বাঙলা প্রণয়োপাখ্যানের উৎস
মুসলমানেরাই যে এদেশে মানবিক-রসাশ্রিত সাহিত্যধারার প্রবর্তন করেন, এ তথ্য এখন আর কারুর কাছেই নতুন নয়। এটি হচ্ছে ইরানী সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। দরবারের ইরানী ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এদেশের হিন্দু-মুসলমানের পরিচয় একই সূত্রে ও একই সময়ে ঘটলেও প্রভাবের তারতম্য ঘটেছে বিস্তর। অপেক্ষাকৃত সংস্কারভারমুক্ত একেশ্বরবাদী মুসলমানের স্বাজাত্যবোধ ইরানী সংস্কৃতি স্বীকরণে সহায়তা করেছে প্রচুর, কিন্তু সংস্কার-পঙ্গু হিন্দুর পক্ষে ছয়শ বছরেও তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তাই মুসলমানেরা যখন আধুনিক সংজ্ঞার বিশুদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টি করছিল, তখনও হিন্দুরা দেবতা ও অতিমানব জগতের মোহ ত্যাগ করতে পারেনি। চর্যাকার থেকে করিওয়ালা অবধি হিন্দুর হাতে দেবমাহাত্মজ্ঞাপক ধর্মীয় প্রচার সাহিত্যই পেয়েছি। ধর্মভাগ জাগানো এর লক্ষ্য-সাহিত্য-শিল্প এর আনুষঙ্গিক রূপ এবং সাহিত্য রস এর আকস্মিক ফল। অপরদিকে মুসলমানদের হাতে বাঙলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা বিচিত্রভাবে সৃষ্ট ও পুষ্ট হতে থাকে।
মুসলমান রচিত সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবিক রস বা মানবতা। একালে মানবতা বলতে যা বোঝায়, এ কিন্তু তা নয়। এ মানবতা মানুষ সম্বন্ধে কৌতূহল বা জিজ্ঞাসাই নির্দেশ করে। অর্থাৎ বিস্ময়-চঞ্চল কল্পচারী মানুষের প্রকৃতি, নিসর্গ ও মানস-সৃষ্ট দেব-দানব সম্বন্ধীয় আদিম কৌতূহল চোখে-দেখা মানবমুখী হয়ে উঠে। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে ওরাও রইল মানুষকেও জিজ্ঞাসার বিষয় করে নিল। প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত, লৌকিক ও অলৌকিক, স্বপ্ন ও কল্পনা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষের কোনো সীমারেখা স্বীকৃত নয় এ লোকে। নদী-নগরী, গিরি-মরু-কান্তার, আকাশ-মাটি-সাগর ও স্বর্গ-মর্ত্য পাতালের পরিসরে দেব-দানব রক্ষা-যক্ষের সমবায়ে গড়ে উঠেছে এ জগৎ। বাহুবল, মনোবল আর বিলাস-বাঞ্ছাই সে জীবনের আদর্শ। সংগ্রামশীলতা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা সে-জীবনের ব্রত এবং ভোগই লক্ষ্য। এক কথায়, সংঘাতময় বিচিত্র দ্বান্দ্বিক জীবনের উল্লাসই এ সাহিত্যে প্রকটিত।
সংস্কৃতের পাক-ভারতিক ভাষায় প্রথম বিশুদ্ধ সাহিত্যিক শালীন রচনা হচ্ছে আবদুর রহমানের সংনেহয়-রাসয় বা সন্দেশ রাসক। এটি হচ্ছে একটি দূতকাব্য এবং বারো শতকে অপভ্রংশে বা অবহট্টে রচিত। মূলতানবাসী কবি আবদুর রহমান তাঁতি মীর হোসেনের সন্তান। অতএব দেশজ মুসলমান।
অপভ্রষ্টে বা অবহট্টে রচিত দ্বিতীয় কাব্যের নাম পহুরিরায় রাসউ বা পৃথ্বীরাজ রাসক। এর রচয়িতা চন্দ বলি বা চন্দ বরদাই। জনপ্রিয়তার ফলে ভাষা ক্রমে আধা-হিন্দিতে রূপান্তরিত হওয়ায়, এটি কালে আদি হিন্দি কাব্যরূপে প্রখ্যাত হয়। এ দুটোই দিওয়ান জাতের কাব্য। আনন্দ ধর রচিত সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ মিশ্রিত কাব্য মাধবানল-কামকলাও এখানে উল্লেখ্য।
এদিকে দাক্ষিণাত্যে তেলেগু ভাষাতে দণ্ডলির সংস্কৃত দশা কুমার চরিত-এর তেরো শতকে কৃত একটি পদ্যানুবাদ পাওয়া গেছে। পাঞ্জাবি লৌকিক ভাষায় রচিত গানের আদি নিদর্শন মিলেছে শিখ গুরু অর্জুনের আদিগ্রন্থে। এ অধ্যাত্মসঙ্গীত রচনা করেছেন নিযামুদ্দীন আউলিয়ার মুর্শিদ, সাধক কবি শেখ ফরীদুদ্দীন শক্করগঞ্জ (মৃ. ১২৬৭ খ্র.)। হিন্দি ভাষায় প্রথম কবি লোদী দরবারের আমীর খসরু (১২৫৪-১৩২৫ খ্র.)। ইনি হিন্দিতে কবিতা, গান ও প্রহেলিকা রচনা করছেন।
কবি দামোর লক্ষ্মণ সেন পদ্মাবতী কথা রচনার কাল নিয়ে মতভেদ আছে। রচনা শুরুর কাল কারুর মতে ১৫২৬ সংবৎ তথা ১৪৫৯ খ্রীস্টাব্দ, আবার কেউ কেউ মনে করেছেন ১৫৭০ সংবৎ বা ১৫১৩ খ্রীস্টাব্দ। এটি উপাখ্যান। শাহ ফিরোজ তুগলকের আমলে মালিক নাসিরের আদেশে লোকগাথা ভিত্তি করে হিন্দি-মসনবী চান্দাইন রচনা করেন কবি মোল্লা দাউদ। রচনা সন ৭৮১ হিজরি বা ১৪৮০ খ্রীস্টাব্দ।
এটি সুফী কবির তত্ত্বরসাত্মক মরমী গাথা। কিন্তু মিয়া সাধনের মৈনাস ও হয়তো দাউদের মসনবীর পরেরকার রচনা নয়। এ অনুমানের সমর্থন মিলেছে ৯১১ হিজরি বা ১৫০৬ খ্রীস্টাব্দের লেখা মানের পাণ্ডুলিপি প্রাপ্তিতে।৭
অনুলিপিই যখন ১৫০৬ খ্রীস্টাব্দের, তখন মূল রচনার তারিখ নিঃসংশয় অনুমানে বিশ-পঁচিশ বছর পিছিয়ে দেয়া যায়। পনেরো শতকের প্রথমার্ধের সিন্ধি মরমী কবি সাধন মৈনাসৎ-এর কবি মিয়া সাধন অভিন্ন ব্যক্তি বলে মনে করবার কারণ নেই। সাধন পূর্ব-উত্তর ভারতের কবি, এবং ভাষা ঠেঠ-হিন্দি ( ভোজপুরী-অবধীঃ)। সাধন ভগৎ যদি এ কাব্যের রচিয়তা হতেন, তাহলে সিন্ধি কবির হিন্দি বিশুদ্ধতর হত। অবশ্য মৈনাসৎ ও অধ্যাত্মরূপক কাব্য। লোর চান্দাইনের অপর কবি সয়ফুলমূলক বদিওজ্জামান ( ১৬২৬ খ্র.) ও তুতিনামা (১৬৪০) রচয়িতা গাওয়াসি, ইনি গোলকুণ্ডার সুলতান আবদুল্লাহ কুতুব শাহর দরবারে ছিলেন।
লোর-চন্দ্রানী উপাখ্যানের পরে রচিত হয় অধ্যাত্মরূপকাশ্রিত আখ্যায়িকা মৃগাবতী। গৌড় সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহর আশ্রিত জৌনপুরের শর্কী সুলতান হোসেন শাহর সভা কবি কুতবন ৯০৯ হিজরি বা ১৫০৪ খ্রীস্টাব্দে এটি রচনা করেন :
নউ সউ নব জব সংবত অহী।
জিব মোহরম চান্দ উজিয়ারী
য়হ কবি কহী পূরী সংয়ারী
গাহা দোহা অবেল অরজ
সোরঠা চৌপছ কই সরজ
সাস্তর অখির বহুতই আয়ে
অউ দেসী চুনি চুনি কছলায়ে। [সুকুমার সেনের পাঠ : ইসলামি বাঙলা সাহিত্য]
অতএব, এটিও লোককাহিনী ভিত্তিক। আঠারো-বিশ শতকের কোনো কোনো বাঙলা উপাখ্যানে মৃগাবতীর অনুসরণ আছে। আঠারো শতকের কবি মুহম্মদ মুকিম মৃগাবতী বাঙলায় অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু এ কাব্য আজও পাওয়া যায়নি।
এর পরে লোকসাহিত্যের জনপ্রিয় পুরোনো উপাখ্যান নিয়ে রূপকাশ্রিত মাধবানল-কামকলা কাব্য রচনা করেন গণপতি (১৫২৭ খ্রী.)। কুতবন প্রভাবিত জায়সীর পদ্মাবৎ রচিত হয় ১৫৪০ খ্রস্টাব্দে। পদ্মাবৎ রূপকাশিত হলেও অতি উৎকৃষ্ট কাব্য।
অতএব, সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশের পাক-ভারতিক আর্য ভাষায় পনেরো শতকের আগে রচিত ধর্মনিরপেক্ষ উপাখ্যান একটিও নেই। পনেরো শতকের শেষার্ধের রচনা বলে চিহ্নিত করা যায় মাত্র একটি। সেটি মোল্লা দাউদের মরমী গাথা চান্দাইন (১৪৮০ খ্রী.); এবং এ-সময়কার বলে অনুমান করা যায় আরও দুটো : দামোর লক্ষণ সেন পদ্মাবতী কথা (১৫৪৯ খ্রী.?) এবং মিয়া সাধনের মৈনাস (১৫৭০-৮০ খ্রী.?) আর সাধারণভাবে তেরো শতকের আগেকার রচনার কোনো নিদর্শনই বাঙলা ছাড়া অপর কোনো আধুনিক পাক-ভারতিক আর্য ভাষায় মেলেনি। সে দিক দিয়ে দেখলে চর্যাগীতি যেমন আধুনিক পাক-ভারতিক আর্য ভাষার আদি নমুনা, তেমনি শাহ মুহম্মদ সগীরের (১৩৮৯-১৪১০ খ্রী.) ইউসুফ জোলায়খাই আদি প্রণয়োপাখ্যান। কেননা, কবি দাউদের চান্দাইন অধ্যাত্মতত্ত্বরসাশ্রিত মসনবী কাব্য আর দামো ও সাধনের কাব্যের রচনাকাল অনিশ্চিত। নতুন কোনো তথ্য-প্রমাণ না-মেলা অবধি আমাদের এ মতই পোষণ করতে হবে। চর্যাগীত যেমন পাক-ভারতিক ভাষা-জগতে নবযুগের স্মারক স্তম্ভ, তেমনি ইউসুফ জোলায়খাও রোমান্টিক সাহিত্যের গৌরব-মিনার।
ভারতে মুসলমান অধিকার যেমন ইরানী সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এদেশবাসীর পরিচয় ঘটিয়েছে, তেমনি একচ্ছত্র শাসন ভারতের অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। এরূপে বাঙালিরা ইরানী ও হিন্দি ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে এবং ঐ দুটোর আদর্শে ও অনুসরণে নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচর্যা করে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ হয়েছে।
বাঙালি মুসলমান রচিত সাহিত্যও মূলত অনুবাদ সাহিত্য। ফারসি-হিন্দি অবলম্বনে গড়ে উঠেছে রোমান্টিক সাহিত্য এবং আরবি-ফারসি থেকে অনূদিত হয়েছে ধর্ম ও যুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ। অনুবাদ বলতে আধুনিক সংজ্ঞায় যা, বোঝায়, সবক্ষেত্রে ঠিক তা ছিল না। অনুবাদ ছিল তিন প্রকারের : কায়িক, ছায়িক ও ভাবিক অর্থাৎ আক্ষরিক, স্বাধীন অনুসৃতি ও ভাবাবলম্বন।
ফারসি প্রণয়োপাখ্যানগুলো (কোনো কোনো হিন্দু আখ্যায়িকাও) প্রধানত সূফীতত্ত্বের রূপকাশ্রিত হলেও বাঙলায় তর্জমা হয়েছে লৌকিক প্রণয়োপাখ্যানরূপেই। তত্ত্বকথাকে এভাবে রস কথায় রূপান্তরের প্রবণতার মধ্যে জীবনবাদী বাঙালি মানসের স্বরূপ ধরা পড়েছে। চর্যা-বাউল বৈষ্ণব-মুর্শিদী প্রভৃতি অধ্যাত্মগীতির উদ্ভবক্ষেত্র বাঙলায় এ মানবিক-রসপ্রীতি লক্ষণীয় ও বিশেষ অর্থপূর্ণ।
সে-যুগের হিসেবে বাঙলা রোমান্টিক সাহিত্য পরিমাণে প্রচুর, যদিও বৈশিষ্ট্যে বিচিত্র নয়। চৌদ্দ শতকের শেষ দশকে যার শুরু, বটতলার বদৌলতে আজ অবধি তার ইতি ঘটেনি। অধিকাংশ রোমান্স উনিশ-বিশ শতকে দোভাষী রীতিতে রচিত এবং রূপে-রসে নিতান্তই তুচ্ছ, আর ভাবে ও ভঙ্গিতেও বৈশিষ্ট্যহীন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত লোকের সাহিত্য সৃষ্টি হওয়ার পর ওসব রচনার আর কোনো সাহিত্যিক মূল্যই নেই এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মূল্যও নগণ্য। তাই আমরা ওগুলো বাদ দিয়ে আঠারো শতক অবধি রচিত ও জ্ঞাত রোমান্সগুলোর নাম করছি।
চৌদ্দ শতকের শেষ দশকে কিংবা পনেরো শতকের প্রথম দশকে রচিত হয় শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ-জোলায়খা। ষোল শতকে পাচ্ছি দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু, মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী, শাহ বারিদ খানের বিদ্যা সুন্দর। সতেরো শতকের উপাখ্যান হচ্ছে : দোনা গাজীর সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান, কাজী দৌলতের সতীময়না লোর চন্দ্রানী, আলাউলের পদ্মাবতী, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামান, সপ্তপয়কর, রতন-কলিকা-আনন্দ-বর্মা, মাগন ঠাকুরের চন্দ্রাবতী, আবদুল হাকিমের লালমতী সয়ফুল মুলুক, ইউসুফ-জোলেখা, নওয়াজিশ খানের গুলে বকাউলী, পরাওলের শাহপরীর কেচ্ছা, মঙ্গল চাঁদের শাহ্ জালাল-মধুমালা। (এতে মঙ্গল কাব্যের মর্মগত অনুকৃতি আছে), সৈয়দ মুহম্মদ আকবরের জেবল মুলুক-সামারোখ, শরীফ শাহ্র লালমতী সয়ফুল মুলুক আর আঠারো শতকে রচিত হয়েছে খলিলের চন্দ্রমুখী, মুহম্মদ মুকিমের গুলে-বকাউলী, কালাকাম, মৃগাবতী, মুহম্মদ আবদুল করিম খোন্দকারের তামিম আনসারী, রফিউদ্দিনের জেবলমুলুক সামারোখ, শাকের মাহমুদের মধুমালা-মনোহর, নুর মুহম্মদের মধুমালা, রামজয়ের শশিচন্দ্রের পুঁথি, দ্বিজপশুপতির চন্দ্রাবলী, গরীবুল্লাহর ইউসুফ-জোলেখা, সোনাভান, সৈয়দ হামজার মধুমালতী, জৈগুনের কেচ্ছা, মুহম্মদ আলী রাজার তমিমগোলাল চৈতুন্ন সিলাল, মিশরী জামাল, মুহম্মদ আলীর শাহ পরী মল্লিকা জাদা, হাসান বানু, আবদুর রজ্জার্কের সয়ফুল মুলুক লালবানু, শমশের আলীর রেজওয়ান শাহ, মুহম্মদ জীবনের বানু হোসেন বাহরাম গোর কামরূপ কালাকাম প্রভৃতি।