বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূত্রপাত

বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সূত্রপাত

পাকিস্তান প্রস্তাব বাংলাদেশের যে নিদারুণ ক্ষতি সাধন করেছে তা নিঃসঙ্গ বেদনাহত ফজলুল হক কখনোই ভুলতে পারেননি। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তিনি পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন জেলা ঘুরে ৫ সেপ্টেম্বর (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) একটি বিবৃতিতে নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভার ত্রুটিবিচ্যুতি উল্লেখ করেন। তাতে ফজলুল হক বলেন : সরকারের বিভিন্ন দপ্তর একেবারে অচল হয়ে গেছে। উচ্চপদস্থ অফিসারেরা কোনোই কাজকর্ম করছেন না। বিচার বিভাগের অযোগ্যতার জন্য জনসাধারণের দুঃখদুর্দশা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এইভাবে চললে পাকিস্তানের পতন অনিবার্য। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে হিন্দুস্থানে ও পাকিস্তানে অফিসারদের কর্মে নিয়োগের ব্যবস্থা হওয়ায় পাকিস্তানকে দুর্ভোগ ভুগতে হবে। শাসনতন্ত্র পরিচালনায় যে বিশেষ অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন, তা এখনও অল্পসংখ্যক মুসলমানদের আয়ত্তে আছে। কাজেই পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র কেবলমাত্র মুসলমান অফিসারদের দিয়ে চালানো সম্ভব নয়। নাজিমুদ্দিনের বোঝা উচিত অনেক বছর পর্যন্ত এই অবস্থা থাকবে। সুতরাং যোগ্য মুসলমান অফিসারদের নিয়োগের পর বাদবাকি সমস্ত পদে অ-মুসলমানদের নিয়োগ করা উচিত। যদি হিন্দু ও মুসলমান অফিসারেরা একসঙ্গে কাজ করেন এবং সমানভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তানের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর হয়ে যাবে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, এর ফলে শাসনতন্ত্রে নিযুক্ত হিন্দু ও মুসলমান কর্মচারীরা ব্যক্তিগত জীবনে ও বৃহৎ কর্মক্ষেত্রে পরস্পর ভ্রাতৃত্ববোধে আবদ্ধ হবেন। অফিসারদের মধ্যে এই মনোভাবের উন্মেষ হলে তা নীচের দিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে এবং ক্রমান্বয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ দূরীভূত হবে। আমি নাজিমুদ্দিনকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, তিনি যদি দায়িত্বশীল পদে অযোগ্য উচ্চাকাঙক্ষী ব্যক্তিদের নিয়োগ করেন, তাহলে তিনি পাকিস্তানের পতন ঘটাবেন। ৫ সেপ্টেম্বর (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ) খবরের কাগজে প্রকাশের জন্য যে বিবৃতিটি ফজলুল হক দেন, তা এখানে উদ্ধৃত করা হল:

In the course of a recent tour in some districts of East Bengal, I was alarmed to fine ordinary business in many Government Departments at a stand still, if not in a state of practical collapse. This I observed mostly in the Judicial Department, especially in posts held by officers in the upper ranks of the services where no work has been done since Aug. 13 or 14. Those who have anything to do with our Law Courts can better imagine than I can describe the distress and sufferings, not to mention loss and inconvenience, caused to litigants by a sudden halt in the working of the machinery of the Government in Departments which deal with affairs concerning the life, liberty and well-being of the people. Pakistan will not be achieved by shouting. Let us all take warning that Pakistan will be a dismal failure unless the Administration can be run smoothly and at a high level of efficiency.

I am convinced that it was a grievous blunder to leave it to officers to choose which of the two Dominions they would prefer to serve. For five years communal passions among the people had been roused to the highest pitch, and it was but natural that Muslims would opt for pakistan and Hindus for Hindusthan. In this insensate rush for the satisfaction of communal ideology, Pakistan has definitely suffered. Muslims are yet in a minority in services requiring technical knowledge and Khwaja Nazimuddin would do well to realize that for very many years to come the Pakistan Administration cannot be run by Muslim officers only.

This is no reflection on Muslim officers. I know almost all the officers in the higher ranks of the services and I have nothing but praise for their devotion to duty, public spirit and capacity for work. But they cannot be expected to be superhuman, and once they have filled up as many posts as is reasonably possible the remaining posts should be given to select non-Muslims who may be willing to co-operate with their Muslim brethren in making Pakistan a success.

I sincerely warn Khwaja Nazimuddin that if he fills responsible positions in the public services, especially the judicial service, with incompetent aspirants after power, he will bring about the downfall of Pakistan.

Let Hindu and Muslim officers be made to work together and bear common responsibilities, and all suspicions about Pakistan and Hindusthan will disappear. I know from personal experience that Hindus and Muslims in the public services invariably fraternize in public and private life, paralleled only by what happens in fighting units on a battlefield. This fraternization among officers will filter down to the masses and communal friction will completely vanish.

I know that there are hundreds of officers who are anxious to change the dictum taken by them in a state of panie. Let them be given the option to serve the Dominion of their birth and all will be well in Pakistan and Hindusthan.

এইভাবে ফজলুল হকই সর্বপ্রথম নাজিমুদ্দিন মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। দেশভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পর দুই রাষ্ট্রের হিন্দু-মুসলিম কর্মচারীরা নিজেদের পছন্দমতো রাষ্ট্রে চলে যাবার জন্য আবেদন করেন। এই সময়ে হিন্দু কর্মচারীরা ভারতে চলে আসেন, আর মুসলমান কর্মচারীরা পাকিস্তানে চলে যান। ফজলুল হক মনে করেন, এই ব্যবস্থা সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বজায় রাখার পক্ষে সহায়ক হবে না। যোগ্য হিন্দু কর্মচারীর অভাবে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি কখনোই মনে-প্রাণে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর মনে হয়, দেশভাগের ফলে বাঙালি মুসলমানদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। তাই তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের পাকিস্তানে যেতে নিষেধ করেন। তাঁর নির্দেশমতো তাঁর কয়েকজন অন্তরঙ্গ-ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পূর্ব বঙ্গের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করেও ভারতেই থেকে যান। ফজলুল হক নিজেও কলকাতায় থাকার সিদ্ধান্ত করেন। কিছুদিন তিনি কলকাতা-ঢাকা যাতায়াত করে উভয় বঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তারপরে ফজলুল হক পারিবারিক ও রাজনৈতিক কারণে স্থায়ীভাবে ঢাকাতে বসবাস শুরু করেন।

তাঁর সাধের বাংলাদেশের মর্যাদা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করবার অভিপ্রায়ে পূর্ব পাকিস্তানে জিন্না ও মুসলিম লিগের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করবার উদ্দেশ্যে তিনি প্রস্তুত হতে থাকেন। প্রথম থেকেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে একমাত্র জাতীয় ভাষারূপে স্বীকৃতি দিয়ে এই ভাষাকে অন্যান্য ভাষাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেন এবং পাকিস্তানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। অথচ ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের লোকগণনা অনুযায়ী দেখা যায়, সমগ্র পাকিস্তানের জনসমষ্টির ৩.৩ ভাগ অংশের মাতৃভাষা হল উর্দু। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশের অধিবাসী নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলেন। অন্যদিকে সমগ্র পাকিস্তানের বেশিরভাগ জনসমষ্টির মাতৃভাষা হল বাংলা। তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দুকে জাতীয় ভাষা করার চেষ্টা হয়। এমনকি পাকিস্তান কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বাঙালি সস্যদের পর্যন্ত বাংলা ভাষায় বত্তৃতা দিতে দেওয়া হয়নি। এর বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ করা হয় তখন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলি খান ঘোষণা করেন:

Pakistan is a Muslim State and it must have as its lingua franca the language of the Muslim nation… It is necessary for a nation to have one language and that language can only be Urdu and no other language.

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই উলেমাদের তৎপরতাও শুরু হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল জেলার সরষিণাতে পূর্ব পাকিস্তান উমেলা সম্মেলন হয়। প্রতিটি জেলা থেকে প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। মৌলানা অবদুর রউফ দানাপুরী সভাপতিত্ব করেন। এখানে গৃহীত প্রস্তাবে যে সমস্ত দাবি করা হয় তার মধ্যে কোরান ও সুন্নতের নীতি বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন না করা, বিবাহ ও বিচ্ছেদের জন্য কাজির আদালত স্থাপন করা, মুসলমান ছেলে-মেয়েদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয় ছিল। তা ছাড়া উর্দুকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একমাত্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেবার দাবিও জানানো হয়। পূর্ব বঙ্গে উলেমারাই সর্বপ্রথম উর্দুর দাবিতে সোচ্চার হন এবং পাকিস্তানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত করার কথা বলেন। উলেমাদের নিয়োগ করে জিন্নাপন্থীরা নিজেদের প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করেন।

দেশভাগের পরেই পাকিস্তানের শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানকে কমিউনিস্ট ও হিন্দুদের প্রভাবমুক্ত করার জন্য কংগ্রেস, কমিউনিস্ট ও গণআন্দোলনের অন্যান্য কর্মীদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালায় এবং অসংখ্য কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। তার ফলে অনেকেই শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কাজকর্মের কোনো সুযোগ না থাকায় বহু কমিউনিস্ট কর্মী আত্মগোপন করেন। পূর্ব বঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রথমে যাঁরা উদ্যোগী হন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট কর্মীরা। কিন্তু তাঁদের পক্ষে পূর্ব বঙ্গের গণ-আন্দোলনকে পরিচালিত করা ও প্রসারিত করা সম্ভব ছিল না। দেশভাগের পূর্বে প্রধানত হিন্দু-প্রধান অঞ্চলকে ভিত্তি করেই কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির গণভিত্তি গড়ে ওঠে। কয়েকটি অঞ্চলে মুসলমান কৃষকদের মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রভাব থাকলেও গোটা পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক সীমানা ও জনসংখ্যার কথা মনে রাখলে সেগুলিকে অনেকটা ছোটো ছোটো পকেটের মতো মনে হবে। তা ছাড়া কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির বেশির ভাগ কর্মী ও নেতাই ছিলেন হিন্দু। দলে দলে হিন্দুরা ভারতে চলে যাওয়ায় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট কর্মীরা ভয়ানক অসুবিধায় পড়েন। এই দুইটি দলের যে গণভিত্তি ছিল তা ধবসে যায়। অনেক কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট কর্মী ও নেতা ভারতে চলে যান। এই অবস্থায় পূর্ব বঙ্গের কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে তাদের বক্তব্য বিষয় নিয়ে জনসাধারণের সামনে হাজির হওয়া কষ্টকর ছিল। মুসলমান জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায়, সরকারি দমননীতির ফলে কমিউনিস্টরা আত্মগোপন করতে বাধ্য হওয়ায় এবং গণভিত্তি নষ্ট হওয়ার ফলে ক্ষুদ্র সংগঠনে পরিণত হওয়ায়, অপরিসীম দুঃখকষ্ট সহ্য করেও কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে পূর্ববঙ্গের গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব ছিল না। অবশ্য এই দু-টি দলের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টিই ছিল সবচেয়ে বেশি সংঘবদ্ধ ও মজবুত। আর কমিউনিস্টরাই মুসলমান যুবক ও ছাত্রদের সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় আকৃষ্ট করার জন্য আত্মনিয়োগ করেন, বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমিক ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতি গড়ে তোলেন। অন্যদিকে কয়েকটি জেলায় প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ পূর্ব-পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা প্রবর্তনে সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করেন। উভয় দলই উপলব্ধি করে, মুসলমান ছাত্র, যুবক ও শিক্ষিত ব্যক্তিরা এগিয়ে এসে নেতৃত্ব না দিলে এই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দু-বছরের মধ্যেই মুসলিম লিগ বিরোধী নতুন দল গড়ে ওঠে। এইভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বে যে শূন্যতা ছিল তা দূর হয়।

উদীয়মান মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানেরা ভেবেছিলেন দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবাধ বিকাশের সম্ভাবনা দেখা দেবে। কিন্তু তাঁরা বিস্মিত হলেন এই দেখে যে, পাকিস্তানের শাসকেরা সাংস্কৃতিক জীবনের স্বাভাবিক পথকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্পদ ও সদ্য গড়ে ওঠা মূলধনের উপর বহিরাগত পীর, ধর্মব্যবসায়ী ও শাসক শ্রেণির লোকদের একচেটিয়া আধিপত্যকে নিরঙ্কুশ রাখার জন্য মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়, বাংলা ভাষা মুসলিম ধর্মের প্রকৃত বাহন হতে পারে না, পবিত্রভাব প্রকাশের মাধ্যমও হতে পারে না। তা ছাড়া পূর্ব বঙ্গের যাবতীয় দেশজ ক্রিয়াকাণ্ড, আচার-পদ্ধতিতে হিন্দুয়ানী ও পৌত্তলিকতার ছাপ রয়েছে। সুতরাং, প্রকৃত মুসলিম হতে হলে এবং মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশকে সম্ভবপর করতে হলে এইসব সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করতে হবে। এইভাবে ধর্মান্ধতার আবরণে দেশজ সংস্কৃতি তথা প্রবহমান গণসংস্কৃতি থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র চলে। কিন্তু দেশভাগের পরেই একদিকে যেমন ইসলামিকরণের প্রচেষ্টা দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি তারই পাশাপাশি আর একটি বলিষ্ঠ ভাবধারা বাঙালি সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে প্রবহমান হয়। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমানেরা তথাকথিত মুসলিম সংস্কৃতির আবরণ থেকে নিজেদের মুক্ত করে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের এক গভীর যোগসূত্র আবিষ্কার করেন। গভীর দরদ ও অধ্যবসায় সহকারে তাঁরা বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। এই আত্মানুসন্ধান বাঙালি মুসলমানদের স্বাধীন চিন্তার অধিকারী করে তোলে। সম্প্রদায়ের নির্দেশ ও শাস্ত্রবাক্যের জটাজাল ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে তাঁরা বুঝতে চাইলেন তাঁদের জীবনে আনুষ্ঠানিক ও সাম্প্রদায়িক ধর্মের স্থান কতটুকু রয়েছে। তাঁরা উপলব্ধি করেন, ধর্মকে তার ন্যায্য প্রাপ্যের চেয়ে বেশি দিলে সবচেয়ে বেশি লোকসান হয় মানুষেরই। এই কারণে মুক্ত চিন্তার সঙ্গে ধর্মান্ধতার বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের পক্ষে ধর্মান্ধতাকে জিইয়ে রেখে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখা কষ্টকর হয়।

এই নতুন ভাবধারার সুষ্পষ্ট ও বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটে ভাসা আন্দোলনে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে পূর্ব বঙ্গের ছাত্রসমাজ গর্জে ওঠেন। এই ভাষা আন্দোলন সমগ্র বাঙালি জাতির আন্দোলনে পরিণত হয়। মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন খুবই আতঙ্কিত হন। মার্চ মাসে জিন্না ঢাকা আসেন। তিনি ঢাকার জনসভায় উর্দুর সমর্থনে বক্তব্য রাখায় বহুসংখ্যক বাঙালি শ্রোতা সভা পরিত্যাগ করে চলে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে জিন্না একই মনোভাব ব্যক্ত করায় প্রচণ্ড ছাত্র বিক্ষোভের সম্মুখীন হন এবং তার ফলে তাঁর পক্ষে ভাষণ সমাপ্ত করা সম্ভব হয়নি। পরে ‘স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে জিন্নার আলোচনা তিক্ত বাদানুবাদের মধ্যে শেষ হয়। তারপরে জিন্না আর কখনও পূর্ব বঙ্গে আসেননি। এই তাঁর প্রথম ও শেষ আগমন। জিন্নার বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের বিক্ষোভ পূর্ব বঙ্গের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ফজলুল হক প্রথমে এই আন্দোলনের গুরুত্ব বিশেষ উপলব্ধি করতে পারেননি। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১১ মার্চ (১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ) যে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় তাতে ছাত্রদের যোগ্য নেতৃত্ব ও পুলিশের নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে তাঁর চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটে। সেদিন ঢাকা হাইকোর্টের সামনে ছাত্রদের পিকেটিং থাকায় ফজলুল হক ও অন্যান্য উকিলেরা তাঁদের মামলা মোকদ্দমা পরিচালনা করতে ভিতরে ঢুকতে পারেননি। প্রথমদিকে হাইকোর্টের ভিতর প্রবেশ করার চেষ্টা করায় তাঁদের সঙ্গে ছাত্রদের আলোচনা ও বাদানুবাদও হয়। কিন্তু যখন উকিলেরা দেখেন যে, ছাত্রদের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করছে তখন তাঁরা সেদিনের মতো আদালত বর্জন করেন। এই ঘটনার এক অসত্য ও বিকৃত বিবরণ তৎকালীন পূর্ববঙ্গের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মহম্মদ আইয়ুব খান তাঁর Friends Not Masters নামক গ্রন্থে দেন। তাতে আইয়ুব খান লেখেন, তিনি হাইকোর্টের নিকট এসে দেখেন ফজলুল হক ছাত্রদের আদালতের কাজে বাধা সৃষ্টি করতে বলছেন। কিন্তু তাঁকে সামনে দেখে ফজলুল হক এতটা ভীত হয়ে পড়েন যে, তিনি ছাত্রদের শান্তভাবে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলেন।১০

ঢাকা হাইকোর্টের নিকট হতে চলে এসে ফজলুল হক সেক্রেটারিয়েটের সামনেও একদল ছাত্রকে দেখেন। তিনি তাঁদের নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেন ও বাড়ি ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। তিনি যখন তাঁদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন হঠাৎ একদল ছাত্রকে পুলিশ ধাওয়া করে। তাঁরা দৌড়ে এসে তাঁর নিকট জড়ো হন। তখন পুলিশ তাঁদের উপর লাঠিচার্জ করে। লাঠির একটি বাড়ি ফজলুল হকের হাঁটুর উপর পড়ে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর সেই ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করা হয়।১১ প্রথমে এই ক্ষত গুরুতর মনে না হলেও, পরে এই পায়ের ব্যথায় আজীবন তাঁকে কষ্ট পেতে হয়। এই আন্দোলনের প্রভাব তাঁর উপর এতটা পড়ে যে, বিধানসভার নিয়ম লঙ্ঘন করে ফজলুল হক ও আরও কয়েকজন নেতা বিধানসভায় কয়েকদিন বাংলাতে বত্তৃতা করেন।১২ তখন থেকেই তিনি মুসলিম লিগ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নার মৃত্যুর পর নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর-জেনারেল নিযুক্ত হন। পূর্বপাকিস্তানে নুরুল আমিন মুখ্যমন্ত্রীরূপে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রাদেশিক লিগ সরকারের স্বৈরাচারী নীতি ও অবাঙালি আমলাতন্ত্র ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভূস্বামী ও পুঁজিপতিদের নিকট সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করায় মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গবাসী ঘৃণা ও ক্রোধ প্রকাশ করেন। শিক্ষিত ও সচেতন বাঙালি মুসলমানেরা প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করে লিগবিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই বিষয়ে প্রথমে উদ্যোগী হন ফজলুল হক, মৌলানা ভাষানী ও সুরাবর্দি। একসময়ে এঁরা তিনজন ছিলেন মুসলিম লিগের প্রধান তিনটি স্তম্ভ। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে সুরাবর্দির চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটে। পাকিস্তানের মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি নতুন দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও তিনি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ তখনও তিনি ভারতেই বসবাস করছিলেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩-২৪ জুন মৌলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকায় পূর্ববঙ্গের প্রায় তিনশত মুসলিম লিগ কর্মীর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লিগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়।১৩ ২৩ জুন ফজলুল হক এই সম্মেলনে কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন : মুসলিম লিগ শাসনে জনসাধারণের চরম দুর্ভোগ হচ্ছে এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা পদদলিত করা হচ্ছে। দলীয় প্রভাবের চাপে সদস্যরা বিভিন্ন গণদাবি আইন সভায় পেশ করতে পারেন না। এইসব সদস্যের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁদেরকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করা প্রয়োজন। আর অবিলম্বে যুবসমাজ ও লিগ কর্মীদের সাধারণ মানুষকে সংঘবদ্ধ করার জন্য এগিয়ে আসা উচিত। পরিশেষে তিনি একথাও ঘোষণা করেন যে, জনগণের স্বার্থ রক্ষার্থে সংগ্রামের জন্য তিনি নিজেও প্রস্তুত আছেন।১৪ ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মৌলানা ভাষানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম লিগ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন নতুন গতিবেগ লাভ করে। সাড়ে তিন বছর পর সুরাবর্দি এই দলে যোগ দেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে মৌলানা ভাসানীর উদ্যোগেই ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে দলের নাম আওয়ামী লিগ রাখা হয়। তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয়কে নিয়ে এই দলকে একটি শক্তিশালী জাতীয় দলে পরিণত করতে চেষ্টা করেন। অনেক কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট কর্মী এই দলের মধ্যে ঢুকে কাজকর্ম শুরু করেন।১৫ তার ফলে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা সহজ ও স্বাভাবিক হতে থাকে। তাঁরা যৌথভাবে মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।

কিন্তু পাকিস্তানের শাসকেরা চুপ করে বসে থাকেনি। পূর্ব বঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্তব্ধ করে দেবার জন্য তাঁরা যাবতীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করে। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষার জন্য উর্দু হরফ চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করলে ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র বিক্ষোভ দেখা দেয়। ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ) ছাত্র শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে পুলিশ গুলি চালায়। তাতে কুড়িজন নিহত ও চারশত ব্যক্তি আহত হন। কিন্তু এক ব্যাপক গণবিক্ষোভের সামনে সরকারকে মাথা নত করতে হয়। বাংলা ভাষার দাবি মেনে নিতে হয়। এই ভাষা আন্দোলনের ফলে মুসলিম লিগের শক্তি দ্রুত হ্রাস পায়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে কয়েকটি দল মুসলিম লিগ সরকারের বিরুদ্ধে সমস্ত দল নিয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে।১৬ তাদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে নির্বাচনের দাবি করা হয়। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন একবার ঘোষণা করেন যে, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তিনি এই প্রতিশ্রুতি পালন করেননি। প্রায় একবছর নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখে ঘোষণা করা হয়, ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়। এই উদ্দেশেই ২২ মার্চ (১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ) ফজলুল হক তাঁর ঢাকার বাসভবনে একটি সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। তিনি ঐ বছরের ২৭ জুলাই নিজের কৃষক প্রজা সমিতিকে সময়োপযোগী করে ‘কৃষক-শ্রমিক দল’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।১৭

যখন ফজলুল হক মুসলিম লিগ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত ছিলেন তখন তাঁর ‘একমাত্র ভ্রাতা’ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর আকস্মিক মৃত্যুর (২৩ জুন, ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ) সংবাদ পেয়ে তিনি খুবই বিচলিত হন ও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করেন। তিনি জাস্টিস রমাপ্রসাদ মুখার্জীর নিকট একটি বার্তায় বলেন:

The loss of the only brother I had in this world had driven me mad with sorrow. Your grief and loss cannot be expressed in words but believe me that mine also is no less heart-rending than yours. I am praying to the Almighty to give both of us consolation in this great national calamity.১৮

এই সময়ে আত্মীয়-পরিজনদের নিকট বারে বারে এই বেদনার কথা তিনি উল্লেখ করেন। সবাইকে স্যার আশুতোষ মুখার্জীর পরিবারের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ও এই পরিবারের প্রতি তাঁর ঋণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তাই স্যার আশুতোষের স্নেহধন্য ফজলুল হক শ্যামাপ্রসাদের অভাবের কথা গভীরভাবে অনুভব করেন।

মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনার সময় তাঁর চোখের সামনে সেই পুরোনো দিনগুলির কথা ভেসে ওঠে যখন তিনি বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক দেখেছিলেন। আবার কী করে সেই দিনগুলি ফিরে পাওয়া যায়, এই আকুলতা তাঁর মধ্যে দেখা যায়। তাই নতুন করে যখন তিনি সামনের দিকে তাকালেন তখন তাঁর মন বাঙালি জীবনের গভীরে প্রবেশ করে। সেখান থেকে তাঁর বেদনাসিক্ত মন রস আহরণ করে শক্তি অর্জন করে।

১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর ফজলুল হক, মৌলানা ভাসানী ও সুরাবর্দির নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তাহারে একুশ দফা দাবি সন্নিবিষ্ট করা হয়।১৯ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের পাকিস্তান প্রস্তাবকে ভিত্তি করে পূর্ব পাকিস্তানকে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য দাবি করা হয়। এই ইস্তাহারে বলা হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্বে থাকবে দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা, আর অবশিষ্ট ক্ষমতা সহ (Residuary Powers) অন্য সমস্ত বিষয়ে পূর্ণ অধিকার পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারের থাকবে।২০ ফজলুল হক, ভাসানী ও সুরাবর্দি এই প্রোগ্রাম নিয়ে গোটা পূর্ববঙ্গের অসংখ্য জনসভায় জিন্না ও মুসলিম লিগের সমালোচনা করেন। এই নির্বাচনে মুসলিম লিগ সম্পূর্ণভাবে ধরাশায়ী হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে শের-ই-বঙ্গাল ফজলুল হক হলেন পূর্ব পাকিস্তানের নব গঠিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার মুখ্যমন্ত্রী। পূর্ব পাকিস্তানে এক নতুন যুগের সূচনা হয়।২১

১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিল মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক কয়েকদিনের জন্য কলকাতায় আসেন। পশ্চিমবঙ্গবাসী সমস্ত অন্তর দিয়ে তাঁকে সংবর্ধনা জানান। কয়েকটি সংবর্ধনানুষ্ঠানে ফজলুল হক তাঁর ভাষণে বাঙালির প্রাণের কথা ব্যক্ত করেন। ৩ মে নেতাজি ভবনে এক ভাষণে তিনি বলেন:

বাঙালি এক অখণ্ড জাতি। তাঁহারা একই ভাষায় কথা বলে এবং একই সুসংহত দেশে বাস করে। তাঁহাদের আদর্শ এক এবং জীবনধারণের প্রণালীও এক। বাংলা অনেক বিষয়ে সারা ভারতকে পথ প্রদর্শক করিয়াছে এবং দেশ বিভাগ সত্ত্বেও জনসাধারণ তথাকথিত নেতৃবৃন্দের ঊর্ধ্বে থাকিয়া কাজ করিতে পারে।… আজ আমাকে ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস গঠনে অংশগ্রহণ করিতে হইতেছে। আশা করি ‘ভারত’ কথাটির ব্যবহার করায় আমাকে আপনারা ক্ষমা করিবেন। আমি উহার দ্বারা পাকিস্তান ও ভারত উভয়কেই বুঝাইয়াছি। এই বিভাগকে কৃত্রিম বিভাগ বলিয়াই আমি মনে করিতে চেষ্টা করিব। আমি ভারতের সেবা করিব।২২

তিনি শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন:

তিনি ভারতের এই দুইজন শ্রেষ্ঠ সন্তানের নিকট হইতে মাতৃভূমির সেবায় নিঃস্বার্থ কর্মের প্রেরণা লাভ করিয়াছেন। বর্তমানে সমগ্র ভারত উপদ্বীপে যখন সাম্প্রদায়িকতা ছাইয়া গিয়াছে, তখন ঐ দানবের ঊর্ধ্বে উঠিবার মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করিয়াছেন বলিয়া তিনি মনে করেন। তিনি তাঁহাদের নিকট হইতে এই মহান সত্য শিক্ষা করিয়াছেন যে, ভারতীয় হিসেবে ‘আমরা দল এবং সাম্প্রদায়িক বিবেচনার ঊর্ধ্বে।২৩

ফজলুল হক পূর্ব বঙ্গের হিন্দুদের সমস্যা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন। তাই তিনি বলেন:

তিনি বুঝিতে পারিয়াছেন গত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা ব্যর্থতায় পীড়িত হইয়াছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা যেন আর কখনও মাথা তুলিতে না পারে তিনি সেজন্য ব্যবস্থা করিবেন। তাঁহার রক্তের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্র নাই। হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণের ভৃত্য বলিয়া তিনি নিজেকে মনে করেন।২৪

বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর প্রীতি ছিল অপরিসীম। প্রিন্সেসের (গ্রান্ড হোটেল) সুপ্রশস্ত হলে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ জনসাধারণের পক্ষ থেকে ৪ মে সম্বর্ধনা জানানো হয়। উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্য থেকে কেউ তাকে ইংরেজিতে, আবার কেউ বাংলাতে বত্তৃতা দিতে বলেন। বহু ভাষাবিদ ফজলুল হক তাঁর প্রাণের ভাষা বাংলাতেই ভাষণ দেন। তিনি বলেন:

পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে পূর্ববঙ্গে বঙ্গভাষার জন্য উৎসাহ বেশি। এমনকি, বঙ্গভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করিবার জন্য পূর্ববঙ্গে একটি ক্ষুদ্র শিশুও প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আসুন, আমরা রাজনীতি ভুলিয়া আমাদের মহান সংহতির ধারক শ্রেষ্ঠ ভাষার ঐতিহ্যের কথা চিন্তা করি।… বাঙলার মঙ্গল, বাঙলা ভাষার সেবা, বাঙালি জাতির উন্নতি ও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জনসাধারণের সেবায় জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি নিয়োজিত করাই তাঁহার জীবনের একমাত্র আকাঙক্ষা।২৫

ফজলুল হক প্রকাশ্যেই বলেন যে, ‘পাকিস্তান’ শব্দের কোনো অর্থ হয় না। যাদের কায়েমি স্বার্থ আছে তারাই এই শব্দটি সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন:

পাকিস্তান বলিতে প্রকৃতপক্ষে কিছুই বুঝায় না। উহা বিভ্রান্তি সূচনা করিবার একটি পন্থা। ইহা কেবল উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মাত্র।২৬

ফজলুল হক বলেন যে, তিনি রাজনৈতিক বিভাগে বিশ্বাস করেন না। তিনি ঘোষণা করেন, ‘দুই বাঙ্গলার মানুষে মানুষে কোন ভেদ নাই। এই কৃত্রিম সীমারেখা আমি মানি না।’ সেদিন কলকাতায় বিরাশি বছরের বৃদ্ধ শের-ই-বঙ্গাল ফজলুল হকের কণ্ঠে ধবনিত হয়েছিল:

জীবনের প্রান্ত সীমায় পৌঁছিয়া আমার আর কোনো আশা বা আকাঙক্ষা নাই। উভয় বঙ্গের মধ্যে যে মিথ্যার প্রাচীর রচিত হইয়াছে, তাহা অপসারিত করিবার কাজ যদি আমি আরম্ভ করিয়া যাইতে পারি, তাহা হইলেই নিজেকে ধন্য মনে করিব। দুই বাঙ্গলার মধ্যে যে ব্যবধান আছে তাহা একটি স্বপ্ন ও ধোঁকা মাত্র। করুণাময় খোদাতাল্লার দরবারে আমার একটি প্রার্থনা তিনি যেন এই ব্যবধান দূর করেন। আমার এই আকাঙক্ষা যাতে পূরণ হয় সেইজন্য আপনারা আমাকে দোয়া করুন।২৭

কলকাতায় ফজলুল হক যে বলিষ্ঠ মনোভাব ব্যক্ত করেন তাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বিগ্ন হয়। তাই তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার বৃহত্তর গণসংগ্রামের নেতা ফজলুল হকের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দিতে চায়। করাচি বন্দর থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে পা দেওয়া মাত্র তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁকে পদচ্যুত করে নিজ গৃহে অন্তরীণ করা হয়। এইভাবে পঁয়তাল্লিশ দিনের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা বাতিল করা হয়। বলা হয়, ফজলুল হক ‘ভারতের চর’। তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রধান অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল:

Mr. A. K. Fazlul Huq was in league with India and tryin to undo Pakistan by seceding.২৮

কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেবে মস্তবড়ো ভুল ছিল। তাঁরা ভেবেছিল একদা জিন্না ফজলুল হককে পর্যুদস্ত করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিজয়কেতন উড়িয়েছিলেন। সুতরাং, জিন্নার প্রকৃত উত্তরাধিকারীরূপে তারাও সাম্প্রদায়িক ও ভারত বিরোধী জিগির তুলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের সংগ্রাম ধবংস করতে পারবে। অবস্থার যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে তা তারা বুঝতে পারেনি। দেশ বিভাগের পূর্বে ফজলুল হক মুসলমান সমাজের বৃহৎ অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে বেশির ভাগ পাকিস্তান দাবির সমর্থক ছিলেন। প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় ফজলুল হককে এই সর্বনাশা নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। তারপর এই কয়টি বছরে পূর্ব পাকিস্তানে যে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের অভ্যুদয় হয়েছে তাঁরা বুঝতে পারলেন পূর্ববঙ্গের বেদনার মূল কারণ কি। অশিক্ষিত অবহেলিত কৃষক সম্প্রদায় ও বিভিন্ন কলকারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকেরা দেখতে পেলেন কারা তাঁদের নিষ্পেষণ করছে। তাই এবার আর ফজলুল হককে বিচ্ছিন্ন করা সহজ ছিল না। ফজলুল হক আর শুধুমাত্র একটি মাত্র নয়। তিনি হলেন নিপীড়ন আর বিভেদপন্থার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তা, ঔদার্য ও সংস্কারমুক্ত মনের মূর্ত প্রতীক। ‘মুক্ত বাংলার’ জয়গান তাঁরই কণ্ঠে প্রথম ধবনিত হয়। পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা প্রথমে তিনিই উড্ডীন করেন। তাই তিনি হলেন পূর্ব বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি যে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করেন পরবর্তীকালে তাকে আরও ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন মৌলানা ভাসানী, সুরাবর্দি ও মুজিবর রহমান। বয়সের ভারে ফজলুল হক পিছিয়ে পড়লেও বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ধারা প্রবাহমান থাকে, আর তা নতুন চেতনায় পূর্ব বঙ্গের মানুষকে উজ্জীবিত করে।

তথ্যসূত্র

Statement issued by A.K. Fazlul Huq, dated 5 September, 1947. Vide The Statesman, 6 September, 1947.

Ibid.

Interview with Wazir Ali and Yusuf Ali.

Ali, Tariq, Pakistan : Military Rule or people’s power, London, 1970, p. 48.

Hindusthan Standard, 10 September, 1947.

Lahiri, Pravas Chandra, Pak-Bharater Ruparekha, Nadiya, 1375; Umar, Badruddin, Purba Banglar Bhasa Andolan O Tatkalin Rajniti (Pratham Khanda), Indian Edition, Calcutta, 1378; ‘Bangladesher Kommunist Party Samparke Du Ekti Katha’ (In Bengali) by Khoka Roy, Member of the Central Committee of the Bangladesh Communist Party, published in the ‘Mulyayan’, Edited by Satyendranarayan Majumdar and Narahari Kaviraj, Saptam Barsa, Choturtha Sankha, 1378, pp. 36–57.

প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ী ও বদরুদ্দিন উমর তাঁদের গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে তৎকালীন ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করেছেন। খোকা রায়ের প্রবন্ধ থেকে পূর্ব বঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।

Sultan, Azad (Edited), Desh Kone Pathe? (In Bengali), 2nd Edition, Dacca, 1963, pp. 1–62. পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইত্যাদি বিষয়ের উপর লিখিত পাঁচটি সুচিন্তিত প্রবন্ধ এই সংকলন গ্রন্থে আছে। Vide also Umar, Badruddin, Purba Banglar Bhasa Andolan, pp. 1–51, 265–296.

Ali, Tariq, Pakistan, pp. 48–50.

Umar, Badruddin, Purba Banglar Bhasa Andolan. pp. 71–72.

১০ Ayub Khan, Mohammad, Friends not masters : a political autobiography, London, 1967, p. 30.

১১ Gupta, Amitava, Purba Pakistan (In Bangali), 1st edition, Calcutta, 1376, p. 15; Vide also Umar, Purba Banglar, p. 73.

১২ Lahiri, Pak-Bharater Ruparekha, p. 303.

১৩ Umar, Purba Banglar, pp. 256–257.

১৪ Ibid, p. 257.

১৫ Lahiri, Pak-Bharater, p. 349.

১৬ Ali, Tariq, Pakistan, pp. 50, 61.

১৭ Abdur Rab, Sahid Suhrawardy, p. 88.

১৮ Amrita Bazar Patrika, 26, June, 1953.

১৯ Abdur Rab, Sahid Suhrawardy, p. 89; Banerjee, D. N., East Pakistan A casestudy in Muslim Politics, Delhi, 1969, pp. 66–69.

২০ 21 Point Programme – Reprinted in Ek Shatabdi by Abdul Khalek, pp. 219–222.

২১ Abdur Rab, Sahid Suhrawardy, pp. 90–92,

২২ Speech delivered by A. K. Fazlul Huq at Calcutta, Vide Ananda Bazar Patrika, 4 may, 1954.

২৩ Ibid.

২৪ Ibid.

২৫ Ibid. 5 May, 1954.

২৬ Ibid. 4 May, 1954.

২৭ Ibid. 3–4 May, 1954; Vide an article ‘Bangali Fazlul Huq’ by Partha Chattopadhyay, published in the Ananda Bazar Patrika on 28 April, 1971; Vide also Gupta Amitava, Purba Pakistan, pp. 32–46.

২৮ Case For Bangla Desh (A Collection of Documents), CPI. Publication. New Delhi, May, 1971, P. 29; Banerjee, D. N., East Pakistan, pp. 70–73.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *