বাঙলা : তোষণ ও প্রতারণার ভাষা
কারো পক্ষেই এখন প্রকাশ্যে বাঙলা ভাষার বিরোধিতা করা সম্ভব নয়; এবং অনেকেই, যদিও বাঙলাবিরোধী, প্রকাশ্যে বাঙলার স্তুতি করেন। রাজনীতিকেরা, আমলারা, এবং অন্যেরা সুযোগ পেলেই স্তুতি করেন বাঙলার, যেমন প্রচণ্ড জনশত্রুও এখন জনতার প্রশংসা করেন। আমাদের রাজনীতিক, আমলা ও অন্যান্য শক্তিমানদের বাঙলা ভাষার ব্যবহার তোষণ-প্রতারণার সুন্দর উদাহরণ। রাজনীতিকেরা, ক্ষমতালব্ধ ও প্রলুব্ধ উভয় শ্রেণীর, জনসভায় বাঙলায়, সাধারণত বিকৃত বাঙলায়, বক্তৃতা দেন, জনতাকে উত্তেজিত করেন, অনেক আশার বাণী শোনান। যদি কোনো ইংরেজিমনস্ক রাজনীতিক দুঃসাহস করেন তাঁর প্রিয় ভাষাটি জনতাকে শোনাতে, তাহলে তা হবে প্রকাশ্য জনসভায় আত্মহত্যা। কিন্তু ওই বক্তা রাজনীতিক, অর্থাৎ চতুর প্রতারণাদক্ষ; তাই তিনি আঞ্চলিক ও কথ্যমিশ্রিত বাঙলা বক্তৃতায় মাত্র সে-কটি ইংরেজি শব্দই ব্যবহার করবেন, যা ব্যবহার না করলে জনগণ তাঁকে ‘অশিক্ষিত’ ভাবতে পারে। রাজনীতিকদের সমস্ত বক্তৃতার সারকথা সকলেরই জানা : তোষণ আর প্রতারণা হচ্ছে তাঁদের বক্তৃতার মর্মকথা। বক্তৃতা-শেষে রাজধানিতে ফিরে তাঁরা ইংরেজিচর্চায়, সাধারণত বিকৃত, মনোযোগ দেন। উচ্চ কর্মচারীদের পদ্ধতিও একই; তাঁরা বাঙলায় তোষণ-প্রতারণার কাজটুকু সেরে ইংরেজিতে চক্রান্ত-শোষণের দায়িত্বটুকু সম্পন্ন করেন। ফেব্রুয়ারি মাস এঁদের সামনে এনে দেয় এক সুন্দর সুযোগ। শহরে-গঞ্জে-গ্রামে প্রধান অতিথি হ’য়ে তাঁরা বাঙলা ভাষার ও তার শহীদদের বন্দনা করেন, এবং আনন্দে প্রতারিত হয় জনগণ। রাজনীতিক আমলা বিচারপতি শিক্ষাবিদ আইনজীবী ডাক্তার ঠিকাদার সবাই বন্দনা-প্রতারণার উৎসবে যোগ দেন; কেউ কেউ সাড়াজাগানো ভাষণ দেন; কিন্তু সবাই ব্যক্তিগত-পারিবারিক-পেশাগত জীবনে আবদ্ধ থাকেন রূপসী ইংরেজির অচ্ছেদ্য বাহুপাশে। তাঁদের পুত্রকন্যারা ইউরোপ-আমেরিকায় বিদ্যার্জন করে, নইলে অন্তত ঢাকা শহরেরই কোনো ইংরেজি-মাধ্যম বিদ্যালয়ে। এ-শ্রেণীটি বাঙলা ভাষাকে এখন তোষণ প্রতারণার ভাষা হিশেবেই ব্যবহার করছেন।