বাঙলা দেশ
কতকগুলি প্রশ্ন আমাকে ছেলেবেলা থেকেই চিন্তান্বিত করেছে, এগুলোর সদুত্তর আমি বহু জায়গায় অনুসন্ধান করে কয়েকটি মীমাংসায় পৌঁছেছি বটে কিন্তু যতখানি দলিল-দস্তাবেজ থাকলে এগুলো প্রমাণরূপে পেশ করা যায় ততখানি করে উঠতে পারিনি। তার প্রধান কারণ আমার আলসেমি নয়– দস্তাবেজের অপ্রাচুর্যই তার আসল কারণ। অনেকদিন ধরে তাই ভেবেছি, আমার যা বলবার তা বলে ফেলি– দলিল থাক আর না-ই থাক– যারা এ-সব লাইনে কাজ করেন, হয়তো তাদের উপকারে লেগে যেতে পারে। দেশ সম্পাদকও এই মত পোষণ করেন– বস্তুত তারই অনুরোধে আমি আমার সমস্যা ও মীমাংসাগুলো পাঠকদের সামনে পেশ করছি; কিন্তু আবার সাবধান করে দিচ্ছি, যথেষ্ট প্রমাণপঞ্জি আমার হাতে নেই।
আমার প্রথম প্রশ্ন, দিল্লি আগ্রা পাঠান-মোঘলদের রাজধানী ছিল। সেখানে মুসলমানের সংখ্যা অত কম কেন? যুক্ত প্রদেশ, বিহার, পশ্চিম বাঙলার দিকে যতই এগোই, দেখি মুসলমানের সংখ্যা কমে আসছে– সেইটেই স্বাভাবিক কিন্তু হঠাৎ পুব বাঙলায় এসে এদের সংখ্যাধিক্য কেন? দিল্লির বাদশা দিল্লি, এলাহাবাদ ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ পুব বাঙলায়ই তলোয়ার চালিয়ে জনসাধারণকে মুসলমান করলেন কেন? উত্তরে কেউ কেউ বলেন, দিল্লির বাদশারা তলোয়ার চালাননি, চালিয়েছিল বাঙলার স্বাধীন পাঠান বাদশারা। তাই যদি হবে, তবে সে যুগে বিহার, বিজাপুর, আহমদাবাদেও স্বাধীন পাঠান রাজারা ছিলেন। তাঁরাই তলোয়ার চালালেন না কেন? কেউ কেউ বলেন, বাঙলা দেশ বৌদ্ধপ্রধান স্থান ছিল– তারা ভালো করে পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরে যাবার পূর্বেই মুসলমান ধর্ম বাঙলা দেশে আসে বলে এদের অনেকেই মুসলমান হয়ে যায়। এর উত্তরে আমার নিবেদন- রাজগির, বুদ্ধগয়া, পাটলিপুত্র, নালন্দা, বিক্রমশিলা সবই বিহার প্রদেশে–এ তো আরও বৌদ্ধপ্রধান ছিল। তবে তারাই-বা মুসলমান হল না কেন?
সর্বশেষে আরও সামান্য একটি বক্তব্য আছে। বহুকাল পূর্বে (শ্রাবণ, ১৩৫৮, বসুমতী) আমি স্বামী বিবেকানন্দের একটি উদ্ধৃতিতে পড়ি,
ভারতবর্ষের দরিদ্রগণের মধ্যে মুসলমানের অত সংখ্যাধিক্য কেন? একথা বলা মূর্খতা যে তরবারির সাহায্যে তাহাদিগকে ধর্মান্তর গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল।…
বস্তুত জমিদার ও পুরুতবর্গের হস্ত হইতে নিষ্কৃতি লাভের জন্য ইহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল। আর সেইজন্য বাঙলা দেশে সেখানে জমিদারের বিশেষ সংখ্যাধিক্য সেখানে কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু অপেক্ষা মুসলমানের সংখ্যা বেশি।*[* এ উদ্ধৃতিতে যে কয়েকটি ফুটকি আছে, সেগুলো প্রবন্ধের সঙ্কলন কর্তাই দিয়েছিলেন। মূল সম্পূর্ণ লেখাটি পেলে আমাদের আলোচনার সুবিধে হয়।]
আমার মূল বক্তব্যের সঙ্গে স্বামীজির কথা কিছুটা মিলে। পরে তার দীর্ঘতর আলোচনা হবে। উপস্থিত তরবারির সাহায্যে যে ব্যাপকভাবে ধর্ম প্রচার করা যায় না, সেই সিদ্ধান্তটি মেনে নিয়ে এগোচ্ছি।
আরবভূমি যদিও মরুময়, তবু তার তিন দিকে সমুদ্র। নৌযাত্রায় আরবরা তাই কখনও পরাজুখ ছিল না। বিশেষত হজরত মুহম্মদের সময় তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে নৌপথে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে দু খানা উত্তম গ্রন্থ এলাহাবাদ একাডেমি থেকে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে– আরবোঁকী জাহাজরাণী (আরব নৌবিদ্যা) ও হিন্দ ও আরবকী তালুকাৎ (ভারত ও আরবের যোগসূত্র)। অতদূর না গিয়ে যারা আরব্যোপন্যাসের সিন্দবাদকে স্মরণে আনতে পারবেন তারাই বলতে পারবেন এক বিশেষ যুগে আরবজাতি কী দুর্দান্ত সমুদ্রাভিযানই করেছে।*[* আরব্যোপন্যাসের প্রথম গল্পটি জাতক থেকে নেওয়া। সতীদাহ ও কোনার্ক মন্দিরের প্রতিচ্ছবিও ওই পুস্তকে পাওয়া যায়।] ওই মৌসুমি (শব্দটি আসলে আরবি ও ইংরিজি মনসুনও তার থেকে) বাতাস আবিষ্কার করে ও ফলে উপকূল ধরে ধরে না এসে এডেনসোকোত্রা থেকে সোজা সিংহল-ভারত আসা সুগম ও দ্রুততর হয়ে যায়।
স্থলপথে আরবরা, ইরান আফগানিস্তান জয় করে। জলপথে সিন্ধুদেশ। এছাড়া সমুদ্রপথে যারা বাণিজ্য করতে ছড়িয়ে পড়ল তাদের নিয়েই আজ আমার আলোচনা। এরা প্রথমে সোকোত্রা (সংস্কৃত দ্বীপ সুখদ্বার–এডেনের কাছেই) তার পর মালদ্বীপ লাক্ষাদ্বীপে ইসলাম প্রচার করে। দক্ষিণ ভারতে পারেনি, (পুব বাঙলার কথা পরে হবে), বর্ষায় পারেনি, মালয় ও ইন্দোনেশিয়ায় পেরেছিল।
হিন্দুদের সমুদ্রযাত্রা কেন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আমি ঠিক জানিনে, তবে যারা বৌদ্ধদের পরাস্ত করে হিন্দুধর্ম পূনর্জীবিত করেছিলেন তারা হয়তো চাননি যে সাগরপারের বৌদ্ধদের সঙ্গে আমাদের কোনও যোগসূত্র থাক–যার ফলে আবার একদিন বৌদ্ধধর্ম মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
তা সে যাই হোক, অষ্টম নবম শতাব্দীতে পুব বাঙলার মাল্লা-মাঝি, আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ীদের দুরবস্থা চরমে। আজও যে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেটের মাঝি-মাল্লারা দুনিয়ার সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় (আজ তারা আবার ইংলন্ডে বসতি স্থাপন করতে আরম্ভ করেছে, প্লেন চার্টার করে পুব বাঙলায় বেড়াতে আসে) এটা কিছু নতুন নয়। হিন্দু বৌদ্ধ যুগে এরাই বাঙলার তাবৎ এবং পুব ভারতের প্রচুর মাল আমদানি-রপ্তানি করেছে, নৌ-নির্মাণ ও নৌবহর চালিয়েছিল বটেই।
সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে প্রধানত এরাই হল অন্নহীন।
আরব ভৌগোলিক (ও ঐতিহাসিকরা) বলেন, অষ্টম ও নবম শতাব্দীতেই (অর্থাৎ বখতিয়ার খিলজির বহু পূর্বেই) আরবরা চট্টগ্রামে উপনিবেশ স্থাপন করেছে ও এ বন্দরেই সবকিছু সংগ্রহ করে (হিন্দুরা তো যাবে না) দক্ষিণ-পুবেও ছড়িয়ে পড়ত।
আরবি ভাষাতে চ ও গ অক্ষর নেই। ট ত-তেও পার্থক্য নেই। সেই হয়েছে বিপদ। তদুপরি নকলনবিশদের ভুল-ত্রুটি তো আছেই। কাজেই যদি-বা চট্টগ্রাম শব্দটি বোঝা যায়, তবু পরবর্তী যুগে এরা সপ্তগ্রাম ও সোনার গাঁ-র সঙ্গেও এটা ঘুলিয়ে গিয়েছে। তারও পরবর্তী যুগের পর্তুগিজরা তাই চট্টগ্রামের উল্লেখ করতে পোর্টে গ্রান্ডে (বড় বন্দর) ও সপ্তগ্রামকে পোর্টে পিক্কোনে (ছোট বন্দর) বলে। [ এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে বর্তমান ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্রতটেই আরবরা বসতি স্থাপন করেন সিলেটের সঙ্গে জলপথের যাতায়াত আরও সহজ ছিল। এরাই মিশনারি এবং বণিক একাধারে। এরাই অষ্টম নবম শতাব্দীতে, একদা যারা মাঝি-মাল্লা ছিল, সেইসব হিন্দুদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করতে আরম্ভ করে। এ তত্ত্বটা মেনে নিলে অষ্টাদশ অশ্বারোহী বঙ্গ জয় অন্য দৃষ্টিতে দেখা যায়। কিন্তু তার জন্য নতুন অধ্যায় প্রয়োজন।
.