বাঙলা ভূতাত্ত্বিক চঞ্চলতা ও নদনদী

বাঙলার ভূতাত্ত্বিক চঞ্চলতা ও নদনদী

প্রায় ৪৫০ কোটি বৎসর পূর্বে ভারত ছিল উত্তপ্ত মৌলিক ভূতাত্ত্বিক স্তরে আবৃত। এই স্তর ক্রমশ শীতল হয়ে যে শিলায় রূপান্তরিত হয়েছিল, তাকে বলা হয় ‘আর্কিয়ান’ শিলাবিন্যাস। এই স্তরেরই বিবর্তনের কোনও এক যুগে ভারতের মধ্য-অঞ্চলকে আলোড়িত করে বিন্ধ্যপর্বত মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অঞ্চলই ভারতের প্রাচীনতম অংশ। এর পরে সৃষ্ট হয়েছিল হিমালয়ের পর্বতমালা। হিমালয় ও বিন্ধ্য——এই দুই পর্বতের অন্তর্বর্তী অঞ্চলে আবির্ভূত উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল গঙ্গানদী।

সরাসরি পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা বাঙলার উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত রাজমহল-শৈলে প্রতিহত হয়ে দক্ষিণপথে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে প্রবেশ করেছে। কিন্তু এসব কথা যত সহজভাবে বলা হচ্ছে, তা তত সহজে ঘটেনি। কোটি কোটি বৎসর ধরে চলেছিল ভূতাত্ত্বিক আলোড়ন ও রূপান্তর। লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে বাঙলাদেশ প্লাবিত হয়েছিল সমুদ্রের জলরাশিদ্বারা। আবার জলরাশি যখন অপসৃত হয়েছিল তখন রেখে গিয়েছিল স্তরে স্তরে পলিমাটি। সমুদ্রের জলের এই বিস্তারের পরিসমাপ্তি ঘটে ভূতত্ত্ববিদ্‌গণ যাকে বলেন প্লাওসিন যুগ (প্রায় দশ থেকে পঁচিশ লক্ষ বৎসর পূর্বে)। কিন্তু এই পরিসমাপ্তির পূর্বেই গঠিত হয়েছিল রাজমহল থেকে শুরু করে গারো ও নাগা-পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত শিলাস্তর-বিন্যাস। এগুলি হিমালয়েরই কতকগুলি শিলাশাখা দক্ষিণাভিমুখী হয়ে প্রসৃত হয়েছে। উত্তরের হিমালয়ের অন্তর্ভুক্ত দার্জিলিং-এর শৈলশৃঙ্গ ও পশ্চিমে বিন্ধ্য পর্বতের শাখা হিসাবে সাঁওতাল পরগনার পর্বতমালা বাঙলাকে বেষ্টন করে রেখেছে। এ ছাড়া, বাঙলার অভ্যন্তরে আর বিশেষ কোন পাহাড় পর্বত নেই। যা আছে তা হচ্ছে বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া, মশক ও বিহারীনাথ এবং পুরুলিয়া জেলায় অযোধ্যা ও বাগমুণ্ডি পাহাড়।

বাঙলার এই ভূতাত্ত্বিক গঠন সম্বন্ধে আমি আমার ‘হিস্ট্রী অ্যাণ্ড কালার অভ্ বেঙ্গল’ (১৯৬৩) বইয়ে কিছু বিশদ বিবরণ দিয়েছি। তা এখানে উদ্ধৃত করছি:

Bengal, as we know it today, is the product of a long process of geological formation. Widespread marine transgressions followed by regressions with consequent uplifts featured its geologic history down to Pleistoncene time it is believed that the latest of such regressions and uplifts are responsible for the development of the tertiary folded belt of Tripura, the propnounced uplift of the Shillong massif, and the less conspicuous uplift if the Garo-Rajmahal basement ridge. In spite of a long history of transgressions and uplifts, the beds constituting the western half of the Bengal delta have very low dips and the predominant structural deformation affecting the sediments are faults that were presumably developed at a number of different stages in the geologic history of the basin. The large alluvial basin is floored with Quaternary sediments deposited by the Ganges and Brahmaputra rivers and their numberous associated streams and distributaries. The Rajmahal Hills, which border the basin on the North-West and west are composed of traps and are considered to be lower Jurassic of the Upper Gondwana system. The hills and trap plateaus range from 500 to 800 feet above sea level, although some individual hills exceed 1500 feet in elevation. Physiographically the hill section is sharply differentiated from the lower, flat Quaternary alluvial and deltaic surfaces to the east. The Bengal basin is bounded on the north-east by the Shillong or Assam Plateau, locally known from west to east, as the Garo, Khasi, and Jaintia hills. The elevations of plateau summits range between 4500 and 6000 feet. The basement rocks are overlain by horizontal sandstone and nummulatic limestone. On the eastern side the Bengal basin is bounded by the Tipperah hills to the north and the

Chittagong hills to the south. (Dr. A.K. Sur,” History & Culture of Bengal”, 1963, page 17).

দুই

যুগযুগ ধরে বাঙলার চেহারার পরিবর্তন ঘটিয়েছে বাঙলার নদনদীসমূহ। একদিকে যেমন নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে তীরবর্তী অংশসমূহ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে, অপরদিকে তেমনই নদীগর্ভে অধিক পলিমাটি অবক্ষেপণের ফলে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলসমূহ নদী থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। কোনও কোনও স্থলে আবার নদীর গতির পরিবর্তন ঘটার ফলে ছোট-বড় নদীতে বিভক্ত হয়ে অঞ্চল বিশেষে জটাজালের সৃষ্টি করেছে। আবার কোনও কোনও স্থলে নদীর গতির পরিবর্তনের ফলে ঐশ্বর্যশালী গ্রামসমূহ তাদের প্রাচীন সমৃদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে।

বাঙলার ভূসংস্থানগত চঞ্চলতা যে এখনও শেষ হয়নি, তা বাঙলার নদীসমূহের স্রোতোধারা থেকে বুঝতে পারা যায়। ষোড়শ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত গঙ্গানদীর স্রোত রাজমহলের পাহাড় অতিক্রম করবার পর বর্তমান মালদহের অনতিদূরে প্রাচীনকালে অবস্থিত প্রসিদ্ধ গৌড়নগরের উত্তর দিয়ে এসে পরে দক্ষিণমুখে প্রবাহিত হত। এখন গঙ্গা ২৫ মাইল দক্ষিণে সরে এসে সূতীর কাছে দুভাগে বিভক্ত হয়েছে, ভাগীরথী ও পদ্মা নদীদ্বয়ে। আগে ভাগীরথীই প্রধান স্রোতোধারা ছিল। অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে পদ্মাই প্রধান স্রোতস্বতীতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া গঙ্গা আগে ত্রিবেণীর কাছে ভাগীরথী সরস্বতী ও যমুনা—এই ত্রিধারায় বিভক্ত হয়ে সাগরে প্রবেশ করত। এককালে এদের মধ্যে সরস্বতীই ছিল বড় নাব্য নদী এবং রূপনারায়ণ, দামোদর প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশাল নদীতে পরিণত হয়েছিল। এই নদী ক্ষীণ হওয়ার ফলে এর তীরস্থিত প্রাচীনকালের প্রসিদ্ধ বন্দর তাম্রলিপ্ত ও পরবর্তীকালের সপ্তগ্রাম বিনষ্ট হয় এবং ভাগীরথীর কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রথমে হুগলী ও পরে কলকাতা বন্দর হিসাবে প্রাধান্যলাভ করে। গত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে ভাগীরথীরও স্রোতোপথের পরিবর্তন ঘটেছে। পূর্বে ভাগীরথী কলকাতা অতিক্রম করবার পর পশ্চিমে শিবপুর অভিমুখে না গিয়ে সোজা দক্ষিণে কালীঘাট, বারুইপুর, মগরা প্রভৃতির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হত। বর্তমানে আদিগঙ্গার শুষ্ক খাতই ভাগীরথীর পূর্বখাতের চিহ্ন বহন করছে।

পূর্বদিকে ব্রহ্মণপুত্রনদেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে এবং নাঙ্গলবন্দের শুষ্কপ্রায় খাত এখন তার চিহ্নস্বরূপ বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমানকালের মেঘনানদী অপেক্ষা- কৃত পরবর্তীকালের সৃষ্টি। স্থলভাগে দক্ষিণবঙ্গেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত কোটালিপাড়ার বিল-অঞ্চলে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে একটি প্রসিদ্ধ বন্দর ছিল। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মনদী উচ্চতর প্রদেশ থেকে মাটি বহন করে এনে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গের যে বিস্তৃতি সাধন করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মোগলযুগও সুন্দরবন সুসমৃদ্ধ জনপদ ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণেও মগ দস্যুদের উৎপীড়নের সুন্দরবন তার সমৃদ্ধি হারায়।

দামোদর পালামৌ জেলার টোরির নিকট উচ্চগিরিশৃঙ্গ থেকে উদ্ভূত হয়ে সর্পিলগতিতে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে কলকাতার ৩০ মাইল দক্ষিণে হুগলী নদীতে গিয়ে পড়েছে।

বাঙলা নদীবহুল দেশ। অসংখ্য তাদের নাম। তাদের মধ্যে একটি অজয়। সাঁওতাল-পরগনার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে উদ্ভূত হয়ে বীরভূম ও বধর্মান জেলার সীমান্ত কিছুদূর পর্যন্ত নির্দেশ করে দিয়ে অজয় কাটোয়ার নিকট ভাগীরথীতে প্রবেশ করেছে। বর্ষার জলে পুষ্ট এই নদীটি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও নাব্য ছিল। এর উত্তরে ছিল উত্তর-রাঢ় বা কঙ্কগ্রামভুক্তি, দক্ষিণে দক্ষিণ-রাঢ় বা বর্ধমানভুক্তি। কংসাবতী ও রূপনারায়ণ অঞ্চলে ছিল সুহ্মদেশ ও তার দক্ষিণে ছিল দণ্ডভুক্তি। ওদিকে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার অন্তবর্তী ভূভাগে ছিল পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি। এর রাজধানী ছিল পুন্ড্রনগর বা বাণগড়। এর দক্ষিণে ছিল বঙ্গদেশ এবং তার দক্ষিণে ছিল হরিকেল ও বঙ্গালদেশ।

তিন

গঙ্গাই বাঙলার প্রধান নদী। হিমালয়ের গাড়বাল পার্বত্য অঞ্চলে গঙ্গোত্রী থেকে উৎপন্ন হয়ে সারা উত্তরভারতের ওপর দিয়ে এসে গঙ্গা রাজমহল পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিমে তেলিয়াগড় ও সকরিগলির সংকীর্ণ খাত অতিক্রম করে গিরিয়ার নিকট বাঙলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখান থেকে গঙ্গার একটা ধারা দক্ষিণদিকে ও অপর ধারা দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। দক্ষিণ ধারাটি মালদহের গৌড়শহরের ধ্বংসাবশেষের ধার দিয়ে প্রবাহিত। এখানে হিমালয় থেকে আগত মহানন্দা এসে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। একসময় গঙ্গানদী গৌড়নগরের আরও উত্তর-পূর্বদিক দিয়ে প্রবাহিত হত এবং গৌড়নগর বোধ হয় এর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত ছিল।

গঙ্গার এই ধারাটি আরও দক্ষিণে বহরমপুর, নবদ্বীপ, কালনা, চুঁচুড়া চন্দননগর, কলকাতা প্রভৃতি শহরের পাশ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। এই অংশ ভাগীরথী নামে পরিচিত। কেননা ভগীরথের শাপগ্রস্ত মৃত পূর্ব-পুরুষদের আত্মার উদ্ধারকল্পে গঙ্গার মর্তে আগমন বৃত্তান্তের সঙ্গে এ অংশ জড়িত। চুঁচুড়ার অদূরে ত্রিবেণীতে ভাগীরথীর শাখানদী সরস্বতী ও যমুনার সঙ্গমস্থল। ত্রিবেণীর মাহাত্ম প্লিনির যুগেও (খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী) খ্যাত ছিল। কলকাতার দক্ষিণে ভাগীরথীর প্রাচীন প্রবাহপথ আদিগঙ্গা নামে পরিচিত। এরই তটে কালীঘাটের মন্দির। এই পথেই আসত গ্রীক ও রোমান জগতের বণিকেরা বাঙলার সঙ্গে বাণিজ্য করতে। মধ্যযুগে বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল’-এ (১৪৯৫) এ নদীপথে বাণিজ্যতরীর যাতায়াতের উল্লেখ পাওয়া যায়। পর্তুগীজরাও এই জলপথ ব্যবহার করত। চৈতন্যদেবও (১৪৮৫-১৫৩৩) এই নদীপথের ওপর অবস্থিত ছত্ৰভোগ দর্শন করে তমলুক হয়ে, সেখান থেকে পুরী গিয়েছিলেন। এই প্রাচীন প্রবাহপথ ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে লুপ্ত হয়েছিল, কেননা ওই বৎসর কর্নেল টলি খিদিরপুর থেকে গড়িয়া পর্যন্ত এই কয়েক মাইল আংশিক পুনরুদ্ধার করেছিলেন। ওলন্দাজ ফান ডেন ব্রুকের (১৬৬০) মানচিত্রে সাগরদ্বীপের উত্তর-পূর্বে বর্তমান কাকদ্বীপ পর্যন্ত চিহ্নিত দেখা যায়। কিন্তু একশত বৎসর পরে রেনেলের মানচিত্রে এই স্রোতোধারা আর অঙ্কিত দেখা যায় না। জয়নগর থানার দক্ষিণ পর্যন্ত নানা পুরানো মন্দির, ঘাট, পুষ্করিণী এই লুপ্ত নদী-পথের স্বাক্ষর বহন করছে।

গঙ্গার দক্ষিণ-পূর্ব ধারা পদ্মা নামে পরিচিত। গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা ব্রহ্মপুত্রের প্রধান শাখা যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়ে বরিশাল ও নোয়াখালি জেলার ভিতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। কৃত্তিবাস ও রেনেল একেই গঙ্গা বলেছেন। অনেকে মনে করেন যে, খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দী থেকেই পদ্মার সূত্রপাত। আবুল ফজল বলে গেছেন যে, কাজিহাটার কাছে গঙ্গা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পদ্মবতী নামে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত প্রবাহ পূর্বাপেক্ষা আরও দক্ষিণ-পূর্বে সরে গিয়ে চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

গত চার শতকে পদ্মার গতির বহু পরিবর্তন ঘটেছে। বোধ হয় পদ্মা পূর্বে রামপুর-বোয়ালিয়ার গা ঘেঁষে চলনবিলের ভিতর দিয়ে ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গাকে অবলম্বন করে ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে মেঘনায় দিয়ে মোহনায় পড়ত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পদ্মার নিম্নস্রোত আরও দক্ষিণে ছিল এবং ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জের ভিতর দিয়ে চাঁদপুরের পঁচিশ মাইল দক্ষিণে শাহবাজপুরের দ্বীপের উত্তরদিকে মেঘনার মোহনায় প্রবেশ করত। কালীগঙ্গা মেঘনাকে পদ্মার সাথে সংযুক্ত করত। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পদ্মার প্রধান স্রোত কীর্তিনাশার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হত। পরে পদ্মা তার বর্তমান গতিপথ অবলম্বন করে।

গঙ্গার দক্ষিণধারার নিম্নপ্রবাহে গঙ্গাসাগর অবস্থিত। এখানে এক দ্বীপের ওপর কপিলমুনির আশ্রম। এই দ্বীপের নাম সাগরদ্বীপ। অনেকের মতে সাগরদ্বীপে প্রতাপাদিত্যের (১৫৬৪-১৬১২) রাজধানী ছিল। এককালে এই অঞ্চল যে সমৃদ্ধিশালী ছিল, তার প্রমাণ উত্তরের জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত ধ্বংসপ্রাপ্ত ইটের বাড়ি ও মন্দিরগুলি থেকে পাওয়া যায়। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে এক ভীষণ জলপ্লাবনে এই দ্বীপ জনহীন ও শ্রীভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।

পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য নদীসমূহ, যথা— ব্রাহ্মণী, ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর দ্বারকেশ্বর রূপনারায়ণ, সুবর্ণরেখা, ও কাঁসাই প্ৰভৃতি ছোটনাগপুরের উচ্চভূমি থেকে নির্গত হয়ে ভাগীরথীতে এসে পড়েছে। এ নদীগুলি বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভরশীল। খাঁড়ি, বাঁকা ও বেহুলা নদী দামোদরের প্রাচীন খাত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কিন্তু আজ এ নদীগুলির সঙ্গে দামোদরের কোন যোগ নেই।

উত্তরবঙ্গের উল্লেখযোগ্য নদীগুলি হচ্ছে তিস্তা, জলঢাকা, তোরসা, পুনর্ভবা আত্রেয়ী, মহানন্দা প্রভৃতি। বর্ষার জলে এসকল নদীর দু’কূল ছাপিয়ে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করে। তিস্তার জল বিশেষ করে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারকে প্লাবিত করে।

দক্ষিণে সুন্দরবন অঞ্চলের ভিতর দিয়ে মুড়িগঙ্গা, সপ্তমুখী, ঠাকুরান, মাতলা ইছামতী, পিয়ালী, বিদ্যাধরী, গোসাবা, হাড়িগঙ্গা প্রভৃতি নদী প্রবাহিত। এগুলি বেশ চওড়া এবং অনেকে মনে করেন এগুলি একসময় গঙ্গার মোহানা ছিল। এগুলির জল লোনা। সেজন্য এ জল পানীয় হিসাবে বা সেচের জন্য ব্যবহৃত হয় না।

সরস্বতী পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় অবস্থিত ত্রিবেণীর নিকট ভাগীরথী থেকে নির্গত হয়ে হুগলি ও হাওড়ার ভিতর দিয়ে পুনরায় ভাগীরথীর নিম্নস্রোতে মিলিত হয়েছে। পূর্বে এটাই ছিল ভাগীরথীর প্রধান খাত এবং বাঙালী বণিকেরা এই পথেই বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে যেত। প্রাচীন বন্দর ও শহর সপ্তগ্রাম এরই তীরে অবস্থিত ছিল। এই সপ্তগ্রামই ছিল পূর্বভারতের অন্যতম প্রধান বন্দর ও শহর। একাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এর গৌরব অব্যাহত ছিল। পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সরস্বতী সপ্তগ্রামের গা ঘেঁষে প্রবাহিত হত। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর পর সপ্তগ্রাম সরস্বতী থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। পরে সরস্বতীর খাত শুষ্ক হবার পর সপ্তগ্রামের তথা প্রাচীন বাঙলার গৌরব-রবি অস্তমিত হয়। পরে হুগলি নদী ও কলকাতা শহরের অভ্যুত্থান ঘটে।

চার

নদীই বাঙলার ইতিহাসের স্রষ্টা। নদীই বাঙালীর চরিত্রকে গঠন করেছে ও তার সমাজ ও ইতিহাসকে বৈচিত্র্যময় করেছে। নদীই বাঙলার ভাগ্যবিধাতা। নদী বহুল দেশে বসে করে বলে বাঙালী মেয়েরা হাতে শাঁখা পরে ও মাছ খায়। উত্তর-ভারতের লোক মাছ খায় না। নদীই বাঙলাকে শস্যশ্যামল করে তুলেছে। নদীই বাঙালীকে প্রাচীন জগতের শ্রেষ্ঠ নাবিকে পরিণত করেছিল ও বাঙালী বণিককে ‘সাতসমুদ্দুর, তের নদী’ পার হয়ে বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে সক্ষম করেছিল। আবার এই নদীই বাঙলার বুকে ডেকে এনেছিল বিদেশী বণিককে, যে বণিক তার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে তাকে নিঃস্ব করেছিল। নদী যেমন একদিকে বাঙলাকে ঐশ্বর্যশালী করেছিল, আবার অপরদিকে তাকে দীনহীন করেও ছেড়ে দিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *