বাঘ ও বিজয়মেসো
ইলা পালচৌধুরী ছিলেন রাজ্যসভার সদস্যা। তাঁর বাবা বিজয়চন্দ্র বসু ছিলেন আলিপুরের চিড়িয়াখানার অধ্যক্ষ। চিড়িয়াখানার বড় ফটক দিয়ে একটু দূরে এগোলেই বাঁ হাতে তাঁর সুন্দর কোয়ার্টার চোখে পড়ত। শৈশবে আমি সেই বাড়িতে কত সকাল বিকেল বড় আনন্দে কাটিয়েছি।
বিজয় বসুর শ্যালা ছিলেন আমার বড় মেসোমশাই। তবে শুধু সেই সুবাদেই ওঁদের সঙ্গে আত্মীয়তা নয়। সেকালের ব্রাহ্ম পরিবারগুলোকে তাঁদের হিন্দু আত্মীয়স্বজনরা খানিকটা অপ্রীতির চোখে দেখতেন বলে ব্রাহ্মদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাটা ছিল বেশি। বিজয় বসুর স্ত্রীকে আমরা ইন্দুমাসিমা বলতাম। আমার জ্যাঠামশাই উপেন্দ্রকিশোরের বাড়িতে আমার জন্মের আগে থেকেই তাঁদের যাওয়া-আসা ছিল। যতদূর জানি ইন্দুমাসিমা বিয়ের আগে ব্রাহ্মবালিকা শিক্ষালয়ে পড়াতেন। আমার মা তখন ওখানকার ছাত্রী ছিলেন।
সে যাই হোক, আমাদের কাছে বড়-মাসিতে আর ইন্দু-মাসিতে বিশেষ তফাত ছিল না। বরং আমাদের কাছে ইন্দুমাসির বাড়িটাই বেশি আকর্ষণীয় ছিল। ঘাস-জমির পাশে, ফুলবাগানের কিনারায় আঁকাবাঁকা পুকুর, তাতে কালো রাজহাঁস চরত। একবার দেখেছিলাম জলের মধ্যে ঘন সবুজ ঘাসের চাপড়া; তার মধ্যিখানে কালো রাজহাঁস ডিম পেড়ে, ন্যাড়া ন্যাড়া বাচ্চা পালছে।
অনেক সময় চিড়িয়াখানায় জন্মানো ছোট ছোট জানোয়ারদের আর রুগ্ণ পাখিদের, কিছুদিন নিজের বাড়িতে রেখে, বিজয়মেসো তাদের দেখাশুনো করে সুস্থ করে তুলতেন। একবার একটা সুন্দর ঝাঁকড়াচুল বদমেজাজি কুকুর আমাকে কামড়ে দিয়েছিল। আরেকবার একজোড়া নীল লোমওয়ালা পার্শিয়ান বেড়ালের গায়ে হাত বোলাতে গেলে, তারা আমার ছোট ভাইয়ের হাতে চার ইঞ্চি লম্বা আঁচড় দিয়েছিল। সেখানে আয়োডিন দিতে হয়েছিল। বিজয়মেসো বলেছিলেন অচেনা লোক দেখলে রুগ্ণ জানোয়াররা ভয় পায়।
বিজয়মেসোর বাড়ির কাছেই বাঘের ঘর। সেখান থেকে নানারকম অদ্ভুত আওয়াজ আসত।
কিন্তু বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু ছিলেন বিজয়মেসো নিজে। মাঝারি লম্বা, শক্ত কর্মঠ চেহারা, চোখ দেখে মনে হত সর্বদা হাসি পাচ্ছে। বাড়িসুদ্ধ সবাই গানবাজনাপাগল, বাদে উনি। তবে স্নানের ঘরের দরজা বন্ধ করে মাঝে মাঝে তাঁকেও গুনগুন করতে শোনা যেত, ‘সা-গা! গা-ধার পা! না মানুষের পা!’ কৈশোরে যত জায়গায় গিয়েছি, বিজয়মেসোর বাড়ির কাছে কোনওটা দাঁড়াতে পারত না। এমনকী তাঁদের শোবার ঘরে গিয়ে দেখেছি বিশাল এক মশারির নীচে মস্ত এক বিজ্লি পাখা ঘুরছে!
ইন্দুমাসির বাড়ির হলঘরের দেওয়ালে একটা বড় হুকে সর্বদা একটা গুলিভরা বন্দুক ঝুলত। চারদিকে নানারকম হিংস্র জানোয়ারের বাস। হঠাৎ কী বিপদ ঘটে বলা তো যায় না। তবে কেউ নাকি কখনও ওই বন্দুকটাকে ব্যবহার হতে দেখেনি।
একদিন রাতের খাওয়া সেরে বিজয়মেসো সবে উঠেছেন, এমন সময় একজন চৌকিদার হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে বলল, ‘সাহাব! শের ভাগা!’ বিজয়মেসো আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘সে কী রে! কোন শের ভাগা?’ সে বলল যে নতুন বাঘটা বোল্টন সাহেব উপহার পাঠিয়েছেন, সেই বাঘ কাঠের ক্রেট ভেঙে পালিয়েছে।
বিজয়মেসো বললেন, ‘তাঁর খাঁচা তো তৈরি ছিল। সেখানে পোরা হয়নি কেন?’ চৌকিদার বলল, ‘নাথুলালের জ্বর হয়েছে, সে কাজে আসেনি। বাকিরা অত বড় বাঘ ঘাঁটতে ভয় পাচ্ছে।’
বিজয়মেসো আঁচিয়ে এসে, দেওয়াল থেকে বন্দুকটা পেড়ে নিয়ে বললেন, ‘চল তা হলে।’ চৌকিদারের মুখ সাদা, ‘সাহাব!’ বিজয়মেসো বললেন, ‘কেন, তোর কাছে খাঁচার চাবি নেই?’ ‘জি, হাঁ।’ ‘তবে আবার কী? আমার সঙ্গে সঙ্গে চল!’ একটু তফাত রেখে চৌকিদার পেছন পেছন চলল।
গেট দিয়ে বেরোতেই, সামনের অন্ধকার ঝোপঝাপগুলো একটু নড়ে উঠল আর একটা বিরাট বাঘ বেরিয়ে এসে, বিজয়মেশোর দুই কাঁধে দুই থাবা রেখে, দু’পায়ে উঠে দাঁড়াল। ওঁর গলার কাছে বাঘের মুখ।
বিজয়মেসো প্রমাদ গনলেন। এমন সময় শুনতে পেলেন বাঘের গলা থেকে খুশি-হওয়া বেড়ালছানার মতো খ-র-র খ-র-র শব্দ বেরোচ্ছে!
আর বলে দিতে হল না। এক নিমেষে সমস্ত ব্যাপারটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। বাঘের মাথায় হাত বুলিয়ে, নরম গলায় বিজয়মেসো বললেন, ‘আরে বাচ্চু! বাচ্চু! তুই ফিরে এসেছিস্!’
বাঘটাও কী করবে ভেবে না পেয়ে ওঁর বুকে মাথা ঘষতে লাগল। বিজয়মেসো পকেট থেকে ওঁর বড় রুমালটা বের করে নিচু হতেই, বাঘও চার পা মাটিতে নামিয়ে ওঁর পায়ে মুখ ঘষতে লাগল। বিজয়মেসো ওর গলায় রুমাল বেঁধে, চৌকিদারকে বললেন, ‘তুই আগে আগে গিয়ে দু’নম্বর খাঁচার দরজা খোল। ওটাই তৈরি আছে।’
চৌকিদার এতক্ষণ হাঁ করে ভাবছিল এ কী ভেলকি দেখছে, না কি? এখন সে আর একমুহূর্তও অপেক্ষা করল না। চাবি নিয়ে দৌড়ল। বিজয়মেসোও বাঘের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খাঁচার মধ্যে ঢুকলেন। তারপর বাঘের মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুই এখন ঘুমো বাচ্চু। আমি কাল আবার আসব।’
বেরিয়ে এসে খাঁচার তলায় চাবি ঘুরিয়ে, চৌকিদারকে বললেন, ‘চল্ রে, রামধরিয়া। অনেক রাত হল।’
রামধরিয়ার মুখে কথা নেই। কিছু দূর গিয়ে মুখ ফিরিয়ে বিজয়মেসো বললেন, ‘কী রে, তাজ্জব বনে গেছিস্ বুঝি? আরে মানুষ ভুলে যায়, জানোয়ার কখনও ভোলে না। ওই বাচ্চু এই বাগানেই জন্মেছিল। ওর মা তখনই মারা গিয়েছিল। আমি ঝুড়িতে করে ওকে বাড়িতে এনে, বোতলে করে দুধ খাইয়ে বড় করেছিলাম। এই বাড়িতে ওর শৈশব কেটেছিল। তাই ছাড়া পেয়েই এখানে চলে এসেছিল।
জানিস্ তো এখানকার নিয়ম, বাড়তি জানোয়ার ভাল জায়গা দেখে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এক সাহেব ওকে কিনেছিল মনে আছে। সে বোধহয় বিলেত ফিরে যাবার সময় বোল্টনকে বাঘটা দিয়ে গেছিল। বোল্টনকে আমি চিনি না, তাই হঠাৎ বুঝতে পারিনি।
বাচ্চু কিন্তু আমাদের বাড়ি আর আমাকে ঠিকই চিনেছিল।’