বাঙলার রাষ্ট্রীয় ইতিহাস

বাঙলার রাষ্ট্রীয় ইতিহাস

অতি প্রাচীন বাঙলার রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের উপাদান হচ্ছে কিংবদন্তী। এই সকল কিংবদন্তী নিবদ্ধ আছে নানা গ্রন্থে-দেশীয় ও বিদেশীয়। শ্রীলঙ্কার ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ’ নামে দুইটি প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্বে বঙ্গদেশের বঙ্গনগরে এক রাজা ছিলেন। তিনি কলিঙ্গদেশের রাজকন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের এক অতি সুশ্রী কন্যা হয়; কিন্তু সে অত্যন্ত দুষ্টা ছিল। সে একবার পালিয়ে গিয়ে মগধ-যাত্রী এক বণিকের দলে ঢুকে যায়। তারা যখন বাঙলার সীমানায় উপস্থিত হয়, তখন এক সিংহ তাদের আক্রমণ করে। বণিকেরা ভয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু রাজকন্যা সিংহকে তুষ্ট করে তাকে বিবাহ করে। (মনে হয়, এখানে আক্ষরিক অর্থে ‘সিংহ’ না ধরে সিংভূম জেলার ‘সিংহ’ উপাধিকারী কোন উপজাতীয়কে ধরে নিলে, এর অর্থ খুব সরল হয়ে যায়)। ওই সিংহের ঔরসে তার গর্ভে সিংহবাহু নমে এক পুত্র এবং এক কন্যা জন্মে। সিংহবাহু বড় হয়ে সিংহকে হত্যা করে ও নিজ ভগ্নীকে বিবাহ করে। (প্রাচীন ভারতে ভগ্নী-বিবাহ সম্বন্ধে লেখকের ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’ ও ‘হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য, গ্রন্থদ্বয় দেখুন)। পরে রাঢ়দেশে সে এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। সিংহবাহুর অনেকগুলি পুত্রসন্তান হয়। প্রথম দুটির নাম বিজয় ও সুমিত্র। বিজয় দুর্বিনীত ও অত্যাচারী ছিল। তার দুর্ব্যবহারে রাঢ়বাসিগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে রাজা সাত শত অনুচরের সঙ্গে বিজয়কে এক নৌকা করে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেন। বিজয় প্রথমে সুপ্পরাক নগরে (আধুনিক ভারতের পশ্চিম উপকূলস্থ সোপারা নগরী) যায়, কিন্তু সেখানে অত্যাচার শুরু করলে সেখানকার লোকেরা তাকে তাড়া করে। তখন বিজয় নৌকাযোগে লঙ্কাদ্বীপে এসে উপস্থিত হয় এবং কুবেণী নামে এক যক্ষিণীকে বিবাহ করে শ্রীলঙ্কায় এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। যে দিন বিজয় লঙ্কাদ্বীপে এসে উপস্থিত হয়, সেদিনই কুশীনগরে ভগবান বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন। বুদ্ধের মহানির্বাণ ঘটেছিল ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সুতরাং সেটাই বিজয়ের শ্রীলঙ্কায় অবতরণের তারিখ।

প্রাক্-বৌদ্ধ যুগের আরও দুটি রাজ্যের কথা আমরা জাতক গ্রন্থসমূহে পাই। এ দুটি হচ্ছে শিবি ও চেতরাষ্ট্র। ডাক্তার অশ্বিনীকুমার চৌধুরী মহাশয় দেখিয়েছেন যে, শিবিরাজ্য ছিল বর্ধমান বিভাগে। তার রাজধানী ছিল জেতুত্তরনগরে (বর্তমানে মঙ্গলকোট)। তখন দামোদর নদের নাম ছিল কন্টিমার নদী। রূপনারায়ণের নাম ছিল কেতুমতী নদী। কেতুমতীর দক্ষিণে অবস্থিত ছিল চেতরাজ্য (বর্তমান ঘাটাল মহকুমার চেতুয়া পরগনা)। তার রাজধানী ছিল চেতা। চেতরাজ্যের পশ্চিমে ছিল বনদ্বার ও পূর্বে ছিল, ‘প্রত্যন্ত’ প্রদেশ দুর্নিভত্ত। এর দক্ষিণে ছিল কলিঙ্গ রাজ্য, বর্তমান মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। শিবি ও চেতরাজ্যের পূর্বসীমায় ছিল ভাগীরথী। বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থ সমূহে শিবি এবং চেতরাষ্ট্রদ্বয়কে ‘মহাজনপদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং এ দুটি রাষ্ট্র যে তৎকালীন ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

আরও যে সকল দেশীয় গ্রন্থে প্রাচীন বাঙলার রাষ্ট্রীয় ইতিহাস সম্পর্কে কিংবদন্তী নিবদ্ধ আছে, তাদের অন্যতম হচ্ছে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি। এই সকল গ্রন্থের রচনাকালে সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। তবে সে সময়েই রচিত হোক না কেন, এগুলির মধ্যে নিবদ্ধ কাহিনীসমূহ যে, এগুলির রচনাকালের বহুপূর্বেই প্রচলিত ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। (এখানে স্মরণীয় যে, মহাভারতের শান্তিপর্বে ‘অত্রাপ্যুদাহরান্তামমিতিহাসং পুরাতনং বাক্যটি আছে)। আমরা অসুর-রাজা বলির কথা আগেই বলেছি। তাঁর ক্ষেত্রজ সন্তানসমূহ থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পৌন্ড্র, সুহ্ম জাতিসমূহ। মহাভারত থেকেই আমরা আরও জানতে পারি বাঙলার তিনজন রাজার কথা। তাঁরা হচ্ছেন পুণ্ডের রাজা বাসুদেব। (ইনি কিরাতদেশেরও রাজা ছিলেন), বঙ্গের রাজা সমুদ্রসেন ও সুহ্মের এক অনামী রাজা।

আলেকজাণ্ডার (৩২৫-৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) গঙ্গারিডি রাজ্যের কথা শুনেছিলেন। তার মানে আলেকজাণ্ডারের সময় পর্যন্ত বাঙলা স্বাধীন ছিল। এর অনতিকাল পরেই বাঙলা তার স্বাধীনতা হারায়। কেননা, মহাস্থানগড়ের এক শিলালিপি থেকে আমরা জানতে পারি যে, উত্তরবাঙলা মৌর্যসাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, কারণ মৌর্যসম্রাট চন্দ্ৰগুপ্ত পুন্ড্রবর্ধন নগরে এক কর্মচারীকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। মনে হয়, এই সময় থেকেই আর্যসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বাঙলাদেশে ঘটেছিল। ‘মনুসংহিতা’ রচনকালে (২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) বাঙলাদেশ আর্যাবর্তের অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হত। কুশাণসম্রাটগণের মুদ্রাও বাঙলার অনেক জায়গায় পাওয়া গিয়েছে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে বাঙলাদেশ গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

শুশুনিয়া পাহাড়ের অভিলেখ থেকে আমরা জানি যে এ সময় পুষ্করণায় (বাঁকুড়া জেলায়) চন্দ্রবর্মা (আনুমানিক ৩৪০-৩৫৯ খ্রিস্টাব্দে) নামে একজন রাজা রাজত্ব করতেন। পরে সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক এই অঞ্চল সাম্রাজভুক্ত হয়। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত বাঙলা গুপ্তরাজগণের অধীন ছিল।

ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্থে বাঙলাদেশ আবার স্বাধীনতা লাভ করে। কোটালিপাড়ার পাঁচখানা ও বর্ধমানের মল্লসারুলে প্রাপ্ত একখানা তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে এই সময় গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও সমাচারদের নামে তিনজন স্বাধীন রাজা ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করেন। গোপচন্দ্র ওড়িশারও এক অংশ অধিকার করেন। তাঁরা শক্তিশালী রাজা ছিলেন। দক্ষিণ পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ তাঁদের অধীন ছিল। এর অনতিকাল পরে বাঙলাদেশের রাজা শশাঙ্ক (৬০৬-৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ) পশ্চিমে কান্যকুব্জ ও দক্ষিণে গঞ্জাম পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হন। তিনি কামরূপ রাজাকে পরাজিত করেছিলেন ও উত্তরপ্রদেশের মৌখরিদের দমন করেছিলেন। কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ) তাঁর রাজধানী ছিল। উয়াং চুয়াং পরিদৃষ্ট রক্তমৃত্তিকা বিহার এখানেই অবস্থিত ছিল।

‘মঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ থেকে আমরা জানতে পারি যে, শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মানব মাত্র আটমাস পাঁচদিন সিংহাসনে আরূঢ় ছিলেন। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে উয়াং চুয়াঙ এদেশে আসেন। তখন তিনি বাঙলা পাঁচটি রাজ্যে বিভক্ত দেখেছিলেন, যথা কজঙ্গল পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি, কর্ণসুবর্ণ, তাম্রলিপ্তি ও সমতট। এ থেকে মনে হয় যে শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাঙলা খণ্ডবিখণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল এবং নানা স্বাধীন নৃপতির অভ্যুত্থান ঘটেছিল। মনে হয় এই সময় গৌড়ে জয়নাগ নামে একজন নৃপতি এবং সমতটে রাজভট (খড়্গাবংশীয়?) নামে আর একজন নৃপতি রাজত্ব করতেন। তবে শ্রীধারণরাতের কইলাণ তাম্রশাসন থেকে আমরা জানতে পারি যে ৬৪০ থেকে ৬৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমতটে জীবধারণ ও তাঁর পুত্র শ্রীধারণ নামে রাতবংশীয় দুজন রাজা রাজত্ব করতেন। ঢাকা অঞ্চলের খড়্গঙ্গবংশীয় রাজারা রাতবংশ উচ্ছেদ করে সমতটে রাজ্যবিস্তার করেন। পাঁচখানা তাম্রশাসন এবং একটি মূর্তিলেখ থেকে খড়্গাবংশের পাঁচজন রাজার নাম আমাদের জানা আছে, যথা খড়্গেঙ্গাদ্যম (৬২৫-৪০) জাতখড়া (৬৪০-৫৮), দেবখড়া (৬৫৮-৭৩), রাজভট্ট, (৬৭৩-৯০) ও বলভট্ট (৬৯০-৭০৫)। তবে তারিখগুলো সবই আনুমানিক।

তারপর বাঙলা বৈদেশিক আক্রমণ দ্বারা বিধ্বস্ত হয়। রঘোলি অভিলেখ থেকে আমরা জানতে পারি যে শৈলবংশীয় রাজা দ্বিতীয় জয়বর্ধনের পিতামহের জ্যেষ্ঠতাত বাঙলা আক্রমণ করে পুন্ড্রবর্ধনের রাজাকে পরাজিত ও নিহত করেন। ৭৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কান্যকুব্জরাজ যশোবর্মণ বাঙলাদেশে অধিকার করেন। তারপর কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য, কামরূপরাজ, হর্ষদেব প্রমুখদের দ্বারা বাঙলা বিধ্বস্ত হয়। এই সকল যুদ্ধবিগ্রহের সময় বাঙলায় ঘোর বিশৃঙ্খলা প্রকাশ পায় ও মাৎস্যন্যায়ের উদ্ভব হয়।

দুই

অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায়ের হাত থেকে বাঙলাদেশকে রক্ষা করেন পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল। অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ গোপালের সময় থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে মদনপালের সময় পর্যন্ত পালবংশই বাঙলার সিংহাসন অধিষ্ঠিত ছিল। একই রাজবংশের ক্রমান্বয়ে চারশ বছর রাজত্ব করা ভারতের ইতিহাসে এক অসাধারণ ঘটনা।

পালরাজবংশের বংশতালিকা এইরূপ—প্রকৃতিপুঞ্জ কর্তৃক নির্বাচিত গোপাল (৭৫০-৭৭০)। ধর্ম পাল (৭৭০-৮০৭)। দেবপাল (৮০৭- ৮৪২)। মহেন্দ্রপাল (৮৪২-৮৫০)। প্রথম শূরপাল (৮৫১-৮৬২)। প্রথম বিগ্রহপাল (৮৬২-৮৬৩)। নারায়ণ

নারায়ণ পাল (৮৬৩-৯১৭)। রাজ্যপাল (৯১৭-৯৫২)। দ্বিতীয় গোপাল (৯৫২-৯৭২)। দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৭২-৯৭৭)।

দ্বিতীয় পাল সাম্রাজ্য : প্রথম মহীপাল (৯৭৭-১০২৭)। নয়পাল (১০২৭-৪৩)। তৃতীয় বিগ্রহপল (১০৪৩-৭০)। দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭০- ৭১), কৈবর্তরাজ দিব্যোক ও রুদ্রক কর্তৃক অধিকারচ্যুত। দ্বিতীয় শূরপাল (১০৭১-১০৭২)।

তৃতীয় পালসাম্রাজ্য : রামপাল (১০৭২-১১২৬)। কুমারপাল (১১২৬- ২৮)। তৃতীয় গোপাল (১১২৮-৪৩) মদনপাল (১১৪৩-১১৬১)। সেনবংশীয় বিজয়সেন কর্তৃক বাঙলা অধিকৃত। গোবিন্দপাল (১১৬১-৬৫)। পলপাল (১১৬৫-১২০০)।

বরেন্দ্রভূমের কোন একস্থানে সিংহাসনের আরোহণ করে পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল অচিরে দেশমধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি মগধ পর্যন্ত নিজ রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। তাঁর পুত্র ধর্মপাল নিজ রাজ্য বিস্তার করেছিলেন দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত। ধর্মপালের পুত্র দেবপাল দিগবিজয়ে বেরিয়ে গান্ধার পর্যন্ত সমস্ত উত্তর ভারত জয় করেছিলেন। বস্তুত পালরাজগণের রাজত্বকালই বাঙলার ইতিহাসের গৌরবময় যুগ। সামরিক অভিযানে পালরাজগণকে বিশেষভাবে সাহায্য করতেন তাঁদের বিজ্ঞ মন্ত্রীরা তাঁদের কৌশলী মন্ত্রণা দিয়ে।

পালরাজগণ নিজেরা বৌদ্ধ হলেও, ব্রাহ্মণ্যধর্মের পোষকতা করতেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রথম শূরপাল (৮৫১-৬২) তাঁর মাতা শিবভক্তা মাহটাদেবীর অনুরোধে বারাণসীর সন্নিকটে চারখানা গ্রামে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা এবং ওই কার্যের ভারপ্রাপ্ত পাশুপত আচার্যপর্ষদের সকল প্রকার ব্যয় নির্বাহার্থ দান করেছিলেন।

আমরা পালযুগের রাজমহিষীদের কথা কিছু বলি। গোপালের মহিষী ছিলেন দেদ্দদেবী। ধর্মপালের মহিষী ছিলেন রাষ্ট্রকুটরাজ পরবলের কন্যা রন্নাদেবী ও দেবপালের মহিষী দুর্লভরাজতনয়া মাহটাদেবী। বিগ্রহপালের মহিষী ছিলেন হৈহয় বা কলচুরি বংশীয় রাজকন্যা লজ্জাদেবী। রাজ্যপালের মহিষী ছিলেন রাষ্ট্রকূটরাজ তুঙ্গের মেয়ে ভাগ্যদেবী। তৃতীয় বিগ্রহপালের দুই মহিষী ছিলেন— একজন কলচুরিরাজ কর্ণের মেয়ে যৌবনশ্রী ও অপরজন রাষ্ট্রকূটবংশীয়া এক রাজকন্যা। রামপালের মহিষী ছিলেন মদনদেবী এ থেকে প্রকাশ পায় যে পালরাজগণ অবাঙালী মেয়েদের বিবাহ করতেন। একটা প্রশ্ন যা স্বাভাবিকভাবে এখানে মনে জাগে, তা হচ্ছে এইসব অবাঙালী মেয়েরা বাঙলাদেশে এসে কিভাবে বাংলাভাষা শিখে তাঁদের স্বামীদের সঙ্গে ঘর করতেন। মনে হয় এসব রাজকন্যার বিদুষী হতেন এবং সংস্কৃত ভাষা ভালোরূপেই জানতেন। সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমেই তাঁরা বাংলাভাষা লিখা নিতেন। অবশ্য, বাংলাভাষা তখন বিবর্তিত হয়ে সংস্কৃত ভাষা ভিত্তিকই ছিল। এখনকার মতো তখন বাংলাভাষায় আরবী, ফারসী, পর্তুগীজ, ইংরেজ প্রভৃতি ভাষায় শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। তবে বাংলাভাষায় তখন বহু দেশজ শব্দ ছিল। বিশেষ করে মাগধী প্রাকৃত। রাজারাজড়ারা যখন অবাঙালী মেয়ে বিয়ে করতেন, সাধারণ লোক যে বিয়ে করত না, একথা নিশ্চিতরূপে বলা কঠিন। বাঙলার সামাজিক ইতিহাসের এদিকটা আমরা কোনদিন ভেবে দেখিনি।

উত্তরভারতে সাম্রাজ্যিক অভিযান চালাবার জন্য পালরাজগণ কান্যকুব্জ ও ভীলমলের গুর্জর-প্রতিহার বংশীয় রাজগণের চিরশত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারা পালদের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মান্যখেতের রাষ্ট্রকূট-বংশীয় রাজারা পালদের সহায় ছিল বলে, গুর্জর-প্রতিহাররা পালদের বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু কোন কারণে রাষ্ট্রকূটগণের সহিত পালদের বিবাদ ঘটায় পালরা যখন সহায়হীন হয়ে পড়ে, তখন গুজর প্রতিহার রাজা প্রথম ভোজ মগধ পর্যন্ত অধিকার করে নিয়ে পালসাম্রাজ্যকে খর্ব করে। এই সময় রাষ্ট্রকূটরাও পালসাম্রাজ্য আক্রমণ করে। চন্দেল ও কম্বোজরাও পালদের পরাজিত করে। পালরাজ দ্বিতীয় বিগ্রহপাল পরাজিত হয়ে দক্ষিণ বাঙলার কোন অঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু পালদের রাজশক্তি বহুদিন এভাবে অস্তমিত থাকেনি। দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র মহীপাল শীঘ্রই পিতৃরাজ্য উদ্ধার করে দ্বিতীয় পালসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বহু যুদ্ধবিগ্রহ করে পালরা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পূর্ব বাঙলার বর্মণরা একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে। এদিকে উত্তর বাঙলায় কৈবর্তরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে ও তাদের অধিপতি দিব্যোকের নেতৃত্বে গৌড় অধিকার করে নেয়। দিব্যোক্যের পর তার ভাই রূদ্রক গৌড়াধিপতি হয়। রুদ্রকের পুত্র ভীমের নিকট হতে পালরাজ রামপাল তাঁর পিতৃরাজ্য উদ্ধার করে তৃতীয় পালসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নানাদিকে যুদ্ধ লিপ্ত হয়ে পালরা দুর্বল হতে থাকে। দ্বাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে। পালরাজ মদনপালে রাজত্বকালে সেনবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয়সেন পালদের কাছ থেকে বাঙলা অধিকার করে নেয়। ‘শেখ সুভোদয়া’ গ্রন্থে বিজয়সেনের রাজ্যপ্রাপ্তির কথা লিখিত আছে।

তিন

পালবংশের পতনের পর বাঙলায় সেনবংশ রাজত্ব করে। সেনবংশের বংশতালিকা হচ্ছে—বিজয়সেন (১০৯৪-১১৬০) বল্লালসেন (১১৫৯-১১৭৯); লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৩)। সেনরাজগণ প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। তাঁরা ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় রাজা বল্লালসেন কৌলীন্যপ্রথা প্রবর্তনের কিংবদন্তীর সহিত সংশ্লিষ্ট। ১৯৮২-৮৩ সালে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নদীয়া জেলার ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে বল্লালঢিবি (পূর্বনাম বামনপুকুর দুর্গ) উৎখনন করে এক বিশাল (বাঙলার বৃহত্তম) মন্দির Complex আবিষ্কার করেছে। অনুমান করা হয়েছে যে, এখানে পাল যুগের এক বৌদ্ধ বিহার বা স্তূপের ওপর রাজা বল্লালসেন এক প্রাসাদ ও ওই মন্দির Complex তৈরি করেছিলেন। সেনবংশের তৃতীয় রাজা লক্ষ্মণসেনের আমলেই গৌড় মুসলমানদের হাতে চলে যায়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি অকস্মাৎ নদীয়া আক্রমণ করে গৌড় দখল করে নেয় এবং গৌড় মুসলমান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তবে অধিকারচুত্য হয়েও সেনরাজারা কিছুকাল মধ্য এবং পূর্ববঙ্গে স্বাধিকার রাখতে পেরেছিলেন। এছাড়া, পশ্চিম ও দক্ষিণ বঙ্গের অনেক স্থানে আঞ্চলিক শাসকরা সেনবংশের নামে অথবা স্বাধীনভাবে বেশ কিছুদিন হিন্দুশাসন অব্যাহত রেখেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *