বাঙলার স্মার্ত পণ্ডিতগণ
মধ্যযুগের কয়েকজন প্রখ্যাত স্মার্ত পণ্ডিতের কথা এখানে বলব। তাঁদের মধ্যে ভবদেব ভট্ট ছিলেন দশম-একাদশ শতাব্দীর লোক। হলায়ুধ ও জীমূতবাহন সেন রাজাদের আমলের লোক। বৃহস্পতি মিশ্র ও রঘুনন্দন ভট্টচার্য মুসলমানদের শাসনকালে প্রাদুর্ভূত হন। হলায়ুধ প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে। তিনি ছিলেন তৃতীয় সেনরাজা লক্ষ্মণসেনের মহাধর্মাধ্যক্ষ। ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও ব্রাহ্মণসমাজের জন্য তিনি অনেকগুলি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করে ছিলেন যথা ‘ব্রাহ্মণসর্বস্ব’ ‘মীমাংসাসর্বস্ব বৈষ্ণবসর্বস্ব, শৈবসর্বস্ব’ ও পণ্ডিতসর্বস্ব। সে যুগের স্মৃতি ব্যবহার ও ধর্মশাস্ত্র রচয়িতাদের মধ্যে তিনিই অগ্রগণ্য। তাঁর আর দুই ভাই ঈশান ও পশুপতিও ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ঈশান রচনা করেছিলেন ‘আহ্নিকপদ্ধতি’ সম্বন্ধে ও পশুপতি ‘শ্রাদ্ধপদ্ধতি’ সম্বন্ধে। এখানে উল্লেখনীয় যে হলায়ুদ নামে আর একজন পণ্ডিতের খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি ‘অভিধান রত্নমালা’ ‘কাব্যরহস্য’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। শেষের খানা ব্যাকরণের বই।
জীমূতবাহন খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীর লোক। তিনি তিনখানা গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থ তিনখানির নাম ‘কালবিবেক’, ব্যবহারমাতৃকা ও ‘দায়ভাগ’। শেষোক্ত বিধানগ্রন্থটির জন্যই তিনি বিখ্যাত। ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে তিনি হিন্দুর পূজানুষ্ঠান, শুভকর্ম, আচার ও ধর্মোৎসব প্রভৃতির কাল নির্দেশ করেছিলেন। তাঁর এই গ্রন্থে ‘হোলকা’ বা হোলি উৎসবের উল্লেখ আছে। ‘ব্যবহারমাতৃকা’ গ্রন্থে হিন্দু বিচারপদ্ধতির আলোচনা আছে। তৃতীয় গ্রন্থটি উত্তরাধিকার সম্পর্কে উত্তরভারতে প্রচলিত ‘মিতাক্ষরা’ বিধানের বিপক্ষে লেখা। এতে উত্তরাধিকার, সম্পত্তিবিভাগ, স্ত্রীধন প্রভৃতি বিষয়ে আলোচিত। বইখানি প্রাচীন শাস্ত্রকারদের যুক্তি ও মতামতের ভিত্তিতে লেখা ও বিশেষ পাণ্ডিত্যপূর্ণ। জীমূতবাহন পিণ্ডদানের সহিত উত্তরাধিকার যুক্ত করেন ও সম্পাদিত কর্ম নিয়মমত না হলেও তাহা সিদ্ধ বলে গ্রহণ করার রীতির বিধান দেন। ‘দায়ভাগ’ বাঙলাদেশে উত্তরাধিকার বিষয়ে যাবতীয় প্রশ্নের সমাধানের নিয়ামক। বাঙলায় ‘দায়ভাগ’-এর বিধানই প্রচলিত।
ভবদেব ভট্ট, হলায়ুধ ও জীবমূতবাহনের কিছু আগেকার লোক। তিনি খ্রিস্টীয় দশম বা একাদশ শতাব্দীতে প্রাদর্ভূত হয়েছিলেন। রাঢ় দেশের সিদ্ধল গ্রামবাসী এক ব্রাহ্মণ বংশে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা গোবর্ধন পণ্ডিতলোক ছিলেন। পিতামহ আদিদেব বর্মণবংশীয় রাজার মন্ত্রী ছিলেন। ভবদেব নিজেও বর্মণবংশীয় রাজা হরিবর্মদেব ও তাঁর এক অজ্ঞাতনামা পুত্রের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁরই মন্ত্রণাপ্রভাবে বর্মণরা বহুদিন রাজত্ব করতে সক্ষম হন। তিনি উত্তররাঢ়ের শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। ‘ভোটরাজা’ নামে তিনি পরিচিত। প্রজাগণের মঙ্গলার্থে তিনি রাঢ় দেশের বহু জায়গায় জলাভাব দূরীকরণের জন্য পুষ্করিণী খনন করে দিয়েছিলেন। বিক্রমপুরে তিনি নারায়ণের এক মন্দির নির্মাণ ও তৎসংলগ্ন এক জলাশায় খনন করে দিয়েছিলেন। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র, সিদ্ধান্ত, তন্ত্র গণিতশাস্ত্র ও আয়ূর্বেদশাস্ত্রে ছিল তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য। বৌদ্ধদেব মতামত খন্ডন করে তিনি বহু বৌদ্ধকে হিন্দু বর্ণাশ্রম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। হিন্দুর আচার, ব্যবহার ও প্রায়শ্চিত্ত সম্বন্ধে বহু প্রামাণ্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যথা দশকর্ম পদ্ধতি’ ‘প্রায়শ্চিত-প্রকরণ,’ ‘ব্যবহার-তিলক’ ও মীমাংসাদর্শনের ওপর এক টীকা। পরবর্তীকালে রঘুনন্দন, মিত্র মিশ্র প্রভৃতি পন্ডিতেরা তাঁর মতামত উদ্ধৃত করেছেন। সমাজের তিনি বহু সংস্কার করে গিয়েছেন। তিনি বাঙলাদেশের ব্রাহ্মণদের খাছ খাবার বিধান দেন। পরে জীমূতবাহনও সেই বিধান দিয়েছিলেন এবং সেই সময় থেকেই বাঙালী ব্রাহ্মণরা মাছ খাওয়া শুরু করেন। তাঁর অব্যবহিত পরেই বৈদিক শ্রেণিক ব্রাহ্মণরা বাঙলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করেন।
বৃহস্পতি মিশ্র পঞ্চদশ শতাব্দীর লোক। পিতা গোবিন্দ ছিলেন ‘মাহিন্ত্য’ শ্রেণিভুক্ত রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ। তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন ও বহু টীকা গ্রন্থ ও স্মৃতিগ্রন্থ লিখে গিয়েছেন। যে সকল টীকাগ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন তার অন্যতম হচ্ছে ‘সুকেশ’ নামে কুমারসম্ভবের টীকা, ‘রঘুবংশবিবেক’ নামে রঘুবংশের টীকা, ‘নির্ণয় বৃহস্পতি’ নামে শিশুপালবধের টীকা, ‘পদচন্দ্রিকা’ নামে অমরকোষের টীকা ও ‘বোধবর্তী’ নামে মেঘদূতের টীকা। তাঁর রচিত স্মৃতিগ্রন্থের মধ্যে ‘রায়মুকুট পদ্ধতি’ ও স্মৃতিরত্নহার’ বিশেষ প্রসিদ্ধ। রঘুনন্দন এ দুখানা স্মৃতিগ্রন্থের প্রামাণ্য উদ্ধৃত করে গিয়েছেন। গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন ও বরাবক শাহের অধীনে উচ্চরাজকর্মে তিনি নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে সুলতান তাঁকে ‘রায়মুকুট’ উপাধি দিয়েছিলেন। তাঁর গুরু শ্রীধর মিশ্রের কাছ থেকে তিনি ‘মিশ্র’ উপাধি পেয়েছিলেন।
রঘুনন্দনই মধ্যযুগের সবচেয়ে বড় স্মার্ত পণ্ডিত। তিনি রাঢ়দেশের লোক ছিলেন। নবদ্বীপের হরিহর ভট্টচার্য তাঁর পিতা। নবদ্বীপের তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত শ্রীনাথ তর্কচূড়ামণির নিকট স্মৃতি ও মীমাংসা অধ্যয়ন করেন। এই উভয় শাস্ত্রেই রঘুনন্দনের ছিল অসাধারণ ব্যুৎপত্তি। তিনি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন এবং চৈতন্যদেবের ন্যায় তিনিও হিন্দু সমাজকে সুলতান হুসেন শাহের সময়কার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। তিনিই বিধান দেন যে মুসলমান, কর্তৃক অপহৃতা হিন্দুনারীকে সামান্য প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা পুনরায় হিন্দসমাজের গ্রহণ করা চলবে। তিনি ‘অষ্টবিংশতিতত্ত্ব স্মৃতিগ্রন্থ, ‘প্রয়োগগ্রন্থ’ দায়তত্ত্ব এবং জীমূতবাহনের ‘দায়ভাগ’-এর ওপর টীকা লেখেন। তিনি আরও বিধান দেন যে বাঙালী ব্রাহ্মণরা মসুর ডাল খেতে পারেন। হিন্দু সামাজিক ও ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর বিধানসমূহ এখনও হিন্দুসমাজে গ্রাহ্য।