বাঙলা দেশ
ইংরেজের সুনাম, সে স্বদেশপ্রেমী। বিদেশের প্রত্যেক ইংরেজকেই তাই তার দেশের বেসরকারি রাজদূত বলা হয়। মুসলমান মাত্রই মিশনারি। বিধর্মীকে ইসলামে টেনে আনার মতো পুণ্য তার কাছে কমই আছে। এবং সে পুণ্যের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ মহাপাপ। ইসলামে তাই মাইনে দিয়ে বা অন্য কোনও প্রকারের অর্থ সাহায্য করে মিশনারি সম্প্রদায় গড়া হয় না। প্রত্যেক মুসলিম ব্যবসায়ীই তার ধর্মের মিশনারি। আফ্রিকায় এখনও মুসলমান হাতির দাঁতের কারবারি অনারারি মিশনারি পাল্লা দেয় মাইনেখোর খৃস্টান মিশনারির সঙ্গে। মাইনে নেওয়ার অসুবিধা এই যে বিধর্মী স্বভাবতই সন্দেহ করে যে মিশনারি তার ধর্মপ্রচার করছে সে শুধু নিজের পেট পোষবার জন্য।
আরব বণিকরা সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এসে বেকার হিন্দু মাঝিমাল্লাকে আহ্বান জানালে, এস আমাদের নৌকায় করে দেশ-দেশান্তরে–ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, মাঝিমাল্লার কাজ করবে, তোমার শ্রীবৃদ্ধি হবে। তুমি সমাজচ্যুত হবে? আমি তোমাকে আমার সমাজে গ্রহণ করব। সে সমাজ ক্ষুদ্র নয়। তুমি লাভবান হবে। আর আমার সমাজের নবদীক্ষিতের সম্মান সর্বোচ্চ এবং আমার সমাজে জাতিভেদ নেই।
মুসলমানদের সুবিধা এই ছিল যে তাদের পূর্বে যারা এসেছিল তারা আপন ধর্মে অন্য লোককে দীক্ষিত করত না, এবং আরব মুসলিমদের ভিতর যে সাম্যবাদ অত্যন্ত প্রখর সেসব কথা সবাই জানে।
আমার বিশ্বাস এই করে ইসলাম পূর্ব বাঙলায় প্রচারিত হয় ৭/৮/৯ম শতাব্দীতে।
হিন্দুসমাজের আরেকটা বিপদ যে মানুষ সেখানে অনিচ্ছায় জাতিচ্যুত হতে পারে। কোনও হিন্দু যদি ভালোবাসাবশত ধর্মান্তরিত তার ভাই মুসলমান বা খৃস্টানকে তার বাড়িতে তার সঙ্গে খেতে বসতে দেয় তবে সমাজ সে হিন্দুকে বর্জন করে। মুসলমান যদি তার খৃষ্টান ভাইকে বাড়িতে থাকতে দেয় তবে সমাজচ্যুত হয় না। তাকে পরিষ্কার বলতে হয়, সে ইসলামে বিশ্বাস করে না, তবে সে সমাজচ্যুত হবে। হিন্দু তার ধর্মে বিশ্বাস রেখেও সমাজচ্যুত হতে পারে। রামমোহন, আদি ব্রাহ্মসমাজের কথা স্মরণ করলেই কথাটা সুস্পষ্ট হয়।
কাজেই কোনও মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত নাবিক তার হিন্দু চাষা ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় পেলে তারও জাত যেত। সবাই যে আশ্রয় দিয়েছে তা নয়, কিন্তু যারা দিয়েছে তারা শেষ পর্যন্ত ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মুসলমানই হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এতটা ছড়াল কী করে? তার একটি তুলনা দিতে পারি। প্যালেস্টাইন থেকে প্রথম প্রথম যেসব খ্রিস্টানদের রোমে ক্রীতদাস রূপে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের কীভাবে সিংহের মুখে ফেলে দেয়া হত সে ছবি অনেকেই নিশ্চয় সিনেমায় দেখেছেন– কুও ভাদি পুস্তক কিংবা ছবি এদেশেও অপরিচিত নয়। অথচ এদেরই সংখ্যা একদিন এমনই বেড়ে গেল যে, সে দেশের সিজারকেও শেষটায় খ্রিস্টান হতে হল। এবং আশ্চর্য, রোমের পোপকে আজকেও রোমান সম্প্রদায়ের লোক হতে হয়। এরও অন্য উদাহরণ আছে। ইসলামের শেষের দিকে খলিফারা তুর্ক। আরব রক্ত এদের গায়ে একেবারেই নেই।
এবং খিলজির বঙ্গাগমনের পূর্বেই বণিকদের কাছে খবর পেয়ে আস্তে আস্তে ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত (বণিকরা মিশনারি বটে, কিন্তু সবসময় শাস্ত্রী হন না) সদাচারী মুসলমান সাধুসন্ত পূর্ববঙ্গে আসতে আরম্ভ করেন। এদের নাতিবিস্তৃত খবর এবং আমাদের মূল বক্তব্য নিয়ে আলোচনা পাঠক পাবেন ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের বই পূর্ব পাকিস্তানে ইসলাম পুস্তিকায়। আমাদের নিয়ে অনেক মতভেদ আছে সত্য কিন্তু আমাদের মূল সিদ্ধান্ত একই সমুদ্রপথেই ইসলাম পূর্ব বাঙলায় আসে! মমাগ্রজ সৈয়দ মরতুজা আলী সাহেবের চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্ট সম্বন্ধে লিখিত একাধিক প্রবন্ধে পাঠক আরও খবর পাবেন।
এই সাধু-সন্তরা ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন সন্দেহ নেই এবং হিন্দু রাজা তথা জনসাধারণ বিধর্মী সাধু-সন্তদের প্রতি আকৃষ্ট হন, এ বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু মূল তত্ত্ব এই যে বণিকরা কতকগুলি কেন্দ্র নির্মাণ না করে থাকলে এঁরা অতখানি করতে পারতেন না। একটি উদাহরণ নিবেদন করি : ভারতবর্ষের সর্বত্র সুপরিচিত পাঁচজন চিশতী। সম্প্রদায়ের সন্তদের মধ্যে তিনজনের কর্মভূমি ও সমাধি দিল্লিতে। কুলুদ্দিন বখতিয়ার কাকি (এঁর কবর কুত্ব মিনারের কাছে), নিজাম উদ্দিন (এঁকে নিয়েই দিল্লি দূরঅসৎ গল্প), এবং নাসিরউদ্দিন চিরাগ দিল্লির বহু শিষ্য পেয়েছিলেন কিন্তু এঁরা ধর্ম পরিবর্তন করেননি। দিল্লিতে এখনও তাদের উর্মপর্বে হিন্দু এবং শিখ অধিকতর এবং সর্বপ্রধান কথা– দিল্লি কখনও মুসলমান-প্রধান হয়নি।
মুসলমান বাদশারা কতখানি সাহায্য করেছিলেন? আমার বিশ্বাস, অল্পই। যেখানে শুধুমাত্র অস্ত্রবলে বিধর্মী এসে রাজ্য স্থাপন করে পূর্বে যেখানে বিজয়ীর আপন ধর্মীয় কেউ ছিল ণা– সে সেখানে যদি প্রজার ধর্মে হস্তক্ষেপ করে তবে তাকে বেশিদিন রাজত্ব করতে হয়। পূর্ব বাঙলায় পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। রাজারা পূর্ব-দীক্ষিত মুসলমানদের সুখ-সুবিধা দিয়ে প্রতিবেশী হিন্দুকে আকৃষ্ট করতে পারতেন।
কু দ্য পালে (রাজপ্রাসাদে হঠাৎ রাজাকে সরানো), কু দেতা (দেশে হঠাৎ সশস্ত্র বা বেআইনি রাষ্ট্র পরিবর্তন) এ ফরাসি কথাগুলো আমাদের কাছে এখন সুপরিচিত। বিশেষ করে সুয়েজ থেকে আরম্ভ করে চীন পর্যন্ত এ ঘটনা এখন নিত্য নিত্য হচ্ছে।
বখতিয়ার খিলজি অষ্টাদশ অশ্বারোহী নিয়ে করেছিলেন, কু দ্য পালে। সেটা কিছু অসম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন, পরদিনই রাজার সৈন্যরা এসে লড়াই দিল না কেন?
তবে কি জনসাধারণ, সৈন্যদল রাজার আচরণে অসন্তুষ্ট ছিল? কোনও কোনও ঐতিহাসিক সে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর দৃষ্টান্তও আছে। আরবের মুষ্টিমেয় প্রথম সৈন্যবাহিনী যখন মরুভূমি অতিক্রম করে মহাপরাক্রান্ত ইরান-রাজকে আক্রমণ করল তখন সেই বিরাট শক্তিশালী রাজবাহিনী অতিশয় অনিচ্ছায় যুদ্ধে নামল। আরবরা বিজয়ী হল। ইয়োরোপীয় ঐতিহাসিকরা বলছেন, ইরানে তার পূর্বেই খবর রটে গিয়েছে, হজরত মুহম্মদ নামীয় এক আরব মহাপুরুষ হ্যাভনট, নিঃস্বদের জন্য নতুন আশার বাণী নিয়ে এসেছেন। এরা সে ধর্মে বিশ্বাসী।
আমার প্রশ্ন, তবে কি পুব বাঙলার মুসলমান তখন অসন্তুষ্ট জনসাধারণের মধ্যে হজরতের বাণী হোক আর না-ই হোক, খিলজিকে পরিত্রাণকর্তারূপে, কিংবা যে-কোনও মুসলমান অভিযানকারীকে ওইরূপে অঙ্কিত করে এমনই আবহাওয়ার সৃষ্টি করে রেখেছিল যে খিলজি তার কু দ্য পালেকে পরে কু দেতাতে পরিবর্তন করতে পেরেছিলেন? ॥
.