বাঙলাড
হতাশ হবার কোনও কারণ নেই। এসিয়াডে বাঙালির তেমন প্রতিপত্তি দেখা গেল না। কারণ একটাই। বাঙালি যে সব খেলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী, দু:খের বিষয় সে সব আইটেম, আমাদের এসিয়াডে নেই। সবই এক ঘেঁয়ে মামুলি ব্যাপার। বিশাল দুটো ওজন নিয়ে সাংঘাতিক চেহারার এক মানুষ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হুপহাপ শব্দ করতে-করতে উঠে দাঁড়াবেন। তারপর দুম করে ফেলে দিয়ে হাত তুলে সরে পড়বেন। এক গাদা অল্পবয়সী মেয়ে জমি থেকে তিড়িং করে ঠিকরে ব্যাঙের মতো লাফ মেরে, শূন্যে সাত আটবার লক্কা পায়রার মতো ডিগবাজি খেয়ে আবার নেমে আসবে। দুটো খোঁটার মাঝখানে বাঁধা এক ডান্ডা ধরে হাড়-গোড়-ভাঙা জীবের মতো চরকিপাক দেবে। দিতে-দিতে হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই গুলিখাওয়া বিমানের মতো লাট খেতে-খেতে নেমে আসবে। গুড়ুম করে গুলির শব্দ, ঝপাং করে জলে হাবুডুবু খেতে-খেতে ভোঁদড়ের মতো এ মাথা থেকে ও মাথা, ও মাথা থেকে এ মাথা। ইলেকট্রনিক ঘড়ির সেকেন্ডের সংখ্যা টিভি-র পর্দার ডান দিকে লাট্টুর মতো খালি ঘুরতেই থাকবে। বিশ্রি চেহারার ন্যাড়াবোঁচা একটা সাইকেল কুজো মতো একটি মানুষ। প্যাডেলে পাগলের মতো পা চালাচ্ছে। গোল হয়ে ঘুরেই চলেছে, ঘুরেই চলেছে। জল্লাদের মত সন্দেহজনক চেহারার মানুষ, প্রাণদণ্ড দেবার মতো চেহারার এক প্রান্তরে সার-সার নিশান সাজিয়ে ঠাঁই ঠাস গুলি মেরে সময় আর অর্থ দুটোই নষ্ট করে চলেছেন।
যত সব ফ্যাশানেবল, জীবন বর্হিভূত কাজ। আমাদের ফিল্ডে নেমে এসো, আমরা কান কেটে ছেড়ে দেব। আমাদের ট্রেনিং নেই, ট্রেনার নেই, প্রাোটিন নেই, ভিটামিন নেই, র্যাশানের খুদকুঁড়ো খেয়ে অন্ধকারে, খানাখন্দে মানুষ, তাইতেই আমরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে, এক এক দিকপাল। এসিয়াডের মতো আমরা যদি বাঙলাড করার সুযোগ পেতুম তাহলে বিদেশি কোনও প্রতিযোগিকে হিট ছেড়ে আর ফাইনালে উঠতে হত না।
আমাদের আইটেমের মধ্যে প্রথম আইটেম হবে, ল্যাঙ মারা।
ফুটবলে ল্যাঙ চলে। সে ল্যাঙে হুইসিল বাজে, ফাউল হয়। আমাদের আইটেম হবে নির্ভেজাল ল্যাঙ। ল্যাঙ মারাটা কোনও কৃতিত্ব নয়, ল্যাঙ খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। প্রতিবেশীর ল্যাঙ, আত্মীয়-স্বজনের ল্যাঙ, কর্মক্ষেত্রের ল্যাঙ। দেখি বাঙালি ছাড়া আর কোনও দেশের প্রতিযোগি দাঁড়িয়ে থেকে সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে সগর্বে মাথা তুলে দেশে ফিরতে পারে! কত রথী মহারথীকে আমরা কাত করে দিয়েছি। বাঙালি বীরের ল্যাং খেয়ে কত তাবড়, তাবড় বাঙালি চিৎপাত হয়ে পড়েছেন। সেই লেঙ্গির তেজ কত, নেতা জানেন, সাহিত্যিক জানেন, সঙ্গীতজ্ঞ জানেন, জানেন প্রাোফেসানাল ম্যান। এই আইটেমটি হবে ক্রিকেট খেলার মতো। স্পিনের মতো, গুগলির মতো ল্যাঙ আসবে, ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। আর একটি আইটেম হবে চিলের পিছনে কাকের ঠোকর।
চিল যখন আকাশে ওড়ে পেছন-পেছন কিছু কাকও ওড়ে। এপাশ থেকে ওপাশ থেকে ঠোকরাতে থাকে। কোনও কোনও চিল অতিষ্ঠ হয়ে ডানা মুড়ে বসে পড়ে। কোনও চিল ওরই মধ্যে নিজের কাজ করে যায়। ঠোকোর সহ্য করার ক্ষমতা বাঙালির যেমন বাড়ছে, ঠোকরাবার ক্ষমতাও সেইরকম বাড়ছে। এই আইটেমটি হবে সাঁতার আর ডাইভিং-এর কমবিনেশান। অনেকটা ওই নতুন খেলা, কিক দি বলের মতো। শূন্যে সাঁতার, চোঁ করে নিচে নেমে এসে আবার ওঠা আবার নামা। মাঝে-মাঝে ডজ করে বেরিয়ে যাওয়া।
এ খেলায় স্বর্ণপদক কার গলায় ঝুলবে? আমাদের।
নেকস্ট আইটেম, ব্যাক বাইটিং। পেছন থেকে খ্যাঁক করে কামড়াবে। কামড়ে যত জনকে আউট করা যাবে তত পয়েন্ট। এই খেলায় দাঁতের জোর আর সহ্যশক্তি দুটোই থাকা চাই। এর সঙ্গে ফুটবলের টাইব্রেকারের মিল থাকবে। এ পক্ষ ছবার কামড়াবে, ও পক্ষ কামড়াবে ছবার। যে পক্ষ কামড় খেয়েও খাড়া থাকবে সেই হবে উইনার। বাঙালি হলে লড়াই হত সমানে সমানে। ব্যাক বাইটার আর ব্যাকবিটন দুপক্ষই সমান শক্তিশালী। অন্য দেশের প্রতিযোগী হেরে ভূত হয়ে যাবে।
নেকস্ট আইটেম, গলায় গামছা।
কে কতরকমের কত পাক সহ্য করতে পারে। পাওনাদারের পাক। পরিবারের পাক। ট্যাক্সের পাক। উৎসব, পালাপার্বণের পাক। দায়দায়িত্বের সাধ্যাতীত পাক। একেবারে পুরোপুরি গলার খেলা। চারশো টাকায় সারা মাস সংসার চালিয়ে, ছেলের এডুকেশান, মেয়ের বিয়ে, বৃদ্ধ পিতামাতার চিকিৎসা। এ দেশের অসংখ্য মানুষের স্থায়ী কোনও উপার্জন নেই। দিন আনি দিন খাই। কি খাই তাও জানা নেই। এই প্রতিযোগিতার জয় পরাজয় এক আধঘণ্টায় ফয়সালা হবে না। হিমালয়ান র্যালি বা ওয়ার্ল্ডকাপ ফুটবলের মতো তিনচার বছর ধরে চলবে। দেখি কে পারে আমাদের সঙ্গে।
এ সবই হল স্পিরিচ্যুয়েল আইটেম। বাংলা অনুবাদ আধ্যাত্মিক করলে চলবে না। স্পিরিট মানে ভূত। এই গ্রুপকে বলতে হবে ভৌতিক বিভাগ। ভূতের খেলা। দ্বিতীয় গ্রুপে স্থান পাবে সেই সব আইটেম যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে শরীর। সোস্যাল জিমন্যাস্টিক। এই বিভাগের প্রথম আইটেম, কোমরের কসরত বা মাঝার মাঝাকি। রাষ্ট্রীয় অথবা বেসরকারি পরিবহণ সংস্থার বাসে এই প্রতিযোগিতার আয়োজন হবে। সরকারি পরিবহণ সংস্থা অ্যানিভারসারির সময় দাঁত বের করা একটি বাসকে যেভাবে আলোকমালায় সজ্জিত করে, পথে পতাকা উঁচিয়ে ছেড়ে দেন, বাঙলাড উপলক্ষে আমরাও সেভাবে সাজাতে পারি। প্রতিযোগিতা শুরু হবে সকালে অফিসটাইমে। দৌড়, লংজাম্প, হার্ডলরেস, ট্রাপিজের খেলা, রেস্টলিং সব কিছুর সমন্বয়ে এই আইটেম! বিদেশিদের জন্যে নাম রাখা যেতে পারে—ক্যাচ দি বাস। পয়েন্ট দেওয়া হবে এই ভাবে—এক, এক চান্সে হাতল ধরা। ক্ষিপ্রবেগে সকলকে টাট্টুঘোড়ার মতো টপকে এসে, এর, ওর, তার বগলের তলা দিয়ে গলে, ফস করে হাতল ধরে, চলমান বাসের চেয়েও দ্রুতবেগে ছুটে, দক্ষিণ অথবা বামপদের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটিকে বাসের মচমচে ফুটবোর্ডে স্থাপন করতে হবে। দুই, ফুটবোর্ডে পা ঠেকানোর ওপর নম্বর থাকবে। জোড়া-জোড়া পায়ের জটলা। পা রাখার তিল পরিমাণ স্থান থাকবে না। আগে থেকেই যে সব পা স্থান করে নিতে পেরেছে, সেই সব পা নতুন কোনও পদাঙ্গুষ্ঠের অনুপ্রবেশ আন্দাজ করে অতিশয় শত্রুভাবাপন্ন। কৌরব পদ সমন্বয়ে ফুটবোর্ড এক চলমান কুরুক্ষেত্র। সূচ্যগ্র মেদিনী বিনা রণে ছেড়ে দিতে নারাজ। ওরই মধ্যে নভোচরের মতো মসৃণ পদস্থাপন সম্ভব করতে হবে। ডাইভিং-এ যেমন জল ছিটকে গেলে নম্বর কাটা যায়, এক্ষেত্রেও তাই করতে হবে। ঝুলন্ত মানুষ মারমুখী হয়ে উঠলে বুঝতে হবে পায়ের আঙুল খোঁচা মেরে ছাল ছাড়িয়ে, মারাত্মক ফাউল করে বিপক্ষের এলাকায় প্রবেশ করেছে। এ খেলার রেফারি জনগণ। বাঁশি বাজবে না। পেনাল্টি গণধাক্কা। প্রতিযোগীর হাত ছেড়ে পতন এবং বাসের চাকায় চিঁড়ে চ্যাপ্টা হওয়া। অর্থাৎ নিজেকে ফুটবলের মতন করে চলমান বাসের গোলের দিকে ছুঁড়ে দিতে হবে। এ বল সে বল নয়। এ বলের সেন্টার ফুটবলের মতো মাঠের মাঝখানে নয় বাসের ভেতরে। সেখানে দু-হাত তুলে, কোমর সোজা রেখে ঘণ্টা দেড়েক, কম অক্সিজেন, বেশি কার্বনডাইঅক্সাইড যুক্ত আখড়ায় কুস্তিগীরের মত লড়তে হবে। দু-কাঁধে জনগণের কনুইয়ের চাপ। ঘাড়ে অনবরত রদ্দা, আর কোমরের পার্শ্বচাপ। এই চাপাচাপির মধ্যে আপপুসোনার মতো কসরত দেখাতে হবে। নামার পর প্রতিযোগিকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে, আপনার নাম, পিতার নাম, কোন দেশ, কত সাল।
আমাদের তালিকায় দৌড়ও থাকবে। ট্র্যাক—। শেয়ালদা ভায়া বৌবাজার টু ড্যালহাউসি। সব টপকে, খানাখন্দ ডিঙিয়ে, লেট বাঁচাবার জন্যে দৌড়। এক মিনিট এদিক ওদিক। লাল ঢ্যারা। তিন ঢ্যারায় একটা সি. এল. হিসেব থেকে খারিজ।
বাঙালি তো সব সময়ই ফিল্ডে নেমেই আছে। সাজুগুজুর কি দরকার! আর পুরস্কার! কন্টকশয্যা, অনিদ্রা, অকালবার্ধক্য। ওইটাই তো খাঁটি সোনা।