন্থ
দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী।