বাঙলা প্রচলনের বর্তমান অবস্থা
এগারো বছরে বাঙলা ভাষা কতোখানি ঢুকেছে রাষ্ট্রের স্তরেস্তরে, নথির রঙিন পাতায়, অত্যন্ত ও বিশেষ গোপনীয় ফাইলে, পরীক্ষার খাতায়, বিচারপতির রায়ে, ব্যাংকের হিশেবখাতায়, কর্মকমিশনের প্রশ্নপত্রে, প্রচারপত্রে, ওষুপত্র আর পণ্যের মোড়কে, ভিত্তিপ্রস্তরে, সেমিনার কক্ষে? কতোটুকু স্থান তার মন্ত্রীর কক্ষে, সচিবের টেবিলে, প্রতিষ্ঠান-সংস্থার নামে, সরকারি নিমন্ত্রণপত্রে, সাইনবোর্ডে, বিজ্ঞাপনে, এবং আরো অজস্র এলাকায়? সম্ভবত দশ শতাংশ এলাকার বেশি বাঙলার অধিকারে আসে নি। সচিবালয়ের একজন উচ্চকর্মকর্তার কক্ষে ঢুকে তাকালে চোখ পড়ে : তাঁর কক্ষের দিগদিগন্ত আচ্ছন্ন ক’রে আছে ইংরেজি। তাঁর টেবিলের কাচের নিচে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদের স্তরক্রমের তালিকা ইংরেজিতে, ফাইল ইংরেজিতে, ছেঁড়া কাগজে লেখা টেলিফোনসংখ্যাগুলো ইংরেজিতে; টেলিফোনটির সংখ্যা, একগুচ্ছ আবেদনপত্র, গেজেট ইংরেজিতে; এবং পাশের ঘরে টাইপরাইটারের হাতুড়ির শব্দও ওঠে ইংরেজিতে। একপ্রস্থ বাঙলা ঝোলানো দেখা যায় দেয়ালে (‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’-এর বর্ষপঞ্জিতে); এবং একস্তুপ বাঙলাকে অব্যবহৃত প’ড়ে থাকতে দেখা যায় কক্ষের এককোণে (বাতিল টেলিফোন পঞ্জিতে)। এ-বাহ্যদৃশ্য পেরিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে বোঝা যায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কিছু কিছু নথি লেখা হচ্ছে বাঙলায়,- দশ ভাগের বেশি হবে না। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান অবশ্য বেশ জোরের সাথে দাবি করে যে বাঙলা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে শুধু তাদের মন্ত্রণালয়ে ও প্রতিষ্ঠানে; আর কোথাও বাঙলা চলছে না। অনেক মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠান আবার দাবি করে যে তারা এমন সব কাজে লিপ্ত, যা বাঙলায় সম্ভব নয়। যেমন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ কাজই হয় ইংরেজিতে। তাদের দাবি : যে সমস্ত আইনের প্রয়োগে শয়তানদের শাস্তি ও পুণ্যবানদের পুরস্কার দেয়া হয়, তার সবই ইংরেজিতে; তাই বাঙলায় কাজ চলতে পারে না। বাঙলা ভাষাটি এমন বদ যে তার ব্যবহারে শয়তান স্বর্গে চ’লে যেতে পারে পুণ্যবান যেতে পারে নরকে! অনেক কর্মকর্তা অবশ্য গোপনে জানান যে সব কাজই তাঁরা বাঙলায় সম্পন্ন করতেন, যদি তাঁদের বাঙলা ব্যবহারের ‘অনুরোধ’ না ক’রে ‘আদেশ’ দেয়া হতো।
বাঙলা প্রচলনের বিগত এগারো বছর সুস্পষ্ট দু-ভাগে বিভক্ত : স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, একটি রূপক ব্যবহার ক’রে বলা যায়, বাঙলা প্রচলন আর ব্যবহারের জোয়ার এসেছিলো; কিন্তু সত্তর দশকের দ্বিতীয়াংশে তা ভাটায় গড়ায়। স্বাধীনতার প্রথম পর্যায়ে কর্মচারীরা ভেবেছিলেন বাঙলায় দক্ষতা উন্নতির সহায়ক হবে, ছাত্ররা ভেবেছিলো বাঙলা আয়ত্ত করতে পারলে চাকুরি পাওয়ার সুবিধা হবে। এ-বৈষয়িক চিন্তার সাথে অবশ্যই জড়িয়ে ছিলো দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। কিন্তু তাঁদের ধারণা সত্য হয় নি;- বাঙলা কোনো রকম উন্নতিতেই কারো সহায়তায় আসে নি, এবং দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবোধও ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলার অবস্থার একটি উদাহরণ এখানে দেয়া যায়। বাঙলা পড়া ও বাঙলা প্রচলন যদিও এক কথা নয়, তবু বাঙলা পড়ার আগ্রহ একটি প্রবণতা নির্দেশ করে যে ছাত্রেরা বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে। স্বাধীনতার পরে বাঙলা বিভাগের প্রতি ভালো ছাত্রদের আকর্ষণ বেড়েছিলো; এবং বাঙলা ভাষা-সাহিত্যকে সহকারি বিষয় হিশেবে গ্রহণ করেছিলো বিপুল পরিমাণ ছাত্রছাত্রী। তাদের হয়তো ধারণা ছিলো যে নিজ বিষয়ের সাথে বাঙলা ভাষাটি যদি ভালোভাবে আয়ত্ত করা যায়, তবে উপকার হবে। সত্তরের দ্বিতীয়াংশে এসে এ-বিভ্রান্তি কেটে যায়; এখন মুষ্টিমেয় ছাত্রছাত্রী সহকারি বিষয় হিশেবে বাঙলা পড়ে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন কিছু নিয়ম রচনা করেছে, যা বাঙলার বিরুদ্ধে যায়। আগে অর্থনীতি সমাজতত্ত্ব রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ের ছাত্রদের সহকারি বিষয় হিশেবে বাঙলা পড়ায় কোনো বাধা ছিলোনা, কিন্তু এখন বাধা দেয়া হচ্ছে। এমন বাঙলাবিরোধী প্রবণতা দেশের নানা কেন্দ্রে সূচারূপে কাজ ক’রে যাচ্ছে।
কিন্তু বহুমুখি বিরোধিতা সত্ত্বেও বাঙলা প্রচলনের গতি রুদ্ধ হয়ে পড়ে নি; নানাভাবে বাঙলা প্রবেশ করছে সমাজ-রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত এখন সব কিছুই পড়তে হয় বাঙলায়, এর ফলে বাঙলা বিস্তৃত হচ্ছে ব্যাপক এলাকায়। ছাত্ররা উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতিতে এসে ইংরেজির মুখোমুখি হয়। এ-স্তরে রুদ্ধ হয় বাঙলার গতি; কিন্তু যারা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাঙলায় সব বিদ্যা পড়েছে, তারা বাঙলাতেই স্বস্তি পায়; এবং চিকিৎসা-কৃষি প্রভৃতিতে শিক্ষকদের আগ্রহের অভাবে তারা কোনোরূপে ইংরেজি ভাষার সাহায্যে কাজ চালায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে অমন অসুবিধা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত বাঙলা ভাষায়ই বক্তৃতা দেয়া হয়, দু-একটি উন্নাসিক বিভাগ বাদে; এবং অধিকাংশ ছাত্রই বাঙলা ভাষায় পরীক্ষা দেয়। বাঙলা ভাষার সাথে এরা জড়িত অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে; বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এরা স্বাভাবিকভাবেই সর্বত্র বাঙলা ব্যবহার করে, ও করবে। তবে এ প্রক্রিয়ায় বাঙলা নিচ থেকে ওপরের দিকে যায়; আর বাঙলা প্রচলনের মূলকথা হচ্ছে অবিলম্বে বাঙলা প্রয়োগ— সর্বত্র ও সর্বস্তরে।