বাঙলা নামের উদ্ভব ও বিবর্তন
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশবিভাগের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালীর আবাসভূমিকে বলা হত ‘বঙ্গদেশ’। ইংরেজিতে বলা হত ‘বেঙ্গল’। ‘বেঙ্গল’ নামটা দিয়েছিল ইংরেজরা। তারা এটা নিয়েছিল পর্তুগীজদের দেওয়া ‘বেঙ্গালা’ শব্দ থেকে। ‘বেঙ্গালা’ শব্দটি মুসলমানদের দেওয়া ‘বঙ্গালহ’ শব্দের রূপান্তর মাত্র। ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ পাঠান সুলতানরাই ‘বঙ্গালহ’ শব্দের ব্যবহার শুরু করে। তবে তার আগেই ত্রয়োদশ শতাব্দীর দুজন বৈদেশিক পর্যটক মার্কো পোলো ও রশিদুদ্দিন তাঁদের ভ্রমণকাহিনীতে ‘বঙ্গাল’ নামটা ব্যবহার করেছিলেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর যখন বাঙলা অধিকার করেন তখন থেকে ‘বঙ্গাল’ শব্দটা আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। প্রাক্-মুসলমান যুগে ‘বঙ্গাল’ বলতে পূর্ববঙ্গের দক্ষিণাংশের এক অঞ্চল-বিশেষকে বোঝাত মাত্র। এটা ‘বঙ্গ’ শব্দের ঠিক সমার্থবোধক ছিল না। কেননা, একই সময়ে আমরা ‘বঙ্গ’ ও ‘বঙ্গাল’— এই দুই ভিন্ন অংশের বিদ্যমানতা লক্ষ্য করি। ‘বঙ্গ’ শব্দ দ্বারা বাঙলার এক ব্যাপক অংশকে বোঝাত, যার অবস্থিতি ছিল ভাগীরথীর পূর্বদিকে। ভাগীরথীর পশ্চিমাংশকে বলা হত রাঢ়দেশ। রাঢ়ের উত্তর-পশ্চিমাংশে ছিল অঙ্গ দেশ ও দক্ষিণে কলিঙ্গ। ‘বঙ্গ’ কোন্ ভাষার শব্দ তা আমরা জানি না। অনেকে মনে করেন যে, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, গঙ্গা প্রভৃতি শব্দ প্রাগার্য তিব্বতীয় উৎস থেকে উদ্ভুত। অনেকে আবার ‘বঙ্গ’ শব্দটি মুণ্ডারী ভাষার শব্দে বলে মনে করেন। এখানে উল্লেখনীয় যে বঙ্গ, বঙ্গাল, ও বঙ্গালী শব্দগুলি চর্যাগীতে আছে।
প্রথমে ‘বঙ্গ’ শব্দটি ছিল এক কৌমগোষ্ঠীর নাম। পরে এটা ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছিল। কৌমগোষ্ঠীর নাম হিসাবে ‘বঙ্গ’ নামটির সঙ্গে বৈদিক যুগের আর্যরাও পরিচিত ছিল। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আমরা বঙ্গের নাম প্রথম পাই। সেখানে বঙ্গবাসীদের ‘বয়াংসি’ বা পক্ষিজাতীয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বোধ হয় পক্ষিবিশেষ তাদের ‘টোটেম’ ছিল। আরও যাদের নাম আমরা বৈদিক সাহিত্যে পাই তারা হচ্ছে ‘পুন্ড্র। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পুন্ড্রদের ‘দস্যু’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মোট কথা, বৈদিক সাহিত্যে আমরা বাঙলাদেশের অধিবাসীদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ লক্ষ্য করি। এমনকি, বৌধায়ন, ধর্মসূত্রের যুগ পর্যন্ত আমরা এ বিদ্বেষ অব্যাহত দেখি। বৌধায়ন ধর্মসূত্র অনুযায়ী পুন্ড্রদের অবস্থিতি ছিল উত্তরবঙ্গে, আর বঙ্গদের মধ্যপূর্ববঙ্গে। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে তাদের আর্যাবর্তের বাইরের লোক বলা হয়েছে। তার মানে, তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি আর্যদের ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে পৃথক ছিল। তবে তাদের দেবতাগণকে কেন্দ্র করে বাঙলাদেশে অনেক তীর্থস্থান ছিল, এবং এই সকল তীর্থস্থান আর্যরাও দর্শন করতে আসত। তার আভাস আমরা বৌধায়ন ধর্মসূত্রে পাই।
দুই
কিন্তু রামায়ণ-মহাভারত রচনার যুগে আমরা বাঙলাদেশের লোকদের প্রতি আর্যদের বিদ্বেষভাব আর লক্ষ্য করি না। মহাভারত রচনার যুগে আমরা বঙ্গ, কর্বট, সুহ্ম প্রভৃতি জনপদের নাম পাই। জৈনদের প্রাচীনতম ধর্মপুস্তক আচারাঙ্গ সূত্রে আমরা ‘লাঢ়’ বা ‘রাঢ়’ দেশের নামেরও উল্লেখ পাই। সেখানে রাঢ়দেশের দুই বিভাগের কথা বলা হয়েছে— বজ্জভূমি (বজ্রভূমি) ও সুব্বভূমি (সুহ্মভূমি)। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থসমূহেও আমরা সুহ্মদের উল্লেখ পাই। তাছাড়া, প্রাক্-বৌদ্ধ যুগেই দুই জনপদের নাম পাই— শিবি ও চেত।
আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন তিনি গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত ‘গঙ্গারিড’ বা ‘গঙ্গারাঢ়’ দেশের লোকদের শৌর্যবীর্যের কথা শুনেই বিপাশা নদীর তীর থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্লিনি, টলেমি ও অন্যান্য গ্রীসদেশীয় লেখকগণও গঙ্গারাঢ় দেশের উল্লেখ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ‘প্রাসাই’ বা প্রাচ্যদেশের কথা শুনতে পাই। প্রাচদেশের কথা পাণিনিও উল্লেখ করে গেছেন। টলেমি বাঙলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গানদীর পাঁচটি শাখার কথাও উল্লেখ করেছেন। এই গঙ্গানদীর ওপর অবস্থিত ‘গঙ্গা’ নামে এক বাণিজ্যকেন্দ্রেরও উল্লেখ পাই। এ নামটা ‘পেরিপ্লাস অভ্ দি ইরিথ্রিয়ান সী নামক গ্রন্থেও উল্লিখিত হয়েছে।
তিন
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পরবর্তীকালে যেটা বাঙালীর আবাসভূমি ‘বঙ্গদেশ’ নামে অভিহিত হত, সেটা প্রাচীনকালে বহু জনগোষ্ঠীর আবাসস্থান হয়ে বহু জনপদে বিভক্ত ছিল। অন্তর্বর্তীকালে এদের অনেক নাম ছিল, যথা— গৌড় বঙ্গ, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ, বঙ্গাল, পুন্ড্র, বরেন্দ্র, রাঢ়, তাম্রলিপ্ত, বারক, কঙ্কগ্রাম, বর্ধমান, কজঙ্গল, দণ্ডভুক্তি, খাড়ি, নাব্য ইত্যাদি। এদের ভৌগোলিক সীমারেখা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ছিল। ভাগীরথীকে সীমারেখা ধরলে তার পশ্চিমে অবস্থিত ছিল, কজঙ্গল, রাঢ়, কঙ্কগ্রাম, কর্বট, সুক্ষ্ম, তাম্রলিপ্ত ও দণ্ডভুক্তি। আর ওর পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত ছিল পুন্ড্র, গৌড় ও বরেন্দ্র; মধ্যভাগে বঙ্গ ও দক্ষিণে হরিকেল, সমতট, বঙ্গাল, খাড়ি ও নাব্য। শেষোক্ত অঞ্চলগুলি পূর্ববাঙলার দক্ষিণাংশের উপকূলবর্তী দেশ ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতেই উত্তরবঙ্গ মৌর্যসাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। এর সপক্ষে যে প্রমাণ আছে তা হচ্ছে উত্তরবঙ্গের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত মৌর্য-যুগের ব্রাহ্মী অক্ষরে লিখিত ও প্রাকৃত ভাষায় রচিত এক লিপি। তবে সমগ্র বাঙলাদেশ যে মৌর্যসাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল, তার সপক্ষে কোন সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। (তুলনীয় নোয়াখালি জেলার শিলুয়ায় প্রাপ্ত ব্ৰাহ্মী অক্ষরে ও প্রাকৃত ভাষায় লিখিত এক মূর্তিলেখ)। সম্ভবত গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়েই সমগ্র বাঙলাদেশ গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, এবং সংস্কৃত ভাষার প্রচলন হয়েছিল। তবে তখনও বাংলাদেশের অংশবিশেষ, যথা— ‘সমতট’ যে প্রত্যন্ত রাজ্যভুক্ত ছিল তার প্রমাণ আমরা আলাহাবাদের স্তম্ভলিপিতে পাই। কিন্তু যদিও গুপ্তসম্রাটগণের আমলে বাঙলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলই একত্রিত হয়েছিল, তথাপি গুপ্তসম্রাট স্কন্দগুপ্তের পর যখন গুপ্তসাম্রাজ্যের ভাঙন ঘটল, তখন বাঙলাদেশের বিভিন্ন অংশে স্বতন্ত্র রাজ্য গড়ে উঠল। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সাতখানা তাম্রশাসন থেকে এই রাজ্যের তিনজন ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিধারী রাজার নাম পাওয়া যায়। তাঁরা হচ্ছেন ধর্মাদিত্য, গোপচন্দ্র ও সমাচারদেব। তাঁদের এলাকাভুক্ত ছিল কৰ্ণ- সুবর্ণ (বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলা)। এটাই তখনকার দিনের বঙ্গরাজ্য ছিল। বোধ হয়, একেই কেন্দ্র করে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে মহারাজ শশাঙ্ক গৌড়সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাঙলাদেশে মাৎস্যকন্যায়-এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। আর অরাজকতার হাত থেকে বাঙলাদেশেকে উদ্ধার করেন খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগে (৭৫০) ‘প্রকৃতিপুঞ্জ’ কর্তৃক মনোনীত পালসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল। নবম ও দশম শতাব্দীর লিপিসমূহ থেকে আমরা জানতে পারি যে, পালযুগের শেষভাগে বঙ্গদেশে উত্তর ও অনুত্তর, এই দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে দক্ষিণ বাঙলায় চন্দ্রদ্বীপ (বাখরগঞ্জ জেলায়) নামেও এক রাজা ছিল। এই রাজ্যের তাম্রশাসন থেকে আমরা লডহচন্দ্র ও গোবিন্দচন্দ্ৰ নাম দুই রাজার নাম পাই।
সেনরাজগণের আমলেও বঙ্গদেশে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, যথা-বিক্রমপুর ভাগ ও নাব্য। একাদশ শতাব্দীর লিপিসমূহেই আমরা প্রথম ‘বঙ্গাল’ দেশের উল্লেখ পাই। এই ‘বঙ্গাল’ শব্দই মুসলমান যুগে বঙ্গদেশকে ‘বঙ্গাল’ নামে অভিহিত করতে সহায়তা করে। মুঘলসাম্রাজ্যের এটা ছিল পূর্বতম সুবা এবং এর বিস্তৃতি ছিল ভাগীরথীর পূর্বপ্রান্ত থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। রাজস্ব আদায়ের জন্য তোডরমল কর্তৃক ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ‘আসল-ই-জাম-তুমার’ নামক তালিকা অনুযায়ী সম্রাট আকবরের সময় বাঙলাদেশ ১৯টি সরকারে বিভক্ত ছিল। তার অন্তর্ভুক্ত ছিল ৬৮৯টি মহাল। বাঙলাদেশ থেকে দিল্লীর মুঘলদরবারে প্রেরিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল, ১,০৬,৯৩,০৬৭ আকবরশাহী টাকা। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় নূতন নূতন অঞ্চল জয়ের পর ওই তালিকা সংশোধিত হয়। তখন বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হয় হিজলি, মেদিনীপুর, জলেশ্বর, কোচবিহারের অংশবিশেষ, পশ্চিম আসাম, ত্রিপুরা, ছোটনাগপুরের অংশবিশেষ ও সুন্দরবন। এই পরিবর্ধিত তালিকায় আমরা বাঙলাদেশকে ৩৪টি সরকারে বিভক্ত দেখতে পাই। তখন এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৩৫০টি মহাল এবং রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১,৩১,১৫,৯০৭ টাকা। পরে কি দাঁড়িয়েছিল সেটা বলবার আগে আমরা গৌড়ের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলে নিতে চাই।
চার
গৌড় নামটিও বেশ প্রাচীন। পণ্ডিতমহল মনে করেন যে, এক সময় বাঙলাদেশে প্রচুর পরিমাণে ইক্ষুর চাষ হত ও তা থেকে গুড় উৎপাদন হত এবং এই গুড় থেকেই ‘গৌড়’ নামে উৎপত্তি। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ আমরা গৌড়দেশের পণ্যের উল্লেখ পাই। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’-এও গৌড় রাজ্যের উল্লেখ আছে। কিন্তু ইতিহাসে গৌড়ের প্রথম অভ্যুত্থান ঘটে গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কিছু পূর্বে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে বরাহমিহির তাঁর ‘বৃহৎসংহিতা’ গ্রন্থে গৌড়কে বাঙলার অংশবিশেষ বলে বর্ণনা করে গেছেন। বাঙলার অপর অংশগুলির তিনি যে নাম করে গেছেন সেগুলি হচ্ছে গৌড়ক, পুণ্ড্র, তাম্রলিপ্তিক, বঙ্গ, সমতট ও বর্ধমান। এই ষষ্ট শতাব্দীতে মৌখরীরাজ ঈশানবর্মার হরাহা শিলালেখে সমুদ্রযাত্রায় পারদর্শী গৌড়গণের সঙ্গে তাঁর বিবাদের কথা আছে। ভবিষ্যপুরাণে গৌড়দেশকে বর্ধমানের উত্তরে ও পদ্মার দক্ষিণে অবস্থিত বলা হয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগে ‘অনর্ঘ-রাঘব’-এর লেখক মুরারি মিশ্র লিখে গেছেন যে, গৌড়ের রাজধানী ছিল চম্পায়। অনেকের মতে মদারণ সরকারের অন্তর্ভুক্ত চম্পানগরী ও চম্পা অভিন্ন। এর অবস্থিতি ছিল দামোদর নদের তীরে বর্ধমানের উত্তর পশ্চিমে।
ইতিহাস যখন গৌড়ের অভ্যুত্থান হয় তখন গৌড়দেশ বলতে পশ্চিম- বাঙলার মালদহ-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলকেই বুঝাত। বস্তুত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্তসাম্রাজ্যের অধঃপতনের সুযোগে মুর্শিদাবাদ জেলায় অন্তৰ্গত (বহরমপুরের নিকট ভাগীরথীতীরস্থ) প্রাচীন কর্ণসুবর্ণ নগরকে কেন্দ্র করে স্বাধীন গৌড়রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে রাজা শশাঙ্ক গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাঙলা ও ওড়িশার কিছু অংশ স্বীয় রাজ্যভুক্ত করে গৌড়ের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তিনি মগধও অধিকার করেছিলেন। এই সময় শশাঙ্ক মালবের উত্তরকালীন গুপ্তরাজগণের সহিত মিত্রতাসূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি মালবরাজ দেবগুপ্তের সহায়তায় মৌখরিরাজ গ্রহবর্মাকে পরাজিত ও নিহত করে কান্যকুব্জ জয় করেন। এর আগে মালবরাজের সহায়তা শশাঙ্ক কামরূপের সুস্থিতবর্মা ও তাঁর পুত্রদের পরাজিত করে কামরূপও অধিকার করেছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই গ্রহবর্মার শ্যালক থানেশ্বরাধিপতি হর্ষবর্ধন কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার সহিত মিত্রতাবদ্ধ হয়ে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে আধিপত্য স্থাপন করেন। তখন কিছুকালের জন্য গৌড়রাজ এদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু হর্ষবর্ধন ও ভাস্করবর্মার মৃত্যুর পর গৌড়রাজ আবার নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর ফলে গৌড়রাজ্যের সংজ্ঞারও পরিবর্তন ঘটে। বিস্তৃত স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের ফলে গৌড় নূতন মর্যাদা লাভ করে। তার ফলে ওই সময় গৌড়ীয় ভাষা ও কাব্যরচনা রীতির প্রসিদ্ধি ভারতের সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়।
অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ পর্যন্ত ‘মগধেশ্বর’ উপাধি বহন করতেন। কান্যকুব্জরাজ যশোবর্মা ‘মগধেশ্বর’ গৌড়রাজকে পরাজিত ও নিহত করেন। এরপর বাঙলায় অরাজকতা দেখা দেয় এবং পরে পালরাজগণের অভ্যুত্থান ঘটে। পালরাজগণকে গৌড়, বঙ্গ ও বঙ্গালদেশের (আবুল ফজলের মতে বঙ্গ + আল = বঙ্গাল) অধীশ্বর বলা হত। দ্বিতীয় পালরাজ ধর্মপাল উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত তাঁর আধিপত্য বিস্তার করেন। লক্ষ্মণসেনকে পরাজিত করে মুসলমানরা যখন বাঙলাদেশ অধিকার করে, তখন তারা নিজেদের ‘গৌড়রাজ’ বলে অভিহিত করত। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘলসম্রাট আকবর বাঙলাদেশ অধিকার করেন এবং সেই সঙ্গেই গৌড়ের রাজনৈতিক সত্তা বিলুপ্ত হয়। তখন থেকেই সমগ্র বাঙলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গাল’ নাম ধারণ করে। বাঙলা তখন মুঘলসাম্রাজ্যের একটি সুবায় পরিণত হয়। পরবর্তী ২০০ বৎসর ‘বাঙলা’ মুঘল সম্রাটগণের অধীনে থাকে।
পাঁচ
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর বাঙলা ইংলণ্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাঙলাদেশ সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীন হয়। মুঘলদের দেওয়া নামের অনুকরণে পর্তুগীজরা বাঙলাদেশকে Bengala নামে অভিহিত করত। ইংরেজদের হাতে যাবার পর এর নাম হয় Bengal। ইংরেজ শাসনাধীনে নানা সময় এর আয়তন ও সীমারেখার পরিবর্তন ঘটে।
১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের ১৭৫৮নং আদেশ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, তখন ইংরেজ সরকারের অধীনস্থ ভারত ১২টি বিভিন্ন শাসন- বিভাগে বিভক্ত ছিল, যথা— (১) বেঙ্গল, (২) বোম্বে, (৩) মাদ্রাজ, (৪) উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ (৫) পঞ্জাব, (৬) আসাম (ইহা ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে বাঙলার অন্তর্ভুক্ত হয়), (৭) মধ্যপ্রদেশ, (৮) ব্রিটিশ ব্রহ্ম (৯) বেরার’, (১০) মহীশূর ও কুর্গ, (১১) রাজপুতানা এবং (১২) মধ্যভারত। সুতরাং ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত বাঙলার আয়তন ছিল পঞ্জাবের পূর্বসীমান্ত থেকে ব্রিটিশ-ব্রহ্মের সীমান্ত পর্যন্ত। তার মানে, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে যুক্তপ্রদেশ, বিহার ও ওড়িশা এবং আসাম বাঙলারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু নানা রকম রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ সরকার বাঙলাদেশকে খর্ব করবার অপচেষ্টায় প্রবৃত্ত হয়েছিল। তাকে ক্রমশ ছোট করে আনা হয়েছিল বঙ্গ, আসাম, বিহার, ওড়িশা ও ছোটনাগপুরে। তারপর আসাম প্রদেশকেও পৃথক করে একজন চী, কমিশনারের শাসনাধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের চীফ্ কমিশনার স্যার এনডু ফ্রেজার প্রস্তাব করেন যে, বাঙলাদেশকে দু’খন্ডে বিভক্ত করা হোক। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রচণ্ড আন্দোলন চলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর তারিখে বাঙলাদেশকে দ্বিখন্ডিত করা হয়। আসাম, ঢাকা-বিভাগ, চট্টগ্রাম- বিভাগ, পার্বত্যত্রিপুরা, দার্জিলিং ও সমগ্র রাজশাহী বিভাগ একত্রিত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে এক নূতন প্রদেশে গঠিত হয়। কিন্তু দেশব্যাপী ক্ষোভ প্রশমিত না হওয়ায় সম্রাট পঞ্চম জর্জ স্বয়ং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর দিল্লী দরবারে ঘোষণার দ্বারা বঙ্গভঙ্গ রহিত করেন। এর ফলে দার্জিলিং, ঢাকা-বিভাগ, চট্টগ্রাম-বিভাগ ও রাজশাহী-বিভাগসমূহকে পুনরায় বাঙলার সহিত যুক্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু বিহার ও ওড়িশার স্বতন্ত্র প্রদেশে পরিণত হয় ও ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতালাভের শর্ত হিসাবে বাঙলাকে আবার দ্বিখন্ডিত করা হয়-পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব-পাকিস্তান। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব- পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করে ‘বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আছে ১৬টি জেলা, যথা—কোচবিচার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, চব্বিশ পরগণা (মার্চ ১৯৮৬ হতে উত্তর ও দক্ষিণ), কলিকাতা, হাওড়া হুগলী, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান ও বীরভূম। আর বাংলাদেশে আছে ২১টি জেলা, যথা— দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা, টাঙ্গাইল, মৈমনসিং, জামালপুর, ঢাকা, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোহর খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালি, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা ও বান্দরবন। বাংলাদেশের বর্তমান আয়তন ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইল। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতালাভের পূর্বে বাঙলার মোট আয়তন ছিল ৭৭,৫২১ বর্গমাইল। স্বাধীনতালাভের পরে পশ্চিমবঙ্গের মোট আয়তন দাঁড়ায় ৩৩,৯২৮ বর্গমাইল। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘বঙ্গ’ নাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।