বাঙলা ভাষার ভূগোল
বাঙলা ভাষা কি একটি? যখন বলি ‘বাঙলা আমাদের মাতৃভাষা’, তখন মনে হয় পৃথিবীতে একটি ভাষা রয়েছে, যার নাম বাঙলা। ওই ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। কিন্তু বাঙলা ভাষা কি একটি? নাকি অনেক? এক সময় একটি সাধু বাঙলা ভাষা ছিলো। “কিয়দ্দিনান্তর রাজা মনে মনে এই বিবেচনা করিলেন জগদীশ্বর আমাকে নানা জনপদের অধিপতি করিয়া অসংখ্য প্রজাগণের হিতাহিত চিন্তার ভার দিয়াছেন। এটা সাধুভাষা। এ-বাক্যটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। সাধুভাষার একটি গৃহীত রূপ ছিলো। ওই রূপটি সর্ববঙ্গীয়। কিন্তু সাধুভাষাই কি বাঙলা ভাষা? এরপর আরেকটি রূপ পাই বাঙলা ভাষার। তার নাম চলতি ভাষা বা চলতি বাঙলা। এখন বই লেখা হয় চলতি ভাষায়। মার্জিত পরিবেশে এখন আমরা চলতি ভাষায়ই কথা বলি। কিন্তু চলতি ভাষাই কি বাঙলা ভাষা? এটা তো বাঙলা ভাষার একটি মার্জিত রূপ। সব বাঙালি চলতি ভাষা বোঝে না। বলতে পারে না। বিক্রমপুরের চাষী বোঝে না চলতি বাঙলা। বলতে পারে না চলতি বাঙলা। এমনকি সব শিক্ষিত ব্যক্তিও ঠিক মতো বলতে পারে না চলতি বাঙলা। কিন্তু বাঙালি মাত্রই তো কথা বলে বাঙলা ভাষায়। মানভূমের চাষী, বিক্রমপুরের জেলে বাঙলা বলে। বাঙলা বলে সিলেটের মাঝি আর বাঁকুড়ার শবজিঅলা। চট্টগ্রামের শাম্পানঅলা বাঙলা বলে, বাঙলা বলে যশোরের ঘরের বউ। তারা কোন বাঙলা বলে? তারা কোন বাঙলা বোঝে? বাঙলা ভাষার কতো রূপ?
বাঙলা ভাষা প্রচলিত বাঙলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে। সম্ভবত আসাম, বিহার ও ওড়িষ্যার কিছু কিছু অংশেও প্রচলিত বাঙলা ভাষা। কোটি কোটি মানুষের ভাষা বাঙলা। একটি বিশেষ ভৌগোলিক এলাকায় সীমাবদ্ধ বাঙলা ভাষা। বাঙলা ভাষার পশ্চিম সীমায় বাঙলা ভাষা মিশে গেছে ওড়িয়া, মাহি, মৈথিলির সাথে। উত্তরপুবে মিশে গেছে অসমিয়া বা আসামির সাথে। বাঙলা ভাষার সীমাঞ্চলে এটি মিশেছে কয়েকটি আদিবাসী ভাষার সাথে। পশ্চিমে বাঙলা ভাষা ছোটোনাগপুর পর্যন্ত বিস্তৃত; পুবে বিস্তৃত আসাম অবধি। বঙ্গোপসাগরের পুব উপকূল দিয়ে বাঙলা ভাষা প্রসারিত উত্তর ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত; আর দক্ষিণে আকিয়াবে বাঙলা ভাষা মেশে ব্রহ্মী ভাষার সাথে। হুগলি নদীর মোহানা থেকে বাঙলা ভাষার দক্ষিণ সীমা উত্তর-পশ্চিম দিকে মেদিনীপুর জেলার ভেতর দিয়ে চ’লে যায়। পশ্চিমে বাঙলা ভাষার সীমা সিংভূম জেলার ভেতর দিয়ে চ’লে গেছে। এখানে বাঙলা ভাষা মুখোমুখি হয় কয়েকটি মুণ্ডা ভাষার। সেখান থেকে বাঙলা ভাষার পশ্চিম সীমা উত্তরপুব দিকে বাঁক নিয়ে রাজমহলের কাছে গঙ্গানদী পার হয়। মহানন্দা নদী ধ’রে বাঙলা ভাষার সীমা মালদহ ও পূর্ণিয়া জেলার ভেতর দিয়ে উত্তর দিকে প্ৰায় নেপালের সীমাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছোয়। বাঙলা ভাষার উত্তর সীমা দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার তরাইর উত্তর দিয়ে পুবে আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় এসে নিজের পুব সীমার সাথে মেশে। আজ থেকে আশি বছর আগে বাঙলা ভাষার এ-সীমা নির্দেশ করেছিলেন জর্জ গ্রিয়ারসন।
বেশ বড়ো এলাকা জুড়েই তো মানুষেরা বলে বাঙলা ভাষা। কিন্তু সবাই এক অভিন্ন অনন্য বাঙলা বলে না। তারা যা বলে তার মধ্যে মিল আছে, কিন্তু অবিকল মিল নেই। এমনকি এক এলাকার বাঙলা সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হ’তে পারে আরেক এলাকার লোকের কাছে। বিক্রমপুরের চাষীর ভাষা বুঝবে না বীরভূমের চাষী। আমি নিজেই তো বুঝি না সিলেটের বা চট্টগ্রামের বাঙলা। তবু বীরভূমের বাঙলাও বাঙলা। সিলেটের বাঙলাও বাঙলা। বিক্রমপুরের মাঠের রাখালের ভাষাও বাঙলা। বাঙলা ভাষা- এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে আছে বাঙলা ভাষার বিভিন্ন রূপ। ওই রূপগুলোকে বলা হয় আঞ্চলিক ভাষা। আঞ্চলিক ভাষাকে বলা হয় উপভাষা। তা যেনো মূল ভাষা নয়, তা উপভাষা। কিন্তু বাঙলা যারা বলে, তাদের অধিকাংশই বলে উপভাষা। চলতি বাঙলা খুব কম লোকই বলে। বহু উপভাষা আছে বাঙলা ভাষার।
প্রত্যেকেই খুব ভালোবাসে নিজের উপভাষা। অনেকে তো মনে করে তার উপভাষার মতো সুন্দর আর মিষ্টি কিছু নেই। কিন্তু অন্যরা তা মনে করে না। আমার কাছে যে-উপভাষা খুব মিষ্টি, আরেকজনের কাছে তা হ’তে পারে উপহাসের বস্তু! তাই উপভাষা নিয়ে উপহাস করার চল আসে সারা পৃথিবীতেই। যেমন বিক্রমপুরের উপভাষা হাসির বিষয় হয়েছিলো দীনবন্ধু মিত্রের “সধবার একাদশী” নাটকে। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালির ভাষা নিয়ে মজা করে অনেকেই। সিলেটের উপভাষা নিয়ে তো সকলের মস্ত মজা। এমনকি মধ্যযুগেও সিলেটের উপভাষা নিয়ে কৌতুক করেছিলেন পরমপুরুষ শ্রীচৈতন্য। চৈতন্যভাগবত নামক জীবনীগ্রন্থে ষোড়শ শতকে কবি বৃন্দাবন দাস লিখেছেন :
সভার সহিত প্রভু হাস্য কথা রঙ্গে।
কহিলেন যেন মত আছিলেন বঙ্গে।।
বঙ্গদেশি বাক্য অনুকরণ করিয়া।
বাঙ্গালেরে কদর্থেন হাসিয়া হাসিয়া।।
বিশেষ চালেন প্রভু দেখি শ্রীহট্টিয়া।
কদর্থেন সে মত বচন বলিয়া
প্রথমেই কানে বাজে উপভাষার উচ্চারণ। কী সুন্দর টানই না থাকে এক একটি উপভাষায়। কী মধুর বরিশালি টান। কী রসালো নোয়াখালি টান। আর কেমন কোলাহল সিলেটিতে চট্টগ্রামিতে। তারপরেই শব্দ। চমৎকার চমৎকার শব্দ পাওয়া যায় বিভিন্ন উপভাষায়। ওই সব শব্দের অনেকগুলোই নেই চলতি ভাষায়। শর্দি লাগলে নাক দিয়ে ঘন যা বেরোয়, তার কোনো নাম নেই চলতি ভাষায়। আমরা বলতাম ‘হিঙ্গইল’। সুরুচির চাপেই বোধ হয় চলতি ভাষায় নেই এমন কোনো শব্দ। ওই ঘনবস্তু নাকে শুকিয়ে গেলে, যা হয়, তার কোনো নাম নেই চলতি ভাষায়। আমরা বলতাম ‘বষ্টি’। কী চমৎকার! কিন্তু চলতি ভাষায় নেই। বর্ষায় সারা মাঠে যখন নেমে আসতো শান্তি আর স্তব্ধতা, বাতাসে যখন একটি ধানের ডগাও কাঁপতো না, ওই অবস্থাকে বলতাম ‘নিরাক’। শহরে ওই নিরাক নেই, নিরাক পড়ে না। তাই চলতি বাঙলায়ও ‘নিরাক’ নেই।
কোনো একটা জায়গা থেকে একটু উত্তরে, কিছুটা পুবে, সামান্য দক্ষিণে, অল্প পশ্চিমে গেলেই দেখা যায় ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে উচ্চারণ। বদলে যাচ্ছে টান। এক সময়, বেশ দূরে গিয়ে, মনে হয় উচ্চারণ বা টান বেশ ভিন্ন হয়ে গেছে। মনে হয় এসে গেছি আরেকটি উপভাষা এলাকায়। তেমনি বদলে যায় শব্দ। বাঙলায় নাকি একটি চলতি কথা আছে যে প্রতি দশ ক্রোশে, বিশ মাইলে, বদলে যায় ভাষা। একেবারে বদলে যায় না, তবে বদলে যায় অনেকখানি। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে গেলেই দেখা যায় কোনো কোনো জিনিশের নাম ভিন্ন হয়ে গেছে। কোনো কোনো ভাব প্রকাশ করা হচ্ছে ভিন্ন শব্দে। আমাদের গ্রামে একটি জিনিশকে আমরা বলতাম ‘আইল্লা’। ‘আইল্লা’ একটি মাটির পাত্র, যাতে আগুন রাখা হয়। গ্রামের মানুষেরা আগুন জমিয়ে রাখে আবার আগুন ধরানোর জন্যে। শীত লাগলে গায়ে শেক দেয়ার জন্যে। কতোদিন শীতকালে আমরা ‘আইল্লা’ পুহিয়েছি। আমাদের গ্রাম থেকে একটু পশ্চিমে কামারগাঁয়ে ‘আইল্লা’র নাম ছিলো ‘মালশা’। আমরা হাসতাম ‘মালশা’ শুনলে। ওরা হাসতো ‘আইল্লা’ শুনলে। আরো কতো শব্দ ভিন্ন ছিলো রাড়িখালে আর কামারগাঁয়ে। এক মাইলের ব্যবধানে। তাই সারা বাঙলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে উচ্চারণে, শব্দে, বাক্য তৈরির কৌশলে অনেক ভিন্নতা। কিন্তু এ-সব উপভাষাই বাঙলা ভাষা।
বাঙলা ভাষা-অঞ্চলে আছে বহু বহু উপভাষা। আঞ্চলিক ভাষা। য়্যাকঝোন্ মানুসের দুটা ব্যাটা আছলো। এটা মালদহের বাঙলা। য়াকজনের দুইডী ছাওয়াল আছিলো। এটা মাণিকগঞ্জের বাঙলা। এক বেডার দুই পুৎ আচিল্। এটা ত্রিপুরার বাঙলা। অ্যাকজোন মান্শির দুই ছওল ছিলো। এটা বাগেরহাটের বাঙলা। এক ঝকার দুইঝন্ বেটা আছিল। এটা জলপাইগুড়ির বাঙলা। একঝনের দুই ব্যাটা ছৈল আছিল। এটা বগুড়ার বাঙলা। কোন মানুষের দুই পুয়া আছিল। এটা সিলেটের বাঙলা। একজন মানুষের দুগুয়া পুয়া আছিল। এটা কাছাড় জেলার বাঙলা। একজনের দুট ছল ছিল। এটা যশোরের বাঙলা। এগুআ মাস্যের দুয়া পোয়া আছিল্। এটা চট্টগ্রামের বাঙলা। আছে এমন অঞ্চল অঞ্চলের বাঙলা ভাষা। এগুলোর মধ্যে মিল আছে, অমিলও আছে। তাই সারা বাঙলা ভাষা- অঞ্চলে একই রকম ধ্বনি উচ্চারিত হয় না বাঙলা ভাষার। একই শব্দে প্রকাশ পায় না মনের ভাব। প্রতিদিন বাঙলা ভাষা-অঞ্চলে মুখর হয়ে ওঠে বিভিন্ন রকম বাঙলা। বিভিন্ন অঞ্চলের বাঙলা। বিভিন্ন উপভাষা। যে-চলতি বাঙলা বলার চেষ্টা করি শোভন পরিবেশে শোভন মানুষেরা, তা বাঙলা ভাষার একটি শোভন রূপ।
বাঙলা ভাষার উপভাষা কতোগুলো? কে জানে! সেগুলো কীভাবে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অঞ্চলে? কে জানে! তবে এমন প্রশ্ন উঠলে মনে পড়ে একজন বিদেশির নাম। তিনি জর্জ আব্রাম গ্রিয়ারসন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশরাজের উচ্চপদস্থ আমলা। গ্রিয়ারসন জরিপ করেছিলেন ভারতের উপভাষাগুলো। জরিপ করেছিলেন বাঙলা উপভাষাগুলো। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর “লিংগুইস্টিক সারভে অফ ইন্ডিয়া” নামক এগারো খণ্ডে সম্পূ র্ণ জরিপের পঞ্চম খণ্ড : প্রথম ভাগে আছে বাঙলা উপভাষার পরিচয়। এ- গ্রন্থে আছে বিভিন্ন বাঙলা উপভাষার নমুনা। গ্রিয়ারসন শুধু নমুনা সংগ্ৰহ করেন নি, তিনি বাঙলা উপভাষাগুলোকে বিভিন্ন ভাগেও সাজিয়েছিলেন। যে-সব উপভাষার মধ্যে মিল বেশি সেগুলোকে ভাগেভাগে সাজিয়েছিলেন গ্রিয়ারসন। তাঁর পর আর কেউ বাঙলা উপভাষার এমন জরিপ করেন নি। এখনো প্রায় সবাই তার বই থেকেই সংগ্রহ করেন বাঙলা উপভাষার নমুনা। যদিও গত আশি বছরে এ-সমস্ত উপভাষারও ঘটেছে নানা বদল।
গ্রিয়ারসন বাঙলা উপভাষাগুলোকে প্রথমে ভাগ করেন দুটি বড়ো শাখায়। এক শাখার নাম ‘পাশ্চাত্য’ অর্থাৎ পশ্চিমের শাখা। আরেক শাখার নাম ‘প্রাচ্য’ অর্থাৎ পুবের শাখা। পশ্চিম শাখার আছে আবার চারটি উপশাখা। এগুলো হচ্ছে কেন্দ্রীয় বা মান শাখা, দক্ষিণ-পশ্চিম শাখা, পশ্চিম শাখা, ও উত্তর শাখা। তাঁর পুব শাখার কেন্দ্রে আছে ঢাকা জেলার উপভাষা। পুব শাখাকে তিনি ভাগ করেছেন দুটি উপশাখায়। একটি প্রাচ্য বা পুব উপশাখা। অন্যটি দক্ষিণ-প্রাচ্য উপশাখা। তাঁর কেন্দ্রীয়, বা মান উপশাখায় পড়ে কলকাতা শহর ও চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, হুগলি ও হাওড়া জেলা। পশ্চিম উপশাখায় আছে ছোটোনাগপুর, মানভূম ও ধলভূমের উপশাখা। দক্ষিণ-পশ্চিম উপশাখায় আছে মেদেনীপুর। উত্তর উপশাখায় পড়ে দিনাজপুরের উপভাষা। তাঁর পুব শাখার পুব উপশাখায় পড়ে ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, বাখরগঞ্জ, সিলেট ও কাছাড়। দক্ষিণ-প্রাচ্য উপশাখায় আছে নোয়াখলি ও চট্টগ্রামের ভাষা। এভাবে উপভাষাগুলোকে ভাগ করেছিলেন গ্রিয়ারসন। এখন নতুনভাবে ভাগ করলে হয়তো উপভাষার ভিন্ন ভূগোল পেতে পারি আমরা।
গ্রিয়ারসন সংগ্রহ করেছিলেন বহু উপভাষার নমুনা। বাইবেলের একটি গল্প রূপায়িত করেছিলেন তিনি বিভিন্ন বাঙলা উপভাষায়। তাই তাঁর গ্রন্থে বাঙলা উপভাষার বিভিন্ন নমুনা পাওয়া যায়। ওই গল্প ছাড়া কিছু গল্প ও গান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। তাই তাঁর গ্রন্থ বাঙলা উপভাষার খনির মতো। কয়েকটি নমুনা এমন :
সাধুভাষা : কোন এক ব্যক্তির দুটি পুত্র ছিল। তন্মধ্যে কনিষ্ঠটী তাহার পিতাকে কহিল পিতঃ বিষয়ের যে অংশ আমার প্রাপ্য তাহা আমাকে দিন। তিনিও উহাদের মধ্যে তাঁহার সম্পত্তি বিভাগ করিয়া দিলেন। ইহার অল্পদিন পরেই কনিষ্ঠ পুত্রটী সমস্ত একত্র করিয়া এক দূর দেশে যাত্রা করিল, এবং তথায় অপরিমিত আচারে তাহার বিষয় অপচয় করিয়া ফেলিল।
কলকাতার (নারীদের) উপভাষা : এক জনের দুই ছেলে ছেল। তাদের যে ছোট, সে তার বাপকে বল্লে, বাবা, আমার ভাগে যা পড়ে তা আমাকে দাও। বাপ তার বিষয় আশয় তাদের বেঁটে দিলে। দিন কতক পরে ছোট ছেলে তার সমস্ত জিনিস পত্তর নিয়ে দূর দেশে চলে গেল; সেখানে বদফেয়ালি করে সমস্ত উড়িয়ে দিলে।
হাওড়ার উপভাষা : কোন লোকের দুটি ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে ছোটটি তার বাপকে বল্লে, বাবা, আমার ভাগে বিষয়ের যা পড়ে তা আমাকে দিন। তাতে সে তার বিষয় তাদিকে ভাগ করে দিলে। অল্প দিন পরে ছোট ছেলে তার অংশের সব বিষয় একত্তরে জড় করে নিয়ে দূর দেশে চলে গেল, আর সেখানে বদ-ফেয়ালি করে সর্বস্ব উড়িয়ে দিল।
মেদেনীপুরের উপভাষা : এক লোক্কার দুট্টা পো থাইল। তান্নেকার মাঝু কোচা পো লিজের বাফুকে বল্ল বাফুহে! বিষৈ আশৈর যে বাটী মুই পাব সেটা মোকে দ্যা। সে তান্নাকার মাঝু বিষৈ বাটী কোরা দিল। ভোৎ দিন যাইনি কোচ্যা পো সমুচ্যা গুটি লিয়া ভোৎ দূরে এক গাঁয়ে চোল্যা গ্যাল। সেঠি সে আকুত্তা খচ্চাপতর কোরা লিজের বিষৈ-আশৈ এক্কাদমে ফুক্কা-প্যাল।
বগুড়ার উপভাষা : এক ঝনের দুই ব্যাটাছৈল আছিল। তারকেরে মধ্যে ছোটঝন কৈল বা হামি যা পামু তা হামাক বাঁট্যা দে। তাই শুনে বাপে বাঁট্যা দিল। ছোটঝন বাঁটা লেওয়ার কদিন পর ভিন দেশে গেল। সেটী যায়্যা লাঠামো করা টাকাকড়ি উড়া দিল
পাবনার উপভাষা : কোনো মানুষের দুই ছাওয়াল ছিল। তার মধ্যি ছোডোটা বাপেক কোলো, বাবা জিনিশ পত্তোরের পাওয়ানা ভাগ আমাক গুনে দ্যাও। ইয়েই শুনে, তার বাপ তার নিজির জিনিশ পত্তোর বাঁট্যা দিলো। অল্প দিন পরে ছোডো ছাওয়াল সকল জিনিশ পত্তোর জড়ো করা দূর দ্যাশে যাত্তারা করলো। এবং সেখানে বদ্কাম্ কর্যা নিজির বিষেয় আসেয় উড়ায়ে দিলো।
মাণিকগঞ্জের উপভাষা : য়্যাক জনের দুইডী ছাওয়াল আছিলো। তাগো মৈদ্দে ছোটডি তার বাপেরে কৈলো, বাবা, আমার ভাগে যে বিত্তি ব্যাসাদ্ পরে তা আমার দ্যাও। তাতে তিনি তান বিষয় সোম্পত্তি তাগো মৈদ্দে বাইটা দিল্যান। তারপর কিছুদিন পরে ঐ ছোট ছাওয়ালডি তার সগল টাকাকড়ি য়্যাকাত্র কইর্যা য়্যাক দূর দ্যাশে চইলা গ্যালো। সেখানে গিয়া তার যা কিছু আছিলো তার বদ্খ্যালী কৈরা উরাইয়া দিলো।
ময়মনসিংহের উপভাষা : এক জনের দুই পুৎ আছিল। তার ছুডু পুতে বাপেরে কইলো বাজি! মাল ব্যাসাতের যে বখ্া আমি পাইবাম্ তা আমারে দেউখাউন। হে তারারে মালপাতি বাট কৈরা দিল। থুরা দিন বাদে ছোট্কা তার হগ্গল মালব্যাসাৎ থুবাইয়া দূর মুল্লুকে গেল। হেইখানে ফৈলামী কৈরা হগ্গল খোয়াইল।
নোয়াখালির উপভাষা : একজন মাইসের দুগা হোলা আছিল্। হিয়ার্ মধ্যে ছুডুগায় হেইতার বাফেরে কইল্ বায়াজি আর ভাগে মাল্ যিগিন্ হড়ে হিগিন্ আঁরে দেও। আর হেইতেও আর হেইতেও হেইতার ব্যাত্তি হোলাইনেরে ভাগ করি দিল। হিয়ার কদিন বাদে ছোড হোলা ব্যাকগিন অত্তর্ করিলই এক দুবই এক দেশে বেড়াইত গেল; হিয়ানে হেইতে সণ্ডামি করি হেইতার ব্যাক বিত্ত উড়াই দিল।
এমন বিচিত্র স্বর সুর টান আর রঙের ভাষা বাঙলা। অঞ্চলে অঞ্চলে তার আঞ্চলিক শোভা। এ-ভাষা নদীর ঢেউয়ে ছলকে ওঠে। কলাপাতার কম্পনে দুলে ওঠে। রাখালের মুখ থেকে মাঠে ময়দানে ঝ’রে পড়ে। পুকুরপাড়ে নতুন বউর মুখে মুখর হয়ে ওঠে। ক্রোধে গর্জন ক’রে ওঠে পদ্মার চরে। নানা স্বরে মুখরিত বাঙলা ভাষার ভূভাগ।