বাঘ

বাঘ

শচী ভেলভেট পোকার টিপ পরতে খুব ভালবাসে। কিছু টিপ তার বাক্সে জমানো ছিল, বাকি কুলুঙ্গিতে। প্রায় দিনই সন্ধেবেলায় ফিকে করে আলতা পরত শচী। তার আলতার বাটি কখনও শুকোত না।

শচীর মাথায় অফুরন্ত চুল, মুঠো করে ধরা যায় না। ঘন গভীর কালো। এই চুলের রাশি নিঃশেষিত ঢেউয়ের মতন তার কাঁধের তট থেকে শান্ত অবনত প্রসারিত হয়ে পিঠ, পিঠের পর জানু পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। অথচ শচী চুলের যত্ন করত না।

শচী তার মুখেরও যত্ন করত না। রোগা ছাঁচের মুখ, একটু তোলা কপাল, পাতলা সরু সরু গাল শচীর। গালের ঢল চিবুকের কাছে কচি আমপাতার মতন বেঁকে আছে। ওর চোখের ভুরু হাল্কা, পালকের কলমের মতন টানা ; চোখ দুটি কোমল গাঢ়। শচীর নাক একটু বেশি লম্বা, ঠোঁট পাতলা।

যত্ন করলে শচীর মুখের লাবণ্য বাড়ত। শচী যত্ন করত না। তার উজ্জ্বল শ্যাম রঙ ধুলো পড়ে পড়ে যেন ম্লান হয়ে এসেছিল।

শরীরের ওপর আরও অযত্ন ছিল শচীর। শীর্ণ গড়নেও তার সুষমা ছিল ; শচী নজর করে খুব কমই দেখেছে। সাদামাটা আধময়লা শাড়ি ঢিলে-ঢালা জামা গায়ে তার সকাল সন্ধে কেটে যেত। সন্ধের পর কুয়োতলায় গা ধুয়ে একটু ছিমছাম হত। আলনা থেকে কোঁচানো শাড়িটা টেনে নিয়ে পরত, মোটামুটি একটা জামা গায়ে দিত। বসে বসে চুল বাঁধবে পরিপাটি করে সে ধৈর্য ছিল না শচীর ; কোনো রকমে একটা বিনুনি সারত, কিম্বা এলো খোঁপা করে ফাঁস দিয়ে নিত। তারপর লণ্ঠনের আলোয় বসে বসে আলতা পরত, টিপ পরত।

এই সময়, সন্ধে পেরিয়ে যখন রাত ঘন গাছপালা শালবন অরণ্য-উপকণ্ঠ অন্ধকারে পরিপূর্ণ, তিরিশ মাইল দূর থেকে স্টেশন যাবার শেষ বাসটা যেন সারাদিন খেটে চাপা আক্রোশে গর্জন করতে করতে এসে হাজির হত। তার দু-চোখের অন্ধকারভেদী শ্বেত আলো শচীদের বাড়ির সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত এই বর্জিত লোকালয় দেখত। তারপর সহসা অন্ধকার। এঞ্জিনের শব্দ শোনা যেত না। কয়েকটি যাত্রীর গলার স্বর, সুধীর ড্রাইভারের হাঁকাহাঁকি, দু-একটা মালপত্র ওঠানোর বিক্ষিপ্ত শব্দের সঙ্গে অচিন্ত্যর জোরালো হাসি মেশানো থাকত। কোনো কোনো দিন পেট্রলের গন্ধ বাতাসে মাখামাখি হত। নানকু মাঝে মাঝে ছুটে আসত কুয়োতলায় বালতি হাতে, ছড় ছড় করে বালতির জল কুয়োয় ফেলতে ফেলতে জল তুলত, আবার ছুটত বনোয়ারীলালের বিশাল বাসটাকে জল খাওয়াতে।

বড় অধৈর্য রাত আটটার এই শেষ বাসটা। পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি থাকবে না কিছুতেই। শান্ত নিস্তব্ধ তরুলতার তন্দ্রা, এই নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন পটভূমির বিভোর ভাব খণ্ডিত করে আবার চলে যাবে।

শচী মাটির বারান্দায় এসে দাঁড়াত প্রায়ই। জোড়া জামতলায় বাসটা দাঁড়িয়ে থাকত। শচী অন্ধকারে কিছু দেখতে পেত না, অনুভব করতে পারত। বাস কোম্পানির অফিসে বাতি জ্বলছে, হ্যাজাক বাতি, বাস থেকে কারা যেন নেমে একটু পায়চারি করে নিচ্ছে, আলোর বিন্দুর মতন বিড়ি-সিগারেটের স্ফুলিঙ্গ চোখে পড়ে, ঈষৎ গুঞ্জন, সামান্য কিছু শব্দ, অন্ধকারের বিশাল চাঁদোয়ার তলায় এই ক্ষীণ চাঞ্চল্যটুকু স্বপ্নের মতন মনে হয় শচীর।

বাসটা আবার কখন দীর্ঘ তরবারির মতন তার দু-চোখের ধারালো আলো জ্বেলে এই অন্ধকার এবং বনস্পতির ব্যুহ থেকে অক্লেশে চলে যায়। শচী ধুলোর গন্ধ অনুভব করে চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তারা দেখে আকাশের।

অচিন্ত্য আর বসে থাকে না, বাসায় ফেলে। নানকু অফিস বন্ধ করছে। মতিয়া মালঘর সামলাচ্ছে।

বাসা থেকে অফিস বড়জোর তিরিশ পা। অচিন্ত্যর পায়ের শব্দ পেতে পেতে হঠাৎ মানুষটাকে যেন চোখের সামনে দৈত্যের মতন হজির দেখতে পায় শচী।

—আজ হাতোয়ায় একটা বাঘ বেরিয়েছে শচী। কালেক্টর সাহেব কাল ঠিক ছুটবে।

শচী স্বামীর দিকে তাকায়। অন্ধকারে অচিন্ত্যকে ঘন ছায়ার মতন দেখাচ্ছে। বিশাল পুরুষ। হাফ হাতা শার্টটা খুলে ফেলে হাতে ঝুলিয়ে রেখেছে। গায়ে গেঞ্জি। শচীর মনে হয়, গেঞ্জি না থাকলে স্বামীকে হয়ত সে অন্ধকারে দেখতেই পেত না।

—বাঘটা বেশ বড়। অচিন্ত্য যেন নিজেই বাঘটা দেখেছে তার ধারণা বেশ বড় বাঘ, শচীর কি মনে হয় জানতে চাইছে এমনভাবে বলল,—এ বাঘ কোন দিক থেকে আসতে পারে বল তো?

শচী বাঘ দেখেনি, সার্কাসের বাঘও নয়, ছবি দেখেছে বইয়ে। এখানে সব সময় বাতাস বয়, বাতাস বইছিল, পাতায় শব্দ, খড়কুটো ধুলো বারান্দায় জমা হচ্ছে, শচী স্বামীর পায়ের দিকে তাকাল। অন্ধকারে দেখা যায় না, কিন্তু মনে মনে শচী দেখতে পেল, সবল শক্ত লোমশ দুটি পা, পায়ে চটি, মালকোঁচামারা ধুতি। গোড়ালির কাছে আধ বিঘতটাক যে কাটা দাগটা আছে শচী তাও চোখ বন্ধ করেই দেখতে পাবে।

—গত বছরে বকোদরে যে-বাঘটা এসেছিল, সেটা ছোট ছিল । একেবারে বাচ্চা। অচিন্ত্য বলল।—এবারে অত বড় বাঘ কোথা থেকে এল, আমি ভেবেই পাচ্ছি না।

—বন থেকে। শচী জোড়া জামতলার দিকে তাকাল।

অচিন্ত্য স্ত্রীর ঠাণ্ডা শান্ত গলার স্বর শুনে এমন ভাব করল যেন শচীর চেয়ে বাজে জবাব আর কেউ কখনও দিতে পারেনি। হেসে ফেলল। —বন থেকেই বাঘ বেরোয়। খুধ বললে তুমি।

শচী নীরব।

বাস কোম্পানির অফিসে তালা পড়েছে। বাতি নিবে গেছে। মালঘর বন্ধ করে মতিয়া তার হাতের ছোট লণ্ঠনটা দোলাতে দোলাতে ওর ডেরার দিকে চলে যাচ্ছে । মতিয়া তার ছাড়া গলায় দেহাতী গান গাইছে।

—দত্তদা কাল পরশু এলে বাঘের খবরটা জানা যাবে। অচিন্ত্য বলল। বলে ঘরে চলে গেল।

শচী দাঁড়িয়ে থাকল। ইচ্ছে করলে সে সামনে ঘুরে বেড়াতে পারত, মাটি ঘাস ধুলো খড় কুটোয় তার পায়ের পাতা আরাম পেত। এই বারান্দায় একটা তক্তপোশ পাতা আছে, বারো মাস পাতা থাকে, শচী তক্তপোশে বসতে পারত পা ছড়িয়ে। বেড়াতে বা বসতে ইচ্ছে করল না শচীর।

অচিন্ত্য গেঞ্জি খুলে রেখে এখন সোজা কুয়োতলায়। সাবান গামছা নিয়ে স্নান করতে বসেছে। নিজেই বালতি বালতি জল ওঠাবে, স্নান করবে।

শচী এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। তার সামনে নির্মল অন্ধকার । এই অন্ধকারে বাসের রাস্তা, বনের পথে অবলুপ্ত। মধ্য রাতের এক একটি দণ্ড যেমন দৈবাৎ শচীকে চকিত করে, মনে হয় সময় তাকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে, তেমনি এই অন্ধকারে কখনও কখনও শচীর মনে হয়, তাকে বুঝি কেউ তার প্রসারিত আলিঙ্গনে গ্রহণ করে নেবে।

অচিন্ত্য স্নান করছে। শচী শুনতে পাচ্ছে। তার স্বামী শরীর শীতল করছে। এই শীতলতার মধ্যে ও-মানুষ কি ভাবছে শচী জানে, বাঘের কথা ভাবছে। অচিন্ত্য সব সময় বাঘের কথা ভাবে।

শচী বাঘ দেখেনি, বাঘের কথা ভাবতেও পারে না।

দমকা হাওয়া এ-পাশ দিয়ে চলে গেল। ঘরের পলকা দরজার কব্জায় শব্দ হল একটু। একটা বুঝি কুটো এসে পড়েছিল চোখে। শচী চোখ রগড়ে কপাল থেকে চুল সরিয়ে নেবার সময় ভেলভেট পোকার টিপে আঙুল রাখল। যেন টিপটা সে অনুভব করল।.

খেতে বসে অচিন্ত্য বলল, —এমন চাকরি, দু’দিন কোথাও যাবার উপায় নেই।

ভেতরের বারান্দায় কাঠের মস্ত পিঁড়ি পেতে স্বামীকে আসন করে দিয়েছে শচী। লণ্ঠনটা একটু উঁচু করে রাখা। মাটিতে পা গুটিয়ে হাঁটু ভেঙে পাশ করে বসেছে শচী।

—এর চেয়ে তখন যদি শেল কোম্পানির চাকরিটা নিতুম, ভাল হত। অচিন্ত্য রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল। —ওদিকটা আরও ভাল ছিল। কাছেই মাকড়ার জঙ্গল, দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। অচিন্ত্য যেন মনে মনে জঙ্গল দেখে নিল। —শেল কোম্পানির সেই চাকরিতে ঝামেলাও ছিল না এত ।

শচী স্বামীকে দেখছিল। দেহাতি তাঁতের মোটা থানের লুঙ্গি পরেছে, গা খালি। বুকটা শাল গাছের শক্ত গুঁড়ির মতন। ঘন কালির রঙ। অজস্র লোম। সুগঠিত সমর্থ এই বুক দেখলে শচীর মনে হয় মানুষটা এক সময় যেন বনে বনে কাঠ কেটে বেড়াত । হাত বুক এমন কি কাঁধের দুপাশে যে পিণ্ডাকার কঠিন মাংস—কাঠুরের মতন কুড়ল না ধরলে তা যেন হয় না।

অচিন্ত্য প্রায় আধখানা রুটি একসঙ্গে ছিঁড়ে তরকারি মাখিয়ে মুখে পুরে দিল। শচী দেখছিল।

বারান্দাটা খুব বড় নয়, তবু লণ্ঠনের আলো এই ঘনীভূত অন্ধকারে প্রদীপের মতন জ্বলছিল। অচিন্ত্যর ডান দিকে বারান্দার প্রান্ত ঘেঁষে খরগোশের শূন্য খাঁচাটা দেখা যায় , না। জলতক্তার চারটে পায়া ভাসা ভাসা নজরে পড়ে। বাঁ দিকে অচিন্ত্যদের শোবার ঘর। জাম কাঠের কালো পাল্লাদুটো ছায়ার মতন দেখাচ্ছে। উঠোনে একরাশ কাঁচা কাঠ—সারাদিন রোদে শুকোয়—এখন কেমন শুকনো গন্ধ ; উঠোন, কুয়োতলা—ও-পাশটা ঘুটঘুট করছে। পেঁপে এবং কলাগাছের ঝোপ থেকে ঝিঁঝিঁ ডাকছিল।

—তোমার দিদির কাছে গিয়ে দিন কয়েক থাকবে নাকি ? অচিন্ত্য স্ত্রীর দিকে তাকাল।

—কেন ? শচী ছোট করে বলল।

—এই এমনি। অনেক দিত তো যাওনি। কটা দিন টাউনে কাটিয়ে এলে… । অচিন্ত্য ডালের বাটি তুলে চুমুক দিল।

শচী স্বামীর মুখ দেখছিল। যার বুক হাত কাঁধ এক কাঠুরের মতন, তার মুখ এমন হওয়া উচিত না। গাল সামান্য ভাঙা হলেও মুখ বেশ গোল। কপাল ছোট, নাক একটু বসা, পুরু ঠোঁট। দু’চোখ ভরা দৃষ্টি। শচীর নিজেরই কতবার মনে হয়েছে, মানুষটার মুখ ছেলেমানুষের মতন, খানিক বোকা খানিক চঞ্চল।

অচিন্ত্য বেশ শব্দ করে খায়। অধৈর্যের মতন, দ্রুত গ্রাসে। ও ডিমের তরকারি টেনে নিল।

—আমি দিদির কাছে গেলে তুমি কি করবে ? শচী হাতের ভর তুলে সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল।

—দত্তদার সঙ্গে কদিন ঘুরে বেড়াব।

—এখানকার কাজ সামলাবে কে ?

—আমিই। অচিন্ত্য আধখানা ডিম রুটির টুকরোর সঙ্গে মেখে গালে পুরে দিল। দিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকল। নিতান্ত মুখ জোড়া তাই কথা বলতে পারছে না, কিন্তু তার হাব-ভাব বোঝাচ্ছিল, একটা ব্যবস্থা সে করেছে।

শচী অ্যালুমিনিয়ামের ছোট ডেকচি থেকে আরও দু’খানা রুটি স্বামীর পাতে দিল।

—একটা মতলব ঠিক করে ফেলেছি—মুখ ফাঁকা হলে অচিন্ত্য বলল, —লাস্ট বাসে দত্তদার সঙ্গে চলে যাব, সকালের বাসেই আবার ফিরব।

—কোথায় যাবে ? শচী অন্যমনস্ক সুরে শুধলো। সে জানত অচিন্ত্য কোথায় যাবার কথা বলছে।

—হাতোয়ায়। অচিন্ত্য এক চুমুকে আধ গ্লাস জল শেষ করে গলা যেন পিরষ্কার করে নিল। —তোমার এই লাস্ট ডাউন-বাসটা নিয়েই যা ঝামেলা। বেকায়দায় মাঝে মাঝে রাত করে ফেলে, নয়তো তেজরা থেকে আমরা চৌধুরী কোম্পানীর মাল-লরিতে হাতোয়া চলে যেতে পারতাম।

শচী স্বামীর উজ্জ্বল চোখ দুটি দেখছিল। জীবনে যেন আর কোনো আকাঙক্ষা নেই মানুষটার, শুধু একবার একটি বাঘ দেখতে চায়, গুলি করে মারতে চায় নিজের হাতে।

লণ্ঠনের আলোর দিকে তাকিয়ে শচী আস্তে আস্তে বলল, —হাতোয়ায় শিকার করতে যাবে ?

—বাঘ শিকার—! অচিন্ত্য বাঘ শব্দটার ওপর প্রচণ্ড ঝোঁক দিল, যেন শচী বারান্তরে আর ভুল না করে।

শচী চুপ করে থাকল। হাতোয়ার জঙ্গলের পাশ দিয়ে অনেকবার সে যাওয়া আসা করেছে। এই জঙ্গলের কোথায় যেন খুব পুরনো একটা হরগৌরীর মন্দির আছে। ভাঙা মন্দির। শচী মন্দিরটার কথা এতবার শুনেছে যে হাতোয়ার জঙ্গলের ওপর দিয়ে যতবার বাসটা গেছে, সে বৃক্ষলতাদির বিশাল যবনিকার দিকে তাকিয়ে আশা করেছে ফাঁক ফোকর দিয়ে মন্দিরটা হয়ত চোখে পড়ে যাবে। কিন্তু কোনোদিন পড়েনি। শচী এখন হাতোয়ার মন্দিরের কথা দু’মুহূর্ত ভাবল, তারপর বাঘের কথা। মনে হল, বাঘটা যেন মন্দিরের পাশ থেকে তার মনে লাফিয়ে পড়ল।

অচিন্ত্যর খাওয়া শেষ হয়ে এসেছিল। শেষ গ্রাস মুখে রেখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল। গ্রাস শেষ হলে অনেকটা জল খেল। তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলল অচিন্ত্য, আসন ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, —দত্তদা হয়ত কাল ন’টার বাসে এসে হাজির হবে।

শচী মাথা তুলল না। শূন্য আসনের দিকে চেয়ে বসে থাকল।

সকালে সূর্যোদয়ের পর শচী রান্নাঘরের দরজা খুলে দিয়ে বাসি চোখে উনুন ধরাবার সময় রোজ পায়রা জোড়ার কথা ভাবে। মতিয়া তাকে একজোড়া পায়রা এনে দিয়েছিল। সাদা পায়রা। খুব তাড়াতাড়ি ওরা শচীর পোষ মেনে গিয়েছিল। শচী ভোরে উঠে কাঠকুঠো টেনে উনুন ধরাবার সময় পায়রা জোড়া ভেতরের বারান্দা আর উঠোনে সারাক্ষণ ঝটপট করে উড়ে বেড়াত। উনুন ধরানো হয়ে গেলে শচী উঠোনে এসে একমুঠো দানা ছড়িয়ে দিলে ওরা বসে বসে খুঁটত আর শচী কুয়োতলায় ফাঁকায় দাঁড়িয়ে মুখ হাত-পা ধুতো, বাসি শাড়ি জামা ছাড়ত, কাচত, দড়িতে শুকোতে দিত। দানা খোটা শেষ করে পায়রা জোড়া এক সময় উড়ে যেত।

এই জোড়া পায়রার একটা দত্তবাবু, অন্যটা অচিন্ত্য মেরেছে। একদিন হাসাহাসি গল্প করতে করতে কি কথায় যেন বাজি ধরে দত্তবাবুর ছররা-বন্দুকে ওরা দু’জনে একে একে উড়ন্ত পায়রা জোড়া মেরে ফেলল।

শচীর সেদিন মনে হয়েছিল, একদিন বাজি ধরে হয়ত ওরা তাকেও মেরে ফেলতে পারে।

এই নিষ্ঠুর কাজ করার পর দত্তবাবু এবং অচিন্ত্য দু’জনেই ভীষণ লজ্জায় এবং অনুতাপে পড়েছিল। দত্তবাবু দু’জোড়া পায়রা এনে দিতে চেয়েছিলেন, অচিন্ত্য স্ত্রীর হাত ধরে ফেলে অনেক অনুনয় করেছে। শচী অবশ্য আর পায়রা আনতে, আনাতে বা পুষতে সম্মত হয়নি।

কিন্তু সকাল বেলায় উনুন ধরাতে বসলে রোজই শচী যেন কানে সেই চঞ্চল বশীভূত দুটি পায়রার পাখা ঝাপ্টানির শব্দ শোনে। এবং কাঠ-কুটোর ধোঁয়ায় শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসার আগেই ফাঁকা উঠোনে নেমে এসে দু’মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। যেন শ্বাস স্বাভাবিক করে নেয়।

আজ শচী উনুন ধরিয়ে উঠোনে নেমে আসতেই অচিন্ত্যকে দেখতে পেল। দু’হাত মাথার ওপর উঠিয়ে গা ভাঙছিল অচিন্ত্য, হাই তুলছিল।

এত সকাল সকাল অচিন্ত্য বড় একটা ওঠে না। শচী মাজন নিতে, সকালের শাড়ি সেমিজ জামা আনতে ঘরে চলে গেল।

কুয়োতলায় অচিন্ত্য জল তুলে দিয়েছে। শচী মুখ হাত পা ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে নিল।

ও-পাশে একটু সবজি বাগানের মতন। অচিন্ত্য কোদাল হাতে বাগানের মাটি ঠিক করে দিচ্ছে, ঝরা মরা পাতা আলাদা করে জড় করছে, হয়ত নিজের হাতে কয়েক বালতি জলও দিয়ে যাবে।

শচী বাসি কাপড় জামা ছেড়ে কেচে নিল। শুকনো কাপড়-চোপড় গায়ে জড়িয়ে কাচা বস্ত্রগুলো যখন উঠোনের দড়িতে টাঙিয়ে দিচ্ছে, অচিন্ত্য বলল,—তোমার এই ফুলের গাছটা বাড়েও না, ফুলও ফোটে না। খুব একটা গাছ পুঁতেছ।

সেমিজ এবং জামা টাঙিয়ে শচী শাড়িটা দড়িতে মেলে দিচ্ছিল। গাছটা তার নজরে পড়ছিল না।

—এটা কি ফুলের গাছ, শচী ?

—বুনো ফুল, নাম জানি না।

—ফুল দেখেছ তুমি ? কেমন দেখতে?

—লাল, ছোট ছোট। আমরা ছেলেবেলায় লাল তিল বলতাম। শচী শাড়ি মেলে উন্মুক্ত উঠোনে এসে দাঁড়াল।

—লাল, ছোট ছোট….অচিন্ত্য হাসল—তোমার ওই টিপের মতন নাকি ?

শচী স্বামীকে দেখছিল। খালি গা, হাতে কোদাল। সেই বুক, হাত, কাঁধ। শচীর মনে হল, লাল তিলের গাছ ইচ্ছে করলেই ও মানুষ কুপিয়ে শিকড় সুষ্ঠু উঠিয়ে ফেলে দিতে পারে।

একটা টিয়াপাখি এ-সময় পেঁপে গাছের ঝোপ থেকে নেমে এসে কুয়োতলার বালতিতে বসে ডাকছিল।

অচিন্ত্য চা খেয়ে তার অফিসে চলে গেছে। স্টেশন থেকে প্রথম বাসটা এসেছিল, যথারীতি দাঁড়িয়ে শহরের দিকে চলে গেছে কখন, এতক্ষণে শহরে পৌঁছোয় পৌছোয়। শহরের বাসটার আসার সময় হল। বেলা দশটার গাড়ি ধরায় স্টেশনে। দত্তবাবু স্টেশনের বাসে আসেননি, হয়ত শহরের বাসে এসে হাজির হবেন। কোন দিক থেকে তিনি আসবেন, কখন আসবেন কেউ জানে না।

অচিন্ত্যর জল খাবার তৈরি হয়ে পড়ে আছে। ডাউন বাস না গেলে আজ আর সে আসছে না। রান্নাঘরে কয়েকটা কাজ সেরে শচী এবার ঘরের কাজে হাত দেবে ভাবছিল। দুটো ঘর, এই বারান্দা পরিষ্কার করার সময় ঝাঁটায় হাত দিলে তখন আর অন্য কাজে হাত দেওয়া যায় না। নানকু বাইরের বারান্দাটা বিকেলে ঝাঁট দিয়ে দেয়।

শচী ঘরে বিছানা তুলছে, খোলা জানালা দিয়ে অচিন্ত্যর অফিস চোখে পড়ছে। জানলার গা ধরে কুলগাছের ছায়া, তারপর রোদ, রোদের মধ্যে ধুলোভরা করবী গাছের ঝোপ তপ্ত হয়ে উঠেছে, কয়েক পা মলিন ঘাস, তারপর অফিস। অফিসের মালঘরটা এখান থেকে চোখে পড়ছিল শচীর । ইট-সিমেন্টের গাঁথনি, মাথায় ঢেউখেলানো টিন। মালঘরের বারান্দার কাছে কয়েক বস্তা আলু নামানো। স্টেশনের বাসে চালান যাবে।

বিছানা তুলতে তুলতে শচী আচমকা প্রথম ডাউন বাসের হর্নের শব্দ শুনতে পেল। গাছ লতা-পাতার মৌনতা সচকিত দূরান্ত থেকে হর্নের শব্দটা ভেসে আসছে, একখানা তীক্ষ জোরালো যান্ত্রিক শব্দ-বাসটা তার আবির্ভাব ঘোষণা করতে করতে এইভাবে আসবে। শচী কল্পনা করতে পারল ধুলোর ঝড় উঠিয়ে বাসটা পিচের রাস্তা ফেলে কাঁচা শড়ক দিয়ে আসছে।

এখানে গাছের শাখায় ক’টা কাক চড়ুই এবং ময়না ঈষৎ ডাকাডাকি করে চুপ করে গেল।

বাসটা এল। জোড়া জামতলায় দাঁড়াল। শচীর বিছানা তোলা প্রায় শেষ। পুবের জানলায় এসে দাঁড়াল ও। বাসটা পুরোপুরি দেখা যায়, সামনের সবটুকু। ড্রাইভারের দরজা খুলে বিজন ড্রাইভার নেমে এসেছে। খাকি ফুলপ্যান্ট, গায়ে আঁট গেঞ্জি হলুদ রঙের, চোখে রঙিন চশমা। চশমাটা খুলে বিজন ড্রাইভার একবার এদিকে তাকাল। তারপর রুমাল বের করে মুখ-গলা মুছতে মুছতে অফিসের দিকে চলে গেল।

সকালের ডাউন বাসে বেশ ভিড় হয়। আজ অতটা ছিল না। শচী দত্তবাবুকে দেখল না। ড্রাইভারের পিছন দিকে সেকেন্ড ক্লাসের দরজা খুলে অন্য লোকজন নামল।

শচী আগে অনুভব করেনি, এখন বাসের লোকজন দেখতে দেখতে অনুভব করল, তার মনে খুব চাপা এক উৎকণ্ঠা ছিল। দত্তবাবু আসেননি, শচী আপাতত স্বস্তি অনুভব করছে।

এটা বিয়ের মাস নয়। সবে ফাল্গুন গিয়েছে। সেকেন্ড ক্লাসের দরজা খুলে এক যুগল নেমে আমের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সকৌতুকে এই পান্থশালা দেখছিল। ফাল্গুনের সদ্য স্বাদ যেন আমতলায় দেখতে পেল শচী। মেয়েটির হাতের শাঁখা এবং সিঁথির সিঁদুর লক্ষ্য করা না গেলেও শচী ওর সর্বাঙ্গে একটি মধুর বর্ণ দেখতে পাচ্ছিল। ছেলেটি আঙুল দিয়ে মহুয়ার গাছ দেখাচ্ছে। মেয়েটি দেখছে।

আরও ক’জন নেমেছে। মাড়োয়ারী দুই বাবু। তারা অন্য দিকে আড়ালে হেঁটে যাচ্ছিল গল্প করতে করতে। খাকি হাফপ্যান্ট, সাদা শার্ট পরা এক ভদ্রলোক সিগারেট খাচ্ছেন। ক’জন দেহাতি বাস অফিস থেকে জল খেয়ে এল। ধোপাটা গাঁটরি নিয়ে নামেনি, শচীদের জামা-কাপড় তার মাথার গামছায় জড়িয়ে বাসার দিকে আসছে। এ-বেলা কাপড় দিয়ে গেল, ও-বেলা ফিরতি পথে নিয়ে যাবে।

মতিয়া আর বাসের কুলি মিলে আলুর বস্তা বাসের মাথায় চাপাচ্ছিল। শচী আমতলার দিকে আরও কয়েক পলক তাকিয়ে ধোপার কাছ থেকে কাপড় নিতে বারান্দায় চলে গেল।

ডাউন বাস চলে গেল, আবার সব শান্ত। জোড়া জামতলা ফাঁকা, অফিস ঘরে সামনে ধুলোয় ভরা পথ এবং মলিন ঘাস চৈত্রের রোদে তেতে উঠেছে। লতাগুল্মের হালকা ছায়া । দূরান্তে বনরেখা, ডালের ক্ষেত, আলুর চাষ । শচী তার দৃষ্টির মধ্যে এত কিছু দেখতে পায় না, অনুমান করে নেয়।

অচিন্ত্য জলখাবার খেয়ে আরও এক দফা চা হাতে নিয়ে অফিসে চলে গেল । দত্তদা না আসায় খুব অধৈর্য। আজ আবার বারোটার আপ বাসে পেট্রলের টিন, মাবিল, ব্যাটারি—টুকটাক আরও কি সব আসবে কোম্পানীর। পুরনো মালপত্র পাঠিয়ে দিতে হবে শহরে। অচিন্ত্য গজরাচ্ছিল। বাস সার্ভিসের কাজে বড় ঝামেলা।

শচী একা হাতে এই ছোট সংসারের দু’কূল সামলে যাচ্ছে। রান্না, ঘরদোর পরিষ্কার, এটা ওটা কাচা, বাসনপত্র ঘোয়া। মাঝে মাঝে নানকু এসে জলটা তুলে দেয়, কাঠটা দিয়ে দেয়।

বাড়িতে ঘড়ি নেই শচীর। বাসের আসা যাওয়া নিয়ে তার সময় মাপা। বারোটার বাস চলে গেল। শচীর আবার সেই উৎকণ্ঠা, দত্তবাবু বুঝি এসে পড়লেন। না, এলেন না। প্রখর রৌদ্রের চৈত্রের মধ্যাহ্ন দাহ্য বস্তুর মতন জ্বলছিল।

খাওয়া দাওয়া সেরে মাটিতে খালি গায়ে শুয়ে অচিন্ত্য ছটফট করছিল। গরমে না বাঘের চিন্তায় কে জানে। শচী ভিজে চুল এলিয়ে জানালার পাশ ঘেঁষে বসেছিল। বাইরে লু বইছে, ঘাস মাটি পুড়ছে, গাছপাতার নরম ডাল কাঁপিয়ে চৈত্র দুপুর কে যেন তার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।

অথচ বনবৃক্ষের কোন নিবিড় ছায়ায় বসে ঘুঘু ডাকছিল । শচী উত্তরের জানালার আধখানা পাট খুলে দিয়েছে। এদিকে কাঁঠালগাছের ঘন ছায়া নেমে আছে বেলা থেকেই। বাতাস গরম বলে পুরো জানলা খুলতে পারে নি। তবু এই অল্প উন্মুক্ত বাতায়ন ঘরের দুঃসহ গরম সামান্য লাঘব করছিল।

অচিন্ত্য হাতপাখা টেনে নিয়ে নিজের মুখ গলা বুকের ওপর খানিক বাতাস করল।

—দত্তদা বোধ হয় কোথাও গেছে, শচী । অচিন্ত্য চোখ না খুলেই বলল।

শচী জবাব দিল না। মানুষটা বাঘের কথাই ভাবছে। সারাদিন শুধু ওই এক ভাবনা।

—পশুপতিকে বলেছি, দেখা হলে খবরটা দিয়ে দিতে। অচিন্ত্য পাখার বাঁট দিয়ে পিঠ চুলকে নিল।

বাইরে ছোট মতন একটা ঘূর্ণি মাতামাতি করছিল। যেন উড়তে উড়তে এই ছায়াতলে ছুটে এসে থতমত খেয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না, এবং শুকনো কটা পাতা শূন্যে উড়ছিল। শচী অন্যমনস্ক চোখে দৃশ্যটা দেখছিল।

দুপুর কাটল। বিকেল এল, গড়াল ; অপরাহ্নের কোনো অদৃশ্য আঁচলে দগ্ধ দিনান্তের শেষ রুক্ষতাটুকুও মুছে গেল। অবশেষে বনজ গন্ধ, শীতল বাতাস, সন্ধ্যা-ছায়া এবং পত্র-মর্মর এই পান্থশালা প্রীতিকর করে তুলল। আকাশে তারা উঠে গেছে তখন।

দত্তবাবু এলেন না। আরও দু দফা বাস এসেছে গেছে। আর মাত্র একটি আপ্‌ বাস যাবে, রাত আটটার শেষ ডাউন বাসটা আসবে।

শচী কুয়োতলায় গা ধুতে গিয়ে সন্ধ্যার আকাশতলে তার মৃত পায়রা দুটির কথা ভাবছিল ।

দত্তবাবু এলেন না। অচিন্ত্য প্রত্যহ প্রতিটি বাসে তাঁকে আশা করেছে। প্রথম প্রথম অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করত, পরে ক্রমশ বিরক্ত বিতৃষ্ণ হয়ে উঠছিল।

শচী আর উৎকণ্ঠা অনুভব করত না। প্রায় সপ্তাহ কাটতে চলল, উনি আর আসবেন না।

শেষ পর্যন্ত রবিবারে হাট বাজারের দিন রাত আটটার ডাউন বাস বিদায় করে দিয়ে অচিন্ত্য বাসায় এসে বলল, —শচী, সেই বাঘটা পালিয়ে গেছে। অচিন্ত্যর গলার স্বর খুব হতাশ।

শচী আজ বাইরের বারান্দায় তক্তপোশের ওপর মাদুর পেতে বসে ছিল। অচিন্ত্য গায়ের শার্ট, গেঞ্জি খুলে তক্তপোশের একপাশে ফেলে রাখল।

—পশুপতি বলছিল, বাঘটা ভুল করে এ-জঙ্গলে এসে পড়েছিল, পালিয়েছে বেটা। অচিন্ত্য তক্তপোশের একপাশে বসে শরীরের ক্লান্তি কাটাচ্ছিল।

শচী স্বামীকে দেখছিল। আজ অতটা অন্ধকার নয়। আকাশে ভাঙা চাঁদ উঠেছে। তারা এবং চাঁদের আলোয় এই বন্যপ্রান্তর ঈষৎ স্পষ্ট দেখাচ্ছিল।

বাঘেদের নানারকম অদ্ভুত স্বভাব থাকে। অচিন্ত্য যেন স্ত্রীকে বাঘের গল্প শোনাচ্ছে, —অসম্ভব চালাক।

শচী পা গুটিয়ে নিয়ে বসল। বাস কোম্পানীর অফিস, মালঘর বন্ধ হয়ে গেছে। আশপাশে কোথাও কাক পাখি ডাকছিল। মন্দ বাতাস বইছে। শিশুগাছের মাথা ডিঙিয়ে আকাশের ভাঙা চাঁদ দেখা যাচ্ছিল।

—বিপদের গন্ধ পেলে আর সে-মুখো হবে না। অচিন্ত্য বলল, বলে একটু থেমে আবার বলল,—এমন চালাক জন্তু আর নেই।

শচী স্বামীর মুখ লক্ষ্য করল একটু। —তুমি তো কখনও বাঘ শিকার করনি, কী করে জানলে ?

—এ-সব জানতে আর কষ্ট কি। শুনেছি…শিকারের বইয়ে পড়েছি। অচিন্ত্য হালকা গলায় বলল, বলে শার্ট টেনে নিয়ে পকেট হাতড়ে বিড়ির কৌটো বের করল। —এত রকমের শিকার আছে, কিন্তু বাঘ শিকারের আলাদা খাতির। কেন বল তো…. ? অচিন্ত্য বিড়ি না ধরিয়ে একটা কাঁচি সিগারেট ধরিয়ে নিল।

শচী কিছু বলল না। স্বামীর উলটো দিকে গুটোনোপা আর একটু ছড়িয়ে দিয়ে বসল।

—পশুদের মধ্যে বাঘ সবচেয়ে বলবান, হিংস্র, আবার তেমনি হুঁশিয়ার। অচিন্ত্য যেন শচীকে উৎসুক শ্রোতা পেয়েছে এমন ভাবে বলল, বলার সময় বই থেকে শব্দ খুঁজে নিচ্ছে যেন। —বাঘ মারার আলাদা ইজ্জত।

—তোমার দত্তদা কটা শিকার করেছে ? শচী আচমকা বলল ; বাঘ শব্দটা সে উচ্চারণ করল না।

—গোটা তিনেক। অচিন্ত্য জবাব দিল। গলা ভর্তি করে ধোঁয়া টেনে গিলে ফেলল, তারপর খানিকটা ধোঁয়া নাক মুখ দিয়ে বের করে বলল,—প্রায় পনের বচ্ছর দত্তদা ফরেস্টে কাজ করছে, এতদিনে মাত্র তিনটে মারতে পেরেছে। তাহলে বোঝ একটা বাঘ শিকার কী জিনিস।

শচী সিগারেটের মুখের ফুলকি দেখছিল। তার মনে হল, এই ফুলকি আরও বড় হলে বোধ হয় বাঘের চোখের মতন দেখাত ।

—আমার কপালে আর সুযোগই জুটছে না। অচিন্ত্য যেন বেশ ক্ষুব্ধ, হতাশ।

সিগারেটটা সামনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে পড়ল অচিন্ত্য । শার্ট গেঞ্জি তুলে নিয়ে চলে গেল ভেতরে।

শচী চুপ করে বসে থাকল। সামনে চাঁদের আলোয় জবাগাছটা তার নিজেরই ছায়ার মতন দেখাচ্ছিল। কয়েকটা কলাফুলের ঝোপ। কোথাও একটি ফুল নেই। তারপর বিবর্ণ ঘাস, লালচে মাটি ; চন্দ্রালোকে ঘাস মাটি সামান্য যেন আদ্র দেখাচ্ছে। আয়নার কাচের মতন এই জ্যোৎস্না যেন বনবৃক্ষ ও লতাগুল্মকে সস্নেহে তোষণ করছিল।

অচিন্ত্য কুয়োতলায় গিয়েছে। স্নান করছে। শচী জলের শব্দ পাচ্ছিল।

চাঁদের আলো ক্রমশ তক্তপোশের ধারে এসে পড়ছিল। আরও কিছু পরে আধখানা তক্তপোশ জুড়ে বসবে। শচী আস্তে আস্তে চাঁদের আলোর দিকে তার পা ছড়িয়ে দিল। ফিকে আলতার রঙ নজরে পড়ছিল ওর। পায়ের পাতা, গোড়ালি, আঙুল আলতার রঙে রঞ্জিত হলেও কেমন খয়েরি স্নান দেখাচ্ছিল। শচী কিছুক্ষণ এই ম্লান মোটা রেখার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর সহসা তার মনে হল, অচিন্ত্য স্নান করে আবার বাইরে এসে বসবে। শচী পা গুটিয়ে নিল।

অচিন্ত্য আজ ঘরে শুতে চাইল না। খুব গুমট ভেতরে। শচী জানত, অত গুমট থাকার কথা নয়। আরও কিছুদিন পরে তাদের বাইরেই শুতে হবে। গত বছরও শুয়েছে। এ বছরে যেন একটু আগে-ভাগে বাইরে আসতে হল।

বাইরের তক্তপোশে অল্প করে বিছানা করল শচী। মাদুরের ওপর আর তোষক পাতল না, সাদা চাদর বিছিয়ে দিল। বালিশ রাখল। এক কুঁজো জল, গ্লাস। মশারি টাঙিয়ে দিল। ভেতরের ঘর দোর বন্ধ করে বাইরে এসে দাঁড়াল।

অচিন্ত্য সামনে মাঠের মতন জায়গাটুকুতে পায়চারি করছিল। খালি গা।

ধবল জ্যোৎস্যা। বাতাস চঞ্চল হয়ে বইছিল। পাতার শব্দ নিস্তব্ধতাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।

—শচী-অচিন্ত্য ডাকল।

শচী মশারির পাশ গুঁজে দিচ্ছিল।

—এদিকে এস, একটু বেড়াই। সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। অচিন্ত্য শচীর দিকে মুখ করে তৃপ্ত গলায় ডাকছিল।

শচী বাইরে মাঠে গিয়ে দাঁড়াল।

—এই জায়গাটা দিনে অসহ্য, রাত্রে কিন্তু বেশ লাগে। অচিন্ত্য বলল।

স্বামীর সঙ্গে হাঁটছিল শচী। ওরা জোড়া জামতলার দিকে যাচ্ছিল।

—এদিকে একদিন একটা বাঘ ছিটকে চলে আসে না ? অচিন্ত্য দূরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বলল ।

—মারবে ? শচী অন্যমনস্ক ।

—বলতে ! অচিন্ত্য সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ দিল না।—আমি ছাড়ব না।

খালি পায়ে পা পা করে হাঁটছিল শচী। তারা ক্রমশ জোড়া জামতলা পাশে রেখে আমতলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। শচীর সেই ছেলেটি এবং মেয়েটির কথা অকস্মাৎ মনে পড়ল। মাত্র ক’দিন আগে ওরা ওই আমতলায় ক্ষণিকের জন্যে দাঁড়িয়েছিল ।

—তুমি কী বাঘ ছাড়া কিছু ভাব না ? শচী আচমকা বলল।

—আর কী ভাবব ? অচিন্ত্য স্ত্রীর দিকে মুখ ফেরাল।

—জগতে আর ভাবনা নেই ? শচী চাপা গলায় বলল।

—থাকবে না কেন। কত আছে—। আমি ভাবি না। অচিন্ত্য সরল গলায় বলল, —আমার কাছে একটা বাঘ অনেক—

—কীর্তি ? শচী যেন এই প্রথম স্বামীকে উপহাস করতে চাইল।

—কীর্তি ফির্তি জানি না। অচিন্ত্য বেপরোয়া গলায় বলল,—একটা মানে হয়। লোকে তবু বলবে। নয়ত কিসের এই বনজঙ্গলে পড়ে থাকা।

শচীর খুব ইচ্ছে হয়েছিল ওই আমতলায় গিয়ে একটু দাঁড়ায়। ইচ্ছেটা হঠাৎ মরে গেল।

তক্তপোশের মাথার দিকে চাঁদের আলো সরে এসেছিল। এখন মাঝ রাত। শচী ঘুমের ঘোরে কিসের অস্বস্তিতে সামান্য ছটফট করল, মুখে বিড়বিড় করে কী বলল। তার হাত অচিন্ত্যর গায়ে পড়েছে। অবলম্বনের মতন কী যেন প্রাণপণে ধরবার চেষ্টা করে ভীতার্ত অস্ফুট শব্দ করল। শচী জেগে উঠল। চোখের পাতা এবং মশারির ঘর থেকে তার দুঃস্বপ্ন চকিতে বাইরে পালিয়ে গেল।

ঘোর কাটার পর কিছুক্ষণ শচী সজ্ঞানে চেয়ে থাকল। সে অরণ্য এবং বাঘের স্বপ্ন দেখছিল। অচিন্ত্য একটা বাঘকে গুলি করে মেরেছে। আহত মুমূর্ষ বাঘটা শচীর দিকে পাক খেতে খেতে এগিয়ে আসছিল। ছোট ছোট ঝোপ কাঁপছিল, ঘাস রগড়ে যাচ্ছিল, মাটি ক্ষত বিক্ষত হচ্ছিল। ভয়ে শচীর সমস্ত শরীর নিশ্চল নিঃসাড় । বাঘটা অনেকখানি শরীর টেনে টেনে এল, তারপর আর পারল না। মরে গেল। অচিন্ত্য উল্লাসে চিৎকার করে কী যেন বলল, শচী ঠিক শুনতে পেল না। তবে তার মনে হল, এতদিনে তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে বলে অচিন্ত্য বিরাট আনন্দে ফেটে পড়েছে। তার উল্লাস এবং আনন্দ বিজয়ী দেবতার মতন দেখাচ্ছিল।

ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসল শচী। অচিন্ত্য অঘোর ঘুমে। চাঁদের পূর্ণ আলোয় সাদা জালের মশারি আরও শ্বেত। বাতাসের তরঙ্গে কাঁপছে। চতুর্দিক নিস্তব্ধ। এত নিস্তব্ধ যে শচীর মনে হল, বিশ্বচরাচর মৃত। অচিন্ত্যর নিশ্বাসের মৃদু শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ও।

অনেকক্ষণ বিমূঢ় অসম্বৃত হয়ে শচী বসে থাকল, এবং স্বামীর গভীর নিশ্বাসের শব্দ শুনল। মশারির ভেতর থেকে বনচিত্র দেখা যাচ্ছিল না। নিরাকার অস্পষ্ট একটি পটছায়ার মতন সামনে বন বৃক্ষসারি দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যহের সেই জোড়া জামতলাও শচী দেখতে পাচ্ছিল না।

একবার মনে হল, মশারি তুলে শচী বাইরে চলে যায়, মাঠে হেঁটে হেঁটে কোথাও গিয়ে দাঁড়ায়। এই জ্যোৎস্না বৃক্ষ নিস্তব্ধতা তার সর্বসত্তা শোষণ করে নিক।

শচী উঠল না। অযথা মাঠে গিয়ে দাঁড়িয়ে লাভ নেই। বনোয়ারীলালের বাসের মতন তাকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে না। শচী তার প্রতি রোমকূপে নিজের ব্যর্থতার স্বেদ অনুভব করতে পারছিল। জীবন এত শূন্য, অর্থহীন শচী আগে কখনও বোধ করেনি। তার দুটি বশীভূত পায়রা মরে যাবার পরও নয়। বেদনা শচীকে ক্রমশ পরিত্যক্ত শিশুর মতন অসহায় করে তুলছিল।

অচিন্ত্যর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শচী কান পেতে হৃদয়ে গ্রহণ করবার চেষ্টা করল। নিয়মিত বিরতির পর নিশ্বাস পড়ছে, প্রশ্বাস প্রবেশ করছে। শচীর মনে হচ্ছিল, অচিন্ত্যর হৃদয়ে কোথাও শূন্যতা নেই। তার প্রাণবায়ু পূর্ণ, গভীর। অচিন্ত্য একদিন তার জীবনকে অর্থময় করে তুলবে। সে বাঘের স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকবে এবং কোনোদিন নিজের জীবনের বিনিময়ে এক আকাঙিক্ষত আনন্দময় অভিজ্ঞতা তার করতলগত করে দেবতার মতন হাসবে। একদিন, শচী জানে না—কবে, কী ভাবে, তবে শচী আজ স্থির নিশ্চয়, অচিন্ত্য তার জীবনের আবেগে এবং ধ্রুব বিশ্বাসে তার মনোমত কীর্তি অর্জন করবে।

শচী কিছু করবে না। গাছের ছায়ার মতন সে বেঁচে থাকবে। নিয়তি নির্দিষ্ট সীমায় পরজীবী আলোয় কখনও হ্রস্ব কখনও বর্ধিত আকারে তাকে আমৃত্যু বেঁচে থাকতে হবে।

স্বামীর মুদিত নিদ্রিত চক্ষের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল শচী । তাকিয়ে থাকতে থাকতে আজ এই প্রথম স্বামীর হয়ে কামনা করল, একদিন এই অরণ্যের ধূর্ত শঙ্কিত পলাতক একটি ব্যাঘ্ৰকে সে যেন হত্যা করতে পারে।

অচিন্ত্য পাশ ফিরল । শচী পা টেনে নিল। শাড়ি টেনে পায়ের আলতা ঢেকে দিল ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *