বাঙলা ভাষার প্রতি সেকালের লোকের মনোভাব

বাঙলা ভাষার প্রতি সেকালের লোকের মনোভাব

॥ ভাষা বিদ্বেষ ॥

ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন না হলে আগের যুগে কোনো বুলিই লেখ্যসাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হত না। আদিযুগে সংস্কৃতই ছিল পাক-ভারতের ধর্মের, শিক্ষার, দরবারের, সাহিত্যের, সংস্কৃতির ও বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের ভাব-বিনিময়ের বাহন। বৌদ্ধ ও জৈনমত প্রচারের বাহনরূপেই প্রথম দুটো বুলি–পালি ও প্রাকৃত সাহিত্যিক ভাষার স্তরে উন্নীত হয়। তারপর অনেককাল রাষ্ট্রশাসন কিংবা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগেনি বলে আর কোনো বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি। পরে সাহিত্যের প্রয়োজনে নাটকে শৌরসেনী, মারাঠী ও মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতে থাকে। আরো পরে রাজপুত রাজাদের প্রতিপোষকতায় শৌরসেনী অপভ্রষ্ট বা অবহট্ঠ সাহিত্যের ভাষার রূপ পায়।

এরপরে মুসলমান আমলে ফারসি হল দরবারী ভাষা। মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এদেশী জনজীবনে যে ভাব-বিপ্লব এল, বিশেষ করে তারই ফলে আধুনিক পাক-ভারতিক আর্যভাষাগুলোর দ্রুত সাহিত্যিক বিকাশ সম্ভব হল। এক্ষেত্রে ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই সব কয়টি আঞ্চলিক বুলি লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হবার সৌভাগ্য লাভ করে। এ ব্যাপারে রামানন্দ, কলন্দর, নানক, কবীর, দাদু, একলব্য, রামদাস, চৈতন্য, রজব প্রভৃতি সন্তগণের দান মুখ্য ও অপরিমেয়।

এদিক দিয়ে পূর্বী বুলিগুলোর ভাগ্যই সবচেয়ে ভাল। এসব বুলি যখন সৃজ্যমান তখন এদের জননী অর্বাচীন অবহট্ঠ বৌদ্ধ বজ্রযান সম্প্রদায়ের যোগ-তন্ত্র-শৈবমত প্রভাবিত এক উপশাখার সাধন-ভজনের মাধ্যম হবার সুযোগ পায়–যার ফলে আধুনিক আর্য ভাষার (অবহট্ঠ থেকে ভাষাগুলোর সৃষ্টিকালের বা দুইস্তরের অন্তর্বর্তীকালের বা সন্ধিকালের) প্রাচীনতম নিদর্শন-স্বরূপ চর্যাগীতিগুলো পেয়েছি।

তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাঙলা লেখ্য শালীন-সাহিত্যের বাহন হল। আর এর দ্রুত বিকাশের সহায়ক হল চৈতন্য-প্রবর্তিত মত। আবার আঠারো-উনিশ শতকে খ্রীস্ট ও ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারের, হিন্দু সমাজ সংস্কারের এবং কোম্পানীর শাসন পরিচালনের প্রয়োজনে বাঙলা গদ্যের সৃষ্টি ও দ্রুত পুষ্টি হয়। এসব আকস্মিক সুযোগ সুবিধা পেয়েও বাঙলা ভাষা স্বাভাবিক ও স্বাধীন বিকাশ লাভ করেনি; কারণ পর পর সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজির চাপে পড়ে বাঙলা কোনোদিন জাতীয় ভাষার বা সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান ভাষার মর্যাদা পায়নি। আজ অবধি বাঙলা একরকম অযত্নে লালিত ও আকস্মিক যোগাযোগে পুষ্ট।

হয়তো দেশ শাসনের প্রয়োজনেই দেশীভাষার অনুশীলনের প্রবর্তনা দিয়েছিলেন সুলতান সুবাদারগণ। যেমনটি ফোর্ট-উইলিয়াম কলেজে দেখেছি পরবর্তীকালে। কিন্তু সুলতান-সুবাদারের প্রবর্তনা সত্ত্বেও সাধারণভাবে অনেক কাল অভিজাতরা বাঙলাভাষার প্রতি বিরূপ ছিল। হয়তো বুলি বলেই এ অবজ্ঞা। ফলে উনিশ শতকের আগে বাঙলা কোনোদিন শক্তিমানের পরিচর্যা পায়নি, তাই অন্তত দশশতক থেকে বাঙলাভাষায় সৃষ্টিকর্ম শুরু হলেও তা সময়ের অনুপাতে অগ্রসর হতে পারেনি। শেক্সপিয়র যখন তাঁর অমর নাটকগুলো রচনা করছিলেন, তখন আমাদের ভাষায় মুকুন্দরাম ও সৈয়দ সুলতানই শ্রেষ্ঠ লেখক। প্রতিভার অভাব হেতুই আমাদের হিন্দু-মুসলমানের রচনা পুচ্ছগ্রাহিতায় তুচ্ছ।

মধ্যযুগে হিন্দুরা বাঙলাকে ধর্মকথা তথা রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ও লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারের বাহনরূপেই কেবল ব্যবহার করতেন। মালাধর বসুর কথায়–পুরাণ পড়িতে নাই। শূদ্রের অধিকার। পাঁচালী পড়িয়া তর এ ভব-সংসার–এ উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। অতএব, তারা গরজে পড়ে ধর্মীয় প্রচার-সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, সাহিত্য-শিল্প গড়ে তুলবার প্রয়াসী হননি। দেবতার মাহাত্ম্যকথা জনপ্রিয় করবার জন্যেই তারা প্রণয়-বিরহ কাহিনীর আশ্রয় নিয়েছেন, এবং এতে সাহিত্য-শিল্প যা গড়ে উঠেছে তথা সাহিত্যরস যা জমে উঠেছে, তা আনুষঙ্গিক ও আকস্মিক, উদ্দিষ্ট নয়। কাজেই বলতে হয়, মধ্যযুগে হিন্দুদের বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস ছিল না। লৌকিক ধর্মের প্রচারই লক্ষ্য ছিল। এর এক কারণ এ হতে পারে যে শিক্ষা ও সাহিত্যের বাহন ছিল সংস্কৃত। কাজেই শিক্ষিত মাত্রই সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ করত। তাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টির গরজ কেউ অনুভব করেননি। তারা অশিক্ষিতদেরকে ধর্মকথা শোনানোর জন্যে ধর্ম-সংপৃক্ত পাচালী রচনা করতেন। তাতে রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণের অনুসৃতি ছিল। পরে সংস্কৃতের প্রভাব কমে গেলেও এবং বাঙলা প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্ব পেলেও পূর্বেকার রীতির বদল হয়নি আঠারো শতক অবধি। আঠারো শতকেই আমরা কয়েকজন হিন্দু প্রণয়োপাখ্যান রচয়িতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি।

বাঙলাদেশের প্রায় সবাই দেশজ মুসলমান। তাই বাঙলা সাহিত্যের উন্মেষ যুগে সুলতান সুবাদারের প্রতিপোষণ পেয়ে কেবল হিন্দুরাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টি করেননি; মুসলমানরাও তাঁদের সাথে সাথে কলম ধরেছিলেন এবং মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই যে, দেব ধর্মপ্রেরণাবিহীন নিছক সাহিত্যরস পরিবেশনের জন্যে তারাই লেখনী ধারণ করেন। আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধসাহিত্য পেয়েছি তাদের হাতেই। কাব্যের বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্যদানের গৌরবও তাঁদেরই। কেননা, সবরকমের বিষয়বস্তুই তাঁদের রচনার অবলম্বন হয়েছে। মুসলমানের দ্বারা এই মানবরসাশ্রিত সাহিত্যধারার প্রবর্তন সম্ভব হয়েছে ইরানী সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে। দরবারের ইরানী ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় এ দেশের হিন্দু-মুসলমানের একই সূত্রে এবং একই কালে হলেও একেশ্বরবাদী মুসলমানের স্বাজাত্যবোধ ইরানী সংস্কৃতি দ্রুত গ্রহণে ও স্বীকরণে তাদের সহায়তা করেছে প্রচুর। কিন্তু রক্ষণশীল হিন্দুর পক্ষে ছয়শ বছরেও তা সম্ভব হয়নি। তাই মুসলমান কবিগণ যখন আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধ সাহিত্য প্রণয়োপাখ্যান রচনা করছিলেন, হিন্দু লেখকগণ তখনো দেবতা ও অতিমানব জগতের মোহমুক্ত হতে পারেননি। যদিও এই দেবভাব একান্তই পার্থিব জীবন ও জীবিকা সংপৃক্ত।

মুসলমান রচিত সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবিকতা–যা মানুষ সম্বন্ধে কৌতূহল বা জিজ্ঞাসাই নির্দেশ করে। বাহুবল, মনোবল আর বিলাসবাঞ্ছই সে-জীবনের আদর্শ। সগ্রামশীলতা ও বিপদের মুখে আত্মপ্রতিষ্ঠা সে-জীবনের ব্রত এবং ভোগই লক্ষ্য। এককথায়, সংঘাতময় বিচিত্র দ্বান্দ্বিক জীবনের উল্লাসই এ সাহিত্যে অভিব্যক্ত।

পাক-ভারতে মুসলমান অধিকার যেমন ইরানী সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এ দেশবাসীর পরিচয় ঘটিয়েছে, তেমনি একচ্ছত্র শাসন ভারতের অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। এরূপে বাঙালিরা ইরানী ও হিন্দুস্তানী ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতি হবার সুযোগ পেয়ে এ দুটোর আদর্শে ও অনুসরণে নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচর্যা করে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ হয়েছে।

অবশ্য হিন্দু-মুসলমানের প্রায় সব রচনাই (বৈষ্ণবসাহিত্যও) মূলত অনুবাদ ও অনুকৃতি এবং মুখ্যত পৌনপুনিকতা দুষ্ট। মৌলিক রচনা দুর্লক্ষ্য। এর কারণ প্রতিভাধর কেউ সাধারণত বাঙলা রচনায় হাত দেননি, অর্থাৎ সংস্কৃতে কিংবা ফারসিতে লিখবার যোগ্যতা যার ছিল, তিনি বাঙলায় সাধারণত লেখেননি। বাঙলা তখনো তাঁদের চোখে বুলি মাত্র। এ যুগে শিক্ষিত জনেরা যেমন লোকসাহিত্য সৃষ্টিতে কিংবা পাঠে বিমুখ, সে যুগে তেমনি তারা বাঙলা ভাষা ও বাঙলা রচনার প্রতি বিরূপ ছিলেন। তাচ্ছিল্যজাত এ অবহেলা বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ মন্থর করেছিল।

এছাড়াও আর দুটো প্রবল কারণ ছিল : ক. সেন রাজারা বাঙলায় উত্তর ভারতিক ব্রাহ্মণ্য সমাজ ও সংস্কৃতি গঠনে তৎপর ছিলেন। পাছে দেশী সংস্কৃতি সৃজ্যমান ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকে বিকৃত করে, সম্ভবত এই আশঙ্কায় শূদ্রের শিক্ষাগ্রহণ নিষিদ্ধ করেছিলেন, এভাবে দেশী লোককে মূর্খ রেখে দেশের ভাষাচর্চার পথ রুদ্ধ রেখেছিলেন তারা। আর তখন বস্তুত অবহট্ঠ-এর যুগ। তাই অবহট্ঠ এর যুগে সংস্কৃত চর্চায় উৎসাহ দান করা রাজকীয় ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

খ. অপরদিকে দেবভাষা সংস্কৃতি ও স্বর্গীয় ভাষা আরবি থেকে শাস্ত্রানুবাদ পাপকর্ম বলে গণ্য হত; ভাষান্তরিত হলে মন্ত্রের বা আয়াতের মহিমা ও পবিত্রতা নষ্ট হবে–এ ধারণা আজো প্রবল। মুসলমানদের অতিরিক্ত একটা বাধা ছিল, তারা বাঙলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা বলে জানত। এদিকে বিজাতি-বিধর্মী রাজার সমর্থন ছিল বলে ব্রাহ্মণদের পক্ষে বিদ্রোহ করা সম্ভব হয়নি বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণ্য সমাজ নৈতিক প্রতিরোধের দ্বারা বাঙলা চর্চা ব্যাহত করবার প্রয়াসী ছিলেন। তাঁরা পাতি দিলেন:

অষ্টাদশ পুরাণানি চ রামস্য চরিতানি চ
ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।

আঠারো শতক অবধি এ বিরূপতা যে ছিল, তার প্রমাণ মিলে অবজ্ঞাসূচক একটি বাঙলা ছড়ায়। এতে কাশীরাম দাসের নাম রয়েছে :

কৃত্তিবেসে কাশীদেসে আর বামুণ-ঘেঁষে
–এ তিন সর্বনেশে।

 শাস্ত্রকথার বাঙলা তর্জমার প্রতিবাদে মুসলমান সমাজও সতেরো শতক অবধি মুখর ছিল, তার আভাস রয়েছে বিভিন্ন কবির কৈফিয়তের সুরে। এদের কেউ কেউ তীব্র প্রতিবাদীও।

শাহ মুহম্মদ সগীর (১৩৮৯-১৩১০ খ্রীস্টাব্দে) বলেন :

নানা কাব্য-কথা-রসে মজে নরগণ।
যার যেই শ্ৰধাএ সন্তোষ করে মন।
না লেখে কিতাব কথা মনে ভয় পায়
 দূষিব সকল তাক ইহ না জুয়ায়।
গুনিয়া দেখি আহ্মি ইহ ভয় মিছা
হয় ভাষায় কিছু হয় কথা সাচা।

 সৈয়দ সুলতান [১৫৮৪ খ্রী.) বলেছেন :

কর্মদোষে বঙ্গেত বাঙ্গালী উৎপন
বুঝে বাঙ্গালী সবে আরবি বচন।

ফলে,

আপনা দীনের বোল এক না বুঝিলা
প্রস্তাব পাইয়া সব ভুলিয়া রহিলা।

কিন্তু,

যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন
সেই ভাষা হয় তার অমূল্য রতন।

তবু,

যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে
পঞ্চালি রচি করি আছত দূষিতে।
 মুনাফিক বোলে মোরে কিতাবেতে পড়ি
কিতাবের কথা দিলু হিন্দুয়ানি করি।

 অবশ্য,

মোহোর মনের ভাব জানে করতারে
যথেক মনের কথা কহিমু কাহারে।

আমাদের হাজী মুহম্মদও [ষোল শতক) নিঃসংশয় নন, তাই তিনি দ্বিধামুক্ত হতে পারেন নিঃ

যে-কিছু করিছে মানা না করিঅ তারে
ফরমান না মানিলে আজাব আখেরে।
হিন্দুয়ানি লেখা তারে না পারি লিখিতে
কিঞ্চিৎ কহিলু কিছু লোকে জ্ঞান পাইতে।  

মনের দিক দিয়ে নিঃসংশয় না হলেও যৌক্তিক বিচারে এতে পাপের কিছু নেই বলেই কবির বিশ্বাস। তাই তিনি পাঠক সাধারণকে বলছেন :

হিন্দুয়ানী অক্ষর দেখি না করিঅ হেলা
বাঙ্গালা অক্ষর পরে আঞ্জি মহাধন
 তাকে হেলা করিবে কিসের কারণ।
যে-আঞ্জি পীর সবে করিছে বাখান
কিঞ্চিৎ যে তাহা হোন্তে জ্ঞানের প্রমাণ।
 যেন তেন মতে যে জানৌক রাত্র দিন।
দেশী ভাষা দেখি মনে না করিও ঘীণ।

 এঁর পরবর্তী কবি মুতালিবেরও (১৬৩৯ খ্রী.) ভয় :

আরবিতে সকলে না বুঝে ভাল মন্দ
 তে কারণে দেশী ভাষে রচিলু প্রবন্ধ।
 মুসলমানি শাস্ত্র কথা বাঙ্গালা করিলু
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয় জানিলু।
 কিন্তু মাত্র ভরসা আছএ মনান্তরে।
বুঝিয়া মুমীন দোয়া করিব আমারে।
 মুমীনের আশীর্বাদে পুণ্য হইবেক
অবশ্য গফুর আল্লা পাপ ক্ষেমিবেক।

আমীর হামজা (১৬৮৪ খ্র.) রচয়িতা আবদুন নবীরও সেই ভয় :

মুসলমানী কথা দেখি মনেহ ডরাই
রচিলে বাঙ্গালা ভাষে কোপে কি গোঁসাই।
লোক উপকার হেতু তেজি সেই ভয়।
দৃঢ়ভাবে রচিবারে ইচ্ছিল হৃদয়।

 রাজ্জাক নন্দন আবদুল হাকিমের (সতেরো শতক] মনে কিন্তু কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব তো নেই-ই পরন্তু যারা এসব গোঁড়ামি দেখায়, তাদের প্রতি তাঁর বিরক্তি তীব্র ভাষায় ও অশ্লীল উক্তির মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন তিনি।

যেইদেশে যেই বাক্য কহে নরগণ
 সেইবাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন
 মারফত ভেদে যার নাহিক গমে।
হিন্দুর অক্ষর হিংসে সে সবেরগণ।
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
 সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।
 দেশী ভাষা বিদ্যা যার মন না জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ না যায়।
 মাতা-পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।

 হিন্দুয়ানী মাতৃভাষার প্রতি এতখানি অনুরাগ সে-যুগের আর কোনো মুসলিম কবির দেখা যায় না।

অতএব, সতেরো শতক অবধি মুসলমান লেখকেরা শাস্ত্রকথা বাঙলায় লেখা বৈধ কি-না সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলেন না। আমরা শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম প্রমুখ অনেক কবির উক্তিতেই এ দ্বিধার আভাস পেয়েছি। সুতরাং যারা বাঙলায় শাস্ত্রগ্রন্থ রচনা করেছেন, তাঁরা দ্বিধা ও পাপের ঝুঁকি নিয়েই করেছেন। এতে তাদের মনোবল, সাহস ও যুক্তি-প্রবণতার পরিচয় মেলে।

উন্নাসিক ব্রাহ্মণ্য অভিজাতদের কাছে বাঙলা ছিল ভাষা। উন্নাসিক মুসলিমদের কাছে হিন্দুয়ানী ভাষা। কারুর চোখে প্রাকৃত ভাষা (দ্বিজ শ্রীধর ও রামচন্দ্র খান ১৬ শতক), কারুর মতে লোক ভাষা (মাধবাচার্য ১৬ শতক), কেউ বলেন লৌকিক ভাষা (কবিশেখর ১৭ শতক), অধিকাংশ লেখক দেশী ভাষা এবং কিছুসংখ্যক লেখক বঙ্গভাষা বলে উল্লেখ করতেন। বহিরাঞ্চলে এ ভাষার নাম গৌড়িয়া!

.

০৩.

মধ্যযুগে হিন্দুয়ানী ভাষার প্রতি মুসলমানদের বিরূপতা ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস প্রসূত। কিন্তু উনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে সে বিরূপতাও রাজনৈতিক যুক্তিভিত্তিক হয়ে আরো প্রবল হবার প্রবণতা দেখায়।

তুর্কী ও মুঘলেরা এদেশে মুসলিম শাসন দৃঢ়মূল করবার প্রয়োজনে বিদেশী ও দেশী মুসলিম মনে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবোধ জিইয়ে রাখতে প্রয়াসী হন। ধর্মের উৎসভূম আরব এবং শাসক ও সংস্কৃতির উদ্ভবক্ষেত্র ইরান-সমরখন্দ-বুখারার প্রতি জনমনে শ্রদ্ধাবোধ ও মানস-আকর্ষণ সৃষ্টির ও লালনের উদ্দেশ্যে কাফের-বিদ্বেষ সঞ্চারিত করে স্বাতন্ত্র্যবোধ জিইয়ে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠীর একটি সচেতন প্রয়াস ছিল। আলাউল হক, তাঁর পুত্র নুরকুতবে আলম, জাহাগীর সিমনানী, আলসানী, শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ প্রভৃতির পত্রে এ মনোভাবের আভাস আছে। আর মুসলিম রচিত ইতিহাসের ভাষায় আর ভঙ্গিতেও হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষ এবং অবজ্ঞা প্রায় সর্বত্র পরিস্ফুট। অনুকূল পরিবেশে এই বহির্মুখী মানসিকতা মুসলিম মনে ক্রমে দৃঢ় হতে থাকে। ইরানে সাফাবী বংশীয় রাজত্বের অবসানে কিছুসংখ্যক বাস্তুত্যাগী ইরানী নাকি বাঙলায়ও বসবাস করতে এসেছিল। সম্ভবত তাদের সাহচর্য আভিজাত্যলোভী দেশী মুসলমানদের বহির্মুখী মানসিকতাকে আরো প্রবল করেছিল। ফারসি ভাষার বাস্তব গুরুত্বে ও সংস্কৃতির মর্যাদায় প্রলুব্ধ বাঙালি তা গ্রহণে-বরণে (উনিশ শতকের বাঙালির ইংরেজি ও বিলেতি সংস্কৃতি গ্রহণের মতোই) আগ্রহ দেখাবে–এ-ই ছিল স্বাভাবিক।

এমনিতেই আভিজাত্যলোভে শিক্ষিত দেশী মুসলমানরা চিরকাল নিজেদের বিদেশাগত মুসলমানের বংশধর বলে পরিচয় দিয়ে আসছে। ফজলে রাব্বী খান বাহাদুর তাঁর হকিকতে মুসলমানে বাঙ্গালা (অনুবাদ : The Origin of the Musalmans of Bengal, 1895 A. D.) গ্রন্থে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বাঙালি মুসলমানেরা প্রায় সবাই বহিরাগত। আঠারো শতকে কোম্পানী শাসন প্রবর্তিত হলেও নবাবী আমলের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া অনেককাল বিলীন হয়নি। ফারসি ছিল ১৮৩৮ খ্রীস্টাব্দ অবধি দরবারী ভাষা। কাজেই ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত সমাজ তখনো মধ্যযুগীয় আমীরী স্বপ্নে বিভোর, যদিও তাদের অজ্ঞাতেই তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছিল। তখন দুর্ভাগ্যের দুর্দিন সত্যই তাদের সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল, তখনো হৃতসর্বস্ব মুসলমান উত্তর ভারতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল জ্ঞাতির ঐশ্বর্যগর্বে নিজের দীনতা ভুলবার নিষ্ফল আশায়। তখন আরবি নয়, এমনকি ফারসিও তত নয়, উর্দু প্রীতিই তাদের মানসিক সান্ত্বনার অবলম্বন হল। উর্দু ভাষা না থাকিলে আজ ভারতের মোসলমানগণ জাতীয়তাবিহীন ও কিরূপ দুর্দশাগ্রস্ত হইত, তাহা চিন্তা করিবার বিষয়। বাংলা দেশের মোসলমানদিগের মাতৃভাষা বাংলা হওয়াতে, বঙ্গীয় মোসলমান জাতির সর্বনাশ হইয়াছে। এই কারণে তাহারা জাতীয়তাবিহীন নিস্তেজ দুর্বল ও কাপুরুষ হইয়া দিয়াছে। [১৯২৭ সন, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার জীবন চরিত : ভূমিকা, মোহাম্মদ রেয়াজদ্দিন আহমদ। ইনি নিজে ছিলেন বাংলা লেখক ও সাংবাদিক। তাই নওয়াব আবদুল লতিফের (১৯২৬-৯৪) মুখে শুনতে পাই: বাঙলার মুসলিম ছোটলোকদের ভাষা বাংলা। আর অভিজাতদের ভাষা উর্দু।

বাঙলার প্রতি মুসলমানদের মনোভাব কত বিচিত্র ছিল তার দু-একটি নমুনা দিচ্ছি: A Muhammadan Gentelman about 1215 B. S. (1808 A. D.) enjoined in his deathbed that his only son should not learn Bengali, as it would make him effiminate. … Muhammadan gentry of Bengal too wrote in Persian and spoke in Hindustani.

(JASB, 1925 PP 192-93; A Bengali Book written in Persian Script : Khan Saheb Abdul Wali). মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন আহমদের পূর্ব উদ্ধৃত উক্তিও স্মর্তব্য।

মীর মশাররফ হোসেন তাঁর আমার জীবনী (১৩১৫ সন) গ্রন্থে লিখেছেন : মুন্সী সাহেব (তাঁর শিক্ষক) বাঙ্গালার অক্ষর লিখিতে জানিতেন না। ….বাঙ্গালা বিদ্যাকেও নিতান্ত ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন। …. আমার পূজনীয় পিতা বাঙ্গালার একটি অক্ষরও লিখিতে পারিতেন না।

মীর মুশাররফ হোসেনের গৌরাই ব্রীজ বা গৌরীসেতু গ্রন্থের সমালোচনা প্রসঙ্গে বঙ্গদর্শনে বঙ্কিমচন্দ্র? যে মন্তব্য করেছিলেন তাতেও মুসলিম সমাজমনের পরিচয় পাই: যতদিন উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদিগের মধ্যে এমত গর্ব থকিবে যে তাঁহারা বাঙ্গালা লিখিবেন না বা বাঙ্গালা শিখিবেন না, কেবল উর্দু-ফারসির চালনা করিবেন, ততদিন সে (হিন্দু-মুসলমান) ঐক্য জন্মিবে না।

[হিন্দু মুসলমান ঐক্য তখনো ছিল না– শাসক-শাসিত সুলভ অবজ্ঞা বিদ্বেষের জেরই বিদ্যমান ছিল!]

বাঙ্গালা ভাষা হিন্দুগণের ভাষা। (নবনুর; ভাদ্র ১৩১০ সন : মুসলমানের প্রতি হিন্দু লেখকের অত্যাচার লেখক কেন চিৎ মর্মাহতের হিতকামিনা। ইনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ।)

আমি জাতিতে মোসলমান,–বঙ্গভাষা আমার জাতীয় ভাষা নহে। [হিন্দু মুসলমান (ঢাকা ১৮৮৮ সন) গ্রন্থে লেখক শেখ আবদুস সোবহান। ইনি ইসলাম সুহৃদ নামক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।].

শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ, তাঁর পুত্র শাহ্ আবদুল কাদির ও ওয়াহাবী (মুহম্মদী) আন্দোলনের প্রবর্তক সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর আন্দোলনের বাহন ছিল উর্দু। সে সূত্রেও ইসলামি সাহিত্যের আধারূপে উর্দু ধর্ম ও জাতি-প্রাণ মুসলিম চিন্তাবিদদের প্রিয় হয়ে উঠেছিল। এ কারণে শেখ আবদুর রহিম, নওশের আলি খান ইউসুফজাই, মৌলানা আকরম খান প্রমুখ অনেক বাঙলা লেখকও উর্দুর প্রয়োজনীয়তা (পাকিস্তান পূর্বযুগেও) অনুভব করতেন। শেখ আবদুর রহিম বলেছেন:….বঙ্গীয় মুসলমানদিগের পাঁচটি ভাষা শিক্ষা না করিলে চলিতে পারে না–ধর্ম ভাষা আরবি, তৎসহ ফারসি এবং উর্দু এই দুইটি, আর রাজভাষা ইংরেজী তৎসহ মাতৃভাষা বাঙ্গালা। (৮ই পৌষ ১৩০৬ সন– মিহির ও সুধাকর)।

মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খান বলেছিলেন–উর্দু আমাদের মাতৃভাষাও নহে, জাতীয় ভাষাও নহে। কিন্তু ভারতবর্ষে মোছলেম জাতীয়তা রক্ষা ও পুষ্টির জন্য আমাদের উর্দুর দরকার। (তৃতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য-সম্মেলন : অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির ভাষণ।)

সাধারণভাবে বলতে গেলে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বাবধি (১৯২০ খ্র;) এক শ্রেণীর বাঙালি মুসলমান উর্দু-বাঙলার দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এঁদের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষিত এবং জমিদার অভিজাতরাই ছিলেন বেশি। বাঙালি মুসলমানের অশিক্ষার সুযোগ ঊনিশ শতকে এবং বিশ শতকের প্রথম তিন দশক অবধি স্ব-আরোপিত (Self assumed) অবাধ নেতৃত্ব পেয়েছিলেন নবাব আবদুল লতিফ, আমীর হোসেন (বিহারী), সৈয়দ আমির আলি, নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নবাব আলি প্রমুখ বহিরাগত মুসলিমের উর্দুভাষী বংশধরগণ। তাঁরাই বাঙালি মুসলমানের মুখপাত্র হিসেবে উর্দুকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা রূপে বিদ্যালয়ে চালাবার স্বপ্ন দেখতেন। পাকিস্তান-উত্তর যুগে তাঁদেরই বংশধর কিংবা জ্ঞাতিত্ব লোভীরাই উর্দুকে বাঙালির উপর চাপিয়ে দেবার প্রয়াসী ছিলেন। আজো একশ্রেণীর শিক্ষিত লোক ও সাহিত্যিক বাঙলায় আরবি-ফারসি শব্দের বহুল প্রয়োগ দ্বারা উর্দুর স্বাদ পাবার প্রয়াসী!

অতএব, গোড়া থেকেই বাঙলা ভাষার অনুশীলনে মুসলমানরা বিবিধ কারণে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। আজো সে-দ্বিধা থেকে তাদের অনেকেই মুক্ত নয়। এভাবে বাঙলা মুসলিম গুণী-জ্ঞানীর আন্তরিক পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত ছিল। তার ফলে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য-ক্ষেত্রে মুসলিম অবদান যতখানি থাকা বাঞ্ছনীয় ও স্বাভাবিক ছিল, তা মেলেনি। সৈয়দ সুলতানও এই দ্বিধাগ্রস্তদেরই অন্যতম। বহু যুক্তি দিয়ে তিনি একদিকে নিজেকে বাঙলা রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, অপরদিকে বিরূপ সমালোচনা প্রতিহত করার প্রয়াস পেয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *