বাঙলায় নবজাগৃতি
সামাজিক বিকৃতি ও ধর্মীয় কুসংস্কার, জড়তা ও অন্ধমূঢ়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় আবির্ভূত হলেন একজন যুগমানব। তিনি হচ্ছেন রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩)। এতদিন মানুষ শুধু ভয় পেয়ে এসেছিল, দৈবের শাসন ও শাস্ত্রের অমোঘ বিধান নতশিরে মেনে নিয়েছিল। রামমোহনই তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ জানান। তিনিই প্রথম তাঁর দেশবাসীকে যুক্তিতর্ক ও বিচারের ওপর নির্ভর করতে শেখান। মাত্র ষোল বৎসর বয়সেই তিনি হিন্দুদিগের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালীর বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেন। পরে তিনি বেদান্ত চর্চার সূত্রপাত করেন এবং ‘এক ও অদ্বিতীয়’ ব্রহ্মের উপলব্ধির জন্য প্রচার চালান। তবে তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধী ছিলেন না। তিনি মাত্র দেখাতে চেয়েছিলেন যে, ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৌত্তলিকতার সঙ্গে এই ধর্মের প্রাচীন সাধকদের ধর্মাচরণের কোনও যোগ নেই। তিনি জাতিভেদ-প্রথার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ খাদ্য কখনও গ্রহণ করতেন না, বা ব্রাহ্মণেরতর জাতির সঙ্গে বসে আহারও করতেন না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি উপবীত ধারণ করে গিয়েছিলেন।
রামমোহন বিশেষভাবে অনুভব করেছিলেন নারীজাতির দুঃখ ও লাঞ্ছনা। বহুবিবাহ রোধ করবার জন্য তিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন এবং সহমরণ প্রথা তাঁরই চেষ্টায় আইন দ্বারা (৪ ডিসেম্বর ১৮২৯) নিষিদ্ধ হয়েছিল।
রামমোহন গোড়া থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন যে দেশবাসীর কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও মানসিক জড়তা দূর করতে পারে একমাত্র শিক্ষার আলোক। তিনি তাঁর অতি আধুনিক বাস্তববাদী মন দিয়ে বুঝেছিলেন, আধ্যাত্মিক বিষয় থেকে পার্থিব বিষয়ের জ্ঞানের দেশবাসীর মনকে নিয়োজিত করতে না পারলে,আধুনিক যুগের উপযোগীরূপে তাকে গড়ে তোলা যাবে না এবং সেজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানশিক্ষার। আধুনিক বিজ্ঞানের বাহন হল আধুনিক ভাষা—ইংরেজি; সেজন্য ইংরেজি শিক্ষার ওপরই তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
ইংরেজি শিক্ষা সম্বন্ধে রামমোহনের এই স্বপ্ন সফল হয়েছিল রামমোহনের মৃত্যুর দু’বছর পরে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে, যখন ইংরেজ সরকার এ সম্বন্ধে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। এর ফলে এদেশে ইংরেজি শিক্ষা দ্রুত প্রসারলাভ করে। কিন্তু এর জন্য সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার চর্চা অবলুপ্ত হয়নি। বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলাদেশে যে নবজাগৃতির সঞ্চার হয়েছিল, তা এই সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার অনুশীলনের দৌলতেই। ওয়ারেন হেষ্টিংস প্রাচ্যবিদ্যা ও সংস্কৃতির বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। উইলকিনস্ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার যে অনুবাদ করেছিলেন, তাতে সংযোজিত হেষ্টিংস-এর ভূমিকা পাঠে আমরা তা অবগত হই। তাঁরই পদাঙ্কে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারী তারিখে স্যার উইলিয়াম জোনস্ কর্তৃক প্রাচ্যবিদ্যা সম্বন্ধে অনুশীলনের জন্য এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হলে, সেখানে সিভিলিয়ানদের শিক্ষার জন্য শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনের পাদ্রী উইলিয়াম কেরী সংস্কৃত ও বাংলার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে বিলাতের পার্লামেন্ট প্রাচ্যবিদ্যার অনুশীলনের জন্য বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা বায় বরাদ্দ মঞ্জুর করেন। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ সরকারী ব্যয়ে কলকাতায় একটি সংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হয়। সংস্কৃতের সহিত ইংরেজি শিক্ষা প্রদান ছাড়াও, সংস্কৃত কলেজ থেকে কিছু শাস্ত্রগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কিছুকাল পরে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে এ কাজটা এশিয়াটিক সোসাইটির ওপর ন্যস্ত করা হয়। প্রাচীন পুঁথি অবলম্বনে সোসাইটি কর্তৃক হিন্দু শাস্ত্রসমূহ ‘বিবলিওথিকা ইণ্ডিকা’ গ্রন্থমালা নামে প্রকাশিত হতে থাকে। এর বাইরেও বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ অনুবাদে প্রয়াসী হন। যাঁরা এই কাজে প্রয়াসী হয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায় ছিলেন তাঁদের অগ্রণী। তাঁর অনূদিত শাস্ত্রসমূহ প্রকাশের পর বাঙলায় বেদচর্চা বিশেষভাবে শুরু হয়। তিনি পাঁচখানি উপনিষদেরও বঙ্গানুবাদ করেন। রাজা রামমোহন রায়ের পর যাঁরা নাম বিশেষভাবে উল্লেখনীয় তিনি হচ্ছেন রাজা রাধাকান্ত দেব। তিনি চল্লিশ বৎসর ব্যাপী অমানুষিক পরিশ্রম করে ‘শব্দকল্পদ্রুম’ নামে এক বিরাট সংস্কৃত অভিধান প্রকাশ করেন। মাত্র বিশ বৎসর বয়সে কালীপ্রসন্ন সিংহ ব্যাসকৃত মহাভারত অনুবাদ করিয়ে বিনামূল্যে বিতরণ করেন। রমেশচন্দ্ৰ দত্ত ঋগ্বেদের বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন ও হিন্দু শাস্ত্র সম্বন্ধে নানা অনুশীলনমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক স্থাপিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ মারফতও ও সংস্কৃতচর্চা বিশেষ পুষ্টিলাভ করে। যোগেশচন্দ্ৰ বাগল মহাশয় বলেছেন, ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার ‘দত্ত, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ, রাজেন্দ্রলাল মিত্র প্রমুখ সংস্কৃতজ্ঞদের রচনা বাংলা গদ্যের পুষ্টিসাধনে এবং সৌষ্ঠববর্ধনে কতখানি সহায় হইয়াছিল, বলিয়া শেষ করা যায় না।’
ঊনবিংশ শতাব্দীর এই নবজাগৃতিকে সার্থক করে তুলেছিল মুদ্রাযন্ত্র। বাঙলাদেশে মুদ্রাযন্ত্র প্রথম স্থাপিত হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষপাদে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর অবাধ বাণিজ্য-নীতি অনুসৃত হবার ফলে বিলাত থেকে বহু সাহেব এদেশে এসে মুদ্রাযন্ত্র ও কাগজ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। বহু ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার ফলে অসংখ্য গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে লোকের অজ্ঞানতা দূর করার কাজে সহায়ক হয়ে ওঠে। তা ছাড়া, এসব সংস্থা নানাশ্রেণীর লোকের কর্মসংস্থানের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়।
দুই
ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগৃতিক এক ধারা যেমন প্রবাহিত হয়েছিল শিক্ষার প্রসারসাধনের দিকে, অপর ধারা তেমনই প্রবাহিত হয়েছিল সামাজিক সংস্কার ও উন্নতিসাধনের দিকে। রামমোহন ও বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে অগ্রণী ছিলেন। উভয়েই উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমাজকে অপপ্রথা ও কুসংস্কারের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে হলে যে প্রয়াস চালাতে হবে, তার বিপক্ষে আসবে তথাকথিত রক্ষণশীল নিষ্ঠাবান গোষ্ঠীর তরফ থেকে ভীষণ বিরোধিতা। উভয়েই সেজন্য ভেবে নিয়েছিলেন যে সে বিরোধিতাকে দমন করতে পারবে একমাত্র সরকারী হস্তক্ষেপ। তাই তাঁরা উভয়েই সতীদাহ প্রথা বিলোপসাধনের জন্য ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য সরকারী সহায়তার মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন। সরকারী আইন দ্বারাই সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হয়েছিল এবং বিধবা বিবাহ আইনসিদ্ধ (জুলাই ১৮৫৬) বলে স্বীকৃত হয়েছিল। যদিও কৌলীন্য-কলুষিত বহুবিবাহ নিরোধ সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের চেষ্টা কার্যকর হয়নি, তবুও বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের ফলে বহুবিবাহ ক্রমাগত হ্রাস পেতে লাগল।
যদিও সামাজিক অপপ্রথাসমূহ নিয়ন্ত্রণ বা বিলোপসাধনের জন্য সরকারের অনুকূল মনোভাব ছিল, তবুও হিন্দুসমাজের তরফ থেকে তার বিপক্ষে যে বিরোধিতা আসবে, তা স্মরণ করে গোড়ার দিকে সরকার সংস্কারমূলক কোনও কাজে হস্তক্ষেপ করতে সাহস পায়নি। কিন্তু রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের আন্দোলনের পর সরকার সে সাহস পায় শীঘ্রই তারা বাল্যবিবাহ দমন করবার জন্য ‘সঙ্গমের’ ন্যূনতম বয়স-নির্দেশক এক আইন প্রণয়ন করেন (১৮৯১)। এ ছাড়া, তাঁরা আইন প্রণয়ন দ্বারা সাগর মেলায় “শিশুবলি দেওয়া’ প্রথারও বিলোপসাধন করেন (১৮৩০); তারপর ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা চড়ক-উৎসবে পিঠে লোহার কাঁটা বিঁধিয়ে চড়ক গাছে ঘোরানোও বন্ধ করে দেন।
বলা বাহুল্য যে, এ সকল সামাজিক সংস্কার ও উন্নতিসাধনের পথ সুগম করে দিয়েছিল শিক্ষার প্রসার। শিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। আগে সংস্কৃত কলেজে শিক্ষালাভের অধিকার ছিল মাত্র ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের। কিন্তু ১৮৫১ থেকে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন সকল জাতির কাছে। ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি ২০টি মডেল স্কুল স্থাপন করেন। স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এ সময় স্ত্রীশিক্ষা প্রসারে উত্তরপাড়া হিতকরী সভার অবদানও উল্লেখনীয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবার পর, এদেশে জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার আরও দ্রুতগতিতে অগ্রসর হতে থাকে। পাশ্চাত্ত্যবিদ্যার প্রসার জনসাধারণকে উদার মনোভাবাপন্ন করে তোলে ও তাদের দীক্ষিত করে গণতান্ত্রিক মন্ত্রে। এর ফসল সমাজের ওপর বৈপ্লবিক প্রভাব বিস্তার করে। সামাজিক রীতিনীতি সম্বন্ধে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ-সমাজের ‘পাঁতি’ দেওয়ার অধিকার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। পাঁতি দেওয়া বিধানসভার একচেটিয়া অধিকারে দাঁড়ায়। বিধানসভা গঠিত হতে থাকে জাতি নির্বিশেষে নির্বাচিত সদস্য নিয়ে। তাঁরাই এখন থেকে সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতি সম্বন্ধে আইন প্রণয়ন করে পাঁতি দিতে থাকেন। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণসমাজকে তা মাথা পেতে স্বীকার করে নিতে হয়।
শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সৃষ্ট হল এক নতুন সাহিত্য। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রবর্তন করলেন বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ। দীনবন্ধু, গিরিশচন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রলাল রচনা করলেন অনন্যসাধারণ নাটকসমূহ। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র রচনা করলেন নতুন থেকে নতুনতর সাহিত্য। তাঁদের রচনাবলী বাঙালীর চিন্তাধারাকে প্রবাহিত করল নতুন পথে। বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠে’র ‘বন্দেমাতরম্’ই বিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক অভিযানের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। এই মন্ত্র বাঙালীর রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে সচেতন করে তুলল। এই পথের পথিক হিসাবে এগিয়ে এলেন অনেকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, শিশিরকুমার ঘোষ, মতিলাল ঘোষ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁদের প্রচেষ্টা দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেল স্বাধীনতার পথে—সে স্বাধীনতা দেশ লাভ করল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে, যদিও বাঙলাকে দ্বিখণ্ডিত করে।
সাহিত্যসাধনার সঙ্গে সঙ্গে চলেছিল বিজ্ঞানের অনুশীলন। এর সুচনা করেছিলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি এক বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে তার নাম দিলেন ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অভ্ সায়েন্স’। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে নানাজন এখানে গবেষণা চালিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন কল্যাণের পথে।
এদিকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এদেশে স্থাপিত হতে লাগল কলকারখানা। কয়লার ব্যাপক ব্যবহার এই প্রক্রিয়াকে বিশেষভাবে সহায়তা করল। সঙ্গে সঙ্গে রেলপথ, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করল, দেশের এক প্রান্তের সঙ্গে অপর প্রান্তের। পরে তড়িৎ-শক্তির ব্যবহার শিল্পোদ্যমকে আরও অগ্রগতির পথে নিয়ে গেল। গ্রামের নিঃস্ব ও বেকার লোক ছুটে এল শহরের দিকে কাজের সন্ধানে। কলকাতা শহর এক বিরাট কর্মকেন্দ্র হয়ে দাঁড়াল।
তিন
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সিভিলিয়ান কর্মচারীদের শিক্ষার জন্য কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কলেজে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হতে সংস্কৃত, বাংলা, আরবী, ফারসী প্রভৃতি প্রাচ্যবিদ্যার পারঙ্গম পণ্ডিতগণের সমাবেশ হয়। কিন্তু এদেশীয়দের শিক্ষার জন্য কোম্পানির তরফ থেকে বিশেষ কিছু করা হয়নি। এ বিষয়ে কোম্পানির সচেষ্ট হন যখন ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদে এদেশের লোকদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। তারই প্রথম ফসল ‘কাউনসিল অভ এডুকেশন (১৮২৪)। দ্বিতীয় ফসল ওই সালেই সংস্কৃত কলেজ স্থাপন। সংস্কৃত কলেজে প্রথমে সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমেই সাহিত্যের পঠন-পাঠন আরম্ভ হয়। ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যসন্তান ছাড়া আর সকলের কাছে কলেজের দ্বার রুদ্ধ ছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চেষ্টাতেই সংস্কৃত কলেজের দ্বার সকল জাতির কাছে উন্মুক্ত হয়। তিনি সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি শিক্ষারও প্রবর্তন করেন। শিক্ষার প্রসারে কোম্পানির তৃতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা। মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় অসাধারণ সৎসাহস দেখিয়েছিলেন মধুসূদন গুপ্ত। মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হবার পর সেখানে শিক্ষার্থীদের অ্যানাটমি শিক্ষার জন্য শব-ব্যবচ্ছেদ করবার প্রয়োজন হয়। মৃত ব্যক্তিকে ছুঁলে হিন্দুসমাজে তাকে পতিত বা একঘরে করবার ভয় দেখানো হয়। সেই মুহূর্তে মধুসূদনই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সমাজের শাসন-ভয় অগ্রাহ্য করে একাজে অগ্রণী হন, এবং শব-ব্যবচ্ছেদ করে অসীম সাহসের পরিচয় দেন। ষাটের দশকের গোড়ায় দু’জন –ভোলানাথ বসু (১৮২৫-৮২) ও মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৬-১৯০৯) চিকিৎসা শাস্ত্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রী এম. ডি. পান।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে ডেভিড হেয়ারের (১৭৪৫-১৮৪২) চেষ্টাতেই এদেশে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। স্কটল্যান্ডবাসী এই ভারতপ্রেমিক পুরুষ এদেশে এসে আঠারো বৎসর ঘড়ির কারবার করে বেশ ধনশালী হয়েছিলেন। তারপর এদেশে শিক্ষার প্রসারে আত্মনিয়োগ করবার জন্য তিনি ঘড়ির কারবার তাঁর সহকারী গ্রে সাহেবকে দান করে দিয়ে, অর্জিত সমস্ত ধনই ব্যয় করেছিলেন ছাত্রদের মঙ্গলার্থে। স্কুল সোসাইটির উদ্যোগে যেসব ইংরেজি ও বাংলা স্কুল স্থাপিত হয়েছিল, সেগুলির উপর তাঁর নজর ছিল। আরপুলির ফ্রি ভারনাকুলার স্কুল, পটলডাঙার ইংলিশ স্কুল ও হিন্দু কলেজের ছাত্রদের স্কুলে নিয়মিত হাজিরায় উৎসাহ দেবার জন্য তিনি নানা ধরনের পুরস্কার দিতেন। হিন্দু কলেজের মেধাবী ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের লেখাপড়ার কতদূর কি উন্নতি হচ্ছে তার খোঁজখবর রাখতেন ও তাদের অসুখ-বিসুখের সময় নিজে সেবা শুশ্রূষা করতেন ও তাদের চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করতেন। এরকম এক ছাত্রের সেবা করতে গিয়েই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু ঘটে 1
হেয়ার মনেপ্রাণে ভারতকেই তাঁর স্বদেশ বলে ভাবতেন ও এদেশ শিক্ষা বিস্তারের জন্য অকৃপণভাবে নিজ সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে গিয়েছেন। স্কুল সোসাইটির অছিদের (ব্যারেটো অ্যাণ্ড কোম্পানি ও ম্যাকিনটশ অ্যাণ্ড কোম্পানির) বিপর্যয়ের পর দুটি স্কুল ছাড়া সোসাইটির অন্যান্য স্কুল যখন উঠে যায়, তখন তিনি নিজ অর্থেই স্কুল দুটিকে (পটলডাঙার ইংরেজি স্কুল ও আর-পুলির বাংলা স্কুল) চালান। এ দুটি স্কুল থেকেই বর্তমান হেয়ার স্কুলের উদ্ভব হয়।
চার
বেসরকারী উদ্যোগে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হবার অনেক পূর্ব থেকেই খ্রিস্টান মিশনারীরা এদেশে ইংরেজি ও পাশ্চাত্ত্য শিক্ষা দেবার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। পলাশীর যুদ্ধের ২৬ বছর পূর্বেই ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে সেণ্ট অ্যানড্রুজ প্রেসবিটেরিয়ান চার্চ একটি অবৈতনিক স্কুল স্থাপন করেছিল। এরকম আরও দু’ একটা স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনারী উইলিয়ম কেরী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। শীঘ্রই তাঁরা হুগলী, দিনাজপুরও যশোহর জেলায় আরও কয়েকটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এ সকল বিদ্যালয়ে তাঁরা আধুনিক প্রণালীতে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দান করতেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ভবানীপুরে জগমোহন বসু ও ধর্মতলায় ড্রামণ্ড নামে এক সাহেব আরও একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেছিলেন। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে ম্যাজিস্ট্রেট ফরবস্ সাহেব চুঁচুড়ায় একটি স্কুল স্থাপন করেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শ্রীরামপুরের মিশনারীদের চেষ্টায় শতাধিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল এবং সেগুলির ছাত্রসংখ্যা ছিল প্রায় ৬৭০০। লণ্ডন মিশনারী সোসাইটিও চুঁচুড়ায় এবং অন্যত্র ১৫টি স্কুল স্থাপন করেছিল। তাদের পাদরি রবার্ট মে সাহেবের উদ্যোগেই এ সকল স্কুল স্থাপিত হয়েছিল, এবং ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যাবার পূর্বে মোট ৩৬টি স্কুল স্থাপন করেছিলেন।
১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে চার্চ মিশনারী সোসাইটি ভূকৈলাসের জমিদার কালীশঙ্কর ঘোষাল প্রদত্ত একখণ্ড জমিতে একটি স্কুল স্থাপন করে। চার্চ মিশনারী সোসাইটির অর্থানুকূল্যে ক্যাপটেন স্টুয়ার্ট নামে এক ব্যক্তি বর্ধমানেও কয়েকটি স্কুল স্থাপন করেন। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে এই সকল স্কুলের সংখ্যা ছিল ১৬ এবং ছাত্রসংখ্যা ছিল ১২০০। সোসাইটি ফর প্রোমোটিং খ্রিস্টীয়ান নলেজও ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা ও তার সন্নিকটে কয়েকটি স্কুল স্থাপন করে। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে এই সব স্কুলের সংখ্যা ছিল ১২।
সুতরাং এদেশে শিক্ষার প্রসারে খ্রিস্টান মিশনারীদের অবদানও খুব কম ছিল না। এ ছাড়া, জেনারেল ক্লড মাটিন নামে কোম্পানীর এক কর্মচারী বিনামূল্যে ‘বিদ্যার্থীদের পাঠার্থে’ এক বিদ্যায়তন স্থাপনের জন্য তেত্রিশ লক্ষ টাকা উইল করে রেখে যান। ওই টাকা থেকে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে চৌরঙ্গীতে “লা- মার্টিনিয়ের কলেজ’ নামে এক শিক্ষায়তন স্থাপনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় ও তার চার-পাঁচ বছরের মধ্যে তা স্থাপন করা হয়।
মিশনারী এবং অন্যদের এসব চেষ্টা পূর্বেই কলকাতার বাঙালীদের মধ্যে নিজ চেষ্টায় ইংরেজি শেখবার একটি আগ্রহ দেখা দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট স্থাপনের (১৭৭৪) পর থেকেই এটা প্রকাশ পেয়েছিল। এ সময় আমরা সুপ্রিম কোর্টের আইনবিদ রামনারায়ণ মিশ্র ও আনন্দরামের নাম শুনি। প্রসন্নকুমার ঠাকুরও (১৮০১-১৮৬৮) নিজ অধ্যবসায়ে ইংরেজি শিখে একজন প্রখ্যাত আইনবিদ হয়েছিলেন ও বহু পয়সা উপার্জন করেছিলেন। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্টের কেরানীদের তো ইংরেজি শিখতেই হত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে শেরিফের অফিসের হেড ক্লার্ক রামমোহন মজুমদারের নাম হিকির ‘স্মৃতিকথা’র মধ্যে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। এ ছাড়া, এটর্নীদের ক্লার্কদেরও ইংরেজি জানতে হত। এরকম কেরানীদের মধ্যে আমরা অ্যাটর্নী হিকির হেড কেরানী রামধন ঘোষের নাম শুনি। সে যুগে যাঁরা বেনিয়ানি ও দাওয়ানি করতেন তাঁদেরও ইংরেজি জানতে হত। রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ও দ্বারকানাথ ঠাকুরও (১৭৯৪-১৮৪৬) স্কুলে না পড়ে ভালো ইংরেজি জানতেন।
পাঁচ
১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর জন্য ওই বছরেই ‘কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপিত হয়। পরের বছর কলিকাতা স্কুল সোসাইটি’ নামে আর একটি সংস্থা গঠিত হয়। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল দেশবাসীর জ্ঞান বিস্তারের সহায়তা করবার জন্য কলকাতায় যেসব বিদ্যলয় আছে, সেগুলিকে সাহায্য করা ও নতুন বিদ্যালয় স্থাপন করা। কিন্তু এর অছিরা দেউলিয়া হওয়ায় এদের স্থাপিত বিদ্যালয়গুলির মধ্যে দুটি ছাড়া সবগুলিই কয়েক বছর পর উঠে যায়। ডেভিড হেয়ার স্কুল সোসাইটির ইউরোপীয়ান সেক্রেটারী ছিলেন এবং তিনিই নিজ অর্থে এই স্কুল দুটিকে চালাতেন। এ সময় রামমোহন রায়ও নিজ ব্যয়ে একটি স্কুল স্থাপন করেন। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে গৌরমোহন আঢ্য নিজে উচ্চশিক্ষিত না হলেও সরকারী সাহায্য ছাড়াই ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারী’ স্কুলটি স্থাপন করেন। ইতিমধ্যে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আলেকজাণ্ডার ডাফও (১৮০৯-১৮৭৮) কলকাতায় এসে গিয়েছেন। তিনিও কলকাতা এবং অন্যত্র কয়েকটি স্কুল ও একটি কলেজ স্থাপন করেন। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজেও নিম্নশ্রেণীর ছাত্রদের জন্য একটি পাঠশালা বিভাগ খোলা হয়। ইতিমধ্যে বিনা বেতনে ইংরেজি শিক্ষা দেবার জন্য একটি ‘হিন্দু ফ্রি স্কুল’ও স্থাপিত হয়ে গিয়েছিল। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল শীল ‘শীলস্ ফ্রি কলেজ’ স্থাপন করেন। এ ছাড়া, ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে ‘হিন্দু চ্যারিটেবল ইনষ্টিটিউশন’ ও ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে “হিন্দু, মেট্রোপিলিটান কলেজ’ স্থাপনেও মতিলাল সহযোগিতা ও অর্থসাহায্য করেন। তাঁর সবচেয়ে বড় দান এবং যার জন্য সহরবাসী তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ, তা হচ্ছে মেডিকেল কলেজ নির্মাণের জন্য ভূমি দান।
ছয়
আমরা আবার হিন্দু কলেজেই ফিরে আসছি। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে তারিখে হিন্দু কলেজ ও সংস্কৃত কলেজ পটলডাঙায় গোলদিঘির উত্তরে নবনির্মিত নিজস্ব ভবনে প্রবিষ্ট হয়। ওই সালেই হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) নামে এক বিশিষ্ট অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান শিক্ষক হিন্দু কলেজে যোগদান করেন ও তৎকালীন ছাত্রদের মনে এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটান। তিনি ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাস পড়াতেন। ছাত্রদের কাছে তিনি অতি প্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কলেজে পড়বার সময় ও কলেজের বাইরে তিনি পাশ্চাত্ত্য মনীষীদের চিন্তাধারা ব্যাখ্যা ও প্রচার দ্বারা ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের ও যুক্তির ভিত্তি পাকা করে দেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে আটজন—কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮১৩-৮৫), রসিককৃষ্ণ মল্লিক (১৮১৩-৫৮), রামগোপাল ঘোষ (১৮১৫-৬৮), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩-৯৮), রাধানাথ শিকদার (১৮১৩-৭০), প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮৮৩-৮৪), শিবচন্দ্র দেব (১৮১১-৯৩) ও দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় (১৮১৪-৭৮) পরবর্তীকালে বাঙলা তথা ভারতের প্রগতিমূলক আন্দোলনের পুরোধা হয়ে দাঁড়ান। তাঁরাই ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে খ্যাত। এঁরাই ভারতের নবজাগৃতির প্রদীপ প্রজ্বলিত করেন।
সাত
এদিকে স্ত্রীশিক্ষার জন্যও যথেষ্ট চেষ্টা চলছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই খ্রিস্টান মিশনারীদের উদ্যোগে কলকাতায় মেয়ে স্কুল স্থাপিত হয়েছিল। তবে সেসব স্কুলে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা যেত না। তার মানে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরাই স্কুলে পড়তে যেত। তবে তা থেকে বুঝায় না যে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা অশিক্ষিতা থাকত। তারাও রীতিমত শিক্ষিতা হত। এক শ্রেণীর বৈষ্ণবী শিক্ষিকা ছিল, যাদের সাহায্যে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা লেখাপড়া শিখত। এরকমভাবেই রাজা সুখময় রায়ের (?-১৮১১) ছেলে রাজা শিবচন্দ্র রায়ের মেয়ে হরসুন্দরী সংস্কৃত, বাংলা ও হিন্দি এই তিন ভাষায় এমন সুশিক্ষিতা হয়েছিলেন যে পণ্ডিতেরাও তাঁকে ভয় করতেন। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও বৈষ্ণবী শিক্ষিকাদের কাছে লেখাপড়া শিখত।
হিন্দু মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়া বিস্তারের জন্য কলকাতায় কয়েকটি খ্রিস্টান মহিলা সমিতির উদ্ভব হয়েছিল। তাদের মধ্যে একটা হচ্ছে “দি ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি ফর দি এস্টাবলিশমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট অভ্, বেঙ্গলী ফিমেল স্কুলস্’। নন্দবাগান অঞ্চলে (গৌরীবেড়ের নিকট) এরা প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে। পরে এরা গৌরীবেড়ে, জানবাজার, চিৎপুর, শ্যামবাজার, বরাহনগর প্রভৃতি অঞ্চলেও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে। এদিকে স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝাবার জন্য ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ‘স্ত্রীশিক্ষা বিধায়ক’ নামে একখানি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ সুখময় রায়ের ছেলে রাজা বৈদ্যনাথ রায় কুড়ি হাজার টাকা ব্যয়ে, হেদুয়ার পূর্বদিকে সেন্ট্রাল স্কুল নামে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (১৮০৮-১৮৮১) উত্তপাড়ায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সরকারী অনুমোদন পাননি। (লেখকের ‘প্রসঙ্গ পঞ্চবিংশতি দ্রঃ)। তবে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন (১৮০১-১৮৫১) কর্তৃক কলকাতায় মেয়ে স্কুল স্থাপনের পূর্বে সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েরা কেউই স্কুলে পড়তে যেত না।
আট
বেথুন সাহেব ছিলেন বড়লাটের শাসন পরিষদের আইন সদস্য ও কাউনসিল অভ্ এডুকেশনের সভাপতি। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে আসেন। কাউনসিল অভ্ এডুকেশনের সদস্য রামগোপাল ঘোষের (১৮১৫-৬৮) সঙ্গে পরিচিত হবার পর, তিনি তাঁর কাছে এদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের জন্য স্কুল খোলার পরিকল্পনা ব্যক্ত করেন। রামগোপাল উৎসাহিত হয়ে বন্ধু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের (১৮১৪-১৮৭৮) (তিনি ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার সূর্যকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র) কাছে এই পরিকল্পনার কথা বলেন। দক্ষিণারঞ্জন প্রথম তাঁর সিমলা স্ট্রিটের বৈঠকখানা বাড়িটা বিনা ভাড়ায় স্কুলের জন্য ছেড়ে দেন। এই সঙ্গে তাঁর পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারটিও দান করেন। দক্ষিণারঞ্জন স্কুলের জন্য স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য আধ বিঘা জমি ও এক হাজার টাকা দেন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে তারিখে বিদ্যালয়টি ‘নেটিভ ফিমেল স্কুল’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর তারিখে হেদুয়ার পশ্চিম দিকের ভূমিতে বর্তমান স্কুল বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে বেথুন সাহেবের আকস্মিক মৃত্যুর পর এর নাম করা হয় ‘বেথুন স্কুল’। ১৮৫০ থেকে ১৮৬৯ পর্যন্ত বিদ্যাসাগর মহাশয় এই স্কুলের সম্পাদক ছিলেন। বিদ্যালয়ের আর একজন শুভানুধ্যায়ী ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বেথুন নিজ অর্থব্যয় ছাড়া, তাঁর যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি এই স্কুলের জন্য দান করেন। কিন্তু স্কুলভবন তৈরি হবার আগেই আকস্মিকভাবে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে স্কুলের ব্যয়ভার সরকার বহন করছেন। বেথুন স্কুলের মেয়েদের গোড়া থেকেই গাড়ি করে বাড়ি থেকে আনা হত ও পৌঁছে দেওয়া হত।
এরপর আরও মেয়ে স্কুল স্থাপিত হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যখন স্থাপিত হয়, তার বিশ-পঁচিশ বছরের মধ্যেই দু-একজন মেয়ে, ছেলেদের সঙ্গে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে লেখাপড়া শেখে। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দুজন মেয়ে কাদম্বিনী বসু ও সরলা দাস প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসবার অনুমতি পায়। বেথুন কলেজের ছাত্রী কাদম্বিনী বসু (১৮৬১- ১৯২৩) কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণা ছাত্রী। সরকার ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে একমাত্র ছাত্রী কাদম্বিনীর জন্যই বেথুন স্কুলে কলেজ বিভাগ খোলেন। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে কাদম্বিনী বেথুন কলেজ থেকে বি. এ. পাস করেন; বেথুন কলেজে তখন মাত্র হিন্দু মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল। চন্দ্রমুখী বসু (১৮৬৯-১৯৪৪) নামে আর একটি মেয়ে খ্রিস্টান বলে বেথুন কলেজে পড়বার প্রবেশাধিকার পায়নি। সে এফ. এ. পড়া শুরু করে ফ্রি চার্চ নর্মাল স্কুলে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে অ্যালেন ডি. অ্যাক নাম্নী এক খ্রিস্টান ছাত্রী বেথুন কলেজে প্রবেশাধিকার পায়। তার ফলে চন্দ্রমুখী বেথুন কলেজ থেকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বি. এ. ও ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি অনার্স-সহ এম. এ. পাস করেন। তিনিই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মেয়ে যিনি এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি বেথুন কলেজে অধ্যাপনা করে কর্মজীবন শুরু করেন ও ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষা নিযুক্ত হন।
এদিকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাদম্বিনীর বিবাহ হয়। বিবাহের পর মেডিকেল কলেজে পাঁচ বৎসর পড়াশোনা করে ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিলাত যান। পরের বছর এল. আর. সি. পি. (এডিনবরা), এল. আর. সি. এস. (গ্লাসগো) এবং ডি. এফ. (ডাবলিন) উপাধি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। কিছুদিন লেডি ডাফরিন হাসপাতালে ডাক্তারি করার পর তিনি স্বাধীনভাবে চিকিৎসা ব্যবসা শুরু করেন। সুবক্তা হিসাবে তাঁর সুনাম ছিল, এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তিনি প্রথম নারী বক্তা।
কাদম্বিনীর সঙ্গে মেডিকেল কলেজে আরও দু’জন মেয়ে ডাক্তারি পড়ত। তারা ভার্জিনিয়া মেরী মিত্র ও বিধুমুখী বসু। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত প্রথম এম. বি. পরীক্ষায় ভার্জিনিয়া প্রথম স্থান অধিকার করে। বিধুমুখীও পাস করেন। কাদম্বিনী পাস না করলেও তাকে মহিলাদের স্পেশাল। সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল।
এসব ঘটনার বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যেই একজন মহিলা আইনের বি. এল. (বেচিলার অভ্ ল) পরীক্ষায় পাস করেন (১৯১৩)। নাম তাঁর রেজিনা গুহ (১৮৯৩-১৯১৯)। তারপর মেয়েদের মধ্যে আইন পড়বার প্রবণতা ক্রমশ বেড়ে যায়। বর্তমানে বহু মহিলা আইনজ্ঞ আছেন এবং কয়েকজন হাইকোর্টের বিচারপতিও নিযুক্ত হয়েছেন। সংবাদপত্রের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, বর্তমানে মেয়েদের মধ্যে আইন পড়ার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে আজকের দিনে মেয়েদের অগ্রগতি সম্পূর্ণ বৈপ্লবিক। প্রতি ঘরেই দু-চারজন মহিলা গ্রাজুয়েট দেখতে পাওয়া যায়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁদের সাফল্য সম্পূর্ণ বিস্ময়কর। বিদেশে গিয়েও তাঁরা তাঁদের প্রতিভাবলে অনেক উচ্চ পদে নিযুক্ত হয়েছেন। এমনকি জগতের সবচেয়ে বড় বিশ্বকোষ ‘এনসাইক্লো- পিডিয়া ব্রিটানিকা’র সম্পাদকমণ্ডলীতেও একজন বাঙালী মহিলা আছেন, নাম সুজাতা ব্যানার্জি। আর দেশের কথা তো ছেড়েই দিন। সমাজের সর্বক্ষেত্রেই তাঁরা নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের এগিয়ে যাবার প্রবণতা আজ ঢের বেশী। এক কথায়, তারা আজ একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছে।
মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সরোজিনী নাইডুর (১৮৭৯-১৯৪৯) নাম বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। ১২ বছর বয়সে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে, উচ্চশিক্ষার জন্য কেমব্রিজে যান। কবি হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের কানপুর অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল হন।
নয়
আমরা আবার ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নে ফিরে আসছি। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেট্রপলিটান কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রেসিডেন্সী কলেজে রূপান্তরিত হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ককলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। একইসঙ্গে আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়, একটা বোম্বাই-এ ও আর একটা মাদ্রাজ-এ। কিন্তু রাজধানীর বিশ্ববিদ্যালয় বলে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সকলের শীর্ষে স্থান পায়। এর অনুমোদন দেবার ক্ষমতা ভারত ছাড়া, ব্রহ্ম ও সিংহল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবার পর শিক্ষার বিস্তার খুব দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বি. এ. পরীক্ষা প্রবর্তিত হলে যদুনাথ বসু ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ওই পরীক্ষায় পাস করেন।
দশ
আগে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদক ও পরীক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে, যখন ইউনিভার্সিটি ল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের পর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৬৪-১৯২৪) প্রচেষ্টায় যখন নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অবলম্বিত হয় তখন বিশ্ববিদ্যালয় এক নতুন মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী হয়। স্বাধীনতা উত্তর যুগে আরও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।