বাঙলা ভাষা : তোমার মুখের দিকে
তোমার মুখের দিকে আমি সব সময়ই তাকিয়ে আছি।
যখন জেগে থাকি তখন তোমার দিকে স্থির ক’রে রাখি চোখ। স্থির ক’রে রাখি অস্তিত্ব।
যখন ঘুমোই তখন তোমার দিকে ধ’রে রাখি দুটি চোখ। স্থির ক’রে রাখি স্বপ্ন।
তুমি আর আমি একই গোত্রের। শ্যামলী রূপসী।
শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ শুনি। চাবুকের শাঁইশাঁই শব্দে গান হয়ে বেজে উঠছে এক হাজার একশো বছর।
শুধু চাবুকের শব্দ শুনি।
শেকলে বাঁধা উদ্ধত দুর্বিনীত প্রাকৃত মানব। ঝনঝন ক’রে ওঠে অজগরের মতো স্তরেস্তরে শেকল আর শেকল আর শেকল।
শেকলের শব্দে অর্কেস্ট্রার মতো বেজে ওঠে এক হাজার একশো বছর।
শুধু শেকলের শব্দ শুনি।
তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়।
হাহাকার রূপান্তরিত হয়ে সঙ্গীতে শোভায়।
আমি চারদিকে শোভা দেখি।
সঙ্গীতে শিহরিত দেখি লোকালয় বন আর প্রান্তর।
তোমার অশ্রুবিন্দু পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুক্তোর চেয়েও সুন্দর। তোমার পিঠের চাবুকের দাগ সবচেয়ে উজ্জ্বল জড়োয়ার চেয়েও উজ্জ্বল।
তুমি তাকালেই সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ে সূর্যাস্তে, চন্দ্রোদয়ে। শিশিরে, সমুদ্রে, বুনোঘাসে, কবিতার পংক্তিতে।
তোমার অ, আ চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর।
তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চণ্ডীদাস
শতাব্দীকাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো ভালোবাসার নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম
তোমার রূপের আমি কোনো সীমা পাই না।
যখন শৈশবে আমার বুক থেকে স্বপ্ন থেকে প্রথম মুখর হয়ে উঠেছিলে, তখন মনে হয়েছিলো এ-ই পৃথিবীতে প্রথম বাণী এলো।
মা বলার সাথে সাথে তুমি আর অদ্বিতীয় আরেকজন এক হয়ে গিয়েছিলে।
জননী জননী।
তারপর তুমি আমার চাঞ্চল্য হয়ে ছড়িয়ে পড়েছো মাঠে মাঠে আকাশে আকাশে। আমার দুঃখ হয়ে কেঁপে উঠেছো আত্মায়।
আমার স্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছো গ্রন্থে।
এক সময় দেখি তুমি আর আমার অস্তিত্ব এক হয়ে গেছে।
সুখে দুঃখে উদ্ধত বিদ্রোহে পরাজয়ে আর বিজয়ে অভিন্ন আমরা।
হাজার বছর ধ’রে। হাজার বছর পরে।